হে বন্ধু, পশ্চাতে ফেলি অন্ধ হিমগিরি অনন্ত বাধ্যক্য তব ফেলুক নিঃশ্বাস; রক্তলিপ্ত যৌবনের অন্তিম পিপাসা নিষ্ঠুর গর্জনে আজ অরণ্য ধোঁয়ায় উঠুক প্রজ্বলি'। সপ্তরথী শোনে নাকো পৃথিবীর শৈশবক্রন্দন, দেখে নাই নির্বাকের অশ্রুহীন জ্বালা। দ্বিধাহীন চণ্ডালের নির্লিপ্ত আদেশে। আদিম কুক্কুর চাহে ধরণীর বস্ত্র কেড়ে নিতে। উল্লাসে লেলিহ জিহ্‌ব লুব্ধ হায়েনারা- তবু কেন কঠিন ইস্পাত জরাগ্রস্ত সভ্যতার হৃদপিণ্ড জর্জর, ক্ষুৎপিপাসা চক্ষু মেলে মরণের উপসর্গ যেন। স্বপ্নলব্ধ উদ্যমের অদৃশ্য জোয়ারে সংঘবদ্ধ বল্মীকের দল।নেমে এসো- হে ফাল্গুনী, বৈশাখের খরতপ্ত তেজে ক্লান্ত দু'বাহু তব লৌহময় হোক বয়ে যাক শোণিতের মন্দাকিনী স্রোত; মুমূর্ষু পৃথিবী উষ্ণ, নিত্য তৃষাতুরা, নির্বাপিত আগ্নেয় পর্বত ফিরে চায় অনর্গল বিলুপ্ত আতপ। আজ কেন সূবর্ণ শৃঙ্খলে বাঁধা তব রিক্ত বজ্রপাণি, তুষারের তলে সুপ্ত অবসন্ন প্রাণ? তুমি শুধু নহ সব্যসাচী, বিস্মৃতির অন্ধকার পারে ধূসর গৈরিক নিত্য প্রান্তহীন বেলাভুমি 'পরে আত্মভোলা, তুমি ধনঞ্জয়।। সহসা আমার গোপন সূর্য হল অস্তগামী এপারে মর্মরধ্বনি শুনি, নিস্পন্দ শবের রাজ্য হতে ক্লান্ত চোখে তাকাল শকুনি।গোদূলি আকাশ ব’লে দিল তোমার মরণ অতি কাছে, তোমার বিশাল পৃথিবীতে এখনো বসন্ত বেঁচে আছে।অদূরে নিবিড় ঝাউবনে যে কালো ঘিরেছে নীরবতা, চোখ তারই দীর্ঘায়িত পথে অস্পষ্ট ভাষায় কয় কথা।আমার দিনান্ত নামে ধীরে আমি তো সুদূর পরাহত, অশত্থশাখায় কালো পাখি দুশ্চিন্তা ছড়ায় অবিরত।সন্ধ্যাবেলা, আজ সন্ধ্যাবেলা নিষ্ঠুর তমিস্রা ঘনাল কী! মরণ পশ্চাতে বুঝি ছিল সহসা উদার চোখাচোখি।।   (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ) সিঁড়ি আমরা সিঁড়ি, তোমরা আমাদের মাড়িয়ে প্রতিদিন অনেক উঁচুতে উঠে যাও, তারপর ফিরেও তাকাও না পিছনের দিকে; তোমাদের পদধূলিধন্য আমাদের বুক পদাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় প্রতিদিন।তোমরাও তা জানো, তাই কার্পেটে মুড়ে রাখতে চাও আমাদের বুকের ক্ষত ঢেকে রাখতে চাও তোমাদের অত্যাচারের চিহ্নকে আর চেপে রাখতে চাও পৃথিবীর কাছে তোমাদের গর্বোদ্ধত, অত্যাচারী পদধ্বনি।তবুও আমরা জানি, চিরকাল আর পৃথিবীর কাছে চাপা থাকবে না। আমাদের দেহে তোমাদের এই পদাঘাত। আর সম্রাট হুমায়ুনের মতো একদিন তোমাদেরও হতে পারে পদস্খলন।। সিগারেট আমরা সিগারেট। তোমরা আমাদের বাঁচতে দাও না কেন? আমাদের কেন নিঃশেষ করো পুড়িয়ে? কেন এত স্বল্প-স্থায়ী আমাদের আয়ু? মানবতার কোন্ দোহাই তোমরা পাড়বে? আমাদের দাম বড় কম এই পৃথিবীতে। তাই কি তোমরা আমাদের শোষণ করো? বিলাসের সামগ্রী হিসাবে ফেলো পুড়িয়ে? তোমাদের শোষণের টানে আমরা ছাই হই: তোমরা নিবিড় হও আরামের উত্তাপে।তোমাদের আরামঃ আমাদের মৃত্যু। এমনি ক'রে চলবে আর কত কাল? আর কতকাল আমরা এমনি নিঃশব্দে ডাকব আয়ু-হরণকারী তিল তিল অপঘাতকে?দিন আর রাত্রি - রাত্রি আর দিন; তোমরা আমাদের শোষণ করছ সর্বক্ষণ আমাদের বিশ্রাম নেই, মজুরি নেই নেই কোনো অল্প-মাত্রার ছুটি।তাই, আর নয়; আর আমরা বন্দী থাকব না কৌটোয় আর প্যাকেটে; আঙুলে আর পকেটে সোনা-বাঁধানো 'কেসে' আমাদের নিঃশ্বাস হবে না রুদ্ধ। আমরা বেরিয়ে পড়ব, সবাই একজোটে, একত্রে- তারপর তোমাদের অসতর্ক মুহূর্তে জ্বলন্ত আমরা ছিট্‌কে পড়ব তোমাদের হাত থেকে বিছানায় অথবা কাপড়ে; নিঃশব্দে হঠাৎ জ্বলে উঠে বাড়িসুদ্ধ পুড়িয়ে মারব তোমাদের যেমন করে তোমরা আমাদের পুড়িয়ে মেরেছ এতকাল।কাব্যগ্রন্থঃ- ছাড়পত্র সিপাহী বিদ্রোহ হঠাৎ দেশে উঠল আওয়াজ- “হো-হো, হো-হো, হো-হো” চমকে সবাই তাকিয়ে দেখে- সিপাহী বিদ্রোহ! আগুন হয়ে সারাটা দেশ ফেটে পড়ল রাগে, ছেলে বুড়ো জেগে উঠল নব্বই সন আগেঃ একশো বছর গোলামিতে সবাই তখন ক্ষিপ্ত, বিদেশীদের রক্ত পেলে তবেই হবে তৃপ্ত! নানাসাহেব, তাঁতিয়াটোপি, ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী- সবার হাতে অস্ত্র, নাচে বনের পশু-পক্ষী। কেবল ধনী, জমিদার, আর আগের রাজার ভক্ত যোগ দিল, তা নয়কো, দিল গরীবেরাও রক্ত! সবাই জীবন তুচ্ছ করে, মুসলমান ও হিন্দু, সবাই দিতে রাজি তাদের প্রতি রক্তবিন্দু; ইতিহাসের পাতায় তোমরা পড় কেবল মিথ্যে, বিদেশীরা ভুল বোঝাতে চায় তোমাদের চিত্তে। অত্যাচারী নয়কো তারা, অত্যাচারীর মুণ্ডু চেয়েছিল ফেলতে ছিঁড়ে জ্বালিয়ে অগ্নিকুণ্ডু। নানা জাতের নানান সেপাই গরীব এবং মূর্খঃ সবাই তারা বুঝেছিল অধীনতার দুঃখ; তাইতো তারা স্বাধীনতার প্রথম লড়াই লড়তে এগিয়েছিল, এগিয়েছিল মরণ বরণ করতে!আজকে যখন স্বাধীন হবার শেষ লড়াইয়ের ডঙ্কা উঠেছে বেজে, কোনোদিকেই নেইকো কোনো শঙ্কা; জব্বলপুরে সেপাইদেরও উঠছে বেজে বাদ্য নতুন ক’রে বিদ্রোহ আজ, কেউ নয়কো বাধ্য, তখন এঁদের স্মরণ করো, স্মরণ করো নিত্য- এঁদের নামে, এঁদের পণে শানিয়ে তোলো চিত্ত। নানাসাহেব, তাঁতিয়াটোপি, ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী, এঁদের নামে, দৃপ্ত কিশোর, খুলবে তোমার চোখ কি?   (মিঠে কড়া কাব্যগ্রন্থ) সুচিকিৎসা বদ্যিনাথের সর্দি হল কলকাতাতে গিয়ে, আচ্ছা ক’রে জোলাপ নিল নস্যি নাকে দিয়ে। ডাক্তার এসে, বল্ল কেশে, “বড়ই কঠিন ব্যামো, এ সব কি সুচিকিৎসা ? —আরে আরে রামঃ। আমার হাতে পড়লে পড়ে ‘এক্‌সরে’ করে দেখি, রোগটা কেমন, কঠিন কিনা–আসল কিংবা মেকি। থার্মোমিটার মুখে রেখে সাবধানেতে থাকুক, আইস–ব্যাগটা মাথায় দিয়ে একটা দিন তো রাখুক। ‘ইনজেক্‌শন’ নিতে হবে ‘অক্সিজেন’টা পরে তারপরেতে দেখব এ রোগ থাকে কেমন ক’রে।” পল্লীগ্রামের বদ্যিনাথ অবাক হল ভারী, সর্দি হলেই এমনতর? ধন্য ডাক্তারী!!‘ভবিষ্যতে’ ও ‘সুচিকিৎসা’ — এই ছড়াদুটি ভূপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের লেখা ‘সুকান্ত-প্রসঙ্গ’, ‘শারদীয়া বসুমতী’, ১৩৫৪-থেকে সংগৃহীত। পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় নি। এগুলি ১৯৪০-এর আগের লেখা বলে অনুমিত। সুতরাং এত দিন ছিল বাঁধা সড়ক, আজ চোখে দেখি শুধু নরক!            এত আঘাত কি সইবে,                      যদি না বাঁচি দৈবে?                                  চারি পাশে লেগে গেছে মড়ক!বহুদিনকার উপার্জন, আজ দিতে হবে বিসর্জন।             নিষ্ফল যদি পন্থা;                        সুতরাং ছেঁড়া কন্থা                                  মনে হয় শ্রেয় বর্জন।।(পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ) সুহৃদবরেষু কাব্যকে জানিতে হয়, দৃষ্টিদোষে নতুবা পতিত শব্দের ঝঙ্কার শুধু যাহা ক্ষীণ জ্ঞানের অতীত। রাতকানা দেখে শুধু দিবসের আলোক প্রকাশ, তার কাছে অর্থহীন রাত্রিকার গভীর আকাশ। মানুষ কাব্যের স্রষ্টা, কাব্য কবি করে না সৃজন, কাব্যের নতুন জন্ম, যেই পথ যখনই বিজন। প্রগতির কথা শুনে হাসি মোর করুণ পর্যায় নেমে এল (স্বেচ্ছাচার বুঝি বা গর্জায়)। যখন নতুন ধারা এনে দেয় দুরন্ত প্লাবন স্বেচ্ছাচার মনে করে নেমে আসে তখনি শ্রাবণ; কাব্যের প্রগতি–রথ? (কারে কহে বুঝিতে অক্ষম, অশ্বগুলি ইচ্ছামত চরে খায়, খুঁজিতে মোক্ষম!) সুজীর্ণ প্রগতি–রথ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উইয়ের জ্বালায় সারথি–বাহন ফেলি ইতস্তত বিপথে পালায়। নতুন রথের পথে মৃতপ্রায় প্রবীণ ঘোটক, মাথা নেড়ে বুঝে, ইহা অ–রাজযোটক॥এই কবিতাটি অরুণাচলকে সুকান্ত পত্রাকারে লিখেছিলেন। রচনার তারিখ ১৩ই কার্তিক ১৩৪৮। সূচনা ভারতবর্ষে পাথরের গুরুভারঃ এহেন অবস্থাকেই পাষাণ বলো, প্রস্তরীভুত দেশের নীরবতার একফোঁটা নেই অশ্রুও সম্বলও। অহল্যা হল এই দেশ কোন্ পাপে ক্ষুদার কান্না কঠিন পাথরে ঢাকা, কোনো সাড়া নেই আগুনের উত্তাপে এ নৈঃশব্দ্য বেঙেছে কালের চাকা। ভারতবর্ষ! কার প্রতীক্ষা করো, কান পেতে কার শুনছ পদধ্বনি? বিদ্রোহে হবে পাথরেরা থরোথরো, কবে দেখা দেবে লক্ষ প্রাণের খনি?ভারতী, তোমার অহল্যারূপ চিনি রামের প্রতীক্ষাতেই কাটাও কাল, যদি তুমি পায়ে বাজাও ও-কিঙ্কিনী, তবে জানি বেঁচে উঠবেই কঙ্কাল।কত বসন্ত গিয়েছে অহল্যা গো- জীবনে ব্যর্থ তুমি তবু বার বার, দ্বারে বসন্ত, একবার শুধু জাগো দুহাতে সরাও পাষাণের গুরুভার।অহল্যা-দেশ, তোমার মুখের ভাষা অনুচ্চারিত, তবু অধৈর্যে ভরা; পাষাণ ছদ্মবেশকে ছেঁড়ার আশা ক্রমশ তোমার হৃদয় পাগল করা।ভারতবর্ষ, তন্দ্রা ক্রমশ ক্ষয় অহল্যা! আজ শাপমোচনের দিন; তুষার-জনতা বুঝি জাগ্রত হয়- গা-ঝাড়া দেবার প্রস্তাব দ্বিধাহীন।অহল্যা, আজ কাঁপে কী পাসাণকায়! রোমাঞ্চ লাগে পাথরের প্রত্যঙ্গে; রামের পদস্পর্শ কি লাগে গায়? অহল্যা, জেনো আমরা তোমার সঙ্গে।।(কাব্যগ্রন্থঃ ঘুমনেই) সেপ্টেম্বর ৪৬ কলকাতায় শান্তি নেই। রক্তের কলঙ্ক ডাকে মধ্যরাত্রে প্রতিটি সন্ধ্যায়। হৃৎস্পন্দনধ্বনি দ্রুত হয়ঃ মূর্ছিত শহর। এখন গ্রামের মতো সন্ধ্যা হলে জনহীন নগরের পথ; স্তম্ভিত আলোকস্তম্ভ আলো দেয় নিতান্ত সভয়ে। কোথায় দোকানপাট? কই সেই জনতার স্রোত? সন্ধ্যার আলোর বন্যা আজ আর তোলে নাকো জনতরণীর পাল শহরের পথে। ট্রাম নেই, বাস নেই- সাহসী পথিকহীন এ শহর আতঙ্ক ছড়ায়। সারি সারি বাড়ি সব মনে হয় কবরের মতো, মৃত মানুষের স্তূপ বুকে নিয়ে পড়ে আছে চুপ ক'রে সভয়ে নির্জনে। মাঝে মাঝে শব্দ হয়ঃ মিলিটারী লরীর গর্জন পথ বেয়ে ছুটে যায় বিদ্যুতের মতো সদম্ভ আক্রোশে। কলঙ্কিত কালো কালো রক্তের মতন অন্ধকার হানা দেয় অতন্দ্র শহরে; হয়তো অনেক রাত্রে পথচারী কুকুরের দল মানুষের দেখাদেখি স্বজাতিকে দেখে আস্ফালন, আক্রমণ করে। রুদ্ধশ্বাস এ শহর ছট্ফট করে সারা রাত- কখন সকাল হবে? জীয়নকাঠির স্পর্শ পাওয়া যাবে উজ্জ্বল রোদ্দুরে? সন্ধ্যা থেকে প্রত্যুষের দীর্ঘকাল প্রহরে প্রহরে সশব্দে জিজ্ঞাসা করে ঘড়ির ঘণ্টায় ধৈর্যহীন শহরের প্রাণঃ এর চেয়ে ছুরি কি নিষ্ঠুর? বাদুড়ের মতো কালো অন্ধকার ভর ক'রে গুজবের ডানা উৎকর্ণ কানের কাছে সারা রাত ঘুরপাক খায়। স্তব্ধতা কাঁপিয়ে দিয়ে কখনো বা গৃহস্থের দ্বারে উদ্ধত, অটল আর সুগম্ভীর শব্দ ওঠে কঠিন বুটের।শহর মূর্ছিত হয়ে পড়ে।জুলাই! জুলাই! আবার আসুক ফিরে আজকের কলকাতার এ প্রার্থনা; দিকে দিকে শুধু মিছিলের কোলাহল- এখনো পায়ের শব্দ যাচ্ছে শোনা।অক্টোবরকে জুলাই হতেই হবে আবার সবাই দাঁড়াব সবার পাশে, আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর মাস এবারের মতো মুছে যাক ইতিহাস।। স্বতঃসিদ্ধ মৃত্যুর মৃত্তিকা ‘পরে ভিত্তি প্রতিকূল – সেখানে নিয়ত রাত্রি ঘনায় বিপুল; সহসা চৈত্রের হাওয়া ছড়ায় বিদায়ঃ স্তিমিত সূর্যের চোখে অন্ধকার ছায়। বিরহ-বন্যার বেগে প্রভাতের মেঘ রাত্রির সীমায় এসে জানায় আবেগ, ধূসর প্রপঞ্চ-বিশ্ব উন্মুক্ত আকাশে অনেক বিপন্ন স্মৃতি বয়ে নিয়ে আসে। তবু তো প্রাণের মর্মে প্রচ্ছন্ন জিজ্ঞাসা অজস্র ফুলের রাজ্যে বাঁধে লঘু বাসা; রাত্রির বিবর্ণ স্মৃতি প্রভাতের বুকে ছড়ায় মলিন হাসি নিরর্থ-কৌতুকে।।   (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ) স্বপ্নপথ আজ রাত্রে ভেঙে গেল ঘুম, চারিদিক নিস্তব্ধ নিঃঝুম, তন্দ্রাঘোরে দেখিলাম চেয়ে অবিরাম স্বপ্নপথ বেয়ে চলিয়াছে দুরাশার স্রোত, বুকে তার বহু ভগ্ন পোত। বিফল জীবন যাহাদের, তারাই টানিছে তার জের; অবিশ্রান্ত পৃথিবীর পথে, জলে স্থলে আকাশে পর্বতে। একদিন পথে যেতে যেতে উষ্ণ বক্ষ উঠেছিল মেতে যাহাদের, তারাই সংঘাতে মৃত্যুমুখী, ব্যর্থ রক্তপাতে।।   (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ) স্মারক আজ রাতে যদি শ্রাবণের মেঘ হঠাৎ ফিরিয়া যায় তবুও পড়িবে মনে, চঞ্চল হাওয়া যদি ফেরে হৃদয়ের আঙ্গিনায় রজনীগন্ধা বনে, তবুও পড়িবে মনে। বলাকার পাখা আজও যদি উড়ে সুদূর দিগঞ্চলে বন্যার মহাবেগে, তবুও আমার স্তব্ধ বুকের ক্রন্দন যাবে মেলে মুক্তির ঢেউ লেগে, মুক্তির মহাবেগে। বাসরঘরের প্রভাতের মতো স্বপ্ন মিলায় যদি বিনিদ্র কলরবে তবুও পথের শেষ সীমাটুকু চিরকাল নিরবধি পার হয়ে যেতে হবে, বিনিদ্র কলরবে। মদিরাপাত্র শুষ্ক যখন উৎসবহীন রাতে বিষণ্ণ অবসাদে বুঝি বা তখন সুপ্তির তৃষা ক্ষুব্ধ নয়নপাতে অস্থির হয়ে কাঁদে, বিষণ্ণ অবসাদে। নির্জন পথে হঠাৎ হাওয়ার আসক্তহীন মায়া ধূলিরে উড়ায় দূরে, আমার বিবাগী মনের কোণেতে কিসের গোপন ছায়া নিঃশ্বাস ফেলে সুরে; ধূলিরে উড়ায় দূরে। কাহার চকিত-চাহনি-অধীর পিছনের পানে চেয়ে কাঁদিয়া কাটায় রাতি, আলেয়ার বুকে জ্যোৎস্নার ছবি সহসা দেখিতে পেয়ে জ্বালে নাই তার বাতি, কাঁদিয়া কাটায় রাতি। বিরহিণী তারা আঁধারের বুকে সূর্যেরে কভু হায় দেখেনিকো কোনো ক্ষণে। আজ রাতে যদি শ্রাবণের মেঘ হঠাৎ ফিরিয়া যায় হয়তো পড়িবে মনে, রজনীগন্ধা বনে।।   (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ) হদিশ আমি সৈনিক, হাঁটি যুগ থেকে যুগান্তরে প্রভাতী আলোয়, অনেক ক্লান্ত দিনের পরে,           অজ্ঞাত এক প্রাণের ঝড়ে।বহু শতাব্দী দরে লাঞ্ছিত, পাই নি ছাড়া বহু বিদ্রোহ দিয়েছে মনের প্রান্ত নাড়া           তবু হতবাক দিই নি সাড়া।আমি সৈনিক, দাসত্ব কাঁদে যুদ্ধে যেতে দেখেছি প্রাণের উচ্ছ্বাস দূরে ধানের ক্ষেতে           তবু কেন যেন উঠি নি মেতে।কত সান্ত্বনা খুঁজেছি আকাশে গভীর নীলে শুধু শূন্যতা এনেছে বিষাদ এই নিখিলে           মূঢ় আতঙ্ক জন-মিছিলে।ক্ষতবিক্ষত চলেছি হাজার, তবুও একা সামনে বিরাট শত্রু পাহাড় আকাশ ঠেকা           কোন সূর্যের পাই নি দেখা।অনেক রক্ত দিয়েছি বিমূঢ় বিনা কারণে বিরোধী স্বার্থ করেছি পুষ্ট অযথা রণে;           সঙ্গিবিহীন প্রাণধারণে।ভীরু সৈনিক করেছি দলিত কত বিক্ষোভ ইন্ধন চেয়ে যখনি জ্বলেছে কুবেরীর লোভ           দিয়েছি তখনি জন-খাণ্ডব!একদা যুদ্ধ শুরু হল সারা বিশ্ব জুড়ে, জগতের যত লুণ্ঠনকারী আর মজুরে,           চঞ্চল দিন ঘোড়ার খুরে।উঠি উদ্ধত প্রাণের শিখরে, চারিদিকে চাই এল আহ্বান জন-পুঞ্জের শুনি রোশনাই           দেখি ক্রমাগত কাছে উৎরাই।হাতছানি দিয়ে গেল শস্যের উন্নত শীষ,           জনযাত্রায় নতুন হদিশ – সহসা প্রণের সবুজে সোনার দৃঢ় উষ্ণীষ।।   (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ) হে পৃথিবী হে পৃথিবী, আজিকে বিদায় এ দুর্ভাগা চায়, যদি কভু শুধু ভুল ক’রে মনে রাখো মোরে, বিলুপ্ত সার্থক মনে হবে দুর্ভাগার!             বিস্মৃত শৈশবে যে আঁদার ছিল চারিভিতে তারে কি নিভৃতে আবার আপন ক’রে পাব, ব্যর্থতার চিহ্ন এঁকে যাব, স্মৃতির মর্মরে? প্রভাতপাখির কলস্বরে যে লগ্নে করেছি অভিযান, আজ তার তিক্ত অবসান। তবু তো পথের পাশে পাশে প্রতি ঘাসে ঘাসে। লেগেছে বিস্ময়! সেই মোর জয়।।   (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ) হে মহাজীবন হে মহাজীবন, আর এ কাব্য নয় এবার কঠিন, কঠোর গদ্যে আনো, পদ-লালিত্য-ঝঙ্কার মুছে যাক গদ্যের কড়া হাতুড়িকে আজ হানো! প্রয়োজন নেই, কবিতার স্নিগ্ধতা- কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী-গদ্যময়ঃ পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝল্‌সানো রুটি।। ভুটিয়া যুবতি চলে পথ; আকাশ কালিমামাখা কুয়াশায় দিক ঢাকা। চারিধারে কেবলই পর্বত; যুবতী একেলা চলে পথ। এদিক-ওদিক চায় গুনগুনি গান গায়, কভু বা চমকি চায় ফিরে; গতিতে ঝরে আনন্দ উথলে নৃত্যের ছন্দ আঁকাবাঁকা গিরিপথ ঘিরে। ভুটিয়া যুবতি চলে পথ।টসটসে রসে ভরপুর-- আপেলের মত মুখ আপেলের মত বুক পরিপূর্ণ প্রবল প্রচুর; যৌবনের রসে ভরপুর। মেঘ ডাকে কড়-কড় বুঝিবা আসিবে ঝড়, একটু নাহিকো ডর তাতে; উঘারি বুকের বাস, পুরায় বিচিত্র আশ উরস পরশি নিজ হাতে!অজানা ব্যাথায় সুমধুর-- সেথা বুঝি করে গুরুগুরু! যুবতি একেলা পথ চলে; পাশের পলাশ-বনে কেন চায় অকারণে? আবেশে চরণ দুটি টলে-- পায়ে-পায়ে বাধিয়া উপলে! আপনার মনে যায় আপনার মনে গায়, তবু কেন আনপানে টান? করিতে রসের সৃষ্টি চাই কি দশের দৃষ্টি? --স্বরূপ জানেন ভগবান!সহজে নাচিয়া যেবা চলে একাকিনী ঘন বনতলে-- জানি নাকো তারো কী ব্যাথায় আঁখিজলে কাজল ভিজায়! স্বপ্ন দেশ আজ ফাল্গুনী চাঁদের জ্যোছনা জুয়ারে ভুবন ভাসিয়া যায় ওরে স্বপন দেশের পরী বিহঙ্গী পাখা মেলে উড়ে যায়। এই শ্যামল কোমল ঘাসে এই বিকচ পুন্দরাসে এই বন-মল্লিকা বাসে এই ফুরফুরে মলয়ায়। দেখ ঘাসের ডাঁটায় ফড়িং ঘুমায়  সবুজ স্বপন সুখে দেখ পদ্মকোরকে অচেতন অলি শেষ মধুকণা মুখে হেথা ঝিঁঝির ঝি ঝিট তান দেখ নিশি শেষে অবসান ছোট টুনটুনিদের গান এবে বিরত ক্লান্ত বুকে দেখ্ মোহ মুর্ছিত মধুর ধরণী  সব ধ্বনি গেছে চুকে । তোরে শিরীষ ফুলের পাপগি খসায়ে পরাগ করিব দান তোরে রজনীগন্ধা গেলাস ভরিয়া অমিয়া করাব পান শেষে ঘুম যদি তোর পায়,, গাহি মৃদু গুঞ্ন গান চারু ঊর্ণনাভের ঝিকিমিকি জালে কেশরের উপাধান। শেষে জোনাকির আলো নিভাবে যখন ঊষার কুয়শাসারে মোরা স্বপন শয়ন ভাঙ্গি দিব তোর পাপিয়ার ঝংকারে। যদি ফিরে যেতে মন চায় যাস ঝিরি ঝিরি ঊষা বায় চড়ি প্রজাপতির পাখায় হিম সিক্ত শিশিরধারে সাথে নিয়ে যাস এই রজনীর স্মৃতি ধরণীর পরপারে।। তাইত আমার মেজাজ খ্যাপা মুখটি এমন হাঁড়ি । তাও কি হয় ! ঐ যে মাঠে শালিখ পাখি ডাকে তার কাছে কৈ যাওনিকো ভাই শুধাওনিতো তাকে ! শালিখ পাখি বেজায় ঠ্যাঁটা চেঁচায় মিছিমিছি, হল্লা শুনে হাড় জ্বলে যায় কেবল কিচিমিচি । মিষ্টি সুরে দোয়েল পাখি জুড়িয়ে দিল প্রাণ তার কাছে কৈ বস্‌লে নাতো শুনলে না তার গান । দোয়েল পাখির ঘ্যান্‌ঘ্যানানি আর কি লাগে ভালো ? যেমন রূপে তেমন গুণে তেমনি আবার কালো । রূপ যদি চাও যাও না কেন মাছরাঙার কাছে, অমন খাসা রঙের বাহার আর কি কারো আছে ? মাছরাঙা ? তারেও কি আর পাখির মধ্যে ধরি রকম সকম সঙের মতন, দেমাক দেখে মরি । পায়রা ঘুঘু কোকিল চড়াই চন্দনা টুনটুনি কারে তোমার পছন্দ হয়, সেই কথাটি শুনি ! এই গুলো সব ছ্যাবলা পাখি নেহাৎ ছোট জাত- দেখলে আমি তফাৎ হাটি অমনি পঁচিশ হাত । এতক্ষণে বুঝতে পারি ব্যাপারখানা কি যে- সবার তুমি খুঁৎ পেয়েছ নিখুঁৎ কেবল নিজে ! মনের মতন সঙ্গী তোমার কপালে নাই লেখা তাইতে তোমায় কেউ পোঁছে না তাইতে থাক একা । সৎপাত্র শুনতে পেলাম পোস্তা গিয়ে— তোমার নাকি মেয়ের বিয়ে ? গঙ্গারামকে পাত্র পেলে ? জানতে চাও সে কেমন ছেলে ? মন্দ নয় সে পাত্র ভালো রঙ যদিও বেজায় কালো ; তার উপরে মুখের গঠন অনেকটা ঠিক পেঁচার মতন ; বিদ্যে বুদ্ধি ? বলছি মশাই— ধন্যি ছেলের অধ্যবসায় ! উনিশটিবার ম্যাট্রিকে সে ঘায়েল হয়ে থামল শেষে । বিষয় আশয় ? গরীব বেজায়— কষ্টে–সৃষ্টে দিন চলে যায় ।মানুষ তো নয় ভাইগুলো তার— একটা পাগল একটা গোঁয়ার ; আরেকটি সে তৈরী ছেলে, জাল করে নোট গেছেন জেলে । কনিষ্ঠটি তবলা বাজায় যাত্রাদলে পাঁচ টাকা পায় । গঙ্গারাম তো কেবল ভোগে পিলের জ্বর আর পাণ্ডু রোগে । কিন্তু তারা উচ্চ ঘর, কংসরাজের বংশধর ! শ্যাম লাহিড়ী বনগ্রামের কি যেন হয় গঙ্গারামের ।— যহোক, এবার পাত্র পেলে, এমন কি আর মন্দ ছেলে ? সন্দেশ সন্দেশের গন্ধে বুঝি দৌড়ে এল মাছি? কেন ভন্ ভন্ হাড় জ্বালাতন ছেড়ে দেওনা বাঁচি! নাকের গোড়ায় সুড়সুড়ি দাও শেষটা দিবে ফাঁকি? সুযোগ বুঝে সুড়–ৎ করে হুল ফোটাবে নাকি? সম্পাদকের দশা সম্পাদকীয়- একদা নিশীথে এক সম্পাদক গোবেচারা । পোঁটলা পুঁটলি বাঁধি হইলেন দেশছাড়া ।। অনাহারী সম্পাদকী হাড়ভাঙা খাটুনি সে । জানে তাহা ভুক্তভোগী অপরে বুঝিবে কিসে ? লেখক পাঠক আদি সকলেরে দিয়া ফাঁকি । বেচারী ভাবিল মনে- বিদেশে লুকায়ে থাকি ।। এদিকে ত ক্রমে ক্রমে বৎসরেক হল শেষ । 'নোটিশ' পড়িল কত 'সম্পাদক নিরুদ্দেশ' ।। লেখক পাঠকদল রুষিয়া কহিল তবে । জ্যান্ত হোক মৃত হোক ব্যাটারে ধরিতে হবে ।। বাহির হইল সবে শব্দ করি 'মার মার' । -দৈবের লিখন, হায়, খণ্ডাইতে সাধ্য কার ।। একদা কেমনি জানি সম্পাদক মহাশয় । পড়িলেন ধরা- আহা দুরদৃষ্ট অতিশয় ।। তারপরে কি ঘটিল কি করিল সম্পাদক । সে সকল বিবরণে নাহি তত আবশ্যক ।। মোট কথা হতভাগ্য সম্পাদক অবশেষে । বসিলেন আপনার প্রাচীন গদিতে এসে ।। (অর্থাৎ লেখকদল লাঠৌষধি শাসনেতে । বসায়েছে তারে পুনঃ সম্পাদকী আসনেতে ।।) ঘুচে গেছে বেচারীর ক্ষণিক সে শান্তি সুখ । লেখকের তাড়া খেয়ে সদা তার শুষ্কমুখ ।। দিস্তা দিস্তা পদ্য গদ্য দর্শন সাহিত্য প'ড়ে । পুনরায় বেচারির নিত্যি নিত্যি মাথা ধরে ।। লোলচর্ম অস্থি সার জীর্ণ বেশ রুক্ষ্ণ কেশ । মুহূর্ত সোয়াস্তি নাই- লাঞ্ছনার নাহি শেষ ।। সাধে কি বলে গাধা বললে গাধা মনের দুঃখে অনেকখানি ভেবে- "বয়েস গেল খাটেতে খাটতে, বৃদ্ধ হলাম এবে, কেউ করে না তোয়াজ তবু, সংসারের কি রীতি! ইচ্ছে করে এক্ষুনি দিই কাজে কর্মে ইতি। কোথাকার ঐ নোংরা কুকুর ,আদর যে তার কত - যখন তখন ঘুমোচ্ছে সে লাটসাহেবের মত! ল্যাজ নেড়ে যেই ঘেউ ঘেউ ঘেউ, লাফিয়ে দাঁড়ায় কোলে, মনিব আমার বোক্‌চন্দর্, আহ্লাদে যান গলে। আমিও যদি সেয়ানা হতুম, আরামে চোখ মুদে রোজ মনিবের মন ভোলাতুম অমনি নেচে কুঁদে। ঠ্যাং নাচাতুম , ল্যাজ দোলাতুম, গান শোনাতুম সাধা - এ বুদ্ধিটা হয়নি আমার - সাধে কি বলে গাধা!বুদ্ধি এঁটে বসল গাধা আহ্লাদে ল্যাজ নেড়ে, নাচল কত, গাইল কত, প্রাণের মায়া ছেড়ে। তারপরেতে শেষটা ক্রমে স্ফূর্তি এল প্রাণে চলল গাধা খোদ্ মনিবের ড্রয়িংরুমের পানে। মনিবসাহেব ঝিমুচ্ছিলেন চেয়ারখানি জুড়ে, গাধার গলার শব্দে হঠাৎ তন্দ্রা গেল উড়ে। চম্‌কে উঠে গাধার নাচন যেমনি দেখেন চেয়ে, হাসির চোটে সাহেব বুঝি মরেন বিষম খেয়ে।ভাব্‌লে গাধা - এই তো মনিব জল হয়েছেন হেসে এইবারে যাই আদর নিতে কোলের কাছে ঘেঁষে। এই না ভেবে এক্কেবারে আহ্লাদেতে ক্ষেপে চড়্ল সে তার হাঁটুর উপর দুই পা তুলে চেপে। সাহেব ডাকেন 'ত্রাহি ত্রাহি' গাধাও ডাকে 'ঘ্যাঁকো', (অর্থাৎ কিনা কোলে চড়েছি, এখন আমায় দ্যাখো!)ডাক শুনে সব দৌড়ে এল ব্যস্ত হয়ে ছুটে , দৌড়ে এল চাকর বাকর মিস্ত্রী মজুর মুটে, দৌড়ে এল পাড়ার লোকে ,দৌড়ে এল মালী - কারুর হাতে ডান্ডা লাঠি কারু বা হাত খালী। ব্যাপার দেখে অবাক সবাই ,চক্ষু ছানা বড়া - সাহেব বললে, "উচিত মতন শাসনটি চাই কড়া।" হাঁ হাঁ বলে ভীষণ রকম উঠল সবাই চটে, দে দমাদম্ মারের চোটে গাধার চমক্ ছোটে।ছুটল গাধা প্রাণের ভয়ে গানের তালিম ছেড়ে, ছুটল পিছে একশো লোকে হুড়মুড়িয়ে তেড়ে। তিন পা যেতে দশ ঘা পড়ে, রক্ত ওঠে মুখে - কষ্টে শেষে রক্ষা পেলে কাঁটার ঝোপে ঢুকে। কাঁটার ঘায়ে চামড়া গেল সার হল তার কাঁদা; ব্যাপার শুনে বললে সবাই, "সাধে কি বলে গাধা"। সাবধান আরে আরে, ওকি কর প্যালারাম বিশ্বাস? ফোঁস্ ফোঁস্ অত জোরে ফেলো নাকো নিশ্বাস। জানোনা কি সে বছর ওপাড়ার ভূতোনাথ, নিশ্বাস নিতে গিয়ে হয়েছিল কুপোকাৎ? হাঁপ ছাড় হ্যাঁস্‌ফ্যাঁস্ ও রকম হাঁ করে- মুখে যদি ঢুকে বসে পোকা মাছি মাকড়ে? বিপিনের খুড়ো হয় বুড়ো সেই হল' রায়, মাছি খেয়ে পাঁচ মাস ভুগেছিল কলেরায়। তাই বলি- সাবধান! ক'রোনাকো ধুপ‌্ধাপ্, টিপি টিপি পায় পায় চলে যাও চুপ্ চাপ্। চেয়োনাকো আগে পিছে, যেয়োনাকো ডাইনে সাবধানে বাঁচে লোকে,- এই লেখে আইনে। পড়েছ ত কথা মালা? কে যেন সে কি করে পথে যেতে পড়ে গেল পাতকো'র ভিতরে ? ভালো কথা- আর যেন সকালে কি দুপুরে , নেয়োনাকো কোনো দিন ঘোষেদের পুকুরে, এরকম মোটা দেহে কি যে হবে কোন্ দিন, কথাটাকে ভেবে দেখ কি রকম সঙ্গিন! চটো কেন? হয় নয় কে বা জানে পষ্ট, যদি কিছু হ'য়ে পড়ে পাবে শেষে কষ্ট। মিছিমিছি ঘ্যান্ ঘ্যান্ কেন কর তক্ক? শিখেছ জ্যাঠামো খালি, ইঁচরেতে পক্ক , মানবে না কোন কথা চলা ফেরা আহারে , একদিন টের পাবে ঠেলা কয় কাহারে । রমেশের মেঝ মামা সেও ছিল সেয়না, যত বলি ভালো কথা কানে কিছু নেয়না শেষকালে একদিন চান্নির বাজারে প'ড়ে গেল গাড়ি চাপা রাস্তার মাঝারে! সাহস পুলিশ দেখে ডরাইনে আর, পালাইনে আর ভয়ে, আরশুলা কি ফড়িং এলে থাকতে পারি সয়ে। আধাঁর ঘরে ঢুকতে পারি এই সাহসের গুণে, আর করে না বুক দুর্ দুর্ জুজুর নামটি শুনে। রাত্তিরেতে একলা শুয়ে তাও ত থাকি কত, মেঘ ডাকলে চেঁচাইনেকো আহাম্মুকের মত। মামার বাড়ির কুকুর দুটোর বাঘের মত চোখ, তাদের আমি খাবার খাওয়াই এমনি আমার রোখ্! এম্‌নি আরো নানান দিকে সাহস আমার খেলে সবাই বলে "খুব বাহাদুর" কিংবা "সাবাস ছেলে"। কিন্তু তবু শীতকালেতে সকালবেলায় হেন ঠান্ডা জলে নাইতে হ'লে কান্না আসে কেন? সাহস টাহস সব যে তখন কোনখানে যায় উড়ে- ষাড়ের মতন কন্ঠ ছেড়ে চেঁচাই বিকট সুরে! হনহন পনপন চলে হনহন        ছোটে পনপনঘোরে বনবন        কাজে ঠনঠনবায়ু শনশন        শীতে কনকনকাশি খনখন        ফোঁড়া টনটনমাছি ভনভন        থালা ঝন ঝন।কাব্যগ্রন্থঃ- হ য ব র ল হরিষে বিষাদ দেখছে খোকা পঞ্জিকাতে এই বছরে কখন কবে ছুটির কত খবর লেখে, কিসের ছুটি কঁদিন হবে। ঈদ্ মহরম দোল্ দেওয়ালি বড়দিন আর বর্ষাশেষে- ভাবছে যত, ফুল্লমুখে ফুর্তিভরে ফেলছে হেসে এমন কালে নীল আকাশে হঠাৎ -খ্যাপা মেঘের মত, উথলে ছোটে কান্নাধারা ডুবিয়ে তাহার হর্য যত। 'কি হল তোর?' সবাই বলে, 'কলমটা কি বিঁধল হাতে? জিবে কি তোর দাঁত বসালি? কামড়াল কি ছারপোকাতে?' প্রশ্ন শুনে কান্না চড়ে অশ্র“ ঝরে দ্বিগুন বেগে, 'পঞ্জিকাটি আছড়ে ফেলে বললে কেঁদে আগুন রেগে; ঈদ্ পড়েছে জষ্ঠি মাসে গ্রীষ্মে যখন থাকেই ছুটি, বর্ষাশেষে আর দোল্ ত দেখি রোব্‌বারেতেই পড়ল দুটি। দিনগুলোকে করলে মাটি মিথ্যে পাজি পঞ্জিকাতে- মুখ ধোব না ভাত খাব না ঘুম যাব না আজকে রাতে।' হাত গণনা ও পাড়ার নন্দগোঁসাই, আমাদের নন্দ খুড়ো, স্বভাবেতে সরল সোজা অমায়িক শান্ত বুড়ো৷ ছিল না তাঁর অসুখবিসুখ, ছিল সে যে মনের সুখে, দেখা যেত সদাই তারে হুঁকো হাতে হাস্যমুখে৷ হঠাৎ কি তার খেয়াল হল, চল্‌ল সে তার হাত দেখাতে ফিরে এল শুকনো সরু, ঠকাঠক্‌ কাঁপছে দাঁতে! শুধালে সে কয় না কথা, আকাশেতে রয় সে চেয়ে, মাঝে মাঝে শিউরে ওঠে, পড়ে জল চক্ষু বেয়ে৷ শুনে লোকে দৌড়ে এল, ছুটে এলেন বদ্যিমশাই, সবাই বলে, 'কাঁদছ কেন ? কি হয়েছে নন্দগোঁসাই?'      খুড়ো বলে, 'বলব কি আর, হাতে আমার পষ্ট লেখা আমার ঘাড়ে আছেন শনি, ফাঁড়ায় ভরা আয়ুর রেখা৷ এতদিন যায়নি জানা ফিরছি কত গ্রহের ফেরে— হঠাৎ আমার প্রাণটা গেলে তখন আমায় রাখবে কে রে? ষাটটা বছর পার হয়েছি বাপদাদাদের পুণ্যফলে— ওরা তোদের নন্দ খুড়ো এবার বুঝি পটোল তোলে৷ কবে যে কি ঘটবে বিপদ কিছু হায় যায় না বলা—' এই ব'লে সে উঠল কেঁদে ছেড়ে ভীষণ উচ্চ গলা৷ দেখে এলাম আজ সকালে গিয়ে ওদের পাড়ার মুখো, বুড়ো আছে নেই কো হাসি, হাতে তার নেই কো হুঁকো৷ হাতুড়ে একবার দেখে যাও ডাক্তারি কেরামৎ- কাটা ছেঁড়া ভাঙা চেরা চটপট মেরামৎ কয়েছেন গুরু মোর, "শোন শোন বৎস, কাগজের রোগী কেটে আগে কর মক্স" উৎসাহে কি না হয়? কি না হয় চেষ্টায়? অভ্যাসে চটপট্ হাত পাকে শেষটায়। খেটে খুটে জল হ'ল শরীরের রক্ত- শিখে দেখি বিদ্যেটা নয় কিছু শক্ত। কাটা ছেঁড়া ঠুক্ ঠাক। কত দেখ যন্ত্র, ভেঙে চুরে জুড়ে দেই তারও জানি মন্ত্র চোখ বুজে চটপট বড় বড় মুর্তি, যত কাটি ঘ্যাঁস্ ঘ্যাঁস্ তত বাড়ে ফুর্তি। ঠ্যাং কাটা গলা কাটা কত কাটা হস্ত, শিরিষের আঠা দিয়ে জুড়ে দেয় চোস্ত। এইবারে বলি তাই, রোগী চাই জ্যান্ত- ওরে ভোলা, গোটাছয় রোগী ধরে আন্ত!গেঁটেবাতে ভুগে মরে ও পাড়ার নন্দী, কিছুতেই সারাবে না এই তার ফন্দি- একদিন এনে তারে এইখানে ভুলিয়ে, গেটেঁবাত ঘেঁটে- ঘুঁটে সব দেব ঘুলিয়ে। কার কানে কট্ কট্ কার নাকে সর্দি, এস, এস, ভয় কিসে? আমি আছি বদ্যি। শুয়ে কে রে? ঠ্যাং ভাঙা? ধরে আন্ এখেনে- স্ক্রুপ্ দিয়ে এঁটে দিব কি রকম দেখে নে। গলা ফোলা কাঁদ কেন? দাঁতে বুঝি বেদনা? এস এস ঠুকে দেই আর মিছে কেঁদ না, এই পাশে গোটা দুই, ওই পাশে তিনটে- দাঁতগুলো টেনে দেখি কোথা গেল চিমটে? ছেলে হও, বুড়ো হও, অন্ধ কি পঙ্গু, মোর কাছে ভেদ নাই, কলেরা কি ডেঙ্গু- কালাজ্বর, পালাজ্বর, পুরানো কি টাটকা, হাতুড়ির একঘায়ে একেবারে আট্কা! হারিয়ে পাওয়া ঠাকুরদাদার চশমা কোথা ? ওরে গণ্‌শা, হাবুল, ভোঁতা, দেখ্‌না হেথা, দেখ্‌না হোথা- খোঁজ না নিচে গিয়ে ।কই কই কই? কোথায় গেল ? টেবিল টানো, ডেস্কও ঠেল, ঘরদোর সব উলটে ফেল- খোঁচাও লাঠি দিয়ে ।খুঁজছে মিছে কুঁজোর পিছে, জুতোর ফাঁকে, খাটের নিচে, কেউ বা জোরে পর্দা খিঁচে- বিছনা দেখে ঝেড়ে-লাফিয়ে ঘুরে হাঁফিয়ে ঘেমে ক্লান্ত সবে পড়্‌ল থেমে, ঠাকুরদাদা আপনি নেমে আসেন তেড়েমেড়ে ।বলেন রেগে, "চশমাটা কি ঠাং গজিয়ে ভাগ্‌ল নাকি ? খোঁজার নামে কেবল ফাঁকি- দেখছি আমি এসে !"যেমন বলা দারূণ রোষে, কপাল থেকে অম্নি খ'সে চশমা পড়ে তক্তপোশে- সবাই ওঠে হেসে ! হিংসুটি এক ছিল দুষ্টু মেয়ে— বেজায় হিংসুটে , আর বেজায় ঝগড়াটি। তার নাম বলতে গেলেই তো মুশকিল, কারণ ঐ নামে শান্ত লক্ষ্মী পাঠিকা যদি কেউ থাকেন, তাঁরা তো আমার উপর চটে যাবেন।হিংসুটির দিদি বড় লক্ষ্মী মেয়ে— যেমন কাজে কর্মে, তেমনি লেখাপড়ায়। হিংসুটির বয়েস সাত বছর হ'য়ে গেল, এখনও তার প্রথম ভাগই শেষ হল না— আর তার দিদি তার চাইতে মোটে এক বছরের বড়, সে এখনই "বোধোদয়" আর "ছেলেদের রামায়ণ" পড়ে ফেলেছে, ইংরিজি ফার্স্টবুক তার কবে শেষ হয়ে গেছে। হিংসুটি কিনা সবাইকে হিংসে করে, সে তো দিদিকেও হিংসে করত। দিদি স্কুলে যায়, প্রাইজ পায়— হিংসুটি খালি বকুনি খায় আর শাস্তি পায়।দিদি যেবার ছবির বই প্রাইজ পেলে আর হিংসুটি কিচ্ছু পেলে না, তখন যদি তার অভিমান দেখতে! সে সারাটি দিন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে গাল ফুলিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে ব'সে রইল— কারও সঙ্গে কথাই বলল না। তারপর রাত্রিবেলায় দিদির অমন সুন্দর বইখানাকে কালি ঢেলে, মলাট ছিঁড়ে, কাদায় ফেলে নষ্ট করে দিল। এমন দুষ্টু হিংসুটে মেয়ে।হিংসুটির মামা এসেছেন, তিনি মিঠাই এনে দু'বোনকেই আদর ক'রে খেতে দিয়েছেন। হিংসুটি খানিকক্ষণ তার দিদির খাবারের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভ্যাঁ ক'রে কেঁদে ফেলল। মাম ব্যস্ত হয়ে বললেন, "কি রে, কী হ'ল? জিভে কামড় লাগল নাকি?" হিংসুটির মুখে আর কথা নেই, সে কেবলই কাঁদছে। তখন তার মা এক ধমক দিয়ে বললেন, "কী হয়েছে বল্‌ না!" তখন হিংসুটি কাঁদতে কাঁদতে বলল, "দিদির ঐ রসমুণ্ডিটা তাকে আমারটার চাইতেও বড়।" তাই শুনে দিদি তাড়াতাড়ি নিজের রসমুণ্ডিটা তাকে দিয়ে দিল। অথচ হিংসুটি নিজে যা খাবার পেয়েছিল তার অর্ধেক সে খেতে পারল না— নষ্ট ক'রে ফেলে দিল। দিদির জন্মদিনে দিদির নতুন জামা, নতুন কাপড় আস্‌লে হিংসুটি তাই নিয়ে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তোলে।একদিন হিংসুটি তার মায়ের আলমারি খুলে দেখে কি— লাল জামা গায়ে, লাল জুতা পায়ে, টুক্‌টুকে রাঙা পুতুল বাক্সের মধ্যে শুয়ে আছে। হিংসুটি বলল, "দেখেছ! দিদি কি দুষ্টু! নিশ্চয়ই মামার কাছ থেকে পুতুল আদায় করেছে— আবার আমায় না দেখিয়ে মায়ের কাছে লুকিয়ে রাখা হয়েছে।" তখন তার ভয়ানক রাগ হল। সে ভাবল, "আমি তো ছোট বোন, আমারই তো পুতুল পাওয়া উচিত। দিদি কেন মিছিমিছি পুতুল পানে?" এই ভেবে সে পুতুলটাকে উঠিয়ে নিল।কি সুন্দর পুতুল! কেমন মিট্‌মিটে চোখ, আর ফুট্‌ফুটে মুখ, কেমন কচি কচি হাত পা, আর টুক্‌টুকে জামা কাপড়! যত সব ভালো ভালো জিনিস সব কিনা দিদি পাবে! হিংসুটির চোখ ফেটে জল এল। সে রেগে পুতুলটাকে আছড়িয়ে মাটিতে ফেলে দিল। তাতেও তার রাগ গেল না; সে একটা ডাণ্ডা নিয়ে ধাঁই ধাঁই ক'রে পুতুলটাকে মারতে লাগল। মারতে মারতে তার নাক মুখ হাত পা ভেঙে, তার জামা কাপড় ছিঁড়ে— আবার তাকে বাক্সের মধ্যে ঠেসে সে রাগে গরগর করতে করতে চলে গেল।বিকেলবেলা মামা এসে তাকে ডাকতে লাগলেন আর বললেন, "তোর জন্য কি এনেছি দেখিস্‌নি?" শুনে হিংসুটি দৌড়ে এল, "কই মামা, কী এনেছ দাও না।"মামা বললেন, "মার কাছে দেখ্‌ গিয়ে কেমন সুন্দর পুতুল এনেছি।" হিংসুটি উৎসাহে নাচতে লাগল, মাকে বলল, "কোথায় রেখেছ মা?" মা বললেন, "আলমারিতে আছে।" শুনে ভয়ে হিংসুটির বুকের মধ্যে ধড়াস্‌ ধড়াস্‌ করে উঠল। সে কাঁদ কাঁদ গলায় বলল, "সেটার কি লাল জামা আর লাল জুতো পরান— মাথায় কালো কালো কোঁকড়ানো চুল ছিল?" মা বললেন, "হ্যাঁ, তুই দেখেছিস্‌ নাকি?"হিংসুটির মুখে আর কথা নেই! সে খানিকক্ষণ ফ্যাল্‌ফ্যাল্‌ ক'রে তাকিয়ে তারপর একেবারে ভ্যাঁ ক'রে কেঁদে এক দৌড়ে সেখান থেকে পালিয়ে গেল।এর পরে যদি তার হিংসে আর দুষ্টুমি না কমে, তবে আর কী ক'রে কমবে? হিংসুটিদের গান আমরা ভালো লক্ষী সবাই, তোমরা ভারি বিশ্রী, তোমরা খাবে নিমের পাচন, আমরা খাব মিশ্রী। আমরা পাব খেলনা পুতুল, আমরা পাব চম্‌চম্, তোমরা ত তা পাচ্ছ না কেউ, পেলে ও পাবে কম কম আমরা শোব খাট পালঙে মায়ের কাছে ঘেঁষ্‌টে, তোমরা শোবে অন্ধকারে একলা ভয়ে ভেস্তে। আমরা যাব জাম্‌তাড়াতে চড়ব কেমন ট্রেইনে, চেঁচাও যদি "সঙ্গে নে যাও" বল্‌ব "কলা এইনে"! আমরা ফিরি বুক ফুলিয়ে রঙিন্ জুতোয় মচ্‌মচ্, তোমরা হাঁদা নোংরা ছিছি হ্যাংলা নাকে ফচ্‌ফচ্। আমরা পরি রেশ্‌মি জরি, আমরা পরি গয়না, তোমরা সেসব পাও না ব'লে তাও তোমাদের সয় না। আমরা হব লাট মেজাজী, তোমরা হবে কিপ্টে, চাইবে যদি কিচ্ছু তখন ধরব গলা চিপ্‌টে। হিতে-বিপরীত ওরে ছাগল, বল্‌ত আগে সুড় সুড়িটা কেমন লাগে? কই গেল তোর জারিজুরি লম্ফঝম্ফ বাহাদুরি। নিত্যি যে তুই আসতি তেড়ে শিং নেড়ে আর দাড়ি নেড়ে, ওরে ছাগল করবি রে কি? গুঁতোবি তো আয়না দেখি।হাঁ হাঁ হাঁ, এ কেমন কথা ? এমন ধারা অভদ্রতা! শান্ত যারা ইতরপ্রাণী, তাদের পরে চোখরাঙানি! ঠান্ডা মেজাজ কয় না কিছু, লাগতে গেছে তারই পিছু? শিক্ষা তোদের এম্নিতর ছি-ছি-ছি! লজ্জা বড়।ছাগল ভাবে সামনে একি! একটুখানি গুতিয়ে দেখি। গুতোর চোটে ধড়াধ্বড় হুড়মুড়িয়ে ধুলোয় পড়। তবে রে পাজি লক্ষ্মীছাড়া, আমার পরেই বিদ্যেঝড়া, পাত্রাপাত্র নাই কিরে হুঁশ্ দে দমাদম্ ধুপুস্ ধাপুস্। হুঁকোমুখো হ্যাংলা হুঁকোমুখো হ্যাংলা          বাড়ি তার বাংলা          মুখে তার হাসি নাই দেখেছ? নাই তার মানে কি?      কেউ তাহা জানে কি?          কেউ কভু তার কাছে থেকেছ? শ্যামাদাস মামা তার      আফিঙের থানাদার,          আর তার কেহ নাই এ-ছাড়া - তাই বুঝি একা সে        মুখখানা ফ্যাকাশে,          ব'সে আছে কাঁদ'-কাঁদ' বেচারা? থপ্ থপ্ পায়ে সে         নাচত যে আয়েসে,          গালভরা ছিল তার ফুর্তি, গাইতো সে সারা দিন      'সারে গামা টিমটিম্'          আহ্লাদে গদ-গদ মূর্তি। এই তো সে দুপ'রে        বসে ওই উপরে,          খাচ্ছিল কাঁচকলা চটকে - এর মাঝে হল কি?       মামা তার মোলো কি?          অথবা কি ঠ্যাং গেল মটকে? হুঁকোমুখো হেঁকে কয়,      'আরে দূর, তা তো নয়,          দেখছ না কিরকম চিন্তা? মাছি মারা ফন্দি এ       যত ভাবি মন দিয়ে -          ভেবে ভেবে কেটে যায় দিনটা। বসে যদি ডাইনে,         লেখে মোর আইনে -          এই ল্যাজে মাছি মারি ত্রস্ত; বামে যদি বসে তাও,      নহি আমি পিছপাও,          এই ল্যাজে আছে তার অস্ত্র। যদি দেখি কোনো পাজি      বসে ঠিক মাঝামাঝি          কি যে করি ভেবে নাহি পাই রে - ভেবে দ্যাখ একি দায়       কোন্ ল্যাজে মারি তায়          দুটি বৈ ল্যাজ মোর নাই রে।' হুলোর গান বিদ্‌ঘুটে রাত্তিরে ঘুট্‌ঘুটে ফাঁকা,           গাছপালা মিশ্‌মিশে মখ‌্‌মলে ঢাকা! জট্‌বাঁধা ঝুল কালো বটগাছতলে,           ধক্‌ধক্ জোনাকির চক্‌মকি জ্বলে। চুপচাপ চারিদিকে ঝোপ ঝাড়গুলো,           আয় ভাই গান গাই আয় ভাই হুলো। গীত গাই কানে কানে চীৎকার ক'রে,           কোন্ গানে মন ভেজে শোন্ বলি তোরে। পূবদিকে মাঝরাতে ছোপ্ দিয়ে রাঙা           রাতকানা চাঁদ ওঠে আধখানা ভাঙা। চট্ ক'রে মনে পড়ে মট্‌কার কাছে           মালপোয়া আধখানা কাল থেকে আছে। দুড়্ দুড়্ ছুটে যাই, দূর থেকে দেখি           প্রাণপণে ঠোঁট চাটে কানকাটা নেকী! গালফোলা মুখে তার মালপোয়া ঠাসা,           ধুক ক'রে নিভে গেল বুকভরা আশা। মন বলে আর কেন সংসারে থাকি,           বিল্‌কুল্ সব দেখি ভেল্‌কির ফাঁকি। সব যেন বিচ্ছিরি সব যেন খালি,           গিন্নীর মুখ যেন চিম্‌নির কালি। মন–ভাঙা দুখ্ মোর কন্ঠেতে পুরে           গান গাই আয় ভাই প্রাণফাটা সুরে। সন্তোষের সিংহাসনে বাস করে মন।। আত্মার সহিত সব সমতুল্য গণে। মাতাপিতা জ্ঞাতি ভাই ভেদ নাহি মনে।। সকলে সমান মিত্র শত্রু নাহি যার। মানুষ তারেই বলি মানুষ কে আর?অহংকার-মদে কভু নহে অভিমানী। সর্বদা রসনারাজ্যে বাস করে বাণী।। ভুবন ভূষিত সদা বক্তৃতার বশে। পর্বত সলিল হয় রসনার রসে।। মিথ্যার কাননে কভু ভ্রমে নাহি ভ্রমে। অঙ্গীকার অস্বীকার নাহি কোন ক্রমে।। অমৃত নিঃসৃত হয় প্রতি বাক্যে যার। মানুষ তারেই বলি মানুষ কে আর?চেষ্টা যত্ন অনুরাগ মনের বান্ধব। আলস্য তাদের কাছে রণে পরাভব।। ভক্তিমতে কুশলগণে আয় আয় ডাকে।। পরিশ্রম প্রতিজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গে থাকে। চেষ্টায় সুসিদ্ধ করে জীবনের আশা। যতনে হৃদয়েতে সমুদয় বাসা।। স্মরণ স্মরণ মাত্রে আজ্ঞাকারী যার। মানুষ তারেই বলি মানুষ কে আর? সখি (১)     কি কহিলি কহ, সই, শুনি লো আবার—                       মধুর বচন! সহসা হইনু কালা;            জুড়া এ প্রাণের জ্বালা,      আর কি এ পোড়া প্রাণ পাবে সে রতন? হ্যাদে তোর পায় ধরি, কহ না লো সত্য করি,      আসিবে কি ব্রজে পুনঃ রাধিকারমণ?(২)    কহ, সখি, ফুটিবে কি এ মরুভূমিতে                     কুসুমকানন ? জলহীনা স্রোতস্বতী,          হবে কি লো জলবতী,    পয়ঃ সহ পয়োদে কি বহিবে পবন? হ্যাদে তোর পায় ধরি, কহ না লো সত্য করি,    আসিবে কি ব্রজে পুনঃ রাধিকারঞ্জন?(৩)    হায় লো সয়েছি কত, শ্যামের বিহনে—                     কতই যাতন। যে জন অন্তরযামী          সেই জানে আর আমি,    কত যে কেঁদেছি তার কে করে বর্ণন? হ্যাদে তোর পায় ধরি, কহ না লো সত্য করি,    আসিবে কি ব্রজে পুনঃ রাধিকামোহন।(৪)    কোথা রে গোকুল-ইন্দু,---বৃন্দাবন-সর—                    কুমুদ-বাসন। বিষাদ নিশ্বাস বায়,            ব্রজ, নাথ, উড়ে যায়,     কে রাখিবে, তব রাজ, ব্রজের রাজন! হ্যাদে তোর পায় ধরি, কহ না লো সত্য করি,     আসিবে কি ব্রজে পুনঃ রাধিকাভূষণ!(৫)    শিখিনী ধরি, স্বজনি, গ্রাসে মহাফণী—                     বিষের সদন! বিরহ বিষের তাপে           শিখিনী আপনি কাঁপে,    কুলবালা এ জ্বালায় ধরে কি জীবন! হ্যাদে তোর পায় ধরি, কহ না লো সত্য করি,    আসিবে কি ব্রজে পুনঃ রাধিকারতন!(৬)    এই দেখ্, ফুলমালা গাঁথিয়াছি আমি—                     মধুর বচন। দোলাইব শ্যামগলে,             বাঁধিব বঁধুরে ছলে—    প্ৰেম-ফুল-ডোরে তাঁরে করিব বন্ধন! হ্যাদে তোর পায় ধরি, কহ না লো সত্য করি,    আসিবে কি ব্রজে পুনঃ রাধাবিনোদন।(৭)   কি কহিলি কহ, সই, শুনি লো আবার—                    মধুর বচন। সহসা হইনু কালা,             জুড়া এ প্রাণের জ্বালা    আর কি এ পোড়া প্রাণ পাবে সে রতন! মধু—যার মধুধ্বনি— কহে কেন কাঁদ, ধনি,    ভুলিতে কি পারে তোমা শ্ৰীমধুসূদন? (ব্রজাঙ্গনা কাব্য) সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর সুরপুরে সশরীরে, শূর-কুল-পতি অর্জ্জুন, স্বকাজ যথা সাধি পুণ্য-বলে ফিরিলা কানন-বাসে ;---তুমি হে তেমতি, যাও সুখে ফিরি এবে ভারত-মণ্ডলে, মনোদ্যানে আশা-লতা তব ফলবতী !— ধন্য ভাগ্য, হে সুভগ, তব ভব-তলে ! শুভ ক্ষণে গর্ভে তোমা ধরিলা সে সতী, তিতিবেন যিনি, বৎস, নয়নের জলে ( স্নেহাসার!) যবে রঙ্গে বায়ু-রূপ ধরি জনরব, দূর বঙ্গে বহিবে সত্বরে এ তোমার কীৰ্ত্তি-বাৰ্ত্তা!—যাও দ্রুতে, তরি, নীলমণি-ময় পথ অপথ সাগরে! অদৃশ্যে রক্ষার্থে সঙ্গে যাবেন সুন্দরী বঙ্গ-লক্ষ্মী! যাও, কবি আশীৰ্ব্বাদ করে!– সমাধি-লিপি দাঁড়াও, পথিক-বর, জন্ম যদি তব বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধিস্থলে ( জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি বিরাম ) মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন! যশোরে সাগরদাঁড়ী কবতক্ষ-তীরে জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী! সমাপ্তে বিসর্জ্জিব আজি, মা গো, বিস্মৃতির জলে ( হৃদয়-মণ্ডপ, হায়, অন্ধকার করি!) ও প্রতিমা!নিবাইল,দেখ,হোমানলে মনঃ-কুণ্ডে অশ্রু-ধারা মনোদুঃখে ঝরি! শুখাইল দুরদৃষ্ট সে ফুল্ল কমলে, যার গন্ধামোদে অন্ধ এ মনঃ,বিস্মরি সংসারে ধর্ম্ম,কর্ম্ম!ডুবিল সে তরি, কাব্য-নদে খেলাইনু যাহে পদ-বলে অল্প দিন!নারিনু,মা,চিনিতে তোমারে শৈশব,অবোধ আমি!ডাকিলা যৌবনে; (যদিও অধম পুত্র,মা কি ভুলে তারে?) এবে---ইন্দ্রপ্রস্থ ছাড়ি যাই দূর বনে! এই বর,হে রবদে,মাগি শেষ বারে,--- জ্যোতির্ম্ময় কর বঙ্গ---ভারত-রতনে! সরস্বতী তপনের তাপে তাপি পথিক যেমতি পড়ে গিয়া দড়ে রড়ে ছায়ার চরণে ; তৃষাতুর জন যথা হেরি জলবতী নদীরে, তাহার পানে ধায় ব্যগ্ৰ মনে পিপাসা-নাশের আশে ; এ দাস তেমতি, জ্বলে যবে প্রাণ তার দুঃখের জ্বলনে, ধরে রাঙা পা দুখানি, দেবি সরস্বতি!--- মার কোল-সম, মা গো, এ তিন ভুবনে আছে কি আশ্রম আর ? নয়নের জলে ভাসে শিশু যবে, কে সাম্ভনে তারে ? কে মোচে আঁখির জল অমনি আঁচলে ? কে তার মনের খেদ নিবারিতে পারে, মধুমাখা কথা কয়ে, স্নেহের কৌশলে ?— এই ভাবি, কৃপাময়ি, ভাবি গো তোমারে! সাংসারিক জ্ঞান “কি কাজ বাজায়ে বীণা ; কি কাজ জাগায়ে সুমধুর প্রতিধ্বনি কাব্যের কাননে ? কি কাজ গরজে ঘন কাব্যের গগনে মেঘ-রূপে, মনোরূপ ময়ূরে নাচায়ে ? স্বতরিতে তুলি তোরে বেড়াবে কি বায়ে সংসার-সাগর-জলে, স্নেহ করি মনে কোন জন ?দেবে---অন্ন অৰ্দ্ধ মাত্র খায়ে, ক্ষুধায় কাতর তোরে দেখি রে তোরণে ? ছিঁড়ি তার-কুল, বীণা ছুড়ি ফেল দূরে! ” কহে সাংসারিক জ্ঞান—ভবে বৃহস্পতি । কিন্তু চিত্ত-ক্ষেত্রে যবে এ বীজ অস্কুরে, উপাড়ে ইহায় হেন কাহার শকতি ? উদাসীন-দশা তার সদা জীব-পুরে, যে অভাগা রাঙা পদ ভজে, মা ভারতি। সাগরে তরি হেরিনু নিশায় তরি অপথ সাগরে, মহাকায়া, নিশাচরী, যেন মায়া-বলে, বিহঙ্গিনী-রূপ ধরি, ধীরে ধীরে চলে, রঙ্গে সুধবল পাখা বিস্তারি অম্বরে! রতনের চূড়া-রূপে শিরোদেশে জ্বলে দীপাবলী, মনোহরা নানা বর্ণ করে,— শ্বেত, রক্ত, নীল, পীত, মিশ্রিত পিঙ্গলে চারি দিকে ফেনাময় তরঙ্গ সুস্বরে গাইছে আনন্দে যেন, হেরি এ সুন্দরী বামারে, বাখানি রূপ, সাহস, আকৃতি। ছাড়িতেছে পথ সবে আস্তে ব্যস্তে সরি, নীচ জন হেরি যথা কুলের যুবতী। চলিছে গুমরে বামা পথ আলো করি, শিরোমণি-তেজে যথা ফণিনীর গতি। সায়ংকাল চেয়ে দেখ, চলিছেন মৃদে অস্তাচলে দিনেশ, ছড়ায়ে স্বর্ণ, রত্ন রাশি রাশি আকাশে। কত বা যত্নে কাদম্বিনী আসি ধরিতেছে তা সবারে সুনীল আঁচলে! – কে না জানে অলঙ্কারে অঙ্গনা বিলাসী? অতি-ত্বরা গড়ি ধনী দৈব-মায়া-বলে বহুবিধ অলঙ্কার পরিবে লো হাসি,— কনক-কঙ্কণ হাতে, স্বর্ণ-মালা গলে! সাজাইবে গজ, বাজী; পৰ্ব্বতের শিরে সুবর্ণ কিরীট দিবে; বহাবে অম্বরে নদস্রোতঃ, উজ্জ্বলিত স্বর্ণবর্ণ নীরে! সুবর্ণের গাছ রোপি, শাখার উপরে হেমাঙ্গ বিহঙ্গ থোবে। –এ বাজী করি রে শুভ ক্ষণে দিনকর কর-দান করে। সায়ংকালের তারা কার সাথে তুলনিবে,লো সুর-সুন্দরি, ও রূপের ছটা কবি এ ভব-মণ্ডলে? আছে কি লো হেন খনি,যার গর্ভে ফলে রতন তোমার মত,কহ,সহচরি গোধূলির?কি ফণিনী,যার সু-কবরী সাজায় সে তোমা সম মণির উজ্জ্বলে?--- ক্ষণমাত্র দেখি তোমা নক্ষত্র-মণ্ডলে কি হেতু?ভাল কি তোমা বাসে না শর্ব্বরী? হেরি অপরূপ রূপ বুঝি ক্ষুণ্ণ মনে মানিনী রজনী রাণী,তেঁই অনাদরে না দেয় শোভিতে তোমা সখীদল-সনে, যবে কেলি করে তারা সুহাস-অম্বরে? কিন্তু কি অভাব তব,ওলো বরাঙ্গনে,--- ক্ষণমাত্র দেখী মুখ,চির আঁখি স্মরে! সারিকা ১          ওই যে পার্থীটি, সখি, দেখিছ পিঞ্জরে রে,                   সতত চঞ্চল,— কভু কাঁদে, কভু গায়,           যেন পাগলিনী-প্রায়,     জলে যথা জ্যোতিবিম্ব—তেমতি তরল!     কি ভাবে ভাবিনী যদি বুঝিতে,স্বজনি,     পিঞ্জর ভাঙিয়া ওরে ছাড়িতে অমনি!২নিজে যে দুঃখিনী,            পরদুঃখ বুঝে সেই রে,                  কহিনু তোমারে;--- আজি ও পাখীর মনঃ       বুঝি আমি বিলক্ষণ---       আমিও বন্দী লো আজি ব্রজ-কারাগারে!       সারিকা অধীর ভাবি কুসুম-কানন,       রাধিকা অধীর ভাবি রাধা-বিনোদন!৩      বনবিহারিণী ধনী বসন্তের সখী রে—                  শুকের সুখিনী? বলে ছলে,ধরে তারে,        বাঁধিয়াছ কারাগারে---       কেমনে ধৈরজ ধরি রবে সে কামিনী?       সারিকার দশা, সখি, ভাবিয়া অস্তরে,       রাধিকারে বেঁধো না লো সংসার-পিঞ্জরে!৪      ছাড়ি দেহ বিহগীরে মোর অনুরোধে রে—                  হইয়া সদয়। ছাড়ি দেহ যাক্ চলি,           হাসে যথা বনস্থলী---      শুকে দেখি সুখে ওর জুড়াবে হৃদয়!      সারিকার ব্যথা সারি, ওলো দয়াবতি,      রাধিকার বেড়ি ভাঙ—এ মম মিনতি।৫     এ ছার সংসার আজি অাঁধার, স্বজনি রে—                  রাধার নয়নে! কেনে তবে মিছে তারে     রাখ তুমি এ আঁধারে---     সফরী কি ধরে প্রাণ বারির বিহনে?     দেহ ছাড়ি, যাই চলি যথা বনমালী;     লাগুক্ কুলের মুখে কলঙ্কের কালি!৬    ভাল যে বাসে, স্বজনি, কি কাজ তাহার রে                 কুলমান ধনে? শ্যামপ্রেমে উদাসিনী        রাধিকা শ্যাম-অধীনী---     কি কাজ তাহার অাজি রত্ন আভরণে?     মধু কহে, কুলে ভুলি কর লো গমন---     শ্ৰীমধুসূদন, ধনি, রসের সদন! সিংহ ও মশক শঙ্খনাদ করি মশা সিংহে আক্রমিল;            ভব-তলে যত নর,            ত্রিদিবে যত অমর,            আর যত চরাচর, হেরিতে অদ্ভুত যুদ্ধ দৌড়িয়া আইল। হুল-রূপ শূলে বীর, সিংহেরে বিঁধিল।             অধীর ব্যথায় হরি,             উচ্চ-পুচ্ছে ক্রোধ করি,             কহিলা;—“কে তুই, কেন             বৈরিভাব তোর হেন?         গুপ্তভাবে কি জন্য লড়াই?— সম্মুখ-সমর কর্‌; তাই অামি চাই।           দেখিব বীরত্ব কত দূর,           আঘাতে করিব দর্প-চূর;           লক্ষ্মণের মুখে কালি           ইন্দ্রজিতে জয়-ডালি,           দিয়াছে এ দেশে কবি।” কহে মশা;—“ভীরু, মহাপাপি, যদি বল থাকে, বিষম-প্রতাপি,           অন্যায়-ন্যায়-ভাবে, ক্ষুধায় যা পায়, খাবে;           ধিক্‌, দুষ্টমতি! মারি তোরে বন-জীবে দিব, রে, কু-মতি।''      হইল বিষম রণ, তুলনা না মিলে;           ভীম দুর্য্যোধনে,           ঘোর গদা-রণে,           হ্রদ দ্বৈপায়নে, তীরস্থ সে রণ-ছায়া পড়িল সলিলে; ডরাইয়া জল-জীবী জল-জন্তুচয়ে,     সভয়ে মনেতে ভাবিল, প্রলয়ে বুঝি এ বীরেন্দ্র-দ্বয় এ সৃষ্টি নাশিল!           মেঘনাদ মেঘের পিছনে,           অদৃশ্য অাঘাতে যথা রণে;           কেহ তারে মারিতে না পায়, ভয়ঙ্কর স্বপ্নসম অাসে,—এসে যায়, জর-জরি শ্রীরামের কটক লঙ্কায়।           কভু নাকে, কভু কাণে,           ত্রিশূল-সদৃশ হানে           হুল, মশা বীর।           না হেরি অরিরে হরি,           মুহুর্মুহুঃ নাদ করি,           হইলা অধীর। হায়! ক্রোধে হৃদয় ফাটিল;— গত-জীব মৃগরাজ ভূতলে পড়িল! ক্ষুদ্র শত্রু ভাবি লোক অবহেলে যারে, বহুবিধ সঙ্কটে সে ফেলাইতে পারে;— এই উপদেশ কবি দিলা অলঙ্কারে। সীতাদেবী অনুক্ষণ মনে মোর পড়ে তব কথা, বৈদেহি! কখন দেখি, মুদিত নয়নে, একাকিনী তুমি, সতি, অশোক-কাননে, চারি দিকে চেড়ীবৃন্দ, চন্দ্রকলা যথা আচ্ছন্ন মেঘের মাঝে ! হায়, বহে বৃথা পদ্মাক্ষি, ও চক্ষুঃ হতে অশ্রু-ধারা ঘনে ! কোথা দাশরথি শূর কোথা মহারথী দেবর লক্ষ্মণ, দেবি, চিরজয়ী রণে ? কি সাহসে, সুকেশিনি, হরিল তোমারে রাক্ষস ? জানে না মূঢ়, কি ঘটিবে পরে ! রাহু-গ্রহ-রূপ ধরি বিপত্তি আঁধারে জ্ঞান-রবি, যবে বিধি বিড়ম্বণ করে ! মজিবে এ রক্ষোবংশ, খ্যাত ত্রিসংসারে, ভূকম্পণে, দ্বীপ যথা অতল সাগরে ! সীতা---বনবাসে ফিরাইলা বনপথে অতি ক্ষুণ্ণ মনে সুরথী লক্ষ্মণ রথ, তিতি চক্ষুঃ-জলে ;---- উজলিল বন-রাজী কনক কিরণে স্যন্দন, দিনেন্দ্র যেন অস্তের অচলে। নদী-পারে একাকিনী সে বিজন বনে দাঁড়ায়ে, কহিলা সতী শোকের বিহ্বলে ;--- “ত্যজিলা কি, রঘু-রাজ, আজি এই ছলে চির জন্যে জানকীরে?হে নাথ!কেমনে--- কেমনে বাঁচিবে দাসী ও পদ-বিরহে? কে, কহ, বারিদ-রূপে, স্নেহ-বারি দানে, ( দাবানল-রূপে যবে দুখানল দহে ) জুড়াবে,হে রঘুচূড়া,এ পোড়া পরাণে? নীরবিলা ধীর সাধ্বী;ধীরে যথা রহে বাহ্য-জ্ঞান-শূন্য মূর্ত্তি,নির্ম্মিত পাষাণে! সুভদ্রা যথা ধীরে স্বপ্ন-দেবী রঙ্গে সঙ্গে করি মায়া-নারী—রত্নোত্তমা রূপের সাগরে,— পশিলা নিশায় হাসি মন্দিরে সুন্দরী সত্যভামা, সাথে ভদ্রা, ফুল-মালা করে । বিমলিল দীপ-বিভা ; পূরিল সত্বরে সৌরভে শয়নাগার, যেন ফুলেশ্বরী সরোজিনী প্রফুল্লিলা আচম্বিতে সরে, কিম্বা বনে বন-সখী মুনাগকেশরী ! শিহরি জাগিলা পার্থ, যেমতি স্বপনে সম্ভোগ-কৌতুকে মাতি সুপ্ত জন জাগে;--- কিন্তু কাঁদে প্রাণ তার সে কু-জাগরণে, সাধে সে নিদ্রায় পুনঃ বৃথা অমুরাগে । তুমি, পার্থ, ভাগ্য-বলে জাগিলা সুক্ষণে মরতে স্বরগ-ভোগ ভোগিতে সোহাগে। সুভদ্রা-হরণ তোমার হরণ-গীত গাব বঙ্গাসরে নব তানে, ভেবেছিনু সুভদ্রা সুন্দরি; কিন্তু ভাগ্যদোষে, শুভে, আশার লহরী শুখাইল, যথা গ্ৰীষ্মে জলরাশি সরে! ফলে কি ফুলের কলি যদি প্রেমাদরে না দেন শিশিরামৃত তারে বিভাবরী? ঘৃতাহুতি না পাইলে, কুণ্ডের ভিতরে, ম্রিয়মাণ, অভিমানে তেজঃ পরিহরি, বৈশ্বানর দুরদৃষ্ট মোর, চন্দ্রাননে, কিন্তু ( ভবিষ্যৎ কথা কহি ) ভবিষ্যতে ভাগ্যবানতর কবি, পূজি দ্বৈপায়নে, ঋষি-কুল-রত্ব দ্বিজ গাবে লো ভারতে তোমার হরণ-গীত ; তুষি বিজ্ঞ জনে লভিবে সুযশঃ, সাঙ্গি---এ সঙ্গীত-ব্ৰতে ! সূর্য্য এখনও আছে লোক দেশ দেশান্তরে দেব ভাবি পূজে তোমা, রবি দিনমণি, দেখি তোমা দিবামুখে উদয়-শিখরে, লুটায়ে ধরণীতলে, করে স্তুতি-ধ্বনি ; আশ্চর্যের কথা, সূৰ্য্য, এ না মনে গণি। অসীম মহিমা তব, যখন প্রখরে শোভ তুমি, বিভাবসু, মধ্যাহ্নে অম্বরে সমুজ্জ্বল করজালে আবরি মেদিনী ! অসীম মহিমা তব, অসীম শকতি, হেম-জ্যোতিঃ-দাতা তুমি চন্দ্র-গ্রহ-দলে ; উর্ব্বরা তোমার বীর্য্যে সতী বসুমতী ; বারিদ, প্রসাদে তব, সদা পূর্ণ জলে ;— কিন্তু কি মহিমা তাঁর, কহ, দিনপতি, কোটি রবি শোভে নিত্য যাঁর পদতলে! সূর্য্য ও মৈনাক-গিরি উদয়-অচলে, দিবা-মুখে এক-চক্রে দিলা দরশন,        অংশু-মালা গলে, বিতরি সুবর্ণ-রশ্মি চৌদিকে তপন।        ফুটিল কমল-জলে        সূর্য্যমুখী সুখে স্থলে,        কোকিল গাইল কলে,        আমোদি কানন। জাগে বিশ্বে নিদ্রা ত্যজি বিশ্ববাসী জন; পুনঃ যেন দেব স্রষ্টা সৃজিলা মহীরে; সজীব হইলা সবে জনমি, অচিরে।       অবহেলি উদয়-অচলে,       শূন্য-পথে রথবর চলে;       বাড়িতে লাগিল বেলা,       পদ্মের বাড়িল খেলা, রজনী তারার মেলা সর্ব্বত্র ভাঙ্গিল;— কর-জালে দশ দিক্ হাসি উজলিল। উঠিতে লাগিলা ভানু নীল নভঃস্থলে; দ্বিতীয়-তপন-রূপে নীল সিন্ধু-জলে        মৈনাক ভাসিল। কহিল গম্ভীরে শৈল দেব দিবাকরে;— “দেখি তব ধীর গতি দুখে আঁখি ঝরে; পাও যদি কষ্ট,—এস, পৃষ্ঠাসন দিব; যেখানে উঠিতে চাও, সবলে তুলিব।” কহিলা হাসিয়া ভানু;—“তুমি শিষ্টমতি; দৈববলে বলী অামি, দৈববলে গতি।”      মধ্যাকাশে শোভিল তপন,—       উজ্জ্বল-যৌবন, প্রচণ্ড-কিরণ; তাপিল উত্তাপে মহী; পবন বহিলা অাগুনের শ্বাস-রূপে; সব শুকাইলা---       শুকাল কাননে ফুল;       প্রাণিকুল ভয়াকুল; জলের শীতল দেহ দহিয়া উঠিল;      কমলিনী কেবল হাসিল!      হেন কালে পতনের দশা,      আ মরি; সহসা      আসি উতরিল;— হিরণ্ময় রাজাসন ত্যজিতে হইল!       অধোগামী এবে রবি,       বিষাদে মলিন-ছবি, হেরি মৈনাকেরে পুনঃ নীল সিন্ধু-জলে,       সম্ভাষি কহিলা কুতূহলে;— “পাইতেছি কষ্ট, ভাই, পূর্ব্বাসন লাগি; দেহ পৃষ্ঠাসন এবে, এই বর মাগি; লও ফিরে মোরে, সখে, ও মধ্য-গগনে;— অাবার রাজত্ব করি, এই ইচ্ছা মনে।” হাসি উত্তরিল শৈল;—“হে মূঢ় তপন, অধঃপাতে গতি যার কে তার রক্ষণ! রমার থাকিলে কৃপা, সবে ভালবাসে;— কাঁদ যদি, সঙ্গে কাঁদে; হাস যদি, হাসে; ঢাকেন বদন যবে মাধব-রমণী, সকলে পলায় রড়ে, দেখি যেন ফণী।” সৃষ্টিকর্ত্তা কে সৃজিলা এ সুবিশ্বে,জিজ্ঞাসিব কারে এ রহস্য কথা,বিশ্বে,আমি মন্দমতি? পার যদি,তুমি দাসে কহ,বসুমতি;--- দেহ মহা-দীক্ষা,দেবি,ভিক্ষা,চিনিবারে তাঁহায়,প্রসাদে যাঁর তুমি,রূপবতি,--- ভ্রম অসম্ভ্রমে শূন্যে!কহ,হে আমারে, কে তিনি,দিনেশ রবি,করি এ মিনতি, যাঁর আদি জ্যোতিঃ,হেম-আলোক সঞ্চারে তোমার বদন,দেব,প্রত্যহ উজ্জ্বলে? অধম চিনিতে চাহে সে পরম জনে, যাঁহার প্রসাদে তুমি নক্ষত্র-মণ্ডলে কর কেলি নিশাকালে রজত-আসনে, নিশানাথ।নদকুল,কহ কলকলে, কিম্বা তুমি,অম্বুপতি,গম্ভীর স্বননে। হিড়িম্বা উজলি ঠৌদিক এবে রূপের কিরণে, বীরেশ ভীমের পাশে কর যোড় করি দাঁড়াইলা,প্রেম-ডোরে বাঁধা কায় মনে হিড়িম্বা;সুবর্ণ-কান্তি বিহঙ্গী সুন্দরী কিরাতের ফাঁদে যেন!ধাইল কাননে গন্ধামোদে অন্ধ অলি,আনন্দে গুঞ্জরি,--- গাইল বাসন্তামোদে শাখার উপরি মধুমাখা গীত পাখী সে নিকুঞ্জ-বনে। সহসা নড়িল বন ঘোর মড়মড়ে, মদ-মত্ত হস্তী কিম্বা গণ্ডার সরোষে পশিলে বনেতে,বন যেই মতে নড়ে! দীর্ঘ-তাল-তুল্য গদা ঘুরায়ে নির্ঘোষে, ছিন্ন করি লতা-কুলে ভাঙি বৃক্ষ রড়ে, পশিল হিড়িম্ব রক্ষঃ----রৌদ্র ভগ্নী-দোষে। হিমঋতু হিমন্তের আগমনে সকলে কম্পিত, রামাগণ ভাবে মনে হইয়া দুঃখিত। মনাগুনে ভাবে মনে হইয়া বিকার, নিবিল প্রেমের অগ্নি নাহি জ্বলে অার। ফুরায়েছে সব অাশা মদন রাজার অাসিবে বসন্ত অাশা—এই অাশা সার। অাশায় অাশ্রিত জনে নিরাশ করিলে, অাশাতে আশার বশ অাশায় মারিলে। সৃজিয়াছি অাশাতরু অাশিত হইয়া, নষ্ট কর হেন তরু নিরাশ করিয়া। যে জন করয়ে আশা, অাশার অাশ্বাসে, নিরাশ করয়ে তারে কেমন মানসে॥ কলহ নাইক নিতুই৷ জগৎ মানে যেন,−তার− মা, দিদি আপনি সে আর, এ ছাড়া কিছুই নেই চেনেনা কারুকেই, অকথা কুকথার ধারে না কোনো ধার শেখেনি আজও ‘তুই’ ‘মুই’৷ একদা হ’ল দুটি বোনে পুতুল নিয়ে কি কারণে ঝগড়া কাড়াকাড়ি, তখন দিয়ে আড়ি হারিয়া কাদোঁ-কাদোঁ হ’য়ে সে আধো আধো কহিল ‘ডিডি!টুমি-টুই!’ ফুলের ফসল জোটে যদি মোটে একটি পয়সা খাদ্য কিনিয়ো ক্ষুধার লাগি’ দুটি যদি জোটে অর্ধেকে তার ফুল কিনে নিয়ো, হে অনুরাগী!বাজারে বিকায় ফল তণ্ডুল সে শুধু মিটায় দেহের ক্ষুধা, হৃদয়-প্রাণের ক্ষুধা নাশে ফুল দুনিয়ার মাঝে সেই তো সুধা! ভোরাই ভোর হল রে, ফর্সা হ’ল, দুল্ ল ঊষার ফুল-দোলা ! আন্ কো আলোয় যায় দেখা ওই পদ্মকলির হাই-তোলা ! জাগলো সাড়া নিদ্ মহলে, অ-থই নিথর পাথার-জলে– আলপনা দ্যায় আল্ তো বাতাস,ভোরাই সুরে মন ভোলা ! ধানের ক্ষেতের সব্ জে কে আজ সোহাগ দিয়ে ছুপিয়েছে ! সেই সোহাগের একটু পরাগ টোপর-পানায় টুপিয়েছে ! আলোর মাঠের কোল ভরেছে, অপরাজিতার রং ধরেছে– নীল-কাজলের কাজল-লতা আস্ মানে চোখ ডুবিয়ে যে | কল্পনা আজ চলছে উড়ে হাল্ কা হাওয়ায় খেল্ খেলে ! পাপ্ ড়ি-ওজন পান্ সি কাদের সেই হাওয়াতেই পালপেলে ! মোতিয়া মেঘের চামর পিঁজে পায়রা ফেরে আলোয় ভিজে পদ্মফুলের অঞ্জলি যে আকাশ-গাঙে যায় ঢেলে ! পূব্ গগনে থির নীলিমা ভুলিয়েছে মন ভুলিয়েছে ! পশ্চিমে মেঘ মেলছে জটা–সিংহ কেশর ফুলিয়েছে ! হাঁস চলেছে আকাশ-পথে, হাস্ ছে কারা পুষ্প-রথে,– রামধনু-রং আঁচলা তাদের আলো-পাথার দুলিয়েছে ! শিশির-কণায় মানিক ঘনায়, দূর্বাদলে দীপ জ্বলে ! শীতল শিথিল শিউলী-বোটায় সুপ্ত শিশুর ঘুম টলে | আলোর জোয়ার উঠছে বেড়ে গন্ধ-ফুলের স্বপন কেড়ে, বন্ধ চোখের আগল ঠেলে রঙের ঝিলিক্ ঝল্ মলে ! নীলের বিথার নীলার পাথার দরাজ এ যে দিল্ খোলা ! আজ কি উচিত ডঙ্কা দিয়ে ঝাণ্ডা নিয়ে ঝড় তোলা ? ফির্ ছে ফিঙে দুলিয়ে ফিতে; বোল ধরেছে বুল্ বুলিতে ! গুঞ্জনে আর কূজন-গীতে হর্ষে ভূবন হর্ বোলা ! মানুষ জাতি জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে সে জাতির নাম মানুষ জাতি; এক পৃথিবীর স্তন্যে লালিত একই রবি শশী মোদের সাথী। শীতাতপ ক্ষুধা তৃষ্ণার জ্বালা সবাই আমরা সমান বুঝি, কচি কাঁচাগুলি ডাঁটো করে তুলি বাঁচিবার তরে সমান যুঝি। দোসর খুঁজি ও বাসর বাঁধি গো, জলে ডুবি, বাঁচি পাইলে ডাঙ্গা, কালো আর ধলো বাহিরে কেবল ভিতরে সবারই সমান রাঙা। বাহিরের ছোপ আঁচড়ে সে লোপ ভিতরের রং পলকে ফোটে, বামুন, শূদ্র, বৃহৎ, ক্ষুদ্র কৃত্রিম ভেদ ধুলায় লোটে।…বংশে বংশে নাহিক তফাত বনেদি কে আর গর্-বনেদি, দুনিয়ার সাথে গাঁথা বুনিয়াদ্ দুনিয়া সবারি জনম-বেদী। অট্টহাস্যে আকাশখানা ফেরে ভোলানাথের ঝোলাঝুলি ঝেড়ে     ভুলগুলো সব অানরে বাছা বাছা ।          আয় প্রমত্ত আয় রে আমার কাঁচা ।আন্ রে টেনে বাঁধা পথের শেষে।     বিবাগি কর্ অবাধ পানে,       পথ কেটে যাই অজানাদের দেশে । আপদ আছে জানি আঘাত আছে, তাই জেনে তো বক্ষে পরাণ নাচে--- ঘুচিয়ে দে ভাই, পুঁথিপোড়োর কাছে     পথে চলার বিধিবিধান যাচা ।         আয় প্রমুক্ত, অায় রে আমার কাঁচা ।চিরযুবা তুই যে চিরজীবী,    জীর্ণ জরা ঝরিয়ে দিয়ে       প্রাণ অফুরান ছড়িয়ে দেদার দিবি । সবুজ নেশায় ভোর করেছিস ধরা, ঝড়ের মেঘে তোরই তড়িৎ ভরা, বসন্তেরে পরাস অাকুল করা      আপন গলার বকূল মালাগাছা ।          আয় রে অমর, আয় রে আমার কাঁচা । সভাতলে ভুঁয়ে কাৎ হয়ে শুয়ে সভাতলে ভুঁয়ে কাৎ হয়ে শুয়ে নাক ডাকাইছে সুল্‌তান, পাকা দাড়ি নেড়ে গলা দিয়ে ছেড়ে মন্ত্রী গাহিছে মূলতান। এত উৎসাহ দেখি গায়কের জেদ হল মনে সেনানায়কের– কোমরেতে এক ওড়না জড়িয়ে নেচে করে সভা গুলতান। ফেলে সব কাজ বরকন্দাজ বাঁশিতে লাগায় ভুল তান।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) সভ্যতার প্রতি দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর, লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী, দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি, গ্লানিহীন দিনগুলি, সেই সন্ধ্যাস্নান, সেই গোচারণ, সেই শান্ত সামগান, নীবারধান্যের মুষ্টি, বল্কলবসন, মগ্ন হয়ে আত্মমাঝে নিত্য আলোচন মহাতত্ত্বগুলি। পাষাণপিঞ্জরে তব নাহি চাহি নিরাপদে রাজভোগ নব-- চাই স্বাধীনতা, চাই পক্ষের বিস্তার, বক্ষে ফিরে পেতে চাই শক্তি আপনার, পরানে স্পর্শিতে চাই ছিঁড়িয়া বন্ধন অনন্ত এ জগতের হৃদয়স্পন্দন। ১৯ চৈত্র, ১৩০২ সমব্যথী যদি       খোকা না হয়ে আমি     হতেম কুকুর-ছানা— তবে     পাছে তোমার পাতে আমি     মুখ দিতে যাই ভাতে তুমি     করতে আমায় মানা?           সত্যি করে বল্‌ আমায়   করিস নে মা, ছল—           বলতে আমায় ‘দূর দূর দূর।           কোথা থেকে এল এই কুকুর'?           যা মা, তবে যা মা, আমায়   কোলের থেকে নামা। আমি    খাব না তোর হাতে, আমি    খাব না তোর পাতে। যদি      খোকা না হয়ে আমি     হতেম তোমার টিয়ে, তবে     পাছে যাই মা, উড়ে আমায়   রাখতে শিকল দিয়ে?            সত্যি করে বল্‌ আমায়   করিস নে মা, ছল—           বলতে আমায় ‘হতভাগা পাখি           শিকল কেটে দিতে চায় রে ফাঁকি'?           তবে নামিয়ে দে মা, আমায়   ভালোবাসিস নে মা। আমি     রব না তোর কোলে, আমি     বনেই যাব চলে।   (শিশু কাব্যগ্রন্থ) সময় আসন্ন হলে সময় আসন্ন হলে আমি যাব চলে, হৃদয় রহিল এই শিশু চারাগাছে— এর ফুলে, এর কচি পল্লবের নাচে অনাগত বসন্তের আনন্দের আশা রাখিলাম আমি হেথা নাই থাকিলাম।   (স্ফুলিঙ্গ) সময়হারা খবর এল , সময় আমার গেছে ,                      আমার-গড়া পুতুল যারা বেচে                বর্তমানে এমনতরো পসারী নেই ;          সাবেক কালের দালানঘরের পিছন কোণেই                                   ক্রমে ক্রমে                            উঠছে জমে জমে                      আমার হাতের খেলনাগুলো ,                                         টানছে ধুলো ।                                   হাল আমলের ছাড়পত্রহীন          অকিঞ্চনটা লুকিয়ে কাটায় জোড়াতাড়ার দিন ।                ভাঙা দেয়াল ঢেকে একটা ছেঁড়া পর্দা টাঙাই ;          ইচ্ছে করে , পৌষমাসের হাওয়ার তোড়টা ভাঙাই ;                ঘুমোই যখন ফড়্‌ফড়িয়ে বেড়ায় সেটা উড়ে ,                                 নিতান্ত ভুতুড়ে ।                আধপেটা খাই শালুক-পোড়া ; একলা কঠিন ভুঁয়ে                      চেটাই পেতে শুয়ে                            ঘুম হারিয়ে ক্ষণে ক্ষণে                      আউড়ে চলি শুধু আপন-মনে —                “ উড়কি ধানের মুড়কি দেব , বিন্নে ধানের খই ,                      সরু ধানের চিঁড়ে দেব , কাগমারে দই । ”          আমার চেয়ে কম-ঘুমন্ত নিশাচরের দল                খোঁজ নিয়ে যায় ঘরে এসে , হায় সে কী নিষ্ফল ।          কখনো বা হিসেব ভুলে আগে মাতাল চোর ,                শূন্য ঘরের পানে চেয়ে বলে , “ সাঙাত মোর ,                      আছে ঘরে ভদ্র ভাষায় বলে যাকে দাওয়াই ?”          নেই কিছু তো , দু-এক ছিলিম তামাক সেজে খাওয়াই ।                       একটু যখন আসে ঘুমের ঘোর          সুড়সুড়ি দেয় আরসুলারা পায়ের তলায় মোর ।                      দুপুরবেলায় বেকার থাকি অন্যমনা ;          গিরগিটি আর কাঠবিড়ালির আনাগোনা    সেই দালানের বাহির ঝোপে ;                           থামের মাথায় খোপে খোপে                পায়রাগুলোর সারাটা দিন বকম্‌-বকম্‌ ।          আঙিনাটার ভাঙা পাঁচিল , ফাটলে তার রকম-রকম                                 লতাগুল্ম পড়ছে ঝুলে ,                           হলদে সাদা বেগনি ফুলে                                 আকাশ-পানে দিচ্ছে উঁকি ।                           ছাতিমগাছের মরা শাখা পড়ছে ঝুঁকি                                 শঙ্খমণির খালে ,                মাছরাঙারা দুপুরবেলায় তন্দ্রানিঝুম কালে          তাকিয়ে থাকে গভীর জলের রহস্যভেদরত                                 বিজ্ঞানীদের মতো ।                      পানাপুকুর , ভাঙনধরা ঘাট ,                অফলা এক চালতাগাছের চলে ছায়ার নাট ।                চক্ষু বুজে ছবি দেখি — কাৎলা ভেসেছে ,          বড়ো সাহেবের বিবিগুলি নাইতে এসেছে ।                      ঝাউগুঁড়িটার'পরে                কাঠঠোকরা ঠক্‌ঠকিয়ে কেবল প্রশ্ন করে ।          আগে কানে পৌঁছত না ঝিঁঝিঁপোকার ডাক ,                এখন যখন পোড়ো বাড়ি দাঁড়িয়ে হতবাক্‌                      ঝিল্লিরবের তানপুরা-তান স্তব্ধতা-সংগীতে                           লেগেই আছে একঘেয়ে সুর দিতে ।          আঁধার হতে না হতে সব শেয়াল ওঠে ডেকে                কল্‌মদিঘির ডাঙা পাড়ির থেকে ।          পেঁচার ডাকে বাঁশের বাগান হঠাৎ ভয়ে জাগে ,                      তন্দ্রা ভেঙে বুকে চমক লাগে ।          বাদুড়-ঝোলা তেঁতুলগাছে মনে যে হয় সত্যি ,                      দাড়িওয়ালা আছে ব্রহ্মদত্যি ।           রাতের বেলায় ডোমপাড়াতে কিসের কাজে                      তাক্‌ধুমাধুম বাদ্যি বাজে ।          তখন ভাবি , একলা ব ' সে দাওয়ার কোণে                      মনে-মনে , ঝড়েতে কাত জারুলগাছের ডালে ডালে                      পির্‌ভু নাচে হাওয়ার তালে ।          শহর জুড়ে নামটা ছিল , যেদিন গেল ভাসি                           হলুম বনগাঁবাসী ।          সময় আমার গেছে ব ' লেই সময় থাকে পড়ে ,                পুতুল গড়ার শূন্য বেলা কাটাই খেয়াল গ ' ড়ে ।          সজনেগাছে হঠাৎ দেখি কমলাপুলির টিয়ে —                গোধূলিতে সুয্যিমামার বিয়ে ;           মামি থাকেন , সোনার বরন ঘোমটাতে মুখ ঢাকা ,                আলতা পায়ে আঁকা ।          এইখানেতে ঘুঘুডাঙার খাঁটি খবর মেলে                কুলতলাতে গেলে ।              সময় আমার গেছে ব ' লেই জানার সুযোগ হল          ‘ কলুদ ফুল ' যে কাকে বলে , ওই যে থোলো থোলো                       আগাছা জঙ্গলে             সবুজ অন্ধকারে যেন রোদের টুক্‌রো জ্বলে ।                বেড়া আমার সব গিয়েছে টুটে ;          পরের গোরু যেখান থেকে যখন খুশি ছুটে                      হাতার মধ্যে আসে ;          আর কিছু তো পায় না , খিদে মেটায় শুকনো ঘাসে ।                 আগে ছিল সাট্‌ন্‌ বীজে বিলিতি মৌসুমি ,                      এখন মরুভূমি ।          সাত পাড়াতে সাত কুলেতে নেইকো কোথাও কেউ                মনিব যেটার , সেই কুকুরটা কেবল ই ঘেউ-ঘেউ          লাগায় আমার দ্বারে ; আমি বোঝাই তারে কত ,                আমার ঘরে তাড়িয়ে দেবার মতো                      ঘুম ছাড়া আর মিলবে না তো কিছু —          শুনে সে লেজ নাড়ে , সঙ্গে বেড়ায় পিছু পিছু ।                      অনাদরের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে পিঠের ‘ পরে                জানিয়ে দিলে , লক্ষ্মীছাড়ার জীর্ণ ভিটের ‘ পরে          অধিকারের দলিল তাহার দেহেই বর্তমান ।                দুর্ভাগ্যের নতুন হাওয়া-বদল করার স্থান এমনতরো মিলবে কোথায় । সময় গেছে তারই ,                সন্দেহ তার নেইকো একেবারেই ।          সময় আমার গিয়েছে , তাই গাঁয়ের ছাগল চরাই ;                রবিশস্যে ভরা ছিল , শূন্য এখন মরাই ।           খুদকুঁড়ো যা বাকি ছিল ইঁদুরগুলো ঢুকে                দিল কখন ফুঁকে ।           হাওয়ার ঠেলায় শব্দ করে আগলভাঙা দ্বার ,                সারাদিনে জনামাত্র নেইকো খরিদ্দার ।                      কালের অলস চরণপাতে          ঘাস উঠেছে ঘরে আসার বাঁকা গলিটাতে ।                 ওরই ধারে বটের তলায় নিয়ে চিঁড়ের থালা          চড়ুইপাখির জন্যে আমার খোলা অতিথশালা ।             সন্ধে নামে পাতাঝরা শিমূলগাছের আগায় ,                      আধ-ঘুমে আধ-জাগায়                মন চলে যায় চিহ্নবিহীন পস্‌টারিটির পথে                           স্বপ্নমনোরথে ;          কালপুরুষের সিংহদ্বারের ওপার থেকে                শুনি কে কয় আমায় ডেকে —                      “ ওরে পুতুলওলা                তোর যে ঘরে যুগান্তরের দুয়ার আছে খোলা ,          সেথায় আগাম-বায়না-নেওয়া খেলনা যত আছে                লুকিয়ে ছিল গ্রহণ-লাগা ক্ষণিক কালের পাছে ;                      আজ চেয়ে দেখ্‌ , দেখতে পাবি ,                                 মোদের দাবি                           ছাপ-দেওয়া তার ভালে ।                পুরানো সে নতুন আলোয় জাগল নতুন কালে ।          সময় আছে কিংবা গেছে দেখার দৃষ্টি সেই                                  সবার চক্ষে নেই —                      এই কথাটা মনে রেখে ওরে পুতুলওলা ,                আপন-সৃষ্টি-মাঝখানেতে থাকিস আপন-ভোলা ।          ওই যে বলিস , বিছানা তোর ভুঁয়ে চেটাই পাতা , ছেঁড়া মলিন কাঁথা —                 ওই যে বলিস , জোটে কেবল সিদ্ধ কচুর পথ্যি —          এটা নেহাত স্বপ্ন কি নয় , এ কি নিছক সত্যি ।                পাস নি খবর , বাহান্ন জন কাহার                      পাল্‌কি আনে — শব্দ কি পাস তাহার ।          বাঘনাপাড়া পেরিয়ে এল ধেয়ে ,                সখীর সঙ্গে আসছে রাজার মেয়ে ।          খেলা যে তার বন্ধ আছে তোমার খেলনা বিনে ,                            এবার নেবে কিনে ।                কী জানি বা ভাগ্যি তোমার ভালো ,                      বাসরঘরে নতুন প্রদীপ জ্বালো ;                নবযুগের রাজকন্যা আধেক রাজ্যসুদ্ধ           যদি মেলে , তা নিয়ে কেউ বাধায় যদি যুদ্ধ ,                ব্যাপারখানা উচ্চতলায় ইতিহাসের ধাপে                      উঠে পড়বে মহাকাব্যের মাপে ।          বয়স নিয়ে পণ্ডিত কেউ তর্ক যদি করে                      বলবে তাকে , একটা যুগের পরে                চিরকালের বয়স আসে সকল-পাঁজি-ছাড়া                                 যমকে লাগায় তাড়া । ”           এতক্ষণ যা বকা গেল এটা প্রলাপমাত্র —                      নবীন বিচারপতি ওগো , আমি ক্ষমার পাত্র ;          পেরিয়ে মেয়াদ বাঁচে তবু যে-সব সময়হারা                      স্বপ্নে ছাড়া সান্ত্বনা আর কোথায় পাবে তারা । সময় চলেই যায় “সময় চ’লেই যায়’ নিত্য এ নালিশে উদ্‌বেগে ছিল ভুপু মাথা রেখে বালিশে। কব্‌জির ঘড়িটার উপরেই সন্দ, একদম করে দিল দম তার বন্ধ– সময় নড়ে না আর, হাতে বাঁধা খালি সে, ভুপুরাম অবিরাম- বিশ্রাম-শালী সে। ঝাঁ-ঝাঁ করে রোদ্‌দুর, তবু ভোর পাঁচটায় ঘড়ি করে ইঙ্গিত ডালাটার কাঁচটায়– রাত বুঝি ঝক্‌ঝকে কুঁড়েমির পালিশে। বিছানায় প’ড়ে তাই দেয় হাততালি সে।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) সময়হারা যত ঘণ্টা , যত মিনিট , সময় আছে যত           শেষ যদি হয় চিরকালের মতো , তখন স্কুলে নেই বা গেলেম ; কেউ যদি কয় মন্দ ,           আমি বলব , ' দশটা বাজাই বন্ধ । '                    তাধিন তাধিন তাধিন ।                 শুই নে বলে রাগিস যদি , আমি বলব তোরে ,                     ' রাত না হলে রাত হবে কী করে । নটা বাজাই থামল যখন , কেমন করে শুই ?                     দেরি বলে নেই তো মা কিচ্ছুই । '                    তাধিন তাধিন তাধিন ।       যত জানিস রূপকথা , মা , সব যদি যাস বলে           রাত হবে না , রাত যাবে না চলে ; সময় যদি ফুরোয় তবে ফুরোয় না তো খেলা ,           ফুরোয় না তো গল্প বলার বেলা ।                    তাধিন তাধিন তাধিন ।   (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ) সমাপন আজ আমি কথা কহিব না।         আর আমি গান গাহিব না। হেরো আজি ভোরবেলা এসেছে রে মেলা লোক,         ঘিরে আছে চারি দিকে         চেয়ে আছে অনিমিখে, হেরে মোর হাসিমুখ ভুলে গেছে দুখশোক।         আজ আমি গান গাহিব না।সকাতরে গান গেয়ে পথপানে চেয়ে চেয়ে         এদের ডেকেছি দিবানিশি। ভেবেছিনু মিছে আশা, বোঝে না আমার ভাষা,         বিলাপ মিলায় দিশি দিশি। কাছে এরা আসিত না, কোলে বসে হাসিত না,         ধরিতে চকিতে হত লীন। মরমে বাজিত ব্যথা--সাধিলে না কহে কথা--         সাধিতে শিখি নি এতদিন। দিত দেখা মাঝে মাঝে, দূরে যেন বাঁশি বাজে,         আভাস শুনিনু যেন হায়। মেঘে কভু পড়ে রেখা, ফুলে কভু দেয় দেখা,         প্রাণে কভু বহে চলে যায়।        আজ তারা এসেছে রে কাছে         এর চেয়ে শোভা কিবা আছে। কেহ নাহি করে ডর, কেহ নাহি ভাবে পর,         সবাই আমাকে ভালোবাসে         আগ্রহে ঘিরিছে চারি পাশে।        এসেছিস তোরা যত জনা,         তোদের কাহিনী আজি শোনা। যার যত কথা আছে খুলে বল্‌ মোর কাছে,         আজ আমি কথা কহিব না ।আয় তুই কাছে আয়, তোরে মোর প্রাণ চায়,         তোর কাছে শুধু বসে রই।         দেখি শুধু, কথা নাহি কই। ললিত পরশে তোর পরানে লাগিছে ঘোর,         চোখে তোর বাজে বেণুবীণা--         তুই মোরে গান শুনাবি না? জেগেছে নূতন প্রাণ, বেজেছে নূতন গান,         ওই দেখ পোহায়েছে রাতি। আমারে বুকেতে নে রে, কাছে আয়--আমি যে রে         নিখিলের খেলাবার সাথী। চারি দিকে সৌরভ, চারি দিকে গীতরব,         চারি দিকে সুখ আর হাসি, চারি দিকে শিশুগুলি মুখে আধো আধো বুলি,         চারি দিকে স্নেহপ্রেমরাশি! আমারে ঘিরেছে কারা, সুখেতে করেছে সারা,         জগতে হয়েছে হারা প্রাণের বাসনা।         আর আমি কথা কহিব না--         আর আমি গান গাহিব না। সমাপ্তি যদিও বসন্ত গেছে তবু বারে বারে সাধ যায় বসন্তের গান গাহিবারে। সহসা পঞ্চম রাগ আপনি সে বাজে, তখনি থামাতে চাই শিহরিয়া লাজে। যত-না মধুর হোক মধুরসাবেশ যেখানে তাহার সীমা সেথা করো শেষ। যেখানে আপনি থামে যাক থেমে গীতি, তার পরে থাক্‌ তার পরিপূর্ণ স্মৃতি। পূর্ণতারে পূর্ণতর করিবারে, হায়, টানিয়া কোরো না ছিন্ন বৃথা দুরাশায়! নিঃশব্দে দিনের অন্তে আসে অন্ধকার, তেমনি হউক শেষ শেষ যা হবার। আসুক বিষাদভরা শান্ত সান্ত্বনায় মধুরমিলন-অন্তে সুন্দর বিদায়।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) সমালোচক বাবা নাকি বই লেখে সব নিজে। কিছুই বোঝা যায় না লেখেন কী যে! সেদিন পড়ে শোনাচ্ছিলেন তোরে, বুঝেছিলি? - বল্‌ মা, সত্যি করে।         এমন লেখায় তবে         বল্‌ দেখি কী হবে।।তোর মুখে মা, যেমন কথা শুনি তেমন কেন লেখেন নাকো উনি। ঠাকুরমা কি বাবাকে কক্‌খনো রাজার কথা শোনায় নিকো কোনো?         সে-সব কথাগুলি         গেছেন বুঝি ভুলি?স্নান করতে বেলা হল দেখে তুমি কেবল যাও, মা, ডেকে ডেকে - খাবার নিয়ে তুমি বসেই থাকো, সে কথা তাঁর মনেই থাকে নাকো।         করেন সারা বেলা         লেখা-লেখা খেলা।।বাবার ঘরে আমি খেলতে গেলে তুমি আমায় বল 'দুষ্টু' ছেলে! বকো আমায় গোল করলে পরে, 'দেখছিস নে লিখছে বাবা ঘরে!'         বল্‌ তো, সত্যি বল্‌ ,         লিখে কী হয় ফল।।আমি যখন বাবার খাতা টেনে লিখি বসে দোয়াত কলম এনে - ক খ গ ঘ ঙ হ য ব র, আমার বেলা কেন, মা, রাগ কর!         বাবা যখন লেখে         কথা কও না দেখে।।বড়ো বড়ো রুল-কাটা কাগোজ নষ্ট বাবা করেন না কি রোজ? আমি যদি নৌকো করতে চাই অম্‌নি বল 'নষ্ট করতে নাই'।         সাদা কাগজে কালো         করলে বুঝি ভালো ?  (শিশু কাব্যগ্রন্থ) সমালোচক (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) কানা-কড়ি পিঠ তুলি কহে টাকাটিকে, তুমি ষোলো আনা মাত্র, নহ পাঁচ সিকে। টাকা কয়, আমি তাই, মূল্য মোর যথা, তোমার যা মূল্য তার ঢের বেশি কথা।    (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) সমুখে শান্তিপারাবার সমুখে শান্তিপারাবার, ভাসাও তরণী হে কর্ণধার। তুমি হবে চিরসাথি, লও লও হে ক্রোড় পাতি, অসীমের পথে জ্বলিবে জ্যোতি ধ্রুবতারকার।মুক্তিদাতা, তোমার ক্ষমা, তোমার দয়া হবে চিরপাথেয় চিরযাত্রার।হয় যেন মর্ত্যের বন্ধন ক্ষয়, বিরাট বিশ্ব বাহু মেলি লয়, পায় অন্তরে নির্ভয় পরিচয় মহা-অজানার।    (শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থ) সমুদ্র কিসের অশান্তি এই মহাপারাবারে , সতত ছিঁড়িতে চাহে কিসের বন্ধন ! অব্যক্ত অস্ফুট বাণী ব্যক্ত করিবারে শিশুর মতন সিন্ধু করিছে ক্রন্দন । যুগযুগান্তর ধরি যোজন যোজন ফুলিয়া ফুলিয়া উঠে উত্তাল উচ্ছ্বাস — অশান্ত বিপুল প্রাণ করিছে গর্জন , নীরবে শুনিছে তাই প্রশান্ত আকাশ । আছাড়ি চূর্ণিতে চাহে সমগ্র হৃদয় কঠিন পাষাণময় ধরণীর তীরে , জোয়ারে সাধিতে চায় আপন প্রলয় , ভাঁটায় মিলাতে চায় আপনার নীরে । অন্ধ প্রকৃতির হৃদে মৃত্তিকায় বাঁধা । সতত দুলিছে ওই অশ্রুর পাথার , উন্মুখী বাসনা পায় পদে পদে বাধা , কাঁদিয়া ভাসাতে চাহে জগৎ-সংসার । সাগরের কণ্ঠ হতে কেড়ে নিয়ে কথা সাধ যায় ব্যক্ত করি মানবভাষায় — শান্ত করে দিই ওই চির-ব্যাকুলতা , সমুদ্রবায়ুর ওই চির হায়-হায় । সাধ যায় মোর গীতে দিবস-রজনী ধ্বনিবে পৃথিবী-ঘেরা সংগীতের ধ্বনি ।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) সম্মিলন সেথায় কপোত-বধূ লতার আড়ালে দিবানিশি গাহে শুধু প্রেমের বিলাপ । নবীন চাঁদের করে একটি হরিণী আমাদের গৃহদ্বারে আরামে ঘুমায় । তার শান্ত নিদ্রাকালে নিশ্বাস পতনে প্রহর গণিতে পারি স্তব্ধ রজনীর । সুখের আবাসে সেই কাটাব জীবন , দুজনে উঠিব মোরা , দুজনে বসিব , নীল আকাশের নীচে ভ্রমিব দুজনে , বেড়াইব মাঠে মাঠে উঠিব পর্বতে সুনীল আকাশ যেথা পড়েছে নামিয়া । অথবা দাঁড়াব মোরা সমুদ্রের তটে , উপলমণ্ডিত সেই স্নিগ্ধ উপকূল তরঙ্গের চুম্বনেতে উচছ্বাসে মাতিয়া থর থর কাঁপে আর জ্বল ' জ্বল ' জ্বলে! যত সুখ আছে সেথা আমাদের হবে , আমরা দুজনে সেথা হব দুজনের , অবশেষে বিজন সে দ্বীপের মাঝারে ভালোবাসা , বেঁচে থাকা , এক হ ' য়ে যাবে । মধ্যাহ্নে যাইব মোরা পর্বতগুহায় , সে প্রাচীন শৈল-গুহা স্নেহের আদরে অবসান রজনীর মৃদু জোছনারে রেখেছে পাষাণ কোলে ঘুম পাড়াইয়া । প্রচ্ছন্ন আঁধারে সেথা ঘুম আসি ধীরে হয়তো হরিবে তোর নয়নের আভা । সে ঘুম অলস প্রেমে শিশিরের মতো । সে ঘুম নিভায়ে রাখে চুম্বন-অনল আবার নূতন করি জ্বালাবার তরে । অথবা বিরলে সেথা কথা কব মোরা , কহিতে কহিতে কথা , হৃদয়ের ভাব এমন মধুর স্বরে গাহিয়া উঠিবে আর আমাদের মুখে কথা ফুটিবে না । মনের সে ভাবগুলি কথায় মরিয়া আমাদের চোখে চোখে বাঁচিয়া উঠিবে! চোখের সে কথাগুলি বাক্যহীন মনে ঢালিবে অজস্র স্রোতে নীরব সংগীত , মিলিবেক চৌদিকের নীরবতা সনে । মিশিবেক আমাদের নিশ্বাসে নিশ্বাসে । আমাদের দুই হৃদি নাচিতে থাকিবে , শোণিত বহিবে বেগে দোঁহার শিরায় । মোদের অধর দুটি কথা ভুলি গিয়া ক ' বে শুধু উচছ্বসিত চুম্বনের ভাষা । দুজনে দুজন আর রব না আমরা , এক হয়ে যাব মোরা দুইটি শরীরে । দুইটি শরীর ? আহা তাও কেন হল ? যেমন দুইটি উল্কা জ্বলন্ত শরীর , ক্রমশ দেহের শিখা করিয়া বিস্তার স্পর্শ করে , মিশে যায় , এক দেহ ধরে , চিরকাল জ্বলে তবু ভস্ম নাহি হয় , দুজনেরে গ্রাস করি দোঁহে বেঁচে থাকে ; মোদের যমক-হৃদে একই বাসনা , দণ্ডে দণ্ডে পলে পলে বাড়িয়া বাড়িয়া , তেমনি মিলিয়া যাবে অনন্ত মিলন । এক আশা রবে শুধু দুইটি ইচছার এই ইচছা রবে শুধু দুইটি হৃদয়ে , একই জীবন আর একই মরণ , একই স্বরগ আর একই নরক , এক অমরতা কিংবা একই নির্বাণ , হায় হায় এ কী হল এ কী হল মোর! আমার হৃদয় চায় উধাও উড়িয়া প্রেমের সুদূর রাজ্যে করিতে ভ্রমণ , কিন্তু গুরুভার এই মরতের ভাষা চরণে বেঁধেছে তার লোহার শৃঙ্খল । নামি বুঝি , পড়ি বুঝি , মরি বুঝি মরি ।                                — Shelley (অনূদিত কবিতা) সর্দিকে সোজাসুজি সর্দি ব’লেই বুঝি সর্দিকে সোজাসুজি সর্দি ব’লেই বুঝি মেডিকেল বিজ্ঞান না শিখে। ডাক্তার দেয় শিষ, টাকা নিয়ে পঁয়ত্রিশ ভাবনায় গেল ঘুম, ওষুধের লাগে ধুম, শঙ্কা লাগালো পারিভাষিকে। আমি পুরাতন পাপী, শুনেই কাঁপি, ডরিনেকো সাদাসিধে ফাঁসিকে।শূন্য তবিল যবে, বলে “পাঁচনেই হবে’– চেতাইল এ ভারতবাসীকে। নর্‌স্‌কে ঠেকিয়ে দূরে যাই বিক্রমপুরে, সহায় মিলিল খাঁদুমাসিকে।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) সাঙ্গ হয়েছে রণ সাঙ্গ হয়েছে রণ। অনেক যুঝিয়া অনেক খুঁজিয়া শেষ হল আয়োজন। তুমি এসো এসো নারী, আনো তব হেমঝারি। ধুয়ে-মুছে দাও ধূলির চিহ্ন, জোড়া দিয়ে দাও ভগ্ন-ছিন্ন, সুন্দর করো সার্থক করো পুঞ্জিত আয়োজন। এসো সুন্দরী নারী, শিরে লয়ে হেমঝারি।হাটে আর নাই কেহ। শেষ করে খেলা ছেড়ে এনু মেলা, গ্রামে গড়িলাম গেহ। তুমি এসো এসো নারী, আনো গো তীর্থবারি। স্নিগ্ধহসিত বদন-ইন্দু, সিঁথায় আঁকিয়া সিঁদুর-বিন্দু মঙ্গল করো সার্থক করো শূন্য এ মোর গেহ। এসো কল্যাণী নারী, বহিয়া তীর্থবারি।বেলা কত যায় বেড়ে। কেহ নাহি চাহে খররবিদাহে পরবাসী পথিকেরে। তুমি এসো এসো নারী, আনো তব সুধাবারি। বাজাও তোমার নিষ্কলঙ্ক শত-চাঁদে-গড়া শোভন শঙ্খ, বরণ করিয়া সার্থক করো পরবাসী পথিকেরে। আনন্দময়ী নারী, আনো তব সুধাবারি।স্রোতে যে ভাসিল ভেলা। এবারের মতো দিন হল গত এল বিদায়ের বেলা। তুমি এসো এসো নারী, আনো গো অশ্রুবারি। তোমার সজল কাতর দৃষ্টি পথে করে দিক করুণাবৃষ্টি, ব্যাকুল বাহুর পরশে ধন্য হোক বিদায়ের বেলা। অয়ি বিষাদিনী নারী, আনো গো অশ্রুবারি।আঁধার নিশীথরাতি। গৃহ নির্জন, শূন্য শয়ন, জ্বলিছে পূজার বাতি। তুমি এসো এসো নারী, আনো তর্পণবারি। অবারিত করি ব্যথিত বক্ষ খোলো হৃদয়ের গোপন কক্ষ, এলো-কেশপাশে শুভ্র-বসনে জ্বালাও পূজার বাতি। এসো তাপসিনী নারী, আনো তর্পণবারি।  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) সাজ এই-যে রাঙা চেলি দিয়ে তোমায় সাজানো, ওই-যে হোথায় দ্বারের কাছে সানাই বাজানো,            অদৃশ্য এক লিপির লিখায়            নবীন প্রাণের কোন্‌ ভূমিকায়                          মিলছে, না জানো।শিশুবেলায় ধূলির 'পরে আঁচল এলিয়ে সাজিয়ে পুতুল কাটল বেলা খেলা খেলিয়ে।            বুঝতে নাহি পারবে আজো            আজ কী খেলায় আপনি সাজো                          হৃদয় মেলিয়ে।অখ্যাত এই প্রাণের কোণে সন্ধ্যাবেলাতে বিশ্বখেলোয়াড়ের খেয়াল নামল খেলাতে।            দুঃখসুখের তুফান লেগে            পুতুল-ভাসান চলল বেগে                          ভাগ্যভেলাতে।তার পরেতে ভোলার পালা, কথা কবে না-- অসীম কালের পটে ছবির চিহ্ন রবে না।            তার পরেতে জিতবে ধুলো,            ভাঙা খেলার চিহ্নগুলো                          সঙ্গে লবে না।রাঙা রঙের চেলি দিয়ে কন্যে সাজানো, দ্বারের কাছে বেহাগ রাগে সানাই বাজানো,            এই মানে তার বুঝতে পারি--            খেয়াল যাঁহার খুশি তাঁরি                          জানো না-জানো। সাড়ে নটা সাড়ে নটা বেজেছে ঘড়িতে;          সকালের মৃদু শীতে      তন্দ্রাবেশে হাওয়া যেন রোদ পোহাইতেছে          পাহাড়ের উপত্যকা-নিচে               বনের মাথায়          সবুজের আমন্ত্রণ-বিছানো পাতায়।      বৈঠকখানার ঘরের রেড়িয়োতে               সমুদ্রপারের দেশ হতে          আকাশে প্লাবন আনে সুরের প্রবাহে,      বিদেশিনী বিদেশের কণ্ঠে গান গাহে               বহু যোজনের অন্তরালে। সব তার লুপ্ত হয়ে মিলেছে কেবল সুরে তালে।          দেহহীন পরিবেশহীন               গীতস্পর্শ হতেছে বিলীন                    সমস্ত চেতনা ছেয়ে।           যে বেলাটি বেয়ে                    এল তার সাড়া     সে আমার দেশের সময়-সূত্র-ছাড়া। একাকিনী, বহি রাগিণীর দীপশিখা                আসিছে অভিসারিকা                    সর্বভারহীনা;   অরূপা সে, অলক্ষিত আলোকে আসীনা।          গিরিনদীসমুদ্রের মানে নি নিষেধ,                    করিয়াছে ভেদ          পথে পথে বিচিত্র ভাষার কলরব, পদে পদে জন্ম-মৃত্যু বিলাপ-উৎসব।          রণক্ষেত্রে নিদারুণ হানাহানি, লক্ষ লক্ষ গৃহকোণে সংসারের তুচ্ছ কানাকানি,               সমস্ত সংসর্গ তার          একান্ত করেছে পরিহার।                    বিশ্বহারা      একখানি নিরাসক্ত সংগীতের ধারা।          যক্ষের বিরহগাথা মেঘদূত                    সেও জানি এমনিই অদ্ভুত।            বাণীমূর্তি সেও একা। শুধু নামটুকু নিয়ে কবির কোথাও নেই দেখা।                    তার পাশে চুপ          সেকালের সংসারের সংখ্যাহীন রূপ। সেদিনের যে প্রভাতে উজ্জয়িনী ছিল সমুজ্জ্বল                    জীবনে উচ্ছল          ওর মাঝে তার কোনো আলো পড়ে নাই। রাজার প্রতাপ সেও ওর ছন্দে সম্পূর্ণ বৃথাই।             যুগ যুগ হয়ে এল পার কালের বিপ্লব বেয়ে, কোনো চিহ্ন আনে নাই তার।          বিপুল বিশ্বের মুখরতা উহার শ্লোকের পটে স্তব্ধ করে দিল সব কথা। সাত ভাই চম্পা সাতটি চাঁপা সাতটি গাছে,            সাতটি চাঁপা ভাই— রাঙা - বসন পারুলদিদি,            তুলনা তার নাই। সাতটি সোনা চাঁপার মধ্যে            সাতটি সোনা মুখ, পারুলদিদির কচি মুখটি            করতেছে টুক্‌টুক্‌। ঘুমটি ভাঙে পাখির ডাকে,            রাতটি যে পোহালো— ভোরের বেলা চাঁপায় পড়ে            চাঁপার মতো আলো। শিশির দিয়ে মুখটি মেজে            মুখখানি বের করে কী দেখছে সাত ভায়েতে            সারা সকাল ধ'রে। দেখছে চেয়ে ফুলের বনে            গোলাপ ফোটে - ফোটে, পাতায় পাতায় রোদ পড়েছে,             চিক্‌চিকিয়ে ওঠে। দোলা দিয়ে বাতাস পালায়            দুষ্টু ছেলের মতো, লতায় পাতায় হেলাদোলা            কোলাকুলি কত। গাছটি কাঁপে নদীর ধারে            ছায়াটি কাঁপে জলে— ফুলগুলি সব কেঁদে পড়ে            শিউলি গাছের তলে। ফুলের থেকে মুখ বাড়িয়ে            দেখতেছে ভাই বোন— দুখিণী এক মায়ের তরে            আকুল হল মন। সারাটা দিন কেঁপে কেঁপে            পাতার ঝুরুঝুরু, মনের সুখে বনের যেন            বুকের দুরুদুরু। কেবল শুনি কুলুকুলু            একি ঢেউয়ের খেলা। বনের মধ্যে ডাকে ঘুঘু            সারা দুপুরবেলা। মৌমাছি সে গুনগুনিয়ে            খুঁজে বেড়ায় কাকে, ঘাসের মধ্যে ঝিঁ ঝিঁ করে            ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকে। ফুলের পাতায় মাথা রেখে            শুনতেছে ভাই বোন— মায়ের কথা মনে পড়ে,            আকুল করে মন। মেঘের পানে চেয়ে দেখে—            মেঘ চলেছে ভেসে, রাজহাঁসেরা উড়ে উড়ে             চলেছে কোন্‌ দেশে। প্রজাপতির বাড়ি কোথায়            জানে না তো কেউ, সমস্ত দিন কোথায় চলে            লক্ষ হাজার ঢেউ। দুপুর বেলা থেকে থেকে            উদাস হল বায়, শুকনো পাতা খ'সে প'ড়ে            কোথায় উড়ে যায়! ফুলের মাঝে দুই গালে হাত            দেখতেছে ভাই বোন— মায়ের কথা পড়ছে মনে,            কাঁদছে পরান মন। সন্ধে হলে জোনাই জ্বলে            পাতায় পাতায়, অশথ গাছে দুটি তারা            গাছের মাথায়। বাতাস বওয়া বন্ধ হল,            স্তব্ধ পাখির ডাক, থেকে থেকে করছে কা - কা            দুটো - একটা কাক। পশ্চিমেতে ঝিকিমিকি,            পুবে আঁধার করে— সাতটি ভায়ে গুটিসুটি            চাঁপা ফুলের ঘরে। ‘গল্প বলো পারুলদিদি'            সাতটি চাঁপা ডাকে, পারুলদিদির গল্প শুনে            মনে পড়ে মাকে। প্রহর বাজে, রাত হয়েছে,             ঝাঁ ঝাঁ করে বন— ফুলের মাঝে ঘুমিয়ে প'ল              আটটি ভাই বোন। সাতটি তারা চেয়ে আছে             সাতটি চাঁপার বাগে, চাঁদের আলো সাতটি ভায়ের             মুখের পরে লাগে। ফুলের গন্ধ ঘিরে আছে             সাতটি ভায়ের তনু— কোমন শয্যা কে পেতেছে             সাতটি ফুলের রেণু। ফুলের মধ্যে সাত ভায়েতে              স্বপ্ন দেখে মাকে— সকাল বেলা ‘জাগো জাগো'             পারুলদিদি ডাকে। (শিশু কাব্যগ্রন্থ) সাত সমুদ্র পারে দেখছ না কি , নীল মেঘে আজ           আকাশ অন্ধকার । সাত সমুদ্র তেরো নদী           আজকে হব পার । নাই গোবিন্দ , নাই মুকুন্দ ,           নাইকো হরিশ খোঁড়া । তাই ভাবি যে কাকে আমি           করব আমার ঘোড়া ।       কাগজ ছিঁড়ে এনেছি এই             বাবার খাতা থেকে , নৌকো দে - না বানিয়ে , অমনি           দিস , মা , ছবি এঁকে । রাগ করবেন বাবা বুঝি           দিল্লি থেকে ফিরে ? ততক্ষণ যে চলে যাব           সাত সমুদ্র তীরে ।       এমনি কি তোর কাজ আছে , মা ,           কাজ তো রোজই থাকে । বাবার চিঠি এক্‌খুনি কি           দিতেই হবে ডাকে ? নাই বা চিঠি ডাকে দিলে           আমার কথা রাখো , আজকে না হয় বাবার চিঠি           মাসি লিখুন - নাকো !   আমার এ যে দরকারি কাজ           বুঝতে পার না কি ? দেরি হলেই একেবারে           সব যে হবে ফাঁকি ।   মেঘ কেটে যেই রোদ উঠবে           বৃষ্টি বন্ধ হলে , সাত সমুদ্র তেরো নদী           কোথায় যাবে চলে !    (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ) সাধ অরুণময়ী তরুণী উষা         জাগায়ে দিল গান। পুরব মেঘে কনকমুখী বারেক শুধু মারিল উঁকি, অমনি যেন জগৎ ছেয়ে         বিকশি উঠে প্রাণ। কাহার হাসি বহিয়া এনে         করিলি সুধা দান। ফুলেরা সব চাহিয়া আছে        আকাশপানে মগন-মনা,        মুখেতে মৃদু বিমল হাসি        নয়নে দুটি শিশির-কণা। আকাশ-পারে কে যেন ব'সে,        তাহারে যেন দেখিতে পায়, বাতাসে দুলে বাহুটি তুলে        মায়ের কোলে ঝাঁপিতে যায়। কী যেন দেখে, কী যেন শোনে--        কে যেন ডাকে, কে যেন গায়-- ফুলের সুখ, ফুলের হাসি        দেখিবি তোরা আয় রে আয়। আ মরি মরি অমনি যদি        ফুলের মতো চাহিতে পারি। বিমল প্রাণে বিমল সুখে বিমল প্রাতে বিমল মুখে ফুলের মতো অমনি যদি        বিমল হাসি হাসিতে পারি। দুলিছে, মরি, হরষ-স্রোতে,        অসীম স্নেহে আকাশ হতে কে যেন তারে খেতেছে চুমো,        কোলেতে তারি পড়িছে লুটে। কে যেন তারি নামটি ধ’রে ডাকিছে তারে সোহাগ ক'রে শুনিতে পেয়ে ঘুমের ঘোরে        মুখটি ফুটে হাসিটি ফোটে, শিশুর প্রাণে সুখের মতো        সুবাসটুকু জাগিয়া ওঠে। আকাশ পানে চাহিয়া থাকে,        না জানি তাহে কী সুখ পায়। বলিতে যেন শেখে নি কিছু,        কী যেন তবু বলিতে চায়। আঁধার কোণে থাকিস তোরা,        জানিস কি রে কত সে সুখ, আকাশপানে চাহিলে পরে        আকাশপানে তুলিলে মুখ। সুদূর দূর, সুনীল নীল,        সুদূরে পাখি উড়িয়া যায়। সুনীল দূরে ফুটিছে তারা,        সুদূর হতে আসিছে বায়। প্রভাতকরে করি রে স্নান         ঘুমাই ফুলবাসে, পাখির গান লাগে রে যেন        দেহের চারি পাশে। বাতাস যেন প্রাণের সখা, প্রবাসে ছিল, নতুন দেখা, ছুটিয়া আসে বুকের কাছে         বারতা শুধাইতে। চাহিয়া আছে আমার মুখে, কিরণময় আমারি সুখে আকাশ যেন আমারি তরে         রয়েছে বুক পেতে। মনেতে করি আমারি যেন         আকাশ-ভরা প্রাণ, আমারি প্রাণ হাসিতে ছেয়ে জাগিছে উষা তরুণ মেয়ে, করুণ আঁখি করিছে প্রাণে         অরুণসুধা দান। আমারি বুকে প্রভাতবেলা ফুলেরা মিলি করিছে খেলা, হেলিছে কত, দুলিছে কত,         পুলকে ভরা মন, আমারি তোরা বালিকা মেয়ে         আমারি স্নেহধন। আমারি মুখে চাহিয়া তোর         আঁখিটি ফুটিফুটি। আমারি বুকে আলয় পেয়ে         হাসিয়া কুটিকুটি। কেন রে বাছা, কেন রে হেন         আকুল কিলিবিলি, কী কথা যেন জানাতে চাস         সবাই মিলি মিলি। হেথায় আমি রহিব বসে         আজি সকালবেলা নীরব হয়ে দেখিব চেয়ে         ভাইবোনের খেলা। বুকের কাছে পড়িবি ঢলে         চাহিবি ফিরে ফিরে, পরশি দেহে কোমলদল স্নেহেতে চোখে আসিবে জল, শিশিরসম তোদের ‘পরে         ঝরিবে ধীরে ধীরে।হৃদয় মোর আকাশ-মাঝে তারার মতো উঠিতে চায়, আপন সুখে ফুলের মতো আকাশপানে ফুটিতে চায়। নিবিড় রাতে আকাশে উঠে চারি দিকে সে চাহিতে চায়, তারার মাঝে হারায়ে গিয়ে আপন মনে গাহিতে চায়। মেঘের মতো হারায় দিশা আকাশ-মাঝে ভাসিতে চায়-- কোথায় যাবে কিনারা নাই, দিবসনিশি চলেছে তাই বাতাস এসে লাগিছে গায়ে, জোছনা এসে পড়িছে পায়ে, উড়িয়া কাছে গাহিছে পাখি, মুদিয়া যেন এসেছে আঁখি, আকাশ-মাঝে মাথাটি থুয়ে আরামে যেন ভাসিয়া যায়, হৃদয় মোর মেঘের মতো আকাশ-মাঝে ভাসিতে চায়। ধরার পানে মেলিয়া আঁখি উষার মতো হাসিতে চায়। জগৎ-মাঝে ফেলিতে পা চরণ যেন উঠিছে না, শরমে যেন হাসিছে মৃদু হাস, হাসিটি যেন নামিল ভুঁয়ে, জাগায়ে দিল ফুলেরে ছুঁয়ে, মালতীবধূ হাসিয়া তারে         করিল পরিহাস। মেঘেতে হাসি জড়ায়ে যায়, বাতাসে হাসি গড়ায়ে যায়, উষার হাসি--ফুলের হাসি-- কানন-মাঝে ছড়ায়ে যায়। হৃদয় মোর আকাশে উঠে উষার মতো হাসিতে চায়। সাধারণ মেয়ে আমি অন্তঃপুরের মেয়ে,            চিনবে না আমাকে। তোমার শেষ গল্পের বইটি পড়েছি, শরৎবাবু,                "বাসি ফুলের মালা'। তোমার নায়িকা এলোকেশীর মরণ-দশা ধরেছিল                পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে। পঁচিশ বছর বয়সের সঙ্গে ছিল তার রেষারেষি,         দেখলেম তুমি মহদাশয় বটে--                জিতিয়ে দিলে তাকে।     নিজের কথা বলি। বয়স আমার অল্প।     একজনের মন ছুঁয়েছিল            আমার এই কাঁচা বয়সের মায়া।         তাই জেনে পুলক লাগত আমার দেহে--     ভুলে গিয়েছিলেম, অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে আমি। আমার মতো এমন আছে হাজার হাজার মেয়ে,         অল্পবয়সের মন্ত্র তাদের যৌবনে।         তোমাকে দোহাই দিই, একটি সাধারণ মেয়ের গল্প লেখো তুমি।            বড়ো দুঃখ তার।         তারও স্বভাবের গভীরে অসাধারণ যদি কিছু তলিয়ে থাকে কোথাও            কেমন করে প্রমাণ করবে সে,         এমন কজন মেলে যারা তা ধরতে পারে। কাঁচা বয়সের জাদু লাগে ওদের চোখে,         মন যায় না সত্যের খোঁজে,     আমরা বিকিয়ে যাই মরীচিকার দামে।     কথাটা কেন উঠল তা বলি।         মনে করো তার নাম নরেশ। সে বলেছিল কেউ তার চোখে পড়ে নি আমার মতো।     এতবড়ো কথাটা বিশ্বাস করব যে সাহস হয় না,            না করব যে এমন জোর কই।     একদিন সে গেল বিলেতে।            চিঠিপত্র পাই কখনো বা।     মনে মনে ভাবি, রাম রাম! এত মেয়েও আছে সে দেশে,            এত তাদের ঠেলাঠেলি ভিড়!         আর তারা কি সবাই অসামান্য--                এত বুদ্ধি, এত উজ্জ্বলতা।     আর তারা সবাই কি আবিষ্কার করেছে এক নরেশ সেনকে            স্বদেশে যার পরিচয় চাপা ছিল দশের মধ্যে।     গেল মেলের চিঠিতে লিখেছে            লিজির সঙ্গে গিয়েছিল সমুদ্রে নাইতে--         বাঙালি কবির কবিতা ক' লাইন দিয়েছে তুলে            সেই যেখানে উর্বশী উঠছে সমুদ্র থেকে--                তার পরে বালির 'পরে বসল পাশাপাশি--     সামনে দুলছে নীল সমুদ্রের ঢেউ,                আকাশে ছড়ানো নির্মল সূর্যালোক।         লিজি তাকে খুব আস্তে আস্তে বললে,     "এই সেদিন তুমি এসেছ, দুদিন পরে যাবে চলে;            ঝিনুকের দুটি খোলা,                মাঝখানটুকু ভরা থাক্‌         একটি নিরেট অশ্রুবিন্দু দিয়ে--            দুর্লভ, মূল্যহীন।'         কথা বলবার কী অসামান্য ভঙ্গি। সেইসঙ্গে নরেশ লিখেছে,     "কথাগুলি যদি বানানো হয় দোষ কী,            কিন্তু চমৎকার-- হীরে-বসানো সোনার ফুল কি সত্য, তবুও কি সত্য নয়।'            বুঝতেই পারছ একটা তুলনার সংকেত ওর চিঠিতে অদৃশ্য কাঁটার মতো     আমার বুকের কাছে বিঁধিয়ে দিয়ে জানায়--            আমি অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে।     মূল্যবানকে পুরো মূল্য চুকিয়ে দিই         এমন ধন নেই আমার হাতে।     ওগো, নাহয় তাই হল,         নাহয় ঋণীই রইলেম চিরজীবন। পায়ে পড়ি তোমার, একটা গল্প লেখো তুমি শরৎবাবু,         নিতান্তই সাধারণ মেয়ের গল্প-- যে দুর্ভাগিনীকে দূরের থেকে পাল্লা দিতে হয়         অন্তত পাঁচ-সাতজন অসামান্যার সঙ্গে--            অর্থাৎ, সপ্তরথিনীর মার। বুঝে নিয়েছি আমার কপাল ভেঙেছে,         হার হয়েছে আমার। কিন্তু তুমি যার কথা লিখবে         তাকে জিতিয়ে দিয়ো আমার হয়ে,            পড়তে পড়তে বুক যেন ওঠে ফুলে।     ফুলচন্দন পড়ুক তোমার কলমের মুখে।         তাকে নাম দিয়ো মালতী।            ওই নামটা আমার।            ধরা পড়বার ভয় নেই।     এমন অনেক মালতী আছে বাংলাদেশে,            তারা সবাই সামান্য মেয়ে।                তারা ফরাসি জর্মান জানে না,                    কাঁদতে জানে।            কী করে জিতিয়ে দেবে।     উচ্চ তোমার মন, তোমার লেখনী মহীয়সী।         তুমি হয়তো ওকে নিয়ে যাবে ত্যাগের পথে,            দুঃখের চরমে, শকুন্তলার মতো।                দয়া কোরো আমাকে।            নেমে এসো আমার সমতলে।         বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাত্রির অন্ধকারে দেবতার কাছে যে অসম্ভব বর মাগি--            সে বর আমি পাব না, কিন্তু পায় যেন তোমার নায়িকা।     রাখো-না কেন নরেশকে সাত বছর লণ্ডনে,         বারে বারে ফেল করুক তার পরীক্ষায়,            আদরে থাক্‌ আপন উপাসিকামণ্ডলীতে।        ইতিমধ্যে মালতী পাস করুক এম.এ.                কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে,         গণিতে হোক প্রথম তোমার কলমের এক আঁচড়ে।            কিন্তু ওইখানেই যদি থাম তোমার সাহিত্যসম্রাট নামে পড়বে কলঙ্ক।     আমার দশা যাই হোক         খাটো কোরো না তোমার কল্পনা।     তুমি তো কৃপণ নও বিধাতার মতো। মেয়েটাকে দাও পাঠিয়ে য়ুরোপে।     সেখানে যারা জ্ঞানী, যারা বিদ্বান, যারা বীর,            যারা কবি, যারা শিল্পী, যারা রাজা,            দল বেঁধে আসুক ওর চার দিকে। জ্যোতির্বিদের মতো আবিষ্কার করুক ওকে--            শুধু বিদুষী ব'লে নয়, নারী ব'লে। ওর মধ্যে যে বিশ্বজয়ী জাদু আছে     ধরা পড়ুক তার রহস্য, মূঢ়ের দেশে নয়--         যে দেশে আছে সমজদার, আছে দরদি,                আছে ইংরেজ জর্মান ফরাসি। মালতীর সম্মানের জন্য সভা ডাকা হোক-না,         বড়ো বড়ো নামজাদার সভা। মনে করা যাক সেখানে বর্ষণ হচ্ছে মুষলধারে চাটুবাক্য,         মাঝখান দিয়ে সে চলেছে অবহেলায়--                ঢেউয়ের উপর দিয়ে যেন পালের নৌকো।         ওর চোখ দেখে ওরা করছে কানাকানি, সবাই বলছে ভারতবর্ষের সজল মেঘ আর উজ্জ্বল রৌদ্র            মিলেছে ওর মোহিনী দৃষ্টিতে। (এইখানে জনান্তিকে বলে রাখি            সৃষ্টিকর্তার প্রসাদ সত্যই আছে আমার চোখে।                বলতে হল নিজের মুখেই,         এখনো কোনো য়ুরোপীয় রসজ্ঞের                সাক্ষাৎ ঘটে নি কপালে।)         নরেশ এসে দাঁড়াক সেই কোণে,     আর তার সেই অসামান্য মেয়ের দল।            আর তার পরে? তার পরে আমার নটেশাকটি মুড়োল,         স্বপ্ন আমার ফুরোল।            হায় রে সামান্য মেয়ে!                হায় রে বিধাতার শক্তির অপব্যয়! ------------------ ২৯ শ্রাবণ ১৩৩৯ পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থ সান্ত্বনা কোথা হতে দুই চক্ষে ভরে নিয়ে এলে জল     হে প্রিয় আমার। হে ব্যথিত, হে অশান্ত, বলো আজি গাব গান      কোন্‌ সান্ত্বনার।   হেথায় প্রান্তরপারে   নগরীর এক ধারে   সায়াহ্নের অন্ধকারে      জ্বালি দীপখানি   শূন্য গৃহে অন্যমনে   একাকিনী বাতায়নে   বসে আছি পুষ্পাসনে      বাসরের রানী-- কোথা বক্ষে বিঁধি কাঁটা ফিরিলে আপন নীড়ে      হে আমার পাখি। ওরে ক্লিষ্ট, ওরে ক্লান্ত, কোথা তোর বাজে ব্যথা,      কোথা তোরে রাখি।চারি দিকে তমস্বিনী রজনী দিয়েছে টানি     মায়ামন্ত্র-ঘের-- দুয়ার রেখেছি রুধি, চেয়ে দেখো কিছু হেথা     নাহি বাহিরের।   এ যে দুজনের দেশ,   নিখিলের সব শেষ,   মিলনের রসাবেশ     অনন্ত ভবন--   শুধু এই এক ঘরে   দুখানি হৃদয় ধরে,   দুজনে সৃজন করে     নূতন ভুবন। একটি প্রদীপ শুধু এ আঁধারে যতটুকু     আলো করে রাখে সেই আমাদের বিশ্ব, তাহার বাহিরে আর     চিনি না কাহাকে।একখানি বীণা আছে, কভু বাজে মোর বুকে     কভু তব কোরে। একটি রেখেছি মালা, তোমারে পরায়ে দিলে     তুমি দিবে মোরে।   এক শয্যা রাজধানী,   আধেক আঁচলখানি   বক্ষ হতে লয়ে টানি     পাতিব শয়ন।   একটি চুম্বন গড়ি   দোঁহে লব ভাগ করি--   এ রাজত্বে, মরি মরি,     এত আয়োজন। একটি গোলাপফুল রেখেছি বক্ষের মাঝে,     তব ঘ্রাণশেষে আমারে ফিরায়ে দিলে অধরে পরশি তাহা     পরি লব কেশে।আজ করেছিনু মনে তোমারে করিব রাজা     এই রাজ্যপাটে, এ অমর বরমাল্য আপনি যতনে তব     জড়াব ললাটে।   মঙ্গলপ্রদীপ ধ'রে   লইব বরণ করে,   পুষ্পসিংহাসন-'পরে       বসাব তোমায়--   তাই গাঁথিয়াছি হার,   আনিয়াছি ফুলভার,   দিয়েছি নূতন তার       কনকবীণায়। আকাশে নক্ষত্রসভা নীরবে বসিয়া আছে       শান্ত কৌতূহলে-- আজি কি এ মালাখানি সিক্ত হবে, হে রাজন্‌,       নয়নের জলে।রুদ্ধকণ্ঠ, গীতহারা, কহিয়ো না কোনো কথা,       কিছু শুধাব না-- নীরবে লইব প্রাণে তোমার হৃদয় হতে       নীরব বেদনা।   প্রদীপ নিবায়ে দিব,   বক্ষে মাথা তুলি নিব,   স্নিগ্ধ করে পরশিব       সজল কপোল--   বেণীমুক্ত কেশজাল   স্পর্শিবে তাপিত ভাল,   কোমল বক্ষের তাল       মৃদুমন্দ দোল। নিশ্বাসবীজনে মোর কাঁপিবে কুন্তল তব,       মুদিবে নয়ন-- অর্ধরাতে শান্তবায়ে নিদ্রিত ললাটে দিব       একটি চুম্বন। সামান্য ক্ষতি বহে মাঘমাসে শীতের বাতাস,           স্বচ্ছসলিলা বরুণা। পুরী হতে দূরে গ্রামে নির্জনে শিলাময় ঘাট চম্পকবনে, স্নানে চলেছেন শতসখীসনে           কাশীর মহিষী করুণা।সে পথ সে ঘাট আজি এ প্রভাতে           জনহীন রাজশাসনে। নিকটে যে ক'টি আছিল কুটির ছেড়ে গেছে লোক, তাই নদীতীর স্তব্ধ গভীর, কেবল পাখির           কূজন উঠিছে কাননে।আজি উতরোল উত্তর বায়ে           উতলা হয়েছে তটিনী। সোনার আলোক পড়িয়াছে জলে, পুলকে উছলি ঢেউ ছলছলে-- লক্ষ মানিক ঝলকি আঁচলে           নেচে চলে যেন নটিনী।কলকল্লোলে লাজ দিল আজ           নারী কণ্ঠের কাকলি। মৃণালভুজের ললিত বিলাসে চঞ্চলা নদী মাতে উল্লাসে, আলাপে প্রলাপে হাসি-উচ্ছ্বাসে           আকাশ উঠিল আকুলি।স্নান সমাপন করিয়া যখন           কূলে উঠে নারী সকলে মহিষী কহিলা, 'উহু! শীতে মরি, সকল শরীর উঠিছে শিহরি, জ্বেলে দে আগুন ওলো সহচরী--           শীত নিবারিব অনলে।'সখীগণ সবে কুড়াইতে কুটা চলিল কুসুমকাননে। কৌতুকরসে পাগলপরানী শাখা ধরি সবে করে টানাটানি, সহসা সবারে ডাক দিয়া রানী           কহে সহাস্য আননে--'ওলো তোরা আয়! ওই দেখা যায়           কুটির কাহার অদূরে, ওই ঘরে তোরা লাগাবি অনল, তপ্ত করিব করপদতল'-- এত বলি রানী রঙ্গে বিভল           হাসিয়া উঠিল মধুরে।কহিল মালতী সকরুণ অতি,           'একি পরিহাস রানীমা! আগুন জ্বালায়ে কেন দিবে নাশি? এ কুটির কোন্‌ সাধু সন্ন্যাসী কোন্‌ দীনজন কোন্‌ পরবাসী           বাঁধিয়াছে নাহি জানি মা!'রানী কহে রোষে, 'দূর করি দাও           এই দীনদয়াময়ীরে।' অতি দুর্দাম কৌতুকরত যৌবনমদে নিষ্ঠুর যত যুবতীরা মিলি পাগলের মতো           আগুন লাগালো কুটিরে।ঘন ঘোর ধূম ঘুরিয়া ঘুরিয়া           ফুলিয়া ফুলিয়া উড়িল। দেখিতে দেখিতে হুহু হুংকারি ঝলকে ঝলকে উল্কা উগারি শত শত লোল জিহ্বা প্রসারি           বহ্নি আকাশ জুড়িল।পাতাল ফুঁড়িয়া উঠিল যেন রে           জ্বালাময়ী যত নাগিনী। ফণা নাচাইয়া অম্বরপানে মাতিয়া উঠিল গর্জনগানে, প্রলয়মত্ত রমণীর কানে           বাজিল দীপক রাগিণী।প্রভাতপাখির আনন্দ গান           ভয়ের বিলাপে টুটিল-- দলে দলে কাক করে কোলাহল, উত্তরবায়ু হইল প্রবল, কুটির হইতে কুটিরে অনল           উড়িয়া উড়িয়া ছুটিল।ছোটো গ্রামখানি লেহিয়া লইল           প্রলয়লোলুপ রসনা। জনহীন পথে মাঘের প্রভাতে প্রমোদক্লান্ত শত সখী-সাথে ফিরে গেল রানী কুবলয় হাতে           দীপ্ত-অরুণ-বসনা।তখন সভায় বিচার-আসনে           বসিয়াছিলেন ভূপতি। গৃহহীন প্রজা দলে দলে আসে, দ্বিধাকম্পিত গদগদ ভাষে নিবেদিল দুঃখ সংকোচে ত্রাসে           চরণে করিয়া বিনতি।সভাসন ছাড়ি উঠি গেল রাজা           রক্তিমমুখ শরমে। অকালে পশিলা রানীর আগার-- কহিলা, 'মহিষী, একি ব্যবহার! গৃহ জ্বালাইলে অভাগা প্রজার           বলো কোন্‌ রাজধরমে!'রুষিয়া কহিল রাজার মহিষী,           'গৃহ কহ তারে কী বোধে! গেছে গুটিকত জীর্ণ কুটির, কতটুকু ক্ষতি হয়েছে প্রাণীর? কত ধন যায় রাজমহিষীর           এক প্রহরের প্রমোদে!'কহিলেন রাজা উদ্যত রোষ           রুধিয়া দীপ্ত হৃদয়ে-- 'যতদিন তুমি আছ রাজরানী দীনের কুটিরে দীনের কী হানি বুঝিতে নারিবে জানি তাহা জানি--           বুঝাব তোমারে নিদয়ে।'রাজার আদেশে কিংকরী আসি           ভূষণ ফেলিল খুলিয়া-- অরুণবরন অম্বরখানি নির্মম করে খুলে দিল টানি, ভিখারি নারীর চীরবাস আনি           দিল রানীদেহে তুলিয়া।পথে লয়ে তারে কহিলেন রাজা,           'মাগিবে দুয়ারে দুয়ারে-- এক প্রহরের লীলায় তোমার যে ক'টি কুটির হল ছারখার যত দিনে পার সে-ক'টি আবার           গড়ি দিতে হবে তোমারে।'বৎসরকাল দিলেম সময়,           তার পরে ফিরে আসিয়া সভায় দাঁড়ায়ে করিয়া প্রণতি সবার সমুখে জানাবে যুবতী হয়েছে জগতে কতটুকু ক্ষতি           জীর্ণ কুটির নাশিয়া।'২৫ আশ্বিন, ১৩০৬ সামান্য লোক সন্ধ্যাবেলা লাঠি কাঁখে বোঝা বহি শিরে নদীতীরে পল্লীবাসী ঘরে যায় ফিরে। শত শতাব্দীর পরে যদি কোনোমতে মন্ত্রবলে অতীতের মৃত্যুরাজ্য হতে এই চাষী দেখা দেয় হয়ে মূর্তিমান, এই লাঠি কাঁখে লয়ে, বিস্মিত নয়ান, চারি দিকে ঘিরি তারে অসীম জনতা কাড়াকাড়ি করি লবে তার প্রতি কথা। তার সুখদুঃখ যত, তার প্রেম স্নেহ, তার পাড়াপ্রতিবেশী, তার নিজ গেহ, তার খেত, তার গোরু, তার চাষ-বাস, শুনে শুনে কিছুতেই মিটিবে না আশ। আজি যার জীবনের কথা তুচ্ছতম সেদিন শুনাবে তাহা কবিত্বের সম।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) সাম্যনীতি কহিল ভিক্ষার ঝুলি, হে টাকার তোড়া, তোমাতে আমাতে, ভাই, ভেদ অতি থোড়া— আদান-প্রদান হোক। তোড়া কহে রাগে, সে থোড়া প্রভেদটুকু ঘুচে যাক আগে।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) সারা রাত তারা সারা রাত তারা যতই জ্বলে রেখা নাহি রাখে আকাশতলে   (স্ফুলিঙ্গ) সারাবেলা হেলাফেলা সারাবেলা           এ কী খেলা আপন - সনে ! এই বাতাসে ফুলের বাসে           মুখখানি কার পড়ে মনে ! আঁখির কাছে বেড়ায় ভাসি কে জানে গো কাহার হাসি ! দুটি ফোঁটা নয়নসলিল           রেখে যায় এই নয়ন কোণে । কোন্ ছায়াতে কোন্ উদাসী দূরে বাজায় অলস বাঁশি , মনে হয় কার মনের বেদন           কেঁদে বেড়ায় বাঁশির গানে । সারাদিন গাঁথি গান কারে চাহে , গাহে প্রাণ , তরুতলের ছায়ার মতন           বসে আছি ফুলবনে । (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) সার্থকতা ফাল্গুনের সূর্য যবে দিল কর প্রসারিয়া সঙ্গীহীন দক্ষিণ অর্ণবে, অতল বিরহ তার যুগযুগান্তের উচ্ছ্বসিয়া ছুটে গেল নিত্য-অশান্তের সীমানার ধারে; ব্যথার ব্যথিত কারে ফিরিল খুঁজিয়া, বেড়ালো যুঝিয়া আপন তরঙ্গদল-সাথে। অবশেষে রজনীপ্রভাতে, জানে না সে কখন দুলায়ে গেল চলি বিপুল নিশ্বাসবেগে একটুকু মল্লিকার কলি। উদ্বারিল গন্ধ তার, সচকিয়া লভিল সে গভীর রহস্য আপনার। এই বার্তা ঘোষিল অম্বরে- সমুদ্রের উদ্বোধন পূর্ণ আজি পুষ্পের অন্তরে। সিংহাসনতলচ্ছায়ে দূরে দূরান্তরে সিংহাসনতলচ্ছায়ে দূরে দূরান্তরে য়ে রাজ্য জানায় স্পর্ধাভরে রাজায় প্রজায় ভেদ মাপা, পায়ের তলায় রাখে সর্বনাশ চাপা। হতভাগ্য যে রাজ্যের সুবিস্তীর্ণ দৈন্যজীর্ণ প্রাণ রাজমুকুটের নিত্য করিছে কুৎসিত অপমান। অসহ্য তাহার দুঃখ তাপ রাজারে না যদি লাগে,লাগে তারে বিধাতার শাপ। মহা-ঐশ্বর্যের নিম্নতলে অর্ধাশন অনশন দাহ করে নিত্য ক্ষুধানলে, শুষ্কপ্রায় কলুষিত পিপাসার জল, দেহে নাই শীতের সম্বল, অবারিত মৃত্যুর দুয়ার, নিষ্ঠুর তাহার চেয়ে জীবন্মৃত দেহ চর্মসার শোষণ করিছে দিনরাত রুদ্ধ আরোগ্যের পথে রোগের অবাধ অভিঘাত-- সেথা মুমূর্ষুর দল রাজত্বের হয় না সহায়, হয় মহা দায়। এক পাখা শীর্ণ যে পাখির ঝড়ের সংকট দিনে রহিবে না স্থির, সমুচ্চ আকাশ হতে ধুলায় পড়িবে অঙ্গহীন-- আসিবে বিধির কাছে হিসাব-চুকিয়ে-দেওয়া দিন। অভ্রভেদী ঐশ্বর্যের চূর্ণীভূত পতনের কালে দরিদ্রের জীর্ণ দশা বাসা তার বাঁধিবে কঙ্কালে। সিন্ধুগর্ভ উপরে স্রোতের ভরে ভাসে চরাচর নীল সমুদ্রের’পরে নৃত্য ক’রে সারা । কোথা হতে ঝরে যেন অনন্ত নির্ঝর , ঝরে আলোকের কণা রবি শশী তারা । ঝরে প্রাণ , ঝরে গান , ঝরে প্রেমধারা — পূর্ণ করিবারে চায় আকাশ সাগর । সহসা কে ডুবে যায় জলবিম্বপারা — দু – একটি আলো – রেখা যায় মিলাইয়া , তখন ভাবিতে বসি কোথায় কিনারা — কোন্ অতলের পানে ধাই তলাইয়া ! নিম্নে জাগে সিন্ধুগর্ভ স্তব্ধ অন্ধকার । কোথা নিবে যায় আলো , থেমে যায় গীত — কোথা চিরদিন তরে অসীম আড়াল ! কোথায় ডুবিয়া গেছে অনন্ত অতীত !   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) সিন্ধুতীরে হেথা নাই ক্ষুদ্র কথা , তুচ্ছ কানাকানি , ধ্বনিত হতেছে চিরদিবসের বাণী । চিরদিবসের রবি ওঠে , অস্ত যায় , চিরদিবসের কবি গাহিছে হেথায় । ধরণীর চারি দিকে সীমাশূন্য গানে সিন্ধু শত তটিনীরে করিছে আহ্বান — হেথায় দেখিলে চেয়ে আপনার পানে দুই চোখে জল আসে , কেঁদে ওঠে প্রাণ । শত যুগ হেথা বসে মুখপানে চায় , বিশাল আকাশে পাই হৃদয়ের সাড়া । তীব্র বক্র ক্ষুদ্র হাসি পায় যদি ছাড়া রবির কিরণে এসে মরে সে লজ্জায় । সবারে আনিতে বুকে বুক বেড়ে যায় , সবারে করিতে ক্ষমা আপনারে ছাড়া ।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) সিন্ধুপারে পউষ প্রখর শীতে জর্জর, ঝিল্লিমুখর রাতি; নিদ্রিত পুরী, নির্জন ঘর, নির্বাণদীপ বাতি। অকাতর দেহে আছিনু মগন সুখনিদ্রার ঘোরে-- তপ্ত শয্যা প্রিয়ার মতন সোহাগে ঘিরেছে মোরে। হেনকালে হায় বাহির হইতে কে ডাকিল মোর নাম-- নিদ্রা টুটিয়া সহসা চকিতে চমকিয়া বসিলাম। তীক্ষ্ণ শাণিত তীরের মতন মর্মে বাজিল স্বর-- ঘর্ম বহিল ললাট বাহিয়া, রোমাঞ্চকলেবর। ফেলি আবরণ, ত্যজিয়া শয়ন, বিরলসন বেশে দুরু দুরু বুকে খুলিয়া দুয়ার বাহিরে দাঁড়ানু এসে। দূর নদীপারে শূন্য শ্মশানে শৃগাল উঠিল ডাকি, মাথার উপরে কেঁদে উড়ে গেল কোন্‌ নিশাচর পাখি। দেখিনু দুয়ারে রমণীমুরতি অবগুণ্ঠনে ঢাকা-- কৃষ্ণ অশ্বে বসিয়া রয়েছে, চিত্রে যেন সে আঁকা। আরেক অশ্ব দাঁড়ায়ে রয়েছে, পুচ্ছ ভূতল চুমে, ধূম্রবরন, যেন দেহ তার গঠিত শ্মশানধূমে। নড়িল না কিছু, আমারে কেবল হেরিল আঁখির পাশে-- শিহরি শিহরি সর্ব শরীর কাঁপিয়া উঠিল ত্রাসে। পাণ্ডু আকাশে খণ্ড চন্দ্র হিমানীর গ্লানি-মাখা, পল্লবহীন বৃদ্ধ অশথ শিহরে নগ্ন শাখা। নীরব রমণী অঙ্গুলী তুলি দিল ইঙ্গিত করি-- মন্ত্রমুগ্ধ অচেতনসম চড়িনু অশ্ব-'পরি।বিদ্যুৎবেগে ছুটে যায় ঘোড়া-- বারেক চাহিনু পিছে, ঘরদ্বার মোর বাষ্পসমান মনে হল সব মিছে। কাতর রোদন জাগিয়া উঠিল সকল হৃদয় ব্যেপে, কণ্ঠের কাছে সুকঠিন বলে কে তারে ধরিল চেপে। পথের দুধারে রুদ্ধদুয়ারে দাঁড়ায়ে সৌধসারি, ঘরে ঘরে হায় সুখশয্যায় ঘুমাইছে নরনারী। নির্জন পথ চিত্রিতবৎ, সাড়া নাই সারা দেশে-- রাজার দুয়ারে দুইটি প্রহরী ঢুলিছে নিদ্রাবেশে। শুধু থেকে থেকে ডাকিছে কুকুর সুদূর পথের মাঝে-- গম্ভীর স্বরে প্রাসাদশিখরে প্রহরঘন্টা বাজে।অফুরান পথ, অফুরান রাতি, অজানা নূতন ঠাঁই-- অপরূপ এক স্বপ্নসমান, অর্থ কিছুই নাই। কী যে দেখেছিনু মনে নাহি পড়ে, ছিল নাকো আগাগোড়া-- লক্ষ্যবিহীন তীরের মতন ছুটিয়া চলেছে ঘোড়া। চরণে তাদের শব্দ বাজে না, উড়ে নাকো ধূলিরেখা-- কঠিন ভূতল নাই যেন কোথা, সকলি বাষ্পে লেখা। মাঝে মাঝে যেন চেনা-চেনা-মতো মনে হয় থেকে থেকে-- নিমেষ ফেলিতে দেখিতে না পাই কোথা পথ যায় বেঁকে। মনে হল মেঘ, মনে হল পাখি, মনে হল কিশলয়, ভালো করে যেই দেখিবারে যাই মনে হল কিছু নয়। দুই ধারে এ কি প্রাসাদের সারি? অথবা তরুর মূল? অথবা এ শুধু আকাশ জুড়িয়া আমারই মনের ভুল? মাঝে মাঝে চেয়ে দেখি রমণীর অবগুণ্ঠিত মুখে-- নীরব নিদয় বসিয়া রয়েছে, প্রাণ কেঁপে ওঠে বুকে। ভয়ে ভুলে যাই দেবতার নাম, মুখে কথা নাহি ফুটে; হুহু রবে বায়ু বাজে দুই কানে ঘোড়া চলে যায় ছুটে।চন্দ্র যখন অস্তে নামিল তখনো রয়েছে রাতি, পূর্ব দিকের অলস নয়নে মেলিছে রক্ত ভাতি। জনহীন এক সিন্ধুপুলিনে অশ্ব থামিল আসি-- সমুখে দাঁড়ায়ে কৃষ্ণ শৈল গুহামুখ পরকাশি। সাগরে না শুনি জলকলরব, না গাহে উষার পাখি, বহিল না মৃদু প্রভাতপবন বনের গন্ধ মাখি। অশ্ব হইতে নামিল রমণী, আমিও নামিনু নীচে, আঁধার-ব্যাদান গুহার মাঝারে চলিনু তাহার পিছে। ভিতরে খোদিত উদার প্রাসাদ শিলাস্তম্ভ-'পরে, কনকশিকলে সোনার প্রদীপ দুলিতেছে থরে থরে। ভিত্তির গায়ে পাষাণমূর্তি চিত্রিত আছে কত, অপরূপ পাখি, অপরূপ নারী, লতাপাতা নানা-মতো। মাঝখানে আছে চাঁদোয়া খাটানো, মুক্তা ঝালরে গাঁথা-- তারি তলে মণিপালঙ্ক-'পরে অমল শয়ন পাতা। তারি দুই ধারে ধূপাধার হতে উঠিছে গন্ধধূপ, সিংহবাহিনী নারীর প্রতিমা দুই পাশে অপরূপ। নাহি কোনো লোক, নাহিকো প্রহরী, নাহি হেরি দাসদাসী। গুহাগৃহতলে তিলেক শব্দ হয়ে উঠে রাশি রাশি। নীরবে রমণী আবৃত বদনে বসিলা শয্যা-'পরে, অঙ্গুলি তুলি ইঙ্গিত করি পাশে বসাইল মোরে। হিম হয়ে এল সর্বশরীর, শিহরি উঠিল প্রাণ-- শোণিতপ্রবাহে ধ্বনিতে লাগিল ভয়ের ভীষণ তান।সহসা বাজিয়া বাজিয়া উঠিল দশ দিকে বীণা-বেণু, মাথার উপরে ঝরিয়া ঝরিয়া পড়িল পুষ্পরেণু। দ্বিগুণ আভায় জ্বলিয়া উঠিল দীপের আলোকরাশি-- ঘোমটা-ভিতরে হাসিল রমণী মধুর উচ্চহাসি। সে হাসি ধ্বনিয়া ধ্বনিয়া উঠিল বিজন বিপুল ঘরে-- শুনিয়া চমকি ব্যাকুল হৃদয়ে কহিলাম জোড়করে, "আমি যে বিদেশী অতিথি, আমায় ব্যথিয়ো না পরিহাসে, কে তুমি নিদয় নীরব ললনা, কোথায় আনিলে দাসে।'অমনি রমণী কনকদণ্ড আঘাত করিল ভূমে, আঁধার হইয়া গেল সে ভবন রাশি রাশি ধূপধূমে। বাজিয়া উঠিল শতেক শঙ্খ হুলুকলরব-সাথে-- প্রবেশ করিল বৃদ্ধ বিপ্র ধান্যদূর্বা হাতে। পশ্চাতে তার বাঁধি দুই সার কিরাতনারীর দল কেহ বহে মালা, কেহ বা চামর, কেহ বা তীর্থজল। নীরবে সকলে দাঁড়ায়ে রহিল-- বৃদ্ধ আসনে বসি নীরবে গণনা করিতে লাগিল গৃহতলে খড়ি কষি। আঁকিতে লাগিল কত না চক্র, কত না রেখার জাল, গণনার শেষে কহিল "এখন হয়েছে লগ্ন-কাল'। শয়ন ছাড়িয়া উঠিল রমণী বদন করিয়া নত, আমিও উঠিয়া দাঁড়াইনু পাশে মন্ত্রচালিতমত। নারীগণ সবে ঘেরিয়া দাঁড়ালো একটি কথা না বলি দোঁহাকার মাথে ফুলদল-সাথে বরষি লাজাঞ্জলি। পুরোহিত শুধু মন্ত্র পড়িল আশিস করিয়া দোঁহে-- কী ভাষা কী কথা কিছু না বুঝিনু, দাঁড়ায়ে রহিনু মোহে। অজানিত বধূ নীরবে সঁপিল শিহরিয়া কলেবর হিমের মতন মোর করে তার তপ্ত কোমল কর। চলি গেল ধীরে বৃদ্ধ বিপ্র, পশ্চাতে বাঁধি সার গেল নারীদল মাথায় কক্ষে মঙ্গল-উপচার। শুধু এক সখী দেখাইল পথ হাতে লয়ে দীপখানি-- মোরা দোঁহে পিছে চলিনু তাহার, কারো মুখে নাহি বাণী। কত না দীর্ঘ আঁধার কক্ষ সভয়ে হইয়া পার সহসা দেখিনু সমুখে কোথায় খুলে গেল এক দ্বার। কী দেখিনু ঘরে কেমনে কহিব, হয়ে যায় মনোভুল, নানা বরনের আলোক সেথায়, নানা বরনের ফুল। কনকে রজতে রতনে জড়িত বসন বিছানো কত, মণিবেদিকায় কুসুমশয়ন স্বপ্নরচিত-মতো। পাদপীঠ-'পরে চরণ প্রসারি শয়নে বসিলা বধূ-- আমি কহিলাম, "সব দেখিলাম, তোমারে দেখি নি শুধু।'চারি দিক হতে বাজিয়া উঠিল শত কৌতুকহাসি। শত ফোয়ারায় উছসিল যেন পরিহাস রাশি রাশি। সুধীরে রমণী দু-বাহু তুলিয়া, অবগুণ্ঠনখানি উঠায়ে ধরিয়া মধুর হাসিল মুখে না কহিয়া বাণী। চকিত নয়ানে হেরি মুখপানে পড়িনু চরণতলে, "এখানেও তুমি জীবনদেবতা!' কহিনু নয়নজলে। সেই মধুমুখ, সেই মৃদুহাসি, সেই সুধাভরা আঁখি-- চিরদিন মোরে হাসালো কাঁদালো, চিরদিন দিল ফাঁকি। খেলা করিয়াছে নিশিদিন মোর সব সুখে সব দুখে, এ অজানাপুরে দেখা দিল পুন সেই পরিচিত মুখে। অমল কোমল চরণকমলে চুমিনু বেদনাভরে-- বাধা না মানিয়া ব্যাকুল অশ্রু পড়িতে লাগিল ঝরে। অপরূপ তানে ব্যথা দিয়ে প্রাণে বাজিতে লাগিল বাঁশি। বিজন বিপুল ভবনে রমণী হাসিতে লাগিল হাসি। সুখ আজি মেঘমুক্ত দিন; প্রসন্ন আকাশ হাসিছে বন্ধুর মতো; সুন্দর বাতাস মুখে চক্ষে বক্ষে আসি লাগিছে মধুর-- অদৃশ্য অঞ্চল যেন সুপ্ত দিগ্‌বধূর উড়িয়া পড়িছে গায়ে। ভেসে যায় তরী প্রশান্ত পদ্মার স্থির বক্ষের উপরি তরল কল্লোলে। অর্ধমগ্ন বালুচর দূরে আছে পড়ি, যেন দীর্ঘ জলচর রৌদ্র পোহাইছে শুয়ে। ভাঙা উচ্চতীর; ঘনচ্ছায়াপূর্ণ তরু; প্রচ্ছন্ন কুটির; বক্র শীর্ণ পথখানি দূর গ্রাম হতে শস্যক্ষেত্র পার হয়ে নামিয়াছে স্রোতে তৃষার্ত জিহ্বার মতো। গ্রামবধূগণ অঞ্চল ভাসায়ে জলে আকণ্ঠমগন করিছে কৌতুকালাপ। উচ্চ মিষ্ট হাসিজলকলস্বরে মিশি পশিতেছে আসি কর্ণে মোর। বসি এক বাঁকা নৌকা-'পরি বৃদ্ধ জেলে গাঁথে জাল নতশির করি রৌদ্রে পিঠ দিয়া। উলঙ্গ বালক তার আনন্দে ঝাঁপায়ে জলে পড়ে বারম্বার কলহাস্যে; ধৈর্যময়ী মাতার মতন পদ্মা সহিতেছে তার স্নেহ-জ্বালাতন। তরী হতে সম্মুখেতে দেখি দুই পার-- স্বচ্ছতম নীলাভ্রের নির্মল বিস্তার; মধ্যাহ্ন-আলোকপ্লাবে জলে স্থলে বনে বিচিত্র বর্ণের রেখা; আতপ্ত পবনে তীর উপবন হতে কভু আসে বহি আম্রমুকুলের গন্ধ, কভু রহি রহি বিহঙ্গের শ্রান্ত স্বর।          আজি বহিতেছে প্রাণে মোর শান্তিধারা-- মনে হইতেছে সুখ অতি সহজ সরল, কাননের প্রস্ফুট ফুলের মতো, শিশু-আননের হাসির মতন, পরিব্যাপ্ত বিকশিত-- উন্মুখ অধরে ধরি চুম্বন-অমৃত চেয়ে আছে সকলের পানে বাক্যহীন শৈশববিশ্বাসে চিররাত্রি চিরদিন। বিশ্ববীণা হতে উঠি গানের মতন রেখেছে নিমগ্ন করি নিথর গগন। সে সংগীত কী ছন্দে গাঁথিব, কী করিয়া শুনাইব, কী সহজ ভাষায় ধরিয়া দিব তারে উপহার ভালোবাসি যারে, রেখে দিব ফুটাইয়া কী হাসি আকারে নয়নে অধরে, কী প্রেমে জীবনে তারেকরিব বিকাশ। সহজ আনন্দখানি কেমনে সহজে তারে তুলে ঘরে আনি প্রফুল্ল সরস। কঠিন আগ্রহভরে ধরি তারে প্রাণপণে-- মুঠির ভিতরে টুটি যায়। হেরি তারে তীব্রগতি ধাই-- অন্ধবেগে বহুদূরে লঙ্ঘি চলি যাই, আর তার না পাই উদ্দেশ।              চারি দিকে দেখে আজি পূর্ণপ্রাণে মুগ্ধ অনিমিখে এই স্তব্ধ নীলাম্বর স্থির শান্ত জল, মনে হল সুখ অতি সহজ সরল। সুখদুঃখ শ্রাবণের মোটা ফোঁটা বাজিল যূথীরে— কহিল, মরিনু হায় কার মৃত্যুতীরে! বৃষ্টি কহে, শুভ আমি নামি মর্তমাঝে, কারে সুখরূপে লাগে কারে দুঃখ বাজে।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) সুখস্বপ্ন ওই জানালার কাছে বসে আছে          করতলে রাখি মাথা । তার কোলে ফুল পড়ে রয়েছে , সে যে ভুলে গেছে মালা গাঁথা । শুধু ঝুরু ঝুরু বায়ু বহে যায় , তার কানে কানে কী যে কহে যায় , তাই আধো শুয়ে আধো বসিয়ে কত ভাবিতেছে আনমনে ।         উড়ে উড়ে যায় চুল , কোথা উড়ে উড়ে পড়ে ফুল ,      ঝুরু ঝুরু কাঁপে গাছপালা           সমুখের উপবনে ।       অধরের কোণে হাসিটি           আধখানি মুখ ঢাকিয়া ,       কাননের পানে চেয়ে আছে            আধমুকুলিত আঁখিয়া ।       সুদূর স্বপন ভেসে ভেসে           চোখে এসে যেন লাগিছে ,       ঘুমঘোরময় সুখের আবেশ             প্রাণের কোথায় জাগিছে ।       চোখের উপরে মেঘ ভেসে যায় ,           উড়ে উড়ে যায় পাখি ,       সারাদিন ধরে বকুলের ফুল           ঝরে পড়ে থাকি থাকি ।       মধুর আলস , মধুর আবেশ ,           মধুর মুখের হাসিটি ,       মধুর স্বপনে প্রাণের মাঝারে           বাজিছে মধুর বাঁশিটি । সুখী প্রাণ জান না তো নির্ঝরিণী, আসিয়াছ কোথা হতে, কোথায় যে করিছ প্রয়াণ, মাতিয়া চলেছ তবু আপন আনন্দে পূর্ণ, আনন্দ করিছ সবে দান। বিজন-অরণ্য-ভূমি দেখিছে তোমার খেলা জুড়াইছে তাহার নয়ান। মেষ-শাবকের মতো তরুদের ছায়ে ছায়ে রচিয়াছ খেলিবার স্থান। গভীর ভাবনা কিছু আসে না তোমার কাছে, দিনরাত্রি গাও শুধু গান। বুঝি নরনারী মাঝে এমনি বিমল হিয়া আছে কেহ তোমারি সমান। চাহে না চাহে না তারা ধরণীর আড়ম্বর, সন্তোষে কাটাতে চায় প্রাণ, নিজের আনন্দ হতে আনন্দ বিতরে তারা গায় তারা বিশ্বের কল্যাণ।Robert Buchanan (অনুবাদ কবিতা) সুখেতে আসক্তি যার সুখেতে আসক্তি যার আনন্দ তাহারে করে ঘৃণা। কঠিন বীর্যের তারে বাঁধা আছে সম্ভোগের বীণা৷   (স্ফুলিঙ্গ) সুধিয়া গয়লা ছিল শিউনন্দন, বিখ্যাত তার নাম, গোয়ালবাড়ি ছিল যেন একটা গোটা গ্রাম। গোরু-চরার প্রকাণ্ড খেত, নদীর ওপার চরে, কলাই শুধু ছিটিয়ে দিত পলি জমির 'পরে। জেগে উঠত চারা তারই, গজিয়ে উঠত ঘাস, ধেনুদলের ভোজ চলত মাসের পরে মাস। মাঠটা জুড়ে বাঁধা হত বিশ-পঞ্চাশ চালা, জমত রাখাল ছেলেগুলোর মহোৎসবের পালা। গোপাষ্টমীর পর্বদিনে প্রচুর হত দান, গুরুঠাকুর গা ডুবিয়ে দুধে করত স্নান। তার থেকে সর ক্ষীর নবনী তৈরি হত কত, প্রসাদ পেত গাঁয়ে গাঁয়ে গয়লা ছিল যত। সুপ্তোত্থিতা ঘুমের দেশে ভাঙিল ঘুম, উঠিল কলস্বর । গাছের শাখে জাগিল পাখি, কুসুমে মধুকর । অশ্বশালে জাগিল ঘোড়া, হস্তীশালে হাতি । মল্লশালে মল্ল জাগি ফুলায় পুন ছাতি । জাগিল পথে প্রহরীদল, দুয়ারে জাগে দ্বারী, আকাশে চেয়ে নিরখে বেলা জাগিয়া নরনারী । উঠিল জাগি রাজাধিরাজ, জাগিল রানীমাতা । কচলি আঁখি কুমার-সাথে জাগিল রাজভ্রাতা । নিভৃত ঘরে ধূপের বাস, রতন-দীপ জ্বালা, জাগিয়া উঠি শয্যাতলে শুধালো রাজবালা ---                              'কে পরালে মালা ! 'খসিয়া-পড়া আঁচলখানি বক্ষে তুলে নিল । আপন-পানে নেহারি চেয়ে শরমে শিহরিল । ত্রস্ত হয়ে চকিত চোখে চাহিল চারি দিকে--- বিজন গৃহ, রতন-দীপ জ্বলিছে অনিমিখে । গলার মালা খুলিয়া লয়ে ধরিয়া দুটি করে সোনার সূতে যতনে গাঁথা লিখনখানি পড়ে। পড়িল নাম, পড়িল ধাম, পড়িল লিপি তার, কোলের 'পরে বিছায়ে দিয়ে পড়িল শতবার । শয়নশেষে রহিল বসে, ভাবিল রাজবালা --- 'আপন ঘরে ঘুমায়ে ছিনু নিতান্ত নিরালা,                              'কে পরালে মালা !'নূতন-জাগা কুঞ্জবনে কুহরি উঠে পিক, বসন্তের চুম্বনেতে বিবশ দশ দিক । বাতাস ঘরে প্রবেশ করে ব্যাকুল উচ্ছাসে, নবীনফুলমঞ্জরীর গন্ধ লয়ে আসে । জাগিয়া উঠে বৈতালিক গাহিছে জয়গান, প্রাসাদদ্বারে ললিত স্বরে বাঁশিতে উঠে তান । শীতলছায়া নদীর পথে কলসে লয়ে বারি --- কাঁকন বাজে, নূপুর বাজে, চলিছে পুরনারী । কাননপথে মর্মরিয়া কাঁপিছে গাছপালা, আধেক মুদে নয়ন দুটি ভাবিছে রাজবালা ---                              'কে পরালে মালা !'বারেক মালা গলায় পরে, বারেক লহে খুলি--- দুইটি করে চাপিয়া ধরে বুকের কাছে তুলি । শয়ন -'পরে মেলায়ে দিয়ে তৃষিত চেয়ে রয়, এমনি করে পাইবে যেন অধিক পরিচয় । জগতে আজ কত-না ধ্বনি উঠিছে কত ছলে --- একটি আছে গোপন কথা, সে কেহ নাহি বলে । বাতাস শুধু কানের কাছে বহিয়া যায় হূহু, কোকিল শুধু অবিশ্রাম ডাকছে কুহু কুহু । নিভৃত ঘরে পরান মন একান্ত উতালা, শয়নশেষে নীরবে বসে ভাবিছে রাজবালা---                              'কে পরালে মালা !'কেমন বীর-মুরতি তার মাধুরী দিয়ে মিশা ---- দীপ্তিভরা নয়ন-মাঝে তৃপ্তিহীন তৃষা । স্বপ্নে তারে দেখেছে যেন এমনি মনে লয় --- ভুলিয়া গেছে রয়েছে শুধু অসীম বিস্ময় । পার্শ্বে যেন বসিয়াছিল, ধরিয়াছিল কর, এখনো তার পরশে যেন সরস কলেবর । চমকি মুখ দু হাতে ঢাকে, শরমে টুটে মন, লজ্জাহীন প্রদীপ কেন নিভে নি সেইক্ষণ ! কন্ঠ হতে ফেলিল হার যেন বিজুলিজ্বালা, শয়ন-'পরে লুটায়ে প'ড়ে ভাবিল রাজবালা ---                              'কে পরালে মালা !'এমনি ধীরে একটি করে কাটিছে দিন রাতি । বসন্ত সে বিদায় নিল লইয়া যূথীজাতি । সঘন মেঘে বরষা আসে, বরষে ঝরঝর্, কাননে ফুটে নবমালতী কদম্বকেশর । স্বচ্ছহাসি শরৎ আসে পূর্ণিমামালিকা, সকল বন আকুল করে শুভ্র শেফালিকা । আসিল শীত সঙ্গে লয়ে দীর্ঘ দুখনিশা, শিশির-ঝরা কুন্দফুলে হাসিয়া কাঁদে দিশা । ফাগুন-মাস আবার এল বহিয়া ফুলডালা, জানালা-পাশে একেলা বসে ভাবিছে রাজবালা ---                              'কে পরালে মালা !' সুপ্রভাত রুদ্র , তোমার দারুণ দীপ্তি এসেছে দুয়ার ভেদিয়া ; বক্ষে বেজেছে বিদ্যুৎবাণ স্বপ্নের জাল ছেদিয়া । ভাবিতেছিলাম উঠি কি না উঠি , অন্ধ তামস গেছে কিনা ছুটি , রুদ্ধ নয়ন মেলি কি না মেলি তন্দ্রা-জড়িমা মাজিয়া । এমন সময়ে , ঈশান , তোমার বিষাণ উঠেছে বাজিয়া । বাজে রে গরজি বাজে রে দগ্ধ মেঘের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে দীপ্ত গগন-মাঝে রে । চমকি জাগিয়া পূর্বভুবন রক্তবদন লাজে রে ।ভৈরব , তুমি কী বেশে এসেছ , ললাটে ফুঁসিছে নাগিনী , রুদ্র-বীণায় এই কি বাজিল সুপ্রভাতের রাগিণী ? মুগ্ধ কোকিল কই ডাকে ডালে , কই ফোটে ফুল বনের আড়ালে ? বহুকাল পরে হঠাৎ যেন রে অমানিশা গেল ফাটিয়া ; তোমার খড়্‌গ আঁধার-মহিষে দুখানা করিল কাটিয়া । ব্যথায় ভুবন ভরিছে , ঝর ঝর করি রক্ত-আলোক গগনে-গগনে ঝরিছে , কেহ-বা জাগিয়া উঠিছে কাঁপিয়া কেহ-বা স্বপনে ডরিছে ।তোমার শ্মশানকিঙ্করদল , দীর্ঘ নিশায় ভুখারি । শুষ্ক অধর লেহিয়া লেহিয়া উঠিছে ফুকারি ফুকারি । অতিথি তারা যে আমাদের ঘরে করিছে নৃত্য প্রাঙ্গণ- ‘ পরে , খোলো খোলো দ্বার ওগো গৃহস্থ , থেকো না থেকো না লুকায়ে — যার যাহা আছে আনো বহি আনো , সব দিতে হবে চুকায়ে । ঘুমায়ো না আর কেহ রে । হৃদয়পিণ্ড ছিন্ন করিয়া ভাণ্ড ভরিয়া দেহো রে । ওরে দীনপ্রাণ , কী মোহের লাগি রেখেছিস মিছে স্নেহ রে ।উদয়ের পথে শুনি কার বাণী , ‘ ভয় নাই , ওরে ভয় নাই — নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই । ‘ হে রুদ্র , তব সংগীত আমি কেমনে গাহিব কহি দাও স্বামী — মরণনৃত্যে ছন্দ মিলায়ে হৃদয়ডমরু বাজাব , ভীষণ দুঃখে ডালি ভরে লয়ে তোমার অর্ঘ্য সাজাব । এসেছে প্রভাত এসেছে । তিমিরান্তক শিবশঙ্কর কী অট্টহাস হেসেছে! যে জাগিল তার চিত্ত আজিকে ভীম আনন্দে ভেসেছে ।জীবন সঁপিয়া , জীবনেশ্বর , পেতে হবে তব পরিচয় ; তোমার ডঙ্কা হবে যে বাজাতে সকল শঙ্কা করি জয় । ভালোই হয়েছে ঝঞ্ঝার বায়ে প্রলয়ের জটা পড়েছে ছড়ায়ে , ভালোই হয়েছে প্রভাত এসেছে মেঘের সিংহবাহনে — মিলনযঞ্ জে অগ্নি জ্বালাবে বজ্রশিখার দাহনে । তিমির রাত্রি পোহায়ে মহাসম্পদ তোমারে লভিব সব সম্পদ খোয়ায়ে — মৃত্যুর লব অমৃত করিয়া তোমার চরণে ছোঁয়ায়ে ।('পূরবী' কাব্যগ্রন্থ) সুশীলা আমার, জানালার ‘পরে সুশীলা আমার, জানালার ‘পরে দাঁড়াও একটিবার! একবার আমি দেখিয়া লইব মধুর হাসি তোমার! কত দুখ-জ্বালা সহি অকাতরে ভ্রমি, গো, দূর প্রবাসে যদি লভি মোর হৃদয়-রতন– সুশীলারে মোর পাশে! কালিকে যখন নাচ গান কত হতেছিল সভা-‘পরে, কিছুই শুনি নি, আছিনু মগন তোমারি ভাবনা-ভরে আছিল কত-না বালিকা, রমণী, রূপসী প্রমোদ-হিয়া, বিষাদে কহিনু, “তোমরা তো নহ সুশীলা, আমার প্রিয়া!’ সুশীলে, কেমনে ভাঙ তার মন হরষে মরিতে পারে যেই জন তোমারি তোমারি তরে! সুশীলে, কেমনে ভাঙ হিয়া তার কিছু যে করি নি, এক দোষ যার ভালোবাসে শুধু তোরে! প্রণয়ে প্রণয় না যদি মিশাও দয়া কোরো মোর প্রতি, সুশীলার মন নহে তো কখনো নিরদয় এক রতি!Robert Burns (অনুবাদ কবিতা) সুসময় শোকের বরষা দিন এসেছে আঁধারি— ও ভাই গৃহস্থ চাষি, ছেড়ে আয় বাড়ি। ভিজিয়া নরম হল শুষ্ক মরু মন, এই বেলা শস্য তোর করে নে বপন।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) সূর্য ও ফুল মহীয়সী মহিমার আগ্নেয় কুসুম সূর্য , ধায় লভিবারে বিশ্রামের ঘুম । ভাঙা এক ভিত্তি- ' পরে ফুল শুভ্রবাস , চারি দিকে শুভ্রদল করিয়া বিকাশ মাথা তুলে চেয়ে দেখে সুনীল বিমানে অমর আলোকময় তপনের পানে , ছোটো মাথা দুলাইয়া কহে ফুল গাছে — “ লাবণ্য-কিরণ ছটা আমারো তো আছে । ”                             — Victor Hugo (অনূদিত কবিতা) সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় দেশশূন্য কালশূন্য জ্যোতিঃশূন্য, মহাশূন্য-'পরি            চতুর্মুখ করিছেন ধ্যান, মহা অন্ধ অন্ধকার সভয়ে রয়েছে দাঁড়াইয়া--            কবে দেব খুলিবে নয়ান। অনন্ত হৃদয়-মাঝে আসন্ন জগৎ-চরাচর            দাঁড়াইয়া স্তম্ভিত নিশ্চল, অনন্ত হৃদয়ে তাঁর ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান            ধীরে ধীরে বিকাশিছে দল। লেগেছে ভাবের ঘোর, মহানন্দে পূর্ণ তাঁর প্রাণ            নিজের হৃদয়পানে চাহি, নিস্তরঙ্গ রহিয়াছে অনন্ত আনন্দপারাবার--            কূল নাহি, দিগ্‌বিদিক নাহি।            পুলকে পূর্ণিত তাঁর প্রাণ, সহসা আনন্দসিন্ধু হৃদয়ে উঠিল উথলিয়া,            আদিদেব খুলিলা নয়ান; জনশূন্য জ্যোতিঃশূন্য অন্ধতম অন্ধকার-মাঝে            উচ্ছ্বসি উঠিল বেদগান।            চারি মুখে বাহিরিল বাণী            চারিদিকে করিল প্রয়াণ।            সীমাহারা মহা অন্ধকারে            সীমাশূন্য ব্যোমপারাবারে            প্রাণপূর্ণ ঝটিকার মতো,            ভাবপূর্ণ, ব্যাকুলতা-সম,            আশাপূর্ণ অতৃপ্তির প্রায়,            সঞ্চরিতে লাগিল সে ভাষা।            দূর দূর যত দূর যায়            কিছুতেই অন্ত নাহি পায়--            যুগ যুগ যুগ যুগান্তর            ভ্রমিতেছে আজিও সে বাণী,            আজিও সে অন্ত নাহি পায়। ভাবের আনন্দে ভোর, গীতিকবি চারি মুখে            করিতে লাগিলা বেদগান। আনন্দের আন্দোলনে ঘন ঘন বহে শ্বাস            অষ্ট নেত্রে বিস্ফুরিল জ্যোতি । জ্যোতির্ময় জটাজাল কোটিসূর্যপ্রভাসম,            দিগ‌্ ‌বিদিকে পড়িল ছড়ায়ে, মহান্‌ ললাটে তাঁর অযুত তড়িতস্ফূর্তি            অবিরাম লাগিল খেলিতে। অনন্ত ভাবের দল, হৃদয়-মাঝারে তাঁর            হতেছিল আকুল ব্যাকুল--            মুক্ত হয়ে ছুটিল তাহারা,            জগতের গঙ্গোত্রীশিখর হতে            শত শত স্রোতে            উচ্ছ্বসিল অগ্নিময় বিশ্বের নির্ঝর,            বাহিরিল অগ্নিময়ী বাণী,            উচ্ছ্বসিল বাষ্পময় ভাব।            উত্তরে দক্ষিণে গেল,            পুরবে পশ্চিমে গেল,            চারি দিকে ছুটিল তাহারা, আকাশের মহাক্ষেত্রে শৈশব-উচ্ছ্বাস বেগে            নাচিতে লাগিল মহোল্লাসে। শব্দশূন্য শূন্যমাঝে সহসা সহস্র স্বরে            জয়ধ্বনি উঠিল উথলি,            হর্ষধ্বনি উঠিল ফুটিয়া,            স্তব্ধতার পাষাণহৃদয়            শত ভাগে গেল রে ফাটিয়া।            শব্দস্রোত ঝরিল চৌদিকে            এককালে সমস্বরে-- পুরবে উঠিল ধ্বনি, পশ্চিমে উঠিল ধ্বনি,            ব্যাপ্ত হল উত্তরে দক্ষিণে। অসংখ্য ভাবের দল খেলিতে লাগিল যত            উঠিল খেলার কোলাহল।            শূন্যে শূন্যে মাতিয়া বেড়ায়--            হেথা ছোটে, হোথা ছুটে যায়।            কী করিবে আপনা লইয়া            যেন তাহা ভাবিয়া না পায়,            আনন্দে ভাঙিয়া যেতে চায়।            যে প্রাণ অনন্ত যুগ রবে            সেই প্রাণ পেয়েছে নূতন,            আনন্দে অনন্ত প্রাণ যেন            মুহূর্তে করিতে চায় ব্যয় ।            অবশেষে আকাশ ব্যাপিয়া            পড়িল প্রেমের আকর্ষণ ।            এ ধায় উহার পানে            এ চায় উহার মুখে,            আগ্রহে ছুটিয়া কাছে আসে।            বাষ্পে বাষ্পে করে ছুটাছুটি,            বাষ্পে বাষ্পে করে আলিঙ্গন।            অগ্নিময় কাতর হৃদয়            অগ্নিময় হৃদয়ে মিশিছে।            জ্বলিছে দ্বিগুণ অগ্নিরাশি            আঁধার হতেছে চুর চুর।            অগ্নিময় মিলন হইতে            জন্মিতেছে আগ্নেয় সন্তান,            অন্ধকার শূন্যমরুমাঝে            শত শত অগ্নি-পরিবার            দিশে দিশে করিছে ভ্রমণ।            নূতন সে প্রাণের উল্লাসে            নূতন সে প্রাণের উচ্ছ্বাসে            বিশ্ব যবে হয়েছে উন্মাদ,            চারি দিকে উঠিছে নিনাদ,            অনন্ত আকাশে দাঁড়াইয়া            চারি দিকে চারি হাত দিয়া            বিষ্ণু আসি মন্ত্র পড়ি দিলা,            বিষ্ণু আসি কৈলা আশীর্বাদ।            লইয়া মঙ্গলশঙ্খ করে,            কাঁপায়ে জগৎ চরাচরে            বিষ্ণু আসি কৈলা শঙ্খনাদ।            থেমে এল প্রচণ্ড কল্লোল,            নিবে এল জ্বলন্ত উচ্ছ্বাস,            গ্রহগণ নিজ অশ্রুজলে            নিবাইল নিজের হুতাশ।            জগতের বাঁধিল সমাজ,            জগতের বাঁধিল সংসার            বিবাহে বাহুতে বাহু বাঁধি            জগৎ হইল পরিবার। বিষ্ণু আসি মহাকাশে, লেখনী ধরিয়া করে            মহান্‌ কালের পত্র খুলি            ধরিয়া ব্রহ্মার ধ্যানগুলি            একমনে পরম যতনে,            লিখি লিখি যুগ-যুগান্তর            বাঁধি দিলা ছন্দের বাঁধনে।           জগতের মহা বেদব্যাস            গঠিলা নিখিল উপন্যাস,            বিশৃঙ্খল বিশ্বগীতি লয়ে            মহাকাব্য করিলা রচন।            জগতের ফুলরাশি লয়ে            গাঁথি মালা মনের মতন            নিজ গলে কৈলা আরোপণ। জগতের মালাখানি জগৎ-পতির গলে            মরি কিবা সেজেছে অতুল            দেখিবারে হৃদয় আকুল।            বিশ্বমালা অসীম অক্ষয়, কত চন্দ্র কত সূর্য কত গ্রহ কত তারা            কত বর্ণ কত গীত-ময়।            নিজ নিজ পরিবার লয়ে            ভ্রমে সবে নিজ নিজ পথে,            বিষ্ণুদেব চক্র হাতে লয়ে,            চক্রে চক্রে বাঁধিলা জগতে।            চক্রপথে ভ্রমে গ্রহ তারা,            চক্রপথে রবি শশী ভ্রমে,            শাসনের গদা হস্তে লয়ে            চরাচর রাখিলা নিয়মে।            দুরন্ত প্রেমেরে মন্ত্র পড়ি            বাঁধি দিলা বিবাহবন্ধনে।            মহাকায় শনিরে ঘেরিয়া            হাতে হাতে ধরিয়া ধরিয়া            নাচিতে লাগিল এক তালে            সুধামুখ চাঁদ শত শত।            পৃথিবীর সমুদ্রহৃদয়            চন্দ্রে হেরি উঠে উথলিয়া।            পৃথিবীর মুখপানে চেয়ে            চন্দ্র হাসে আনন্দে গলিয়া।            মিলি যত গ্রহ ভাইবোন            এক অন্নে হইল পালিত,            তারা-সহোদর যত ছিল            এক সাথে হইল মিলিত।            কত কত শত বর্ষ ধরি            দূর পথ অতিক্রম করি            পাঠাইছে বিদেশ হইতে            তারাগুলি আলোকের দূত            ক্ষুদ্র ওই দূরদেশবাসী            পৃথিবীর বারতা লইতে।            রবি ধায় রবির চৌদিকে            গ্রহ ধায় রবিরে ঘেরিয়া            চাঁদ হাসে গ্রহমুখ চেয়ে,            তারা হাসে তারায় হেরিয়া।            মহাছন্দ মহা অনুপ্রাস          চরাচরে বিস্তারিল পাশ।     পশিয়া মানসসরোবরে            স্বর্ণপদ্ম করিলা চয়ন,            বিষ্ণুদেব প্রসন্ন আননে            পদ্মপানে মেলিল নয়ন।            ফুটিয়া উঠিল শতদল,            বাহিরিল কিরণ বিমল,            মাতিল রে দ্যুলোক ভূলোক            আকাশে পুরিল পরিমল।            চরাচরে উঠাইয়া গান            চরাচরে জাগাইয়া হাসি            কোমল কমলদল হতে            উঠিল অতুল রূপরাশি।            মেলি দুটি নয়ন বিহ্বল            ত্যজিয়া সে শতদলদল            ধীর ধীরে জগৎ-মাঝারে            লক্ষ্মী আসি ফেলিলা চরণ--            গ্রহে গ্রহে তারায় তারায়            ফুটিল রে বিচিত্র বরন।            জগৎ মুখের পানে চায়,            জগৎ পাগল হয়ে যায়,            নাচিতে লাগিল চারি দিকে--            আনন্দের অন্ত নাহি পায়।            জগতের মুখপানে চেয়ে            লক্ষ্মী যবে হাসিলেন হাসি            মেঘেতে ফুটিল ইন্দ্রধনু,            কাননে ফুটিল ফুলরাশি--            হাসি লয়ে করে কাড়াকাড়ি            চন্দ্র সূর্য গ্রহ চারি ভিতে,            চাহে তাঁর চরণছায়ায়            যৌবনকুসুম ফুটাইতে।            জগতের হৃদয়ের আশা            দশ দিকে আকুল হইয়া            ফুল হয়ে পরিমল হয়ে            গান হয়ে উঠিল ফুটিয়া।            একি হেরি যৌবন-উচ্ছ্বাস,            একি রে মোহন ইন্দ্রজাল--            সৌন্দর্যকুসুমে গেল ঢেকে            জগতের কঠিন কঙ্কাল।            হাসি হয়ে ভাতিল আকাশে            তারকার রক্তিম নয়ান,            জগতের হর্ষকোলাহল            রাগিণীতে হল অবসান।            কোমলে কঠিন লুকাইল,            শক্তিরে ঢাকিল রূপরাশি,            প্রেমের হৃদয়ে মহা বল            অশনির মুখে দিল হাসি।            সকলি হইল মনোহর            সাজিল জগৎ-চরাচর।মহাছন্দে বাঁধা হয়ে যুগ যুগ যুগ যুগান্তর            পড়িল নিয়ম-পাঠশালে            অসীম জগৎ-চরাচর।            শ্রান্ত হয়ে এল কলেবর,            নিদ্রা আসে নয়নে তাহার,            আকর্ষণ হতেছে শিথিল,            উত্তাপ হতেছে একাকার।            জগতের প্রাণ হতে            উঠিল রে বিলাপসংগীত,            কাঁদিয়া উঠিল চারি ভিত । পুরবে বিলাপ উঠে, পশ্চিমে বিলাপ উঠে,            কাঁদিল রে উত্তর দক্ষিণ, কাঁদে গ্রহ, কাঁদে তারা, শ্রান্তদেহে কাঁদে রবি--            জগৎ হইল শান্তিহীন।            চারি দিক হতে উঠিতেছে            আকুল বিশ্বের কণ্ঠস্বর,            ‘‘জাগো জাগো জাগো মহাদেব,            কবে মোরা পাব অবসর?            অলঙ্ঘ্য নিয়মপথে ভ্রমি            হয়েছে হে শ্রান্ত কলেবর।            নিয়মের পাঠ সমাপিয়া            সাধ গেছে খেলা করিবারে,            একবার ছেড়ে দাও, দেব,            অনন্ত এ আকাশ-মাঝারে।’’            জগতের আত্মা কহে কাঁদি,            ‘‘আমারে নূতন দেহ দাও—            প্রতিদিন বাড়িছে হৃদয়,            প্রতিদিন বাড়িতেছে আশা,            প্রতিদিন টুটিতেছে দেহ,            প্রতিদিন ভাঙিতেছে বল।            গাও দেব মরণসংগীত            পাব মোরা নূতন জীবন।’’            জগৎ কাঁদিল উচ্চরবে            জাগিয়া উঠিল মহেশ্বর,            তিন কাল ত্রিনয়ন মেলি,            হেরিলেন দিক দিগন্তর। প্রলয়বিষাণ তুলি করে ধরিলেন শূলী,            পদতলে জগৎ চাপিয়া— জগতের আদি অন্ত থরথর থরথর            একবার উঠিল কাঁপিয়া।            বিষাণেতে পুরিলা নিশ্বাস,            ছিঁড়িয়া পড়িয়া গেল            জগতের সমস্ত বাঁধন। উঠিল রে মহাশূন্যে গরজিয়া তরঙ্গিয়া ছন্দোমুক্ত জগতের উন্মত্ত আনন্দকোলাহল। ছিঁড়ে গেল রবি শশী গ্রহ তারা ধূমকেতু,            কে কোথায় ছুটে গেল,            ভেঙে গেল, টুটে গেল,            চন্দ্রে সূর্যে গুঁড়াইয়া            চূর্ণ চূর্ণ হয়ে গেল।            মহা অগ্নি জ্বলিল রে,            আকাশের অনন্ত হৃদয়            অগ্নি, অগ্নি, শুধু অগ্নিময়।            মহা অগ্নি উঠিল জ্বলিয়া            জগতের মহা চিতানল। খণ্ড খণ্ড রবি শশী, চূর্ণ চূর্ণ গ্রহ তারা            বিন্দু বিন্দু আঁধারের মতো            বরষিছে চারি দিক হতে,            অনলের তেজোময় গ্রাসে            নিমেষেতে যেতেছে মিশায়ে।            সৃজনের আরম্ভসময়ে            আছিল অনাদি অন্ধকার,            সৃজনের ধ্বংসযুগান্তরে            রহিল অসীম হুতাশন। অনন্ত আকাশগ্রাসী অনলসমুদ্রমাঝে            মহাদেব মুদি ত্রিনয়ান            করিতে লাগিলা মহাধ্যান। সৃষ্টিলীলাপ্রাঙ্গনের প্রান্তে দাঁড়াইয়া সৃষ্টিলীলাপ্রাঙ্গণের প্রান্তে দাঁড়াইয়া দেখি ক্ষণে ক্ষণে তমসের পরপার, যেথা মহা-অব্যক্তের অসীম চৈতন্যে ছিনু লীন। আজি এ প্রভাতকালে ঋষিবাক্য জাগে মোর মনে। করো করো অপাবৃত হে সূর্য,আলোক-আবরণ, তোমার অন্তরতম পরম জ্যোতির মধ্যে দেখি আপনার আত্মার স্বরূপ। যে আমি দিনের শেষে বায়ুতে মিশায় প্রাণবায়ু, ভস্মে যার দেহ অন্ত হবে, যাত্রাপথে সে আপন না ফেলুক ছায়া সত্যের ধরিয়া ছদ্মবেশ। এ মর্তের লীলাক্ষেত্রে সুখে দুঃখে অমৃতের স্বাদ পেয়েছি তো ক্ষণে ক্ষণে, বারে বারে অসীমেরে দেখেছি সীমার অন্তরালে। বুঝিয়াছি,এ জন্মের শেষ অর্থ ছিল সেইখানে, সেই সুন্দরের রূপে, সে সংগীতে অনির্বচনীয়। খেলাঘরে আজ যবে খুলে যাবে দ্বার ধরণীর দেবালয়ে রেখে যাব আমার প্রণাম, দিয়ে যাব জীবনের সে নৈবেদ্যগুলি মূল্য যার মৃত্যুর অতীত। সে তো সে দিনের কথা, বাক্যহীন যবে সে তো সে দিনের কথা, বাক্যহীন যবে এসেছিনু প্রবাসীর মতো এই ভবে বিনা কোনো পরিচয়, রিক্ত শূন্য হাতে, একমাত্র ক্রন্দন সম্বল লয়ে সাথে। আজ সেথা কী করিয়া মানুষের প্রীতি কণ্ঠ হতে টানি লয় যত মোর গীতি। এ ভুবনে মোর চিত্তে অতি অল্প স্থান নিয়েছ, ভুবননাথ। সমস্ত এ প্রাণ সংসারে করেছ পূর্ণ। পাদপ্রান্তে তব প্রত্যহ যে ছন্দে-বাঁধা গীত নব নব দিতেছি অঞ্জলি, তাও তব পূজাশেষে লবে সবে তোমা সাথে মোরে ভালোবেসে এই আশাখানি মনে আছে অবিচ্ছেদে। যে প্রবাসে রাখ সেথা প্রেমে রাখো বেঁধে।নব নব প্রবাসেতে নব নব লোকে বাঁধিবে এমনি প্রেমে। প্রেমের আলোকে বিকশিত হব আমি ভুবনে ভুবনে নব নব পুষ্পদলে; প্রেম-আকর্ষণে যত গূঢ় মধু মোর অন্তরে বিলসে উঠিবে অক্ষয় হয়ে নব নব রসে, বাহিরে আসিবে ছুটি– অন্তহীন প্রাণে নিখিল জগতে তব প্রেমের আহ্বানে নব নব জীবনের গন্ধ যাব রেখে, নব নব বিকাশের বর্ণ যাব এঁকে। কে চাহে সংকীর্ণ অন্ধ অমরতাকূপে এক ধরাতলমাঝে শুধু একরূপে বাঁচিয়া থাকিতে। নব নব মৃত্যুপথে তোমারে পূজিতে যাব জগতে জগতে।  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) সে লড়াই ঈশ্বরের বিরুদ্ধে লড়াই সে লড়াই ঈশ্বরের বিরুদ্ধে লড়াই যে যুদ্ধে ভাইকে মারে ভাই।   (স্ফুলিঙ্গ) সেই আমাদের দেশের পদ্ম সেই আমাদের দেশের পদ্ম তেমনি মধুর হেসে ফুটেছে, ভাই, অন্য নামে অন্য সুদূর দেশে।   (স্ফুলিঙ্গ) সেই পুরাতন কালে ইতিহাস যবে সেই পুরাতন কালে ইতিহাস যবে সংবাদে ছিল না মুখরিত নিস্তব্ধ খ্যাতির যুগে-- আজিকার এইমতো প্রাণযাত্রাকল্লোলিত প্রাতে যাঁরা যাত্রা করেছেন মরণশঙ্কিল পথে আত্মার অমৃত-অন্ন করিবারে দান দূরবাসী অনাত্মীয় জনে, দলে দলে যাঁরা উত্তীর্ণ হন নি লক্ষ্য, তৃষানিদারুণ মরুবালুতলে অস্থি গিয়েছেন রেখে, সমুদ্র যাঁদের চিহ্ন দিয়েছে মুছিয়া, অনারদ্ধ কর্মপথে অকৃতার্থ হন নাই তাঁরা-- মিশিয়া আছেন সেই দেহাতীত মহাপ্রাণ-মাঝে শক্তি জোগাইছে যাহা অগোচরে চিরমানবেরে-- তাঁহাদের করুণার স্পর্শ লভিতেছি আজি এই প্রভাত-আলোকে, তাঁহাদের করি নমস্কার। সেতারের তারে সেতারের তারে ধানশি মিড়ে মিড়ে উঠে বাজিয়া। গোধূলির রাগে মানসী স্বরে যেন এল সাজিয়া।   (স্ফুলিঙ্গ) সেদিন আমাদের ছিল খোলা সভা সেদিন আমাদের ছিল খোলা সভা আকাশের নিচে রাঙামাটির পথের ধারে। ঘাসের 'পরে বসেছে সবাই। দক্ষিণের দিকে শালের গাছ সারি সারি, দীর্ঘ, ঋজু, পুরাতন,-- স্তব্ধ দাঁড়িয়ে, শুক্লনবমীর মায়াকে উপেক্ষা ক'রে;-- দূরে কোকিলের ক্লান্ত কাকলিতে বনস্পতি উদাসীন। ও যেন শিবের তপোবন-দ্বারের নন্দী, দৃঢ় নির্মম ওর ইঙ্গিত। সভার লোকেরা বললে,-- "একটা কিছু শোনাও, কবি, রাত গভীর হয়ে এল।" খুললেম পুঁথিখানা, যত পড়ে দেখি সংকোচ লাগে মনে। এরা এত কোমল, এত স্পর্শকাতর, এত যত্নের ধন। এদের কণ্ঠস্বর এত মৃদু, এত কুণ্ঠিত। এরা সব অন্তঃপুরিকা, রাঙা অবগুণ্ঠন মুখের 'পরে। তার উপরে ফুলকাটা পাড়, সোনার সুতোয়। রাজহংসের গতি ওদের, মাটিতে চলতে বাধা। প্রাচীন কাব্যে এদের বলেছে ভীরু, বলেছে, বরবর্ণিনী। বন্দিনী ওরা বহু সম্মানে। ওদের নূপুর ঝংকৃত হয় প্রাচীরঘেরা ঘরে, অনেক দামের আস্তরণে। বাধা পায় তার নৈপুণ্যের বন্ধনে। এই পথের ধারের সভায়, আসতে পারে তারাই সংসারের বাঁধন যাদের খসেছে, খুলে ফেলেছে হাতের কাঁকন মুছে ফেলেছে সিঁদুর; যারা ফিরবে না ঘরের মায়ায়, যারা তীর্থযাত্রী; যাদের অসংকোচ অক্লান্ত গতি, ধূলিধূসর গায়ের বসন; যারা পথ খুঁজে পায় আকাশের তারা দেখে; কোনো দায় নেই যাদের কারো মন জুগিয়ে চলবার; কত রৌদ্রতপ্ত দিনে কত অন্ধকার অর্ধরাত্রে যাদের কণ্ঠ প্রতিধ্বনি জাগিয়েছে অজানা শৈলগুহায়,-- জনহীন মাঠে, পথহীন অরণ্যে। কোথা থেকে আনব তাদের নিন্দা প্রশংসার ফাঁদে টেনে। উঠে দাঁড়ালেম আসন ছেড়ে। ওরা বললে, "কোথা যাও কবি?" আমি বললেম,-- "যাব দুর্গমে, কঠোর নির্মমে, নিয়ে আসব কঠিনচিত্ত উদাসীনের গান।" সেদিন আমার জন্মদিন সেদিন আমার জন্মদিন। প্রভাতের প্রণাম লইয়া উদয়দিগন্ত-পানে মেলিলাম আঁখি, দেখিলাম সদ্যস্নাত উষা আঁকি দিল আলোকচন্দনলেখা হিমাদ্রির হিমশুভ্র পেলব ললাটে। যে মহাদূরত্ব আছে নিখিল বিশ্বের মর্মস্থানে তারি আজ দেখিনু প্রতিমা গিরীন্দ্রের সিংহাসন-'পরে। পরম গাম্ভীর্যে যুগে যুগে ছায়াঘন অজানারে করিছে পালন পথহীন মহারণ্য-মাঝে, অভ্রভেদী সুদূরকে রেখেছে বেষ্টিয়া দুর্ভেদ্য দুর্গমতলে উদয়-অস্তের চক্রপথে। আজি এই জন্মদিনে দূরত্বের অনুভব অন্তরে নিবিড় হয়ে এল। যেমন সুদূর ওই নক্ষত্রের পথ নীহারিকা-জ্যোতির্বাষ্প-মাঝে রহস্যে আবৃত, আমার দূরত্ব আমি দেখিলাম তেমনি দুর্গমে- অলক্ষ্য পথের যাত্রী, অজানা তাহার পরিণাম। আজি এই জন্মদিনে দূরের পথিক সেই তাহারি শুনিনু পদক্ষেপ নির্জন সমুদ্রতীর হতে। সেদিন কি তুমি এসেছিলে ওগো সেদিন কি তুমি এসেছিলে ওগো, সে কি তুমি, মোর সভাতে। হাতে ছিল তব বাঁশি, অধরে অবাক হাসি, সেদিন ফাগুন মেতে উঠেছিল মদবিহ্বল শোভাতে। সে কি তুমি ওগো, তুমি এসেছিলে সেদিন নবীন প্রভাতে– নবযৌবনসভাতে।সেদিন আমার যত কাজ ছিল সব কাজ তুমি ভুলালে। খেলিলে সে কোন্‌ খেলা, কোথা কেটে গেল বেলা– ঢেউ দিয়ে দিয়ে হৃদয়ে আমার রক্তকমল দুলালে। পুলকিত মোর পরানে তোমার বিলোল নয়ন বুলালে, সব কাজ মোর ভুলালে।তার পরে হায় জানি নে কখন ঘুম এল মোর নয়নে। উঠিনু যখন জেগে ঢেকেছে গগন মেঘে তরুতলে আছি একেলা পড়িয়া দলিত পত্রশয়নে। তোমাতে আমাতে রত ছিনু যবে কাননে কুসুমচয়নে ঘুম এল মোর নয়নে।সেদিনের সভা ভেঙে গেছে সব আজি ঝরঝর বাদরে। পথে লোক নাহি আর, রুদ্ধ করেছি দ্বার, একা আছে প্রাণ ভূতলশয়ান আজিকার ভরা ভাদরে। তুমি কি দুয়ারে আঘাত করিলে– তোমারে লব কি আদরে আজি ঝরঝর বাদরে।তুমি যে এসেছ ভস্মমলিন তাপসমুরতি ধরিয়া। স্তিমিত নয়নতারা ঝলিছে অনলপারা, সিক্ত তোমার জটাজুট হতে সলিল পড়িছে ঝরিয়া। বাহির হইতে ঝড়ের আঁধার আনিয়াছ সাথে করিয়া তাপসমুরতি ধরিয়া।নমি হে ভীষণ, মৌন, রিক্ত, এসো মোর ভাঙা আলয়ে। ললাটে তিলকরেখা যেন সে বহ্নিলেখা, হস্তে তোমার লৌহদণ্ড বাজিছে লৌহবলয়ে। শূন্য ফিরিয়া যেয়ো না অতিথি, সব ধন মোর না লয়ে। এসো এসো ভাঙা আলয়ে।  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) সোনায় রাঙায় মাখামাখি সোনায় রাঙায় মাখামাখি, রঙের বাঁধন কে দেয় রাখি পথিক রবির স্বপন ঘিরে। পেরোয় যখন তিমিরনদী তখন সে রঙ মিলায় যদি প্রভাতে পায় আবার ফিরে। অস্ত-উদয়-রথে রথে যাওয়া-আসার পথে পথে দেয় সে অাপন আলো ঢালি। পায় সে ফিরে মেঘের কোণে, পায় ফাগুনের পারুলবনে প্রতিদানের রঙের ডালি।   (স্ফুলিঙ্গ) সোনার তরী গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা। কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।   রাশি রাশি ভারা ভারা   ধান-কাটা হল সারা,   ভরা নদী ক্ষুরধারা খরপরশা-- কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা॥একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা--- চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।   পরপারে দেখি আঁকা   তরুছায়ামসী-মাখা   গ্রামখানি মেঘে ঢাকা   প্রভাতবেলা--- এপারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা॥গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে! দেখে যেন মনে হয়, চিনি উহারে।   ভরা পালে চলে যায়,   কোনো দিকে নাহি চায়,   ঢেউগুলি নিরুপায়   ভাঙে দু ধারে--- দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে॥ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্‌ বিদেশে? বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।   যেয়ো যেথা যেতে চাও,   যারে খুশি তারে দাও---   শুধু তুমি নিয়ে যাও   ক্ষণিক হেসে আমার সোনার ধান কূলেতে এসে॥  যত চাও তত লও তরণী-পরে। আর আছে?--- আর নাই, দিয়েছি ভরে॥   এতকাল নদীকূলে   যাহা লয়ে ছিনু ভুলে   সকলি দিলাম তুলে থরে বিথরে--- এখন আমারে লহো করুণা ক'রে॥ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।   শ্রাবণগগন ঘিরে   ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,   শূন্য নদীর তীরে রহি নু পড়ি--- যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী॥ সৌন্দর্যের সংযম নর কহে, বীর মোরা যাহা ইচ্ছা করি। নারী কহে জিহ্বা কাটি, শুনে লাজে মরি! পদে পদে বাধা তব, কহে তারে নর। কবি কহে, তাই নারী হয়েছে সুন্দর।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) স্কুল-পালানে মাস্টারি-শাসনদুর্গে সিঁধকাটা ছেলে                    ক্লাসের কর্তব্য ফেলে         জানি না কী টানে ছুটিতাম অন্দরের উপেক্ষিত নির্জন বাগানে ।               পুরোনো আমড়াগাছ হেলে আছে                    পাঁচিলের কাছে ,                 দীর্ঘ আয়ু বহন করিছে তার         পুঞ্জিত নিঃশব্দ স্মৃতি বসন্তবর্ষার ।              লোভ করি নাই তার ফলে ,                    শুধু তার তলে সে সঙ্গরহস্য আমি করিতাম লাভ                     যার আবির্ভাব অলক্ষ্যে ব্যাপিয়া আছে সর্ব জলে স্থলে ।         পিঠ রাখি কুঞ্চিত বল্কলে                    যে পরশ লভিতাম         জানি না তাহার কোনো নাম ; হয়তো সে আদিম প্রাণের         আতিথ্যদানের                    নিঃশব্দ আহ্বান ,                          যে প্রথম প্রাণ         একই বেগ জাগাইছে গোপন সঞ্চারে                          রসরক্তধারে              মানবশিরায় আর তরুর তন্তুতে ,         একই স্পন্দনের ছন্দ উভয়ের অণুতে অণুতে ।                        সেই মৌনী বনস্পতি         সুবৃহৎ আলস্যের ছদ্মবেশে অলক্ষিতগতি       সূক্ষ্ম সম্বন্ধের জাল প্রসারিছে নিত্যই আকাশে ,                    মাটিতে বাতাসে ,               লক্ষ লক্ষ পল্লবের পাত্র লয়ে         তেজের ভোজের পানালয়ে । বিনা কাজে আমিও তেমনি বসে থাকি                     ছায়ায় একাকী ,              আলস্যের উৎস হতে         চৈতন্যের বিবিধ দিগ্‌বাহী স্রোতে আমার সম্বন্ধ চরাচরে        বিস্তারিছে অগোচরে কল্পনার সূত্রে বোনা জালে    দূর দেশে দূর কালে ।       প্রাণে মিলাইতে প্রাণ     সে বয়সে নাহি ছিল ব্যবধান ; নিরুদ্ধ করে নি পথ ভাবনার স্তূপ ;         গাছের স্বরূপ সহজে অন্তর মোর করিত পরশ ।         অনাদৃত সে বাগান চায় নাই যশ                    উদ্যানের পদবীতে ।              তারে চিনাইতে মালীর নিপুণতার প্রয়োজন কিছু ছিল নাকো ।              যেন কী আদিম সাঁকো                    ছিল মোর মনে বিশ্বের অদৃশ্য পথে যাওয়ার আসার প্রয়োজনে ।          কুলগাছ দক্ষিণে কুয়োর ধারে , পুবদিকে নারিকেল সারে সারে ,              বাকি সব জঙ্গল আগাছা ।                    একটা লাউয়ের মাচা কবে যত্ন ছিল কারো , ভাঙা চিহ্ন রেখে গেছে পাছে ।              বিশীর্ণ গোলকচাঁপা-গাছে                    পাতাশূন্য ডাল অভুগ্নের ক্লিষ্ট ইশারার মতো । বাঁধানো চাতাল ;         ফাটাফুটো মেঝে তার , তারি থেকে গরিব লতাটি যেত চোখে-না-পড়ার ফুলে ঢেকে ।                    পাঁচিল ছ্যাৎলা-পড়া ছেলেমি খেয়ালে যেন রূপকথা গড়া কালের লেখনি-টানা নানামতো ছবির ইঙ্গিতে , সবুজে পাটলে আঁকা কালো সাদা রেখার ভঙ্গিতে ।              সদ্য ঘুম থেকে জাগা          প্রতি প্রাতে নূতন করিয়া ভালো-লাগা              ফুরাত না কিছুতেই ।         কিসে যে ভরিত মন সে তো জানা নেই । কোকিল দোয়েল টিয়ে এ বাগানে ছিল না কিছুই ,                          কেবল চড়ুই ,                    আর ছিল কাক ।                          তার ডাক                    সময় চলার বোধ মনে এনে দিত । দশটা বেলার রোদ         সে ডাকের সঙ্গে মিশে নারিকেল-ডালে              দোলা খেত উদাস হাওয়ার তালে তালে । কালো অঙ্গে চটুলতা , গ্রীবাভঙ্গি , চাতুরী সতর্ক আঁখিকোণে ,                    পরস্পর ডাকাডাকি ক্ষণে ক্ষণে —              এ রিক্ত বাগানটিরে দিয়েছিল বিশেষ কী দাম ।         দেখিতাম , আবছায়া ভাবনায় ভালোবাসিতাম । স্তন ১ নারীর প্রাণের প্রেম মধুর কোমল , বিকশিত যৌবনের বসন্তসমীরে কুসুমিত হয়ে ওই ফুটেছে বাহিরে , সৌরভসুধায় করে পরান পাগল । মরমের কোমলতা তরঙ্গ তরল উথলি উঠেছে যেন হৃদয়ের তীরে । কী যেন বাঁশির ডাকে জগতের প্রেমে বাহিরিয়া আসিতেছে সলাজ হৃদয় , সহসা আলোতে এসে গেছে যেন থেমে — শরমে মরিতে চায় অঞ্চল – আড়ালে । প্রেমের সংগীত যেন বিকশিয়া রয় , উঠিছে পড়িছে ধীরে হৃদয়ের তালে । হেরো গো কমলাসন জননী লক্ষ্মীর — হেরো নারীহৃদয়ের পবিত্র মন্দির ।২ পবিত্র সুমেরু বটে এই সে হেথায় , দেবতা বিহারভূমি কনক – অচল । উন্নত সতীর স্তন স্বরগ প্রভায় মানবের মর্ত্যভূমি করেছে উজ্জ্বল । শিশু রবি হোথা হতে ওঠে সুপ্রভাতে , শ্রান্ত রবি সন্ধ্যাবেলা হোথা অস্ত যায় । দেবতার আঁখিতারা জেগে থাকে রাতে , বিমল পবিত্র দুটি বিজন শিখরে । চিরস্নেহ – উৎসধারে অমৃত নির্ঝরে সিক্ত করি তুলিতেছে বিশ্বের অধর । জাগে সদা সুখসুপ্ত ধরণীর’পরে , অসহায় জগতের অসীম নির্ভর । ধরণীর মাঝে থাকি স্বর্গ আছে চুমি , দেবশিশু মানবের ওই মাতৃভূমি ।  (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) স্তব্ধ যাহা পথপার্শ্বে, অচৈতন্য, যা রহে না জেগে স্তব্ধ যাহা পথপার্শ্বে, অচৈতন্য, যা রহে না জেগে ধূলিবিলুন্ঠিত হয় কালের চরণঘাত লেগে। যে নদীর ক্লান্তি ঘটে মধ্যপথে সিন্ধু-অভিসারে অবরুদ্ধ হয় পঙ্কভারে। নিশ্চল গৃহের কোণে নিভৃতে স্তিমিত যেই বাতি নির্জীব আলোক তার লুপ্ত হয় না ফুরাতে রাতি। পান্থের অন্তরে জ্বলে দীপ্ত আলো জাগ্রত নিশীথে, জানে না সে আঁধারে মিশিতে।   (স্ফুলিঙ্গ) স্তুতি নিন্দা স্তুতি নিন্দা বলে আসি, গুণ মহাশয়, আমরা কে মিত্র তব? গুণ শুনি কয়, দুজনেই মিত্র তোরা শত্রু দুজনেই— তাই ভাবি শত্রু মিত্র কারে কাজ নেই।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) স্ত্রীর বোন চায়ে তার স্ত্রীর বোন চায়ে তার ভুলে ঢেলেছিল কালি, “শ্যালী’ ব’লে ভর্ৎসনা করেছিল বনমালী। এত বড়ো গালি শুনে জ্ব’লে মরে মনাগুনে, আফিম সে খাবে কিনা সাত মাস ভাবে খালি, অথবা কি গঙ্গায় পোড়া দেহ দিবে ডালি।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) স্থির জেনেছিলাম পেয়েছি তোমাকে স্থির জেনেছিলেম, পেয়েছি তোমাকে, মনেও হয়নি তোমার দানের মূল্য যাচাই করার কথা। তুমিও মূল্য করনি দাবি। দিনের পর দিন গেল, রাতের পর রাত, দিলে ডালি উজাড় ক'রে। আড়চোখে চেয়ে আনমনে নিলেম তা ভাণ্ডারে; পরদিনে মনে রইল না। নববসন্তের মাধবী যোগ দিয়েছিল তোমার দানের সঙ্গে, শরতের পূর্ণিমা দিয়েছিল তারে স্পর্শ। তোমার কালো চুলের বন্যায় আমার দুই পা ঢেকে দিয়ে বলেছিলে "তোমাকে যা দিই তোমার রাজকর তার চেয়ে অনেক বেশি; আরো দেওয়া হল না আরো যে আমার নেই।" বলতে বলতে তোমার চোখ এল ছলছলিয়ে। আজ তুমি গেছ চলে, দিনের পর দিন আসে, রাতের পর রাত, তুমি আস না। এতদিন পরে ভাণ্ডার খুলে দেখছি তোমার রত্নমালা, নিয়েছি তুলে বুকে। যে গর্ব আমার ছিল উদাসীন সে নুয়ে পড়েছে সেই মাটিতে যেখানে তোমার দুটি পায়ের চিহ্ন আছে আঁকা। তোমার প্রেমের দাম দেওয়া হল বেদনায়, হারিয়ে তাই পেলেম তোমায় পূর্ণ ক'রে। স্নিগ্ধ মেঘ তীব্র তপ্ত স্নিগ্ধ মেঘ তীব্র তপ্ত আকাশেরে ঢাকে, আকাশ তাহার কোনো চিহ্ন নাহি রাখে। তপ্ত মাটি তৃপ্ত যবে হয় তার জলে নম্ৰ নমস্কার তারে দেয় ফুলে ফলে।   (স্ফুলিঙ্গ) স্নেহগ্রাস অন্ধ মোহবন্ধ তব দাও মুক্ত করি— রেখো না বসায়ে দ্বারে জাগ্রত প্রহরী হে জননী, আপনার স্নেহ-কারাগারে সন্তানেরে চিরজন্ম বন্দী রাখিবারে। বেষ্টন করিয়া তারে আগ্রহ-পরশে, জীর্ণ করি দিয়া তারে লালনের রসে, মনুষ্যত্ব-স্বাধীনতা করিয়া শোষণ আপন ক্ষুধিত চিত্ত করিবে পোষণ? দীর্ঘ গর্ভবাস হতে জন্ম দিলে যার স্নেহগর্ভে গ্রাসিয়া কি রাখিবে আবার? চলিবে সে এ সংসারে তব পিছু-পিছু? সে কি শুধু অংশ তব, আর নহে কিছু? নিজের সে, বিশ্বের সে, বিশ্বদেবতার— সন্তান নহে, গো মাতঃ, সম্পত্তি তোমার। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) স্নেহদৃশ্য বয়স বিংশতি হবে, শীর্ণ তনু তার বহু বরষের রোগে অস্থিচর্মসার। হেরি তার উদাসীন হাসিহীন মুখ মনে হয় সংসারে লেশমাত্র সুখ পারে না সে কোনোমতে করিতে শোষণ দিয়ে তার সর্বদেহ সর্বপ্রাণমন। স্বল্পপ্রাণ শীর্ণ দীর্ঘ জীর্ণ দেহভার শিশুসম কক্ষে বহি জননী তাহার আশাহীন দৃঢ়ধৈর্য মৌনম্লানমুখে প্রতিদিন লয়ে আসে পথের সম্মুখে। আসে যায় রেলগাড়ি, ধায় লোকজন— সে চাঞ্চল্যে মুমূর্ষুর অনাসক্ত মন যদি কিছু ফিরে চায় জগতের পানে, এইটুকু আশা ধরি মা তাহারে আনে।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) স্পর্ধা হাউই কহিল, মোর কী সাহস, ভাই, তারকার মুখে আমি দিয়ে আসি ছাই! কবি কহে, তার গায়ে লাগে নাকো কিছু, সে ছাই ফিরিয়া আসে তোরি পিছু পিছু।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) স্পর্শমণি নদীতীরে বৃন্দাবনে সনাতন একমনে              জপিছেন নাম, হেনকালে দীনবেশে ব্রাহ্মণ চরণে এসে              করিল প্রণাম। শুধালেন সনাতন, 'কোথা হতে আগমন,              কী নাম ঠাকুর?' বিপ্র কহে, 'কিবা কব, পেয়েছি দর্শন তব              ভ্রমি বহুদূর। জীবন আমার নাম, মানকরে মোর ধাম,              জিলা বর্ধমানে-- এতবড়ো ভাগ্যহত দীনহীন মোর মতো              নাই কোনোখানে। জমিজমা আছে কিছু, করে আছি মাথা নিচু,              অল্পস্বল্প পাই। ক্রিয়াকর্ম-যজ্ঞযাগে বহু খ্যাতি ছিল আগে,              আজ কিছু নাই। আপন উন্নতি লাগি শিব-কাছে বর মাগি              করি আরাধনা। একদিন নিশিভোরে স্বপ্নে দেব কন মোরে--              পুরিবে প্রার্থনা! যাও যমুনার তীর, সনাতন গোস্বামীর              ধরো দুটি পায়! তাঁরে পিতা বলি মেনো, তাঁরি হাতে আছে জেনো              ধনের উপায়।'শুনি কথা সনাতন ভাবিয়া আকুল হন--              'কী আছে আমার! যাহা ছিল সে সকলি ফেলিয়া এসেছি চলি--              ভিক্ষামাত্র সার।' সহসা বিস্মৃতি ছুটে, সাধু ফুকারিয়া উঠে,              'ঠিক বটে ঠিক। একদিন নদীতটে কুড়ায়ে পেয়েছি বটে              পরশমানিক। যদি কভু লাগে দানে সেই ভেবে ওইখানে              পুঁতেছি বালুতে-- নিয়ে যাও হে ঠাকুর, দুঃখ তব হবে দূর              ছুঁতে নাহি ছুঁতে।'বিপ্র তাড়াতাড়ি আসি খুঁড়িয়া বালুকারাশি              পাইল সে মণি, লোহার মাদুলি দুটি সোনা হয়ে উঠে ফুটি,              ছুঁইল যেমনি। ব্রাহ্মণ বালুর 'পরে বিস্ময়ে বসিয়া পড়ে--              ভাবে নিজে নিজে। যমুনা কল্লোলগানে চিন্তিতের কানে কানে              কহে কত কী যে! নদীপারে রক্তছবি দিনান্তের ক্লান্ত রবি              গেল অস্তাচলে-- তখন ব্রাহ্মণ উঠে সাধুর চরণে লুটে              কহে অশ্রুজলে, 'যে ধনে হইয়া ধনী মণিরে মান না মণি              তাহারি খানিক মাগি আমি নতশিরে।' এত বলি নদীনীরে              ফেলিল মানিক।২৯ আশ্বিন, ১৩০৬ স্পষ্ট সত্য সংসার কহিল, মোর নাহি কপটতা, জন্মমৃত্যু, সুখদুঃখ, সবই স্পষ্ট কথা। আমি নিত্য কহিতেছি যথাসত্য বাণী, তুমি নিত্য লইতেছ মিথ্যা অর্থখানি।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) স্পষ্টভাষী বসন্ত এসেছে বনে, ফুল ওঠে ফুটি, দিনরাত্রি গাহে পিক, নাহি তার ছুটি। কাক বলে, অন্য কাজ নাহি পেলে খুঁজি, বসন্তের চাটুগান শুরু হল বুঝি! গান বন্ধ করি পিক উঁকি মারি কয়, তুমি কোথা হতে এলে কে গো মহাশয়? আমি কাক স্পষ্টভাষী, কাক ডাকি বলে। পিক কয়, তুমি ধন্য, নমি পদতলে; স্পষ্টভাষা তব কণ্ঠে থাক বারো মাস, মোর থাক্‌ মিষ্টভাষা আর সত্যভাষ।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) স্বদেশদ্বেষী কেঁচো কয়, নীচ মাটি, কালো তার রূপ। কবি তারে রাগ ক’রে বলে, চুপ চুপ! তুমি যে মাটির কীট, খাও তারি রস, মাটির নিন্দায় বাড়ে তোমারি কি যশ!   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) স্বপ্ন কাল রাতে দেখিনু স্বপন — দেবতা - আশিস - সম                 শিয়রে সে বসি মম                মুখে রাখি করুণনয়ন কোমল অঙ্গুলি শিরে                বুলাইছে ধীরে ধীরে                সুধামাখা প্রিয় - পরশন —                 কাল রাতে হেরিনু স্বপন । হেরি সেই মুখপানে                 বেদনা ভরিল প্রাণে                  দুই চক্ষু জলে ছলছলি — বুকভরা অভিমান                   আলোড়িয়া মর্মস্থান                 কণ্ঠে যেন উঠিল উছলি । সে শুধু আকুল চোখে            নীরবে গভীর শোকে               শুধাইল , “ কী হয়েছে তোর ?” কী বলিতে গিয়ে প্রাণ              ফেটে হল শতখান ,                তখনি ভাঙিল ঘুমঘোর । অন্ধকার নিশীথিনী                  ঘুমাইছে একাকিনী ,                অরণ্যে উঠিছে ঝিল্লিস্বর , বাতায়নে ধ্রুবতারা                  চেয়ে আছে নিদ্রাহারা —                   নতনেত্রে গণিছে প্রহর । দীপ - নির্বাপিত ঘরে                শুয়ে শূন্য শয্যা - পরে                 ভাবিতে লাগিনু কতক্ষণ — শিথানে মাথাটি থুয়ে                সেও একা শুয়ে শুয়ে                 কী জানি কী হেরিছে স্বপন                 দ্বিপ্রহরা যামিনী যখন ।    (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) স্বপ্ন হঠাৎ উঠল রাতে স্বপ্ন হঠাৎ উঠল রাতে প্রাণ পেয়ে, মৌন হতে ত্রাণ পেয়ে। ইন্দ্রলোকের পাগ্‌লাগারদ খুলল তারই দ্বার, পাগল ভুবন দুর্দাড়িয়া ছুটল চারিধার– দারুণ ভয়ে মানুষগুলোর চক্ষে বারিধার, বাঁচল আপন স্বপন হতে খাটের তলায় স্থান পেয়ে।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) স্বপ্নরুদ্ধ নিষ্ফল হয়েছি আমি সংসারের কাজে, লোকমাঝে আঁখি তুলে পারি না চাহিতে। ভাসায়ে জীবনতরী সাগরের মাঝে তরঙ্গ লঙ্ঘন করি পারি না বাহিতে। পুরুষের মতো যত মানবের সাথে যোগ দিতে পারি নাকো লয়ে নিজ বল, সহস্র সংকল্প শুধু ভরা দুই হাতে বিফলে শুকায় যেন লক্ষ্মণের ফল। আমি গাঁথি আপনার চারি দিক ঘিরে সূক্ষ্ম রেশমের জাল কীটের মতন। মগ্ন থাকি আপনার মধুর তিমিরে, দেখি না এ জগতের প্রকাণ্ড জীবন। কেন আমি আপনার অন্তরালে থাকি! মুদ্রিত পাতার মাঝে কাঁদে অন্ধ আঁখি। স্বপ্নে দেখি নৌকো আমার স্বপ্নে দেখি নৌকো আমার নদীর ঘাটে বাঁধা; নদী কিম্বা আকাশ সেটা লাগল মনে ধাঁধাঁ। এমন সময় হঠাৎ দেখি, দিক্‌সীমানায় গেছে ঠেকি একটুখানি ভেসে-ওঠা ত্রয়োদশীর চাঁদা। “নৌকোতে তোর পার করে দে’ এই ব’লে তার কাঁদা। আমি বলি, “ভাবনা কী তায়, আকাশপারে নেব মিতায়– কিন্তু আমি ঘুমিয়ে আছি এই যে বিষম বাধা, দেখছ আমার চতুর্দিকটা স্বপ্নজালে ফাঁদা।’   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) স্বর্গ হইতে বিদায় ম্লান হয়ে এল কণ্ঠে মন্দারমালিকা, হে মহেন্দ্র, নির্বাপিত জ্যোতির্ময় টিকা মলিন ললাটে। পুণ্যবল হল ক্ষীণ, আজি মোর স্বর্গ হতে বিদায়ের দিন, হে দেব, হে দেবীগণ। বর্ষ লক্ষশত যাপন করেছি হর্ষে দেবতার মতো দেবলোকে। আজি শেষ বিচ্ছেদের ক্ষণে লেশমাত্র অশ্রুরেখা স্বর্গের নয়নে দেখে যাব এই আশা ছিল। শোকহীন হৃদিহীন সুখস্বর্গভূমি, উদাসীন চেয়ে আছে। লক্ষ লক্ষ বর্ষ তার চক্ষের পলক নহে; অশ্বত্থশাখার প্রান্ত হতে খসি গেলে জীর্ণতম পাতা যতটুকু বাজে তার, ততটুকু ব্যথা স্বর্গে নাহি লাগে, যবে মোরা শত শত গৃহচ্যুত হতজ্যোতি নক্ষত্রের মতো মুহূর্তে খসিয়া পড়ি দেবলোক হতে ধরিত্রীর অন্তহীন জন্মমৃত্যুস্রোতে। সে বেদনা বাজিত যদ্যপি, বিরহের ছায়ারেখা দিত দেখা, তবে স্বরগের চিরজ্যোতি ম্লান হত মর্তের মতন কোমল শিশিরবাষ্পে-- নন্দনকানন মর্মরিয়া উঠিত নিশ্বসি, মন্দাকিনী কূলে কূলে গেয়ে যেত করুণ কাহিনী কলকণ্ঠে, সন্ধ্যা আসি দিবা-অবসানে নির্জন প্রান্তর-পারে দিগন্তের পানে চলে যেত উদাসিনী, নিস্তব্ধ নিশীথ ঝিল্লিমন্ত্রে শুনাইত বৈরাগ্যসংগীত নক্ষত্রসভায়। মাঝে মাঝে সুরপুরে নৃত্যপরা মেনকার কনকনূপুরে তালভঙ্গ হত। হেলি উর্বশীর স্তনে স্বর্ণবীণা থেকে থেকে যেন অন্যমনে অকস্মাৎ ঝংকারিত কঠিন পীড়নে নিদারুণ করুণ মূর্ছনা। দিত দেখা দেবতার অশ্রুহীন চোখে জলরেখা নিষ্কারণে। পতিপাশে বসি একাসনে সহসা চাহিত শচী ইন্দ্রের নয়নে যেন খুঁজি পিপাসার বারি। ধরা হতে মাঝে মাঝে উচ্ছ্বসি আসিত বায়ুস্রোতে ধরণীর সুদীর্ঘ নিশ্বাস-- খসি ঝরি পড়িত নন্দনবনে কুসুমমঞ্জরী। থাকো স্বর্গ হাস্যমুখে, করো সুধাপান দেবগণ। স্বর্গ তোমাদেরি সুখস্থান-- মোরা পরবাসী। মর্তভূমি স্বর্গ নহে, সে যে মাতৃভূমি-- তাই তার চক্ষে বহে অশ্রুজলধারা, যদি দু দিনের পরে কেহ তারে ছেড়ে যায় দু দণ্ডের তরে। যত ক্ষুদ্র, যত ক্ষীণ, যত অভাজন, যত পাপীতাপী, মেলি ব্যগ্র আলিঙ্গন সবারে কোমল বক্ষে বাঁধিবারে চায়-- ধূলিমাখা তনুস্পর্শে হৃদয় জুড়ায় জননীর। স্বর্গে তব বহুক অমৃত, মর্তে থাক্‌ সুখে দুঃখে অনন্তমিশ্রিত প্রেমধারা-- অশ্রুজলে চিরশ্যাম করি ভূতলের স্বর্গখণ্ডগুলি।                  হে অপ্সরী, তোমার নয়নজ্যোতি প্রেমবেদনায় কভু না হউক ম্লান-- লইনু বিদায়। তুমি কারে কর না প্রার্থনা, কারো তরে নাহি শোক। ধরাতলে দীনতম ঘরে যদি জন্মে প্রেয়সী আমার, নদীতীরে কোনো-এক গ্রামপ্রান্তে প্রচ্ছন্ন কুটিরে অশ্বত্থছায়ায়, সে বালিকা বক্ষে তার রাখিবে সঞ্চয় করি সুধার ভাণ্ডার আমারি লাগিয়া সযতনে। শিশুকালে নদীকূলে শিবমূর্তি গড়িয়া সকালে আমারে মাগিয়া লবে বর। সন্ধ্যা হলে জ্বলন্ত প্রদীপখানি ভাসাইয়া জলে শঙ্কিত কম্পিত বক্ষে চাহি একমনা করিবে সে আপনার সৌভাগ্যগণনা একাকী দাঁড়ায়ে ঘাটে। একদা সুক্ষণে আসিবে আমার ঘরে সন্নত নয়নে চন্দনচর্চিত ভালে রক্তপট্টাম্বরে, উৎসবের বাঁশরীসংগীতে। তার পরে সুদিনে দুর্দিনে, কল্যাণকঙ্কণ করে, সীমন্তসীমায় মঙ্গলসিন্দূরবিন্দু, গৃহলক্ষ্মী দুঃখে সুখে, পূর্ণিমার ইন্দু সংসারের সমুদ্রশিয়রে। দেবগণ, মাঝে মাঝে এই স্বর্গ হইবে স্মরণ দূরস্বপ্নসম, যবে কোনো অর্ধরাতে সহসা হেরিব জাগি নির্মল শয্যাতে পড়েছে চন্দ্রের আলো, নিদ্রিতা প্রেয়সী লুণ্ঠিত শিথিল বাহু, পড়িয়াছে খসি গ্রন্থি শরমের-- মৃদু সোহাগচুম্বনে সচকিতে জাগি উঠি গাঢ় আলিঙ্গনে লতাইবে বক্ষে মোর-- দক্ষিণ অনিল আনিবে ফুলের গন্ধ, জাগ্রত কোকিল গাহিবে সুদূর শাখে।                অয়ি দীনহীনা, অশ্রু-আঁখি দুঃখাতুর জননী মলিনা, অয়ি মর্ত্যভূমি। আজি বহুদিন পরে কাঁদিয়া উঠেছে মোর চিত্ত তোর তরে। যেমনি বিদায়দুঃখে শুষ্ক দুই চোখ অশ্রুতে পুরিল, অমনি এ স্বর্গলোক অলস কল্পনাপ্রায় কোথায় মিলালো ছায়াচ্ছবি। তব নীলাকাশ, তব আলো, তব জনপূর্ণ লোকালয়, সিন্ধুতীরে সুদীর্ঘ বালুকাতট, নীল গিরিশিরে শুভ্র হিমরেখা, তরুশ্রেণীর মাঝারে নিঃশব্দ অরুণোদয়, শূন্য নদীপারে অবনতমুখী সন্ধ্যা-- বিন্দু-অশ্রুজলে যত প্রতিবিম্ব যেন দর্পণের তলে পড়েছে অসিয়া।              হে জননী পুত্রহারা, শেষ বিচ্ছেদের দিনে যে শোকাশ্রুধারা চক্ষু হতে ঝরি পড়ি তব মাতৃস্তন করেছিল অভিষিক্ত, আজি এতক্ষণ সে অশ্রু শুকায়ে গেছে। তবু জানি মনে যখনি ফিরিব পুন তব নিকেতনে তখনি দুখানি বাহু ধরিবে আমায়, বাজিবে মঙ্গলশঙ্খ, স্নেহের ছায়ায় দুঃখে-সুখে-ভয়ে-ভরা প্রেমের সংসারে তব গেহে, তব পুত্রকন্যার মাঝারে আমারে লইবে চিরপরিচিতসম-- তার পরদিন হতে শিয়রেতে মম সারাক্ষণ জাগি রবে কম্পমান প্রাণে, শঙ্কিত অন্তরে, ঊর্ধ্বে দেবতার পানে মেলিয়া করুণ দৃষ্টি, চিন্তিত সদাই যাহারে পেয়েছি তারে কখন হারাই। স্বর্গ হইতে বিদায় ম্লান হয়ে এলো কণ্ঠে মন্দারমালিকা, হে মহেন্দ্র, নির্বাপিত জ্যোতির্ময় টিকা মলিন ললাটে। পুণ্যবল হল ক্ষীণ, আজি মোর স্বর্গ হতে বিদায়ের দিন, হে দেব, হে দেবীগণ। বর্ষ লক্ষশত যাপন করেছি হর্ষে দেবতার মতো দেবলোকে। আজি শেষ বিচ্ছেদের ক্ষণে লেশমাত্র অশ্রুরেখা স্বর্গের নয়নে দেখে যাব এই আশা ছিল। শোকহীন হৃদিহীন সুখস্বর্গভূমি, উদাসীন চেয়ে আছে। লক্ষ-লক্ষ বর্ষ তার চক্ষের পলক নহে; অশ্বত্থশাখার প্রান্ত হতে খসি গেলে জীর্ণতম পাতা যতটুকু বাজে তার, ততটুকু ব্যথা স্বর্গে নাহি লাগে, যবে মোরা শত শত গৃহচ্যুত হতজ্যোতি নক্ষত্রের মতো মুহূর্তে খসিয়া পড়ি দেবলোক হতে ধরিত্রীর অন্তহীন জন্মমৃত্যুস্রোতে। সে বেদনা বাজিত যদ্যপি, বিরহের ছায়ারেখা দিত দেখা, তবে স্বরগের চিরজ্যোতি ম্লান হত মর্তের মতন কোমল শিশিরবাষ্পে-- নন্দনকানন মর্মরিয়া উঠিত নিশ্বসি, মন্দাকিনী কূলে-কূলে গেয়ে যেত করুণ কাহিনী কলকণ্ঠে, সন্ধ্যা আসি দিবা-অবসানে নির্জন প্রান্তর-পারে দিগন্তের পানে চলে যেত উদাসিনী, নিস্তব্ধ নিশীথ ঝিল্লিমন্ত্রে শুনাইত বৈরাগ্যসংগীত নক্ষত্রসভায়। মাঝে মাঝে সুরপুরে নৃত্যপরা মেনকার কনকনূপুরে তালভঙ্গ হত। হেলি উর্বশীর স্তনে স্বর্ণবীণা থেকে থেকে যেন অন্যমনে অকস্মাৎ ঝংকারিত কঠিন পীড়নে নিদারুণ করুণ মূর্ছনা। দিত দেখা দেবতার অশ্রুহীন চোখে জলরেখা নিষ্কারণে। পতিপাশে বসি একাসনে সহসা চাহিত শচী ইন্দ্রের নয়নে যেন খুঁজি পিপাসার বারি। ধরা হতে মাঝে মাঝে উচ্ছ্বসি আসিত বায়ুস্রোতে ধরণীর সুদীর্ঘ নিশ্বাস-- খসি ঝরি পড়িত নন্দনবনে কুসুমমঞ্জরী। থাকো স্বর্গ হাস্যমুখে, করো সুধাপান দেবগণ। স্বর্গ তোমাদেরি সুখস্থান-- মোরা পরবাসী। মর্তভূমি স্বর্গ নহে, সে যে মাতৃভূমি-- তাই তার চক্ষে বহে অশ্রুজলধারা, যদি দু দিনের পরে কেহ তারে ছেড়ে যায় দু দণ্ডের তরে। যত ক্ষুদ্র, যত ক্ষীণ, যত অভাজন, যত পাপীতাপী, মেলি ব্যগ্র আলিঙ্গন সবারে কোমল বক্ষে বাঁধিবারে চায়-- ধূলিমাখা তনুস্পর্শে হৃদয় জুড়ায় জননীর। স্বর্গে তব বহুক অমৃত, মর্তে থাক্‌ সুখে দুঃখে অনন্তমিশ্রিত প্রেমধারা-- অশ্রুজলে চিরশ্যাম করি ভূতলের স্বর্গখণ্ডগুলি।                   হে অপ্সরী, তোমার নয়নজ্যোতি প্রেমবেদনায় কভু না হউক ম্লান-- লইনু বিদায়। তুমি কারে কর না প্রার্থনা, কারো তরে নাহি শোক। ধরাতলে দীনতম ঘরে যদি জন্মে প্রেয়সী আমার, নদীতীরে কোনো-এক গ্রামপ্রান্তে প্রচ্ছন্ন কুটিরে অশ্বত্থছায়ায়, সে বালিকা বক্ষে তার রাখিবে সঞ্চয় করি সুধার ভাণ্ডার আমারি লাগিয়া সযতনে। শিশুকালে নদীকূলে শিবমূর্তি গড়িয়া সকালে আমারে মাগিয়া লবে বর। সন্ধ্যা হলে জ্বলন্ত প্রদীপখানি ভাসাইয়া জলে শঙ্কিত কম্পিত বক্ষে চাহি একমনা করিবে সে আপনার সৌভাগ্যগণনা একাকী দাঁড়ায়ে ঘাটে। একদা সুক্ষণে আসিবে আমার ঘরে সন্নত নয়নে চন্দনচর্চিত ভালে রক্তপট্টাম্বরে, উৎসবের বাঁশরীসংগীতে। তার পরে সুদিনে দুর্দিনে, কল্যাণকঙ্কণ করে, সীমন্তসীমায় মঙ্গলসিন্দূরবিন্দু, গৃহলক্ষ্মী দুঃখে সুখে, পূর্ণিমার ইন্দু সংসারের সমুদ্রশিয়রে। দেবগণ, মাঝে মাঝে এই স্বর্গ হইবে স্মরণ দূরস্বপ্নসম, যবে কোনো অর্ধরাতে সহসা হেরিব জাগি নির্মল শয্যাতে পড়েছে চন্দ্রের আলো, নিদ্রিতা প্রেয়সী লুণ্ঠিত শিথিল বাহু, পড়িয়াছে খসি গ্রন্থি শরমের-- মৃদু সোহাগচুম্বনে সচকিতে জাগি উঠি গাঢ় আলিঙ্গনে লতাইবে বক্ষে মোর-- দক্ষিণ অনিল আনিবে ফুলের গন্ধ, জাগ্রত কোকিল গাহিবে সুদূর শাখে।                 অয়ি দীনহীনা, অশ্রু-আঁখি দুঃখাতুর জননী মলিনা, অয়ি মর্ত্যভূমি। আজি বহুদিন পরে কাঁদিয়া উঠেছে মোর চিত্ত তোর তরে। যেমনি বিদায়দুঃখে শুষ্ক দুই চোখ অশ্রুতে পুরিল, অমনি এ স্বর্গলোক অলস কল্পনাপ্রায় কোথায় মিলালো ছায়াচ্ছবি। তব নীলাকাশ, তব আলো, তব জনপূর্ণ লোকালয়, সিন্ধুতীরে সুদীর্ঘ বালুকাতট, নীল গিরিশিরে শুভ্র হিমরেখা, তরুশ্রেণীর মাঝারে নিঃশব্দ অরুণোদয়, শূন্য নদীপারে অবনতমুখী সন্ধ্যা-- বিন্দু-অশ্রুজলে যত প্রতিবিম্ব যেন দর্পণের তলে পড়েছে অসিয়া।               হে জননী পুত্রহারা, শেষ বিচ্ছেদের দিনে যে শোকাশ্রুধারা চক্ষু হতে ঝরি পড়ি তব মাতৃস্তন করেছিল অভিষিক্ত, আজি এতক্ষণ, সে অশ্রু শুকায়ে গেছে। তবু জানি মনে যখনি ফিরিব পুন তব নিকেতনে তখনি দুখানি বাহু ধরিবে আমায়, বাজিবে মঙ্গলশঙ্খ, স্নেহের ছায়ায় দুঃখে-সুখে-ভয়ে-ভরা প্রেমের সংসারে তব গেহে, তব পুত্রকন্যার মাঝারে আমারে লইবে চিরপরিচিতসম--তার পরদিন হতে শিয়রেতে মম সারাক্ষণ জাগি রবে কম্পমান প্রাণে, শঙ্কিত অন্তরে, ঊর্ধ্বে দেবতার পানে মেলিয়া করুণ দৃষ্টি, চিন্তিত সদাই যাহারে পেয়েছি তারে কখন হারাই। (  ২৪ অগ্রহায়ণ, ১৩০২) স্বাধীনতা শর ভাবে, ছুটে চলি, আমি তো স্বাধীন, ধনুকটা একঠাঁই বদ্ধ চিরদিন। ধনু হেসে বলে, শর, জান না সে কথা— আমারি অধীন জেনো তব স্বাধীনতা।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) স্বার্থ কে রে তুই, ওরে স্বার্থ, তুই কতটুকু, তোর স্পর্শে ঢেকে যায় ব্রহ্মান্ডের মুখ, লুকায় অনন্ত সত্য—স্নেহ সখ্য প্রীতি মুহূর্তে ধারণ করে নির্লজ্জ বিকৃতি, থেমে যায় সৌন্দর্যের গীতি চিরন্তন তোর তুচ্ছ পরিহাসে। ওগো বন্ধুগণ, সব স্বার্থ পূর্ণ হোক। ক্ষুদ্রতম কণা ভান্ডারে টানিয়া আনো—কিছু ত্যজিয়ো না। আমি লইলাম বাছি চিরপ্রেমখানি, জাগিছে যাহার মুখে অনন্তর বাণী অমৃতে অশ্রুতে মাখা। মোর তরে থাক্‌ পরিহাস্য পুরাতন বিশ্বাস নির্বাক্‌। থাক্‌ মহাবিশ্ব, থাক্‌ হৃদয়-আসীনা অন্তরের মাঝখানে যে বাজায় বীণা।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) স্মৃতি ওই দেহ-পানে চেয়ে পড়ে মোর মনে যেন কত শত পূর্ব-জনমের স্মৃতি । সহস্র হারানো সুখ আছে ও নয়নে, জন্মজন্মান্তের যেন বসন্তের গীতি । যেন গো আমারি তুমি আত্মবিস্মরণ, অনন্ত কালের মোর সুখ দুঃখ শোক, কত নব জগতের কুসুমকানন, কত নব আকাশের চাঁদের আলোক । কত দিবসের তুমি বিরহের ব্যথা, কত রজনীর তুমি প্রণয়ের লাজ -- সেই হাসি সেই অশ্রু সেই-সব কথা মধুর মুরতি ধরি দেখা দিল আজ । তোমার মুখেতে চেয়ে তাই নিশিদিন জীবন সুদূরে যেন হতেছে বিলীন ।। স্মৃতি (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) সে ছিল আরেক দিন এই তরী-’পরে, কন্ঠ তার পূর্ণ ছিল সুধাগীতিস্বরে। ছিল তার আঁখি দুটি ঘনপক্ষ্মচ্ছায়, সজল মেঘের মতো ভরা করুণায়। কোমল হৃদয়খানি উদ্‌বেলিত সুখে, উচ্ছ্বসি উঠিত হাসি সরল কৌতুকে। পাশে বসি ব’লে যেত কলকণ্ঠকথা, কত কী কাহিনী তার কত আকুলতা! প্রত্যুষে আনন্দভরে হাসিয়া হাসিয়া প্রভাত-পাখির মতো জাগাত আসিয়া। স্নেহের দৌরাত্ম্য তার নির্ঝরের প্রায় আমারে ফেলিত ঘেরি বিচিত্র লীলায়। আজি সে অনন্ত বিশ্বে আছে কোন্‌খানে তাই ভাবিতেছি বসি সজলনয়ানে।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) স্মৃতিকাপালিনী পূজারতা, একমনা স্মৃতিকাপালিনী পূজারতা, একমনা, বর্তমানেরে বলি দিয়া করে অতীতের অর্চনা।  (স্ফুলিঙ্গ) স্মৃতি-পাথেয় একদিন কোন্‌ তুচ্ছ আলাপের ছিন্ন অবকাশে সে কোন্‌ অভাবনীয় স্মিতহাসে অন্যমনা আত্মভোলা যৌবনেরে দিয়ে ঘন দোলা মুখে তব অকস্মাৎ প্রকাশিল কী অমৃত-রেখা কভু যার পাই নাই দেখা, দুর্লভ সে প্রিয় অনির্বচনীয়। হে মহা অপরিচিত এক পলকের লাগি হয় সচকিত গভীর অন্তরতর প্রাণে কোন্‌ দূরে বনান্তের পথিকের গানে; সে অপূর্ব আসে ঘরে পথহারা মুহূর্তের তরে। বৃষ্টিধারামুখরিত নির্জন প্রবাসে সন্ধ্যাবেলা যূথিকার সকরুণ স্নিগ্ধ গন্ধশ্বাসে, চিত্তে রেখে দিয়ে গেল চিরস্পর্শ স্বীয় তাহারি স্খলিত উত্তরীয়। সে বিস্মিত ক্ষণিকেরে পড়ে মনে কোনোদিন অকারণে ক্ষণে ক্ষণে শীতের মধ্যাহ্নকালে গোরুচরা শস্যরিক্ত মাঠে চেয়ে চেয়ে বেলা যবে কাটে। সঙ্গহারা সায়াহ্নের অন্ধকারে সে স্মৃতির ছবি সূর্যাস্তের পার হতে বাজায় পূরবী। পেয়েছি যে-সব ধন যার মূল্য আছে ফেলে যাই পাছে সেই যার মূল্য নাই, জানিবে না কেও সঙ্গে থাকে অখ্যাত পাথেয়। স্মৃতির ভূমিকা আজি এই মেঘমুক্ত সকালের স্নিগ্র্ধ নিরালায় অচেনা গাছের যত ছিন্ন ছিন্ন ছায়ার ডালায় রৌদ্রপুঞ্জ আছে ভরি। সারাবেলা ধরি কোন্ পাখি আপনারি সুরে কুতূহলী আলস্যের পেয়ালায় ঢেলে দেয় অস্ফুট কাকলি। হঠাৎ কী হল মতি, সোনালি রঙের প্রজাপতি আমার রুপালি চুলে বসিয়া রয়েছে পথ ভূলে। সাবধানে থাকি, লাগে ভয়, পাছে ওর জাগাই সংশয়- ধরা পড়ে যায় পাছে, আমি নই গাছের দলের, আমার বাণী সে নহে ফুলের ফলের। চেয়ে দেখি, ঘন হয়ে কোথা নেমে গেচে ঝোপঝাড়; সম্মুখে পাহাড় আপনার আচলতা ভূলে থাকে বেলা-অবেলায়, হামাগুড়ি দিয়ে চলে দলে দলে মেঘের খেলায়। হোথা শুষ্ক জলধারা শব্দহীন রচিছে ইশারা শরিশ্রান্ত নিদ্রিত বর্ষার। নুড়িগুলি বনের ছায়ার মধ্যে অস্থিসার প্রেতের অঙ্গুলি নির্দেশ করিছে তারে যাহা নিরর্থক, নির্ঝরিণী-সর্পিণীর দেহচ্যুত ত্বক্। এখনি এ আমার দেখাতে মিলায়েছে শৈলশ্রেণী তরঙ্গিত নীলিম রেখাতে আপন অদৃশ্য লিপি। বাড়ির সিঁড়ির 'পরে স্তরে স্তরে বিদেশীফুলের টব, সেথা জেরেনিয়মের গন্ধ শ্বসিয়া নিয়েছে মোর ছন্দ এ চারিদিকের এই-সব নিয়ে সাথে বর্ণে গন্ধে বিচিত্রিত একটি দিনের ভূমিকাতে এটুকু রচনা মোর বাণীর যাত্রায় হোক পার যে কদিন তার ভাগ্যে সময়ের আছে অধিকার। স্যাকরা কার লাগি এই গয়না গড়াও                 যতন-ভরে। স্যাকরা বলে, একা আমার                 প্রিয়ার তরে।শুধাই তারে, প্রিয়া তোমার                 কোথায় আছে। স্যাকরা বলে, মনের ভিতর                 বুকের কাছে।আমি বলি, কিনে তো লয়                 মহারাজাই। স্যাকরা বলে, প্রেয়সীরে                 আগে সাজাই।আমি শুধাই, সোনা তোমার                 ছোঁয় কবে সে। স্যাকরা বলে অলখ ছোঁওয়ায়                 রূপ লভে সে।শুধাই, একি একলা তারি                 চরণতলে। স্যাকরা বলে, তারে দিলেই                 পায় সকলে। স্রোত জগৎ-স্রোতে ভেসে চলো, যে যেথা আছ ভাই! চলেছে যেথা রবি শশী চল্‌ রে সেথা যাই। কোথায় চলে কে জানে তা, কোথায় যাবে শেষে, জগৎ-স্রোত বহে গিয়ে কোন্‌ সাগরে মেশে। অনাদি কাল চলে স্রোত অসীম আকাশেতে, উঠেছে মহা কলরব অসীমে যেতে যেতে। উঠিছে ঢেউ, পড়ে ঢেউ, গনিবে কেবা কত! ভাসিছে শত গ্রহ তারা, ডুবিছে শত শত। ঢেউয়ের ‘পরে খেলা করে আলোকে আঁধারেতে, জলের কোলে লুকাচুরি জীবনে মরণেতে। শতেক কোটি গ্রহ তারা যে স্রোতে তৃণপ্রায় সে স্রোত-মাঝে অবহেলে ঢালিয়া দিব কায়, অসীম কাল ভেসে যাব অসীম আকাশেতে, জগৎ- কলকলরব শুনিব কান পেতে। দেখিব ঢেউ--উঠে ঢেউ, দেখিব মিশে যায়, জীবন-মাঝে উঠে ঢেউ মরণ-গান গায়। দেখিব চেয়ে চারি দিকে, দেখিব তুলে মুখ-- কত-না আশা, কত হাসি, কত-না সুখ দুখ, বিরাগ দ্বেষ ভালোবাসা, কত-না হায়-হায়-- তপন ভাসে, তারা ভাসে, তা’রাও ভেসে যায়। কত-না যায়, কত চায়, কত-না কাঁদে হাসে-- আমি তো শুধু ভেসে যাব, দেখিব চারি পাশে।অবোধ ওরে, কেন মিছে করিস ‘আমি আমি’। উজানে যেতে পারিবি কি সাগরপথগামী? জগৎ-পানে যাবি নে রে, আপনা-পানে যাবি-- সে যে রে মহামরুভূমি, কী জানি কী যে পাবি। মাথায় করে আপনারে, সুখ-দুখের বোঝা, ভাসাতে চাস প্রতিকূলে-- সে তো রে নহে সোজা । অবশ দেহ, ক্ষীণ বল, সঘনে বহে শ্বাস, লইয়া তোর সুখদুখ এখনি পাবি নাশ।জগৎ হয়ে রব আমি, একেলা রহিব না। মরিয়া যাব একা হলে একটি জলকণা। আমার নাহি সুখ দুখ, পরের পানে চাই-- যাহার পানে চেয়ে দেখি তাহাই হয়ে যাই। তপন ভাসে, তারা ভাসে, আমিও যাই ভেসে-- তাদের গানে আমার গান, যেতেছি এক দেশে। প্রভাত সাথে গাহি গান, সাঁঝের সাথে গাই, তারার সাথে উঠি আমি--তারার সাথে যাই। ফুলের সাথে ফুটি আমি, লতার সাথে নাচি, বায়ুর সাথে ঘুরি শুধু ফুলের কাছাকাছি। মায়ের প্রাণে স্নেহ হয়ে শিশুর পানে ধাই, দুখীর সাথে কাঁদি আমি সুখীর সাথে গাই। সবার সাথে আছি আমি, আমার সাথে নাই, জগৎ-স্রোতে দিবানিশি ভাসিয়া চলে যাই। হঠাৎ দেখা রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা, ভাবি নি সম্ভব হবে কোনোদিন। আগে ওকে বারবার দেখেছি লালরঙের শাড়িতে- দালিম-ফুলের মতো রাঙা; আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড়, আঁচল তুলেছে মাথায় দোলন-চাঁপার মতো চিকন-গৌর মুখখানি ঘিরে। মনে হল, কালো রঙে একটা গভীর দূরত্ব ঘনিয়ে নিয়েছে নিজের চার দিকে, যে দূরত্ব সর্ষেক্ষেতের শেষ সীমানায় শালবনের নীলাঞ্জনে।থমকে গেল আমার সমস্ত মনটা; চেনা লোককে দেখলেম অচেনার গাম্ভীর্যে। হঠাৎ খবরের কাগজ ফেলে দিয়ে আমাকে করলে নমস্কার। সমাজবিধির পথ গেল খুলে, আলাপ করলেম শুরু— ‘কেমন আছ’, ‘কেমন চলছে সংসার’ ইত্যাদি।সে রইল জানলার বাইরের দিকে চেয়ে যেন কাছের-দিনের-ছোঁয়াচ-পার-হওয়া চাহনিতে। দিলে অত্যন্ত ছোটো দুটো-একটা জবাব, কোনোটা বা দিলেই না। বুঝিয়ে দিলে হাতের অস্থিরতায়— কেন এ-সব কথা, এর চেয়ে অনেক ভালো চুপ ক’রে থাকা।আমি ছিলেম অন্য বেঞ্চিতে ওর সাথিদের সঙ্গে। এক সময়ে আঙুল নেড়ে জানালে কাছে আসতে। মনে হল কম সাহস নয়- বসলুম ওর এক-বেঞ্চিতে। গাড়ির আওয়াজের আড়ালে বললে মৃদুস্বরে, ‘কিছু মনে কোরো না, সময় কোথা সময় নষ্ট করবার। আমাকে নামতে হবে পরের স্টেশনেই; দূরে যাবে তুমি, দেখা হবে না আর কোনোদিনই। তাই, যে প্রশ্নটার জবাব এতকাল থেমে আছে, শুনব তোমার মুখে। সত্য করে বলবে তো?’ আমি বললেম, ‘বলব।’ বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়েই শুধোল, ‘আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে- কিছুই কি নেই বাকি?’একটুকু রইলেম চুপ করে; তারপর বললেম, ‘রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে।’ খটকা লাগল, কী জানি বানিয়ে বললেম না কি। ও বললে, ‘থাক্, এখন যাও ও দিকে।’ সবাই নেমে গেল পরের স্টেশনে। আমি চললেম একা। হম যব না রব সজনী হম যব না রব, সজনী, নিভৃত বসন্তনিকুঞ্জবিতানে       আসবে নির্মল রজনী— মিলনপিপাসিত আসবে যব, সখি,       শ্যাম হমারি আশে, ফুকারবে যব ‘রাধা রাধা’       মুরলি ঊরধ শ্বাসে, যব সব গোপিনী আসবে ছুটই        যব হম আওব না, যব সব গোপিনী জাগবে চমকই        যব হম জাগব না, তব কি কুঞ্জপথ হমারি আশে        হেরবে আকুল শ্যাম। বন বন ফেরই সো কি ফুকারবে        ‘রাধা রাধা’ নাম। না যমুনা, সো এক শ্যাম মম,        শ্যামক শত শত নারী— হম যব যাওব শত শত রাধা        চরণে রহবে তারি। তব্ সখি যমুনে, যাই নিকুঞ্জে,        কাহে তয়াগব দে। হমারি লাগি এ বৃন্দাবনমে কহ,       সখি, রোয়ব কে। ভানু কহে চুপি, মানভরে রহে,       আও বনে ব্রজনারী— মিলবে শ্যামক থরথর আদর,       ঝরঝর লোচনবারি॥ হম সখি দারিদ নারী হম সখি দারিদ নারী ! জনম অবধি হম পীরিতি করনু           মোচনু লোচন - বারি । রূপ নাহি মম , কছুই নাহি গুণ           দুখিনী আহির জাতি , নাহি জানি কছু বিলাস - ভঙ্গিম           যৌবন গরবে মাতি । অবলা রমণী , ক্ষুদ্র হৃদয় ভরি           পীরিত করনে জানি ; এক নিমিখ পল , নিরখি শ্যাম জনি           সোই বহুত করি মানি । কুঞ্জ পথে যব নিরখি সজনি হম , শ্যামক চরণক চীনা , শত শত বেরি ধূলি চুম্বি সখি ,           রতন পাই জনু দীনা । নুঠুর বিধাতা , এ দুখ - জনমে           মাঙব কি তুয়া পাশ ! জনম অভাগী , উপেখিতা হম ,           বহুত নাহি করি আশ ,— দূর থাকি হম রূপ হেরইব ,           দূরে শুনইব বাঁশি । দূর দূর রহি সুখে নিরীখিব           শ্যামক মোহন হাসি । শ্যাম - প্রেয়সি রাধা ! সখিলো !           থাক' সুখে চিরদিন ! তুয়া সুখে হম রোয়ব না সখি           অভাগিনী গুণ হীন । অপন দুখে সখি , হম রোয়ব লো ,           নিভৃতে মুছইব বারি । কোহি ন জানব , কোন বিষাদে            তন - মন দহে হমারি । ভানু সিংহ ভনয়ে , শুন কালা           দুখিনী অবলা বালা— উপেখার অতি তিখীনি বাণে           না দিহ না দিহ জ্বালা । হরপণ্ডিত বলে ব্যঞ্জন সন্ধি এ হরপণ্ডিত বলে, “ব্যঞ্জন সন্ধি এ, পড়ো দেখি, মনুবাবা, একটুকু মন নিয়ে।’মনোযোগহন্ত্রীর বেড়ি আর খন্তির ঝংকার মনে পড়ে; হেঁসেলের পন্থার ব্যঞ্জন-চিন্তায় অস্থির মন তার। থেকে থেকে জল পড়ে চক্ষুর কোণ দিয়ে।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) হাজারিবাগের ঝোপে হাজারটা হাই হাজারিবাগের ঝোপে হাজারটা হাই তুলেছিল হাজারটা বাঘে, ময়মন্‌সিংহের মাসতুত ভাই গর্জি উঠিল তাই রাগে। খেঁকশেয়ালের দল শেয়ালদহর হাঁচি শুনে হেসে মরে অষ্টপ্রহর, হাতিবাগানের হাতি ছাড়িয়া শহর ভাগলপুরের দিকে ভাগে– গিরিডির গিরগিটি মস্ত-বহর পথ দেখাইয়া চলে আগে। মহিশূরে মহিষটা খায় অড়হর– খামকাই তেড়ে গিয়ে লাগে।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) হাত দিয়ে পেতে হবে হাত দিয়ে পেতে হবে কী তাহে আনন্দ– হাত পেতে পাওয়া যাবে সেটাই পছন্দ। আপিসেতে খেটে মরা তার চেয়ে ঝুলি ধরা ঢের ভালো– এ কথায় নাই কোনো সন্দ।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) হাতে কোনো কাজ নেই হাতে কোনো কাজ নেই, নওগাঁর তিনকড়ি সময় কাটিয়ে দেয় ঘরে ঘরে ঋণ করি। ভাঙা খাট কিনেছিল, ছ পয়সা খরচা– শোয় না সে হয় পাছে কুঁড়েমির চর্চা। বলে, “ঘরে এত ঠাসা কিঙ্কর কিঙ্করী, তাই কম খেয়ে খেয়ে দেহটারে ক্ষীণ করি।’   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) হাতে-কলমে বোলতা কহিল, এ যে ক্ষুদ্র মউচাক, এরই তরে মধুকর এত করে জাঁক! মধুকর কহে তারে, তুমি এসো ভাই, আরো ক্ষুদ্র মউচাক রচো দেখে যাই।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) হায় গগন নহিলে তোমারে ধরিবে কে বা “হায় গগন নহিলে তোমারে ধরিবে কে বা ওগো তপন তোমার স্বপন দেখি যে,করিতে পারি নে সেবা।’ শিশির কহিল কাঁদিয়া, “তোমারে রাখি যে বাঁধিয়া হে রবি,এমন নাহিকো আমার বল। তোমা বিনা তাই ক্ষুদ্র জীবন কেবলি অশ্রুজল।’“আমি বিপুল কিরণে ভুবন করি যে আলো, তবু শিশিরটুকুরে ধরা দিতে পারি বাসিতে পারি যে ভালো।’ শিশিরের বুকে আসিয়া কহিল তপন হাসিয়া, “ছোটো হয়ে আমি রহিব তোমারে ভরি, তোমার ক্ষুদ্র জীবন গড়িব হাসির মতন করি।’  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) হার শুক্লা একাদশী। লাজুক রাতের ওড়না পড়ে খসি            বটের ছায়াতলে,                  নদীর কালো জলে।         দিনের বেলায় কৃপণ কুসুম কুণ্ঠাভরে      যে-গন্ধ তার লুকিয়ে রাখে নিরুদ্ধ অন্তরে         আজ রাতে তার সকল বাধা ঘোচে,      আপন বাণী নিঃশেষিয়া দেয় সে অসংকোচে।               অনিদ্র কোকিল দূর শাখাতে মুহুর্মুহু খুঁজতে পাঠায় কুহুগানের মিল।         যেন রে আর সময় তাহার নাই, এক রাতে আজ এই জীবনের শেষ কথাটি চাই।      ভেবেছিলেম সইবে না আজ লুকিয়ে রাখা বদ্ধ বাণীর অস্ফুটতায় যে-কথা মোর অর্ধাবরণ-ঢাকা।      ভেবেছিলেম বন্দীরে আজ মুক্ত করা সহজ হবে, ক্ষুদ্র বাধায় দিনে দিনে রুদ্ধ যাহা ছিল অগৌরবে।     সে যবে আজ এল ঘরে জোৎস্নারেখা পড়েছে মোর 'পরে                  শিরীষ-ডালের ফাঁকে ফাঁকে।            ভেবেছিলেম বলি তাকে-- "দেখো আমায়, জানো আমায়, সত্য ডাকে আমায় ডেকে লহো,    সবার চেয়ে গভীর যাহা নিবিড় ভাষায় সেই কথাটি কহো।               হয় নি মোদের চরম মন্ত্র পড়া,         হয় নি পূর্ণ অভিষেকের তীর্থজলের ঘড়া,    আজ হয়ে যাক মালাবদল যে-মালাটি অসীম রাত্রিদিন                           রইবে অমলিন।'         হঠাৎ বলে উঠল সে-যে, ক্রুদ্ধ নয়ন তার-- গড়ের মাঠে তাদের দলের হার হয়েছে, অন্যায় সেই হার।          বারে বারে ফিরে ফিরে খেলাহারের গ্লানি                  জানিয়ে দিল ক্লান্তি নাহি মানি। বাতায়নের সমুখ থেকে চাঁদের আলো নেমে গেল নীচে,         তখনো সেই নিদ্রাবিহীন কোকিল কুহরিছে। হার-জিত ভিমরুলে মৌমাছিতে হল রেষারেষি, দুজনায় মহাতর্ক শক্তি কার বেশি। ভিমরুল কহে, আছে সহস্র প্রমাণ তোমার দংশন নহে আমার সমান। মধুকর নিরুত্তর ছলছল-আঁখি— বনদেবী কহে তারে কানে কানে ডাকি, কেন বাছা, নতশির! এ কথা নিশ্চিত বিষে তুমি হার মানো, মধুতে যে জিত।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ) হার-মানা হার পরাব তোমার গলে হার-মানা হার পরাব তোমার গলে- দূরে রব কত আপন বলের ছলে।    জানি আমি জানি ভেসে যাবে আভিমান-    নিবিড় ব্যথায় ফাটিয়া পড়িবে প্রাণ,    শূন্য হিঁয়ার বাঁশিতে বাজিবে গান,       পাষাণ তখন গলিবে নয়নজলে।শতদলদল খুলে যাবে থরে থরে, লুকানো রবে না মধু চিরদিন-তরে।    আকাশ জুড়িয়া চাহিবে কাহার আঁখি,    ঘরের বাহিরে নীরবে লইবে ডাকি,    কিছুই সেদিন কিছুই রবে না বাকি-       পরম মরণ লভিব চরনতলে।রচনা: শান্তিনিকেতন ৭ বৈশাখ ১৩১৯ রবীন্দ্র রচনাবলী, বিশ্বভারতী ১৩৮৯ সং খণ্ড ১১, পৃ ১৫৩ থেকে সংগৃহীত। হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট আমার মেয়ে সঙিনীদের ডাক শুনতে পেয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচের তলায় যাচ্ছিল সে নেমে অন্ধকারে ভয়ে ভয়ে, থেমে থেমে।    হাতে ছিল প্রদীপখানি, আঁচল দিয়ে আড়াল ক'রে চলছিল সাবধানী।।আমি ছিলাম ছাতে তারায় ভরা চৈত্রমাসের রাতে। হঠাৎ মেয়ের কান্না শুনে, উঠে দেখতে গেলাম ছুটে। সিঁড়ির মধ্যে যেতে যেতে প্রদীপটা তার নিভে গেছে বাতাসেতা। শুধাই তারে, 'কী হয়েছে বামি?' সে কেঁদে কয় নীচে থেকে, 'হারিয়ে গেছি আমি!’তারায় ভরা চৈত্রমাসের রাতে ফিরে গেছি ছাতে মনে হল আকাশ-পানে চেয়ে, আমার বামির মতোই যেন অমনি কে এক মেয়ে নীলাম্বরের আঁচলখানি ঘিরে দীপশিখাটি বাঁচিয়ে একা চিলছে ধীরে ধীরে। নিবত যদি আলো, যদি হঠাৎ যেত থামি, আকাশ ভরে উঠত কেঁদে, "হারিয়ে গেছি আমি!' হালকা আমার স্বভাব হালকা আমার স্বভাব, মেঘের মতো না হোক গিরিনদীর মতো। আমার মধ্যে হাসির কলরব আজও থামল না। বেদীর থেকে নেমে আসি, রঙ্গমঞ্চে বসে বাঁধি নাচের গান, তার বায়না নিয়েছি প্রভুর কাছে। কবিতা লিখি, তার পদে পদে ছন্দের ভঙ্গিমায় তারুণ্য ওঠে মুখর হয়ে, ঝিঁঝিট খাম্বাজের ঝংকার দিতে আজো সে সংকোচ করে না। আমি সৃষ্টিকর্তা পিতামহের রহস্য-সখা। তিনি অর্বাচীন নবীনদের কাছে প্রবীণ বয়সের প্রমাণ দিতে ভুলেই গেছেন। তরুণের উচ্ছৃঙ্খল হাসিতে উতরোল তাঁর কৌতুক, তাদের উদ্দাম নৃত্যে বাজান তিনি দ্রুততালের মৃদঙ্গ। তাঁর বজ্রমন্দিত গাম্ভীর্য মেঘমেদুর অম্বরে, অজস্র তাঁর পরিহাস বিকশিত কাশবনে, শরতের অকারণ হাস্যহিল্লোলে। তাঁর কোনো লোভ নেই প্রধানদের কাছে মর্যাদা পাবার; তাড়াতাড়ি কালো পাথর চাপা দেন না চাপল্যের ঝরনার মুখে। তাঁর বেলাভূমিতে ভঙ্গুর সৈকতের ছেলেমানুষি প্রতিবাদ করে না সমুদ্রের। আমাকে চান টেনে রাখতে তাঁর বয়স্যদলে, তাই আমার বার্ধক্যের শিরোপা হঠাৎ নেন কেড়ে ফেলে দেন ধুলোয়-- তার উপর দিয়ে নেচে নেচে চলে যায় বৈরাগী পাঁচ রঙের তালি-দেওয়া আলখাল্লা পরে। যারা আমার মূল্য বাড়াতে চায়, পরায় আমাকে দামি সাজ, তাদের দিকে চেয়ে তিনি ওঠেন হেসে, ও সাজ আর টিঁকতে পায় না আনমনার অনবধানে। আমাকে তিনি চেয়েছেন নিজের অবারিত মজলিসে, তাই ভেবেছি যাবার বেলায় যাব মান খুইয়ে, কপালের তিলক মুছে, কৌতুকে রসোল্লাসে। এস আমার অমানী বন্ধুরা মন্দিরা বাজিয়ে-- তোমাদের ধুলোমাখা পায়ে যদি ঘুঙুর বাঁধা থাকে লজ্জা পাব না। হাসি সুদূর প্রবাসে আজি কেন রে কী জানি কেবল পড়িছে মনে তার হাসিখানি । কখন নামিয়া গেল সন্ধ্যার তপন , কখন থামিয়া গেল সাগরের বাণী । কোথায় ধরার ধারে বিরহবিজন একটি মাধবীলতা আপন ছায়াতে দুটি অধরের রাঙা কিশলয় – পাতে হাসিটি রেখেছে ঢেকে কুঁড়ির মতন ! সারা রাত নয়নের সলিল সিঞ্চিয়া রেখেছে কাহার তরে যতনে সঞ্চিয়া! সে হাসিটি কে আসিয়া করিবে চয়ন , লুব্ধ এই জগতের সবারে বঞ্চিয়া ! তখন দুখানি হাসি মরিয়া বাঁচিয়া তুলিবে অমর করি একটি চুম্বন ।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) হাসিমুখে শুকতারা হাসিমুখে শুকতারা লিখে গেল ভোররাতে আলোকের আগমনী অাঁধারের শেষপাতে।   (স্ফুলিঙ্গ) হাসিরাশি নাম রেখেছি বাব্‍লারানী,             একরত্তি মেয়ে। হাসিখুশি চাঁদের আলো              মুখটি আছে ছেয়ে। ফুট্‌ফুটে তার দাঁত কখানি,             পুট্‌পুটে তার ঠোঁট। মুখের মধ্যে কথাগুলি সব             উলোটপালোট। কচি কচি হাত দুখানি,             কচি কচি মুঠি, মুখ নেড়ে কেউ কথা ক'লে             হেসেই কুটি-কুটি। তাই তাই তাই তালি দিয়ে             দুলে দুলে নড়ে, চুলগুলি সব কালো কালো             মুখে এসে পড়ে। ‘চলি চলি পা পা'             টলি টলি যায়, গরবিনী হেসে হেসে             আড়ে আড়ে চায়। হাতটি তুলে চুড়ি দুগাছি             দেখায় যাকে তাকে, হাসির সঙ্গে নেচে নেচে            নোলক দোলে নাকে। রাঙা দুটি ঠোঁটের কাছে            মুক্তো আছে ফ'লে, মায়ের চুমোখানি-যেন            মুক্তো হয়ে দোলে। আকাশেতে চাঁদ দেখেছে,            দু হাত তুলে চায়, মায়ের কোলে দুলে দুলে            ডাকে ‘আয় আয়'। চাঁদের আঁখি জুড়িয়ে গেল            তার মুখেতে চেয়ে, চাঁদ ভাবে কোত্থেকে এল             চাঁদের মতো মেয়ে। কচি প্রাণের হাসিখানি            চাঁদের পানে ছোটে, চাঁদের মুখের হাসি আরো            বেশি ফুঠে ওঠে। এমন সাধের ডাক শুনে চাঁদ            কেমন করে আছে— তারাগুলি ফেলে বুঝি            নেমে আসবে কাছে! সুধামুখের হাসিখানি            চুরি করে নিয়ে রাতারাতি পালিয়ে যাবে            মেঘের আড়াল দিয়ে। আমরা তারে রাখব ধরে            রানীর পাশেতে। হাসিরাশি বাঁধা রবে            হাসিরাশিতে। (শিশু কাব্যগ্রন্থ) হাস্যদমনকারী গুরু হাস্যদমনকারী গুরু– নাম যে বশীশ্বর, কোথা থেকে জুটল তাহার ছাত্র হসীশ্বর। হাসিটা তার অপর্যাপ্ত, তরঙ্গে তার বাতাস ব্যাপ্ত, পরীক্ষাতে মার্কা যে তাই কাটেন মসীশ্বর। ডাকি সরস্বতী মাকে,– “ত্রাণ করো এই ছেলেটাকে, মাস্টারিতে ভর্তি করো হাস্যরসীশ্বর।’   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ) হিং টিং ছট্ স্বপ্ন দেখেছেন রাত্রে হবুচন্দ্র ভূপ — অর্থ তার ভাবি ভাবি গবুচন্দ্র চুপ। শিয়রে বসিয়ে যেন তিনটে বাদঁরে উকুন বাছিতেছিল পরম আদরে — একটু নড়িতে গেলে গালে মারে চড় , চোখে মুখে লাগে তার নখের আঁচড় । সহসা মিলালো তারা , এল এক বেদে, ‘পাখি উড়ে গেছে ‘ ব‘লে মরে কেঁদে কেঁদে। সম্মুখে রাজারে দেখি তুলি নিল ঘাড়ে , ঝুলায়ে বসায়ে দিল উচু এক দাঁড়ে। নীচেতে দাঁড়ায়ে এক বুড়ি থুড়থুড়ি হাসিয়া পায়ের তলে দেয় সুড়সুড়ি। রাজা বলে ‘কী আপদ ‘ কেহ নাহি ছাড়ে— পা দুটা তুলিতে চাহে , তুলিতে না পারে । পাখির মত রাজা করে ঝটপট্ বেদে কানে কানে বলে —- হিং টিং ছট্। স্বপ্ন মঙ্গলের কথা অমৃতসমান, গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান।।হবুপুর রাজ্যে আজ দিন ছয় –সাত চোখে কারো নিদ্রা নাই, পেটে নাই ভাত। শীর্ণ গালে হাত দিয়ে নত করি শির রাজ্যসুদ্ধ বালকবৃদ্ধ ভেবেই অস্থির । ছেলেরা ভুলেছে খেলা, পন্ডিতেরা পাঠ, মেয়েরা করেছে চুপ এতই বিভ্রাট। সারি সারি বসে গেছে, কথা নাহি মুখে, চিন্তা যত ভারী হয় মাথা পড়ে ঝুঁকে । ভুঁইফোঁড় তত্ত্ব যেন ভূমিতলে খোঁজে, সবে যেন বসে গেছে নিরাকার ভোজে। মাঝে মঝে দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া উৎকট হঠাৎ ফুকারি উঠে-হিং টিং ছট্। স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান, গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান।।চারি দিক হতে এল পন্ডিতের দল— অযোধ্যা কনোজ কাঞ্চী মগধ কোশল। উজ্জয়িনী হতে এল বুধ-অবতংস কালিদাস কবীন্দ্রের ভাগিনেয় বংশ। মোটা মোটা পুঁথি লয়ে উলটায় পাতা, ঘন ঘন নাড়ে বসি টিকিসুদ্ধ মাথা। বড়ো বড়ো মস্তকের পাকা শস্যখেত বাতাসে দুলিছে যেন শীর্ষ- সমেত। কেহ শ্রুতি, কেহ স্মৃতি, কেহ-বা পুরাণ, কেহ ব্যাকারণ দেখে, কেহ অভিধান । কোনোখানে নাহি পায় অর্থ কোনোরূপ, বেড়ে ওঠে অনুস্বর-বিসর্গের স্তূপ। চুপ করে বসে থাকে, বিষম সংকট, থেকে থেকে হেঁকে ওঠে -হিং টিং ছট্। স্বপ্ন মঙ্গলের কথা অমৃতসমান, গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান।।কহিলেন হতাশ্বাস হবুচন্দ্ররাজ, ম্লেচ্ছদেশে আছে নাকি পন্ডিত সমাজ– তাহাদের ডেকে আন যে যেখানে আছে, অর্থ যদি ধরা পড়ে তাহাদের কাছে।‘ কটা-চুল নীলচক্ষু কপিশকপোল যবন পন্ডিত আসে , বাজে ঢাক ঢোল ॥ গায়ে কলো মোটা মোটা ছাঁটাছোঁটা কুর্তি- গ্রীষ্ম তাপে উষ্মা বাড়ে, ভারি উগ্রমূর্তি। ভূমিকা না করি কিছু ঘড়ি খুলি কয়, ‘সতেরো মিনিট মাত্র রয়েছে সময়—- কথা যদি থাকে কিছু বলো চট্পট্।‘ সভাসুদ্ধ বলি উঠে - হিং টিং ছট্। স্বপ্ন মঙ্গলের কথা অমৃতসমান ।। গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান।।স্বপ্ন শুনি ম্লেচ্ছমুখ রাঙা টকটকে, আগুন ছুটিতে চায় মুখে আর চোখে । কিন্তু তবু স্বপ্ন ওটা করি অনুমান , যদিও রাজার শিরে পেয়েছিল স্থান । অর্থ চাই? রাজ কোষে আছে ভূরি ভূরি – রাজ স্বপ্নে অর্থ নাই যত মাথা খুড়ি । নাই অর্থ, কিন্তু তবু কহি অকপট শুনিতে কী মিষ্ট আহা –হিং টিং ছট্।’ স্বপ্ন মঙ্গলের কথা অমৃতসমান, গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুন্যবান।।শুনিয়া সভাস্থ সবে করে ধিক্-ধিক , কোথাকার গন্ডমূর্খ পাষন্ড নাস্তিক! স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন মাত্র মস্তিষ্ক বিকার এ কথা কেমন করে করিব স্বীকার ! জগৎ বিখ্যাত মোরা ‘ধর্মপ্রাণ‘ জাতি– স্বপ্ন উড়াইয়ে দিবে! দুপুরে ডাকাতি! হবুচন্দ্র রাজা কহে পাকালিয়া চোখে, ‘গবুচন্দ্র, এদের উচিত শিক্ষা হোক । হেঁটোয় কন্টক দাও , উপরে কন্টক, ডালকুত্তাদের মাঝে করহ বন্টক‘। সতেরো মিনিট—কাল না হইতে শেষ ম্লেচ্ছ পন্ডিতের আর না মিলে উদ্দেশ। সভাস্থ সবাই ভাসে আনন্দাশ্রুনীরে, ধর্মরাজ্যে পুনর্বার শান্তি এল ফিরে। পন্ডিতেরা মুখচক্ষু করিয়া বিকট পুনর্বার উচ্চারিল —- হিং টিং ছট্ স্বপ্ন মঙ্গলের কথা অমৃতসমান, গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান।।অতঃপর গৌড় হতে এল হেন বেলা যবন পন্ডিতদের গুরু মারা চেলা। নগ্নশির, সজ্জা নাই, লজ্জা নাই ধড়ে—- কাছা কোঁচা শতবার খ‘সে খ‘সে পড়ে। অস্তিত্ব আছে না আছে , ক্ষীণখর্ব দেহ, বাক্য যবে বহিরায় না থাকে সন্দেহ। এতটুকু যন্ত্র হতে এত শব্দ হয় দেখিয়া বিশ্বের লাগে বিষম বিস্ময়। না জানে অভিবাদন, না পুছে কুশল , পিতৃনাম শুধাইলে উদ্যতমুষল। সগর্বে জিজ্ঞাসা করে, কী লয়ে বিচার! শুনিলে বলিতে পারি কথা দুই- চার, ব্যাখ্যায় করিতে পারি উলট্পালট।‘ সমস্বরে কহে সবে –হিং টিং ছট্ স্বপ্ন মঙ্গলের কথা অমৃতসমান , গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান।।স্বপ্ন কথা শুনি মুখ গম্ভীর করিয়া কহিল গৌড়ীয় সাধু প্রহর ধরিয়া , ‘নিতান্ত সরল অর্থ, অতি পরিস্কার— বহু পুরাতন ভাব, নব আবিস্কার । ত্র্যম্বকের ত্রিয়ন ত্রিকাল ত্রিগুন শক্তিভেদে ব্যাক্তিভেদ দ্বিগুণ বিগুণ। বিবর্তন আবর্তন সম্বর্তন আদি জীবশক্তি শিবশক্তি করে বিসম্বাদী। আকর্ষন বিকর্ষন পুরুষ প্রকৃতি। আণব চৌম্বক বলে আকৃতি বিকৃতি। কুশাগ্রে প্রবহমান জীবাত্মবিদ্যুৎ ধারণা পরমা শক্তি সেথায় উদ্ভুদ। ত্রয়ী শক্তি ত্রিস্বরূপে প্রপঞ্চে প্রকট, সংক্ষেপে বলিতে গেলে—হিং টিং ছট্ স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান, গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান।।‘ সাধু সাধু সাধু ‘ রবে কাঁপে চারি ধার– সবে বলে , ‘পরিস্কার, অতি পরিস্কার!‘ দুর্বোধ যা-কিছু ছিল হয়ে গেল জল, শন্য আকাশের মতো অত্যন্ত নির্মল। হাঁপ ছাড়ি উঠিলেন হবুচন্দ্ররাজ, আপনার মাথা হতে খুলি লয়ে তাজ পরাইয়া দিল ক্ষীণ বাঙালির শিরে— ভারে তার মাথা টুকৃ পড়ে বুঝি ছিড়ে। বহু দিন পরে আজ চিন্তা গেল ছুটে, হাবুডুবু হবুরাজ্য নড়িচড়ি ওঠে। ছেলেরা ধরিল খেলা, বৃদ্ধেরা তামুক- এক দন্ডে খুলে গেল রমণীর মুখ। দেশ-জোড়া মাথা-ধরা ছেড়ে গেল চট্, সবাই বুঝিয়া গেল-হিং টিং ছট্ স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান, গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান।।যে শুনিবে এই স্বপ্ন মঙ্গলের কথা সর্বভ্রম ঘুচে যবে, নহিবে অন্যথা। বিশ্বে কভূ বিশ্ব ভেবে হবে না ঠকিতে, সত্যেরে সে মিথ্যা বলি বুঝিবে চকিতে। যা আছে তা নাই আর নাই যাহা আছে, এ কথা জাজ্বল্যমান হবে তার কাছে । সবাই সরল ভাবে দেখিবে যা-কিছু সে আপন লেজুড় জুড়িবে তার পিছু। এসো ভাই, তোল হাই, শুয়ে পড়ো চিত, অনিশ্চিত এ সংসারে এ কথা নিশ্চিত— জগতে সকলেই মিথ্যা, সব মায়াময়, স্বপ্ন শুধু সত্য আর সত্য কিছু নয়। স্বপ্ন মঙ্গলের কথা অমৃতসমান, গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান।শান্তিনিকেতন ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১২৯৯ সোনার তরী (কাব্যগ্রন্থ) হিংস্র রাত্রি আসে চুপে চুপে হিংস্র রাত্রি আসে চুপে চুপে, গতবল শরীরের শিথিল অর্গল ভেঙে দিয়ে অন্তরে প্রবেশ করে, হরণ করিতে থাকে জীবনের গৌরবের রূপ কালিমার আক্রমণে হার মানে মন। এ পরাভবের লজ্জা এ অবসাদের অপমান যখন ঘনিয়ে ওঠে সহসা দিগন্তে দেখা দেয় দিনের পতাকাখানি স্বর্ণকিরণের রেখা-আঁকা; আকাশের যেন কোন্‌ দূর কেন্দ্র হতে উঠে ধ্বনি “মিথ্যা মিথ্যা’ বলি। প্রভাতের প্রসন্ন আলোকে দুঃখবিজয়ীর মূর্তি দেখি আপনার জীর্ণদেহদুর্গের শিখরে।  (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) হিন্দুমেলার উপহার ১ হিমাদ্রি শিখরে শিলাসন - ' পরি , গান ব্যাসঋষি বীণা হাতে করি — কাঁপায়ে পর্বত শিখর কানন , কাঁপায়ে নীহারশীতল বায় ।২ স্তব্ধ শিখর স্তব্ধ তরুলতা , স্তব্ধ মহীরূহ নড়েনাকো পাতা । বিহগ নিচয় নিস্তব্ধ অচল ; নীরবে নির্ঝর বহিয়া যায় ।৩ পূরণিমা রাত — চাঁদের কিরণ — রজতধারায় শিখর , কানন , সাগর-ঊরমি , হরিত-প্রান্তর , প্লাবিত করিয়া গড়ায়ে যায় ।৪ ঝংকারিয়া বীণা কবিবর গায় , ‘ কেন রে ভারত কেন তুই , হায় , আবার হাসিস্‌! হাসিবার দিন আছে কি এখনো এ ঘোর দুঃখে ।৫ দেখিতাম যবে যমুনার তীরে , পূর্ণিমা নিশীথে নিদাঘ সমীরে , বিশ্রামের তরে রাজা যুধিষ্ঠির , কাটাতেন সুখে নিদাঘ-নিশি ।৬ তখন ও - হাসি লেগেছিল ভালো , তখন ও - বেশ লেগেছিল ভালো , শ্মশান লাগিত স্বরগ সমান , মরু উরবরা ক্ষেতের মতো ।৭ তখন পূর্ণিমা বিতরিত সুখ , মধুর উষার হাস্য দিত সুখ , প্রকৃতির শোভা সুখ বিতরিত পাখির কূজন লাগিত ভালো ।৮ এখন তা নয় , এখন তা নয় , এখন গেছে সে সুখের সময় । বিষাদ আঁধার ঘেরেছে এখন , হাসি খুশি আর লাগে না ভালো ।৯ অমার আঁধার আসুক এখন , মরু হয়ে যাক ভারত-কানন , চন্দ্র সূর্য হোক মেঘে নিমগন প্রকৃতি-শৃঙ্খলা ছিঁড়িয়া যাক্‌ ।১০ যাক ভাগীরথী অগ্নিকুণ্ড হয়ে , প্রলয়ে উপাড়ি পাড়ি হিমালয়ে , ডুবাক ভারতে সাগরের জলে , ভাঙিয়া চুরিয়া ভাসিয়া যাক্‌ ।১১ চাই না দেখিতে ভারতেরে আর , চাই না দেখিতে ভারতেরে আর , সুখ-জন্মভূমি চির বাসস্থান , ভাঙিয়া চুরিয়া ভাসিয়া যাক ।১২ দেখেছি সে-দিন যবে পৃথ্বীরাজ , সমরে সাধিয়া ক্ষত্রিয়ের কাজ , সমরে সাধিয়া পুরুষের কাজ , আশ্রয় নিলেন কৃতান্ত-কোলে ।১৩ দেখেছি সে-দিন দুর্গাবতী যবে , বীরপত্নীসম মরিল আহবে বীরবালাদের চিতার আগুন , দেখেছি বিস্ময়ে পুলকে শোকে ।১৪ তাদের স্মরিলে বিদরে হৃদয় , স্তব্ধ করি দেয় অন্তরে বিস্ময় ; যদিও তাদের চিতাভস্মরাশি , মাটির সহিত মিশায়ে গেছে!১৫ আবার সে - দিন(ও) দেখিয়াছি আমি , স্বাধীন যখন এ-ভারতভূমি কী সুখের দিন! কী সুখের দিন! আর কি সেদিন আসিবে ফিরে ?১৬ রাজা যুধিষ্ঠির (দেখেছি নয়নে) স্বাধীন নৃপতি আর্য-সিংহাসনে , কবিতার শ্লোকে বীণার তারেতে , সেসব কেবল রয়েছে গাঁথা!১৭ শুনেছি আবার , শুনেছি আবার , রাম রঘুপতি লয়ে রাজ্যভার , শাসিতেন হায় এ-ভারতভূমি , আর কি সে-দিন আসিবে ফিরে!১৮ ভারত-কঙ্কাল আর কি এখন , পাইবে হায় রে নূতন জীবন ; ভারতের ভস্মে আগুন জ্বলিয়া , আর কি কখনো দিবে রে জ্যোতি ।১৯ তা যদি না হয় তবে আর কেন , হাসিবি ভারত! হাসিবি রে পুনঃ , সে-দিনের কথা জাগি স্মৃতিপটে , ভাসে না নয়ন বিষাদজলে ?২০ অমার আঁধার আসুক এখন , মরু হয়ে যাক ভারত-কানন , চন্দ্র সূর্য হোক মেঘে নিমগন , প্রকৃতি-শৃঙ্খলা ছিঁড়িয়া যাক ।২১ যাক ভাগীরথী অগ্নিকুণ্ড হয়ে , প্রলয়ে উপাড়ি পাড়ি হিমালয়ে , ডুবাক ভারতে সাগরের জলে , ভাঙিয়া চুরিয়া ভাসিয়া যাক্‌ ।২২ মুছে যাক মোর স্মৃতির অক্ষর , শূন্যে হোক লয় এ শূন্য অন্তর , ডুবুক আমার অমর জীবন , অনন্ত গভীর কালের জলে । ' হিন্দুস্থান মোরে হিন্দুস্থান            বারবার করেছে আহ্বান      কোন্‌ শিশুকাল হতে পশ্চিমদিগন্ত-পানে ভারতের ভাগ্য যেথা নৃত্যলীলা করেছে শ্মশানে,                    কালে কালে               তাণ্ডবের তালে তালে,                    দিল্লিতে আগ্রাতে          মঞ্জীরঝংকার আর দূর শকুনির ধ্বনি-সাথে;                    কালের মন্থনদণ্ডঘাতে               উচ্ছলি উঠেছে যেথা পাথরের ফেনস্তূপে          অদৃষ্টের অট্টহাস্য অভ্রভেদী প্রাসাদের রূপে।          লক্ষ্মী-অলক্ষ্মীর দুই বিপরীত পথে                    রথে প্রতিরথে      ধূলিতে ধূলিতে যেথা পাকে পাকে করেছে রচনা         জটিল রেখার জালে শুভ-অশুভের আল্‌পনা।          নব নব ধ্বজা হাতে নব নব সৈনিকবাহিনী      এক কাহিনীর সূত্র ছিন্ন করি আরেক কাহিনী          বারংবার গ্রন্থি দিয়ে করেছে যোজন।      প্রাঙ্গণপ্রাচীর যার অকস্মাৎ করেছে লঙ্ঘন                    দস্যুদল,         অর্ধরাত্রে দ্বার ভেঙে জাগিয়েছে আর্ত কোলাহল,                    করেছে আসন-কাড়াকাড়ি,          ক্ষুধিতের অন্নথালি নিয়েছে উজাড়ি।      রাত্রিরে ভুলিল তারা ঐশ্বর্যের মশাল-আলোয়--          পীড়িত পীড়নকারী দোঁহে মিলি সাদায় কালোয়                    যেখানে রচিয়াছিল দ্যূতখেলাঘর,      অবশেষে সেথা আজ একমাত্র বিরাট কবর                    প্রান্ত হতে প্রান্তে প্রসারিত;          সেথা জয়ী আর পরাজিত                    একত্রে করেছে অবসান               বহু শতাব্দীর যত মান অসম্মান।      ভগ্নজানু প্রতাপের ছায়া সেথা শীর্ণ যমুনায়                    প্রেতের আহ্বান বহি চলে যায়,                             বলে যায়--          আরো ছায়া ঘনাইছে অস্তদিগন্তের                              জীর্ণ যুগান্তের। হিমাদ্রির ধ্যানে যাহা হিমাদ্রির ধ্যানে যাহা স্তব্ধ হয়ে ছিল রাত্রিদিন, সপ্তর্ষির দৃষ্টিতলে বাক্যহীন শুভ্রতায় লীন, সে তুষারনির্ঝরিণী রবিকরস্পর্শে উচ্ছ্বসিতা দিগ্‌ দিগন্তে প্রচারিছে অন্তহীন আনন্দের গীতা।   (স্ফুলিঙ্গ) হিমালয় যেখানে জ্বলিছে সূর্য, উঠিছে সহস্র তারা,          প্রজ্বলিত ধূমকেতু বেড়াইছে ছুটিয়া। অসংখ্য জগৎযন্ত্র, ঘুরিছে নিয়মচক্রে           অসংখ্য উজ্জ্বল গ্রহ রহিয়াছে ফুটিয়া। গম্ভীর অচল তুমি, দাঁড়ায়ে দিগন্ত ব্যাপি,           সেই আকাশের মাঝে শুভ্র শির তুলিয়া। নির্ঝর ছুটিছে বক্ষে, জলদ ভ্রমিছে শৃঙ্গে,           চরণে লুটিছে নদী শিলারাশি ঠেলিয়া। তোমার বিশাল ক্রোড়ে লভিতে বিশ্রাম-সুখ           ক্ষুদ্র নর আমি এই আসিয়াছি ছুটিয়া। পৃথিবীর কোলাহল, পারি না সহিতে আর ,           পৃথিবীর সুখ দুখ গেছে সব মিটিয়া । সারাদিন, সারারাত, সমুচ্চ শিখরে বসি,           চন্দ্র-সূর্য-গ্রহময় শূন্যপানে চাহিয়া। জীবনের সন্ধ্যাকাল কাটাইব ধীরে ধীরে,           নিরালয় মরমের গানগুলি গাহিয়া। গভীর নীরব গিরি, জোছনা ঢালিবে চন্দ্র,           দূরশৈলমালাগুলি চিত্রসম শোভিবে। ধীরে ধীরে ঝুরু ঝুরু, কাঁপিবেক গাছপালা           একে একে ছোটো ছোটো তারাগুলি নিভিবে। তখন বিজনে বসি, নীরবে নয়ন মুদি,           স্মৃতির বিষণ্ণ ছবি আঁকিব এ মানসে। শুনিব সুদূর শৈলে, একতানে নির্ঝারিণী,           ঝর ঝর ঝর ঝর মৃদুধ্বনি বরষে। ক্রমে ক্রমে আসিবেক জীবনের শেষ দিন,           তুষার শয্যার ' পরে রহিব গো শুইয়া। মর মর মর মর দুলিবে গাছের পাতা           মাথার উপরে হুহু -- বায়ু যাবে বহিয়া।চোখের সামনে ক্রমে , নিভিবে রবির আলো           বনগিরি নির্ঝরিণী অন্ধকারে মিশিবে। তটিনীর মৃদুধ্বনি, নিঝরের ঝর ঝর           ক্রমে মৃদুতর হয়ে কানে গিয়া পশিবে। এতকাল যার বুকে, কাটিয়া গিয়াছে দিন,           দেখিতে সে ধরাতল শেষ বার চাহিব। সারাদিন কেঁদে কেঁদে -- ক্লান্ত শিশুটির মতো           অনন্তের কোলে গিয়া ঘুমাইয়া পড়িব। সে ঘুম ভাঙিবে যবে, নূতন জীবন ল'য়ে,           নূতন প্রেমের রাজ্যে পুন আঁখি মেলিব। যত কিছু পৃথিবীর দুখ,জ্বালা, কোলাহল,           ডুবায়ে বিস্মৃতি-জলে মুছে সব ফেলিব। ওই যে অসংখ্য তারা, ব্যাপিয়া অনন্ত শূন্য           নীরবে পৃথিবী-পানে রহিয়াছে চাহিয়া। ওই জগতের মাঝে, দাঁড়াইব এক দিন,           হৃদয় বিস্ময়-গান উঠিবেক গাহিয়া। রবি শশি গ্রহ তারা, ধূমকেতু শত শত           আঁধার আকাশ ঘেরি নিঃশবদে ছুটিছে। বিস্ময়ে শুনিব ধীরে, মহাস্তব্ধ প্রকৃতির           অভ্যন্তর হতে এক গীতধ্বনি উঠিছে। গভীর আনন্দ-ভরে, বিস্ফারিত হবে মন           হৃদয়ের ক্ষুদ্র ভাব যাবে সব ছিঁড়িয়া। তখন অনন্ত কাল, অনন্ত জগত-মাঝে           ভুঞ্জিব অনন্ত প্রেম মনঃপ্রাণ ভরিয়া। হৃদয়ক সাধ মিশাওল হৃদয়ে হৃদয়ক সাধ মিশাওল হৃদয়ে ,    কন্ঠে বিমলিন মালা । বিরহবিষে দহি বহি গল রয়নী ,    নহি নহি আওল কালা । বুঝনু বুঝনু সখি বিফল বিফল সব ,     বিফল এ পীরিতি লেহা — বিফল রে এ মঝু জীবন যৌবন ,     বিফল রে এ মঝু দেহা ! চল সখি গৃহ চল , মঞ্চ নয়নজল ,     চল সখি চল গৃহকাজে , মালতিমালা রাখহ বালা ,    ছি ছি সখি মরু মরু লাজে । সখি লো দারুণ আধিভরাতুর     এ তরুণ যৌবন মোর , সখি লো দারুণ প্রণয়হলাহল     জীবন করল অঘোর । তৃষিত প্রাণ মম দিবসযামিনী     শ্যামক দরশন আশে , আকুল জীবন থেহ ন মানে ,     অহরহ জ্বলত হুতাশে ।     সজনি , সত্য কহি তোয় , খোয়াব কব হম শ্যামক প্রেম     সদা ডর লাগয়ে মোয় । হিয়ে হিয়ে অব রাখত মাধব ,     সো দিন আসব সখি রে - বাত ন বোলবে , বদন ন হেরবে ,      মরিব হলাহল ভখি রে । ঐস বৃথা ভয় না কর বালা ,      ভানু নিবেদয় চরণে , সুজনক পীরিতি নৌতুন নিতি নিতি ,     নহি টুটে জীবনমরণে ।(ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী কাব্যগ্রন্থ) হৃদয়-আকাশ আমি ধরা দিয়েছি গো আকাশের পাখি, নয়নে দেখেছি তব নূতন আকাশ । দুখানি আঁখির পাতে কী রেখেছ ঢাকি, হাসিলে ফুটিয়া পড়ে উষার আভাস । হৃদয় উড়িতে চায় হোথায় একাকী আঁখিতারকার দেশে করিবারে বাস । ওই গগনেতে চেয়ে উঠিয়াছে ডাকি, হোথায় হারাতে চায় এ গীত-উচ্ছ্বাস । তোমার হৃদয়াকাশ অসীম বিজন, বিমল নীলিমা তার শান্ত সুকুমার, যদি নিয়ে যাই ওই শূন্য হয়ে পার আমার দুখানি পাখা কনকবরন -- হৃদয় চাতক হয়ে চাবে অশ্রুধার, হৃদয়চকোর চাবে হাসির কিরণ ।। হৃদয়-আসন কোমল দুখানি বাহু শরমে লতায়ে বিকশিত স্তন দুটি আগুলিয়া রয়, তারি মাঝখানে কি রে রয়েছে লুকায়ে অতিশয়-সযতন-গোপন হৃদয়! সেই নিরালায় সেই কোমল আসনে দুইখানি স্নেহস্ফুট স্তনের ছায়ায় কিশোর প্রেমের মৃদু প্রদোষকিরণে আনত আঁখির তলে রাখিবে আমায়! কত-না মধুর আশা ফুটিছে সেথায় -- গভীর নিশীথে কত বিজন কল্পনা, উদাশ নিশ্বাসবায়ু বসন্তসন্ধায়, গোপনে চাঁদিনী রাতে দুটি অশ্রুকণা । তারি মাঝে আমারে কি রাখিবে যতনে, হৃদয়ের সুমধুর স্বপনশয়নে ?। হৃদয়ধর্ম হৃদয় পাষাণভেদী নির্ঝরের প্রায়, জড়জন্তু সবাপানে নামিবারে চায়। মাঝে মাঝে ভেদচিহ্ন আছে যত যার সে চাহে করিতে মগ্ন লুপ্ত একাকার। মধ্যদিনে দগ্ধদেহে ঝাঁপ দিয়ে নীরে মা ব’লে সে ডেকে ওঠে স্নিগ্ধ তটিনীরে। যে চাঁদ ঘরের মাঝে হেসে দেয় উঁকি সে যেন ঘরেরই মেয়ে শিশু সুধামুখী। যে-সকল তরুলতা রচি উপবন গৃহপার্শ্বে বাড়িয়াছে, তারা ভাইবোন। যে পশুরে জন্ম হতে আপনার জানি, হৃদয় আপনি তারে ডাকে ‘পুঁটুরানী’। বুদ্ধি শুনে হেসে ওঠে, বলে—কী মূঢ়তা! হৃদয় লজ্জায় ঢাকে হৃদয়ের কথা।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ) হৃদয়ের ভাষা হৃদয় , কেন গো মোরে ছলিছ সতত , আপনার ভাষা তুমি শিখাও আমায় । প্রত্যহ আকুল কন্ঠে গাহিতেছি কত , ভগ্ন বাঁশরিতে শ্বাস করে হায় হায় ! সন্ধ্যাকালে নেমে যায় নীরব তপন সুনীল আকাশ হতে সুনীল সাগরে । আমার মনের কথা , প্রাণের স্বপন ভাসিয়া উঠিছে যেন আকাশের ‘পরে । ধ্বনিছে সন্ধ্যার মাঝে কার শান্ত বাণী , ও কি রে আমারি গান ? ভাবিতেছি তাই । প্রাণের যে কথাগুলি আমি নাহি জানি সে – কথা কেমন করে জেনেছে সবাই । মোর হৃদয়ের গান সকলেই গায় , গাহিতে পারি নে তাহা আমি শুধু হায় ।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ) হে উষা, নিঃশব্দে এসো হে উষা, নিঃশব্দে এসো, আকাশের তিমিরগুণ্ঠন করে উন্মোচন। হে প্রাণ, অন্তরে থেকে মুকুলের বাহ্য আবরণ করো উন্মোচন। হে চিত্ত, জাগ্রত হও, জড়ত্বের বাধা নিশ্চেতন করে উন্মোচন। ভেদবুদ্ধি-তামসের মোহযবনিকা, হে আত্মন, করে উন্মোচন।   (স্ফুলিঙ্গ) হে জনসমুদ্র, আমি ভাবিতেছি মনে হে জনসমুদ্র, আমি ভাবিতেছি মনে কে তোমারে আন্দোলিছে বিরাট মন্থনে অনন্ত বরষ ধরি। দেবদৈত্যদলে কী রত্ন সন্ধান লাগি তোমার অতলে অশান্ত আবর্ত নিত্য রেখেছে জাগায়ে পাপে-পুণ্যে সুখে-দুঃখে ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় ফেনিল কল্লোলভঙ্গে। ওগো, দাও দাও কী আছে তোমার গর্ভে– এ ক্ষোভ থামাও। তোমার অন্তরলক্ষ্মী যে শুভ প্রভাতে উঠিবেন অমৃতের পাত্র বহি হাতে বিস্মিত ভুবন-মাঝে, লয়ে বরমালা ত্রিলোকনাথের কণ্ঠে পরাবেন বালা, সেদিন হইবে ক্ষান্ত এ মহামন্থন, থেমে যাবে সমুদ্রের রুদ্র এ ক্রন্দন।  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) হে তরু, এ ধরাতলে হে তরু, এ ধরাতলে রহিব না যবে তখন বসন্তে নব পল্লবে পল্লবে তোমার মর্মরধ্বনি পথিকেরে কবে, "ভালো বেসেছিল কবি বেঁচে ছিল যবে।"   (স্ফুলিঙ্গ) হে নিস্তব্ধ গিরিরাজ হে নিস্তব্ধ গিরিরাজ, অভ্রভেদী তোমার সংগীত তরঙ্গিয়া চলিয়াছে অনুদাত্ত উদাত্ত স্বরিত প্রভাতের দ্বার হতে সন্ধ্যার পশ্চিমনীড়-পানে দুর্গম দুরূহ পথে কী জানি কী বাণীর সন্ধানে! দুঃসাধ্য উচ্ছ্বাস তব শেষ প্রান্তে উঠি আপনার সহসা মুহূর্তে যেন হারায়ে ফেলেছে কণ্ঠ তার, ভুলিয়া গিয়াছে সব সুর — সামগীত শব্দহারা নিয়ত চাহিয়া শূন্যে বরষিছে নির্ঝরিণীধারা।হে গিরি,যৌবন তব যে দুর্দম অগ্নিতাপবেগে আপনারে উৎসারিয়া মরিতে চাহিয়াছিল মেঘে সে তাপ হারায়ে গেছে, সে প্রচণ্ড গতি অবসান — নিরুদ্দেশ চেষ্টা তব হয়ে গেছে প্রাচীন পাষাণ। পেয়েছ আপন সীমা, তাই আজি মৌন শান্ত হিয়া সীমাবিহীনের মাঝে আপনারে দিয়েছ সঁপিয়া।  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) হে পথিক, কোন্‌খানে চলেছ কাহার পানে “হে পথিক, কোন্‌খানে চলেছ কাহার পানে।’ গিয়েছে রজনী, উঠে দিনমণি, চলেছি সাগরস্নানে। উষার আভাসে তুষারবাতাসে পাখির উদার গানে শয়ন তেয়াগি উঠিয়াছি জাগি, চলেছি সাগরস্নানে।“শুধাই তোমার কাছে সে সাগর কোথা আছে।’ যেথা এই নদী বহি নিরবধি নীল জলে মিশিয়াছে। সেথা হতে রবি উঠে নবছবি, লুকায় তাহারি পাছে– তপ্ত প্রাণের তীর্থস্নানের সাগর সেথায় আছে।“পথিক তোমার দলে যাত্রী ক’জন চলে।’ গণি তাহা ভাই শেষ নাহি পাই, চলেছে জলে স্থলে। তাহাদের বাতি জ্বলে সারারাতি তিমির-আকাশ-তলে। তাহাদের গান সারা দিনমান ধ্বনিছে জলে স্থলে।“সে সাগর, কহো,তবে আর কত দূরে হবে।’ “আর কত দূরে’ “আর কত দূরে’ সেই তো শুধাই সবে। ধ্বনি তার আসে দখিন বাতাসে ঘনভৈরবরবে। কভু ভাবি “কাছে’, কভু “দূরে আছে’– আর কত দূরে হবে।“পথিক, গগনে চাহো, বাড়িছে দিনের দাহ।’ বাড়ে যদি দুখ হব না বিমুখ, নিবাব না উৎসাহ। ওরে ওরে ভীত তৃষিত তাপিত জয়সংগীত গাহো। মাথার উপরে খররবিকরে বাড়ুক দিনের দাহ।“কী করিবে চলে চলে পথেই সন্ধ্যা হলে।’ প্রভাতের আশে স্নিগ্ধ বাতাসে ঘুমাব পথের কোলে। উদিবে অরুণ নবীন করুণ বিহঙ্গকলরোলে। সাগরের স্নান হবে সমাধান নূতন প্রভাত হলে।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) হে প্রিয়, দুঃখের বেশে হে প্রিয়, দুঃখের বেশে অাস যবে মনে তোমারে আনন্দ ব'লে চিনি সেই ক্ষণে।   (স্ফুলিঙ্গ) হে বিরাট নদী হে বিরাট নদী, অদৃশ্য নিঃশব্দ তব জল অবিচ্ছিন্ন অবিরল চলে নিরবধি। স্পন্দনে শিহরে শূন্য তব রুদ্র কায়াহীন বেগে; বস্তুহীন প্রবাহের প্রচণ্ড আঘাত লেগে পুঞ্জ পুঞ্জ বস্তুফেনা উঠে জেগে; ক্রন্দসী কাঁদিয়া ওঠে বহ্নিভরা মেঘে। আলোকের তীব্রচ্ছটা বিচ্ছুরিয়া উঠে বর্ণস্রোতে ধাবমান অন্ধকার হতে; ঘুর্ণাচক্রে ঘুরে ঘুরে মরে স্তরে স্তরে সুর্যচন্দ্রতারা যত বুদ্বুদের মতো।   হে ভৈরবী, ওগো বৈরাগিণী, চলেছ যে নিরুদ্দেশ সেই চলা তোমার রাগিণী, শব্দহীন সুর। অন্তহীন দূর তোমারে কি নিরন্তর দেয় সাড়া। সর্বনাশা প্রেমে তার নিত্য তাই তুমি ঘরছাড়া। উন্মত্ত সে-অভিসারে তব বক্ষোহারে ঘন ঘন লাগে দোলা--ছড়ায় অমনি নক্ষত্রের  মণি; আঁধারিয়া ওড়ে শূন্যে ঝোড়ো এলোচুল; দুলে উঠে বিদ্যুতের দুল; অঞ্চল আকুল গড়ায় কম্পিত তৃণে, চঞ্চল পল্লবপুঞ্জে বিপিনে বিপিনে; বারম্বার ঝরে ঝরে পড়ে ফুল জুঁই চাঁপা বকুল পারুল পথে পথে তোমার ঋতুর থালি হতে। শুধু ধাও, শুধু ধাও, শুধু বেগে ধাও উদ্দাম উধাও; ফিরে নাহি চাও, যা কিছু তোমার সব দুই হাতে ফেলে ফেলে যাও। কুড়ায়ে লও না কিছু, কর না সঞ্চয়; নাই শোক, নাই ভয়, পথের আনন্দবেগে অবাধে পাথেয় করো ক্ষয়।   যে মুহূর্তে পূর্ণ তুমি সে মুহূর্তে কিছু তব নাই, তুমি তাই পবিত্র সদাই। তোমার চরণস্পর্শে বিশ্বধূলি মলিনতা যায় ভুলি পলকে পলকে-- মৃত্যু ওঠে প্রাণ হয়ে ঝলকে ঝলকে। যদি তুমি মুহূর্তের তরে ক্লান্তিভরে দাঁড়াও থমকি, তখনি চমকি উচ্ছ্রিয়া উঠিবে বিশ্ব পুঞ্জ পুঞ্জ বস্তুর পর্বতে; পঙ্গু মুক কবন্ধ বধির আঁধা স্থুলতনু ভয়ংকরী বাধা সবারে ঠেকায়ে দিয়ে দাঁড়াইবে পথে; অণুতম পরমাণু আপনার ভারে সঞ্চয়ের অচল বিকারে বিদ্ধ হবে আকাশের মর্মমূলে কলুষের বেদনার শূলে। ওগো নটী, চঞ্চল অপ্সরী, অলক্ষ্য সুন্দরী তব নৃত্যমন্দাকিনী নিত্য ঝরি ঝরি তুলিতেছে শুচি করি মৃত্যস্নানে বিশ্বের জীবন। নিঃশেষে নির্মল নীলে বিকাশিছে নিখিল গগন।   ওরে কবি, তোরে আজ করেছে উতলা ঝংকারমুখরা এই ভুবনমেখলা, অলক্ষিত চরণের অকারণ অবারণ চলা। নাড়ীতে নাড়ীতে তোর চঞ্চলের শুনি পদধ্বনি, বক্ষ তোর উঠে রনরনি। নাহি জানে কেউ রক্তে তোর নাচে আজি সমুদ্রের ঢেউ, কাঁপে আজি অরণ্যের ব্যাকুলতা; মনে আজি পড়ে সেই কথা-- যুগে যুগে এসেছি চলিয়া, স্খলিয়া স্খলিয়া চুপে চুপে রূপ হতে রূপে প্রাণ হতে প্রাণে। নিশীথে প্রভাতে যা কিছু পেয়েছি হাতে এসেছি করিয়া ক্ষয় দান হতে দানে, গান হতে গানে।   ওরে দেখ্ সেই স্রোত হয়েছে মুখর, তরণী কাঁপিছে থরথর। তীরের সঞ্চয় তোর পড়ে থাক্ তীরে, তাকাস নে ফিরে। সম্মুখের বাণী নিক তোরে টানি মহাস্রোতে পশ্চাতের কোলাহল হতে অতল আঁধারে -- অকূল আলোতে। হে বিশ্বদেব, মোর কাছে তুমি হে বিশ্বদেব, মোর কাছে তুমি দেখা দিলে আজ কী বেশে। দেখিনু তোমারে পূর্বগগনে, দেখিনু তোমারে স্বদেশে। ললাট তোমার নীল নভতল বিমল আলোকে চির-উজ্জ্বল নীরব আশিস-সম হিমাচল তব বরাভয় কর। সাগর তোমার পরশি চরণ পদধূলি সদা করিছে হরণ, জাহ্নবী তব হার-আভরণ দুলিছে বক্ষ’পর। হৃদয় খুলিয়া চাহিনু বাহিরে, হেরিনু আজিকে নিমেষে– মিলে গেছ ওগো বিশ্বদেবতা, মোর সনাতন স্বদেশে।শুনিনু তোমার স্তবের মন্ত্র অতীতের তপোবনেতে– অমর ঋষির হৃদয় ভেদিয়া ধ্বনিতেছে ত্রিভুবনেতে। প্রভাতে হে দেব,তরুণ তপনে দেখা দাও যবে উদয়গগনে মুখ আপনার ঢাকি আবরণে হিরণ-কিরণে গাঁথা– তখন ভারতে শুনি চারি ভিতে মিলি কাননের বিহঙ্গগীতে প্রাচীন নীরব কণ্ঠ হইতে উঠে গায়ত্রীগাথা। হৃদয় খুলিয়া দাঁড়ানু বাহিরে শুনিনু আজিকে নিমেষে, অতীত হইতে উঠিছে হে দেব, তব গান মোর স্বদেশে।নয়ন মুদিয়া শুনিনু, জানি না কোন্‌ অনাগত বরষে তব মঙ্গলশঙ্খ তুলিয়া বাজায় ভারত হরষে। ডুবায়ে ধরার রণহুংকার ভেদি বণিকের ধনঝংকার মহাকাশতলে উঠে ওঙ্কার কোনো বাধা নাহি মানি। ভারতের শ্বেত হৃদিশতদলে, দাঁড়ায়ে ভারতী তব পদতলে, সংগীততানে শূন্যে উথলে অপূর্ব মহাবাণী। নয়ন মুদিয়া ভাবীকালপানে চাহিনু, শুনিনু নিমেষে তব মঙ্গলবিজয়শঙ্খ বাজিছে আমার স্বদেশে।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) হে ভারত, আজি নবীন বর্ষে হে ভারত, আজি নবীন বর্ষে শুন এ কবির গান। তোমার চরণে নবীন হর্ষে এনেছি পূজার দান। এনেছি মোদের দেহের শকতি এনেছি মোদের মনের ভকতি, এনেছি মোদের ধর্মের মতি, এনেছি মোদের প্রাণ। এনেছি মোদের শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য তোমারে করিতে দান।কাঞ্চন-থালি নাহি আমাদের, অন্ন নাহিকো জুটে যা আছে মোদের এনেছি সাজায়ে নবীন পর্ণপুটে। সমারোহে আজ নাই প্রয়োজন, দীনের এ পূজা, দীন আয়োজন, চিরদারিদ্র৻ করিব মোচন চরণের ধুলা লুটে। সুরদুর্লভ তোমার প্রসাদ লইব পর্ণপুটে।রাজা তুমি নহ, হে মহাতাপস, তুমিই প্রাণের প্রিয়। ভিক্ষাভূষণ ফেলিয়া পরিব তোমারি উত্তরীয়। দৈন্যের মাঝে আছে তব ধন, মৌনের মাঝে রয়েছে গোপন তোমার মন্ত্র অগ্নিবচন– তাই আমাদের দিয়ো। পরের সজ্জা ফেলিয়া পরিব তোমার উত্তরীয়।দাও আমাদের অভয়মন্ত্র অশোকমন্ত্র তব। দাও আমাদের অমৃতমন্ত্র, দাও গো জীবন নব। যে জীবন ছিল তব তপোবনে যে জীবন ছিল তব রাজাসনে মুক্ত দীপ্ত সে মহাজীবন চিত্ত ভরিয়া লব। মৃত্যুতরণ শঙ্কাহরণ দাও সে মন্ত্র তব।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) হে মোর চিত্ত হে মোর চিত্ত, পুণ্য তীর্থে জাগো রে ধীরে এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে। হেথায় দাঁড়ায়ে দু বাহু বাড়ায়ে নমি নরদেবতারে— উদার ছন্দে, পরমানন্দে বন্দন করি তাঁরে। ধ্যানগম্ভীর এই-যে ভূধর, নদী-জপমালা-ধৃত প্রান্তর, হেথায় নিত্য হেরো পবিত্র ধরিত্রীরে— এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে॥ কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে কত মানুষের ধারা দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে, সমুদ্রে হল হারা। হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন— শক-হুন-দল পাঠান-মোগল এক দেহে হল লীন। পশ্চিমে আজি খুলিয়াছে দ্বার, সেথা হতে সবে আনে উপহার, দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে— এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে॥ এসো হে আর্য, এসো অনার্য, হিন্দু-মুসলমান। এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ, এসো এসো খৃস্টান। এসো ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন ধরো হাত সবাকার। এসো হে পতিত, হোক অপনীত সব অপমানভার। মার অভিষেকে এসো এসো ত্বরা, মঙ্গলঘট হয় নি যে ভরা সবার-পরশে-পবিত্র-করা তীর্থনীরে— আজি ভারতের মহামানবের সাগরতীরে॥ হে মোর দুর্ভাগা দেশ হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর---গীতাঞ্জলিহে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান, অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান!              মানুষের অধিকারে              বঞ্চিত করেছ যারে, সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান, অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান। মানুষের পরশেরে প্রতিদিন ঠেকাইয়া দূরে ঘৃণা করিয়াছ তুমি মানুষের প্রাণের ঠাকুরে।               বিধাতার রুদ্ররোষে               দুর্ভিক্ষের দ্বারে বসে ভাগ করে খেতে হবে সকলের সাথে অন্নপান। অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।   তোমার আসন হতে যেথায় তাদের দিলে ঠেলে সেথায় শক্তিরে তব নির্বাসন দিলে অবহেলে।               চরণে দলিত হয়ে               ধুলায় সে যায় বয়ে সে নিম্নে নেমে এসো, নহিলে নাহি রে পরিত্রাণ। অপমানে হতে হবে আজি তোরে সবার সমান।   যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।               অজ্ঞানের অন্ধকারে               আড়ালে ঢাকিছ যারে তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান। অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।   শতেক শতাব্দী ধরে নামে শিরে অসম্মানভার, মানুষের নারায়ণে তবুও কর না নমস্কার।               তবু নত করি আঁখি               দেখিবারে পাও না কি নেমেছে ধুলার তলে হীন পতিতের ভগবান, অপমানে হতে হবে সেথা তোরে সবার সমান। দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে, অভিশাপ আঁকি দিল তোমার জাতির অহংকারে।               সবারে না যদি ডাক',               এখনো সরিয়া থাক', আপনারে বেঁধে রাখ' চৌদিকে জড়ায়ে অভিমান-- মৃত্যুমাঝে হবে তবে চিতাভস্মে সবার সমান। ২০ আষাঢ়, ১৩১৭ হে মোর সুন্দর হে মোর সুন্দর, যেতে যেতে পথের প্রমোদে মেতে যখন তোমার গায় কারা সবে ধুলা দিয়ে যায়, আমার অন্তর করে হায় হয়। কেঁদে বলি, হে মোর সুন্দর, আজ তুমি হও দণ্ডধর, করহ বিচার। তার পরে দেখি, এ কী, খোলা তব বিচারঘরের দ্বার, নিত্য চলে তোমার বিচার। নীরবে প্রভাত-আলো পড়ে তাদের কলুষরক্ত নয়নের 'পরে; শুভ্র বনমল্লিকার বাস স্পর্শ করে লালসার উদ্দীপ্ত নিশ্বাস; সন্ধ্যাতাপসীর হাতে জ্বালা সপ্তর্ষির পূজাদীপমালা তাদের মত্ততাপানে সারারাত্রি চায়-- হে সুন্দর, তব গায় ধুলা দিয়ে যারা চলে যায়। হে সুন্দর, তোমার বিচারঘর পুষ্পবনে, পুণ্যসমীরণে, তৃণপুঞ্জে পতঙ্গগুঞ্জনে, বসন্তের বিহঙ্গকূজনে, তরঙ্গচুম্বিত তীরে মর্মরিত পল্লববীজনে।   প্রেমিক আমার, তারা যে নির্দয় ঘোর, তাদের যে আবেগ দুর্বার। লুকায়ে ফেরে যে তারা করিতে হরণ তব আভরণ, সাজাবারে আপনার নগ্ন বাসনারে। তাদের আঘাত যবে প্রেমের সর্বাঙ্গে বাজে, সহিতে সে পারি না যে; অশ্রু-আঁখি তোমারে কাঁদিয়া ডাকি-- খড়গ ধরো, প্রেমিক আমার, করো গো বিচার। তার পরে দেখি এ কী, কোথা তব বিচার-আগার। জননীর স্নেহ-অশ্রু ঝরে তাদের উগ্রতা-'পরে; প্রণয়ীর অসীম বিশ্বাস তাদের বিদ্রোহশেল ক্ষতবক্ষে করি লয় গ্রাস। প্রেমিক আমার, তোমার সে বিচার-আগার বিনিদ্র স্নেহের স্তব্ধ নিঃশব্দ বেদনামাঝে, সতীর পবিত্র লাজে, সখার হৃদয়রক্তপাতে, পথ-চাওয়া  প্রণয়ের বিচ্ছেদের রাতে, অশ্রুপ্লুত করুণার পরিপূর্ণ ক্ষমার প্রভাতে।   হে রুদ্র আমার, লুব্ধ তারা, মুগ্ধ তারা, হয়ে পার তব সিংহদ্বার, সংগোপনে বিনা নিমন্ত্রণে সিঁধ কেটে চুরি করে তোমার ভাণ্ডার। চোরা ধন দুর্বহ সে ভার পলে পলে তাহাদের র্মম দলে, সাধ্য নাহি রহে নামাবার। তোমারে কাঁদিয়া তবে কহি বারম্বার-- এদের মার্জনা করো, হে রুদ্র আমার। চেয়ে দেখি মার্জনা যে নামে এসে প্রচণ্ড ঝঞ্ঝার বেশে; সেই ঝড়ে ধুলায় তাহারা পড়ে; চুরির প্রকাণ্ড বোঝা খণ্ড খণ্ড হয়ে সে-বাতাসে কোথা যায় বয়ে। হে রুদ্র আমার, মার্জনা তোমার গর্জমান বজ্রাগ্নিশিখায়, সুর্যাস্তের প্রলয়লিখায়, রক্তের বর্ষণে, অকস্মাৎ সংঘাতের ঘর্ষণে ঘর্ষণে। হে যক্ষ সেদিন প্রেম তোমাদের হে যক্ষ, সেদিন প্রেম তোমাদের বৃদ্ধ ছিল আপনাতেই পদ্মকুঁড়ির মতো। সেদিন সংকীর্ণ সংসারে একান্তে ছিল তোমার প্রেয়সী যুগলের নির্জন উৎসবে, সে ঢাকা ছিল তোমার আপনাকে দিয়ে, শ্রাবণের মেঘমালা যেমন হারিয়ে ফেলে চাঁদকে আপনারি আলিঙ্গনের আচ্ছাদনে। এমন সময়ে প্রভুর শাপ এল বর হয়ে, কাছে থাকার বেড়া-জাল গেল ছিঁড়ে। খুলে গেল প্রেমের আপনাতে-বাঁধা পাপড়িগুলি, সে-প্রেম নিজের পূর্ণ রূপের দেখা পেল বিশ্বের মাঝখানে। বৃষ্টির জলে ভিজে' সন্ধ্যাবেলাকার জুঁই তাকে দিল গন্ধের অঞ্জলি। রেণুর ভারে মন্থর বাতাস তাকে জানিয়ে দিল নীপ-নিকুঞ্জের আকুতি। সেদিন অশ্রুধৌত সৌম্য বিষাদের দীক্ষা পেলে তুমি; নিজের অন্তর-আঙিনায় গড়ে তুললে অপূর্ব মূর্তিখানি স্বর্গীয় গরিমায় কান্তিমতী। যে ছিল নিভৃত ঘরের সঙ্গিনী তার রসরূপটিকে আসন দিলে অনন্তের আনন্দমন্দিরে ছন্দের শঙ্খ বাজিয়ে। আজ তোমার প্রেম পেয়েছে ভাষা, আজ তুমি হয়েছ কবি, ধ্যানোদ্ভবা প্রিয়া বক্ষ ছেড়ে বসেছে তোমার মর্মতলে বিরহের বীণা হাতে। আজ সে তোমার আপন সৃষ্টি বিশ্বের কাছে উৎসর্গ-করা। হে রাজন তুমি আমারে হে রাজন্‌, তুমি আমারে বাঁশি বাজাবার দিয়েছ যে ভার তোমার সিংহদুয়ারে– ভুলি নাই তাহা ভুলি নাই, মাঝে মাঝে তবু ভুলে যাই, চেয়ে চেয়ে দেখি কে আসে কে যায় কোথা হতে যায় কোথা রে।কেহ নাহি চায় থামিতে। শিরে লয়ে বোঝা চলে যায় সোজা, না চাহে দখিনে বামেতে। বকুলের শাখে পাখি গায়, ফুল ফুটে তব আঙিনায়– না দেখিতে পায়,না শুনিতে চায়, কোথা যায় কোন্‌ গ্রামেতে।বাঁশি লই আমি তুলিয়া। তারা ক্ষণতরে পথের উপরে বোঝা ফেলে বসে ভুলিয়া। আছে যাহা চিরপুরাতন তারে পায় যেন হারাধন, বলে, “ফুল এ কী ফুটিয়াছে দেখি। পাখি গায় প্রাণ খুলিয়া।’হে রাজন্‌,তুমি আমারে রেখো চিরদিন বিরামবিহীন তোমার সিংহদুয়ারে। যারা কিছু নাহি কহে যায়, সুখদুখভার বহে যায়, তারা ক্ষণতরে বিস্ময়ভরে দাঁড়াবে পথের মাঝারে তোমার সিংহদুয়ারে।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) হে হিমাদ্রি, দেবতাত্মা, শৈলে শৈলে আজিও তোমার হে হিমাদ্রি, দেবতাত্মা, শৈলে শৈলে আজিও তোমার অভেদাঙ্গ হরগৌরী আপনারে যেন বারম্বার শৃঙ্গে শৃঙ্গে বিস্তারিয়া ধরিছেন বিচিত্র মুরতি। ওই হেরি ধ্যানাসনে নিত্যকাল স্তব্ধ পশুপতি, দুর্গম দুঃসহ মৌন– জটাপুঞ্জতুষারসংঘাত নিঃশব্দে গ্রহণ করে উদয়াস্তরবিরশ্মিপাত পূজাস্বর্ণপদ্মদল। কঠিনপ্রস্তরকলেবর মহান্‌-দরিদ্র, রিক্ত, আভরণহীন দিগম্বর, হেরো তাঁরে অঙ্গে অঙ্গে এ কী লীলা করেছে বেষ্টন– মৌনেরে ঘিরেছে গান, স্তব্ধেরে করেছে আলিঙ্গন সফেন চঞ্চল নৃত্য, রিক্ত কঠিনেরে ওই চুমে কোমল শ্যামলশোভা নিত্যনব পল্লবে কুসুমে ছায়ারৌদ্রে মেঘের খেলায়। গিরিশেরে রয়েছেন ঘিরি পার্বতী মাধুরীচ্ছবি তব শৈলগৃহে হিমগিরি।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ) হেথায় তিনি কোল পেতেছেন হেথায় তিনি কোল পেতেছেন        আমাদের এই ঘরে। আসনটি তাঁর সাজিয়ে দে ভাই,        মনের মতো করে।     গান গেয়ে আনন্দমনে        ঝাঁটিয়ে দে সব ধুলা। যত্ন করে দূর করে দে        আবর্জনাগুলা। জল ছিটিয়ে ফুলগুলি রাখ        সাজিখানি ভরে-- আসনটি তাঁর সাজিয়ে দে ভাই, মনের মতো করে।                                 দিনরজনী আছেন তিনি                                      আমাদের এই ঘরে,                                 সকালবেলায় তাঁরি হাসি                                    আলোক ঢেলে পড়ে।                                যেমনি ভোরে জেগে উঠে                                      নয়ন মেলে চাই,                                খুশি হয়ে আছেন চেয়ে                                      দেখতে মোরা পাই।                                তাঁরি মুখের প্রসন্নতায়                                      সমস্ত ঘর ভরে।                                সকালবেলায় তাঁর হাসি                                                      আলোক ঢেলে পড়ে। একলা তিনি বসে থাকেন        আমাদের এই ঘরে আমরা যখন অন্য কোথাও        চলি কাজের তরে, দ্বারের কাছে তিনি মোদের        এগিয়ে দিয়ে যান-- মনের সুখে ধাই রে পথে,        আনন্দে গাই গান। দিনের শেষে ফিরি যখন        নানা কাজের পরে, দেখি তিনি একলা বসে        আমাদের এই ঘরে।                               তিনি জেগে বসে থাকেন                                    আমাদের এই ঘরে                                আমরা যখন অচেতনে                                    ঘুমাই শয্যা-'পরে।                            জগতে কেউ দেখতে না পায়                                    লুকানো তাঁর বাতি,                              আঁচল দিয়ে আড়াল ক'রে                                    জ্বালান সারা রাতি।                              ঘুমের মধ্যে স্বপন কতই                                     আনাগোনা করে,                               অন্ধকারে হাসেন তিনি                                    আমাদের এই ঘরে। ( পৌষ, ১৩১৬) হেলাভরে ধুলার 'পরে হেলাভরে ধুলার 'পরে ছড়াই কথাগুলো। পায়ের তলে পলে পলে গুঁড়িয়ে সে হয় ধুলো।   (স্ফুলিঙ্গ) হোক ভারতের জয় এসো এসো ভ্রাতৃগণ! সরল অন্তরে         সরল প্রীতির ভরে         সবে মিলি পরস্পরে আলিঙ্গন করি আজ বহুদিন পরে । এসেছে জাতীয় মেলা ভারতভূষণ ,         ভারত সমাজে তবে         হৃদয় খুলিয়া সবে এসো এসো এসো করি প্রিয়সম্ভাষণ । দূর করো আত্মভেদ বিপদ-অঙ্কুর ,         দূর করো মলিনতা         বিলাসিতা অলসতা , হীনতা ক্ষীণতা দোষ করো সবে দূর । ভীরুতা বঙ্গীয়জন-কলঙ্ক-প্রধান —         সে-কলঙ্ক দূর করো ,         সাহসিক তেজ ধরো , স্বকার্যকুশল হও হয়ে একতান । হল না কিছুই করা যা করিতে এলে —         এই দেখো হিন্দুমেলা ,         তবে কেন কর হেলা ? কী হবে কী হবে আর তুচ্ছ খেলা খেলে ? সাগরের স্রোতসম যাইছে সময় ।         তুচ্ছ কাজে কেন রও ,         স্বদেশহিতৈষী হও — স্বদেশের জনগণে দাও রে অভয় । নাহি আর জননীর পূর্বসুতগণ —         হরিশ্চন্দ্র যুধিষ্ঠির         ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ বীর , অনন্তজলধিতলে হয়েছে মগন ।    নাহি সেই রাম আদি সম্রাট প্রাচীন ,         বিক্রম-আদিত্যরাজ ,         কালিদাস কবিরাজ , পরাশর পারাশর পণ্ডিত প্রবীণ । সকলেই জল বায়ু তেজ মৃত্তিকায়         মিশাইয়া নিজদেহ         অনন্ত ব্রহ্মের গেহ পশেছে কীর্তিরে শুধু রাখিয়ে ধরায় । আদরে সে প্রিয় সখী আচ্ছাদি গগনে         সে লোকবিশ্রুত নাম         সে বিশ্ববিজয়ী ধাম নির্ঘোষে ঘুষিছে সদা অখিল ভুবনে । যবনের রাজ্যকালে কীর্তির আধার         চিতোর-নগর নাম         অতুলবীরত্বধাম , কেমন ছিল রে মনে ভাবো একবার । এইরূপ কত শত নগর প্রাচীন         সুকীর্তি-তপন-করে         ভারত উজ্জ্বল ক ' রে অনন্ত কালের গর্ভে হয়েছে বিলীন । নাহি সেই ভারতের একতা-বিভব ,         পাষাণ বাঁধিয়া গলে         সকলের পদতলে লুটাইছে আর্যগণ হইয়া নীরব । গেল , হায় , সব সুখ অভাগী মাতার —         ছিল যত মনোআশা         নিল কাল সর্বনাশা , প্রসন্ন বদন হল বিষণ্ন তাঁহার । কী আর হইবে মাতা খুলিয়া বদন ।         দীপ্তভানু অস্ত গেল ,         এবে কালরাত্রি এল ,   বসনে আবরি মুখ কাঁদো সর্বক্ষণ । বিশাল অপার সিন্ধু , গভীর নিস্বনে         যেখানে যেখানে যাও         কাঁদিতে কাঁদিতে গাও — ডুবিল ভারতরবি অনন্ত জীবনে । সুবিখ্যাত গৌড় যেই বঙ্গের রতন —          তার কীর্তিপ্রতিভায়         খ্যাতাপন্ন এ ধরায় হয়েছিল একদিন বঙ্গবাসিগণ । গেল সে বঙ্গের জ্যোতিঃ কিছুকাল পরে —         কোনো চিহ্ন নাহি তার ,         পরিয়া হীনতাহার , ডুবিয়াছে এবে বঙ্গ কলঙ্কসাগরে । হিন্দুজনভ্রাতৃগণ! করি হে বিনয় —         একতা উৎসাহ ধরো ,         জাতীয় উন্নতি করো , ঘুষুক ভুবনে সবে ভারতের জয় । জগদীশ! তুমি , নাথ , নিত্য-নিরাময়         করো কৃপা বিতরণ ,         অধিবাসিজনগণ , করুক উন্নতি — হোক্‌ ভারতের জয়! কী চেয়েছে? কী পেয়েছে? – গিয়েছে হারায়ে। বয়স বেড়েছে ঢের নরনারীদের, ঈষৎ নিভেছে সূর্য নক্ষত্রের আলো; তবুও সমুদ্র নীল; ঝিনুকের গায়ে আল্পনা; একটি পাখির গান কী রকম ভালো। মানুষ কাউকে চায়- তার সেই নিহত উজ্জ্বল ঈশ্বরের পরিবর্তে অন্য কোনো সাধনার ফল।মনে পড়ে কোন এক তারাভরা রাতের বাতাসে ধর্মাশোকের ছেলে মহেন্দ্রের সাথে উতরোল বড় সাগরের পথে অন্তিম আকাঙ্ক্ষা নিয়ে প্রাণে তবুও কাউকে আমি পারিনি বোঝাতে। সেই ইচ্ছা সঙ্ঘ নয় শক্তি নয় কর্মীদৈর সুধীদের বিবর্ণতা নয়, আরো আলো : মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়। যেন সব অন্ধকার সমুদ্রের ক্লান্ত নাবিকেরা। মক্ষিকার গুঞ্জনের মতো এক বিহ্বল বাতাসে ভূমধ্যসাগরলীন দূর এক সভ্যতার থেকে আজকের নব সভ্যতায় ফিরে আসে;- তুমি সেই অপরূপ সিন্ধু রাত্রি মুতদের রোল দেহ দিয়ে ভালোবেসে, তবু আজ ভোরের কল্লোল। সূর্য কখন সূর্য কখন পশ্চিমে ঢ’লে মশালের মত ভেঙে লাল হয়ে উঠে সমুদ্দুরের ভিতরে নিভছে গিয়ে; সে যে রোজ নেভে সকলেই জানে, তবু আজো ডুবে যায় সময়মতন সকলের অজানিতে। নারী সাপ যখ বণিক ভিখিরী পিশাচ সকলে মিলে ভোরবেলা থেকে মনের সূর্যনগরীর আলো খুঁজে পথের প্রমাণ সূর্যের ত্বকে রক্তে ঘুরছে কী যে। শিশুর মতন বানানের ভুলে মহাজীবনের ভাষা আধো শিখে আধো শেখার প্রয়াসে পরস্পরকে তারা দেখেছে কঠিন সিঁড়িকাটাপথে;- নরকের সিঁড়ি এঁকে বেঁকে ঘুরে বীতবর্ষণ কৃষ্ণ মেঘের মত নীলিমায় দূরে কোথায় মিশেছে। মানবহৃদয় তাকে পেতে চায় প্রেমে আর অনুমানে; ধূলো হাড় ঊর্ণায় ডাঙা বন্দরে চোরা নগরের রক্তনদীর ঢেউয়ে জেনে নিতে চায় কি সে ইতিহাসঠাসা বেদনার থেকে এ সিঁড়ি জেগেছে,- কোথায় গিয়েছে,- এত কঙ্কাল খুলি এত আবছায়া ফেনিল সাগর- জ্ঞান প্রেম প্রাণ একে ঘিরে আছে কেন; নরনারীদের নিরাশাসূচক মুখে কেন তবু আসে ভালো প্রভাতের মতন বিচ্ছুরণ? মুখে ভুল ভাষা পুরুষ নারীর; হৃদয়ের কোলাহলে কি কাম কারণ-কর্দম? তবুও নদীর রক্ত জল। সময় এখন মরুভূমি; সীমাঃ মৃগতৃষ্ণার মত, পান্থ বানাল মানুষ তোমাকে;- তোমার সাধনা গতি প্রাণনার ঢের হাড়গোড় ভেঙে প'ড়ে থাকে, তবু, মানবেতিহাস মানে আরো আলোকিত চেতনার স্বাদ;- মনের সূর্যনগরী জ্ঞানের কাছে প্রেমের নিজের নিবেদন;- তাই মহাঅঘটনে কালো ইতিহাসরাত গ্রহণ মুক্ত সূর্যের মত আলো। সূর্য নক্ষত্র নারী তোমার নিকট থেকে সর্বদাই বিদায়ের কথা ছিলো সব চেয়ে আগে; জানি আমি। সে-দিনও তোমার সাথে মুখ-চেনা হয় নাই। তুমি যে এ-পৃথিবীতে র’য়ে গেছো। আমাকে বলেনি কেউ। কোথাও জল্কে ঘিরে পৃথিবীর অফুরান জল র’য়ে গেছে;– যে যার নিজের কাজে আছে, এই অনুভবে চ’লে শিয়রে নিয়ত স্ফীত সুর্যকে চেনে তারা; আকাশের সপ্রতিভ নক্ষত্রকে চিনে উদীচীর কোনো জল কী ক’রে অপর জল চিনে নেবে অন্য নির্ঝরের? তবুও জীবন ছুঁ’য়ে গেলে তুমি;- আমার চোখের থেকে নিমেষ নিহত সূর্যকে সরায়ে দিয়ে।স’রে যেতো; তবুও আয়ুর দিন ফুরোবার আগে। নব-নব সূর্যকে কে নারীর বদলে ছেড়ে দেয়; কেন দেব? সকল প্রতীতি উৎসবের চেয়ে তবু বড়ো স্থিরতর প্রিয় তুমি;- নিঃসূর্য নির্জন ক’রে দিতে এলে। মিলন ও বিদায়ের প্রয়োজনে আমি যদি মিলিত হতাম তোমার উৎসের সাথে, তবে আমি অন্য সব প্রেমিকের মতো বিরাট পৃথিবী আর সুবিশাল সময়কে সেবা ক’রে আত্মস্থ হতাম। তুমি তা জানো না, তবু, আমি জানি, একবার তোমাকে দেখেছি;- পিছনের পটভূমিকায় সময়ের শেষনাগ ছিলো, নেই;- বিজ্ঞানের ক্লান্ত নক্ষত্রেরা নিভে যায়;- মানুষ অপ্রিজ্ঞাত সে-আমায়; তবুও তাদের একজন গভীর মানুষী কেন নিজেকে চেনায়! আহা, তাকে অন্ধকার অনন্তের মতো আমি জেনে নিয়ে, তবু, অল্পায়ু রঙিন রৌদ্রে মানবের ইতিহাসে কে না জেনে কোথায় চলেছি!দুইচারিদিকে সৃজনের অন্ধকার র’য়ে গেছে, নারী, অবতীর্ণ শরীরের অনুভূতি ছাড়া আরো ভালো কোথাও দ্বিতীয় সূর্য নেই, যা জ্বালালে তোমার শরীর সব অলোকিত ক’রে দিয়ে স্পষ্ট ক’রে দেবে কোনো কালে শরীর যা র’য়ে গেছে। এই সব ঐশী কাল ভেঙে ফেলে দিয়ে নতুন সময় গ’ড়ে নিজেকে না গ’ড়ে তবু তুমি ব্রহ্মান্ডের অন্ধকারে একবার জন্মাবার হেতু অনুভব করেছিলে;- জন্ম-জন্মান্তের মৃত স্মরণের সাঁকো তোমার হৃদয় স্পর্শ করে ব’লে আজ আমাকে ইসারাপাত ক’রে গেলে তারি;- অপার কালের স্রোত না পেলে কী ক’রে তবু, নারী তুচ্ছ, খন্ড, অল্প সময়ের স্বত্ব কাটায়ে অঋণী তোমাকে কাছে পাবে- তোমার নিবিড় নিজ চোখ এসে নিজের বিষয় নিয়ে যাবে? সময়ের কক্ষ থেকে দূর কক্ষে চাবি খুলে ফেলে তুমি অন্য সব মেয়েদের আত্ম অন্তরঙ্গতার দান দেখায়ে অনন্তকাল ভেঙ্গে গেলে পরে, যে-দেশে নক্ষত্র নেই- কোথাও সময় নেই আর- আমারো হৃদয়ে নেই বিভা- দেখাবো নিজের হাতে- অবশেষে কী মকরকেতনে প্রতিভা।তিনতুমি আছো জেনে আমি অন্ধকার ভালো ভেবে যে-অতীত আর যেই শীত ক্লান্তিহীন কাটায়েছিলাম; তাই শুধু কাটায়েছি। কাটায়ে জানেছি এই-ই শূন্যে, তবু হৃদয়ের কাছে ছিল অন্য-কোন নাম। অন্তহীন অপেক্ষার চেয়ে তবে ভালো দ্বীপাতীত লক্ষ্যে অবিরাম চ’লে যাওয়া শোককে স্বীকার ক’রে অবশেষে তবে নিমেষের শরীরের উজ্জলতায়-অনন্তের জ্ঞানপাপ মুছে দিতে হবে। আজ এই ধ্বংসমত্ত অন্ধকার ভেদ ক’রে বিদ্যুতের মতো তুমি যে শরীর নিয়ে র’য়ে গেছো, সেই কথা সময়ের মনে জানাবার আশার কি একজন পুরুষের নির্জন শরীরে একটি পলক শুধু- হৃদয়বিহীন সব অপার আলোকবর্ষ ঘিরে? অধঃপতিত এই অসময়ে কে-বা সেই উপচার পুরুষ মানুষ?- ভাবি আমি;- জানি আমি,তবু সে-কথা আমাকে জানাবার হৃদয় আমার নেই;– যে-কোনো প্রেমিক আজ এখন আমার দেহের প্রতিভূ হয়ে নিজের নারীকে নিয়ে পৃথিবীর পথে একটি মুহূর্তে যদি আমার অনন্ত হয় মহিলার জ্যোতিষ্ক জগতে। সূর্য নিভে গেলে সূর্য, মাছরাঙা, আমি উত্তীর্ণ হয়েছে পাখী মদী সূর্যের অন্ধ আবেগের দু’মুহূর্তে আনন্দের পরীক্ষার বুঝি। নিভে গেছে;- আমি কেন তবু সূর্য খুঁজি।             তুমি জানি না কোথায় তুমি- সূর্য নিভে গেছে; তোমার মননে আজ স্থির সন্ধ্যার কুমোর পোকা- বাঁশের ছ্যাঁদায় ঘূণ- শাদা বেতফলের শিশির।             আছে ‘নেই- নেই-’ মনে হয়েছিল কবে- চারিদিকে উঁচু- উঁচু গাছে, বাতাস? না সময় বলছে; ‘আছে, আছে।’ অনেক অনেক দিনের পর আজ             অঘ্রাণ রাত অন্ধকারে সময়পরিক্রমা করতে গিয়ে আবছা স্মৃতির বইয়ের পাতার থেকে জমা- খরচ সবি মুছে ফেলে দিয়ে দানের আয়োজনে নেমে এল, চেয়ে দেখি নারী কেমন নিখুঁতভাবে কৃতী; ডানা নড়ে শিশির শব্দ করে বাহিরে ঐ অঘ্রাণ রাত থেকে; এসব ঋতু আমার হৃদয়ে কি এক নিমেষনিহত সমাহিতি নিয়ে আসে; ভিতরে আরো প্রবেশ ক’রে প্রাণ একটি বৃক্ষে সময় মরুভূমি লীন দেখেছে, গভীর পাখি বৃক্ষ তুমি। সূর্য রাত্রি নক্ষত্র এইখানে মাইল-মাইল ঘাস ও শালিখ রৌদ্র ছাড়া কিছু নেই। সূর্যালোকিত হ'য়ে শরীর ফসল ভালোবাসি আমারি ফসল সব- মীনকন্যা এসে ফলালেই বৃশ্চিক কর্কট তুলা মেষ সিংহ রাশি বলয়িত হ'য়ে উঠে আমাকে সূর্যের মতো ঘিরে নিরবধি কাল নীলাকাশ হ'য়ে মিশে গেছে আমার শরীরে। এই নদী নীড় নারী কেউ নয়; -মানুষের প্রাণের ভিতরে এ-পৃথিবী তবুও তো সব অধিক গভীরভাবে মানবজীবন ভালো হ'লে অধিক নিবিড়তরভাবে প্রকৃতিকে অনুভব করা যায়। কিছু নয়- অন্তহীন ময়দান অন্ধকার রাত্রি নক্ষত্র- তারপর কেউ তাকে না চাইতে নবীন করুণ রৌদ্রে ভোর;- অভাবে সমাজ নষ্ট না-হ'লে মানুষ এইসবে হ'য়ে যেতো এক তিল অধিক বিভোর। সূর্যকরোজ্জ্বলা আমরা কিছু চেয়েছিলাম প্রিয়; নক্ষত্র মেঘ আশা আলোর ঘরে ঐ পৃথিবীর সূর্যসাগরে দেখেছিলাম ফেনশীর্ষ আলোড়নের পথে মানুষ তাহার ছায়ান্ধকার নিজের জগতে জন্ম নিল- এগিয়ে গেল; - কত আগুন কত তুষার যুগ শেষ করে সে আলোর লক্ষ্যে চলার কোন্‌ শেষ হবে না আর জেনে নিয়ে নির্মল নির্দেশ পেয়ে যাবে গভীর জ্ঞানের, - ভেবেছিলাম, পেয়ে যাবে প্রেমের স্পষ্ট গতি সত্য সূর্যালোকের মতন; - ব’লে গেল মৃত অন্ধকারে জীবিতদের প্রতি।জীবিত, মানে আজ সময়ের পথে বালি শিশির ধুলোর মতো কণা মিলিয়ে তাদের প্রাণের প্রেরণা ক্রমেই চরিতার্থ হতে চায়। চারদিকে নীল অপার্থিবতায় সোনার মতন চিলের ডানায় কোনো খাদ মেশানো নেই, তবু তার প্রাণে কোটি বছর পরে কোনো মানে বার করেছে মন কি প্রকৃতির? মানুষ তবু পাখির চেয়ে ঢের অমৃতলোক হাতের কাছে পেয়ে তবু কি অমৃতের?মানুষ আমি,- মানুষ আমার পাশে হৃদয়ে তার হৃদয় মেশালেও ব্যক্তি আমি ব্যক্তিপুরুষ সে-ও; দ্বীপের মতন একা আমি তুমি; অনন্ত সব পৃথক দ্বীপের একক মরুভূমি: যে যার পরিপূর্ণ অবিশ্বাসে র’য়ে গেছে;- সেখান থেকে ব্যাজস্তূতি কপট প্রণয় ভয় দেখ কেমন উৎসারিত হয়; প্রাণের প্রয়াস রয়েছে তবু, তাই দেখেছি মানুষ অনর্গল অন্ধকারে মরে মানবকে তার প্রতিনিধি রেখে গেছে, - হয়তো একদিন সফলতা পেয়ে যাবে ইতিহাসের ভোরে। সূর্যতামসী কোথাও পাখির শব্দ শুনি; কোনো দিকে সমুদ্রের সুর; কোথাও ভোরের বেলা র’য়ে গেছে – তবে। অগণন মানুষের মৃত্যু হ’লে – অন্ধকারে জীবিত ও মৃতের হৃদয় বিস্মিতের মতো চেয়ে আছে; এ কোন সিন্ধুর সুর: মরণের – জীবনের? এ কি ভোর? অনন্ত রাত্রির মতো মনে হয় তবু। একটি রাত্রির ব্যথা সয়ে - সময় কি অবশেষে এ-রকম ভোরবেলা হয়ে আগামী রাতের কালপুরুষের শস্য বুকে ক’রে জেগে ওঠে? কোথাও ডানার শব্দ শুনি; কোন দিকে সমুদ্রের সুর - দক্ষিণের দিকে, উত্তরের দিকে, পশ্চিমের পানে?সৃজনের ভয়াবহ মানে; তবু জীবনের বসন্তের মতন কল্যাণে সূর্যালোকিত সব সিন্ধু-পাখিদের শব্দ শুনি; ভোরের বদলে তবু সেইখানে রাত্রি করোজ্জ্বল ভিয়েনা, টোকিও, রোম, মিউনিখ – তুমি? সার্থবাহ, সার্থবাহ, ওইদিকে নীল সমুদ্রের পরিবর্তে আটলাণ্টিক চার্টার নিখিল মরুভূমি! বিলীন হয় না মায়ামৃগ – নিত্য দিকদর্শিন; যা জেনেছে – যা শেখেনি - সেই মহাশ্মশানের গর্ভাঙ্কে ধূপের মত জ্ব’লে জাগে না কি হে জীবন – হে সাগর - শকুন্ত-ক্রান্তির কলরোলে। সূর্যপ্রতিম আমরণ কেবলই বিপন্ন হয়ে চলে তারপর যে বিপদ আসে জানি হৃদয়ঙ্গম করার জিনিস; এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। বালুচরে নদীটির জল ঝরে, খেলে যায় সূর্যের ঝিলিক, মাছরাঙা ঝিকমিক্ করে উড়ে যায়, মৃত্যু আর করুণার দুটো তরোয়াল আড়াআড়ি গ’ড়ে ভেঙে নিতে চায় এই সব সাঁকো ঘর বাড়ি; নিজেদের নিশিত আকাশ ঘিরে থাকে।এ রকম হয়েছে অনেক দিন–রৌদ্রে বাতাসে; যারা সব দেখেছিল– যারা ভালোবেসেছিল এই সব–তারা সময়ের সুবিধায় নিলেমে বিকিয়ে গেছে আজ। তারা নেই। এসো আমরা যে যার কাছে–যে যার যুগের কাছে সব সত্য হয়ে প্রতিভাত হয়ে উঠি। নব পৃথিবীকে পেতে সময় চলেছে? হে আবাচী, হে উদীচী, কোথাও পাখির শব্দ শুনি; কোথাও সূর্যের ভোর রয়ে গেছে বলে মনে হয়! মরণকে নয় শুধু– মরণসিন্ধুর দিকে অগ্রসর হয়ে যা-কিছু দেখার আছে আমরাও দেখে গেছি; ভুলে গেছ্‌ স্মরণে রেখেছি। পৃথিবীর বালি রক্ত কালিমার কাছে তারপর আমরা খারিজ হয়ে দোটানার অন্ধকারে তবুও তো চক্ষুস্থির রেখে গণিকাকে দেখায়েছি ফাঁদ; প্রেমিককে শেখায়েছি ফাঁকির কৌশল। শেখাই নি?শতাব্দী আবেশে অস্তে চলে যায়; বিপ্লবী কি স্বর্ণ জমায়। আকন্ঠ মরণে ডুবে চিরদিন প্রেমিক কি উপভোগ করে যায়                            স্নিগ্ধ সার্থবাহদের ঋণ। তবে এই অলক্ষিতে কোন্‌খানে জীবনের আশ্বাস রয়েছে। আমরা অপেক্ষাতুর; চাঁদের উঠার আগে কালো সাগরের মাইলের পরে আরো অন্ধকার ডাইনি মাইলের পড়ি দেওয়া পাখিদের মতো নক্ষত্রের জোছনায় যোগান দিয়ে ভেসে এ অনন্ত প্রতিপদে তবু চাঁদ ভুলে উড়ে যাওয়া চাই উড়ে যেতে চাই।পিছনের ঢেউগুলো প্রতারণা করে ভেসে গেছে; সামনের অভিভূত অন্তহীন সমুদ্রের মতন এসেছে লবণাক্ত পালকের ডানায় কাতর জাপটার মতো ভেঙে বিশ্বাসহন্তার তো কেউ সমুদ্রের অন্ধকার পথে পড়ে আছে মৃত্যু আজীবন অগণন হল, তবু এ রকমই হবে।‘কেবলই ব্যক্তির–ব্যক্তির মৃত্যু শেষ করে দিয়ে আজ আমরাও মরে গেছি সব–‘ দলিলে না ম’রে তব এ রকম মৃত্যু অনুভব ক’রে তারা হৃদয়বিহীন ভাবে ব্যাপ্ত ইতিহাস সাঙ্গ করে দিতে চেয়ে যতদূর মানুষের প্রাণ অতীতে ম্লানায়মান হয়ে গেছে সেই সীমা ঘিরে জেগে ওঠে উনিশশো তেতাল্লিশ, চুয়াল্লিশ, অনন্তের অফুরন্ত রৌদ্রের তিমিরে। সূর্যসাগরতীরে সূর্যের আলো মেটায় খোরাক কার; সেই কথা বুঝা ভার অনাদি যুগের অ্যামিবার থেকে আজিকে ওদের প্রাণ গড়িয়া উঠিল কাফ্রির মতো সূর্যসাগরতীরে কালো চামড়ার রহস্যময় ঠাস বুনোনিটি ঘিরে।চারিদিকে স্থির-ধুম্র নিবিড় পিড়ামিড যদি থাকে- অনাদি যুগের অ্যামিবার থেকে আজিকে মানবপ্রাণ সূর্যতাড়সে ভ্রুণকে যদিও করে ঢের ফলবান- তবুও আমরা জননী বলিবো কাকে? গড়িয়া উঠিলো মানবের দল সূর্যসাগরতীরে কালো আত্মার রহস্যময় ভুলের বুনুনি ঘিরে।গ্রন্থ: মহাপৃথিবী সৃষ্টির তীরে বিকেলের থেকে আলো ক্রমেই নিস্তেজ হ'য়ে নিভে যায়- তবু     ঢের স্মরণীয় কাজ শেষ হ'য়ে গেছেঃ হরিণ খেয়েছে তার আমিষাশী শিকারীর হৃদয়কে ছিঁড়ে; সম্রাটের ইশারায় কঙ্কালের পাশাগুলো একবার সৈনিক হয়েছে;     স্বচ্ছল কঙ্কাল হ'য়ে গেছে তারপর;     বিলোচন গিয়েছিলো বিবাহ-ব্যাপারে;     প্রেমিকেরা সারাদিন কাটায়েছে গণিকার বারে     সভাকবি দিয়ে গেছে বাক্‌বিভূতিকে গালাগাল। সমস্ত আচ্ছন্ন সুর একটি ওংকার তুলে বিস্মৃতির দিকে উড়ে যায়।     এ-বিকেল মানুষ না মাছিদের গুঞ্জরণময়!     যুগে-যুগে মানুষের অধ্যবসায়     অপরের সুযোগের মতো মনে হয়। কুইসলিং বানানো কি নিজ নাম- হিটলার সাত কানাকড়ি     দিয়ে তাহা কিনে নিয়ে হ'য়ে গেল লালঃ     মানুষেরই হাতে তবু মানুষ হতেছে নাজেহাল;     পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকরি।     এ-কেমন পরিবেশে র'য়ে গেছি সবে-     বাক্‌পতি জন্ম নিয়েছিলো যেই কালে, অথবা সামান্য লোক হেঁটে যেতে চেয়েছিলো স্বাভাবিক ভাবে পথ দিয়ে,     কী ক'রে তাহ'লে এ-রকম ফিচেল পাতালে     হৃদয়ের জন- পরিজন নিয়ে হারিয়ে গিয়েছে?     অথবা যে-সব লোক নিজের সুনাম ভালোবেসে     দুয়ার ও পরচুলা না এঁটে জানে না কোনো লীলা, অথবা যে-সব নাম ভালো লেগে গিয়েছিলোঃ আপিলা চাপিলা -রুটি খেতে গিয়ে তারা ব্রেডবাস্কেট খেলো শেষে। এরা সব নিজেদের গণিকা, দালাল, রেস্ত, শত্রুর খোঁজে     সাত-পাঁচ ভেবে সনির্বন্ধতায় নেমে আসে; যদি বলি, তারা সব তোমাদের চেয়ে ভালো আছে;     অসৎপাত্রের কাছে তবে তারা অন্ধ বিশ্বাসে কথা বলেছিলো ব'লে দুই হাত সতর্কে গুটায়ে     হ'য়ে ওঠে কী যে উচাটন!     কুকুরের ক্যানারির কান্নার মতনঃ তাজা ন্যাকড়ার ফালি সহসা ঢুকেছে নালি ঘায়ে। ঘরের ভিতরে কেউ খোয়ারি ভাঙছে ব'লে কপাটের জং     নিরস্ত হয় না তার নিজের ক্ষয়ের ব্যবসায়ে,     আগাগোড়া গৃহকেই চৌচির করেছে বরং;     অরেঞ্জপিকোর ঘ্রাণ নরকের সরায়ের চায়ে ক্রমেই অধিক ফিকে হ'য়ে আসে; নানারূপ জ্যামিতিক টানের ভিতরে     স্বর্গ মর্ত্য পাতালের কুয়াশায় মতন মিলনে     একটি গভীর ছায়া জেগে ওঠে মনে; অথবা তা' ছায়া নয়- জীব নয় সৃষ্টির দেয়ালের 'পরে।     আপাদমস্তক আমি আর দিকে তাকায়ে রয়েছি; গগ্যাঁ ছবির মতো- তবু গগ্যাঁ চেয়ে গুরু হাত থেকে     বেরিয়ে সে নাকচোখে ক্কচিৎ ফুটেছে টায়ে-টায়ে; নিভে যায়- জ্বলে ওঠে, ছায়া, ছাই, দিব্যযোনি মনে হয় তাকে।     স্বাতিতারা শুকতারা সূর্যের ইস্কুল খুলে     সে-মানুষ নরক বা মর্ত্যে বহাল হ'তে গিয়ে বৃষ মেষ বৃশ্চিক সিংহের প্রাতঃকাল ভালোবেসে নিয়ে যায় কন্যা মীন মিথুনের কূলে।কাব্যগ্রন্থ - সাতটি তারার তিমির সে আমাকে সে নিয়েছিলো ডেকে; বলেছিলোঃ 'এ নদীর জল তোমার চোখের মত ম্লান বেতফল; সব ক্লান্তি রক্তের থেকে স্নিগ্ধ রাখছে পটভূমি; এই নদী তুমি।''এর নাম ধানসিঁড়ি বুঝি?' মাছরাঙাদের বললাম; গভীর মেয়েটি এসে দিয়েছিলো নাম। আজো আমি মেয়েটিকে খুঁজি; জলের অপার সিঁড়ি বেয়ে কোথায় যে চলে গেছে মেয়ে।সময়ের অবিরল শাদা আর কালো বনানীর বুক থেকে এসে মাছ আর মন আর মাছরাঙাদের ভালোবেসে ঢের আগে নারী এক - তবু চোখ ঝলসানো আলো ভালোবেসে ষোলো আনা নাগরিক যদি না হয়ে বরং হতো ধানসিঁড়ি নদী। সে কত পুরনো কথা সে কত পুরনো কথা-যেন এই জীবনের ঢের আগে আরেক জীবন তোমারে সিঁড়ির পথে তুলে দিয়ে অন্ধকারে যখন গেলাম চুপে তুমিও ফের নি পিছে-তুমিও ডাকনি আর; আমারও নিবিড় হলো মন যেন এক দেশলাই জ্বলে গেছে-জ্বলিবেই-হালভাঙ্গা জাহাজের স্তুপে আমার এ জীবনের বন্দরে;তারপর শান্তি শুধু বেগুনি সাগর- মেঘের সোনালি চুল- আকাশ উঠেছে ভরে হেলিওট্রোপের মতো রুপেআমার জীবন এই; তোমারও জীবন তাই;এইখানে পৃথিবীর ‘পর এই শান্তি মানুষের;এই শান্তি,যতদিন ভালোবেসে গিয়েছি তোমারে কেন যেন লেগুনের মতো আমি অন্ধকারে কোন্‌ দূর সমুদ্রের ঘরচেয়েছি-চেয়েছি, আহা.. ভালোবেসে না-কেঁদে কে পারে। তবুও সিঁড়ির পথে তুলে দিয়ে অন্ধকারে যখন গেলাম চলে চুপে তুমিও দেখনি ফিরে-তুমিও ডাকনি আর-আমিও খুঁজি নি অন্ধকারে যেন এক দেশলাই জ্বলে গেছে-জ্বলিবেই-হালভাঙ্গা জাহাজের স্তুপে তোমারে সিঁড়ির পথে তুলে দিয়ে অন্ধকারে যখন গেলাম চলে চুপে। সে কামনা নিয়ে যে কামনা নিয়ে মধুমাছি ফেরে বুকে মোর সেই তৃষা! খুঁজে মরি রূপ, ছায়াধূপ জুড়ি, রঙের মাঝারে হেরি রঙডুবি! পরাগের ঠোঁটে পরিমলগুঁড়ি- হারায়ে ফেলি গো দিশা! আমি প্রজাপতি-মিঠা মাঠে মাঠে সোঁদালে সর্ষেক্ষেতে; বোদের সফরে খুঁজি নাকো ঘর, বাঁধি নাকো বাসা-কাঁপি থরথর অতসী ছুঁড়ির ঠোটের উপর শুঁড়ির গেলাসে মেতে! আমি দক্ষিণা-দুলালীর বীণা,পউষপরশহারা! ফুল-আঙিয়ার আমি ঘুমভাঙা পিয়াল চুমিয়া পিলাই গো রাঙা পিয়ালার মধু তুলি রাতজাগা হোরীর হারারা সাড়া! আমি গো লালিমা-গোধূলির সীমা, বাতাসের লাল, ফুল। দুই নিমেষের তরে আমি জ্বালি নীল আকাশের গোলাপী দেয়ালী! আমি খুশরোজী, আমি গো খেয়ালী, চঞ্চল, চুলবুল। বুকে জ্বলে মোর বাসর দেউটি-মধুপরিণয়রাতি! তুলিছে ধরণী বিধবা-নয়ন মনের মাঝারে মদনমোহন মিলননদীর নিধুর কানন রেখেছে রে মোর পাতি!   (ঝরা পালক কাব্যগ্রন্থ) সেই দিন এই মাঠ স্তব্ধ হবে নাকো জানি সেই দিন এই মাঠ স্তব্ধ হবে নাকো জানি— এই নদী নক্ষত্রের তলে সেদিনও দেখিবে স্বপ্ন– সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে! আমি চলে যাব ব’লে চালতাফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে নরম গন্ধের ঢেউয়ে? লক্ষ্মীপেঁচা গান গাবে নাকি তার লক্ষ্মীটির তরে? সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে!          চারিদিকে শান্ত বাতি-ভিজে গন্ধ-মৃদু কলরব;           খেয়া নৌকাগুলো এসে লেগেছে চরের খুব কাছে;           পৃথিবীর এইসব গল্প বেঁচে র’বে চিরকাল;           এশিরিয়া ধুলো আজ-বেবিলন ছাই হয়ে আছে। সেইদিন এই মাঠ সেইদিন এই মাঠ স্তব্ধহবে নাকো জানি---এই নদী নক্ষত্রের তলে সেদিনও দেখিবে স্বপ্ন---সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আ ঝরে ! আমি চলে যাব ব ’লে চালতাফুল কি অর ভিজিবে না শিশিরের জলে নরম গন্ধের ঢেউয়ে? লক্ষ্মীপেঁচা গান গাবে নাকি তার লক্ষ্মীটির তরে?              সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে !           চারি দিকে শান্ত বাতি---ভিজে গন্ধ---মৃদু কলরব;            খেয়ানৌকাগুলো এসে লেগেছে চরের খুব কাছে;                  পৃথিবীর এই গল্প বেঁচে রবে চিরকাল;            এশিরিয়া ধুলো আজ---বেবিলন ছাই হয়ে আছে । সেদিন এ-ধরণীর সেদিন এ ধরণীর সবুজ দ্বীপের ছায়া-উতরোল তরঙ্গের ভিড় মোর চোখে জেগে জেগে ধীরে ধীরে হল অপহত- কুয়াশায় ঝ’রে পড়া আতসের মতো! দিকে দিকে ডুবে গেল কোলাহল,- সহসা উজার জলে ভাটা গেল ভাসি! অতি দুর আকাশের মুখখানা আসি বুকে মোর তুলে গেল যেন হাহাকার সেই দিন মোর অভিসার মৃত্তিকার শূন্য পেয়ালার ব্যথা একাকারে ভেঙে বকের পাখার মতো শাদা লঘু মেঘে ভেসেছিল আতুর, উদাসী! বনের ছায়ার নিচে ভাসে কার ভিজে চোখ কাঁদে কার বারোঁয়ার বাঁশি সেদিন শুনি নি তাহা- ক্ষুধাতুর দুটি আঁখি তুলে অতি দূর তারকার কামনায় তরী মোর দিয়েছিনু খুলে! আমার এ শিরা-উপশিরা চকিতে ছিড়িয়া গেল ধরণীর নাড়ীর বন্ধন- শুনেছিনু কান পেতে জননীর স্থবির ক্রন্দন, মোর তরে পিছুডাক মাটি-মা, তোমার! ডেকেছিল ভিজে ঘাস-হেমন্তের হিম মাস, জোনাকির ঝাড়! আমারে ডাকিয়াছিল আলেয়ার লাল মাঠ-শ্মশানের খেয়াঘাট আসি! কঙ্কালের রাশি, দাউদাউ চিতা,- কত পূর্বজাতকের পিতামহ-পিতা, সর্বনাশ ব্যসন-বাসনা, কত মৃত গোক্ষুরার ফণা, কত তিথি, কত যে অতিথি, কত শত যোনিচক্রস্মৃতি করেছিল উতলা আমারে! আধো আলো-আধেক আঁধারে মোর সাথে মোর পিছে এল তারা ছুটে মাটির বাটের চুমা শিহরি উঠিল মোর ঠোটে-রোমপুটে! ধু ধু মাঠ-ধানক্ষেত-কাশফুল-বুনোহাস-বালুকার চর বকের ছানার মতো যেন মোর বুকের উপর এলোমেলো ডানা মেলে মোর সাথে চলিল নাচিয়া! মাঝপথে থেমে গেল তারা সব, শকুনের মতো শূন্যে পাখা বিথারিয়া দূরে দূরে আরো দূরে-আরো দূরে চলিলাম উড়ে নিঃসহায় মানুষের শিশু একা, অনন্তের শুক্ল অন্তঃপুরে অসীমের আঁচলের তলে! স্ফীত সমুদ্রের মতো আনন্দের আর্ত কোলাহলে উঠিলাম উথলিয়া দুরন্ত সৈকতে, দূর ছায়াপথে! পৃথিবীর প্রেত চোখ বুঝি সহসা উঠিল ভাসি তারক-দর্পণে মোর অপহৃত আননের প্রতিবিম্ব খুঁজি ভ্রূণ-ভ্রষ্ট সন্তানের তরে মাটি-মা ছুটিয়া এল বুকফাটা মিনতির ভরে,- সঙ্গে নিয়ে বোবা শিশু-বৃদ্ধ মৃত পিতা সূতিকা-আলয় আর শ্মশানের চিতা। মোর পাশে দাঁড়াল সে গর্ভিণীর ক্ষোভে, মোর দুটি শিশু আঁখিতারকার লোভে কাঁদিয়ো উঠিল তার পীনস্তন, জননীর প্রাণ। জরায়ূর ডিম্বে তার জন্মিয়াছে সে ঈপ্সিত বাঞ্ছিত সন্তান তার তরে কালে কালে পেতেছে সে শৈবালবিছানা, শালতমালের ছায়া। এনেছে সে নব নব ঋতুরাগ-পউষনিশির মেঘে ফাল্গুনের ফাগুয়ার মায়া! তার তারে বৈতরণীতীরে সে যে ঢালিয়াছে গঙ্গার গাগরী, মৃত্যুর অঙ্গার মথি স্তন তার বারবার ভিজা রসে উঠিয়াছে ভরি। উঠিয়াছে দূর্বাধানে শোভি, মানবের তরে সে যে এনেছে মানবী! মশলা-দরাজ এই মাটিটার ঝাঁঝ যে রে- কেন তবে দু-দণ্ডের অশ্রু-অমানিশা দূর আকাশের তরে বুকে তোর তুলে যায় নেশাখোর মক্ষিকার তৃষা! নয়ন মুদিনু ধীরে- শেষ আলো নিভে গেল পলাতকা নীলিমার পারে, সদ্য প্রসূতির মতো অন্ধকার বসুন্ধরা আবরি আমারে। সোনার খাঁচার বুকে রহিব না আমি সোনার খাঁচার বুকে রহিব না আমি আর শুকের মতন; কি গল্প শুনিতে চাও তোমরা আমার কাছে — কোন্‌ কোন্‌ গান, বলো, তাহলে এ — দেউলের খিলানের গল্প ছেড়ে চলো, উড়ে চলো, — যেখানে গভীর ভোরে নোনাফল পাকিয়াছে, — আছে আতাবন, পউষের ভিজে ভোরে, আজ হায় মন যেন করিছে কেমন; — চন্দ্রমালা, রাজকন্যা, মুখ তুলে চেয়ে দেখ — শুধাই , শুন লো, কি গল্প শুনিতে চাও তোমরা আমার কাছে, — কোন্‌ গান বলো, আমার সোনার খাঁচা খুলে দাও, আমি যে বনের হীরামন;রাজকন্যা শোনে নাকো — আজ ভোরে আরসীতে দেখে নাকো মুখ, কোথায় পাহাড় দূরে শাদা হয়ে আছে যেন কড়ির মতন, — সেই দিকে চেয়ে — চেয়ে দিনভোর ফেটে যায় রূপসীর বুক, তবুও সে বোঝে না কি আমারো যে সাধ আছে — আছে আনমন আমারো যে — চন্দ্রমালা, রাজকন্যা, শোনো — শোনো তোলো তো চিবুক। হাড়পাহাড়ের দিকে চেয়ে চেয়ে হিম গেছে তার স্নান। সোনালি অগ্নির মতো সোনালি অগ্নির মতো আকাশ জ্বলছে স্থির নীল পিলসুজে; পৃথিবীর শেষ রৌদ্র খুঁজে কেউ কি পেয়েছে কিছু কোনো দিকে? পায় নি তো কেউ। তারপর বাদুড়ের কালো কালো ঢেউ উড়ায়ে শঙ্খচিল কোথায় ডুবল চোখ বুজে। অনেক রক্তাক্ত সোনা লুফে নিয়ে চ’লে গেছে নগরীর পানে মানুষেরা রক্তের সন্ধানে। বাদুড়েরা তারপর ছক কেটে আঁধার আকাশে জীবনের অন্য-এক মানে ভালবাসেঃ হয় তো-বা সূর্যের ও-পিঠের মানে। চিন্তার-ইচ্ছার শান্তি চারদিকে নামছে নীরবেঃ যত কাল লাল সূর্য পিছু ফিরে রবে। বাদূড় যেখানে দূর- আরো দূর আকাস কালোয় গিয়ে মেশে সে-গাহনে একদিন মানুষও নিঃশেষে নিভে গেলে বুঝি তার শেষ হিরোশিমা শান্ত হবে। সোনালি সিংহের গল্প আমাদের পরিজন নিজেদের চিনেছিলো না কি? এই সব সংকল্পের পিছে ফিরে হেমন্তের বেলাবেলি দিন নির্দোষ আমোদ সাঙ্গ ক'রে ফেলে চায়ের ভিতরে; চায়ের অসংখ্য ক্যান্টিন। আমাদের উত্তমর্ণদের কাছে প্রতিজ্ঞার শর্ত চেয়ে তবু তাহাদের খুঁজে পাই ছিমছাম,- কনুয়ের ভরে ব'সে আছে প্রদেশের দূর বিসারিত সব ক্ষমতার লোভে।     কোথায় প্রেমিক তুমি; দীপ্তির ভিতরে! কোথাও সময় নেই আমাদের ঘড়ির আঁধারে। আমাদের স্পর্শাতুর কন্যাদের মন বিশৃঙ্খল শতাব্দীর সর্বনাশ হ'য়ে গেছে জেনে সপ্রতিভ রূপসীর মতো বিচক্ষণ, যে-কোনো রাজার কাজে উৎসাহিত নাগরের তরে; যে-কোনো ত্বরান্বিত উৎসাহের তরে; পৃথিবীর বারগৃহ ধ'রে তারা উঠে যেতে চায়। নীরবতা আমাদের ঘরে। আমাদের ক্ষেতে-ভূঁয়ে অবিরাম হতমান সোনা ফ'লে আছে ব'লে মনে হয়; আমাদের হৃদয়ের সাথে সে-সব ধানের আন্তরিক পরিচয় নেই; তবু এই সব ফসলের দেশে সূর্য নিরন্তর হিরণ্ময়; আমাদের শস্য তবু অবিকল পরের জিনিস মিড্‌ল্‌ম্যানদের কাছে পর নয়। তাহারা চেনায়ে দেয় আমাদের ঘিঞ্জি ভাঁড়ার, আমাদের জরাজীর্ণ ডাক্তারের মুখ, আমাদের উকিলের অনুপ্রাণনাকে, আমাদের পড়পরতার সব পড়তি কৌতুক তাহারা বেহাত ক'রে ফেলে সব। রাজপথে থেকে-থেকে মূঢ় নিঃশব্দতা বেড়ে ওঠে; অকারণে এর-ওর মৃত্যু হ'য়ে গেলে- অনুভব ক'রে তবু বলবার মতো কোনো কথা নেই। বিকেলে গা ঘেঁষে সব নিরুত্তেজ সরজমিনে ব'সে বেহেড আত্মার মতো সূর্যাস্তের পানে চেয়ে থেকে নিভে যায় এক পৃথিবীর প্রক্ষিপ্ত রাত্রির লোকসানে। তবুও ভোরের বেলা বার-বার ইতিহাসে সঞ্চারিত হ'য়ে দেখেছে সময়, মৃত্যু, নরকের থেকে পাপীতাপীদের গালাগালি সরায়ে মহান সিংহ আসে যায় অনুভাবনায় স্নিগ্ধ হ'য়ে,- যদি না সূর্যাস্তের ফের হয়ে যায় সোনালি হেঁয়ালি।  সোনালী ডানার শঙ্খচিল মনে পড়ে সেই কলকাতা–সেই তেরোশো তিরিশ– বস্তির মতো ঘর, বৌবাজারের মোড়ে দিনমান ট্রাম করে ঘরঘর। আমাদের কিছু ছিল না তখন ছিল শুধু যৌবন, সাগরের মতো বেগুনি আকাশে সোনালি চিলের মন।ছেঁড়া শাড়ি পরে কাটাইতে দিন বাঁটনা হলুদ মাখা বিভারানী বোস, তোমার দু হাতে ছিল দুটো শাদা শাঁখা, শাদা শাঁখা শুধু তোমার দু হাতে জুটিত না তেল চুলে, তবুও আমরা দিতাম আকাশে বকের পাখনা তুলে।জুটিত না কালি কলমে আমার কাগজে পড়িত টান, তোমার বইয়ের মার্জিনে, বিভা, লিখিতাম আমি গান। পাশের বাড়ির পোড়া কাঠ এনে দেয়ালে আঁকিতে ছবি। আমি বলিতাম–’অবন্তী-বিভা’, তুমি শুধাইতে ‘ঈগল কবি’চক্ষে তোমার মিঙ্ যুগ ভাসে কাঙড়ার ছবি ঐ নীল চোখে আমার হৃদয়ে অনুরাধাপুর পুরানো ফরাসি গানের বোকে সেদিন আমার পথে পথে হাঁটা সেও তম্বুরা মান্ডলিন তোমার সেদিন ঘর সিঁড়ি ভাঙা বাংলার পট, পুরোনো চীন।পৃথিবীর মুখে তুড়ি দিয়ে দিয়ে দুইটি হৃদয় সেই ডাল তেল নুন জোটে না যাদের জামা-শাড়ি কিছু নেই, তবুও আকাশ জয়ের বাসনা দু:খের গুলি সে যেন ঢিল, আমরা দুজনে বেগুনি আকাশে সোনালি ডানার শঙ্খচিল—শরীরের ক্ষুধা মাটির মতন স্বপ্ন তখন সোনার সিঁড়ি, মানুষ থাকুক সংসারে পড়ে আমরা উড়িব পৃথিবী ছিঁড়ি।সকাল হয়েছে: চাল নাই ঘরে, সন্ধা হয়েছে: প্রদীপ নাই, আমার কবিতা কেউ কেনে নাকো? তোমার ছবিও ঘুঁটের ছাই?ছ মাসের ভাড়া পড়ে আছে না কি? ঘরে নাই তবু চাল কড়ি নুন? আকাশের নীল পথে পথে তবু আমার হৃদয় আত্তিলা হূণ আকাশের নীল পথ থেকে পথে জানালার পর জানালা খুলে ভোরের মুনিয়াপাখির মতন কোথায় যে দিতে পাখনা তুলে।সংসার আজ শিকার করেছে সোনালি চিলেরা হল শিকার, আজ আমি আর কবিতা লিখি না তুমিও তো ছবি আঁকো না আর। তবুও শীতের শেষে ফাল্গুনে মাতাল যখন সোনালি বন তেরোশো তিরিশ—দারিদ্র্য সেই ফিরে চাই আজ সে যৌবন।ফিরে চাই আমি তোমারে আবার আমার কবিতা, তোমার ছবি— শুধাতাম আমি ‘অনুরাধাপুর’— শুধাইতে তুমি ‘শকুন কবি’। সেই-যে আকাশ খোঁজার স্বপ্ন দুখের ছররা—সে যেন ঢিল, আমরা দুজনে বেগুনি আকাশে সোনালি ডানার শঙ্খচিল। সৌরকরোজ্জ্বল পরের ক্ষেতের ধানে মই দিয়ে উঁচু করে নক্ষত্রে লাগানো     সুকঠিন নয় আজ; যে-কোনো পথের বাঁকে ভাঙনের নদীওর শিয়রে     তাদের সমাজ। তবুও তাদের ধারা- ধর্ম অর্থ কাম কলরব কুশীলব-     কিংবা এ-সব থেকে আসন্ন বিপ্লব ঘনারে- ফসল ফলায়ে- তবু যুগে-যুগে উড়ায়ে গিয়েছে পঙ্গপাল।     কাল তবু- হয়তো আগামী কাল। তবুও নক্ষত্র নদী সূর্য নারী সোনার ফসল মিথ্যা নয়। মানুষের কাছ থেকে মানবের হৃদয়ের বিবর্ণতা ভয় শেষ হবে; চতুর্থ- আরো সব আন্তর্জাতিক গ'ড়ে ভেঙে গ'ড়ে দীপ্তিমান কৃষিজাত জাতক মানব। স্থবির যৌবন তারপর একদিন উজ্জ্বল মৃত্যৃর দূত এসে কহিবেঃতোমারে চাই- তোমারেই,নারী; এইসব সোনা রূপা মসলিন যুবাদের ছাড়ি চ’লে যেতে হবে দূর আবিষ্কারে ভেসে।বলিলাম;শুনিল সেঃ’তুমি তবু মৃত্যুর দূত নও-তুমি-‘ ‘নগর-বন্দর ঢের খুঁজিয়াছি আমি; তারপর তোমার এই জানালায় থামি ধোঁয়া সব;-তুমি যেন মরীচিকা-আমি মরুভূমি-‘শীতের বাতাস নাকে চলে গেলো জানালার দিকে পড়িল আধেক শাল বুক থেকে খসে সুন্দর জন্তুর মতো তার দেহকোষে রক্ত শুধু দেহ শুধু শুধু হরিণীকেবাঘের বিক্ষোভ বুকে নিয়ে নদীর কিনারে-নিম্নে-রাতে? তবে তুমি ফিরে যাও ধোঁয়ায় আবার; উজ্জ্বল মৃত্যুর দূত বিবর্ণ এবার- বরং নারীকে ছেড়ে কঙ্কালের হাতে তোমারে তুলিয়া লবে কুয়াশা-ঘোড়ায়। তুমি এই পৃথিবীর অনাদি স্থবির;- সোনালি মাছের মতো তবু করে ভিড় নীল শৈবালের নিচে জলের মায়ায়প্রেম-স্বপ্ন-পৃথিবীর স্বপ্ন প্রেম তোমার হৃদয়ে। হে স্থবির, কী চাও বলো তো- শাদা ডানা কোনো এক সারসের মতো? হয়তো সে মাংস নয়-এই নারী; তবু মৃত্যু পড়ে নাই আজ তার মোহে।তাহার ধূসর ঘোড়া চরিতেছে নদীর কিনারে কোনো এক বিকেলের জাফরান দেশে। কোকিল কুকুর জ্যেৎস্না ধুলো হয়ে গেছে কত ভেসে? মরণের হাত ধরে স্বপ্ন ছাড়া কে বাঁচিতে পারে? স্থান থেকে স্থান থেকে স্থানচ্যুত হ'য়ে চিহ্ন ছেড়ে অন্য চিহ্নে গিয়ে ঘড়ির কাঁটার থেকে সময়ের স্নায়ুর স্পন্দন খসিয়ে বিমুক্ত ক'রে তাকে দেখা যায় অবিরল শাদা-কালো সময়ের ফাঁকে সৈকত কেবলই দূর সৈকতে ফুরায় ; পটভূমি বার-বার পটভূমিচ্ছেদ ক'রে ফেলে আঁধারকে আলোর বিলয় আলোককে আঁধারের ক্ষয় শেখায় শুক্ল সূর্যে ; গ্লানি রক্তসাগরের জয় দেখায় কৃষ্ণ সূর্যে ; ক্রমেই গভীর কৃষ্ণ হয়। স্বপ্ন পাণ্ডুলিপি কাছে রেখে ধূসর দীপের কাছে আমি নিস্তব্ধ ছিলাম ব’সে; শিশির পড়িতেছিল ধীরে-ধীরে খ’সে; নিমের শাখার থেকে একাকীতম কে পাখি নামিউড়ে গেলো কুয়াশায়,- কুয়াশার থেকে দূর-কুয়াশায় আরো। তাহারি পাখার হাওয়া প্রদীপ নিভায়ে গেলো বুঝি? অন্ধকার হাতড়ায়ে ধীরে-ধীরে দেশলাই খুঁজি; যখন জ্বলিবে আলো কার মুখ দেখা যাবে বলতে কি পারো?কার মুখ?- আমলকী শাখার পিছনে শিঙের মতন বাঁকা নীল চাঁদ একদিন দেখেছিলো, আহা, সে-মুখ ধূসরতম আজ এই পৃথিবীর মনে।তবু এই পৃথিবীর সব আলো একদিন নিভে গেলে পরে, পৃথিবীর সব গল্প একদিন ফুরাবে যখন, মানুষ র’বে না আর, র’বে শুধু মানুষের স্বপ্ন তখনঃ সেই মুখ আর আমি র’বো সেই স্বপ্নের ভিতরে। স্বপ্নের ধ্বনিরা ন্বপ্নের ধ্বনিরা এসে বলে যায় : স্থবিরতা সব চেয়ে ভালো; নিস্তব্ধ শীতের রাতে দীপ জ্বেলে অথবা ণিভায়ে দীপ বিছানায় শুয়ে স্থবিরের চোখে যেন জমে ওঠে অন্য কোনো বিকেলের আলো। সেই আলো চিরদিন হয়ে থাকে স্থির, সব ছেড়ে একদিন আমিও স্থবির হয়ে যাব; সেদিন শীতের রাতে সোনালি জরির কাজ ফেলে প্রদীপ নিভায়ে রব বিছানায় শুয়ে; অন্ধকারে ঠেস দিয়ে জেগে রব বাদুড়ের আঁকাবাঁকা আকাশের মতো স্থবিরতা, কবে তুমি আসিবে বল তো। স্বপ্নের হাত পৃথিবীর বাধা — এই দেহের ব্যাঘাতে হৃদয়ে বেদনা জমে — স্বপনের হাতে আমি তাই আমারে তুলিয়া দিতে চাই। যেই সব ছায়া এসে পড়ে দিনের রাতের ঢেউয়ে — তাহাদের তরে জেগে আছে আমার জীবন; সব ছেড়ে আমাদের মন ধরা দিত যদি এই স্বপনের হাতে! পৃথিবীর রাত আর দিনের আঘাতে বেদনা পেত না তবে কেউ আর — থাকিত না হৃদয়ের জরা — সবাই স্বপ্নের হাতে দিত যদি ধরা!… আকাশ ছায়ার ঢেউয়ে ঢেকে সারাদিন — সারা রাত্রি অপেক্ষায় থেকে পৃথিবীর যত ব্যথা — বিরোধ, বাস্তব হৃদয় ভুলিয়া যায় সব চাহিয়াছে অন্তর যে ভাষা, যেই ইচ্ছা, যেই ভালোবাসা, খুঁজিয়াছে পৃথিবীর পারে পারে গিয়া — স্বপ্নে তাহা সত্য হয়ে উঠেছে ফলিয়া! মরমের যত তৃষ্ণা আছে — তারই খোঁজে ছায়া আর স্বপনের কাছে তোমরা চলিয়া আস — তোমরা চলিয়া আস সব! ভুলে যাও পৃথিবীর ঐ ব্যথা — ব্যাঘাত — বাস্তব! সকল সময় স্বপ্ন — শুধু স্বপ্ন জন্ম লয় যাদের অন্তরে– পরস্পরে যারা হাত ধরে নিরালা ঢেউয়ের পাশে পাশে গোধূলির অস্পষ্ট আকাশে যাহাদের আকাঙক্ষার জন্ম মৃত্যু — সব পৃথিবীর দিন আর রাত্রির রব শোনে না তাহারা! সন্ধ্যার নদীর জল, পাথরে জলের ধারা আয়নার মতো জাগিয়া উঠিছে ইতস্তত তাহাদের তরে। তাদের অন্তরে স্বপ্ন, শুধু স্বপ্ন জন্ম লয় সকল সময়!… পৃথিবীর দেয়ালের পরে আঁকাবাঁকা অসংখ্য অক্ষরে একবার লিখিয়াছি অন্তরের কথা — সে সব ব্যর্থতা আলো আর অন্ধকারে গিয়াছে মুছিয়া! দিনের উজ্জ্বল পথ ছেড়ে দিয়ে ধূসর স্বপ্নের দেশে গিয়া হৃদয়ের আকাঙক্ষার নদী ঢেউ তুলে তৃপ্তি পায় — ঢেউ তুলে তুপ্তি পায় যদি — তবে ঐ পৃথিবীর দেয়ালের পরে লিখিতে যেয়ো না তুমি অস্পষ্ট অক্ষরে অন্তরের কথা! — আলো আর অন্ধকারে মুছে যায় সে সব ব্যর্থতা! পৃথিবীর অই অধীরতা থেমে যায়, আমাদের হৃদয়ের ব্যথা দূরের ধুলোর পথ ছেড়ে স্বপ্নেরে — ধ্যানেরে কাছে ডেকে লয় উজ্জ্বল আলোর দিন নিভে যায় মানুষেরও আয়ূ শেষ হয় পৃথিবীর পুরানো সে পথ মুছে ফেলে রেখা তার — কিন্তু এই স্বপ্নের জগৎ চিরদিন রয়! সময়ের হাত এসে মুছে ফেলে আর সব — নক্ষত্রেরও আয়ু শেষ হয়! স্বভাব যদিও আমার চোখে ঢের নদী ছিলো একদিন পুনরায় আমাদের দেশে ভোর হ’লে, তবুও একটি নদী দেখা যেতো শুধু তারপর; কেবল একটি নারী কুয়াশা ফুরোলে নদীর রেখার পার লক্ষ্য ক’রে চলে; সূর্যের সমস্ত গোল সোনার ভিতরে মানুষের শরীরের স্থিরতর মর্যাদার মতো তার সেই মূর্তি এসে পড়ে। সূর্যের সম্পূর্ণ বড় বিভোর পরিধি যেন তার নিজের জিনিস। এতদিন পরে সেইসব ফিরে পেতে সময়ের কাছে যদি করি সুপারিশ তা’হলে সে স্মৃতি দেবে সহিষ্ণু আলোয় দু-একটি হেমন্তের রাত্রির প্রথম প্রহরে; যদিও লক্ষ লোক পৃথিবীতে আজ আচ্ছন্ন মাছির মত মরে - তবুও একটি নারী ‘ভোরের নদীর জলের ভিতরে জল চিরদিন সূর্যের আলোয় গড়াবে’ এ রকম দু-চারটে ভয়াবহ স্বাভাবিক কথা ভেবে শেষ হ’য়ে গেছে একদিন সাধারণভাবে। স্বাতীতারা স্বাতীতারা, কবে তোমায় দেখেছিলাম কলকাতাতে আমি দশ-পনেরো বছর আগে; সময় তখন তোমার চুলে কালো মেঘের মতন লুকিয়ে থেকে বিদ্যুৎ জ্বালাল তোমার নিশিত নারীমুখের-জানো তো অন্তর্যামী। তোমার মুখ; চারিদিকে অন্ধকারে জলের কোলাহল। কোথাও কোনো বেলাভূমির নিয়ন্তা নেই-গভীর বাতাসে তবুও সব রণক্লান্ত অবসন্ন নাবিক ফিরে আসে। তারা যুবা, তারা মৃত; মৃত্যু অনেক পরিশ্রমের ফল। সময় কোথাও নিবারিত হয় না, তবু, তোমার মুখের পথে আজও তাকে থামিয়ে একা দাঁড়িয়ে আছ- নারি হয়তো ভোরে আমরা সবাই মানুষ ছিলাম, তারই নিদর্শনের সূর্যবলয় আজকের এই অন্ধ জগতে। চারিদিকে অলীক সাগর জ্যাসন ওডিসিয়ূস ফিনিশিয় সার্থবাহের অধীর আলো- ধর্মাশোকের নিজের তো নয়, আপতিত কাল আমরা আজও বহন করে, সকল কঠিন সমুদ্রে প্রবাল লুটে তোমার চোখের বিষাদ ভৎসর্না…. প্রেম নিভিয়ে দিলাম প্রিয়। স্মৃতি থমথমে রাত, আমার পাশে বসল অতিথি- বললে, আমি অতীত ক্ষুধা-তোমার অতীত স্মৃতি! -যে দিনগুলো সাঙ্গ হল ঝড়বাদলের জলে, শুষে গেল মেরুর হিমে, মরুর অনলে, ছায়ার মতো মিশেছিলাম আমি তাদের সনে; তারা কোথায়?-বন্দি স্মৃতিই কাঁদছে তোমার মনে! কাঁদছে তোমার মনের খাকে, চাপা ছাইয়ের তলে, কাঁদছে তোমার স্যাঁত্সেঁতে শ্বাস-ভিজা চোখের জলে, কাঁদছে তোমার মূক মমতার রিক্ত পাথার ব্যেপে, তোমার বুকের খাড়ার কোপে, খুনের বিষে ক্ষেপে! আজকে রাতে কোন্ সে সুদূর ডাক দিয়েছে তারে,- থাকবে না সে ত্রিশূলমূলে, শিবের দেউলদ্বারে! মুক্তি আমি দিলেম তারে-উল্লাসেতে দুলে স্মৃতি আমার পালিয়ে গেল বুকের কপাট খুলে নবালোকে-নবীন উষার নহবতের মাঝে। ঘুমিয়েছিলাম, দোরে আমার কার করাঘাত বাজে! -আবার আমায় ডাকলে কেন স্বপনঘোরের থেকে! অই লোকালোক-শৈলচূড়ায় চরণখানা রেখে রয়েছিলাম মেঘের রাঙা মুখের পানে চেয়ে, কোথার থেকে এলে তুমি হিম সরণি বেয়ে! ঝিম্‌ঝিমে চোখ, জটা তোমার ভাসছে হাওয়ার ঝড়ে, শ্মশানশিঙা বাজল তোমার প্রেতের গলার স্বরে! আমার চোখের তারার সনে তোমার আঁখির তারা মিলে গেল, তোমার মাঝে আবার হলেম হারা! -হারিয়ে গেলাম ত্রিশূলমূলে, শিবের দেউলদ্বারে; কাঁদছে স্মৃতি-কে দেবে গো-মুক্তি দেবে তারে! হঠাৎ তোমার সাথে হঠাৎ তোমার সাথে কলকাতাতে সে এক সন্ধ্যায় উনিশশো চুয়াল্লিশে দেখা হ’ল- কত লোক যায় তড়াম বাস ট্যাক্সি মোটর জিপ হেঁকে যাদের হৃদয়ে বেশি কথা হাতে কাজ কম- তাদের অনেকে পায়ে হেঁটে চলে যায়।কেবলি ক্লান্তিতে ধুঁকে আমাদের মুখে ঠোঁটে তবু যেই হাসি ফুটে উঠে স্বপ্নকে খণ্ডন ক’রে বিষয়প্রত্যাশী অমূল্য সংসারী সে-ই-বাজারে বন্দরে ঘোরে, মাপজোক করে হিসেবের খতিয়ানে লাভ হলে রক্তের ভিতরে তৃপ্তি পায়-লোকসান হয়ে গেলে অন্ধকারে নিগৃহীত মনে অনুভব করে কোনো মনিবের সংকীর্ণ বেতনে ভৃত্যের শরীর তার- ভৃত্যের শরীরে তার মন নারী আর নক্ষত্রের তবু মহাজন?তুমি এলে সময়ের ঢের আয়ূ শেষ ক’রে তবে এখনো প্রদীপ জ্বলে এরকম স্থির অনুভবে তোমার শরীর আজো সুশ্রী নম্র-তবুও হ্রদয় সেই স্নিগ্ধ শরীরের সতীনের মতো কাঁটা নয়? দুরু দুরু হৃদয়ের বিস্ময়ে ব্যথায় একথা যদি ভাবি তবু সে ব্যথার চেয়ে আরেক শক্তির বেশি দাবি সেই স্বাদ তুমি- আমাদের চোখে এসেছিলে ব’লে পৃথিবীকে ভালো ক’রে পাই আমি-এ পৃথিবী অন্তর্হিত হ’লে।সত্যই সূর্যের আলো- তবুও সূর্যের চেয়ে সুখী তোমার গভীরভাবে ভালো শরীরের মুখোমুখি আমার শরীর-মন- ঈশ্বরেরা অনুরোধে কখনো সময় গতি কি থামায় তার-লীন হলে অনুসৃত হয়? তুমি তাকে থামায়েছ-সৃষ্টির অন্তিম হিতাহিত ভুলে আজ কলকাতার শীতরাতে কবের অতীত বহমান সময়কে অন্ধকার চোখঠার দিয়ে নারীর শরীর নিয়ে রয়েছ দাঁড়িয়ে। তোমার উরুর চাপে সময় পায়ের নিচে প’ড়ে থেমে আছে ব’লে মৃত তারিখকে আবিষ্কার করে ভালোবাসা বেঁচে উঠে, আহা, এক মুহুর্তের শেষে তবুও কি ম’রে যাবে পুনরায় সময়ের গতি ভালোবেসে? অতীত তো সুজাতার শিশু; নারি, মনীষীহৃদয় সে শিশুকে বাঁচাবার জন্য ব্যস্ত নয়।হে সময় একদিন তোমার গহীন ব্যবহারে যা হয়েছে মুছে গেছে, পুনরায় তাকে ফিরিয়ে দেবার কোনো দাবি নিয়ে যদি নারীর পায়ের চিহ্নে চ’লে গিয়ে তোমার সে অন্তিম অবধি তোমাকে বিরক্ত করে কেউ সব মৃত ক্লান্ত ব্যস্ত নক্ষত্রের চেয়েও অধিক অধীরতা ক্ষমতায় ব্রক্ষ্মাণ্ড শিল্পের শেষ দিক এই মহিলার মত নারীচোখে যদি কেউ খুঁজে ফেরে-তবে সেই অর্থ আমাদের এই মুহুর্তের মতো হবে। হরিণেরা স্বপ্নের ভিতরে বুঝি–ফাল্গুনের জোছনার ভিতরে। দেখিলাম পলাশের বনে খেলা করে হরিণেরা; রূপালি চাঁদের হাত শিশিরে পাতায়; বাতাস ঝরিছে ডানা — মুক্তা ঝ’রে যায় পল্লবের ফাঁকে ফাঁকে-বনে বনে-হরিণের চোখে; হরিণেরা খেলা করে হাওয়া আর মুক্তার আলোকে। হীরের প্রদীপ জ্বেলে শেফালিকা বোস যেন হাসে হিজল ডালের পিছে অগণন বনের আকাশে– বিলুপ্ত ধূসর কোন পৃথিবীর শেফালিকা আহা; ফাল্গুনের জোছনায় হরিণেরা জানে শুধু তাহা। বাতাস ঝাড়িছে ডানা, হীরা ঝরে হরিণের চোখে– হরিণেরা খেলা করে হাওয়া আর হীরার আলোকে। হাঁস নয়টি হাঁসকে রোজ চোখ মেলে ভোরে দেখা যায় জলপাই পল্লবের মতো স্নিগ্ধ জলে; তিনবার তিনগুনে নয় হয় পৃথিবীর পথে; এরা তবু নয়জন মায়াবীর মতো জাদুবলে!সে-নদীর জল খুব গভীর-গভীর; সেইখানে শাদা মেঘ- লঘু মেঘ এসে দিনমানে কারো নীচে ডুবে গিয়ে তবু যেতে পারেনাকো কোনো সময়ের শেষে।চারিদিকে উঁচু-উঁচু উলুবন, ঘাসের বিছানা; অনেক সময় ধ'রে চুপ থেকে হেমন্তের জল প্রতিপন্ন হ'য়ে গেছে যে-সময়ে নীলাকাশ ব'লে সুদূরে নারীর কোলে তখন হাঁসের দলবলমিশে গেছে অপরাহ্নে রোদের ঝিলিকে; অথবা ঝাঁপির থেকে অমেয় খইয়ের রঙ ঝরে; সহসা নদীর মতো প্রতিভাত হয়ে যায় সব; নয়টি অমল হাঁস নদীতে রয়েছে মনে পড়ে। হাওয়ার রাত গভীর হাওয়ার রাত ছিল কাল- অসংখ্য নক্ষত্রের রাত; সারারাত বিস্তীর্ণ হাওয়া আমার মশারিতে খেলেছে; মশারিটা ফুলে উঠেছে কখনো মৌসুমী সমুদ্রের পেটের মতো, কখনো বিছানা ছিঁড়ে নক্ষত্রের দিকে উড়ে যেতে চেয়েছে, এক-একবার মনে হচ্ছিল আমার- আধো ঘুমের ভিতর হয়তো- মাথার উপরে মশারি নেই আমার স্বাতী তারার কোল ঘেঁসে নীল হাওয়ার সমুদ্রে শাদা বকের মতো উড়ছে সে! কাল এমন চমৎকার রাত ছিল। সমস্ত মৃত নক্ষত্রেরা কাল জেগে উঠেছিল-আকাশে একতিল ফাঁক ছিল না; পৃথিবীর সমস্ত ধূসরপ্রিয় মৃতদের মুখও সেই নক্ষত্রের ভিতর দেখেছি আমি; অন্ধকার রাতে অশ্বত্থের চুড়ায় প্রেমিক চিলপুরুষের শিশির – ভেজা চোখের মতো ঝলমল করছিল সমস্ত নক্ষত্রেরা; জোছনারাতে বেবিলনের রানির ঘাড়ের ওপর চিতার উজ্জ্বল চামড়ার শালের মতো জ্বলজ্বল করছিল বিশাল আকাশ! কাল এমন আশ্চর্য রাত ছিল।নে নক্ষত্রেরা আকাশের্ বুকে হাজার-হাজার বছর আগে ম’রে গিয়েছে তারাও কাল জানালার থিবর দিয়ে অসংখ্য মৃত আকাশ সঙ্গে করে এনেছে যে রুপসীদের আমি এশিরিয়ায়, মিশরে বিদিশায় ম’রে যেতে দেখেছি কাল তারা অতিদূরে আকাশের সীমানায় কুয়াশায় কুয়াশায় দীর্ঘ বর্শা হাতে করে কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে গেছে যেন- মৃত্যুকে দলিত করবার জন্য? জীবনের গভীর জয় প্রকাশ করবার জন্য? প্রেমের ভয়াবহ গম্ভীর স্তম্ভ তুলবার জন্য? আড়ষ্ট- অভিভূত হয়ে গেছি আমি, কাল রাতের প্রবল নীল অত্যাচার আমাকে ছিঁড়ে ফেলেছে যেন; আকাশের বিরামহীন বিস্তৃর্ণ ডানার ভিতর পৃথিবী কিটের মতো মুছে গিয়েছে কাল! আর উত্তুঙ্গ বাতাস এসেছে আকাশের বুক থেকে নেমে আমার জানালার ভিতর দিয়ে, শাঁই শাঁই করে, সিংহের হুঙ্কারে উৎক্ষিপ্ত হরিৎ প্রান্তরের অজস্র জেব্রার মতো! হৃদয় ভরে গিয়েছে আমার বিস্তীর্ণ ফেল্টের সবুজ ঘাসের গন্ধে, দিগন্ত-প্লাবিত বলীয়ান রৌদ্রের আঘ্রাণে মিলনোন্মত্ত বাঘিনীর গর্জনের মতো অন্ধকারের চঞ্চল বিরাট সজীব রোমশ উচ্ছ্বাসে, জীবনের দুর্দান্ত নীল মত্ততায়!আমার হৃদয় পৃথিবী ছিঁড়ে উড়ে গেল, নীল হাওয়ার সমুদ্রে স্ফীত মাতাল বেলুনের মতো গেল উড়ে, একটা দূর নক্ষত্রের মাস্তুলকে তারায়-তারায় উড়িয়ে দিয়ে চলল একটা দুরন্ত শুকনের মতো। হাজার বছর শুধু খেলা করে হাজার বছর শুধু খেলা করে অন্ধকারে জোনাকির মতো : চারিদিকে চিরদিন রাত্রির নিধান- বালির উপরে জ্যেৎস্না- দেবদারু ছায়া ইতস্তত বিচূর্ণ থামের মতো; দ্বারকার- দাঁড়ায়ে রয়েছে মৃত ম্লান শরীরে ঘুমের ঘ্রাণ আমাদের- ঘুচে গেছে জীবনের সব লেনদেন : ‘মনে আছে?’ শুধালো সে- শুধালাম আমি শুধু, ‘বনলতা সেন?’ হাজার বর্ষ আগে সেই মেয়েটি এর থেকে নিকটতর হ’লো না : কেবল সে দূরের থেকে আমার দিকে একবার তাকালো আমি বুঝলাম চকিত হয়ে মাথা নোয়ালো সে কিন্তু তবুও তার তাকাবার প্রয়োজন – সপ্রতিভ হয়ে সাত-দিন আট-দিন ন-দিন দশ-দিন সপ্রতিভ হয়ে — সপ্রতিভ হয়ে সমস্ত চোখ দিয়ে আমাকে নির্দিষ্ট করে অপেক্ষা করে — অপেক্ষা ক’রে সেই মেয়েটি এর চেয়ে নিকটতর হ’লো না কারণ, আমাদের জীবন পাখিদের মতো নয় যদি হ’ত সেই মাঘের নীল আকাশে (আমি তাকে নিয়ে) একবার ধবলাটের সমুদ্রের দিকে চলতাম গাঙশালিখের মতো আমরা দু’টিতে আমি কোন এক পাখির জীবনের জন্য অপেক্ষা করছি তুমি কোন এক পাখির জীবনের জন্য অপেক্ষা করছো হয়তো হাজার হাজার বছর পরে মাঘের নীল আকাশে সমুদ্রের দিকে যখন উড়ে যাবো আমাদের মনে হবে হাজার হাজার বছর আগে আমরা এমন উড়ে যেতে চেয়েছিলাম। হায় চিল হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে! তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে। পৃথিবীর রাঙ্গা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে; আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে! হায় চিল হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই মেঘের ভিজে দুপুরে তুমি আর কেঁদো নাকে উড়ে-উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে তোমার কান্নার সূরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দুরে আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই মেঘের ভিজে দুপুরে তুমি আর কেঁদো নাকে উড়ে-উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে হায় পাখি একদিন কালীদহে ছিল না কি হায় পাখি, একদিন কালীদহে ছিল না কি – দহের বাতাসে আষাঢ়ের দু’পহরে কলরব কর নি কি এই বাংলায়! আজ সারাদিন এই বাদলের কোলাহলে মেঘের ছায়ায় চাঁদ সদাগর: তার মধুকর ডিঙাটির কথা মনে আসে, কালীদহে কবে তারা পড়েছিলো একদিন ঝড়ের আকাশে,- সেদিনো অসংখ্য পাখি উড়েছিলো না কি কালো বাতাসের গায়, আজ সারাদিন এই বাদলের জলে ধলেশ্বরীর চরায় গাংশালিখের ঝাঁক, মনে হয়, যেন সেই কালীদহে ভাসে;এই সব পাখিগুলো কিছুতেই আজিকার নয় যেন-নয়- এ নদীও ধলেশ্বরী নয় যেন-এ আকাশ নয় আজিকার: ফণীমনসার বনে মনসা রয়েছে নাকি? আছে; মনে হয়, এ নদী কি কালীদহ নয়? আহা, ঐ ঘাটে এলানো খোঁপার সনকার মুখ আমি দেখি না কি? বিষন্ন মলিন ক্লান- কি যে সত্য সব; তোমার এ স্বপ্ন সত্য, মনসা বলিয়া গেল নিজে। হিন্দু-মুসলমান মহামৈত্রীর বরদ-তীর্থে-পুণ্য ভারতপুরে পূজার ঘন্টা মিশিছে হরষে নমাজের সুরে-সুরে! আহ্নিক হেথা শুরু হয়ে যায় আজান বেলার মাঝে, মুয়াজ্জেনদের উদাস ধ্বনিটি গগনে গগনে বাজে, জপে ঈদগাতে তসবি ফকির, পূজারী মন্ত্র পড়ে, সন্ধ্যা-উষার বেদবাণী যায় মিশে কোরানের স্বরে; সন্ন্যাসী আর পীর মিলে গেছে হেথা-মিশে গেছে হেথা মসজিদ , মন্দির!কে বলে হিন্দু বসিয়া রয়েছে একাকী ভারত জাঁকি? -মুসলমানের হসে- হিন্দু বেঁধেছে মিলন-রাখী; আরব মিশর তাতার তুর্কী ইরানের চেয়ে মোরা ওগো ভারতের মোসলেমদল, তোমাদের বুক-জোড়া! ইন্দ্র প্রস্থ ভেঙেছি আমরা, আর্যাবর্ত ভাঙি গড়েছি নিখিল নতুন ভারত নতুন স্বপনে রাঙি! নবীন প্রাণের সাড়া আকাশে তুলিয়া ছুটিছে মুক্ত যুক্তবেণীর ধারা!রুমের চেয়েও ভারত তোমার আপন, তোমার প্রাণ! হেথায় তোমার ধর্ম অর্থ, হেথায় তোমার ত্রাণ; হেথায় তোমার আশান ভাই গো, হেথায় তোমার আশা; যুগ যুগ ধরি এই ধূলিতলে বাঁধিয়াছ তুমি বাসা, গড়িয়াছ ভাষা কল্পে-কল্পে দরিয়ার তীরে বসি, চক্ষে তোমার ভারতের আলো-ভারতের রবি, শশী, হে ভাই মুসলমান তোমাদের তরে কোল পেতে আছে ভারতের ভগবান!এ ভারতভূমি নহেকো তোমার, নহকো আমার একা, হেথায় পড়েছে হিন্দুর ছাপ- মুসলমানের রেখা, হিন্দু মনীষা জেগেছে এখানে আদিম উষার ক্ষণে, ইন্দ্রদ্যুম্নে উজ্জয়িনীতে মথুরা বৃন্দাবনে! পাটলিপুত্র শ্রাবস্তী কাশী কোশল তক্ষশীলা। অজন্তা আর নালন্দা তার রটিছে কীর্তিলীলা! ভারতী কমলাসীনা কালের বুকেতে বাজায় তাহার নব প্রতিভার বীণা!এই ভারতের তখতে চড়িয়া শাহানশাহার দল স্বপ্নের মণিপ্রদীপে গিয়েছে উজলি আকাশতল! গিয়েছে তাহার কল্পলোকের মুক্তার মালা গাঁথি পরশে তাদের জেগেছে আরব উপন্যাসের রাতি! জেগেছে নবীন মোগল-দিল্লি-লাহোর-ফতেহপুর যমুনাজলের পুরানো বাঁশিতে বেজেছে নবীন সুর! নতুন প্রেমের রাগে তাজমহলের তরুণিমা আজও উষার আরুণে ‌জাগে!জেগেছে হেথায় আকবরী আইন-কালের নিকষ কোলে বারবার যার উজল সোনার পরশ উঠিল জ্বলে। সেলিম, সাজাহাঁ- চোখের জলেতে এক্‌শা করিয়া তারা গড়েছে মীনার মহলা স্তম্ভ কবর ও শাহদারা! ছড়ায়ে রয়েছে তন্দ্রাবিহীন-অপলক, অপরূপ! যেন মায়াবীর তুড়ি স্বপনের ঘোরে ত্বব্ধ করিয়া রেখেছে কনকপুরী!মোতিমহলের অযুত রাত্রি, লক্ষ দীপের ভাতি আজিও বুকের মেহেরাবে যেন জ্বালায়ে যেতেছে বাতি- আজিও অযুত বেগম-বাঁদীর শষ্পশয্যা ঘিরে অতীত রাতের চঞ্চল চোখ চকিতে যেতেছে ফিরে! দিকে দিকে আজও বেজে ওঠে কোন্‌ গজল-ইলাহী গান! পথহারা কোন্‌ ফকিরের তানে কেঁদে ওঠে সারা প্রাণ! -নিখিল ভারতময় মুসলমানের স্বপন-প্রেমের গরিমা জাগিয়া রয়!এসেছিল যারা ঊষর ধুসর মরুগিরিপথ বেয়ে, একদা যাদের শিবিরে সৈন্যে ভারত গেছিল ছেয়ে, আজিকে তাহারা পড়শি মোদের, মোদের বহিন-ভাই; আমাদের বুকে বক্ষে তাদের ,আমাদের কোলে ঠাঁই কাফের যবন টুটিয়া গিয়াছে ছুটিয়া গিয়াছে ঘৃণা, মোস্‌লেম্‌ বিনা ভারত বিকল, বিফল হিন্দু বিনা মহামৈত্রীর গান বাজিছে আকাশে নব ভারতের গরিমায় গরীয়ান! হৃদয়ে প্রেমের দিন হৃদয়ে প্রেমের দিন কখন যে শেষ হয় — চিতা শুধু পড়ে থাকে তার, আমরা জানি না তাহা; — মনে হয় জীবনে যা আছে আজো তাই শালিধান রূপশালি ধান তাহা… রূপ, প্রেম… এই ভাবি… খোসার মতন নষ্ট ম্লান একদিন তাহাদের অসারতা ধরা পড়ে, — যখন সবুজ অন্ধকার, নরম রাত্রির দেশ নদীর জলের গন্ধ কোন এক নবীনাগতার মুখখানা নিয়ে আসে — মনে হয় কোনোদিন পৃথিবীতে প্রেমের আহ্বান এমন গভীর করে পেয়েছি কি? প্রেম যে নক্ষত্র আর নক্ষত্রের গান, প্রাণ যে ব্যাকুল রাত্রি প্রান্তরের গাঢ় নীল অমাবস্যায় –চলে যায় আকাশের সেই দূর নক্ষত্রের লাল নীল শিখার সন্ধানে, প্রাণ যে আঁধার রাত্রি আমার এ, — আর তুমি স্বাতীর মতন রূপের বিচিত্র বাতি নিয়ে এলে, — তাই প্রেম ধুলায় কাঁটায় যেইখানে মৃত হয়ে পড়ে ছিল পৃথিবীর শূণ্য পথে সে গভীর শিহরণ, তুমি সখী, ডুবে যাবে মুহূর্তেই রোমহর্ষে — অনিবার অরুণের ম্লানে জানি আমি; প্রেম যে তবুও প্রেম; স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে রবে, বাঁচিতে সে জানে। হে হৃদয় হে হৃদয় নিস্তব্ধতা? চারিদিকে মৃত সব অরণ্যেরা বুঝি? মাথার ওপরে চাঁদ চলছে কেবলি মেঘ কেটে পথ খুঁজে-পেঁচার পাখায় জোনাকির গায়ে ঘাসের ওপরে কী যে শিশিরের মতো ধূসরতা দীপ্ত হয় না কিছু? ধ্বনিও হয় না আর?হলুদ দু’-ঠ্যাং তুলে নেচে রোগা শালিখের মতো যেন কথা ব’লে চলে তবুও জীবনঃ বয়স তোমার কত? চল্লিশ বছর হল? প্রণয়ের পালা ঢের এল গেল- হল না মিলন?পর্বতের পথে-পথে রৌদ্রে রক্তে অক্লান্ত শফরে খচ্চরে পিঠে কারা চড়ে? পতঞ্জলি এসে ব’লে দেবে প্রভেদ কী যারা শুধু ব’সে থেকে ব্যথা পায় মৃত্যর গহ্বরে মুখে রক্ত তুলে যারা খচ্চরের পিঠ থেকে পড়ে যায়?মৃত সব অরণ্যেরা; আমার এ-জীবনের মৃত অরণ্যেরা বুঝি বলেঃ কেন যাও পৃথিবীর রৌদ্র কোলাহলে নিখিল বিষের ভোক্তা নীলকন্ঠ আকাশের নীচে কেন চ’লে যেতে চাও মিছে; কোথাও পাবে না কিছু; মৃত্যুই অনন্ত শান্তি হয়ে অন্তহীন অন্ধকারে আছে লীন সব অরণ্যের কাছে। আমি তবু বলিঃ এখনও যে-ক’টা দিন বেঁচে আছি সূর্যে-সূর্যে চলি, দেখা যাক পৃথিবীর ঘাস সৃষ্টির বিষের বিন্দু আর নিষ্পেষিত মনুষ্যতার আঁধারের থেকে আনে কী ক’রে যে মহা-নীলাকাশ, ভাবা যাক—ভাবা যাক- ইতিহাস খুঁড়লাই রাশি-রাশি দুঃখের খনি ভেদ ক’রে শোনা যায় শুশ্রুষার মতো শত-শত শত জলঝর্ণার ধ্বনি। হে হৃদয় (অগ্রন্থিত) হে হৃদয়, একদিন ছিলে তুমি নদী পারাপারহীন এক মোহনায় তরণীর ভিজে কাঠ খুঁজিতেছে অন্ধকার স্তব্ধ মহোদধি। তোমার নির্জন পাল থেকে যদি মরণের জন্ম হয়, হে তরণী, কোনো দূর পীত পৃথিবীর বুকে ফাল্গুনিক তবে ঝরনার জল আজো ঢালুক নীরবে; বিশীর্ণেরা আঁজলায় ভরে নিক সলিলের মুক্তা আর মণি অন্ধকার সাগরের মরণকে নিষ্ঠা দিয়ে_ ঊষালোকে মাইক্রোফোনের মতো রবে। হেমন্ত আজ রাতে মনে হয় সব কর্মক্লান্তি অবশেষে কোনো এক অর্থ শুষে গেছে। আমাদের সব পাপ- যদি জীব কোনো পাপ ক’রে থাকে পরস্পর কিংবা দূর নক্ষত্র গুল্ম, গ্যাস, জীবানুর কাছে- হিয়েছে ক্ষয়িত হয়ে। বৃত্ত যেন শুদ্ধতায় নিরুত্তর কেন্দ্রে ফিরে এল এই শান্ত অঘ্রাণের রাতে। যতদূর চোখ যায় বিকোশিত প্রান্তরের কুয়াশায় ব্যাস শাদা চাদরের মত কুয়াশার নিচে শুয়ে! হরিতকী অরণ্যের থেকে চুপে সঞ্চারিত হয়ে নিশীথের ছায়া যেন মেধাবী প্রশান্তি এক রেখে গেছে প্রতিধ্বনিহীন, হিম পৃথিবীর পিঠে। সুষুপ্ত হরিব- লোষ্ট্র; মৃত্যু আজ; ব্যাঘ্র মৃত; মৃত্যুর ভিতরে                                              অমায়িক। জলের উপর দিয়ে চ’লে যায় তারা; তবু জল স্পর্শ করে নাক’ সিংহদুয়ারের মত জেগে ওঠে ইন্দ্রধনু তাহাদের যেতে দেয়; অদ্ভুত বধির চোখে তবু তারা অভ্যর্থনা করে নাক’ আজ আর আলোর বর্বর জননীকে।বাংলার শস্যহীন ক্ষেতের শিয়রে মৃত্যু, বড়, গোল চাঁদ; গভীর অঘ্রাণ এসে দাঁড়ায়েছে। অনন্য যোদ্ধার মত এসেছে সে কতবার দিনের ওপারে সন্ধ্যা- ঋতুর ভিতরে প্লাবী হেমন্তকে দৃষ্ট প্রত্যঙ্গের মত এই স্ফীত পৃথিবীতে ছুরির ফলার মত টেনে নিয়ে। বেবিলন থেকে বিলম্বিত এসপ্লানেডে বিদীর্ণ চীনের থেকে এই শীর্ণ এককড়িপুরে মানুষের অরুন্তুদ চেষ্টার ভিতরে। হেমন্ত কুয়াশায় সকাল-সন্ধ্যাবেলা আমি সেই নারীকে দেখেছি জেনেছি অনেক দিন- তারপর তবুও ভেবেছি। তারপর ঢের দিন পৃথিবীর সেই শাদা সাধারণ কথা ছোট বড় জিনিসের বিস্মরণে ক্রমে ভুলে গেছি। আকাশ আমাকে বলেঃ 'সে না তুমি আত্মসমাহিতি?' পৃথিবী আমাকে দেখে ভেবে যায়ঃ 'এর প্রাণে, আহা, লাখেরাজ হয়ে প'ড়ে র'য়েছে সততা; যে নারীকে নদীর কিনারে জলে ভালোবেসেছিল সময়ের সুবাতাস মুখ ছঁইয়ে চ'লে গেলে যদি তার কথা ভুরু কোঁচকায়ে ভেবে নিতে হয়, মানবহৃদয় তবে সে কোন রকম।' হেমন্তের কুয়াসায় বেড়াতে কারু দাবী অমল ঋণের মত গ্রহণ ক'রেছি আমি নিতে ভুলে গিয়ে; তার ভালোবাসা পেয়ে ভয়াবহভাবে সৎ হয়ে আছি- ভাবি। হেমন্তের রাতে শীতের ঘুমের থেকে এখন বিদায় নিয়ে বাহিরের অন্ধকার রাতে হেমন্তলক্ষ্মীর সব শেষ অনিকেত অবছায়া তারাদের সমাবেশ থেকে চোখ নামায়ে একটি পাখির ঘুম কাছে পাখিনীর বুকে ডুবে আছে,– চেয়ে দেখি;– তাদের উপরে এই অবিরল কালো পৃথিবীর আলো আর ছায়া খেলে–মৃত্যু আর প্রেম আর নীড়। এ ছাড়া অধিক কোনো নিশ্চয়তা নির্জন্তা জীবনের পথে আমাদের মানবীয় ইতিহাস চেতনায়ও নেই;– (তবু আছে।) এমনই অঘ্রাণ রাতে মনে পড়ে–কত সব ধূসর বাড়ির আমলকীপল্লবের ফাঁক দিয়ে নক্ষত্রের ভিড় পৃথিবীর তীরে–তীরে ধূসরিম মহিলার নিকটে সন্নত দাঁড়ায়ে রয়েছে কত মানবের বাষ্পাকুল প্রতীকের মতো– দেখা যেত; এক আধ মহূর্ত শুধু;– সে অভিনিবেশ ভেঙ্গে ফেলে সময়ের সমুদ্রের রক্ত ঘ্রাণ পাওয়া গেল;– ভীতিশব্দ রীতিশব্দ মুক্তিশব্দ এসে আরো ঢের পটভূমিকার দিকে দিগন্তের ক্রমে মানবকে ডেকে নিয়ে চ’লে গেল প্রেমিকের মতো সসম্ভ্রমে; তবুও সে প্রেম নয়, সুধা নয়,– মানুষের ক্লান্ত অন্তহীন ইতিহাস–আকুতির প্রবীণতা ক্রমায়াত ক’রে সে বিলীন?আজ এই শতাব্দীতে সকলেরি জীবনের হৈমন্ত সৈকতে বালির উপরে ভেসে আমাদের চিন্তা কাজ সংকল্পের তরঙ্গকঙ্কাল দ্বীপসমুদ্রের মতো অস্পষ্ট বিলাপ ক’রে তোমাকে আমাকে অন্তহীন দ্বীপহীনতার দিকে অন্ধকারে ডাকে। কেবলি কল্লোল আলো–জ্ঞান প্রম পূর্ণত্র মানবহৃদয় সনাতন মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে– তবু– ঊনিশ শো অনন্তের জয়হয় যেতে পারে, নারি, আমাদের শতাব্দীর দীর্ঘতর চেতনার কাছে আমরা সজ্ঞান হয়ে বেঁচে থেকে বড়ো সময়ের সাগরের কূলে ফিরে আমাদের পৃথিবীকে যদি প্রিয়তর মনে করি প্রিয়তম মৃত্যু অবধি;– সকল আলোর কাজ বিষণ্ন জেনেও তবু কাজ ক’রে– গানে গেয়ে লোকসাধারণ ক’রে দিতে পারি যদি আলোকের মানে। দেখা দিলে রাঙা মৃত্যুর রূপে এতদিনের কি গো রানি? মিলন-গোধূলি-লগনে শুনালে চির-বিদায়ের বাণী।   যে ধূলিতে ফুল ঝরায় পবন   রচিলে সেথায় বাসর-শয়ন, বারেক কপোলে রাখিয়া কপোল, ললাটে কাঁকন হানি, দিলে মোর পরে সকরুণ করে কৃষ্ণ কাফন টানি।    নিশি না পোহাতে জাগায়ে বলিলে, ‘হল যে বিদায় বেলা।” তব ইঙ্গিতে ও-পার হইতে এপারে আসিল ভেলা।   আপনি সাজালে বিদায়ের বেশে   আঁখি-জল মম মুছাইলে হেসে, বলিলে, ‘অনেক হইয়াছে দেরি, আর জমিবে না খেলা! সকলের বুকে পেয়েছ আদর, আমি দিনু অবহেলা।‘    ‘চোখ গেল উহু চোখ গেল’বলে কাঁদিয়া উঠিল পাখি, হাসিয়া বলিলে, ‘বন্ধু, সত্যি চোখ গেল ওর নাকি?’   অকূল অশ্রু-সাগর-বেলায়   শুধু বালু নিয়ে যে-জন খেলায়, কী বলিব তারে, বিদায়-ক্ষণেও ভিজিল না যার আঁখি! শ্বসিয়া উঠিল নিশীথ-সমীর, ‘চোখ গেল’কাঁদে পাখি!দেখিনু চাহিয়া ও-মুখের পানে – নিরশ্রু নিষ্ঠুর! বুকে চেপে কাঁদি, প্রিয় ওগো প্রিয়, কোথা তুমি কত দূর?   এত কাছে তুমি গলা জড়াইয়া   কেন হুহু করে ওঠে তবু হিয়া, কী যেন কী কীসের অভাব এ বুকে ব্যথা-বিধুর! চোখ-ভরা জল, বুক-ভরা কথা, কণ্ঠে আসে না সুর।    হেনার মতন বক্ষে পিষিয়া করিনু তোমারে লাল, ঢলিয়া পড়িলে দলিত কমল জড়ায়ে বাহু-মৃণাল!   কেঁদে বলি, ‘প্রিয়া, চোখে কই জল?   হল না তো ম্লান চোখের কাজল!’ চোখের জল নাই – উঠিল রক্ত – সুন্দর কঙ্কাল! বলিলে, ‘বন্ধু, চোখেরই তো জল, সে কি রহে চিরকাল?’    ছল ছল ছল কেঁদে চলে জল, ভাঁটি-টানে ছুটে তরি, সাপিনির মতো জড়াইয়া ধরে শশীহীন শর্বরী।   কূলে কূলে ডাকে কে যেন, ‘পথিক,   আজও রাঙা হয়ে ওঠেনি তো দিক! অভিমানী মোর! এখনই ছিঁড়িবে বাঁধন কেমন করি? চোখে নাই জল – বক্ষের মোর ব্যথা তো যায়নি মরি!’    কেমনে বুঝাই কী যে আমি চাই, চির-জনমের প্রিয়া! কেমনে বুঝাই – এত হাসি গাই তবু কাঁদে কেন হিয়া!   আছে তব বুকে করুণার ঠাঁই,   স্বর্গের দেবী – চোখে জল নাই! কত জীবনের অভিশাপ এ যে, কতবার জনমিয়া – পারিজাত-মালা ছুঁইতে শুকালে – হারাইলে দেখা দিয়া।    ব্যর্থ মোদের গোধূলি-লগন এই সে জনমে নহে, বাসর-শয়নে হারায়ে তোমায় পেয়েছি চির-বিরহে!   কত সে লোকের কত নদনদী   পারায়ে চলেছি মোরা নিরবধি, মোদের মাঝারে শত জনমের শত সে জলধি বহে। বারেবারে ডুবি বারেবারে উঠি জন্ম-মৃত্যু-দহে!    বারে বারে মোরা পাষাণ হইয়া আপনারে থাকি ভুলি, ক্ষণেকের তরে আসে কবে ঝড়, বন্ধন যায় খুলি।   সহসা সে কোন সন্ধ্যায়, রানি,   চকিতে হয় গো চির-জানাজানি! মনে পড়ে যায় অভিশাপ-বাণী, উড়ে যায় বুলবুলি। কেঁদে কও, ‘প্রিয়, হেথা নয়, হেথা লাগিয়াছে বহু ধূলি।’    মুছি পথধূলি বুকে লবে তুলি মরণের পারে কবে, সেই আশে, প্রিয়, সাজিয়াছি বর মৃত্যুর উৎসবে!   কে জানিত হায় মরমের মাঝে   এমন বিয়ের নহবত বাজে! নবজীবনের বাসর-দুয়ারে কবে ‘প্রিয়া’‘বধূ’হবে – সেই সুখে, প্রিয়া, সাজিয়াছি বর মৃত্যুর উৎসবে!   (চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ) সান্তনা চিত্ত- কুঁড়ি- হাস্না- হানা মৃত্যু- সাঁঝে ফুটলো গো! জীবন- বেড়ায় আড়াল ছাপি' বুকের সুবাস টুটলো গো! এই ত কারার প্রাকার টুটে' বন্দী এল বাইরে ছুটে, তাই ত নিখিল আকুল- হৃদয় শ্মশান- মাঝে জুটল গো! ভবন- ভাঙ্গা আলোর শিখায় ভূবন রেঙ্গে উঠলো গো।স্ব-রাজ দলের চিত্ত- কমল লুটল বিশ্বরাজের পায়, দলের চিত্ত উঠলো সুটে শতদলের শ্বেত আভায়। রূপে কুমার আজকে দোলে অপরূপের শীশ- মহলে, মৃত্যু- বাসুদেবের কোলে কারার কেশব ঐ গো যায়, অনাগত বৃন্দাবনে মা যশদা শাঁখ বাজায়।আজকে রাতে যে ঘুমুলো, কালকে প্রাতে জাগবে সে। এই বিদায়ের অস্ত আঁধার উদয়-ঊষার রাংবে রে! শোকের নিশির শিশির ঝরে ফলবে ফসল ঘরে ঘরে, আবার শীতের রিক্ত শাখায় লাগবে ফুলেল রাগ এসে। যে মা সাঁঝে ঘুম পাড়াল, চুম দিয়ে ঘুম ভাংবে সে।না ঝ'রলে তাঁর প্রান- সাগরে মৃত্যু- রাতের হিম- কণা জীবন- শুক্তি ব্যররথ হ'ত, মুক্তি- মুক্তা ফ'লত না। নিখিল আঁখির ঝিনুক মাঝে অশ্রু- মাণিক ঝলত না যে! রোদের উনুন না নিবিলে চাঁদের সুধা গ'লত না। গগন- লোকে আকাশ বধুর সন্ধ্যা- প্রদীপ জ্ব'লত না।মরা বাঁশে বাজবে বাঁশি কাটুক না আজ কুঠার তায়, এই বেনুতেই ব্রজের বাঁশি হয়ত বাজবে এই হেথায়। হয়ত এবার মিলন- রাসে বংশীধারী আসবে পাশে, চিত্ত- চিতার ছাই মেখে শিব সৃষ্টি- বিষান ঐ বাজায়! জন্ম নেবে মেহেদী ঈসা ধরার বিপুল এই ব্যথায়।কর্মে যদি বিরাম না রয়,শান্তি তবে আসত না! ফ'লবে ফসল- নইলে নিখিল নয়ন- নীরে ভাসত না! নেই ক' দেহের খোসার মায়া, বীজ আনে তাই তরুর ছায়া, আবার যদি না জন্মাত, মৃত্যুতে সে হাসত না। আসবে আবার- নৈলে ধরায় এমন ভালো বাসত না! সাবধানী ঘণ্টা রক্তে আমার লেগেছে আবার সর্বনাশের নেশা। রুধির-নদীর পার হতে ওই ডাকে বিপ্লব-হ্রেষা! বন্ধু গো, সখা, আজি এই নব জয়-যাত্রার আগে দ্বেষ-পঙ্কিল হিয়া হতে তব শ্বেত পঙ্কজ মাগে বন্ধু তোমার ; দাও দাদা দাও তব রূপ-মসি ছানি অঞ্জলি ভরি শুধু কুৎসিত কদর্যতার গ্লানি! তোমার নীচতা, ভীরুতা তোমার, তোমার মনের কালি উদ্‌গারো সখা বন্ধুর শিরে ; তব বুক হোক খালি! সুদূর বন্ধু, দূষিত দৃষ্টি দূর করো, চাহো ফিরে, শয়তানে আজ পেয়েছে তোমায়, সে যে পাঁক ঢালে শিরে! চিরদিন তুমি যাহাদের মুখে মারিয়াছ ঘৃণা-ঢেলা, যে ভোগানন্দ দাসেদেরে গালি হানিয়াছ দুই বেলা, আজি তাহাদেরই বিনামার তলে আসিয়াছ তুমি নামি! বাঁদরেরে তুমি ঘৃণা করে ভালোবাসিয়াছ বাঁদরামি! হে অস্ত্রগুরু! আজি মম বুকে বাজে শুধু এই ব্যথা, পাণ্ডবে দিয়া জয়কেতু, হলে কুক্কুর-কুরু-নেতা! ভোগ-নরকের নারকীয় দ্বারে হইয়াছ তুমি দ্বারী, হারামানন্দে হেরেমে ঢুকেছ হায় হে ব্রহ্মচারী! তোমার কৃষ্ণ রূপ-সরসীতে ফুটেছে কমল কত, সে কমল ঘিরি নেচেছে মরাল কত সহস্র শত, – কোথা সে দিঘির উচ্ছল জল, কোথা সে কমল রাঙা, হেরি শুধু কাদা, শুকায়েছে জল, সরসীর বাঁধ ভাঙা! সেই কাদা মাখি চোখে মুখে তুমি সাজিয়াছ ছি ছি সং, বাঁদর-নাচের ভালুক হয়েছ, হেসে মরি দেখে ঢং। অন্ধকারের বিবর ছাড়িয়া বাহিরিয়া এসো দাদা, হেরো আরশিতে – বাঁদরের বেদে করেছে তোমায় খ্যাঁদা! মিত্র সাজিয়া শত্রু তোমারে ফেলেছে নরকে টানি, ঘৃণার তিলক পরাল তোমারে স্তাবকের শয়তানি! যাহারা তোমারে বাসিয়াছে ভালো, করিয়াছে পূজা নিতি, তাহাদের হানে অতি লজ্জার ব্যথা আজ তব স্মৃতি। নপুংসক ওই শিখণ্ডী আজ রথের সারথি তব, – হানো বীর তব বিদ্রুপ-বাণ, সব বুক পেতে লব ভীষ্মের সম ; যদি তাহে শর-শয়নের বর লভি, তুমি যত বল আমিই সে-রণে জিতিব অস্ত্র-কবি! তুমি জান, তুমি সম্মুখ রণে পারিবে না পরাজিতে, আমি তব কাল যশোরাহু সদা শঙ্কা তোমার চিতে, রক্ত-অসির কৃষ্ণ মসির যে কোনো যুদ্ধে, ভাই, তুমি নিজে জান তুমি অশক্ত, করিয়াছ শুরু তাই চোরা-বাণ ছোঁড়া বেল্লিকপনা বিনামা আড়ালে থাকি ন্যক্কার-আনা নপুংসকেরে রথ-সম্মুখে রাখি। হেরো সখা আজ চারিদিক হতে ধিক্কার অবিরত ছি ছি বিষ ঢালি জ্বালায় তোমার পুরানো প্রদাহ-ক্ষত! আমারে যে সবে বাসিয়াছে ভালো, মোর অপরাধ নহে! কালীয়-দমন উদিয়াছে মোর বেদনার কালীদহে – তাহার দাহ তা তোমারে দহেনি, দহেছে যাদের মুখ তাহারা নাচুক জ্বলুনির চোটে। তুমি পাও কোন সুখ? দগ্ধ-মুখ সে রাম-সেনাদলে নাচিয়া হে সেনাপতি! শিব সুন্দর সত্য তোমার লভিল একী এ গতি? যদিই অসতী হয় বাণী মোর, কালের পরশুরাম কঠোর কুঠারে নাশিবে তাহারে, তুমি কেন বদনাম কিনিছ বন্ধু, কেন এত তব হিয়া দগদগি জ্বালা? – হোলির রাজা কে সাজাল তোমারে পরায়ে বিনামা-মালা? তোমার গোপন দুর্বলতারে, ছি ছি করে মসিময় প্রকাশিলে, সখা, এইখানে তব অতি বড়ো পরাজয়। শতদল-দলে তুমি যে মরাল শ্বেত-সায়রের জলে। ওঠো সখা, বীর, ঈর্ষা-পঙ্ক-শয়ন ছাড়িয়া পুনঃ, নিন্দার নহ, নান্দীর তুমি, উঠিতেছে বাণী শুনো। ওঠো সখা, ওঠো, লহো গো সালাম, বেঁধে দাও হাতে রাখি, ওই হেরো শিরে চক্কর মারে বিপ্লব-বাজপাখি! অন্ধ হোয়ো না, বেত্র ছাড়িয়া নেত্র মেলিয়া চাহো – ঘনায় আকাশে অসন্তোষের নিদারুণ বারিবাহ। দোতালায় বসি উতাল হোয়ো না শুনি বিদ্রোহ-বাণী, এ নহে কৌরব, এ কাঁদন উঠে নিখিল-মর্ম ছানি। বিদ্রুপ করি উড়াইবে এই বিদ্রোহ-তেঁতো জ্বালা? সুরের তোমরা কী করিবে তবু হবে কান ঝালাপালা অসুরের ভীম অসি-ঝনঝনে, বড়ো অসোয়াস্তি-কর! বন্ধু গো, এত ভয় কেন? আছে তোমার আকাশ-ঘর! অর্গল এঁটে সেথা হতে তুমি দাও অনর্গল গালি, গোপীনাথ মলো? সত্য কি? মাঝে মাঝে দেখো তুলি জালি বারীন* ঘোষের দ্বীপান্তর আর মির্জাপুরের বোমা, লাল বাংলার হুমকানি,– ছি ছি, এত অসত্য ও মা, কেমন করে যে রটায় এ সব ঝুটা বিদ্রোহী দল! সখী গো, আমায় ধরো ধরো! মাগো, কত জানে এরা ছল! সই লো, আমার কাতুকুতু ভাব হয়েছে যে, ঢলে পড়ি আঁচলে জড়ায়ে পা চলে না গো, হাত হতে পড়ে ছড়ি! শ্রমিকের গাঁতি, বিপ্লব-বোমা, আ মলো তোমরা মরো! যত সব বাজে বাজখাঁই সুর, মেছুনি-বৃত্তি ধরো! যারা করে বাজে সুখভোগ ত্যাগ, আর রাজরোষে মরে, ওই বোকাদের ইতর ভাষায় গালি দাও খুব করে। এই ইতরামি, বাঁদরামি-আর্ট আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে হন্যে কুকুর পেট পালো আর হাউ হাউ মরো কেঁদে? এই নোংরামি করে দিনরাত বল আর্টের জয়! আর্ট মানে শুধু বাঁদরামি আর মুখ ভ্যাংচানো কয়! আপনার নাক কেটে দাদা এই পরের যাত্রা ভাঙা ইহাই হইল আদর্শ আর্ট, নাকি-সুর, কান রাঙা! আর্ট ও প্রেমের এই সব মেড়ো মাড়োয়ারি দলই জানে, কোনো বিদ্রোহ অসন্তোষের রেখা নাই কোনোখানে! সব ভুয়ো দাদা, ও-সবে দেশের কিছুই হইবে নাকো, এমনই করিয়া জুতো খাও আর মলমল-মল মাখো! –জ্ঞান-অঞ্জন-শলাকা তৈরি হতেছে এদের তরে, দেখিবে এদের আর্টের আঁটুনি একদিনে গেছে ছড়ে! বন্ধু গো! সখা! আঁখি খোলো, খোলো শ্রবণ হইতে তুলা, ওই হেরো পথে গুর্খা-সেপাই উড়াইয়া যায় ধুলা! ওই শোনো আজ ঘরে ঘরে কত উঠিতেছে হাহাকার, ভূধর প্রমাণ উদরে তোমার এবার পড়িবে মার! তোমার আর্টের বাঁশরির সুরে মুগ্ধ হবে না এরা, প্রয়োজন-বাঁশে তোমার আর্টের আটশালা হবে ন্যাড়া! প্রেমও আছে সখা, যুদ্ধও আছে, বিশ্ব এমনই ঠাঁই, ভালো নাহি লাগে, ভালো ছেলে হয়ে ছেড়ে যাও, মানা নাই! আমি বলি সখা, জেনে রেখো মনে কোনো বাতায়ন-ফাঁকে সজিনার ঠ্যাঙা সজনিরই মতো হাতছানি দিয়ে ডাকে। যত বিদ্রুপই করো সখা, তুমি জান এ সত্য-বাণী, কারুর পা চেটে মরিব না; কোনো প্রভু পেটে লাথি হানি ফাটাবে না পিলে, মরিব যেদিন মরিব বীরের মতো, ধরা-মা-র বুকে আমার রক্ত রবে হয়ে শাশ্বত! আমার মৃত্যু লিখিবে আমার জীবনের ইতিহাস! ততদিন সখা সকলের সাথে করে নাও পরিহাস!   (ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ) সাম্যবাদী গাহি সাম্যের গান- যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্‌লিম-ক্রীশ্চান। গাহি সাম্যের গান! কে তুমি?- পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারো? কন্‌ফুসিয়াস্‌? চার্বআখ চেলা? ব’লে যাও, বলো আরো! বন্ধু, যা-খুশি হও, পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা-খুশি পুঁথি ও কেতাব বও, কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক- জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব প’ড়ে যাও, যত সখ- কিন্তু, কেন এ পন্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল? দোকানে কেন এ দর কষাকষি? -পথে ফুটে তাজা ফুল! তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান, সকল শাস্র খুঁজে পাবে সখা, খুলে দেখ নিজ প্রাণ! তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম, সকল যুগাবতার, তোমার হৃষয় বিশ্ব-দেউল সকল দেবতার। কেন খুঁজে ফের’ দেবতা ঠাকুর মৃত পুঁথি -কঙ্কালে? হাসিছেন তিনি অমৃত-হিয়ার নিভৃত অন্তরালে!বন্ধু, বলিনি ঝুট, এইখানে এসে লুটাইয়া পড়ে সকল রাজমুকুট। এই হৃদ্য়ই সে নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন, বুদ্ধ-গয়া এ, জেরুজালেম্‌ এ, মদিনা, কাবা-ভবন, মস্‌জিদ এই, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়, এইখানে ব’সে ঈসা মুসা পেল সত্যের পরিচয়। এই রণ-ভূমে বাঁশীর কিশোর গাহিলেন মহা-গীতা, এই মাঠে হ’ল মেষের রাখাল নবীরা খোদার মিতা। এই হৃদয়ের ধ্যান-গুহা-মাঝে বসিয়া শাক্যমুনি ত্যজিল রাজ্য মানবের মহা-বেদনার ডাক শুনি’। এই কন্দরে আরব-দুলাল শুনিতেন আহবান, এইখানে বসি’ গাহিলেন তিনি কোরানের সাম-গান! মিথ্যা শুনিনি ভাই, এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই। সাম্যবাদী - মরুভাস্কর আদি উপাসনালয় -- উঠিল আবার নূতন করিয়া -- ভূত প্রেত সমুদয় তিনি শত ষাট বিগ্রহ আর মূর্তি নূতন করি' বসিল সোনার বেদীতে যে হায় আল্লার ঘর ভরি।সহিতে না পারি এ দৃশ্য, এই স্রষ্টার অপমান, ধেয়ানে মুক্তি-পথ খোঁজে নবী, কাঁদিয়া ওঠে পরান। খদিজারে কন-- "আল্লাতালার কসম, কাবার ঐ "লাৎ" "ওজ্জা"র করিব না পূজা, জানি না আল্লা বই। নিজ হাতে যারে করিল সৃষ্টি খড় আর মাটি দিয়া কোন্‌ নির্বোধ পূজিবে তাহারে হায় স্রষ্টা বলিয়া!"সাধ্বী পতিব্রতা খাদিজাও কহেন স্বামীর সনে-- "দূর কর ঐ লাত্‌ মানাতেরে, পূজে যাহা সব-জনে। তভ শুভ-বরে একেশ্বর সে জ্যোতির্ময়ের দিশা পাইয়াছি প্রভু, কাটিয়া গিয়াছে আমার আঁধার নিশা।"ক্রমে ক্রমে সব কোরেশ জানিল -- মোহাম্মদ আমিন করে না কো পূজা কাবার ভূতেরে ভাবিয়া তাদেরে হীন। সালাম অস্ত রবি কাব্য-গীতির শ্রেষ্ঠ স্রষ্ঠা, দ্রষ্ঠা, ঋষি ও ধ্যানী মহাকবি রবি অস্ত গিয়াছে! বীণা, বেণুকা ও বাণী নীরব হইল। ধুলির ধরণী জানিনা সে কত দিন রস- যমুনার পরশ পাবেনা। প্রকৃতি বাণীহীন মৌন বিষাদে কাঁদিবে ভুবনে ভবনে ও বনে একা; রেখায় রেখায় রুপ দিবে আর কাহার ছন্দ লেখা? অপ্রাকৃত মদনে মাধবী চাঁদের জ্যোৎস্না দিয়া রূপায়িত রসায়িত করিবে কে লেখনী, তুলিকা নিয়া?ব্যাস, বাল্মীকি,কালিদাস, খৈয়াম, হাফিজ ও রুমী আরবের ইমরুল কায়েস যে ছিলে এক সাথে তুমি! সকল দেশের সক্ল কালের সকল কবিরে ভাঙ্গি' তাঁহাদের রুপে রসে রাঙ্গাইয়া, বুঝি কত যুগ জাগি' তোমারে রচিল রসিক বিধাতা, অপরুপ সে বিলাস, তব রুপে গুনে ছিল যে পরম সুন্দরের আভাস। এক সে রবির আলোকে তিমির- ভীত এ ভারপ্তবাসী ভেলেছিল প্রাধীনতা- পিড়ন দুঃখ- দৈন্যরাশি। যেন উর্ধ্বের বরাভয় তুমি আল্লাহর রহমত, নিত্য দিয়াছ মৃত এ জাতিরে অমৃত শরবত, সকল দেশের সব জাতির সকল লোকের তুমি অর্ঘ্য আনিয়া ধন্য করিলে ভারত- বঙ্গভুমি।।তোমার মরুতে তোমার আলোকে ছায়া- তরু ফুল-লতা জমিয়া চির স্নিগ্ধ করিয়া রেখেছিল শত ব্যথা। অন্তরে আর পাইনা যে আলো মানস-গগন-কবি, বাহিরের রবি হেরিয়া জাগে যে অন্তরে তব ছবি। গোলাব ঝরেছে, গোলাবি আতর কাঁদিয়া ফিরিছে হায়। আতরে কাতর করে আরো প্রান, ফুলেরে দেখিতে চায়।ফুলের, পাখির, চাঁদ-সুরুজের নাহি ক' যেমন জাতি, সকলে তাদেরে ভালোবাসে, ছিল তেমনি তোমার খ্যাতি। রস-লোক হতে রস দেয় যারা বৃষ্টিধারার প্রায় তাদের নাহি ক' ধর্ম ও জাতি, সকলে ঘরে যায় অবারিত দ্বার রস- শিল্পীর, হেরেমেও অনায়াসে যায় তার সুর কবিতা ও ছবি আনন্দে অবকাশে।ছিল যে তোমার অবারিত দ্বার সকল জাতির গেহে, তোমারে ভাবিত আকাশের চাঁদ, চাহিত গভীর স্নেহে। ফুল হারাইয়া আঁচলে রুমালে তোমার সুরভি মাখে বক্ষে নয়নে বুলায়ে আতর, কেঁদে ঝরাফুল ডাকে।আপন জীবন নিঙ্গাড়ি' যেজন তৃষাতুর জনগণে দেয় প্রেম রস, অভয় শক্তি বসি' দূর নির্জনে, মানুষ তাহারি তরে কাঁদে, কাঁদে তারি তরে আল্লাহ, বেহেশত হতে ফেরেশ্তা কহে তাহারেই বাদশাহ।শত রুপে রঙ্গে লীলা- নিকেতন আল্লার দুনিয়াকে রাঙ্গায় যাহারা, আল্লার কৃপা সদা তাঁরে ঘিরে থাকে। তুমি যেন সেই খোদার রহম, এসেছিল রুপ ধরে, আর্শের ছায়া দেখাইয়া ছিলে রুপের আর্শি ভরে।কালাম ঝরেছে তোমার কলমে, সালাম লইয়া যাও উর্দ্ধে থাকি' এ পাষান জাতিরে রসে গলাইয়া দাও।। সাহেব ও মোসাহেব সাহেব কহেন, “চমৎকার! সে চমৎকার!” মোসাহেব বলে, “চমৎকার সে হতেই হবে যে! হুজুরের মতে অমত কার?”সাহেব কহেন, “কী চমৎকার, বলতেই দাও, আহা হা!” মোসাহেব বলে, “হুজুরের কথা শুনেই বুঝেছি, বাহাহা বাহাহা বাহাহা!”সাহেব কহেন, “কথাটা কি জান? সেদিন -” মোসাহেব বলে, “জানি না আবার? ঐ যে, কি বলে, যেদিন -”সাহেব কহেন, “সেদিন বিকেলে বৃষ্টিটা ছিল স্বল্প।” মোসাহেব বলে, “আহা হা, শুনেছ? কিবা অপরুপ গল্প!”সাহেব কহেন, “আরে ম’লো! আগে বলতেই দাও গোড়াটা!” মোসাহেব বলে, “আহা-হা গোড়াটা! হুজুরের গোড়া! এই, চুপ, চুপ ছোঁড়াটা!”সাহেব কহেন, “কি বলছিলাম, গোলমালে গেল গুলায়ে!” মোসাহেব বলে, “হুজুরের মাথা! গুলাতেই হবে। দিব কি হস্ত বুলায়ে?”সাহেব কহেন, “শোনো না! সেদিন সূর্য্য উঠেছে সকালে!” মোসাহেব বলে, “সকালে সূর্য্য? আমরা কিন্তু দেখি না কাঁদিলে কোঁকালে!”সাহেব কহেন, “ভাবিলাম, যাই, আসি খানিকটা বেড়ায়ে,” মোসাহেব বলে, “অমন সকাল! যাবে কোথা বাবা, হুজুরের চোখ এড়ায়ে!”সাহেব কহেন, “হ’ল না বেড়ানো, ঘরেই রহিনু বসিয়া!” মোসাহেব বলে, “আগেই বলেছি! হুজুর কি চাষা, বেড়াবেন হাল চষিয়া?”সাহেব কহেন, “বসিয়া বসিয়া পড়েছি কখন ঝিমায়ে!” মোসাহেব বলে, “এই চুপ সব! হুজুর ঝিমান! পাখা কর, ডাক নিমাইএ”সাহেব কহেন, “ঝিমাইনি, কই এই ত জেগেই রয়েছি!” মোসাহেব বলে, “হুজুর জেগেই রয়েছেন, তা আগেই সবারে কয়েছি!”সাহেব কহেন, “জাগিয়া দেখিনু, জুটিয়াছে যত হনুমান আর অপদেব!” “হুজুরের চোখ, যাবে কোথা বাবা?” প্রণামিয়া কয় মোসাহেব।। সিন্ধুঃ তৃতীয় তরঙ্গ হে ক্ষুধিত বন্ধু মোর, তৃষিত জলধি, এত জল বুকে তব, তবু নাহি তৃষার অবধি! এত নদী উপনদী তব পদে করে আত্মদান,   বুভুক্ষু! তবু কি তব ভরলি না প্রাণ?   দুরন্ত গো, মহাবাহু    ওগো রাহু, তিন ভাগ গ্রাসিয়াছ-এক ভাগ বাকী! সুরা নাই-পাত্র-হাতে কাঁপিতেছে সাকী! হে দুর্গম! খোলো খোলো খোলো দ্বার। সারি সারি গিরি-দরী দাঁড়ায়ে দুয়ারে করে প্রতীক্ষা তোমার। শস্য-শ্যামা বসুমতী ফুলে-ফলে ভরিয়া অঞ্জলি    করিছে বন্দনা তব, বলী! তুমি আছ নিয়া নিজ দুরন্ত কল্লোল    আপনাতে আপনি বিভোল! পাশে না শ্রবণে তব ধরণীতে শত দুঃখ-গীত; দেখিতেছ বর্তমান, দেখেছ অতীত, দেখিবে সুদূরে ভবিষ্যৎ- মৃত্যুঞ্জয়ী দ্রষ্টা, ঋষি, উদাসীনবৎ! ওঠে ভাঙে তব বুকে তরঙ্গের মতো জন্ম-মৃত্যু দুঃখ-সুখ, ভূমানন্দে হেরিছ সতত!হে পবিত্র! আজিও সুন্দর ধরা, আজিও অম্লান সদ্য-ফোটা পুষ্পসম, তোমাতে করিয়া নিতি স্নান! জগতের যত পাপ গ্লানি হে দরদী, নিঃশেষে মুছিয়া লয় তব স্নেহ-পাণি! ধরা তব আদরিনী মেয়ে, তাহারে দেখিতে তুমি আস’ মেঘ বেয়ে! হেসে ওঠে তৃণে-শস্যে দুলালী তোমার, কালো চোখ বেয়ে ঝরে হিম-কণা আনন্দাশ্রু-ভরা! জলধারা হ’য়ে নামো, দাও কত রঙিন যৌতুক,   ভাঙ’ গড়’ দোলা দাও,- কন্যারে লইয়া তব অনন্ত কৌতুক! হে বিরাট, নাহি তব ক্ষয়, নিত্য নব নব দানে ক্ষয়েরে ক’রেছ তুমি জয়!হে সুন্দর! জলবাহু দিয়া ধরণীর কটিতট আছো আঁকড়িয়া ইন্দ্রানীলকান্তমণি মেখলার সম, মেদিনীর নিতম্ব সাথে দোল’ অনুপম! বন্ধু, তব অনন্ত যৌবন তরঙ্গে ফেনায়ে ওঠে সুরার মতন! কত মৎস্য-কুমারীরা নিত্য তোমা’ যাচে, কত জল-দেবীদের শুষ্ক মালা প’ড়ে তব চরণের কাছে, চেয়ে নাহি দেখ, উদাসীন! কার যেন স্বপ্নে তুমি মত্ত নিশিদিন! মন্থর-মন্দার দিয়া দস্যু সুরাসুর মথিয়া লুন্ঠিয়া গেছে তব রত্ন-পুর, হরিয়াছে উচ্চেঃশ্রবা, তব লক্ষ্মী, তব শশী-প্রিয়া তার সব আছে আজ সুখে স্বর্গে গিয়া! ক’রেছে লুন্ঠন তোমার অমৃত-সুধা-তোমার জীবন! সব গেছে, আছে শুধু ক্রন্দন-কল্লোল, আছে জ্বালা, আছে স্মৃতি, ব্যথা-উতরোল উর্ধ্বে শূন্য, নিম্নে শূন্য,-শূন্য চারিধার, মধ্যে কাঁদে বারিধার, সীমাহীন রিক্ত হাহাকার! হে মহান! হে চির-বিরহী! হে সিন্ধু, হে বন্ধু মোর, হে মোর বিদ্রোহী, সুন্দর আমার!    নমস্কার!    নমস্কার লহ! তুমি কাঁদ,-আমি কাঁদি,-কাঁদে মোর প্রিয়া অহরহ। হে দুস্তর, আছে তব পার, আছে কূল, এ অনন্ত বিরহের নাহি পার–নাহি কূল–শুধু স্বপ্ন, ভুল। মাগিব বিদায় যবে, নাহি র’ব আর, তব কল্লোলের মাঝে বাজে যেন ক্রন্দন আমার! বৃথাই খুঁজিবে যবে প্রিয় উত্তরিও বন্ধু ওগো সিন্ধু মোর, তুমি গরজিয়া! তুমি শূন্য, আমি শূন্য, শূন্য চারিধার, মধ্যে কাঁদে বারিধার, সীমাহীন রিক্ত হাহাকার।চট্টগ্রাম ৩১/০৭/১৯২৬কাব্যগ্রন্থঃ-সিন্ধু-হিন্দোল সিন্ধুঃ দ্বিতীয় তরঙ্গ হে সিন্ধু, হে বন্ধু মোর      হে মোর বিদ্রোহী!       রহি’ রহি’      কোন্‌ বেদনায়     তরঙ্গ-বিভঙ্গে মাতো উদ্দাম লীলায়!      হে উন্মত্ত, কেন এ নর্তন?     নিষ্ফল আক্রোশে কেন কর আস্ফালন      বেলাভূমে পড়ো আছাড়িয়া!     সর্বগ্রাসী! গ্রাসিতেছ মৃত্যু-ক্ষুধা নিয়া      ধরণীরে তিলে-তিলে!     হে অস্থির! স্থির নাহি হ’তে দিলে      পৃথিবীরে! ওগো নৃত্য-ভোলা,     ধরারে দোলায় শূন্যে তোমার হিন্দোলা!       হে চঞ্চল,     বারে বারে টানিতেছ দিগন্তিকা-বন্ধুর অঞ্চল! কৌতুকী গো! তোমার এ-কৌতুকের অন্ত যেন নাই।-       কী যেন বৃথাই      খুঁজিতেছ কূলে কূলে কার যেন পদরেখা!-কে নিশীথে এসেছিল ভুলে     তব তীরে, গর্বিতা সে নারী,     যত বারি আছে চোখে তব      সব দিলে পদে তার ঢালি’,      সে শুধু হাসিল উপক্ষায়! তুমি গেলে করিতে চুম্বন, সে ফিরালো কঙ্কণের ঘায়!       –গেল চ’লে নারী!     সন্ধান করিয়া ফের, হে সন্ধানী, তারি      দিকে দিকে তরণীর দুরাশা লইয়া,     গর্জনে গর্জনে কাঁদ–“পিয়া, মোর পিয়া!’’বলো বন্ধু, বুকে তব কেন এত বেগ, এত জ্বালা? কে দিল না প্রতিদিন? কে ছিঁড়িল মালা? কে সে গরবিনী বালা? কার এত রূপ এত প্রাণ,    হে সাগর, করিল তোমার অপমান!    হে মজনু, কোন্‌ সে লায়লীর     প্রণয়ে উন্মাদ তুমি?-বিরহ-অথির     করিয়াছে বিদ্রোহ ঘোষণা, সিন্ধুরাজ,    কোন্‌ রাজকুমারীর লাগি’? কারে আজ     পরাজিত করি’ রণে, তব প্রিয়া রাজ-দুহিতারে     আনিবে হরণ করি?-সারে সারে     দলে দলে চলে তব তরঙ্গের সেনা,     উষ্ণীষ তাদের শিরে শোভে শুভ্র ফেনা!      ঝটিকা তোমার সেনাপতি আদেশ হানিয়া চলে উর্ধ্বে অগ্রগতি।      উড়ে চলে মেঘের বেলুন, ‘মাইন্‌’ তোমার চোরা পর্বত নিপুণ! হাঙ্গর কুম্ভীর তিমি চলে ‘সাবমেরিন’, নৌ-সেনা চলিছে নীচে মীন!    সিন্ধু-ঘোটকেতে চড়ি’ চলিয়াছ বীর       উদ্দাম অস্থির! কখন আনিবে জয় করি’-কবে সে আসিবে তব প্রিয়া,       সেই আশা নিয়া       মুক্তা-বুকে মালা রচি’ নীচে!      তোমার হেরেম্‌-বাঁদী শত শুক্তি-বধূ অপেক্ষিছে।      প্রবাল গাঁথিছে রক্ত-হার-      হে সিন্ধু, হে বন্ধু মোর-তোমার প্রিয়ার!       বধূ তব দীপাম্বীতা আসিবে কখন?      রচিতেছে নব নব দ্বীপ তারি প্রমোদ-কানন।       বক্ষে তব চলে সিন্ধু-পোত      ওরা তব যেন পোষা কপোতী-কপোত।      নাচায়ে আদর করে পাখীরে তোমার      ঢেউ-এর দোলায়, ওগো কোমল দুর্বার!       উচ্ছ্বাসে তোমার জল উলসিয়া উঠে,       ও বুঝি চুম্বর তব তা’র চঞ্চুপুটে?      আশা তব ওড়ে লুব্ধ সাগর-শকুন,      তটভূমি টেনে চলে তব আশা-তারকার গুণ!      উড়ে যায় নাম-নাহি-জানা কত পাখী,      ও যেন স্বপন তব!-কী তুমি একাকী       ভাব কভু আনমনে যেন,        সহসা লুকাতে চাও আপনারে কেন!      ফিরে চলো ভাঁটি-টানে কোন্‌ অন্তরালে,      যেন তুমি বেঁচে যাও নিজেরে লুকালে!-       শ্রান্ত মাঝি গাহে গান ভাটিয়ালী সুরে,      ভেসে যেতে চায় প্রাণ দূরে-আরো দূরে।       সীমাহীন নিরুদ্দেশ পথে,      মাঝি ভাসে, তুমি ভাস, আমি ভাসি স্রোতে।           নিরুদ্দেশ! শুনে কোন্‌ আড়ালীর ডাক      ভাটিয়ালী পথে চলো একাকী নির্বাক?       অন্তরের তলা হ’তে শোন কি আহবান?      কোন্‌ অন্তরিকা কাঁদে অন্তরালে থাকি’ যেন,         চাহে তব প্রাণ!      বাহিরে না পেয়ে তারে ফের তুমি অন্তরের পানে       লজ্জায়-ব্যথায়-অপমানে!       তারপর, বিরাট পুরুষ! বোঝা নিজ ভুল      জোয়ারে উচ্ছ্বসি’ ওঠো, ভেঙে চল কূল       দিকে দিকে প্লাবনের বাজায়ে বিষাণ      বলো, ‘ প্রেম করে না দুর্বল ওরে করে মহীয়ান্‌!’ বারণী সাকীরে কহ, ‘ আনো সখি সুরার পেয়ালা!’ আনন্দে নাচিয়া ওঠো দুখের নেশায় বীর, ভোল সব জ্বালা!   অন্তরের নিষ্পেষিত ব্যথার ক্রন্দন   ফেনা হ’য়ে ওঠে মুখে বিষর মতন।   হে শিব, পাগল! তব কন্ঠে ধরি’ রাখো সেই জ্বালা-সেই হলাহল!    হে বন্ধু, হে সখা, এতদিনে দেখা হ’ল, মোরা দুই বন্ধু পলাতকা।কত কথা আছে-কত গান আছে শোনাবার, কত ব্যথা জানাবার আছে-সিন্ধু, বন্ধু গো আমার!   এসো বন্ধু, মুখোমুখি বসি, অথবা টানিয়া লহ তরঙ্গের আলিঙ্গন দিয়া, দুঁহু পশি   ঢেউ নাই যেথা-শুধু নিতল সুনীল!- তিমির কহিয়া দাও-সে যেন খোলে না খিল    থাকে দ্বারে বসি’,   সেইখানে ক’ব কথা। যেন রবি-শশী    নাহি পশে সেথা।    তুমি র’বে-আমি র’ব-আর র’বে ব্যথা!   সেথা শুধু ডুবে র’বে কথা নাহি কহি’,-    যদি কই,-   নাই সেথা দু’টি কথা বই, আমিও বিরহী, বন্ধু, তুমিও বিরহী!’চট্টগ্রাম ৩১/০৭/১৯২৬কাব্যগ্রন্থঃ-সিন্ধু-হিন্দোল সিন্ধুঃ প্রথম তরঙ্গ হে সিন্ধু, হে বন্ধু মোর, হে চির-বিরহী,      হে অতৃপ্ত! রহি’ রহি’       কোন্‌ বেদনায়      উদ্বেলিয়া ওঠ তুমি কানায় কানায়? কি কথা শুনাতে চাও, কারে কি কহিবে বন্ধু তুমি? প্রতীক্ষায় চেয়ে আছে উর্ধ্বে নীলা নিম্নে বেলা-ভুমি!      কথা কও, হে দুরন্ত, বল, তব বুকে কেন এত ঢেউ জাগে, এত কলকল?      কিসের এ অশান্ত গর্জন?      দিবা নাই রাত্রি নাই, অনন্ত ক্রন্দন       থামিল না, বন্ধু, তব! কোথা তব ব্যথা বাজে! মোরে কও, কা’রে নাহি ক’ব!      কা’রে তুমি হারালে কখন্‌?     কোন্‌ মায়া-মণিকার হেরিছ স্বপন?      কে সে বালা? কোথা তার ঘর?     কবে দেখেছিলে তারে? কেন হ’ল পর      যারে এত বাসিয়াছ ভালো!     কেন সে আসিল, এসে কেন সে লুকালো?      অভিমান ক’রেছে সে?     মানিনী ঝেপেছে মুখ নিশীথিনী-কেশে?     ঘুমায়েছে একাকিনী জোছনা-বিছানে?     চাঁদের চাঁদিনী বুঝি তাই এত টানে     তোমার সাগর-প্রাণ, জাগায় জোয়ার?     কী রহস্য আছে চাঁদে লুকানো তোমার?       বল, বন্ধু বল,    ও কি গান? ওকি কাঁদা? ঐ মত্ত জল-ছলছল-       ও কি হুহুঙ্কার?      ঐ চাঁদ ঐ সে কি প্রেয়সী তোমার?      টানিয়া সে মেঘের আড়াল     সুদূরিকা সুদূরেই থাকে চিরকাল? চাঁদের কলঙ্ক ঐ, ও কি তব ক্ষুধাতুর চুম্বনের দাগ? দূরে থাকে কলঙ্কিনী, ও কি রাগ? ও কি অনুরাগ?      জান না কি, তাই    তরঙ্গে আছাড়ি’ মর আক্রোশে বৃথাই?….     মনে লাগে তুমি যেন অনন্ত পুরুষ     আপনার স্বপ্নে ছিলে আপনি বেহুঁশ!      অশান্ত! প্রশান্ত ছিলে       এ-নিখিলে      জানিতে না আপনারে ছাড়া। তরঙ্গ ছিল না বুকে, তখনো দোলানী এসে দেয়নি ক’ নাড়া!     বিপুল আরশি-সম ছিলে স্বচ্ছ, ছিলে স্থির,      তব মুখে মুখ রেখে ঘুমাইত তীর।–      তপস্বী! ধেয়ানী!     তারপর চাঁদ এলো-কবে, নাহি জানি      তুমি যেন উঠিলে শিহরি’।     হে মৌনী, কহিলে কথা-“মরি মরি,       সুন্দর সুন্দর!”     “সুন্দর সুন্দর” গাহি’ জাগিয়া উঠিল চরাচর!     সেই সে আদিম শব্দ, সেই আদি কথা,     সেই বুঝি নির্জনের সৃজনের ব্যথা,      সেই বুঝি বুঝিলে রাজন্‌     একা সে সুন্দর হয় হইলে দু’জন!     কোথা সে উঠিল চাঁদ হৃদয়ে না নভে সে-কথা জানে না কেউ, জানিবে না,  চিরকাল নাহি-জানা র’বে। এতদিনে ভার হ’ল আপনারে নিয়া একা থাকা,     কেন যেন মনে হয়-ফাঁকা, সব ফাঁকা     কে যেন চাহিছে মোরে, কে যেন কী নাই,     যারে পাই তারে যেন আরো পেতে চাই!          জাগিল আনন্দ-ব্যথা, জাগিল জোয়ার,     লাগিল তরঙ্গে দোলা, ভাঙিল দুয়ার,      মাতিয়া উঠিলে তুমি!     কাঁপিয়া উঠিল কেঁদে নিদ্রাতুরা ভূমি!     বাতাসে উঠিল ব্যেপে তব হতাশ্বাস,     জাগিল অন্তত শূন্যে নীলিমা-উছাস!     রোমাঞ্চিত হ’ল ধরা,      বুক চিরে এল তার তৃণ-ফুল-ফল।     এল আলো, এল বায়ু, এল তেজ প্রাণ,    জানা ও অজানা ব্যেপে ওঠে সে কি অভিনব গান!     এ কি মাতামাতি ওগো এ কি উতরোল!     এত বুক ছিল হেথা, ছিল এত কোন!     শাখা ও শাখীতে যেন কত জানাশোনা,    হাওয়া এসে দোলা দেয়, সেও যেন ছিল জানা       কত সে আপনা!      জলে জলে ছলাছলি চলমান বেগে,    ফুলে হুলে চুমোচুমি-চরাচরে বেলা ওঠে জেগে!      আনন্দ-বিহ্বল সব আজ কথা কহে, গাহে গান, করে কোলাহল! বন্ধু ওগো সিন্ধুরাজ! স্বপ্নে চাঁদ-মুখ হেরিয়া উঠিলে জাগি’,  ব্যথা ক’রে উঠিল ও-বুক। কী যেন সে ক্ষুধা জাগে, কী যেন সে পীড়া, গ’লে যায় সারা হিয়া, ছিঁড়ে যায় যত স্নায়ু শিরা!     নিয়া নেশা, নিয়া ব্যথা-সুখ     দুলিয়া উঠিলে সিন্ধু উৎসুক উন্মুখ!     কোন্‌ প্রিয়-বিরহের সুগভীর ছায়া    তোমাতে পড়িল যেন, নীল হ’ল তব স্বচ্ছ কায়া!      সিন্ধু, ওগো বন্ধু মোর!      গর্জিয়া উঠিল ঘোর       আর্ত হুহুঙ্কারে!       বারে বারে    বাসনা-তরঙ্গে তব পড়ে ছায়া তব প্রেয়সীর, ছায়া সে তরঙ্গে ভাঙে, হানে মায়া, উর্ধ্ব প্রিয়া স্থির!      ঘুচিল না অনন্ত আড়াল,     তুমি কাঁদ, আমি কাঁদি, কাঁদি সাথে কাল!      কাঁদে গ্রীষ্ম, কাঁদে বর্ষা, বসন্ত ও শীত,      নিশিদিন শুনি বন্ধু ঐ এক ক্রন্দনের গীত,      নিখিল বিরহী কাঁদে সিন্ধু তব সাথে,     তুমি কাঁদ, আমি কাঁদি, কাঁদে প্রিয়া রাতে!      সেই অশ্রু-সেই লোনা জল তব চক্ষে — হে বিরহী বন্ধু মোরা — করে টলমল!      এক জ্বালা এক ব্যথা নিয়া তুমি কাঁদ, আমি কাঁদি, কাঁদে মোর প্রিয়া।চট্টগ্রাম ২৯/০৭/১৯২৬কাব্যগ্রন্থঃ-সিন্ধু-হিন্দোল সুখবিলাসিনী পারাবত তুমি রৌদ্রোজ্জ্বল দিবসে তোমার আসিনি সজল মেঘের ছায়া, তৃষ্ণা-আতুর হরিণী চোখে কী হবে হানিয়া মরীচি-মায়া! আমি কালো মেঘ – নামি যদি তব বাতায়ন-পাশে বৃষ্টিধারে, বন্ধ করিয়া দিবে বাতায়ন, যদি ভিজে যাও নয়নাসারে! সুখবিলাসিনী পারাবত তুমি, বাদল রাতের পাপিয়া নহ, তব তরে নয় বাদলের ব্যথা – নয়নের জল দুর্বিষহ। ফাল্গুন-বনে মাধবী-বিতানে যে পিক নিয়ত ফুকারি ওঠে, তুমি চাও সেই কোকিলের ভাষা তোমার রৌদ্রতপ্ত ঠোঁটে। জানি না সে ভাষা, হয়তো বা জানি, ছল করে তাই হাসিতে চাহি, সহসা নিরখি – নেমেছে বাদল রৌদ্রোজ্জ্বল গগন বাহি। ইরানি-গোলাব-আভা আনিয়াছ চুরি করি ভরি ও রাঙা তনু, আমি ভাবি বুঝি আমারই বাদল-মেঘশেষে এল ইন্দ্রধনু। ফণীর ডেরায় কাঁটার কুঞ্জে ফোটে যে কেতকী, তাহার ব্যথা বুঝিবে না তুমি, ধরণি তো তব ঘর নহে, এলে ভ্রমিতে হেথা। ভ্রম করে তুমি ভ্রমিতে ধরায় এসেছ, ফুলের দেশের পরি, জানিতে না হেথা সুখদিন শেষে আসে দুখ-রাতি আঁধার করি। রাঙা প্রজাপতি উড়িয়া এসেছ, চপলতা-ভরা চিত্র-পাখা, জানিতে না হেথা ফুল ফুটে ফুল ঝরে যায়, কাঁদে কানন ফাঁকা। যে লোনা জলের সাত সমুদ্র গ্রাস করিয়াছে বিপুল ধরা, সেই সমুদ্রে জনম আমার, আমি সেই মেঘ সলিল ভরা। ভাসিতে যে আসে আমার সলিলে, তাহারে ভাসায়ে লইয়া চলি সেই অশ্রুর সপ্ত পাথারে, পারায়ে ব্যথার শতেক গলি। ভুল করে প্রিয়া এ ফুল-কাননে এসেছিলে, জানা ছিল না তব এ বন-বেদনা অশ্রুমুখীরে; এ নহে মাধবীকুঞ্জ নব। মাটির করুণাসিক্ত এ মন, হেথা নিশিদিন যে ফুল ঝরে তারই বেদনায় ভরে আছে মন, হাসিতে তাদেরই অশ্রু ক্ষরে। সেই বেদনায় এসেছিলে তুমি ক্ষণিক স্বপন, ভুলের মেলা, জাগিয়া তাহারই স্মৃতি লয়ে কাটে আমার সকাল সন্ধ্যাবেলা। এ মোর নিয়তি, অপরাধ নহে আমারও তোমারও – স্বপন-রানি! আমার বাণীতে তোমার মুরতি বীণাপাণি নয় বেদনাপাণি। তোমার নদীতে নিতি কত তরি এপার হইতে ওপারে চলে; কাণ্ডারিহীন ভাঙা তরি মোর ডুবে গেল তব অতল তলে। ওরা শুধু তব মুখ চেয়ে যায়, সুখের আশার বণিক ওরা, আমি ডুবে তব দেখিলাম তল জলশেষে চোরা বালুতে ভরা। ভয় নাই প্রিয়, মগ্ন এ তরি তব বিস্মৃতি-বালুকাতলে দু-দিনে পড়িবে ঢাকা, উদাসীন, তুমি বয়ে যাবে চলার ছলে। কুড়াতে এসেছে দুখের ঝিনুক ব্যথার আকুল সিন্ধুকূলে, আঁচল ভরিয়া কুড়ায়ে হয়তো ফেলে দেবে কোথা মনের ভুলে। তোমাদের ব্যথা-কাঁদন যেটুকু, সে শুধু বিলাস, পুতুলখেলা, পুতুল লইয়া কাটে চিরদিন, আদর করিয়া ভাঙিয়া ফেলা। মোর দেহমনে নয়নে ও প্রেমে অশ্রুজল নীরদ মাখা, কী হবে ভিজিয়া এ বাদলে, রানি, তব ধ্যান ওই চন্দ্র তারকা। সে চাঁদ উঠেছে গগনে তোমার-আমার সন্ধ্যাতিমির শেষে, আমি যাই সেই নিশীথিনী-পারে যেথায় সকল আঁধার মেশে। আমার প্রেমের বরষায় ধুয়ে তব হৃদি হল সুনীলতর – সে গগনে যবে উঠিবে গো চাঁদ উজ্জ্বলতর তাহারে করো। যদি সে-চন্দ্রহসিত নিশীথে বিস্বাদ লাগে তোমার চোখে, তোমার অতীত তোমারে খুঁজিয়ো আমার বিধুর গানের লোকে। সেথা ব্যথা রবে, রবে সান্তনা, রবে চন্দন-সুশীতলতা, যে-ফুল জীবনে ঝরে না সে-ফুল হইয়া ফুটিবে তোমার ব্যথা। আমার গানের চির-দাহ যাহা সে আছে গো নীলকন্ঠে মম, চিরশেষে এল যে অমৃতবাণী, দিনু তা তোমারে হে প্রিয়তম! আমার শাখায় কন্টক থাক, কাঁটার ঊর্ধ্বে তুমি যে ফুল – আমি ফুটায়েছি তোমারে কুসুম করিয়া, সে মোর সুখ অতুল। বিদায়-বেলায় এই শুধু চাই, হে মোর মানস-কানন-পরি, তোমার চেয়েও তব বন্ধুরে ভালোবাসি যেন অধিক করি।   (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) সুপার (জেলের) বন্দনা সুপার (জেলের) বন্দনা** হুগলি জেলে কারারুদ্ধ থাকাকালীন জেলের সকল প্রকার জুলুম আমাদের উপর দিয়ে পরখ করে নেওয়া হয়েছিল। সেই সময় জেলের মূর্তিমান ‘জুলুম’ বড়-কর্তাকে দেখে এই গেয়ে আমরা অভিনন্দন জানাতাম।তোমারি জেলে পালিছ ঠেলে, তুমি ধন্য ধন্য হে। আমার এ গান তোমারি ধ্যান, তুমি ধন্য ধন্য হে॥ রেখেছে সান্ত্রী পাহারা দোরে আঁধার-কক্ষে জামাই-আদরে বেঁধেছ শিকল-প্রণয়-ডোরে।                  তুমি ধন্য ধন্য হে॥ আ-কাঁড়া চালের অন্ন-লবণ করেছে আমার রসনা-লোভন, বুড়ো ডাটা-ঘাঁটা লাপসি শোভন,                তুমি ধন্য ধন্য হে॥ ধরো ধরো খুড়ো চপেটা মুষ্টি, খেয়ে গয়া পাবে সোজা স-গুষ্টি, ওল-ছোলা দেহ ধবল-কুষ্টি                তুমি ধন্য ধন্য হে॥ সুবহ্-উম্মেদ সর্বনাশের পরে পৌষ মাস    এল কি আবার ইসলামের? মন্বন্তর-অন্তে কে দিল    ধরণিরে ধন-ধান্য ঢের? ভুখারির রোজা রমজান পরে    এল কি ঈদের নওরোজা? এল কি আরব-আহবে আবার    মূর্ত মর্ত-মোর্তজা? হিজরত করে হজরত কি রে    এল এ মেদিনী-মদিনা ফের? নতুন করিয়া হিজরি গণনা    হবে কি আবার মুসলিমের?        *      *      *    বরদ-বিজয়ী বদরুদ্দোজা৪    ঘুচাল কি অমা রৌশনিতে? সিজাদ করিল নিজ‍্‍দ হেজাজ৬    আবার ‘কাবা’র মসজিদে। আরবে করিল ‘দারুল-হার’–    ধসে পড়ে বুঝি ‘কাবা’র ছাদ! ‘দীন দীন’রবে শমশের-হাতে    ছুটে শের-নর ‘ইবনে সাদ’! মাজার ফাড়িয়া উঠিল হাজার    জিন্দান-ভাঙা জিন্দা বীর! গারত হইল করদ হুসেন,    উঁচু হল পুন শির নবির! আরব আবার হল আরাস্তা,    বান্দারা যত পড়ে দরুদ। পড়ে শুকরানা‘আরবা রেকাত’    আরফাতে যত স্বর্গ-দূত। ঘোষিল ওহদ, ‘আল্লা আহদ !’    ফুকারে তূর্য তুর পাহাড় মন্দ্রে বিশ্ব-রন্ধ্রে-রন্ধ্রে    মন্ত্র আল্লা-হু-আকবার! জাগিয়া শুনিনু প্রভাতি আজান    দিতেছে নবীন মোয়াজ্জিন। মনে হল এল ভক্ত বেলাল    রক্ত এ-দিনে জাগাতে দীন! জেগেছে তখন তরুণ তুরাণ    গোর চিরে যেন আঙ্গোরায়। গ্রিসের গরুরী গারত করিয়া    বোঁও বোঁও তলোয়ার ঘোরায়। রংরেজ৭ যেন শমশের যত    লালফেজ-শিরে তুর্কিদের। লালে-লাল করে কৃষ্ণসাগর    রক্ত-প্রবাল চূর্ণি ফের। মোতি হার সম হাথিয়ার দোলে    তরুণ তুরাণি বুকে পিঠে! খাট্টা-মেজাজ গাঁট্টা মারিছে    দেশ-শত্রুর গিঁঠে গিঁঠে! মুক্ত চন্দ্র-লাঞ্ছিত ধ্বজা    পতপত ওড়ে তুর্কিতে, রঙিন আজি ম্লান আস্তানা    সুরখ রঙের সুর্খিতে বিরান১০ মুলুক ইরানও সহসা    জাগিয়াছে দেখি ত্যজিয়া নিদ! মাশুকের বাহু ছাড়ায়ে আশিক    কসম করিছে হবে শহিদ! লায়লির প্রেমে মজনুন আজি    ‘লা-এলা’র তরে ধরেছে তেগ। শিরীন শিরীরে ভুলে ফরহাদ    সারা ইসলাম পরে আশেক! পেশতা-আপেল-আনার-আঙুর-    নারঙ্গি-শেব-বোস্তানে মুলতুবি আজ সাকি ও শরাব    দীওয়ান-ই-হাফিজ জুজদানে! নার্গিস লালা লালে-লাল আজি    তাজা খুন মেখে বীর প্রাণের, ফিরদৌসীর রণ-দুন্দুভি    শুনে পিঞ্জরে জেগেছে শের! হিংসায়-সিয়া শিয়াদের তাজে    শিরাজী-শোণিমা লেগেছে আজ। নৌ-রুস্তম উঠেছে রুখিয়া    সফেদ দানবে দিয়াছে লাজ? মরা মরক্কো মরিয়া হইয়া    মাতিয়াছে করি মরণ-পণ, স্তম্ভিত হয়ে হেরিছে বিশ্ব–    আজও মুসলিম ভোলেনি রণ! জ্বালাবে আবার খেদিব-প্রদীপ    গাজি আবদুল করিম বীর, দ্বিতীয় কামাল রীফ-সর্দার–    স্পেন ভয়ে পায়ে নোয়ায় শির! রীফ৬ শরিফ সে কতটুকু ঠাঁই    আজ তারই কথা ভুবনময়!– মৃত্যুর মাঝে মৃত্যুঞ্জয়ে    দেখেছে যাহারা, তাদেরই জয়! মেষ-সম যারা ছিল এতদিন    শের হল আজ সেই মেসের! এ-মেষের দেশ মেষ-ই রহিল    কাফ্রির অধম এরা কাফের! নীল দরিয়ায় জেগেছে জোয়ার    ‘মুসা’র উষার টুটেছে ঘুম। অভিশাপ-‘আসা’ গর্জিয়া আসে    গ্রাসিবে যন্ত্রী-জাদু-জুলুম। ফেরাউন১ আজও মরেনি ডুবিয়া?    দেরি নাই তার, ডুবিবে কাল! জালিম-রাজার প্রাসাদে প্রাসাদে    জ্বলেছে খোদার লাল মশাল! কাবুল লইল নতুন দীক্ষা    কবুল করিল আপনা জান। পাহাড়ি তরুর শুকনো শাখায়    গাহে বুলবুল খোশ এলহান! পামির ছাড়িয়া আমির আজিকে    পথের ধুলায় খোঁজে মণি! মিলিয়াছে মরা মরু-সাগরে রে    আব-হায়াতের৩ প্রাণ-খনি! খর-রোদ-পোড়া খর্জুর তরু–    তারও বুক ফেটে ক্ষরিছে ক্ষীর! “সুজলা সুফলা শস্য-শ্যামলা”    ভারতের বুকে নাই রুধির! জাগিল আরব ইরান তুরান    মরক্কো আফগান মেসের।– সর্বনাশের পরে পৌষমাস    এলো কি আবার ইসলামের?        *      *      *    কসাই-খানার সাত কোটি মেষ    ইহাদেরই শুধু নাই কি ত্রাণ মার খেয়ে খেয়ে মরিয়া হইয়া    উঠিতে এদের নাই প্রাণ? জেগেছে আরব ইরান তুরান    মরক্কো আফগান মেসের। এয়্ খোদা! এই জাগরণ-রোলে    এ-মেষের দেশও জাগাও ফের!হুগলি, অগ্রহায়ণ, ১৩৩১ (জিঞ্জির কাব্যগ্রন্থ) সুর-কুমার (দিলীপকুমারের ইউরোপ যাত্রা উপলক্ষ্যে)বন্ধু, তোমায় স্বপ্ন-মাঝে ডাক দিল কি বন্দিনী সপ্ত সাগর তেরো নদীর পার হতে সুর-নন্দিনী!বীণ-বাদিনী বাজায় হঠাৎ যাত্রা-পথের দুন্দুভি, অরুণ আঁখি কইল সাকি, ‘আজকে শরাব মুলতুবি!’সাগর তোমায় শঙ্খ বাজায়, হাতছানি দেয় সিন্ধু-পার, গানের ভেলায় চললে ভেসে রূপকথারই রাজকুমার!গানের ভেলায় চললে ভেসে রূপকথারই রাজকুমার! লয়ে সুরের সোনার কাঠি দিগ‌্‌বিজয়ে যাও সেথায়।বন্দী-দেশের আনন্দ-বীর! আনবে তুমি জয় করি ইন্দ্রলোকের উর্বশী নয় – কণ্ঠলোকের কিন্নরী।শ্বেতদ্বীপের সুর-সভায় আজকে তোমার আমন্ত্রণ, অস্ত্রে যারা রণ জেতেনি বীণায় তারা জিনল মন।কণ্ঠে আছে আনন্দ-গান, হস্ত-পদে থাক শিকল; ফুল-বাগিচায় ফুলের মেলা, নাই-বা সেথা ফলল ফল।বৃত্ত-ব্যাসে বন্দী তবু মোদের রবির অরুণ-রাগ জয় করেছে যন্ত্রাসুরের মানব-মেধের লক্ষ যাগ।ছুটছে যশের যজ্ঞ-ঘোড়া স্পর্ধা-অধীর বিশ্বময়, তোমার মাঝে দেখব বন্ধু নূতন করে দিগ্‌বিজয়।বীণার তারে বিমান-পারের বেতার-বার্তা শুনছি ওই কণ্ঠে যদি গান থাকে গো পিঞ্জরে কেউ বন্ধ নই।চলায় তোমার ক্লান্তি তো নাই নিত্য তুমি ভ্রাম্যমান, তোমার পায়ে নিত্য নূতন দেশান্তরের বাজবে গান।বধূর মতন বিধুর হয়ে সুদূর তোমায় দেয় গো ডাক, তোমার মনের এপার থেকে উঠল কেঁদে চক্রবাক!ধ্যান ভেঙে যায় নবীন যোগী, ওপার পানে চায় নয়ন, মনের মানিক খুঁজে ফের বনের মাঝে সর্বক্ষণ।দূর-বিরহী, পার হয়ে যাও সাত সাগরের অশ্রুজল, আমরা বলি – যাত্রা তোমার সুন্দর হোক, হোক সফল!  (ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ) সুরা আদ-দুহা শপথ প্রথম দিবস- বেলার শপথ রাতের তিমির- ঘন, করেন নি প্রভু বর্জন তোমা', করেন নি দুশমনী কখনো। পরকাল সে যে উত্তমতর, হইকাল আর দুনিয়া হ'তে, অচিরাত তব প্রভু দানিবেন (সম্পদ) খুশী হইবে যাতে। পিতৃহীন সে তোমারে তিনি কি করেন নি পরে শরন দান? ভ্রান্ত পথে তোমারে পাইয়া তিনিই না তোমা পথ দেখান? তিনি কি পাননি অভাবী তোমারে আভাব সব করেন মোচন? করিয়ো না তাই পিতৃহীনের উপরে কখনো উতপীড়ন। যে জন প্রার্থী--- তাহারে দেখিও করো না তিরস্কার কভু, বক্ত করহ নিয়ামত যাহা দিলেন তোমারে তব প্রভু। সুরা ইখলাস (শুরু করিলাম) ল'য়ে নাম আল্লার করুণা ও দয়া যাঁর অশেষ অপার।বল, আল্লাহ এক! প্রভু ইচ্ছাময়, নিষ্কাম নিরপেক্ষ, অন্য কেহ নয়। করেন না কাহারেও তিনি যে জনন, কাহারও ঔরস-জাত তিনি নন। সমতুল তাঁর নাই কেহ আর। সুরা কাওসার শুরু করিলাম পূত নামেতে খোদার কৃপা করুণার যিনি অসীম পাথার।অনন্ত কল্যাণ তোমা' দিয়াছি নিশ্চয়, অতএব তব প্রতিপালক যে হয় নামায পড় ও দাও কোরবাণী তাঁরেই, বিদ্বেষ তোমারে যে, অপুত্রক সে-ই। সুরা কাফেরুন শুরু করিলাম নামে সেই আল্লার, আকর যে সব দয়া কৃপা করুণার।বল, হে বিধর্মীগন, তোমরা যাহার পূজা কর, - আমি পূজা করি না তাহার। তোমরা পূজ না তাঁরে আমি পূজি যাঁরে, তোমরা যাহারে পূজ - আমিও তাহারে পূজিতে সম্মত নই। তোমরাও নহ প্রস্তুত পূজিতে, যাঁরে পূজি অহরহ। তোমার ধর্ম যাহা তোমাদের তরে, আমার যে ধর্ম র'বে আমারি উপরে। সুরা নসর (শুরু করিলাম) ল'য়ে নাম আল্লার করুণা ও দয়া যাঁর অশেষ অপার।আসিয়াছে আল্লার শুভ সাহায্য বিজয়! দেখিবে - আল্লার ধর্মে এ জগৎময় যত লোক দলে দলে করিছে প্রবেশ, এবে নিজ পালক সে প্রভুর অশেষ প্রচার হে প্রসংশা কৃতজ্ঞ অন্তরে, কর ক্ষমা প্রার্থনা তাঁহার গোচরে। করেন গ্রহন তিনি সবার অধিক ক্ষমা আর অনুতাপ-যাচ্ঞা সঠিক। সুরা নাস (শুরু করিলাম) ল'য়ে নাম আল্লার করুণা ও দয়া যাঁর অশেষ অপার।বল, আমি তাঁরি কাছে মাগি গো শরণ সকল মানবে যিনি করেন পালন। কেবল তাঁহারি কাছে - ত্রিভুবন মাঝ সবার উপাস্য যিনি রাজ- অধিরাজ। কুমন্ত্রণা দানকারী "খান্নাস" শয়তান মানব দানব হ'তে চাহি পরিত্রাণ। সুরা ফাতেহা (শুরু করিলাম) ল'য়ে নাম আল্লার করুণা ও দয়া যাঁর অশেষ অপার।সকলি বিশ্বের স্বামী আল্লার মহিমা, করুণা কৃপার যাঁর নাই নাই সীমা। বিচার-দিনের বিভু! কেবল তোমারি আরাধনা করি আর শক্তি ভিক্ষা করি। সহজ সরল পথে মোদেরে চালাও, যাদের বিলাও দয়া সে পথ দেখাও। অভিশপ্ত আর পথভ্রষ্ট যারা, প্রভু, তাহাদের পথে যেন চালায়ো না কভু। সুরা ফালাক (শুরু করিলাম) ল'য়ে নাম আল্লার করুণা ও দয়া যাঁর অশেষ অপার।বল, আমি শরণ যাচি ঊষা-পতির, হাত হতে তার - সৃষ্টিতে যা আছে তির। আঁধার-ঘন নিশীথ রাতের ভয় অপকার- এ সব হ'তে অভয় শরণ যাচি তাঁহার। যাদুর ফুঁয়ে শিথিল করে (কঠিন সাধন) সংকল্পের বাঁধন, যাচি তার নিবারণ। ঈর্ষাতুরের বিদ্বেষ যে ক্ষতি করে- শরণ যাচি, পানাহ্ মাগি তাহার তরে। সুরা লাহাব (শুরু করিলাম) ল'য়ে নাম আল্লার করুণা ও দয়া যাঁর অশেষ অপার।ধ্বংস হোক্ আবু লাহাবের বাহুদ্বয়, হইবে বিধ্বস্ত তাহা হইবে নিশ্চয়। করেছে অর্জ্জন ধন সম্পদ সে যাহা কিছু নয়, কাজে তার লাগিবে না তাহা। শিখাময় অনলে সে পশিবে ত্বরায় সাথে তার সে অনল-কুন্ডে যাবে হায় জায়া তার - অপবাদ-ইন্ধন বাহিনী, তাহার গলায় দড়ি বহিবে আপনি। সেবক সত্যকে হায় হত্যা করে অত্যাচারীর খাঁড়ায়, নেই কি রে কেউ সত্যসাধক বুক খুলে আজ দাঁড়ায়? শিকলগুলো বিকল করে পায়ের তলায় মাড়ায়, – বজ্র-হাতে জিন্দানের ওই ভিত্তিটাকে নাড়ায়? নাজাত -পথের আজাদ মানব নেই কি রে কেউ বাঁচা, ভাঙতে পারে ত্রিশ কোটি এই মানুষ-মেষের খাঁচা? ঝুটার পায়ে শির লুটাবে, এতই ভীরু সাঁচা? –    ফন্দি-কারায় কাঁদছিল হায় বন্দি যত ছেলে, এমন দিনে ব্যথায় করুণ অরুণ আঁখি মেলে, পাবক-শিখা হস্তে ধরি কে তুমি ভাই এলে? ‘সেবক আমি’ – হাঁকল তরুণ কারার দুয়ার ঠেলে।    দিন-দুনিয়ায় আজ খুনিয়ার রোজ-হাশরের মেলা, করছে অসুর হক-কে না-হক, হক-তায়ালায় হেলা! রক্ষ-সেনার লক্ষ আঘাত বক্ষে বড়োই বেঁধে, রক্ষা করো, রক্ষা করো, উঠতেছে দেশ কেঁদে। নেই কি রে কেউ মুক্তি-সেবক শহিদ হবে মরে, চরণ-তলে দলবে মরণ ভয়কে হরণ করে,      ওরে        জয়কে বরণ করে – নেই কি এমন সত্য-পুরুষ মাতৃ-সেবক ওরে? কাঁপল সে স্বর মৃত্যু-কাতর আকাশ-বাতাস ছিঁড়ে, বাজ পড়েছে, বাজ পড়েছে ভারতমাতার নীড়ে!    দানব দলে শাস্তি আনে নাই কি এমন ছেলে? একী দেখি গান গেয়ে ওই অরুণ আঁখি মেলে পাবক-শিখা হস্তে ধরে কে বাছা মোর এলে? ‘মা গো আমি সেবক তোমার! জয় হোক মা-র।’           হাঁকল তরুণ কারার-দুয়ার ঠেলে!    বিশ্বগ্রাসীর ত্রাস নাশি আজ আসবে কে বীর এসো ঝুট শাসনে করতে শাসন, শ্বাস যদি হয় শেষও।           – কে আজ বীর এসো। ‘বন্দি থাকা হীন অপমান!’ হাঁকবে যে বীর তরুণ, – শির-দাঁড়া যার শক্ত তাজা, রক্ত যাহার অরুণ, সত্য-মুক্তি স্বাধীন জীবন লক্ষ্য শুধু যাদের, খোদার রাহায় জান দিতে আজ ডাক পড়েছে তাদের। দেশের পায়ে প্রাণ দিতে আজ ডাক পড়েছে তাদের, সত্য-মুক্তি স্বাধীন জীবন লক্ষ্য শুধু যাদের। হঠাৎ দেখি আসছে বিশাল মশাল হাতে ও কে? ‘জয় সত্যম্’ মন্ত্র-শিখা জ্বলছে উজল চোখে। রাত্রি-শেষে এমন বেশে কে তুমি ভাই এলে? ‘সেবক তোদের, ভাইরা আমার! – জয় হোক মা-র!’           হাঁকল তরুণ কারার দুয়ার ঠেলে!(বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ) সোহাগ গুলশন কো চুম চুম কহতে বুলবুল, রুখসারা সে বে-দরদি বোরকা খুল!           হাঁসতি হ্যায় বোস্তাঁ,           মস্ত্ হো যা দোস্তাঁ, শিরি শিরাজি সে যা বেহোশ জাঁ।           সব কুছ আজ রঙিন হ্যায় সব কুছ মশগুল,           হাঁস্‌তি হ্যায় গুল হো কর দোজখ বিলকুল হা রে আশেক           মাশুক কি চমনোঁ মে ফুলতা নেই দোবারা ফুল                     ফুল ফুল ফুল॥  (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ) স্তব্ধ বাদল ওই   নীল-গগনের নয়ন-পাতায়                         নামল কাজল-কালো মায়া।      বনের ফাঁকে চমকে বেড়ায়                         তারই সজল আলোছায়া।    ওই   তমাল তালের বুকের কাছে        ব্যথিত কে দাঁড়িয়ে আছে                         দাঁড়িয়ে আছে।        ভেজা পাতায় ওই কাঁপে তার                         আদুল ঢলঢল কায়া। যার   শীতল হাতের পুলক-ছোঁয়ায়                         কদমকলি শিউরে ওঠে,        জুইকুঁড়ি সব নেতিয়ে পড়ে                         কেয়াবধূর ঘোমটা টুটে।    আহা!  আজ কেন তার চোখের ভাষা        বাদল-ছাওয়া ভাসা-ভাসা –                         জলে-ভাসা?        দিগন্তরে ছড়িয়েছে সেই                         নিতল আঁখির নীল আবছায়া।    ও কার  ছায়া দোলে অতল কালো                         শালপিয়ালের শ্যামলিমায়?      আমলকি-বন থামল ব্যথায়                         থামল কাঁদন গগন-সীমায়।    আজ  তার বেদনাই ভরেছে দিক,        ঘরছাড়া হায় এ কোন পথিক,                         এ কোন পথিক?      এ কীস্তব্ধতারই আকাশ-জোড়া                       অসীম রোদন-বেদন-ছায়া।(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) স্তব্ধ-রাতে থেমে আসে রজনির গীত-কোলাহল,      ওরে মোর সাথি আঁখি-জল,           এইবার তুই নেমে আয় –           অতন্দ্র এ নয়ন-পাতায়।    আকাশে শিশির ঝরে, বনে ঝরে ফুল, রূপের পালঙ্ক বেয়ে ঝরে এলোচুল ; কোন গ্রহে কে জড়ায়ে ধরিছে প্রিয়ায়, উল্কার মানিক ছিঁড়ে ঝরে পড়ে যায়। আঁখি-জল, তুই নেমে আয় - বুক ছেড়ে নয়ন-পাতায়!...              ওরে সুখবাদী অশ্রুতে পেলিনে যারে, হাসিতে পাবি কি তারে আজি?      আপনারে কতকাল দিবি আর ফাঁকি? অন্তহীন শূন্যতারে কত আর রাখবি রে কুয়াশায় ঢাকি? ভিখারি সাজিলি যদি, কেন তবে দ্বারে এসে ফিরে যাস নিতি অন্ধকারে? পথ হতে আন-পথে কেঁদে যাস লয়ে ভিক্ষা-ঝুলি, প্রাসাদ যাচিস যার তারেই রহিলি শুধু ভুলি?     সকলে জানিবে তোর ব্যথা, শুধু সে-ই জানিবে না কাঁটা-ভরা ক্ষত তোর কোথা?      ওরে ভীরু, ওরে অভিমানী! যাহারে সকল দিবি, তারে তুই দিলি শুধু বাণী? সুরের সুরায় মেতে কতটুকু কমিল রে মর্মদাহ তোর? গানের গহিনে ডুবে কতদিন লুকাইবি এই আঁখি-লোর? কেবলই গাঁথিলি মালা, কার তরে কেহ নাহি জানে!   অকূলে ভাসায়ে দিস, ভেসে যায় মালা শূন্য-পানে।    সে-ই শুধু জানিল না, যার তরে এত মালা-গাঁথা, জলে-ভরা আঁখি তোর, ঘুমে-ভরা আঁখি-পাতা। কে জানে কাটিবে কিনা আজিকার অন্ধ এ নিশীথ, হয়তো হবে না গাওয়া কাল তোর আধ-গাওয়া গীত, হয়তো হবে না বলা, বাণীর বুদ‍্‍বুদে যাহা ফোটে নিশিদিন! সময় ফুরায়ে যায় – ঘনায়ে আসিল সন্ধ্যা কুহেলি-মলিন! সময় ফুরায়ে যায়, চলো এবে, বলি আঁখি তুলি – ওগো প্রিয়, আমি যাই, এই লহো মোর ভিক্ষা-ঝুলি! ফিরেছি সকল দ্বারে, শুধু তব ঠাঁই ভিক্ষা-পাত্র লয়ে করে কভু আসি নাই।    ভরেছে ভিক্ষার ঝুলি মানিকে মণিতে, ভরে নাই চিত্ত মোর! তাই শূন্য-চিতে এসেছি বিবাগি আজি, ওগো রাজা-রানি, চাহিতে আসিনি কিছু! সংকোচে অঞ্চল মুখে দিয়ো নাকো টানি।জানাতে এসেছি শধু– অন্তর-আসনে সব ঠাঁই ছেড়ে দিয়ে – যাহারে গোপনে চলে গেছি বন-পথে একদা একাকী, বুক-ভরা কথা লয়ে – জল-ভরা আঁখি। চাহিনিকো হাত পেতে তারে কোনোদিন, বিলায়ে দিয়েছি তারে সব, ফিরে পেতে দিইনিকো ঋণ!         ওগো উদাসিনী, তব সাথে নাহি চলে হাটে বিকিকিনি। কারও প্রেম ঘরে টানে, কেহ অবহেলে ভিখারি করিয়া দেয় বহুদূরে ঠেলে! জানিতে আসিনি আমি, নিমেষের ভুলে কখনও বসেছ কি না সেই নদী-কূলে,      যার ভাটি-টানে – ভেসে যায় তরি মোর দূর শূন্যপানে। চাহি না তো কোন কিছু, তবু কেন রয়ে রয়ে ব্যাথা করে বুক, সুখ ফিরি করে ফিরি, তবু নাহি সহা যায়      আজি আর এ-দুঃখের সুখ।...    আপনারে দলিয়া, তোমারে দলিনি কোনোদিন, আমি যাই, তোমারে আমার ব্যথা দিয়ে গেনু ঋণ।  (চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ) স্নেহ-পরশ আমি      এদেশ হতে বিদায় যেদিন নেব প্রিয়তম,      কাঁদবে এ বুক সঙ্গীহারা কপোতিনী সম –        তখন মুকুরপাশে একলা গেহে           আমারই এই সকল দেহে      চুমব আমি চুমব নিজেই অসীম স্নেহে গো! আহা  পরশ তোমার জাগছে যে গো এই সে দেহে মম,                               কম সরস-হরষ সম।        তখন তুমি নাইবা – প্রিয় – নাইবা রলে কাছে,      জানব আমার এই সে দেহে এই সে দেহে গো      তোমার বাহুর বুকের শরম-ছোঁয়ার আকুল কাঁপন আছে –                               মদির অধীর পুলক নাচে!      তখন নাইবা আমার রইল মনে           কোনখানে মোর দেহের বনে        জড়িয়েছিলে লতার মতন আলিঙ্গনে গো! আমি  চুমোয় চুমোয় ডুবাব এই সকল দেহ মম –                               ওগো শ্রাবণ-প্লাবন সম। (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ) স্নেহ-ভীতু ওরে   এ কোন্ স্নেহ-সুরধুনী নামল আমার সাহারায়?               বক্ষে কাঁদার বান ডেকেছে, আজ হিয়া কূল না হারায়!                     কণ্ঠে চেপে শুষ্ক তৃষা                     মরুর সে পথ তপ্ত সিসা,         চলতে একা পাইনি দিশা ভাই;         বন্ধ নিশাস – একটু বাতাস!               এক ফোঁটা জল জহর-মিশা! –         মিথ্যা আশা, নাই সে নিশানাই!         হঠাৎ ও কার ছায়ার মায়া রে? – যেন   ডাক-নামে আজ গাল-ভরা ডাক ডাকছে কে ওই মা-হারায়!          লক্ষ যুগের বক্ষ-ছাপা তুহিন হয়ে যে ব্যথা আর কথা ছিল ঘুমা,               কে সে ব্যথায় বুলায় পরশ রে? – ওরে   গলায় তুহিন কাহার কিরণতপ্ত সোহাগ-চুমা?             ওরে ও ভূত, লক্ষ্মীছাড়া,               হতভাগা, বাঁধনহারা।         কোথায় ছুটিস! একটু দাঁড়া, হায়!               ওই তো তোরে ডাকচে স্নেহ,               হাতছানি দেয় ওই তো গেহ,         কাঁদিস কেন পাগল-পারা তায়? এত    ডুকরে কিসের তিক্ত কাঁদন তোর?         অভিমানি! মুখ ফেরা দেখ যা পেয়েচিস তাও হারায়! হায়,   বুঝবে কে যে স্নেহের ছোঁয়ায় আমার বাণী রা হারায়।  (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) স্মরণে আজ  নতুন করে পড়ল মনে মনের মতনে এই  শাঙন সাঁঝের ভেজা হাওয়ায়, বারির পতনে।             কার কথা আজ তড়িৎ-শিখায়             জাগিয়ে গেল আগুন লিখায়,             ভোলা যে মোর দায় হল হায়                            বুকের রতনে। এই   শাঙন সাঁঝের ভেজা হাওয়ায়, বারির পতনে। আজ  উতল ঝড়ের কাতরানিতে গুমরে ওঠে বুক      নিবিড় ব্যথায় মূক হয়ে যায় মুখর আমার মুখ।           জলো হাওয়ার ঝাপটা লেগে           অনেক কথা উঠল জেগে           পরান আমার বেড়ায় মেগে                          একটু যতনে। এই   শাঙন সাঁঝের ভেজা হাওয়ায়, বারির পতনে।   (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ) হার-মানা-হার তোরা   কোথা হতে কেমনে এসে              মণি-মালার মতো আমার কণ্ঠে জড়ালি। আমার   পথিক-জীবন এমন করে              ঘরের মায়ায় মুগ্ধ করে বাঁধন পরালি।আমায়   বাঁধতে যারা এসেছিল গরব করে হেসে তারা   হার মেনে হায় বিদায় নিল কেঁদে, তোরা   কেমন করে ছোট্ট বুকের একটু ভালোবেসে   ওই    কচি বাহুর রেশমি ডোরে ফেললি আমায় বেঁধে! তোরা   চলতে গেলে পায়ে জড়াস,         ‘না’ ‘না’ বলে ঘাড়টি নড়াস,   কেন   ঘর-ছাড়াকে এমন করে           ঘরের ক্ষুধা স্নেহের সুধা মনে পড়ালি।  ওরে   চোখে তোদের জল আসে না–         চমকে ওঠে আকাশ তোদের              চোখের মুখের চপল হাসিতে।   ওই    হাসিই তো মোর ফাঁসি হল,   ওকে   ছিঁড়তে গেলে বুকে লাগে,              কাতর কাঁদন ছাপা যে ও হাসির রাশিতে!   আমি   চাইলে বিদায় বলিস, ‘উঁহু,                     ছাড়ব নাকো মোরা’    ওই   একটু মুখের ছোট্ট মানাই এড়িয়ে যেতে নারি,   কত    দেশ-বিদেশের কান্নাহাসির                বাঁধনছেঁড়ার দাগ যে বুকে পোরা, তোরা    বসলি রে সেই বুক জুড়ে আজ,          চিরজয়ীর রথটি নিলি কাড়ি।   ওরে    দরদিরা! তোদের দরদ          শীতের বুকে আনলে শরৎ, তোরা    ঈষৎ-ছোঁয়ায় পাথরকে আজ                 কাতর করে অশ্রুভরা ব্যথায় ভরালি।  (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ পথে হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ পথে কুড়াই ঝরা ফুল একেলা আমি তুমি কেন হায় আসিলে হেথায় সুখের স্বরগ হইতে নামি।চারিপাশে মোর উড়িছে কেবল শুকনো পাতা মলিন ফুলদল বৃথাই কেন হায় তব আঁখিজল ছিটাও অবিরল দিবসযামী।এলে অবেলায় পথিক বেভুল বিঁধিছে কাঁটা নাহি যবে ফুল কি দিয়া বরণ করি ও চরণ নিভিছে জীবন, জীবনস্বামী।। হারামণি এমন করে অঙ্গনে মোর ডাক দিলি কে স্নেহের কাঙালি!           কে রে ও তুই কে রে?           আহা  ব্যথার সুরে রে,           এমন  চেনা স্বরে রে,      আমার ভাঙা ঘরের শূন্যতারই বুকের পরে রে। এ কোন     পাগল স্নেহ-সুরধুনীর আগল ভাঙালি?         কোন্ জননির দুলাল রে তুই, কোন্ অভাগির হারামণি,           চোখ-ভরা তোর কাজল চোখে রে আহা    ছলছল কাঁদন চাওয়ার সজল ছায়া কালো মায়া           সারাখনই উছলে যেন পিছল ননি রে!           মুখভরা তোর ঝরনাহাসি           শিউলি সম রাশি রাশি আমার     মলিন ঘরের বুকে মুখে লুটায় আসি রে! বুক-জোড়া তোর ক্ষুদ্ধ স্নেহ দ্বারে দ্বারে কর হেনে যে যায় কেউ কি তারে ডাক দিল না? ডাকল যারা তাদের কেন                               দলে এলি পায়?    কেন আমার ঘরের দ্বারে এসেই আমার পানে চেয়ে এমন                     থমকে দাঁড়ালি?      এমন চমকে আমায় চমক লাগালি? এই কি রে তোর চেনা গৃহ, এই কিরে তোর চাওয়া স্নেহ হায়! তাই কি আমার দুখের কুটির হাসির গানের রঙে রাঙালি?      হে মোর    স্নেহের কাঙালি। এ সুর যেন বড়োই চেনা, এ স্বর যেন আমার বাছার, কখন সে যে ঘুমের ঘোরে হারিয়েছিনু হয় না মনে রে! না চিনেই আজ তোকে চিনি, আমারই সেই বুকের মানিক, পথ ভুলে তুই পালিয়ে ছিলি সে কোন ক্ষণে সে কোন বনে রে!         দুষ্টু ওরে, চপল ওরে, অভিমানী শিশু!        মনে কি তোর পড়ে না তার কিছু?        সেই অবধি জাদুমণি কত শত জনম ধরে      দেশ বিদেশে ঘুরে ঘুরে রে, আমি  মা-হারা সে কতই ছেলের কতই মেয়ের       মা হয়ে বাপ খুঁজেছি তোরে!           দেখা দিলি আজকে ভোরে রে!      উঠছে বুকে হাহা ধ্বনি        আয় বুকে মোর হারামণি, আমি  কত জনম দেখিনি যে ওই মু-খানি রে!    পেটে-ধরা নাই বা হলি, চোখে ধরার মায়াও নহে এ, তোকে পেতেই জন্ম জন্ম এমন করে বিশ্ব-মায়ের           ফাঁদ পেতেছি যে! আচমকা আজ ধরা দিয়ে মরা-মায়ের ভরা-স্নেহে হঠাৎ জাগালি।           গৃহহারা বাছা আমার রে!      চিনলি কি তুই হারা-মায়ে চিনলি কি তুই আজ?        আজকে আমার অঙ্গনে তোর পরাজয়ের বিজয়-নিশান           তাই কি টাঙালি?           মোর    স্নেহের কাঙালি।(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ) হিংসাতুর হিংসাই শুধু দেখেছ এ চোখে? দেখ নাই আর কিছু? সম্মুখে শুধু রহিলে তাকায়ে, চেয়ে দেখিলে না পিছু! সম্মুখ হতে আঘাত হানিয়া চলে গেল যে-পথিক তার আঘাতেরই ব্যথা বুকে ধরে জাগ আজও অনিমিখ? তুমি বুঝিলে না, হায়, কত অভিমানে বুকের বন্ধু ব্যথা হেনে চলে যায়!আঘাত তাহার মনে আছে শুধু, মনে নাই অভিমান? তোমারে চাহিয়া কত নিশি জাগি গাহিয়াছে কত গান, সে জেগেছে একা – তুমি ঘুমায়েছ বেভুল আপন সুখে, কাঁটার কুঞ্জে কাঁদিয়াছে বসি সে আপন মনোদুখে, কুসুম-শয়নে শুইয়া আজিকে পড়ে না সেসব মনে, তুমি তো জান না, কত বিষজ্বালা কণ্ঠক-দংশনে! তুমি কি বুঝিবে বালা, যে আঘাত করে বুকের প্রিয়ারে, তার বুকে কত জ্বালা!ব্যথা যে দিয়াছে – সম্মুখে ভাসে নিষ্ঠুর তার কায়া, দেখিলে না তব পশ্চাতে তারই অশ্রু-কাতর ছায়া!.. অপরাধ শুধু মনে আছে তার, মনে নাই কিছু আর? মনে নাই, তুমি দলেছ দুপায়ে কবে কার ফুলহার?কাঁদয়ে কাঁদিয়া সে রচেছে তার অশ্রুর গড়খাই, পার হতে তুমি পারিলে না তাহা, সে-ই অপরাধী তাই? সে-ই ভালো, তুমি চিরসুখী হও, একা সে-ই অপরাধী! কী হবে জানিয়া, কেন পথে পথে মরুচারী ফেরে কাঁদি!হয়তো তোমারে করেছে আঘাত, তবুও শুধাই আজি, আঘাতের পিছে আরও কিছু কি গো ও বুকে ওঠেনি বাজি? মনে তুমি আজ করিতে পার কি –তব অবহেলা দিয়া কত যে কঠিন করিয়া তুলেছ তাহার কুসুম-হিয়া? মানুষ তাহারে করেছ পাষাণ–সেই পাষাণের ঘায় মুরছায়ে তুমি পড়িতেছ বলে সেই অপরাধী হায়? তাহারই সে অপরাধ – যাহার আঘাতে ভাঙিয়া গিয়াছে তোমার মনের বাঁধ!কিন্তু কেন এ অভিযোগ আজি? সে তো গেছে সব ভুলে! কেন তবে আর রুদ্ধ দুয়ার ঘা দিয়া দিতেছে খুলে? শুষ্ক যে-মালা আজিও নিরালা যত্নে রেখেছে তুলি ঝরায়ো না আর নাড়া দিয়ে তার পবিত্র ফুলগুলি! সেই অপরাধী, সেই অমানুষ, যত পার দাও গালি! নিভেছে যে-ব্যথা দয়া করে সেথা আগুন দিয়ো না জ্বালি!‘মানুষ’, ‘মানুষ’শুনে শুনে নিতি কান হল ঝালাপালা! তোমরা তারেই অমানুষ বল – পায়ে দল যার মালা! তারই অপরাধ – যে তার প্রেম ও অশ্রুর অপমানে আঘাত করিয়া টুটায়ে পাষাণ অশ্রু-নিঝর আনে! কবি অমানুষ – মানিলাম সব! তোমার দুয়ার ধরি কবি না মানুষ কেঁদেছিল প্রিয় সেদিন নিশীথ ভরি? দেখেছ ঈর্ষা – পড়ে নাই চোখে সাগরের এত জল? শুকালে সাগর –দেখিতেছ তার সাহারার মরুতল! হয়তো কবিই গেয়েছিল গান, সে কি শুধু কথা – সুর কাঁদিয়াছিল যে – তোমারই মতো সে মানুষ বেদনাতুর! কবির কবিতা সে শুধু খেয়াল? তুমি বুঝিবে না, রানি, কত জ্বাল দিলে উনুনের জলে ফোটে বুদ‍্‍বুদ‍্-বাণী! তুমি কী বুঝিবে, কত ক্ষত হয়ে বেণুর বুকের হাড়ে সুর ওঠে হায়, কত ব্যথা কাঁদে সুর-বাঁধা বীণা-তারে!সেদিন কবিই কেঁদেছিল শুধু? মানুষ কাঁদেনি সাথে? হিংসাই শুধু দেখেছ, দেখনি অশ্রু নয়ন-পাতে? আজও সে ফিরিছে হাসিয়া গাহিয়া? –হায়, তুমি বুঝিবে না, হাসির ফুর্তি উড়ায় যে – তার অশ্রুর কত দেনা!   (চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ) হিন্দি গান ॥ ১॥          আজ বন-উপবন-মে           চঞ্চল মেরে মন-মে মোহন মুরলীধারী কুঞ্জ কুঞ্জ ফিরে শ্যাম।      সুনো মোহন নূপুর গুঁজত হ্যায়,           বাজে মুরলী বোলে রাধা নাম॥                কুঞ্জ কুঞ্জ ফিরে শ্যাম॥ বোলে বাঁশরি আও শ্যাম-পিয়ারি–           ঢুঁড়ত হ্যায় শ্যাম-বিহারী,           বনবালা সব চঞ্চল           ওড়াওয়ে অঞ্চল কোয়েল সখী গাওয়ে সাথ গুণধাম॥           কুঞ্জ কুঞ্জ ফিরে শ্যাম॥         ফুলকলি ভোলে ঘুংঘট খোলে পিয়াকি মিলনকি প্রেমকি বোলি বোলে,           পবন পিয়া লেকে সুন্দর সৌরভ           হাঁসত যমুনা সখী দিবস-যাম॥                কুঞ্জ কুঞ্জ ফিরে শ্যাম॥    ॥ ২॥ খেলত বায়ু ফুল-বনমে আও প্রাণ-পিয়া। আও মনমে প্রেম-সাথি আজ রজনি              গাও প্রাণ-প্রিয়া॥      মন-বনমে প্রেম মিলি      ভোলত হ্যায় ফুল-কলি,      বোলত হ্যায় পিয়া পিয়া।              বাজে মুরলিয়া॥    মন্দিরমে রাজত হ্যায় পিয়া তব মুরতি, প্রেম-পূজা লেও পিয়া, আও প্রেম-সাথি,         চাঁদ হাসে তারা সাথে         আও পিয়া প্রেম-রাথে, সুন্দর হ্যায় প্রেম-রাতি, আও মোহনিয়া।         আও প্রাণ-পিয়া॥॥ ৩॥ চক্র সুদর্শন ছোড়কে মোহন        তুম ব্যনে বনওয়ারি। ছিন লিয়ে হ্যায় গদা পদম সব        মিল করকে ব্রজনারী॥ চার ভুজা আব দো বানায়ে, ছোড়কে বৈকুন্ঠ ব্রিজ-মে আয়ে, রাস রচায়ে ব্রিজ-কে মোহন       ব্যন গয়ে মুরলীধারী॥    সত্যভামা-কো ছোড়কে আয়ে, রাধা-প্যারি সাথ-মে লায়ে, বৈতরণি-কো ছোড়কে ব্যন গয়ে       যমুনাকে তটচারী॥    ॥ ৪॥ তুম প্রেমকে ঘনশ্যাম            ম্যায় প্রেম কি শ্যাম প্যারি। প্রেম কা গান তুমহরে দান            ম্যায় হুঁ প্রেম-ভিখারি॥      হৃদয় বিচমে যমুনা-তীর      তুমহরি মুরলী বাজে ধীর,      নয়ন-নীর কী বহত যমুনা            প্রেমকে মাতোয়ারি॥ যুগ যুগ হোয়ে তুমহরি লীলা মেরে হৃদয়-বনমে। তুমহরে মোহন মন্দির পিয়া মোহত মেরে মনমে।         প্রেম-নদী-নীর নিত বহি যায়,      তুমহরে চরণ কো কাঁহু না পায়,      রোয়ে শ্যাম-প্যারি সাথে ব্রজনারী            আও মুরলীধারী॥    ॥ ৫॥ ঝুলন ঝুলায়ে ঝাউ ঝক ঝোরে,       দেখো সখী চম্পা লচকে। বাদরা গরজে দামিনী দমকে॥    আও ব্রজ-কি কুঙারি ওঢ়ে নীল শাড়ি, নীল কমল-কলিকে পহনে ঝুমকে॥ হাররে ধান কি লও মে হো বালি,       ওড়নি রাঙাও শতরঙ্গি আলি,       ঝুলা ঝুলো ডালি ডালি, আও প্রেম-কুঙারি মন ভাও, প্যারে প্যারে সুর-মে শাওনি সুনাও!    রিমঝিম রিমঝিম পড়ত কোয়ারে, সুন পিয়া পিয়া কহে মুরলী পুকারে,       ওহি বোলি-সে হিরদয় খটকে॥॥ ৬॥ ঝুলে কদমকে ডারকে ঝুলনা মে কিশোরী কিশোর। দেখে দোউ এক এক-কে মুখকো চন্দ্রমা-চকোর– য্যায়সা চন্দ্রমা চকোর হোকে প্রেম-নেশা বিভোর॥         মেঘ-মৃদং বাজে ওহি ঝুলনাকে ছন্দ্-মে,      রিমঝিম বাদর বরষে আনন্দ্-মে,      দেখনে যুগল শ্রীমুখ-চন্দ-কো            গগন ঘেরি আয়ে ঘনঘটা-ঘোর॥         নব নীর বরষণে কো চাতকী চায়,      ওয়সে গোপী ঘনশ্যাম দেখ তৃষ্ণা মিটায়;      সব দেবদেবী বন্দনা-গীত গায়–            ঝরে বরষা-মে ত্রিভুবন-কি আনন্দাশ্রু-লোর॥    ॥ ৭॥ প্রেমনগর-কা ঠিকানা কর-লে      প্রেমনগর-কা ঠিকানা। ছোড় কারিয়ে দো-দিন-কা ঘর      ওহি রাহ-মে জানা॥ দুনিয়া দওলত হ্যায় সব মায়া, সুখ-দুখ হ্যায় দো জগৎ কা কায়া,      দুখ-কো তু গলে লাগা লে–         আগে না পসতানা॥    আতি হ্যায় যব রাত আঁধারি– ছোড় তুম মায়া বন্ধন ভারি, প্রেম-নগর কি কর তৈয়ারি        আয়া হ্যায় পরোয়ানা॥    ॥ ৮॥ সোওত জগত আঁঠু জান রাহত প্রভু        মন-মে তুমহারে ধ্যান। রাত-আঁধেরি-সে চাঁদ সমান প্রভু        উজ্জ্বল কর মেরা প্রাণ॥    এক সুর বোলে ঝিওর সারে রাত– এ্যায়সে হি জপ তুহু তেরা নাম, হে নাথ! রুম রুম মে রম রহো মেরে        এক তুমহারা গান॥ গয়ি বন্ধু কুটুম স্বজন– ত্যজ দিনু ম্যায় তুমহারে কারণ, তুম হো মেরে প্রাণ-আধারণ–        দাসী তুমহারি জ্ঞান॥ (ঝড় কাব্যগ্রন্থ) হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ মাভৈঃ! মাভৈঃ! এতদিনে বুঝি জাগিল ভারতে প্রাণ    সজীব হইয়া উঠিয়াছে আজ শ্মশান গোরস্থান!      ছিল যারা চির-মরণ-আহত,      উঠিয়াছে জাগি’ ব্যথা-জাগ্রত,    ‘খালেদ’ আবার ধরিয়াছে অসি, ‘অর্জুন’ ছোঁড়ে বাণ।    জেগেছে ভারত, ধরিয়াছে লাঠি হিন্দু-মুসলমান!   মরিছে হিন্দু, মরে মুসলিম এ উহার ঘায়ে আজ,    বেঁচে আছে যারা মরিতেছে তারা, এ-মরণে নাহি লাজ।      জেগেছে শক্তি তাই হানাহানি,      অস্ত্রে অস্ত্রে নব জানাজানি।    আজি পরীক্ষা-কাহার দস্ত হয়েছে কত দারাজ!    কে মরিবে কাল সম্মুখে-রণে, মরিতে কা’রা নারাজ।       মূর্চ্ছাতুরের কন্ঠে শুনে যা জীবনের কোলাহল,    উঠবে অমৃত, দেরি নাই আর, উঠিয়াছে হলাহল।      থামিসনে তোরা, চালা মন্থন!      উঠেছে কাফের, উঠেছে যবন;    উঠিবে এবার সত্য হিন্দু-মুসলিম মহাবল।    জেগেছিস তোরা, জেগেছে বিধাতা, ন’ড়েছে খোদার কল।       আজি ওস্তাদে-শাগরেদে যেন শক্তির পরিচয়।    মেরে মেরে কাল করিতেছে ভীরু ভারতের নির্ভয়।      হেরিতেছে কাল,-কবজি কি মুঠি      ঈষৎ আঘাতে পড়ে কি-না টুটি’,    মারিতে মারিতে কে হ’ল যোগ্য, কে করিবে রণ-জয়!    এ ‘মক্‌ ফাইটে’ কোন্‌ সেনানীর বুদ্ধি হয়নি লয়!   ক’ ফোঁটা রক্ত দেখিয়া কে বীর টানিতেছে লেপ-কাঁথা!    ফেলে রেখে অসি মাখিয়াছে মসি, বকিছে প্রলাপ যা-তা!      হায়, এই সব দুর্বল-চেতা      হবে অনাগত বিপ্লব-নেতা!    ঝড় সাইক্লোনে কি করিবে এরা! ঘূর্ণিতে ঘোরে মাখা?    রক্ত-সিন্ধু সাঁতরিবে কা’রা-করে পরীক্ষা ধাতা।   তোদেরি আঘাতে টুটেছে তোদের মন্দির মসজিদ,    পরাধীনদের কলুষিত ক’রে উঠেছিল যার ভিত!      খোদা খোদ যেন করিতেছে লয়      পরাধীনদের উপাসনালয়!    স্বাধীন হাতের পূত মাটি দিয়া রচিবে বেদী শহীদ।    টুটিয়াছে চূড়া? ওরে ঐ সাথে টুটিছে তোদের নিঁদ!   কে কাহারে মারে, ঘোচেনি ধন্দ, টুটেনি অন্ধকার,    জানে না আঁধারে শত্রু ভাবিয়া আত্মীয়ে হানে মার!      উদিবে অরুণ,ঘুচিবে ধন্দ,      ফুটিবে দৃষ্টি, টুটিবে বন্ধ,    হেরিবে মেরেছে আপনার ভায়ে বদ্ধ করিয়া দ্বার!    ভারত-ভাগ্য ক’রেছে আহত ত্রিশূল ও তরবার!   যে-লাঠিতে আজ টুটে গম্বুজ, পড়ে মন্দির-চূড়া,    সেই লাঠি কালি প্রভাতে করিবে শত্রু-দুর্গ গুঁড়া!      প্রভাতে হবে না ভায়ে-ভায়ে রণ,      চিনিবে শত্রু, চিনিবে স্বজন।    করুক কলহ-জেগেছে তো তবু-বিজয়-কেতন উড়া!    ল্যাজে তোর যদি লেগেছে আগুন, স্বর্ণলঙ্কা পুড়া! হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক হিন্দু-মুসলিম দুটি ভাই ভারতের দুই আঁখি তারা এক বাগানে দুটি তরু দেবদারু আর কদম চারা।।যেন গঙ্গা সিন্ধু নদী যায় গো বয়ে নিরবধি এক হিমালয় হতে আসে, এক সাগরে হয় গো হারা।।বুলবুল আর কোকিল পাখী এক কাননে যায় গো ডাকি, ভাগীরথী যমুনা বয় মায়ের চোখের যুগল ধারা।।ঝগড়া করে ভায়ে ভায়ে এক জননীর কোল লয়ে মধুর যে এ কলহ ভাই পিঠোপিঠী ভায়ের পারা।।পেটে ধরা ছেলের চেয়ে চোখে ধরারা মায়া বেশী, অতিথী ছিল অতীতে, আজ সে সখা প্রতিবেশী। ফুল পাতিয়ে গোলাপ বেলী একই মায়ের বুকে খেলি, পাগলা তা'রা আল্লা ভগবানে ভাবে ভিন্ন যারা।। হুল ও ফুল ওরা কয়, ‘আগে ফুল ফুটাইতে,                     এখন ফুটাও হুল!’ আমি কই, ‘যদি হুল না ফুটাই                      ফুটিবে কি তবে fool?’ বন্ধু, মিথ্যা অপত্য-স্নেহে                           আপত্তি নাহি করি ধর্ম লয়েছে অধর্ম নাম,                           সত্য গিয়াছে মরি! গাঁয়ের বউঝি জল নিতে যায়                       মেছুড়ে বুঝিতে নারে, গাল দেয় রেগে – ইহাদেরই দোষে                    মাছ বসে নাকো চারে! ভোগী বলে, ‘বাবা, কেন কাঁদ তুমি,                 মামা নহে তব চাষা, ধনীর দুঃখ দেখ নাকো, একী                       একঘেয়ে ভালোবাসা!’ ‘আল্লা বলান’ বলি। ওরা বলে –                    ‘দালানে তা আসে কেন? টাকাওয়ালাদের কী করে চিনিলে,                     তুমি তো আল্লা চেন!’ ওরা বলে, ‘মোরা টাকার পুকুর                     দুয়ারে খুঁড়িয়া রাখি, উহারাই তার দু-এক কলশি                         জল ভরে নেয় নাকি?’ আরও বলে, ‘দিই কলশিতে জল                     দিই না তো সাথে দড়ি, আমরা কী জানি, কেন এ পুকুরে                     ওরা ডুবে যায় মরি?’ ওরা বলে, ‘চাষা খাইতে পায় না–                    আর জন্মের পাপ, পাওনা সুদের নালিশ করিলে                         ওরা কেন দেয় শাপ?’ মোরা যত দিই উত্তর তার                          ওরা ‘দুত্তোর’ কহে, বলে ‘জমিদারি স্বত্ব আমার,                         তোমার মামার নহে।’ মোরা বলি, ‘কত ইম্পিরিয়াল                        ব্যাংকে তোমার টাকা!’ ওরা বলে, ‘কোনো কাজে তা লাগে না,                (বাবা) ফিক্‌স্‌ড ডিপোজিটে রাখা!’ মোরা বলি, ‘মোরা যাব না, মোদের                  প্রাপ্য যা তা না পেলে!’ ওরা বলে, ‘কেন জেলে যাবে, বাবা,                  ভদ্রলোকের ছেলে!’ আমি বলি, ‘জাগ, দৈত্যরে মার,                    দা নিয়ে দুয়ার খুল।’ ওরা বলে, ‘বাঘ হলে কেন বন-                     বাগিচার বুলবুল?’ আমি বলি, ‘কেন অসত্য বল,                      ভ্রান্ত পথ দেখাও?’ ওরা বলে, ‘আহ্‌‌, চুপ করো কবি,                   ফুল শোঁকো, মধু খাও!’ আমি বলি, ‘চোর ঢুকিয়াছে ঘরে,                    মারো তারে পায়ে দলে!’ ওরা বলে, ‘বাঁশুরিয়া! বাঁশি কেন                    বংশদণ্ড হলে!’ ওরা বলে, ‘দাদা, এতদিন তুমি                      বেশ তো ঘুমায়ে ছিলে! কখন হইল ‘ইনসমনিয়া’?                          সারা দেশ জাগাইলে!’ আমি বলি, ‘দেশ জাগে যদি, কেন                   তোমাদের ডর লাগে?’ ওরা বলে, ‘আসে রাম-দা লইয়া।                    রামদা বলিত আগে!’ কে যে বলে ঠিক, কে বলে বেঠিক,                  ঠিকে ভুল হয় কার? চাষা ও মজুরে ঠকাইয়া খায়                        দুনিয়ার ঠিকাদার! ‘ওরা তো বলে না, তুমি কেন বল,                  কেন তব মাথাব্যথা?’ জিজ্ঞাসে সাধু। – আমি বলি, ‘কহে                   ওদেরই আত্মা কথা!’ হায় রে দুনিয়া দেখি মৌলানা                        মৌলবিতে একাকার, আমি একা হেথা কাফের রে দাদা                     আমি একা গুনাগার! গুনাগারি দেয় বণিকেরা নাকি,                      চাষারাই করে লাভ, ধনী যেন সদা তৃষিত, এবং                        চাষা সদা কচি ডাব! শুনেছি সেদিন ধনিক-সভায়–                       নতুন আইন হবে, চাষাদের দা, দাঁত আর নখ                        খেঁটে লাঠি নাহি রবে। আমি বলি, ‘হয়ে অভাবে স্বভাব                     নষ্ট, হয়েছে চোর!’ ওরা বলে, ‘তাই বল, তাই চুরি                     হয় না বাড়িতে তোর!’ আমি বলি, ‘খেয়ো না এ কদন্ন,                     হালালি অন্ন খাও!’ ওরা বলে, ‘তুমি এদেরই দালালি                     করে বুঝি টাকা পাও?’ ‘যার যত তলা দালান, সে তত                     আল্লা-তালার প্রিয়–’ ওরা কয়। আমি বলি, ‘বেশ করে                    সে তালায় তালা দিয়ো!’ আমি ভিক্ষুক কাঙালের দলে –                       কে বলে ওদের নীচ? ভোগীরা স্বর্গে যাবে, যদি খায়                       ওদের পানের পিচ! ওরা হাসে, ‘এ কি কবিতার ভাষা?                   বস্তিতে থাক বুঝি?’ আমি কই, ‘আজও পাইনি পুণ্য-                     বস্তির পথ খুঁজি! দোওয়া করো, যেন ওই গরিবের                     কর্দমাক্ত পথে যেতে পারি, এই ভোগ-বিলাসীর                      পাপ-নর্দমা হতে!’   (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ) হেমপ্রভা কোন অতীতের আঁধার ভেদিয়া           আসিলে আলোক-জননি। প্রভায় তোমার উদিল প্রভাত           হেম-প্রভ হল ধরণি॥         ভগ্ন দুর্গে ঘুমায়ে রক্ষী      এলে কি মা তাই বিজয়-লক্ষ্মী, ‘মেয়্ ভুখা হুঁ’-র ক্রন্দন-রবে           নাচায়ে তুলিলে ধমনি ॥    এসো বাংলার চাঁদ-সুলতানা           বীর-মাতা বীর-জায়া গো॥ তোমাতে পড়েছে সকল কালের বীর-নারীদের ছায়া গো॥         শিব-সাথে সতী শিবানী সাজিয়া      ফিরিছ শ্মশানে জীবন মাগিয়া,      তব আগমনে নব-বাংলার           কাটুক আঁধার রজনি॥ (ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ) হোঁদলকুতকুতের বিজ্ঞাপন মিচকে-মারা কয় না কথা মনটি বড়ো খুঁতখুঁতে। ‘ছিঁচকাঁদুনে’ ভ্যাবিয়ে ওঠেন একটু ছুঁতেই না ছুঁতে। ড্যাবরা ছেলে ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে থেকে গাল ফুলান, সন্দেশ এবং মিষ্টি খেতে – বাসরে বাস – এক জাম্বুবান! নিম্নমুখো-যষ্টি ছেলে দশটি ছেলে লুকিয়ে খান, বদমায়েশির মাসি পিসি, আধখানা চোখ উঁচিয়ে চান! হাঁদারা হয় হদ্দ বোকার, সব কথাতেই হাঁ করে! ডেঁপো চতুর আধ-ইশারায় সব বুঝে নেয় ঝাঁ করে! ভোঁদা খোকার নামটি ভুঁদো বুদ্ধি বেজায় তার ভোঁতা। সব চেয়ে ভাই ইবলিশ হয় যে ছেলেদের ঘাড় কোঁতা। পুঁয়ে-লাগা সুঁটকো ছেলে মুখটা সদাই মুচকে রয়! পেটফুলো তার মস্ত পিলে, হাত-পাগুলোও কুঁচকে রয়! প্যাঁটরা ছেলের য়্যাব্বড়ো পেট, হাত নুলো আর পা সরু! চলেন যেন ব্যাংটি হো হো উ-র্ গজ-ঢাক গাল পুরু! গাবদা ছেলের মনটি সাদা একটুকুতেই হন খুশি, আদর করে মা তারে তাই নাম দিয়েছেন মনটুসি। ষাঁড়ের নাদ সে নাদুস নুদুস গোবর-গণেশ যে শ্রীমান, নাঁদার মতন য়্যাভ ভুঁড়ি তাঁর চলতে গিয়ে হুমড়ি খান! ছ্যাঁচড় ছেলে বেদড় ভারি ধুমসুনি খায় সব কথায়। উদমো ছেলে ছটফটে খুব একটুকুতেই উতপুতায়! ফটকে ছেলে ছটকে বেড়ায় আঁটি তারা বজ্জাতের, দুষ্টু এবং চুলবুলেরা সবখানে পায় লজ্জা ঢের। বোঁচা-নাকা খাঁদা যে হয় নাম রেখো তার চামচিকে, এসব ছেলে তেঁদড় ভারী ডরায় না দাঁত-খামচিকে! টুনিখুকির মুখটি ছোটো টুনটুনি তার মন সরল, ময়না-মানিক নাম যার ভাই মনটি তারও খুব তরল! গাল টেবো যাঁর নাম টেবি তাঁর একটুকুতেই যান রেগে। কান-খড়কে মায়ের লেঠা, রয় ঘুমুলেও কান জেগে। খুদে খুকির নামটি টেপু মা-দুলালি আবদেরে। ডর-পুকুনে আঁতকে ওঠে নাপতে দেখে আঁক করে! পুঁটুরানি বাপ-সোহাগি, নন্দদুলাল মানিক মা-র, দাদু বুড়োর ন্যাওটা যে ভাই মটরু ছাগল নামটি তার! ভুতো ছেলে ঠগ বড়ো হয়, ভয় করে না কাউকে সে, নাই পরোয়া যতই কেন কিল আর থাপড় দাও ঠেসে। দস্যি ছেলে ভয় করে না চোখ-রাঙানি ভূত-পেরেত, সতর-চোখি জুজুর খোঁজে বেড়িয়ে বেড়ায় রাত বিরেত! ডানপিটেরা ঝুলঝাপপুর গুলি-ডাণ্ডায় মদ্দ খুব! বাঁদরা-মুখোর ভ্যাংচিয়ে মুখ দাঁত খিঁচে বে-হদ্দ হুব! বীর বাদল সে – দেশের তরে প্রাণ দিতে ভাই যে শিখে, আনবে যে সাত-সাগর-পারের বন্দিনী দেশ-লক্ষ্মীকে! কেউ যদি ভাই হয় তোমজদের এমনিতরো মর্দ ফেরো, হো হো! তাকে পাঠিয়ে দেব বাচ্চা হোঁদল কুতকুতের!  (ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ) হোলি আয় লো সই খেলব খেলা           ফাগের ফাজিল পিচকিরিতে। আজ শ্যামে জোর করব ঘায়েল           হোরির সুরের গিটকিরিতে।      বসন ভূষণ ফেল লো খুলে,      দে দোল দে দোদুল দুলে,      কর লালে লাল কালার কালো           আবির হাসির টিটকিরিতে॥(পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ) "প্রণয়?" "ছি!" "ভালবাসা---প্রেম?" "তাও নয় |" "সে কি তবে?" .        "দিও নাম, দিই পরিচয়--- আসক্তি বিহীন শুদ্ধ ঘন অনুরাগ, আনন্দ সে নাহি তাহে পৃথিবীর দাগ ; আছে গভীরতা আর উদ্বেল উচ্ছ্বাস, দু'ধারে সংযম-বেলা, ঊর্দ্ধে নীল আকাশ, উজ্জ্বল কৌমুদীতলে অনাবৃত প্রাণ, বিম্ব প্রতিবিম্ব কার প্রাণে অধিষ্ঠান ; ধরার মাঝারে থাকি ধরা ভুলে যাওয়া, উন্নত-কামনা-ভরে ঊর্দ্ধ দিকে চাওয়া ; পবিত্র পরশে যার, মলিন হৃদয়, আপনাতে প্রতিষ্ঠিত করে দেবালয়, ভকতি বিহ্বল, প্রিয় দেব-প্রতিমারে প্রণমিয়া দূরে রহে, নারে ছুঁইবারে ; আলোকের আলিঙ্গনে, আঁধারের মত, বাসনা হারায়ে যায়, দুঃখ পরাহত ; জীবন কবিতা-গীতি, নহে আর্তনাদ, চঞ্চল নিরাশা, আশা, হর্ষ, অবসাদ | আপনার বিকাইয়া আপনাতে বাস, আত্মার বিস্তার ছিঁড়ি' ধরণীর পাশ | হৃদয়-মাধুরী সেই, পূণ্য তেজোময়, সে কি তোমাদের প্রেম?---কখনই নয় | শত মুখে উচ্চারিত, কত অর্থ যার, সে নাম দিও না এরে মিনতি আমার |" স্মৃতিচিহ্ন ওরা ভেবেছিল মনে আপনার নাম মনোহর হর্ম্মরূপে বিশাল অক্ষরে ইষ্টক প্রস্তরে রচি চিরদিন তরে রেখে যাবে ! মূঢ় ওরা, ব্যর্থ মনস্কাম। প্রস্তর খসিয়াছে ভূমে প্রস্তরের পরে, চারিদিকে ভগ্নস্তূপ, তাহাদের তলে লুপ্ত স্মৃতি ; শুষ্ক তৃণ কাল-নদী-জলে ভেসে যায় নামগুলি, কেবা রক্ষা করে! মানব হৃদয় ভুমি করি অধিকার, করেছে প্রতিষ্ঠা যারা দৃঢ় সিংহাসন, দরিদ্র আছিল তারা, ছিল না সম্বল প্রস্তরের এত বোঝা জড় করিবার ; তাদের রাজত্ব হের অক্ষুণ্ণ কেমন কাল স্রোতে ধৌত নাম নিত্যসমুজ্জ্বল।