label
stringclasses
16 values
text
stringlengths
3.73k
6k
is_valid
bool
1 class
shomresh
যেন। থানার সামনে যে এসটিডি বুথ রয়েছে সেখান থেকে মাকে ফোন করল অর্জুন। থানা থেকেই করতে পারত, তখন মনে ছিল না। মা জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার রে? আমার ফিরতে একটু রাত হবে। তুমি শুয়ে পড়ে। তুই কোত্থেকে বলছিস? থানার সামনে থেকে। এক্ষুনি বাড়ি চলে আয়। কেন? ওঁরা এসেছেন। মা গলা নামালেন। কারা? ওই যে, আমেরিকা থেকে যাঁরা এসেছেন। দুটো টাকা ছেলেটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে অর্জুন বাড়ির দিকে রওনা হল। মেজর এবং গোরানসাহেব তার বাড়িতে? হঠাৎ! ওঁরা কেউ বলেননি যে যাবেন। দরজা খোলাই ছিল। মেজরের উঁচু গলা গলি থেকেই শোনা যাচ্ছিল। খুব প্রশংসা করছেন তিনি। অর্জুন ঘরে ঢুকতেই মা বললেন, আয়। মেজর জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় ঘুরে বেড়াও বলো তো? অর্জুন ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, আপনারা আসবেন বলেননি তো! মেজর বললেন বাংলায়, আরে। ওই টিফিন ক্যারিয়ার কি সার্কিট হাউসে পড়ে থাকবে? বাড়িতে তো কেউ দশটা ওই জিনিস রাখে না। যদি প্রয়োজন হয় তা হলে তোমার মা কী করবেন? বোঝ! ওঁরা ওটা ফেরত দিতে এসেছেন। মা বললেন। কতক্ষণ? অর্জুন জিজ্ঞেস করল। আধঘণ্টা হয়ে গেল। মেজর বললেন। গোরানসাহেব চুপচাপ শুনছিলেন। বাংলায় কথা হলে তিনি যে কিছুই বুঝতে পারছেন না তা কিন্তু বুঝতে দিচ্ছেন না। এখন ওঁর মুখে সেই বীভৎস অভিব্যক্তি নেই। বেশ শান্তমুখে বসে আছেন এখন। অর্জুন ঘড়ি দেখল, আপনারা গাড়িটাকে কখন আসতে বলেছেন? এসে গেছে। তাতে চড়েই তোমাদের এখানে এলাম। বড় রাস্তায় রাখতে বলেছি, গলিতে ঢোকাইনি। আমরা তো ট্রেন ধরতে যাচ্ছি না। কথাগুলো বলে মায়ের দিকে তাকালেন মেজর। মা হেসে ভেতরে ঢুকে গেলেন। গোরানসাহেব এবার কথা বললেন, আজকে যদি তেমন কিছু না ঘটে তা হলে আমার মনে হয় কালই রওনা হওয়া ভাল। ঠিক। মেজর মাথা নাড়লেন, অর্জুন, এখান থেকে হাসিমারায় যেতে কতক্ষণ লাগবে? রাস্তা ভাল নয়। অন্তত আড়াই-তিন ঘণ্টা ধরে নিতে পারেন। বাঃ। তা হলে আমরা বেলা বারোটা নাগাদ রওনা হতে পারি। কথাবার্তা ইংরেজিতে হচ্ছিল। গোরানসাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কালকে ওখানে গিয়ে কোনও হোটেল বা গেস্ট হাউসে নিশ্চয়ই ওঠা যাবে? অর্জুন মাথা নাড়ল, না। ওদিকে হোটেল আছে ফুন্টশলিং-এ। হাসিমারার আধঘণ্টা দূরে। শহরটা ভুটানের বর্ডারে। কিন্তু ডাকবাংলো আছে, ফরেস্ট বাংলো পাবেন। মনে হয় খালি পাওয়া যাবে। গোরানসাহেব বললেন, না পাওয়া গেলেও ক্ষতি নেই, আমাদের সঙ্গে টেন্ট আছে। আশা করি টেন্টে থাকতে তোমার অসুবিধে হবে না। আমার? অবাক হল অর্জুন। হ্যাঁ। মেজর বলেছেন তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন। তাই তো? এটা তো বলার দরকার পড়ে না। উত্তরবাংলায় অভিযান করব আর তুমি সঙ্গে থাকবে না এটা আমি ভাবতেই পারি না। মেজর হাসলেন। এই সময় মা একটা ট্রে হাতে ঢুকলেন। তাতে বড়বড় চিনেমাটির বাটিতে গাঢ় পায়েস থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। পায়েসের বুকে কিশমিশ ফুলে উঠেছে। মেজর চিৎকার করে উঠলেন, গ্র্যান্ডি? অর্জুন অবাক হয়ে গেল। মায়ের সঙ্গে মেজরের কথা হয়েছে এবং তার ফলে হল এই পায়েস। মেজর তখন গোরানসাহেবকে নিয়ে পড়েছেন, এটাকে বলে পায়েস। অমৃত। তোমাদের দেশে এ-জিনিস পাবে না। এর চেয়ে ভাল ডিনার আমি আর কিছুই আশা করতে পারি না। মা বললেন,তোরা অনেকদূরে যাবি। ফিরতে রাত হলে তো খাবি না। তাই একটু পায়েস করে দিলাম। নলেন গুড় বাড়িতে ছিল— কেমন হয়েছে কে জানে? মেজর এবং গোরানসাহেব একসঙ্গে প্রশংসা শুরু করলেন। ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে গেল যে, মা লজ্জা পেয়ে ভেতরে চলে গেলেন। বেরোবার সময় মা জিজ্ঞেস করলেন, তোরা কতদূরে যাচ্ছিস? হুতুমপুর। অর্জুন জবাব দিল। সে আবার কোথায়? এখান থেকে ঘণ্টাখানেক। কারও সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিস? হ্যাঁ। অর্জুন আর কথা বাড়াল না। গোরানসাহেব যাদের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন তাদের কথা শুনলে মা চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করবেন। জীবনে আর কখনও মেজরদের বেঁধে কিছু খাওয়াবেন না। বাঙালি মায়েরা এখনও বিশ্বাস করেন তেনাদের সঙ্গে মজা করা ঠিক নয়। কখন কী হয়ে যাবে কিছুই বলা যায় না। অর্জুন ড্রাইভারের পাশে বসে ছিল। হাইওয়ের দিকে যেতে-যেতে ড্রাইভার বলল, এত রাত্রে আপনারা যেতে চাইলেন, আমি টাকার লোভে না বললাম না। কিন্তু–। কি-কিন্তু? মেজর পেছন থেকে খেকিয়ে উঠলেন। খুব ডাকাতি হচ্ছে সার। হাইওয়েতে এখন ডাকাতি লেগেই আছে। অর্জুন মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, হয়েছে। কিন্তু এখন আর হবে না। আপনি কী বলছেন সার? কাল রাত্রেও হয়েছে। বললাম তো, আর হবে না। আপনি শোনেননি বোধ হয়। একটা বেড়াল এসে রাস্তা কাটে, গাড়ি দাঁড়িয়ে যায়, আর তখনই ডাকাতরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। ড্রাইভার জোর করে বোঝাবেই। পড়লে পড়বে। আমাদের সঙ্গে আছেটা কী যে, ডাকাতি করবে। মেজর প্রসঙ্গটা থামাতে চাইলেন, তা ছাড়া আমাকে তুমি ডাকাত দেখিও না। জীবনে কত ডাকাত দেখলাম। সেবার সাহারার বুটে টেন্ট খাটিয়ে বসে সবে হুইস্কিতে চুমুক মেরেছি, সঙ্গে সঙ্গে উটের পিঠে চেপে কালিবান ডাকাতরা এসে হাজির। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কী বললেন কথাটা? তালিবান, না কালিবান? কালিবান। তালিবানরা আফগানিস্তানে, কালিবান সাহারায়। গুলিয়ে ফেলো না। একা, বুঝলে, স্রেফ একা এই হুইস্কির বোতল হাতে নিয়ে এমন বক্তৃতা দিলাম যে, ব্যাটারা হাত পেতে বসে পড়ল। সবাইকে হুইস্কি খাওয়াতে খুশি হয়ে চলে গেল। আমাকে ডাকাত দেখাতে এসেছ? মেজরের কথা শেষ হতেই অর্জুন বলল, তোমার ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। যারা ডাকাতি করছিল তারা একটু আগে ধরা পড়েছে। আমাদের শহরে? হ্যাঁ। রেসকোর্স পাড়ার সন্দীপকে চেনো? আই বাপ! অত বড়লোকের
false
nihar_ronjon_gupta
কী এখন সে করবে? কোন পথে কাজ শুরু করবে? ধাংলোয় ফিরে খনির কর্তা সুধাময় চৌধুরীর কাছে একটা জরুরী তার করে দিল। পুঁটলি রহস্য সুব্রত এসে বাংলোয় নিজের ঘরে ঢুকল। নানা এলোমেলো চিন্তায় সেও যেন দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ব্যাপারটা নিছক একটা অ্যাকসিডেণ্ট না অন্য কিছু। কিন্তু সবচাইতে আশ্চর্য, লোক গেল কি করে খাদের মধ্যে। নাঃ ব্যাপারটাকে যতটা সহজ ভাবা গিয়েছিল, এখন দেখা যাচ্ছে ঠিক ততটা নয়। চাকরকে এককাপ গরম চা দিতে বলে শংকর ইজিচেয়ারটার ওপরে গাটা ঢেলে দিয়ে চোখ বুজে চিন্তা করতে লাগল। চিন্তা করতে করতে কখন এক সময় জাগরণ-ক্লান্ত দুচোখের পাতায় ঘুমের চুলুনি নেমেছে তা ও টেরই পায়নি। ভৃত্যের ডাকে চোখ রাগড়াতে রগড়াতে উঠে বসল। বাবুজি, চা। ভৃত্যের হাত থেকে ধূমায়িত চায়ের কাপটা নিয়ে সামনের একটা টিপিয়ের ওপরে সুব্রত নামিয়ে রাখল। তৃত্য ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল। খোলা জানোলা পথে রৌদ্র কলঙ্কিত শীতের সুন্দর প্রভাত। দূরে কালো পাহাড়ের অস্পষ্ট ইশারা। ওদিকে ট্রাম লাইনে পর-পর কয়খানা খালি টবগাড়ি-কয়েকটা সাঁওতাল যুবক সেখানে দাঁড়িয়ে জটলা পাকাচ্ছে। চা পান শেষ করে সুব্রত উঠে গিয়ে ঘরের দরজাটা এঁটে জামার পকেট থেকে খনির মধ্যে কুড়িয়ে পাওয়া ন্যাকড়ার ছোট্ট পুটলিটা বের করল। একটা আধময়লা রুমালের ছোট পুঁটলি। কম্পিত হস্তে সুব্রত পুঁটলিটা খুলে ফেলল। পুঁটলিটা খুলতেই তার মধ্যকার কয়েকটা জিনিস চোখে পড়ল। একটা মাঝারি গোছের ডিনামাইট, একটা পলতে, একটা টর্চ!… আশ্চর্য, এগুলো খনির মধ্যে কেমন করে গেল। ডিনামাইট কেন?…সুব্রত ভাবতে লাগল। ডিনামাইট সাধারণতঃ খাদের মধ্যে বড় বড় কয়লার চাংড়া ধ্বসাবার জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সঙ্গে পলতেও একটা দেখা যাচ্ছে। এই ডিনামাইটের সঙ্গে পলতের সাহায্যে আগুন ধরিয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বড় বড় কয়লার চাংড়া ধ্বসানোর সুবিধা হয়। টর্চ।…এটা বোধ হয়। অন্ধকারে পথ দেখাবার জন্য। তবে কি কেউ গোপনে রাত্রে এই সব সরঞ্জাম নিয়ে খাদে গিয়েছিল কয়লার চাংড়া ধ্বসাতে?..নিশ্চয়ই তাই-কিন্তু ধ্বসাতেই যদি কেউ গিয়ে থাকবে। তবে, এগুলো সেখানে ফেলে এলো কেন?–তবে কি ধ্যবসায়নি? না ধ্বসিয়ে চলে এসেছিল?-কিন্তু এমনও তো হতে পারে আরো ডিনামাইট, আরো পলতে ছিল, একটায় যদি না হাসিল হয় তবে এটার দরকার হতে পারে এই ভেবে বেশী ডিনামাইট নিয়ে যাওয়া হয়েছিল? তারপর হয়ত একটাতেই কাজ হয়ে যেত, এটার আর দরকার হয়নি, তাড়াতাড়িতে এটা ফেলেই চলে এসেছে।—কিন্তু কোন পথ দিয়ে লোকটা খনির মধ্যে ঢুকল। ঢুকবার তো মাত্র একটিই পথ। চানকের সাহায্যে! চানকের চাবী কার কাছে থাকে? আবদুল মিস্ত্রি বললে তার কাছেই থাকে। চাবীটা এমন কোন মূল্যবান চাবী নয়, বা কোন প্রাইভেট ঘরের চাবী নয়, সামান্য চানকের চাবী।-চাবীটা রাত্রে চুরি করা এমন কোন কঠিন ব্যাপার নয়। এবং কাজ শেষ হয়ে যাবার পর যথাস্থানে চাবীটা আবার রেখে আসাও দুঃসাধ্য ব্যাপার নয়…তাহলে দেখা যাচ্ছে ভূত নয়। মানুষেরই কাজ। কিন্তু এর সঙ্গে লোকগুলো মারা যাবার কী সম্পর্ক আছে? তবে কি।–সহসা চিন্তার সূত্র ধরে একটা কথা সুব্রতর মনের কোঠায় এসে উঁকি দিতেই, সুব্রতর মুখটা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। নিশ্চয়ই তাই।–কিন্তু রুমালটা? রুমালটা কার?–সুব্রত রুমালখানি সজাগ দৃষ্টির সামনে তুলে ধরে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করতে লাগল। রুমালখানি আকারে ছোটই। হাতে সেলাই করা সাধারণ লংকুথের টুকরো দিয়ে তৈরী রুমাল। রুমালে একধারে ছোট অক্ষরে লাল সূতায় ইংরাজি অক্ষর , . এক কোণে ধোপার চিহ্ন রয়েছে।… সুব্রতর মাথার মধ্যে চিন্তাজাল জন্ট পাকাতে লাগল। কবি রুমাল! কার রুমাল! , নামের। যার তার পুরো নাম কি হতে পারে? শশাঙ্ক, শংকর, শশধর, শরদিন্দু, শরৎ, শশি, শচীন, শৈলেশ কিংবা সনৎ, সুকুমার, সমীর, সুধাময়। কে! কে! কিন্তু এমনও তো হতে পারে অন্য কারো রুমাল চুরি করে আনা হয়েছিল, তবে? …সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। যোগসূত্র এলোমেলো হয়ে কেমন যেন জট পাকিয়ে যায়। হ্যাঁ, ঠিক ঠিক…আসতেই হবে! সে আসবে! আসবে! অবশ্যম্ভাবী একটা আশু ঘটনার সম্ভাবনায় সুব্রতর সর্বশরীর সহসা যেন রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে! সুব্ৰত চেয়ার ছেড়ে ওঠে, ঘরের মধ্যে পায়চারী শুরু করে দেয় দীর্ঘ পা ফেলে ফেলে। বাইরে গোলমাল শোনা গেল। পুলিশের লোক এসে গেছে অদূরবর্তি কাতরাসগড় স্টেশন থেকে। চঞ্চলপদে পুঁটলিটা আবার পূর্বের মত বেঁধে সুব্রত সেটা নিজের সুটকেসের মধ্যে ভরে রেখে দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে এল। দারোগাবাবু সকলের জবানবন্দী নিয়ে, ধাওড়ার লাস ময়না তদন্তের জন্য চালান দিয়ে খাদের লাসগুলো উদ্ধারের একটা আশু ব্যবস্থা করবার জন্য শংকরবাবুকে আদেশ দিয়ে চলে গেলেন। সুব্রত যাবার সময় তার পরিচয় দিয়ে দারোগাবাবুকে অনুরোধ জানাল : এখানে ইতিপূর্বে যে সব ম্যানেজারবাবু খুন হয়েছেন তঁদের ময়না তদন্তের রিপোর্টগুলো সংক্ষেপে মোটামুটি যদি জানান। তবে তার বড্ড উপকার হয়। দারোগাবাবু সুব্রতর পরিচয় পেয়ে অত্যন্ত খুশী হলেন এবং যাবার সময় বলে গেলেন, নিশ্চয়ই, একথা বলতে। আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে কত যে খুশী হলাম। কালই আপনাকে রিপোর্ট একটা মোটামুটি সংগ্রহ করে লিখে পাঠাব। সুব্রত বললে, আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। পুলিশের লোক হয়েও যে আপনি এত উদার, সত্যই আশ্চর্যের বিষয়। কিরিটী যদি এখানে আসে। তবে নিশ্চয়ই আপনার কাছে সংবাদ পাঠাবো। এসে আলাপ করবেন। আচ্ছা! নমস্কার। আঁধার রাতের পাগল সুব্রত শংকরবাবুর সঙ্গে গোপন পরামর্শ করে অলক্ষ্যে চানকের ওপরে দুজন সাঁওতালকে সর্বক্ষণ পাহারা দেবার জন্য নিযুক্ত করল। বিকালের দিকে সুধাময়বাবুর সেক্রেটারী কলকাতা থেকে তার করে জবাব দিলেনঃ কর্তা বর্তমানে কলকাতায় নেই। তিনি যা ভাল বোঝেন তাই করুন। কর্তা কলকাতায় ফিরে
false
shorotchandra
সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়া ছিলেন। তাঁহার মাথার উপর আঁচল ছিল কিন্তু মুখখানি অনাবৃত। রমেশ দেখিল, জ্যাঠাইমা আপনিই কখন আসিয়াছেন—তাহাকে ত্যাগ করেন নাই। বাহিরের লোক দেখিল ইনিই বিশ্বেশ্বরী, ইনিই ঘোষাল-বাড়ির গিন্নীমা। পল্লীগ্রামে শহরের কড়া পর্দা নাই। তত্রাচ বিশ্বেশ্বরী বড়বাড়ির বধূ বলিয়াই হোক কিংবা অন্য যে-কোন কারণেই হোক, যথেষ্ট বয়ঃপ্রাপ্তিসত্ত্বেও সাধারণতঃ কাহারো সাক্ষাতে বাহির হইতেন না। সুতরাং সকলেই বড় বিস্মিত হইল। যাহারা শুধু শুনিয়াছিল, কিন্তু ইতিপূর্বে কখনো চোখে দেখে নাই, তাহারা তাঁহার আশ্চর্য চোখ-দুটির পানে চাহিয়া একেবারে অবাক হইয়া গেল। বোধ করি, তিনি হঠাৎ ক্রোধবশেই বাহির হইয়া পড়িয়াছিলেন। সকলে মুখ তুলিবামাত্রই তিনি তৎক্ষণাৎ থামের পার্শ্বে সরিয়া গেলেন। সুস্পষ্ট তীব্র আহ্বানে রমেশের বিহ্বলতা ঘুচিয়া গেল। সে সম্মুখে অগ্রসর হইয়া আসিল। জ্যাঠাইমা আড়াল হইতে তেমনি সুস্পষ্ট উচ্চকণ্ঠে বলিলেন, গাঙ্গুলীমশায়কে ভয় দেখাতে মানা করে দে রমেশ! আর হালদারমশায়কে আমার নাম করে বল্‌ যে, আমি সবাইকে আদর করে বাড়িতে ডেকে এনেচি, সুকুমারীকে অপমান করবার তাঁর কোন প্রয়োজন ছিল না। আমার কাজ-কর্মের বাড়িতে হাঁকাহাঁকি, গালিগালাজ করতে আমি নিষেধ করচি। যাঁর অসুবিধে হবে তিনি আর কোথাও গিয়ে বসুন। বড়গিন্নীর কড়া হুকুম সকলে নিজের কানে শুনিতে পাইল। রমেশের মুখ ফুটিয়া বলিতে হইল না—হইলে সে পারিত না। ইহার ফল কি হইল, তাহা সে দাঁড়াইয়া দেখিতেও পারিল না। জ্যাঠাইমাকে সমস্ত দায়িত্ব নিজের মাথায় লইতে দেখিয়া সে কোনমতে চোখের জল চাপিয়া দ্রুতপদে একটা ঘরে গিয়া ঢুকিল; তৎক্ষণাৎ তাহার দুই চোখ ছাপাইয়া দরদর করিয়া জল গড়াইয়া পড়িতে লাগিল। আজ সারাদিন সে নিজের কাজে ব্যস্ত ছিল, কে আসিল, না আসিল তাহার খোঁজ লইতে পারে নাই। কিন্তু আর যেই আসুক, জ্যাঠাইমা যে আসিতে পারেন, ইহা তাহার সুদূর কল্পনার অতীত ছিল। যাহারা উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল, তাহারা আস্তে আস্তে বসিয়া পড়িল। শুধু গোবিন্দ গাঙ্গুলী ও পরাণ হালদার আড়ষ্ট হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। কে একজন তাহাদিগকে উদ্দেশ করিয়া ভিড়ের ভিতর হইতে অস্ফুটে কহিল, বসে পড় না খুড়ো? ষোলখানা লুচি, চারজোড়া সন্দেশ কে কোথায় খাইয়ে-দাইয়ে সঙ্গে দেয় বাবা! পরাণ হালদার ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল। কিন্তু আশ্চর্য, গোবিন্দ গাঙ্গুলী সত্যই বসিয়া পড়িল। তবে মুখখানা সে বরাবর ভারী করিয়া রাখিল এবং আহারের জন্য পাতা পড়িলে তত্ত্বাবধানের ছুতা করিয়া সকলের সঙ্গে পঙ্‌ক্তি-ভোজনে উপবেশন করিল না। যাহারা তাহার এই ব্যবহার লক্ষ্য করিল তাহারা সকলেই মনে মনে বুঝিল, গোবিন্দ সহজে কাহাকেও নিষ্কৃতি দিবে না। অতঃপর আর কোন গোলযোগ ঘটিল না। ব্রাহ্মণেরা যাহা ভোজন করিলেন, তাহা চোখে না দেখিলে প্রত্যয় করা শক্ত এবং প্রত্যেকেই খুদি, পটল, ন্যাড়া, বুড়ি প্রভৃতি বাটীর অনুপস্থিত বালকবালিকার নাম করিয়া যাহা বাঁধিয়া লইলেন তাহাও যৎকিঞ্চিৎ নহে। সন্ধ্যার পর কাজ-কর্ম প্রায় সারা হইয়া গিয়াছে, রমেশ সদর দরজার বাহিরে একটা পেয়ারাগাছের তলায় অন্যমনস্কের মত দাঁড়াইয়াছিল, মনটা তাহার ভাল ছিল না। দেখিল, দীনু ভট্টাচার্য ছেলেদের লইয়া লুচি-মণ্ডার গুরুভারে ঝুঁকিয়া পড়িয়া একরূপ অলক্ষ্যে বাহির হইয়া যাইতেছে। সর্বপ্রথমে খেঁদির নজর পড়ায় সে অপরাধীর মত থতমত খাইয়া দাঁড়াইয়া পড়িয়া শুষ্ককণ্ঠে কহিল, বাবা, বাবু দাঁড়িয়ে— সবাই যেন একটু জড়সড় হইয়া পড়িল। ছোট মেয়েটির এই একটি কথা হইতেই রমেশ সমস্ত ইতিহাসটা বুঝিতে পারিল; পলাইবার পথ থাকিলে সে নিজেই পলাইত। কিন্তু সে উপায় ছিল না বলিয়া আগাইয়া আসিয়া সহাস্যে কহিল, খেঁদি, এ-সব কার জন্যে নিয়ে যাচ্ছিস রে? তাহাদের ছোট-বড় পুঁটুলিগুলির ঠিক সদুত্তর খেঁদি দিতে পারিবে না আশঙ্কা করিয়া দীনু নিজেই একটুখানি শুষ্কভাবে হাসিয়া বলিল, পাড়ার ছোটলোকদের ছেলেপিলেরা আছে ত বাবা, এঁটো-কাঁটাগুলো নিয়ে গেলে তাদের দুখানা-চারখানা দিতে পারব। সে যাই হোক বাবা, কেন যে দেশসুদ্ধ লোক ওঁকে গিন্নীমা বলে ডাকে তা আজ বুঝলুম। রমেশ তাহার কোন উত্তর না করিয়া সঙ্গে সঙ্গে ফটকের ধার পর্যন্ত আসিয়া—হঠাৎ প্রশ্ন করিল, আচ্ছা ভট্‌চায্যিমশাই, আপনি ত এদিকের সমস্তই জানেন, এ গাঁয়ে এত রেষারেষি কেন বলতে পারেন? দীনু মুখে একটা আওয়াজ করিয়া বার-দুই ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হায় রে বাবাজী, আমাদের কুঁয়াপুর ত পদে আছে। যে কাণ্ড এ কদিন ধরে খেঁদির মামার বাড়িতে দেখে এলুম! বিশ ঘর বামুন-কায়েতের বাস নেই, গাঁয়ের মধ্যে কিন্ত চারটে দল। হরনাথ বিশ্বেস দুটো বিলিতি আমড়া পেড়েছিল বলে তার আপনার ভাগ্নেকে জেলে দিয়ে তবে ছাড়লে। সমস্ত গ্রামেই বাবা এই রকম—তা ছাড়া মামলায় মামলায় একেবারে শতচ্ছিদ্র!—খেঁদি, হরিধনের হাতটা একবার বদলে নে মা। রমেশ আবার জিজ্ঞাসা করিল, এর কি কোন প্রতিকার নেই ভট্‌চায্যিমশাই? প্রতিকার আর কি করে হবে বাবা—এ যে ঘোর কলি! ভট্টাচার্য একটা নিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, তবে একটা কথা বলতে পারি বাবাজী। আমি ভিক্ষে-সিক্ষে করতে অনেক জায়গাতেই ত যাই—অনেকে অনুগ্রহ করেন। আমি বেশ দেখেচি, তোমাদের ছেলেছোকরাদের দয়াধর্ম আছে—নেই কেবল বুড়ো ব্যাটাদের। এরা একটু বাগে পেলে আর একজনের গলায় পা দিয়ে জিভ বার না করে আর ছেড়ে দেয় না। বলিয়া দীনু যেমন ভঙ্গি করিয়া জিভ বাহির করিয়া দেখাইল, তাহাতে রমেশ হাসিয়া ফেলিল। দীনু কিন্তু হাসিতে যোগ দিল না, কহিল, হাসির কথা নয় বাবাজী, অতি সত্য কথা। আমি নিজেও প্রাচীন হয়েচি—কিন্ত—তুমি যে অন্ধকারে অনেকদূর এগিয়ে এলে বাবাজী। তা হোক ভট্‌চায্যিমশাই, আপনি বলুন। কি আর বলব বাবা, পাড়াগাঁ-মাত্রই এই রকম। এই গোবিন্দ গাঙ্গুলী—এ ব্যাটার পাপের কথা মুখে আনলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। ক্ষ্যান্তিবামনি ত আর মিথ্যে বলেনি—কিন্তু সবাই ওকে ভয় করে। জাল করতে, মিথ্যে সাক্ষী, মিথ্যে মোকদ্দমা সাজাতে ওর জুড়ি নেই।
false
shomresh
কারো সঙ্গে যাওয়া ঢের ভাল। না। উনি আলাদা কম্পার্টমেন্টে যাচ্ছেন। এখানে তো ইচ্ছে করলেই সিট বদলানো যায় না। ঠিক আছে, আমি এবার উঠি। দীপাবলী জানালার ধারে নিজের আসনে বসল। এর মধ্যে ভরে গিয়েছে কামরা। সে স্বস্তির সঙ্গে দেখল তার আশপাশে সবাই অবাঙালি। কিছুটা নিশ্চিন্তে যাওয়া যাবে। বাঙালির কৌতূহলের সামনে তাকে এ যাত্রায় পড়তে হচ্ছে না। ট্রেন ছাড়ল। সুদীপ হাত নাড়ল। ট্রেন তাকে একই জায়গায় রেখে এগিয়ে যাচ্ছে। সুদীপ চোখের আড়ালে চলে গেল। হঠাৎ দীপাবলীর মনে হল ঈশ্বরের সঙ্গে দেখা হলে ও একটা প্রস্তাব দিত। তিনি মানুষকে অকাতরে দুঃখ যন্ত্রণা দিয়ে গেছেন। সুখ দেওয়া মাত্র মনে হয়েছে বেশি দেওয়া হয়ে গেল, তাড়াতাড়ি সুখ কেড়ে নিয়েছেন। তাই মানুষের একটু পাওনা থেকে যায়ই তাঁর কাছে। এই পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার সময়টা মানুষ যেন কিছু আগে জানতে পারে। এই ভাবে হাত নেড়ে আপাতত থেকে যাওয়া মানুষেরা তাকে বিদায় জানাবে। চোখ বন্ধ করল দীপাবলী। সঙ্গে সঙ্গে কাঁপনি এল। এতক্ষণ কথায় কথায় ভেতরে ভেতরে যে নির্লিপ্তির পাঁচিল তুলেছিল তা ভেঙে পড়ল হুড়মুড় করে। সে কলকাতায় পশ্চিমবাংলা ছেড়ে একদম একা অনিশ্চিতের পথে চলে যাচ্ছে। এই যাওয়ার জন্যে কত চেষ্টা ছিল। কিন্তু যাওয়ার সময় নিজেকে ভীষণ নিঃস্ব লাগছে। মনের এত শেকড় এখানকার মাটিতে ছড়ানো ছিল? চোখ উপছে জল গড়ালল। আপনার চোখে কি কয়লা গিয়েছে? চমকে মুখ ফিরিয়ে দীপাবলী দেখল উল্টোদিকের সিটে বসা এক অবাঙালি বৃদ্ধ সস্নেহে তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলেন। তাঁর পাশে বসা একজন বললেন, কয়লা কাঁহাসে আয়েগা, ইয়ে তো ডিজেল ইঞ্জিন হ্যায়। ও, ভুল গিয়া থা। বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন। চোখ মুছল দীপাবলী। তারপর ছুটন্ত গাছপালা বাংলাদেশের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল। অথচ সে কিছুই দেখছিল না। কি নিঃসঙ্গ, শূন্যতায় তার চারপাশ তিরতির করে কাঁপছিল। অথচ সে এসব নিয়ে কখনও ভাবেনি। বুকের ভেতর জমা সমস্ত আলো যেন অকস্মাৎ উধাও! সহযাত্রীরা মোটামুটি ভদ্র এবং মিশুকে। বিশেষ করে বৃদ্ধ ভদ্রলোক। রাত্রে শাওয়ার আগে তিনি তাঁর সঞ্চয় থেকে কিছু খাবার এগিয়ে দিলেন। বিকেল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। ট্রেনে যে লোকটা খাবারের অর্ডার নিতে আসে তাকেও সে দেখতে পায়নি। খিদে ছিল প্রচণ্ড। কিন্তু একেবারে অপরিচিত মানুষের কাছ থেকে খাবার নিতে কখনই অভ্যস্ত নয় সে। তাই মাথা নেড়ে সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছিল। ভদ্রলোক হেসে হিন্দীতে বলেছিলেন, আরে বেটি, তুমারা জরুর ভুখ লাগা। ট্রেনে উঠে তুমি কাঁদলে। এতক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলে। সঙ্গে খাবার আনোনি। আর এত বড় রাতটায় পেটে কিছু না দিলে চোখে, ঘুম আসবে না। দীপাবলী হেসে ফেলল, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু— নাও ধরো। বৃদ্ধ পরোটা আর তরকারি এগিয়ে দিলেন একটা প্লাস্টিকের প্লেটে রেখে। অগত্যা খেতে হল। একদম অচেনা স্বাদ। পরোটায় একধরনের রুক্ষতা থাকলেও বেশ স্বাদু। সঙ্গে জলের পাত্রও নেই। বৃদ্ধ সেটাও দিলেন, শোনো বেটি, তুমি মেয়ে, একা যখন ট্রেনে চাপবে তখন খাবার আর জল সবসময় সঙ্গে রাখবে। ছেলেদের মত প্ল্যাটফর্মে নেমে জলখাবার খেতে তো তোমরা পারো না। কেন পারব না? তোমরা লজ্জা পাবে। অল্প সময়ে ছোটাছুটি করতে হবে। নিজের জন্যে কিছু করা যখন প্রয়োজন তখন লজ্জা হবে কেন? হয়তো। আমি বুঝি না। অনেক বয়স হয়েছে তো। যৌবনে মেয়েদের কখনও একা ট্রেনে চাপতে দেখিনি। এখন দিন পাল্টাচ্ছে। আপনার বাড়ির মেয়েরা কখনও প্রয়োজনে একা ট্রেনে চাপেনি? না বেটি। তাদের বিয়ে হয়ে যায় যোল বছরের মধ্যেই। তখন তারা থাকে বাবার আশ্রয়ে। তারপর তো স্বামী শ্বশুরের ছায়ায়। প্রয়োজন হয় না। অত অল্প বয়সে বিয়ে দিচ্ছেন কেন? ওরা স্বাবলম্বী হবার সুযোগ পায় না। বৃদ্ধ হাসলেন, আমি যা বলব তা তোমার পছন্দ হবে না। বলুন না। যুক্তি থাকলে অপছন্দ হবে কেন? যুক্তি? পৃথিবীর অর্ধেক কাজ যুক্তি দিয়ে হয় না। নিজেকে নিঃস্ব করেও অনেক ছেলে বাপমায়ের সেবা করে কোন যুক্তিতে বলতে পারো। বৃদ্ধ বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকালেন, আমরা সবসময় সংসারের শান্তিকে গুরুত্ব দিই। যে মেয়ে ছেলের বউ হয়ে এল তার ওপর অনেক দায়িত্ব। তাকে সংসারের একজন হতে হবে। এটা যদি সে না ভাবতে পারে তাহলে সংসারে শান্তি আসবে না। সে যদি বাপের সংসারে পরিণত হয়ে আসে তাহলে স্বামীর সংসারের নিয়মকানুন মানতে নাও পারতে পারে। পাখির বোল একবার ফুটে গেলে সে কি আর নতুন কথা শেখে? বৃদ্ধ হাসলেন। আমি এটা মানছি না। এসব ছেলেরা নিজেদের সুবিধে করার জন্যে বলে। বউ আনে কিন্তু ছেলের মায়েরা। তারা মেয়ে। তর্ক চলতে পারত। কিন্তু দীপাবলী ক্লান্তি বোধ করল। সে কি করে এই বৃদ্ধকে বোঝাবে শুধু একজন পুরুষের পাশে পাশে তার সন্তানের মা হয়ে সেই সংসারের শান্তি বজায় রাখার জন্যে কোন মেয়ের জন্ম হতে পারে না। ভালো না লাগলেও একটা লোলাকের সঙ্গে সারাজীবন থাকো, তার ছেলেপুলের মা হও আর নিজের সমস্ত ভাল খারাপগুলো একে একে বিসর্জন দাও। পৃথিবীর সমস্ত সভ্য দেশের মেয়ে এই ব্যবস্থা থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে মুক্ত করেছে। বাংলাদেশের মেয়েদের মনে এমন উপলব্ধি যখন তীব্র হয়ে বসবে। তখনই ছবিটা পাল্টে যাবে। ততদিন অপেক্ষা করা ছাড়া কোন উপায় নেই। নিজের বাকে শুয়ে এতক্ষণ যেটাকে ভুলে থাকতে চাইছিল তা আর পারল না। দীপাবলী। সুদীপকে শেষ সময়ে থামিয়ে দিয়ে খুবই ভাল করেছে সে। কি দরকার গায়ে পড়ে আলাপ করার। দিল্লী থেকে কলকাতায় এসেও যদি কেউ নিজের
false
shunil_gongopaddhay
খবর দেননি, তা আমরা জানি। কিন্তু ওই খোঁড়া লোকটা, রাজা রায়চৌধুরী, তাকে খবর দেননি তো? অমিতাভ বললেন, না, তিনি কিছুই জানেন না। লোকটি বলল, গুড! ও লোকটার সব কিছুতে মাথা গলানো অভ্যেস। এবার মাথা গলাতে এলে ওর মাথাটাও কেটে ফেলব আর আপনার ছেলেরও! ঠিক আছে, পরশুদিন আবার কথা হবে! ফোনটা রেখে দিয়ে অমিতাভ অন্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আর মোটে তিনদিন সময় দিয়েছে। সিদ্ধার্থ বলল, যেভাবেই হোক টাকাটা জোগাড় করতেই হবে। আপনার মনে নেই, গত বছর একটা কোম্পানির বড়সাহেব একদিন মর্নিংওয়ার্কে বেরিয়ে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে তাকে কয়েকজন কিডন্যাপ করে। ঠিক এইরকমই, পুলিশে খবর দিতে ভয় দেখানো হয়েছিল। ওঁর বাড়ির লোক মোটা টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ভদ্রলোককে উদ্ধার করেন। তারপর পুলিশে খবর দেওয়া হয়। পুলিশ কয়েকজনকে ধরেছে, কিছু টাকাও ফেরত পাওয়া গিয়েছে। আমাদেরও সেরকম করতে হবে। অমিতাভ হতাশভাবে বললেন, আগে টাকা চাই! অত টাকা! রিনি বলল, একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। ডাক্তার সুপ্রিয় রায় নামে আগে যে একজন ফোন করেছিল, বিন্দুকে একটু পরেই ফেরত দেওয়ার কথা বলেছিল, সে কোথায় গেল? জয়ন্তী বললেন, সে ধাপ্পা দিয়েছে! রিনি বলল, কিন্তু সে বিল্টুর কথা জানে। কোন স্কুলে পড়ে তাও জানে। সিদ্ধার্থ বলল, সে লোকটাও ওদেরই দলের। তোমাকে ফোন করে ওই কথা বলেছিল কেন জানো? যাতে তোমরা আগেই পুলিশে খবর না দাও। ততক্ষণে বিন্দুকে ওরা অনেক দূরে সরিয়ে ফেলেছে। অমিতাভ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, বদমাইশের দল! আমি এখন বেরোচ্ছি। দেখি, কোথায় কোথায় টাকা পাওয়া যায়! জোজো দোতলায় উঠে এসে দেখল, কাকাবাবুর ঘরের দরজা বন্ধ। সে বাইরে থেকে দুবার ডাকল, কাকাবাবু, কাকাবাবু! কোনও উত্তর নেই। সে আবার বলল, কাকাবাবু, আমি জোজো। তাও কোনও উত্তর নেই! জোজো আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, আপনি ব্যস্ত আছেন? এবারে ভিতর থেকে শোনা গেল কাকাবাবুর গলা। তিনি বললেন, না, ব্যস্ত নেই। কিন্তু দরজা খুলতে ইচ্ছে করছে না। তুমি পরে এসো। জোজো অবাক হয়ে কয়েকবার চোখ পিটপিট করল। তারপর পা টিপে টপে উঠে গেল উপরে। বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে বুকের উপর বই রেখে পড়ছে সন্তু আর একটা গান বাজছে মিউজিক সিস্টেমে। জোজো ঘরে ঢুকে বলল, ব্যাড হ্যাবিট, ব্যাড হ্যাবিট। শুয়ে শুয়ে বই পড়া মোটেই ভাল নয়। তা হলে আর চেয়ার-টেবিল বানানো হয়েছে কেন? সন্তু বলল, তুই যে বিছানায় বসে বসে ব্রেকফাস্ট খাস? তা হলে খাওয়ার টেবিল থাকে কেন বাড়িতে? জোজো বলল, ওটা হচ্ছে রোমান স্টাইল। রোমের বড় বড় লোকেরা বিছানায় শুয়ে শুয়ে খেত আর বিরাট বিরাট ঢেকুর তুলত। আমার অবশ্য ঢেকুর ওঠে না। সন্তু বলল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুয়ে শুয়ে লিখতেন আর পড়তেন। জোজো জিজ্ঞেস করল, তুই বুঝি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে শুয়ে শুয়ে পড়তে দেখেছিস? সন্তু সঙ্গে সঙ্গে বলল, তুই বুঝি সেকালের রোমের লোকদের শুয়ে শুয়ে খেতে দেখেছিস? জোজো বলল, হ্যাঁ দেখেছি, সিনেমায়! সন্তু উঠে বসে জিজ্ঞেস করল, তুই আমার শরদিন্দু গ্রন্থাবলিটা ফেরত এনেছিস? জোজো বলল, এখনও শেষ হয়নি। আস্তে আস্তে পড়ছি। সন্তু বলল, তোর কাছে আমার অনেক বই জমে যাচ্ছে, জোজো। জোজো বলল, আমি একসঙ্গে তিন-চারটে বই পড়ি। একবার এ বইয়ের দুপাতা, আবার বিকেলে আর-একটা বইয়ের তিন পাতা… হঠাৎ কথা থামিয়ে জোজো সন্তুর দিকে একটুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, কাকাবাবুর কী হয়েছে রে সন্তু? সন্তু বলল, কেন, তুই কী দেখলি? জোজো বলল, দরজা বন্ধ। এই সময় কোনওদিনও তো দরজা বন্ধ থাকে। আমাকে দেখলেই জিজ্ঞেস করেন, নতুন খবর কী জোজোসাহেব? আজ আমি ডাকলাম, তবু দরজা খুললেন না! সন্তু বলল, আজ কাকাবাবুকে ডিস্টার্ব করা চলবে না। ওঁর খুব মনখারাপ। আমাদের বাড়িসুদ্ধ সকলেরই মনখারাপ। কাকাবাবু কারও সঙ্গে কথাই বলতে চাইছেন না। জোজো ভুরু কুঁচকে বলল, বাড়িসুদ্ধ সকলেরই মনখারাপ? কেন রে? কী হয়েছে? সন্তু বলল, সেটা আর কাউকে জানানো নিষেধ। তোকে বললে তো তুই দুনিয়াসুদ্ধ লোককে জানিয়ে দিবি। জোজো বলল, আই প্রমিস। সন্তু বলল, তুই বিন্দুকে চিনিস তো? আমাদের বাড়িতে প্রায়ই আসে। জোজো বলল, বিল্টুকে চিনব না কেন? ও তো ছবি এঁকে একটা দারুণ প্রাইজ পেয়েছে। কী হয়েছে বিন্দুর? সন্তু বলল, বিন্দুকে পাওয়া যাচ্ছে না। মানে, তাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। সাংঘাতিক একদল লোক কুড়ি লাখ টাকা চেয়েছে। টাকাটা ঠিক সময় না পেলে… জোজো বলল, এই ব্যাপার? এ জন্য কাকাবাবু শুধু শুধু মনখারাপ করবেন কেন? তিনি তো ইচ্ছে করলেই লোকগুলোকে ধরে ফেলতে পারেন। সন্তু বলল, না, শোন। আজ ভোরবেলা সিদ্ধার্থদা ফোন করেছিলেন। আমাকে বললেন, খবরটা জানাননি বলে খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু লোকগুলো শর্ত দিয়েছে, পুলিশে খবর দেওয়া চলবে না। আর কাকাবাবুকে কিছুতেই এর মধ্যে জড়ানো যাবে না। এমনকী কাকাবাবু এখন বিলুদের বাড়িতে যেতেও পারবেন না। কাকাবাবু কিছু করতে গেলেই ওরা বিলুকে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়েছে। সিদ্ধার্থদা আমাকে বললেন, কাকাবাবুকে এইসব কথা বুঝিয়ে বলতে। ওঁরা টাকা দিয়েই বিন্দুকে ছাড়িয়ে আনতে চান। এইসব কথা শুনেই কাকাবাবু কেমন যেন হয়ে গেলেন। একটা কথাও বললেন না। তারপর… জোজো, তুই কখনও কাকাবাবুকে কাঁদতে দেখেছিস? জোজো বলল, কোনওদিন না। কাকাবাবু কেঁদেছেন? সন্তু বলল, প্রথমে চোখ দিয়ে জল নেমে এল। তারপর কিছুক্ষণ ফুঁপিয়েফুঁপিয়ে কাঁদলেন। একটু পরে সেই যে দরজা বন্ধ করলেন, আর কারও ডাকে। সাড়া দিচ্ছেন না! কাকাবাবু বিন্দুকে খুব ভালবাসেন। জোজো বলল, কাকাবাবু সব
false
shunil_gongopaddhay
ইউসুফ বললেন, ঘর তো খালি নেই। আজই একটি পার্টি এসেছে। অন্য লোকটি বলল, ঘর খালি নেই? ঠিক আছে, আমরা বারান্দায় বসছি, আমাদের চা করে দাও। আর চটপট রুটি-মাংস বানিয়ে দাও, আমরা নিয়ে যাব। ইউসুফ বললেন, মাফ করবেন সার। এখানে বাইরের লোকদের খাবার দেওয়ার নিয়ম নেই। লোকটি দুখানা একশো টাকার নোট বার করে দিয়ে বলল, বেশি কথা বোলো না, এই নাও, যা বলছি করে দাও! ইউসুফ বললেন, আমি পারব না। আপনারা বরং ডান দিকে এক কিলোমিটার চলে যান, সেখানে হোটেল আছে। খাবারদাবার সব পাবেন। একজন লোক এবার ইউসুফ মিঞার গলা চেপে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, কোথায় আমরা যাব না যাব, তা তোমার কাছে কে শুনতে চেয়েছে? মারব এক থাপ্পড়! কামাল একবার ওপর থেকে চেঁচিয়ে বললেন, ও কী হচ্ছে, ওকে ছেড়ে দিন। সন্তু দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেল। লোক দুটি কামালের কথা গ্রাহ্যই করল না। একজন ইউসুফকে চুলের মুঠি ধরে বলল, আমাদের চিনিস না? মুখে-মুখে কথা! টাকা দেব, খাবার তৈরি করে দিবি। কাকাবাবুও উঠে এসে রেলিং-এর পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বললেন, লোকদুটি তো বড় বেয়াদপ। শুধু-শুধু ইউসুফকে মারছে! সন্তু ততক্ষণে নীচে পৌঁছে গেছে। ইউসুফের কাছে গিয়ে শান্ত কণ্ঠে লোক দুটিকে বলল, ওকে ছেড়ে দিন। কাকাবাবু বললেন, সন্তু একা পারবে না। কামাল, তুমি নীচে গিয়ে লোক দুটিকে ধরো। এবার ওদের একজন টর্চের আলো ফেলল দোতলায়। অন্যজন অস্ফুট স্বরে বলল, ও কে? রাজা রায়চৌধুরী না? অন্য লোকটি বলল, হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে। ইউসুফকে ছেড়ে দিয়ে ওরা দ্রুত ফিরে গেল জিপগাড়িটার দিকে। কামাল নীচে পৌঁছবার আগেই ওরা স্টার্ট দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেল! কামাল বিরক্তভাবে বললেন, চৌকিদার গেল কোথায়? ইউসুফ, তুমি বেরোতে গেলে কেন? বাইরের লোক ডাকাডাকি করলেও তুমি বেরোবে না। ইউসুফ আস্তে-আস্তে বললেন, এইসব লোক, বেআইনিভাবে পয়সা রোজগার করে, আর সব জায়গায় গায়ের জোর ফলায়। সন্তু আর কামাল ফিরে এলেন দোতলায়। জোজো বলল, ওরা কাকাবাবুকে দেখেই ভয়ে পালাল। কাকাবাবু চিন্তিতভাবে বললেন, ব্যাপারটা ভাল হল না রে জোজো। আমি ভেবেছিলাম, এই সাতনার মতন জায়গায় আমাকে কেউ চিনবে না। কামাল বললেন, সত্যিই তো, চিনল কী করে? এখানে আপনি অনেকদিন আসেননি। এখানে হিরের খনি আছে, অনেকরকম ব্যবসা শুরু হচ্ছে, তাই গুণ্ডা বদমাশদের উৎপাত বাড়ছে। তোক দুটোর ব্যবহার টিপিক্যাল গুণ্ডার মতন। কাকাবাবু বললেন, অনেকদিন আগে সূর্যপ্রসাদ নামে একটা লোক আমার কাছে জব্দ হয়েছিল। খাজুরাহো মন্দিরের মূর্তি ভেঙে-ভেঙে বিক্রি করা ছিল তার কাজ। ফাঁদে ফেলে তাকে আমি ধরেছিলাম। খুব একটা শাস্তি দিইনি। মূর্তিগুলো সব উদ্ধার করার পর সে আমার সামনে নাকে খত দিয়েছিল, তারপর তাকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। কামাল বললেন, এই তো আপনার দোষ! আপনার দয়ার শরীর, আপনি ক্ষমা করে দেন। তারা কিন্তু আপনার শত্রুই থেকে যায়। কাকাবাবু অংশুর দিকে তাকালেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, না, তা নয়। অনেক সময় ক্ষমা করে দিলে তারা ভাল হয়ে যায়। কামাল বললেন, ওই সূর্যপ্রসাদ তো কুখ্যাত অপরাধী। চোরাচালান, মানুষ খুন, কিছুই বাকি রাখেনি। পুলিশের হাত থেকে দুবার পালিয়েছে। আপনি ক্ষমা করে দিলেও সে একটুও শোধরায়নি। এখন তার মস্তবড় দল। তবে শুনেছি, তার নিজেরই দলের একজন লোক তার তলপেটে একবার ছুরি মেরেছিল, তাতেও সে বেঁচে গেছে বটে, কিন্তু শরীর ভেঙে গেছে। নিজে আর বেরুতে পারে না। কোনও জায়গায় লুকিয়ে থেকে সে দল চালায়। এ-লোকগুলো সূর্যপ্রসাদের দলের লোক হতে পারে। কাকাবাবু বললেন, তা হলে আর কী করা যাবে? কামাল বললেন, সূরপ্রসাদকে আপনি নাক-খত দিইয়েছিলেন, সেই অপমানের সে শোধ নেওয়ার চেষ্টা করবে না? যখন সে শুনবে আপনি এখানে এসেছেন … আমার মনে হচ্ছে দাদা, ওই লোক দুটো দলবল নিয়ে ফিরে আসবে, এখানে হামলা করবে! কাকাবাবু বললেন, আমি তো আর ওদের ঘাঁটাতে যাচ্ছি না। এখানে আমি গুণ্ডা দমন করতে আসিনি, এসেছি বিশ্রাম নিতে। কামাল জোরে-জোরে মাথা নেড়ে বললেন, উঁহুঃ, ভাল বুঝছি না। এখানকার চৌকিদার তো দেখছি অপদার্থ। পুলিশের পাহারার ব্যবস্থা করতে হবে। নরেন্দ্র ভামা আমার ওপর আপনাদের দেখাশুনোর দায়িত্ব দিয়েছেন। জোজো বলল, গল্পটার কী হল? তারপর আফগানিস্তানের গল্পটা বলুন। ডাকাতের দল আপনাদের ঘিরে ধরেছিল— কামাল বললেন, এখন তো আর গল্প হবে না ভাইটি। আমার এখনই থানায় যাওয়া দরকার। যদি রাত্তিরেই ওরা ফিরে আসে? কামাল উঠে দাঁড়ালেন। কাকাবাবু বললেন, ভেবেছিলাম এখানে নিরিবিলিতে শান্তিতে থাকব। তা নয়, এর মধ্যে এসে গেল গুণ্ডা, তার ওপর পুলিশ। গল্পটা মাটি হয়ে গেল। তুমি যাও বঙ্গে, কপাল তোমার সঙ্গে! অভাগা যেদিকে যায়, সাগর শুকায়ে যায়! সকালবেলা চা খেতে-খেতে কাকাবাবু অংশুঁকে জিজ্ঞেস করলেন, কী হে, কবিতা মেলাতে পারলে? অংশু কাঁচুমাচুভাবে বলল, আমার দ্বারা হবে না সার। আমার সাতপুরুষে কেউ কখনও ওকর্ম করেনি। কাকাবাবু বললেন, তুমি কী করে জানলে? সাতপুরুষের সকলের কথা জানো? তোমার বাবা ছুতোর মিস্তিরি, ঠাকুদা কী ছিলেন? ঠাকুর্দার বাবা? অংশু বলল, আমার ঠাকুদাকে আমি কখনও চোখেই দেখিনি। আগে আমাদের মেদিনীপুরের কোনও গ্রামে বাড়ি ছিল, বাবা চলে এসেছিলেন সোদপুরে। কাকাবাবু বললেন, মেদিনীপুরের গ্রামে তোমার ঠাকুর্দা হয়তো কবিয়াল ছিলেন। অনেক ছুতোর মিস্তিরি, নৌকোর মাঝি, গোরুর গাড়ির গাড়োয়ান নিজেরা গান বানান। পোস্ট অফিসের এক পিওনের কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক গান শিখেছিলেন, তা জানো? অংশু এসব কথায় কান না দিয়ে মুখ গোঁজ করে বলল, তা
false
nihar_ronjon_gupta
গলদঘর্ম হয়ে ওঠে। এ কি ফ্যাসাদেই পড়ল সে! এ কি গোলকধাঁধা? কোথায় নির্গমনের পথ? মাথা তুলে চারিদিকে তাকিয়ে রত্নমঞ্জিলেরও হদিস পায় না। ঘন আগাছা ও বুনো গাছপালায় দৃষ্টি ব্যাহত হয়। হঠাৎ একটা সুমিষ্ট মেয়েলী হাসির খিলখিল শব্দে চমকে ওঠে। হাসির রেশটা অন্ধকারের বুকে একটা শব্দতরঙ্গ তুলে গেল যেন। বিস্মিত হতচকিত বিনয় এদিক-ওদিক তাকায় অন্ধকার। কে? কে হাসলে আমন করে? কে? আবার সেই মিষ্টি খিলখিল হাসির তরঙ্গ বয়ে গেল। কে—কে হাসছ? চিৎকার করে বলে বিনয় যেন মরণীয়া হয়ে, কিন্তু চিৎকার করলেও শব্দটা যেন গলা দিয়ে স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয় না। প্রত্যুত্তরে আবার সেই হাসি শোনা যায়। কে? কে? আমি। মেয়েলী কণ্ঠে প্রত্যুত্তর এল এবারে। তুমি কে? আমি রাত্রি। রাত্ৰি! হ্যাঁ, পথ হারিয়ে ফেলেছেন তো? বিনয়ের মনে হয় যেন খুব কাছ থেকেই কণ্ঠস্বর ভেসে এল। এদিক-ওদিক তাকিয়েও কিন্তু বিনয় কাউকে দেখতে পেলে না। কোথায় তুমি? কাছেই আছি। পথ হারিয়ে ফেলেছেন তো! থাকুন। এখন বাকি রাতটুকু, পথ খুঁজে পাবেন না। মাথা খুঁড়ে মরলেও না।-কৌতুকে যেন উচ্ছসিত কণ্ঠ। পথ খুঁজে পাব না! না। পথ জানলে তো পথ খুঁজে পাবেন। শুধু জঙ্গলই নয়, এটা হচ্ছে মা মনসার স্থান। ভীষণ সাপ ওই জায়গাটায়। সাপ! হ্যাঁ। আর বেশীক্ষণ পথ খুঁজতে হবে না, ওরা এলো বলে। কারা? কালসাপ সব। মা-মনসার চেলারা! তুমিও তো আছে! আমাকে ওরা চেনে, আমায় ছোবল দেবে না। বিনয় অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। মেয়েটির কণ্ঠস্বরও আর শোনা যায় না! একসময় বিনয়ই আবার প্রশ্ন করে, আছ না চলে গেলে? যাইনি, আছি। কিন্তু কেন বলুন তো? জবাব এল। আমাকে একটু পথটা দেখিয়ে দাও না! বা রে আব্দার! আমি পথ দেখাতে যাব কেন? পথটা খুঁজে পাচ্ছি না যে উঁহু। দেবো না। দেবে না? না ঠিক আছে, একটা শর্তে পথ দেখিয়ে দিতে পারি— কি শর্তে? রত্নমঞ্জিল ছেড়ে চলে যাবে বল! কথা দাও, তাহলেই পথ দেখিয়ে দেবো! রাজী আছ। আমার ঐ শর্তে? না। তবে থাকো। ভাবিছ দিনের বেলায় পথ খুঁজে পাবে! তা হচ্ছে না, তার আগেই তোমার মৃতদেহ রাণীদিঘির পাঁকের তলায় পুঁতে ফেলবে। কে-কে পুঁতে ফেলবে? কেন, দুর্বাসা মুনি! দুর্বাসা মুনি? সে আবার কে? এসে যখন ঘাড় টিপে ধরবে তখনই জানতে পারবে দুর্বস মুনি কে! তার চাইতে যাও না। কলকাতায় ফিরে। কেন মিথ্যে প্রাণ দেবে! প্রাণের ভয় আমি করি না। প্রাণের ভয় করো না! না! আবার কিছুক্ষণ স্তব্ধতা। কোন পক্ষেরই কোন সাড়া নেই। হঠাৎ আবার মেয়েটির কণ্ঠস্বর শোনা গেল, এবারে একেবারে পাশে, এস, আমার হাত ধর। আশ্চর্য! নারীমূর্তি। প্রসারিত হাত। হাত ধর! গুণ্ঠনবতী নারী আবার আহ্বান জানাল। সে যেন হঠাৎ মাটি খুঁড়ে উঠেছে একটা চকিত বিস্ময়ের মত। চল। আর দেরি করো না, টের পেলে বিপদে পড়বে। মন্ত্রমুগ্ধের মত বিনয় হাতটি তার বাড়িয়ে দিল। একটি কোমল হাত তার মণিবন্ধ চেপে ধরল। স্পর্শ তো নয়, একটা পুলক-কোমল শিহরণ! রহস্যময়ী পথ-প্রদর্শিকার এই পথ যে অত্যন্ত সুপরিচিত, চলতে চলতে বিনয় খুব ভাল ভাবেই সেটা বুঝতে পারছিল। ফণীমনসা ও কাঁটাঝোপের মধ্যে দিয়ে অন্যথায় এই অন্ধকারে অক্লেশে সহজ গতিতে ঐভাবে কারো পক্ষেই এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। নিঃশব্দেই দুজনে অন্ধকারে কাঁটাঝোপের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলছিল। এবং ঠিক ঐ মুহূর্তটিতে বিনয়ের সমস্ত মন জুড়ে একটিমাত্র স্পর্শের অনুভূতিই তার সমগ্র চেতনাকে যেন একটি মিষ্টি-স্নিগ্ধ সৌরভের মতই আমোদিত করে রেখেছিল, যে কোমল পেলাব মণিবন্ধটি সে পরম বিশ্বাসে ও আশ্বাসে নিবিড় করে ধরেছিল তারই স্পর্শটুকু। মিনিট-পাঁচ-সাত ঐভাবে চলাবার পর হঠাৎ পথ-প্রদর্শিকা বলে উঠল, উঃ, হাতটা যে গেল আমার! কি শক্ত হাতের মুঠো আপনার! লজ্জায় তাড়াতাড়ি বিনয় তার মুষ্টি ছেড়ে দিল। সত্যি, আমি দুঃখিত। আচ্ছা এবার আমি বিদায় নোব। ঐ যে দেখুন সামনে রত্নমঞ্জিল। এবারে নিশ্চয়ই চিনে যেতে পারবেন! বিনয় তাকিয়ে দেখল, এ সেই জায়গা উদ্যানের মধ্যে আজ রাত্রে যেখানে দোতলায় নিজের শোবার ঘরের জানালা থেকে সেই লাল আলোর নিশানা চোখে পড়েছিল। হ্যাঁ, এবারে সে চিনে রত্নমঞ্জিলে যেতে পারবে। পথ হারাবার ভয় নেই একটু এগিয়ে গেলেই সেই নাটমন্দির। তারপর তো সব তার চেনাই। হ্যাঁ, পারব। ধন্যবাদ। আপনাকে-কথাটা বিনয়ের শেষ হল না, বিস্ময়ে তখন সে এদিকে-ওদিকে তাকাচ্ছে। আশেপাশে তার কোথাও সেই ক্ষণপূর্বের রহস্যময়ী পথ-প্রদর্শিকা নেই। যাদুর মতই অন্ধকারে কোথায় মিলিয়ে গিয়েছে। তথাপি বৃথাই এদিক-ওদিক দু-চার পা অগ্রসর হয়ে অনুসন্ধিৎসু কণ্ঠে ডাকতে লাগল, কোথায় গেলেন? শুনছেন? কোথায় গেলেন? কারো কোন সাড়া নেই। অকস্মাৎ সে স্বপ্নের মতই যেন মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। কেবল হাতের পাতায় ক্ষণপূর্বের সেই কোমল স্পর্শানুভূতিটুকু লেগে আছে অবশিষ্ট তখনো। এদিকে রাতও প্রায় শেষ হয়ে এল। রাত্রিশেষের হাওয়ায় কেমন একটা আলতো ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা ভাব। আকাশের তারাগুলোও যেন সারাটা রাত জেগে থেকে এখন ঝিমিয়ে এসেছে। তাদের চোখেও বুঝি ঘুম লেগেছে। বিনয় এক পা এক পা করে এগিয়ে চলল। সদর দরজাটা হাঁ-হাঁ করছে। খোলা। নীচের এই সদর দরজাটা তো বন্ধ থাকার কথা। খোলা আছে কেন? এখন মনে পড়লো, যাবার সময়ও দরজাটা এমনিই খোলা ছিল। দরজাটা বন্ধ করতে যাবে বিনয়, বাইরে কার মৃদু পদশব্দ পাওয়া গেল। থমকে দাঁড়াল সে? মনোহর। এত রাত্ৰে মনোহর বাড়ির বাইরে কোথায় গিয়েছিল? মনোহর! ডাকে বিনয়। মনোহরও বোধ হয় বিনয়কে দরজার গোড়ায় দেখবে প্রত্যাশা করেনি। ঐ সময়। বিনয়কে দরজার সামনে দেখে মনোহরাও থমকে
false
humayun_ahmed
চাইর-পাঁচ দিন থাকে, আবার চইল্যা যায়। সংসার চলে কীভাবে? চলে না। মা চিড়া কুটে, মুড়ি ভাজে, মুড়ি-লাডভু বানায়। আমি লুচি-লাডভু বানাইতে পারি। আমাকে ভেলিগুড় আইন্যা দিয়েন। ভেলিগুড়টা কী? ভেলিগুড় চিনেন না? না। কুষার থাইক্যা হয়। কুষার চিনেন? না। ইক্ষু চিনেন? হুঁ। এখন বুঝেছি। আখের গুড়। আমরা চাইর ভাইনের মধ্যে সবচাইতে সুন্দর যে জন তার নাম নয়নতারা। আমার বড়। তিন বছরের বড়। তোমাদের সব বোনের নামের শেষেই তারা আছে নাকি? হুঁ। আমার পরেরটার নাম স্বৰ্ণতারা, তার পরের জনের নাম লজ্জাতারা। তোমরা দেখি তারা-পরিবার। ভাই হলে কী নাম হতো? বাপজান সেইটাও ঠিক কইরা রাখছে। ভাই হইলে নাম হইত। তারা মিয়া। হি হি হি… আঁখিতারার হাসির মধ্যেই মিসির আলি ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের মধ্যেও তাঁর চেতনার কিছু অংশ কাজ করতে লাগল। তিনি স্বপ্নে দেখছেন নৌকায় করে কোথাও যেন যাচ্ছেন। নৌকা খুব দুলছে। নৌকায় কোনো মাঝি নেই। অথচ নৌকা ঠিকই যাচ্ছে। স্বপ্নের ভেতরও তিনি চিন্তিত বোধ করছেন। মাঝি নেই, নৌকা চলছে কীভাবে? স্রোতের অনুকূলে যাচ্ছে? নাকি নৌকায় পাল আছে? পালের নৌকার তো এত দ্রুত যাওয়ার কথা না। নাকি এটা ইনজিনের নৌকা? ইনজিনের নৌকা হলে ভটভট আওয়াজ আসত। কোনো আওয়াজ নেই। শুধুই ঝড়ের শব্দ। মিসির আলির ঘুম ভাঙল ঠিক সন্ধ্যায়। দুপুরে এত লম্বা ঘুম তিনি এর আগে ঘুমান নি। অসময়ের লম্বা ঘুম শরীর আউলে ফেলে, মাথায় ভোঁতা। যন্ত্রণা হয়। তার হচ্ছে। মাথার এই যন্ত্রণা কমানোর জন্য আবার ঘুমিয়ে পড়তে হয়। ঘুমের যন্ত্রণা ঘুম দিয়ে সারানো। রান্নাঘরে খুঁটিখাট শব্দ হচ্ছে। আঁখিতারা মনে হয় রান্নাবান্নায় লেগে গেছে। তাকে কয়েকটা জিনিস শেখাতে হবে। চা বানানো। নানা রকম চা। দুধ চা, লিকার চা, আদা চা, মসলা চা, ঠাণ্ডা। চা। রাত ন’টার দিকে বাড়িওয়ালা আজমল সাহেব বেড়াতে এলেন। তাঁর আসার প্ৰধান উদ্দেশ্য আঁখিতারা কাজকর্ম কেমন করছে খোঁজ নেওয়া। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, কাজের মেয়ে রাখতে হয় মারের ওপর। সকালে একটা থাপ্পড় দেবেন, সারাদিন ভালো থাকবে। মাগরেবের নামাজের পর আবার থাপ্নড়, রাতটা আরামে কাটবে। মিসির আলি বললেন, মেয়েটা ভালো, থাপ্পড় দিতে হবে বলে মনে হয় না। আজমল সাহেব বললেন, গ্রামের পিচকা মেয়ে কখনো ভালো হয় না। মায়ের পেট থেকে এরা যখন বের হয় তাদের ভালো জিনিস সব মায়ের পেটে রেখে দিয়ে বের হয়। রান্নাবান্না কিছু জানে? মনে হয় জানে। রেবুর কাছে পাঠিয়ে দেবেন? দু-একটা আইটেম শিখিয়ে দেবে। রেবু রান্না জানে? খুব ভালো রান্না জানে। তার হাতে চিতলের পেটি খেলে বাকি জীবন মনে থাকবে। মিসির আলি বললেন, রেবুর ভালো নাম কি রাবেয়া? আজমল সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, ভালো নাম রাবেয়া হবে কোন দুঃখে। ভালো নাম শেফালী। রেবু কি বলেছে তার ভালো নাম রাবেয়া? না। বলতেও পারে। মাথা ঠিক নাই। কখন কী বলে নিজেও জানে না। আপনাকে বলে নাই তো তার বিবাহ হয়েছে? স্বামী তালাক দিয়ে চলে গেছে? জি না, এ রকম কিছু বলে নাই। আজমল সাহেব দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, পাগলামি এমন এক অসুখ একবার হয়ে গেলে কখনো পুরোপুরি সারে না। অসুখের বীজ থেকেই যায়। ঠিকমতো আলো-হাওয়া পেলে বীজ থেকে গাছ হয়ে যায়? ঠিক বলেছি না ভাই সাহেব। মিসির আলি কিছু বললেন না। আজমল সাহেব হতাশ গলায় বললেন, গত বৃহস্পতিবার সে তার মামীর সঙ্গে আপনাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলেছে। মিসির আলি বললেন, কী বলেছে? বলেছে, আপনি নাকি তাকে বলেছেন, দুদিন পরপর তোমাকে দেখার জন্য পাত্ৰ পক্ষের লোকজন আসে। পছন্দ হয় না বলে ফিরত যায়। এত ঝামেলার দরকার কী? আমাকে বিয়ে করে ফেলো। তার মামী আবার তার কথা বিশ্বাসও করে ফেলেছে। মেয়েরা এই জাতীয় কথা দ্রুত বিশ্বাস করে। আমার কানে যখন কথাটা আসল আমি রেবুকে ডেকে কষে এক চড় লাগালাম। রেবু সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করল যে মজা করার জন্য বানিয়ে বানিয়ে এইসব বলেছে। বলেন কী! আজমল সাহেব দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, সাধারণ মানুষের কথা এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিতে হয়। পাগলের কথা যে কান দিয়ে শুনবেন সেই কান দিয়েই বের করবেন। এক কান থেকে আরেক কানে যাওয়ার সময় দেবেন না, বুঝেছেন? মিসির আলি মাথা নেড়ে জানালেন যে বুঝেছেন। আজমল সাহেব হঠাৎ প্ৰসঙ্গ পরিবর্তন করে বললেন, আপনি কি খাজা বাবার ডাক পেয়েছেন? মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, কার ডাক? খাজা বাবার, উনার ডাক পেয়েছেন? আপনি কী বলছেন বুঝতে পারছি না। আজমল সাহেব বললেন, খাজা বাবা আজমীর থেকে না ডাকলে কেউ আজমীর শরিফ যেতে পারে না। আপনি কখনো আজমীর শরীফে গিয়েছেন? জি না। তার মানে ডাক পান নাই। আমি আগামী নভেম্বরে ইনশাল্লাহ। আজমীর যাব। চলেন আমার সঙ্গে। যাবতীয় খরচ আমার। ট্রেনে উঠে যদি একটা পান খেতে ইচ্ছা করে সেই পানটাও আমি কিনে দেব। মিসির আলি জবাব দিলেন না। আজমল সাহেব বললেন, কথা ফাইনাল। না। করবেন না। আমি দু-তিন বছর অন্তর একবার করে খাজা বাবার কাছে। যাই। সমস্যা নিয়ে যাই। উনার রওজা মোবারকে উপস্থিত হয়ে সমস্যার ফানা চাই। উনি ব্যবস্থা করেন। আজ পর্যন্ত তার কাছে গিয়ে খালি হাতে ফিরত আসিনি। এইবার কী সমস্যা নিয়ে যাচ্ছেন? রেবুর সমস্যা নিয়ে যাচ্ছি। তার মাথাটা যেন ঠিক হয়ে যায়। তার একটা ভালো বিবাহ যেন দিতে পারি।
false
tarashonkor
অর্থহীন হইয়া উঠিতেছিল, কল্পনার মধ্যে তাহার গ্রাম মুছিয়া গিয়াছে, মা নাই, পিসিমা নাই, কেহ নাই, সব যেন বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। সুশীল বলিল, নাইন্টিন ফোরটিনগ্রেটেস্ট ইয়ার অব অল। উঃ, এতক্ষণে বোধহয় ওয়ার ডিক্লেয়ার হয়ে গেছে। অস্ট্রিয়ান আর্মি মার্চ করে চলেছে। দুই-এক জন করিয়া এতক্ষণে বিছানা ছাড়িয়া বাহিরে আসিতেছিল। নিচে রাজপথে ভিড় জমিয়া উঠিয়াছে, খবরের কাগজের হকারের হাঁকে সংবাদের চাঞ্চল্যে সমস্ত জনতার মধ্যে যেন একটা চাঞ্চল্য জাগিয়া উঠিয়াছে। সুশীল এদিক-ওদিক দেখিয়া বলিল, ঘরে এস। উঃ, বেটা দেখছি এই ভোরেও আমার সঙ্গ ছাড়ে নি! মার্ক দ্যাট ম্যান, ওই যে ওদিকের ফুটপাতে হাঁ করে হাবার মত দাঁড়িয়ে, ও-লোকটা স্পাই। স্পাই! হ্যাঁ। ঘরে এস। ঘরে ঢুকিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া সুশীল বলিল, এইবার কাজের সময় আসছে শিবনাথ। যে কোনো মুহূর্তে প্রত্যেককে প্রয়োজন হতে পারে! শিবনাথ উত্তর দিল না। নির্ভীক উজ্জ্বল দৃষ্টিতে সুশীলের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল, সৈনিক যেমন ভাবে-ভঙ্গিতে সেনাপতির মুখের দিকে চাহিয়া থাকে। সুশীল আবার বলিল, এইবার টাকার প্রয়োজন হবে, বাড়ি থেকে তুমি টাকা আনতে পারবে? চিন্তা করিয়া শিবনাথ বলিল, আপনি তো জানেন, একুশ বছরের এদিকে আমার কোনো হাত নেই। হুঁ। তোমার আর যা ভ্যালুয়েবলস আছে, আমাকে দাও। শিবনাথ একে একে বোম, ঘড়ি, আংটি, হাতের তাগা খুলিয়া সুশীলের হাতে তুলিয়া দিল। সুশীল সেগুলি পকেটে পুরিয়া বলিল, খুব সাবধানে থাকবে। পুলিশ এইবার খুব অ্যাকটিভ হয়ে উঠবে। ভাল, তুমি এই চিঠিখানা নিয়ে পূৰ্ণর কাছে যাও। চিঠিখানা বরং পড়ে নাও, পড়ে ছিঁড়ে ফেললা। মুখে তাকে চিঠির খবর বলবে। তার ওখানে বড় বেশি উপদ্রব পুলিশের, আমি যাব না। আর চিঠি নিয়ে যাওয়াও ঠিক নয়। চিঠিখানা পড়িয়া লইয়া শিবনাথ স্লিপার ছাড়িয়া জুতা পরিয়া সুশীলের সঙ্গেই বাহির হইবার জন্য বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইল। সুশীল নিচের দিকে চাহিয়া বলিল, একটা মোটর এসে দাঁড়াল দরজায়। শিবনাথ ঝুঁকিয়া দেখিল, রামকিঙ্করবাবু ও কমলেশ মোটর হইতে নামিতেছেন। পূৰ্ণর কাছে যাইবার জন্য সে যেন অকস্মাৎ অতিমাত্রায় ব্যাকুল হইয়া উঠিল, সুশীলের জামা ধরিয়া আকর্ষণ। করিয়া সে বলিল, আসুন আসুন, ওদের আমি চিনি। সুশীল আর কোনো প্রশ্ন করিল না, নিচে নামিয়া আসিয়া দরজার মুখেই শিবনাথকে রামকিঙ্করবাবু ও কমলেশের সম্মুখে রাখিয়া নিতান্ত অপরিচিতের মতই চলিয়া গেল। রামকিঙ্করবাবু সহাস্যমুখে বলিলেন, এই যে তুমি তোমার ঠিকানা জানি না যে খোঁজ করি। তুমি তো যেতে পারতে আমাদের বাসায়। শিবনাথ কোনো উত্তর দিল না, হেঁট হইয়া পথের উপরেই রামকিঙ্করকে প্রণাম করিয়া নীরবেই দাঁড়াইয়া ছিল। কমলেশও নতমুখে অকারণে জুতাটা ফুটপাথের উপর ঘষিতেছিল। রামকিঙ্করবাবু আবার বলিলেন, এস, গাড়িতে এস; আমাদের ওখান হয়ে আসবে। শিবনাথ বলিল, না। আমি এখন একজন বন্ধুর ওখানে যাচ্ছি। বেশ তো, চল, গাড়িতেই সেখান হয়ে আমাদের বাসায় যাব। মা এসেছেন কাশী থেকে, ভারি ব্যস্ত তোমাকে দেখবার জন্যে। মা! নান্তির দিদিমা! তবে–! শিবনাথের বুকের ভিতরে যেন একটা আলোড়ন উঠিল। নান্তি, নান্তি আসিয়াছে–গৌরী! ইহার পর কোনো ভদ্রকন্যা ভদ্ররমণীর বাস অসম্ভব—এই কথাটা তাহার মনে পড়িয়া গেল। আরও মনে পড়িয়া গেল, তাহার মা-পিসিমার সহিত রামকিঙ্করবাবুর রূঢ় আচরণের। কথা। তাহার সমস্ত অন্তর বিদ্রোহের ঔদ্ধত্য উদ্ধত হইয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু সেঔদ্ধত্যের প্রকাশ হইবার লগ্নক্ষণ আসিবার পূর্বেই তাহার নজরে পড়িল, দূরে একটা চায়ের দোকানে দাঁড়াইয়া সুশীল বারবার তাহাকে পূর্ণর নিকট যাইবার জন্য ইঙ্গিত করিতেছে। সে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করিল না, পথে পা বাড়াইয়া সে বলিল, না, গাড়িতে সেখানে যাবার নয়; আমি চললাম, সেখানে আমার জরুরি দরকার। মুহূর্তে রামকিঙ্করবাবু উগ্র হইয়া উঠিলেন, কঠোর উগ্ৰ দৃষ্টিতে তিনি শিবনাথের দিকে চাহিলেন, কিন্তু ততক্ষণে শিবনাথ তহাদিগকে অনায়াসে অতিক্ৰম করিয়া আপন পথে দৃঢ় দ্রুত পদক্ষেপে অগ্রসর হইয়া চলিয়াছে। কমলেশের ঠোঁট দুইটি অপমানে অভিমানে থরথর করিয়া কাঁপিতেছিল। রামকিঙ্করবাবু সামাজিক বা আত্মীয়তার ধার কোনো দিনই ধরিতেন না। প্রাতঃকাল হইতে রাত্রি দ্বিপ্রহরে নিদ্রাভিভূত হইবার মুহূর্তটি পর্যন্ত তাহার একমাত্র চিন্তা—বিষয়ের চিন্তা, ব্যবসায়ের চিন্তা, অর্থের আরাধনা। ইহার মধ্যে আত্মীয়তা কুটুম্বিতা, এমনকি সামাজিক সৌজন্য প্রকাশের পর্যন্ত অবকাশ তাহার হইত না। ধনী পিতার সন্তান, শৈশব হইতেই তাবেদারের কাঁধে কাঁধে মানুষ হইয়াছেন, যৌবনের প্রারম্ভ হইতেই তাহাদের মালিক ও প্রতিপালকের আসনে। বসিয়া কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করিয়াছেন, ফলে প্রভুত্বের দাবি, মানসিক উগ্রতা তাঁহার অভ্যাসগত স্বভাব হইয়া দাঁড়াইয়াছে। আর একটি বস্তু—সেটি বোধহয় তাঁহার জন্মগত, কর্মী পিতার সন্তান তিনি, কর্মের নেশা তাঁহার রক্তের ধারায় বর্তমান। এই কর্মের উন্মত্ত নেশায় তিনি সবকিছু ভুলিয়া থাকেন; আত্মীয়তা কুটুম্বিতা সামাজিক সৌজন্য প্রকাশের অভ্যাস পর্যন্ত এমনই করিয়া ভুলিয়া থাকার ফলে অনভ্যাসে দাঁড়াইয়া গিয়াছে। কিন্তু আসল মানুষটি এমন নয়। এই কৃত্রিম অভ্যাসকরা জীবনের মধ্যে সে মানুষের দেখা মাঝে মাঝে পাওয়া যায়, যে মানুষের আপনার জনের জন্য অফুরন্ত মমতা; অদ্ভুত তাহার খেয়াল, যে খেয়ালের বশবর্তী হইয়া স্বর্ণমুষ্টিও ধুলায় ফেলিয়া দিতে পারেন। কাশীতে অকস্মাৎ প্লেগ দেখা দিতে কমলেশ তাহার দিদিমা ও গৌরীকে লইয়া কলিকাতায় আসিতেই রামকিঙ্করবাবু গৌরীকে দেখিয়া সবিস্ময়ে বলিলেন, নান্তি যে অনেক বড় হয়ে গেলি রে, অ্যাঁ! গৌরী মামাকে প্রণাম করিয়া মুখ নিচু করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। এই দুই মাসের মধ্যেই গৌরীর সর্ব অবয়ব হইতে জীবনের গতির স্বাচ্ছন্দ্য পর্যন্ত ঈষৎ ক্ষুণ্ণ ম্লান হইয়া গিয়াছে। শিবনাথকে যে পত্র সে লিখিয়াছিল, সে পত্রের ভাষা তাহার স্বকীয় অভিব্যক্তি নয়, সে ভাষা অপরের, সে তিরস্কার অন্যের; শিবনাথের প্রতি তাহার নিজের অকথিত সকল কথা ধীরে ধীরে তাহার রূপের মধ্যে এমনই করিয়া
false
shunil_gongopaddhay
তার ঠিক মাঝখানে সেই আলোটা জ্বলছে। যন্ত্রটা দেখলেই কেমন যেন ভয়-ভয় করে, মনে হয় যেন এক একচক্ষু দানব। কিছু প্যাকিং বাক্স ছড়ানো আছে চারদিকে, কাকাবাবু দুএকটা বাক্স খুলে দেখলেন তার মধ্যে রয়েছে নানারকম যন্ত্রপাতির অংশ। লাল চক্ষুওয়ালা যন্ত্রটার দিকে কাকাবাবু চেয়ে রইলেন একটুক্ষণ। যন্ত্রপাতি সম্পর্কে তাঁর বেশি জ্ঞান নেই, ওটা কিসের যন্ত্র তিনি বুঝতে পারলেন না। একবার ভাবলেন, এটা কি কমপিউটার? হিমালয়ের এই দুৰ্গম জায়গায় মাটির নীচে ঘর বানিয়ে কী ভাবে এরা এই এতবড় একটা যন্ত্র বসাল সে-কথা ভেবে আশ্চর্য হয়ে গেলেন কাকাবাবু। এক পা এক পা করে তিনি যন্ত্রটার দিকে এগিয়ে গেলেন। হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল, এই যন্ত্রটায় হাত দিলেই যে কিছু বিপদ ঘটবে, তা তো হতে পারে না। কুকুরটা এই ঘরের মধ্যে ছিল, কুকুরটা এই যন্ত্রটা নিশ্চয়ই দু একবার টুয়েছে, ওর তো কিছু হয়নি! কাকাবাবু যন্ত্রটার খুব কাছে এগিয়ে যেতেই পেছন দিকের দরজায় দুম-দুম শব্দ হল। কাকাবাবু ফিরে দেখলেন, দরজাটা লোহার তৈরি এবং খুব মজবুত। তিনি খিল আটকে দিয়েছেন, আর বাইরে থেকে খোলার সাধ্য কারুর নেই। এখন এই ঘরের মধ্যেই তিনি নিরাপদ। বাইরে থেকে কেইন শিপটনের গলার আওয়াজ শোনা গেল, মিঃ রায়চৌধুরী, ডোনট বিহেভ লাইক আ ফুল। দরজা খুলে দাও। কাকাবাবু বললেন, না, আমি দুঃখিত, এখন দরজাটা খুলতে পারছি না? কেইন শিপটন বলল, শিগগির খোলো? কাকাবাবু বললেন, আমি ব্যস্ত আছি। একটু। প্লীজ আমায় বিরক্ত কোরো না। কেইন শিপটন বলল, এক্ষুনি খুলে দাও, নইলে ব্লাস্ট করে আমরা দরজাটা ভেঙে ফেলব। কাকাবাবু বললেন, তোমাদের দরজা তোমরা ভাঙবে, এতে আমার কী করার আছে। ইচ্ছে হলে ভাঙো। কাকাবাবু যন্ত্রটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। বিভিন্ন রঙের অনেকগুলো বোতাম যন্ত্রটার গায়ে সার-স্যার সাজানো। কাকাবাবু সাহস করে একটা বোতাম টিপলেন। অমনি যন্ত্রটার মধ্য থেকে খুব জোরে আওয়াজ বেরিয়ে এল, টু টু নাইন। কে ওয়াই সেভেন সেভেন। আলফা ওমেগা- আওয়াজটা এত হঠাৎ আর এত জোরে হল যে, কাকাবাবু চমকে খানিকটা পিছিয়ে এলেন। যন্ত্র তো কথা বলতে পারে না, নিশ্চয়ই ওর মধ্যে রেকর্ড করা আছে। এগুলো কোনও সাঙ্কেতিক সূত্র। ক্লেইন শিপটন বলল, খবরদার ঐ যন্ত্রে আর হাত দিও না, তুমি মরে যাবে। দরজা খোলো, তোমার ভাইপো সম্পর্কে জরুরি কথা আছে। এ দুটোই যে ধাপ্পা, তা বুঝতে একটুও অসুবিধে হল না। কাকাবাবুর। তিনি হাসলেন। কেইন শিপটনকে তিনি বললেন, তার চেয়েও জরুরি কাজে আমি ব্যস্ত আছি, ওসব কথা পরে হবে। কাকাবাবু আর-একটা বোতাম টিপতেই ফটাস করে যন্ত্রটার খানিকটা স্ক্রিপ্রংয়ের ডালার মতন খুলে গেল। ভেতরটায় কাচের ঢাকা দেওয়া অনেকগুলো ঘড়ির মতন জিনিস। সেগুলোর মধ্যে বিকিঝিকি শব্দ হচ্ছে। কাকাবাবু ওতে হাত দিলেন না। তিনি আর-একটা বোতাম টিপলেন, তখন যন্ত্রটা দিয়ে বীপ বীপবীপ বীপ শব্দ হতে লাগল। দরজার বাইরে থেকে কেইন শিপটন পাগলের মতন চিৎকার করছে। কাকাবাবু ওর কথায় আর কোনও উত্তর দিলেন না। কেইন শিপটন কেন এত ক্ষেপে যাচ্ছে তা কাকাবাবু এবার বুঝতে পারলেন। এই যন্ত্রটা বাইরে খবর পাঠায়। কাকাবাবু নানারকম বোতাম এক সঙ্গে টিপে দিলে যন্ত্রটা নানারকম উল্টেপোল্ট খবর এক সঙ্গে পাঠাতে শুরু করবে। তার ফলে, যে-দেশে এই খবরগুলো যাওয়ার কথা সেখানে বুঝে যাবে যে এখানে কিছু গণ্ডগোল হয়েছে। কেইন শিপটন তা জানাতে চায় না। কেইন শিপটন বলল, রায়চৌধুরী, শোনো। তোমাকে একটা সুযোগ দিচ্ছি। তুমি যদি দরজা খুলে বেরিয়ে আসো, আমরা তোমার কোনও ক্ষতি করব না। তোমাকে মুক্তি দেব। কাকাবাবু বললেন, তাই নাকি, হঠাৎ এত উদার হলে যে? যন্ত্রটায় হাত দিও না! তুমি জানো না, ওর মধ্যে একটা বোতাম টিপলে এই পুরো জায়গাটাই বিস্ফোরণে উড়ে যাবে? এই কথা আমাকে বিশ্বাস করতে বলে? আমি সত্যিই বলছি। বেশ তো। তোমাদের হাত থেকে ছাড়া পাবার যখন কোনও উপায় নেই, তখন এই পুরো জায়গাটা আমি বিস্ফোরণে উড়িয়ে দিতেই চাই। তোমাকে আমরা বাঁচার সুযোগ দিচ্ছি। তোমার ভাইপোকেও আমরা ছেড়ে দেব। আমার ভাইপো কোথায়? সে এখানেই আছে। তাকে কথা বলতে বলো। তার গলা শুনতে চাই। এবার কেইন শিপটন চুপ করে গেল। তার মিথ্যে ধরা পড়ে গেছে। সন্তুকে এখনও ওরা ধরতে পারেনি। সাত-আটজন লোক মিলে সন্তুকে তাড়া করলেও এখনও সন্তুকে ওরা ধরতে পারেনি। সন্তু নানান সুড়ঙ্গের মধ্যে ওদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। কেইন শিপটন তার সঙ্গীদের প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বলল, এখনও তোমরা ছেলেটাকে ধরতে পারলে না? অপদার্থের দল? কাকাবাবু একটুক্ষণ থেমে রইলেন। কেইন শিপটন যে বলল, একটা বোতাম টিপলে পুরো জায়গাটাই বিস্ফোরণে উড়ে যাবে, সে-কথা কি সত্যি? গুপ্তচরদের মধ্যে অনেক সময় এরকম ব্যাপার থাকে। ধরা দেবার বদলে তারা নিজেরাই সব কিছু ধ্বংস করে দেবার ব্যবস্থা রাখে। কিন্তু এখান থেকে পালাবার কি আর অন্য রাস্তা নেই? কেইন শিপটনের দলবল পালাতে চাইছে না কেন? কাকাবাবু চেঁচিয়ে বললেন, কেইন শিপটন, এবার আমি তোমাদের হুকুম দিচ্ছি, শোনো। যদি প্ৰাণে বাঁচতে চাও, পালাও! আমি পরপর সবকটা বোতামই টিপব শেষ পর্যন্ত! কেইন শিপটন বলল, ব্লাড ফুল, তা হলে তুমিও মরবে! তোমাদের হাতে মরার চেয়ে তোমাদের সকলকে ধবংস করে মরা অনেক ভাল। রায়চৌধুরী, এদিকে এসো, দরজার কাছে, প্লীজ, একটা কথা শোনে— কাকাবাবু এরই মধ্যে একটা অজগর সাপের ফোঁসফোঁসানির মতন শব্দ শুনতে পেলেন। শব্দ। কিন্তু ঐ যন্ত্রটা থেকে আসছে না। একটু লক্ষ করতেই কাকাবাবু টের পেলেন শব্দটা
false
humayun_ahmed
হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি, ব্যাঙাচির এই অবস্থা? ইউনিভার্সিটির পুরানো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে মুখ হাসি হাসি করে জিজ্ঞেস করা হয়— তারপর কি খবর ভাল আছেন? এখন কি করছেন? কলেজের পুরানো বন্ধুর সঙ্গে বলা হয়— আরো তুমি? কেমন আছ? আর স্কুল লেভেলের বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে— একজন আরেকজনের উপর ঝাপিয়ে পড়ে –তাই নিয়ম। আমি ব্যাঙাচির উপর ঝাঁপ দেব কি দেব না ভাবছি। বেচারা যেভাবে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে আমার ঝাঁপের অপেক্ষা করছে। ঝাঁপ দেয়াই মনস্থ করলাম। দুহাতেও তাকে ঠিক জড়িয়ে ধরা গেল না। ব্যাঙচি ধরা গলায় বলল, দোস্ত গরমের মধ্যে জড়াজড়ি করিস না ছাড়। শরীর ভর্তি চর্বি। জড়াজড়ি করলে অস্বস্তি লাগে। আমি বললাম, লাণ্ডক অস্বস্তি। তোকে ছাড়ব না। তুই এমন মটু হয়েছিস কি ভাবে? খেয়ে খেয়ে মটু হয়েছি দোস্ত। দিন-রাত খাই। বলিস কি? কেন খাব না বল— আল্লাহপাক মানুষকে খাওয়ার জন্যেই তো সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই মানুষের খাদ্যদ্রব্য। গরু-মহিষ, ছাগলভেড়া, পোকামাকড়, গাছ-গাছড়া সবই তো আমরা খাচ্ছি। খাচ্ছি না? হুঁ খচ্ছি। আমার এক চাচী ছিলেন পেটে সন্তান এলেই তিনি মাটি খেতেন। মাটির চুলার তিনটা মাথা ভেঙ্গে একদিন খেয়ে ফেললেন। সেদিন রান্না হল না। রাঁধবে কোথায়? চুলা নেই। চাচীর শাশুড়ি চাচীর উপর খুব রাগ করল—বৌমা এতই যদি মাটি খেতে হয়— ক্ষেতে চলে যাও। ক্ষেতে গিয়ে মাটি খাও। আমি চোখের আড়াল হলে তুমি দেখি বাড়িঘর সব খেয়ে ফেলবে। তাদের আবার মাটির ঘরবাড়ি তো, এই জন্যে চিন্তাটা বেশি। আমি হো হো করে হাসছি। বড় হয়ে ব্যাঙচি যে এমন রসিক হবে তা বোঝা যায়নি। ছোটবেলায় তার প্রতিভা বেঞ্চিতে ইয়ে করে দেবার ব্যাপারেই সীমাবদ্ধ ছিল। ব্যাঙচি ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোর সঙ্গে দেখা হয়ে ভাল লাগছে রে দোস্ত। তুই যখন জড়িয়ে ধরলি তখন প্রায় কেঁদেই ফেলেছিলাম। দেখা হলে জড়িয়ে ধরার মত বন্ধু মানুষের এক দুটার বেশি থাকে না। আয় কোথাও বসে চা-টা কিছু খাই। ভাল কথা, চাকরি-বাকরি কিছু করছিস? পার্ট টাইম চাকরি। পার্ট টাইম চাকরি ভাল রে দোস্ত। টেনশান কম। কাজটা কি? বেতন কত? বেতন কম হলে বলিস না। তোকে লজ্জা দেবার জন্যে জিজ্ঞেস করিনি। পুরানো বন্ধু সেই দাবিতে জিজ্ঞেস করা। অনুসন্ধানের কাজ। একটা লোককে খুজে বের করা। খুজে বের করতে পারলে কুড়ি হাজার টাকা পাব। খুঁজে না পেলে লবডঙ্গা। দোস্ত চিন্তা করিস না। আমি তোকে সাহায্য করব। ওয়ার্ড অব অনার। পুরানো বন্ধুর জন্যে এইটুকু না করলে কি হয়। তাছাড়া আমার কাজকর্মও কিছু নেই। আয় কোথাও বসে চা-টা কিছু খাই। ফর ওল্ড টাইম সেক। তোর সঙ্গে টাকা-পয়সা কিছু আছে? না। আমার পাঞ্জাবীর পকেট নেই। এটা ভাল করেছিস। পকেটই ফেলে দিয়েছিস। টাকা আমার কাছেও নেই। বউ টাকা দেয় না। টাকা দিলেই খাওয়া-দাওয়া করব। এই জন্যে দেয় না। সে যেমন বুনো ওল আমিও তেমন বাঘা তেতুল। আমিও ব্যাঙচি —ঢাকা শহরে তিনটা জায়গায় ব্যবস্থা করা আছে। বাকিতে খাই, মাসকাবারি টাকা দেই। চল আমার সঙ্গে একটু হাঁটতে হবে। পারবি না? পারব। তোকে দেখে এমন ভাল লাগছে দোস্ত। আবার খারাপও লাগছে। খালি পায়ে হাঁটছিস দেখে মনে ব্যথা পেয়েছি। আই এ্যাম হার্ট। ভিক্ষা করে যে ফকির সেও স্পঞ্জের স্যান্ডেল পায়ে দেয়। আর তুই হাঁটছিস খালি পায়ে? তুই কোন চিন্তা করিস না—তোকে আমি ভাল এক জোড়া স্যান্ডেল কিনে দেব। প্ৰমিস। টাকা থাকলে আজই কিনে দিতাম। জুতার দোকানে বাকি দেয় না। ব্যাঙচি আমাকে নিয়ে মালীবাগের এক কাবাব হাউসে ঢুকল। পিয়া কাবাব এণ্ড বিরানী হাউস। সাইনবোর্ডে রোগা পটকা এক খাসির ছবি। খাসির মুখটা হাসি হাসি। হাস্যমুখী ছাগল যে পেইন্টার একেছে। তাকে ধন্যবাদ দিতে হয়। মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণী হাসতে পারে না বলে যে ধারণা প্রচলিত তা যে সম্পূর্ণ ভুল হাস্যমুখী ছাগল দেখে তা বোবা যায়। দোস্ত কি খাবি? যা খেতে ইচ্ছে করে খা। এটা বলতে গেলে আমার নিজেরই দোকান। মালিক আমার ভাগ্নে। আপন না, পাতানো। আপন ভাগ্নের চেয়ে পাতানে ভাগ্রের জোর বেশি তাতো জনিসই। জানিস না? বিরানী খাবি? বিকাল বেলা বিরানী খাব? বাসি বিরানী। এর টেস্ট আলাদা। গরম করে দিবে, নাশতার মত খা। বিরানী যত। বাসি হয় তত স্বাদ হয়।— ঘি ভেতরে ঢুকে। মাংস নরম হয়। মাংসের প্রত্যেকটা আঁশ আলাদা আলাদা হয়ে যায়। আমার কথা শুনে আজ খেয়ে দেখা। একবার খেলে আর টাটকা পোলাও খেতে পারবি না। শুধু বাসি পোলাও খাবি। খাওয়ার মত স্থূল ব্যাপারও যে এত দৃষ্টিনন্দন হতে পারে ভাবিনি। আরিফ খাচ্ছে, আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি। মনে হচ্ছে পোলাওয়ের প্রতিটি দানার স্বাদ সে আলাদা করে। পাচ্ছে। হাডিড চুষছে। আনন্দে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। খাওয়ার মাঝখানে একটা আস্ত পেয়াজ নিয়ে কচকচ করে চিবিয়ে ফেলল। গাঢ় স্বরে বলল, পেয়াজের রস হজমের সহায়ক। ভরপেট বিরানী খাবার পর দুটা মিডিয়াম সাইজ পেয়াজ চিবিয়ে খেয়ে ফেলবি দেখবি আধা ঘন্টার মধ্যে আবার ক্ষিধে পেয়েছে। আমার অবশ্যি হজমের সমস্যা নেই। বিরানী পর্ব (তিন প্লেট। আর ছিল না। শেষ হবার পর এক বাটি সুপের মত তরল পদার্থ এল। সুপের উপর গুলমরিচের গুড়া ভাসছে। কুচিকুচি করে কাটা কাঁচা মরিচ ভাসছে। আরিফ বাটির দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। সুপের বাটির দিকে এমন মুগ্ধ প্ৰেমপূৰ্ণ দৃষ্টিতে এর আগে
false
shomresh
পড়ে আছে। আকাশলাল সেটা তুলে নিতেই রিভারভারটাকে অনুভব করল। তা হলে হায়দারের কাছে রিভলভার ছিল। অস্ত্রটাকে পকেটে পুরে সে দরজার দিকে এগোল। এখনও রাত শেষ হয়নি। মেয়েটা কি এরই মধ্যে একা বেরিয়ে গেছে পাশের গ্রামের প্রেমিকের ঘোড়ার গাড়ির নিয়ে আসতে? এত সাহস কি ওর হবে? কিন্তু ও যখন বলেছে তখন তার যাওয়া উচিত। না হলে বেলা বাড়লে হায়দার তাকে একা এখানে রেখে চলে যাবে। তারপর কি হবে কে বলতে পারে? দরজাটা খোলার সময় সামান্য আওয়াজ হল। আকাশলাল মুখ ফিরিয়ে দেখল শায়িত শরীরটা নড়ছে না। সে চট করে বাইরে বেরিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে হিম বাতাসে তার সর্বাঙ্গে কেপে উঠল। ভোরের আগে পৃথিবীর বোধহয় বেশি শীতের দরকার হয়। অন্ধকার পাতলা হলেও সে যখন ঢালু পথ বেয়ে নেমে যাচ্ছিল তখন অসুপ্লিবিধেটাকে টের পেল। মন যা চাইছে। শরীর তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না। নিঃশ্বাসের কষ্ট বাড়ছে, সেই সঙ্গে ক্লান্তি। মাঝেমাঝেই দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিতে হচ্ছিল তার। পকেটে হাত যেতেই অস্ত্রটির টের পেয়ে মনে অন্য ধরণের সাহস তৈরি হচ্ছিল। এখন গ্রামের সমস্ত মানুষ ঘুমে অচেতন। আকাশলাল ধীরে ধীরে মাঠে নেমে এল। এটুকু আসতেই মনে হচ্ছিল তার শরীরের সমস্ত শক্তি শেষ হয়ে গিয়েছে। সে ওপরের দিকে তাকাল। গ্রামটা এখন কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে। এবং তখনই নিজের মুখের কথা মনে এল। এই অবস্থায় যে দেখবে সেই অবাক হবে। ভয়ও পেতে পারে। একটা পাথরের ওপর বসে পড়ল আকাশলাল। তারপর সস্তপর্ণে ব্যান্ডেজ খুলতে লাগল পাকিগুলো খুলে সহজেই। গতকালের জড়ানোটা সম্ভবত ঠিক ছিল না। এবার তুলোর প্যাড। সেগুলো যেন চামড়ার সঙ্গে শক্ত হয়ে এটে আছে। অনেকটা তোলার পরও হাতের তালুতে ওদের অস্তি ভূ ধরা পড়ছিল। টেনে ছিড়তে ভয় লাগছিল তার। একটা আয়না থাকলে বোঝা যেত মুখের চেহারা এখন কি রকম দেখাচ্ছে। কিন্তু ব্যান্ডেজ খোলার পর বেশ হালকা লাগছে মাথাটা। অনেকদিন পরে দুই গালে মুখে হাওয়া লাগায় অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। আকাশলাল উঠল। একসময় সে যখন ঝরনার কাছে পৌঁছাতে পারল তখন শুকতারা ড়ুবে গেছে। পূবের আকাশে হালকা ছোপ লাগছে। সুনসান রাস্তার ধারে কাছে কেউ নেই। ধীরে ধীরে ঝরনার কাছে পৌঁছে সে জলে হাত দিল। কনকনে ঠান্ডা। হঠাৎ খেয়াল হতে সে এক আজিলা জল তুলে নিয়ে মুখের ওপর রাখল। মনে হচ্ছিল ঠান্ডা জল চামড়া কেটে ফেলছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর কয়েক আজলা জলের ঝাপটা পাওয়ার পর মুখটা বেশ পরিস্কার হয়ে গেল। আকাশলাল টের পেল তার মুখে এখন তুলোর অস্তিত্ব নেই। ঠিক তখনই তার কানে একটা শব্দ এল। ঘোড়ার নলের শব্দ। ঝরনার ধারে পাহাড়ের গায়ে শরীরটাকে আড়ালে রেখে আকাশলাল দাঁড়িয়ে ছিল। যে আসছে তাকে না দেখে দেখা দেওয়া উচিত নয়। নিজের বৃদ্ধিসুদ্ধি ফিরে আসছে ভেবে সে খুশি হল। একটু বাদেই শব্দ টা কাছে এগিয়ে এল। হঠাৎই আড়াল থেকে একটা ঘোড়া এবং তার পেছনে সাধারণ চেহারার গাড়ি বেরিয়ে এল যেন গাড়িটি চালাচ্ছে সেই মেয়েটি, তার পাশে একজন তরুণ। এই কাকভোরে ওরা দুই গ্রাম থেকে এসে কোথায় মিলিত হল কে জানে! আকাশলাল দেখতে পেল ঘোড়ার গাড়িটাকে থামিয়ে মেয়েটা ওপরের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলল, ছেলেটাকে। ছেলেটা মাথা নেড়ে নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। তারপর ঝরনার দিকে এগিয়ে এল। হয়তো মেয়েটা একাই তার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে কিন্তু ছেলেটা আর একটু এলে সে ধরা পড়ে যাবে। আকাশলাল বাধ্য হয়ে আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। তাকে দেখতে পেয়ে ছেলেটা বেশ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। দাড়িয়ে পেছন ফিরে মেয়েটাকে বলল। মেয়েটা এদিকে তাকাতেই আকাশলাল হাত নাড়ল। ততক্ষণে ছেলেটার পাশ কাটিয়ে সে কাছে এগিয়ে এসেছে। মেয়েটা বলল, আপনাকে একদম চিনতে পারছি না। ব্যান্ডেজ খোলার পর কি রকম দেখাচ্ছে? খুব খারাপ? যাঃ! আপনি খুব সুন্দর। ও আমার বন্ধু। সাতজনের একজন? একটু লজ্জা পেল না মেয়েটি। মাথা নেড়ে বলল, না। সাতজনের মধ্যে সেরা। আপনার সঙ্গী আজ ওর এই গাড়ি নিয়ে শহরে চলে যাচ্ছে। ওকেও সঙ্গে যেতে হবে। আমার সেটা একদম ইচ্ছে নয়। কেন? আকাশলাল জিজ্ঞাসা করল। লোকটাকে আমার একদম পছন্দ নয়। তোমার বন্ধু যদি আমাকে নিয়ে শহরে যেত তা হলে কি তুমি আপত্তি করতে? মেয়েটি হাসল, না। আপনি ভাল লোক। আকাশলাল ছেলেটির দিকে তাকাল, তা হলে ভাই, তুমি আমার একটা উপকার করো। আমার এখনই এই জায়গা ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত। তুমি আমাকে এমন কোথাও পৌঁছে দাও যেখান থেকে আমি সদরে যাওয়ার গাড়ি পেয়ে যেতে পারি। এখনই ছেলেটা যেন অবাক হয়েই ছিল। হ্যাঁ। নইলে তোমার বিপদ হতে পারে। আমার সঙ্গী আগে শহরে পৌঁছালে বীর বিক্রমকে মুক্ত করবে। সে ফিরে এলে তোমার বান্ধবী আর কখনই কোনও পুরুষকে বিয়ে করতে পারবে না। আপনার বন্ধু কি আকাশলালের লোক? হ্যাঁ। কিন্তু আমরাও আকাশলালের সমর্থক। বেশ। আকাশলাল তোমাদের কথা জানতে পারলে বীরবিক্রমকে এবছরের মধ্যে গ্রামে ফিরতে দিত না। এটা আমি বাজি রেখে বলতে পারি। ছেলেটা মেয়েটার কাছে এগিয়ে গেল। ওদের মধ্যে নিচু গলায় কিছু কথা হল যা শোনার চেষ্টা করল না আকাশলাল। মেয়েটা এবার তাকে বলল, আপনার শরীর খারাপ। আপনার যেতে খুব অসুবিধে হবে। আপনি কাল পর্যন্ত ঘরের বাইরে যেতে পারেননি। আকাশলাল বলল, তুমি ঠিকই বলেছ বোন। কিন্তু চলে যাওয়া ছাড়া আমার উপায় নেই। শেষ পর্যন্ত ওরা রাজি হল। মেয়েটা নেমে এল
false
shirshendu
জানো? জানি। আপনি উকিল। বাবা আপনাকে এস্টেটের কাজ দেখার জন্য মাইনে দিয়ে রেখেছেন। সোজা কথায় আপনি আমাদের কর্মচারী। আপনার কী অধিকার বাড়ির বউ কোথায় গেছে তা আমার কাছে জানতে চাওয়ার? শচীন এটা সহ্য করতে পারল না। একদম বেহেড হয়ে গিয়ে সে বলল, সরিয়েছ! তোমরাই চপলাকে সরিয়েছ! কিন্তু পারবে বাঁচাতে? চপলা আমার। আমি যেমন করে পারি তাকে দখল করবই। দেখি তোমরা কী করতে পারো। যে রাগ ও হতাশা বহুকাল ধরে বিশাখার ভিতরে মাথা কুটে কুটে একটা বেরোবার পথ খুঁজছিল আজ সে পথ পেয়ে গেছে। বিশাখা ফুসে উঠে বলল, খুব আসকারা পেয়ে গেছেন তাই না? কিন্তু এর ফল আপনাকে ভোগ করতে হবে। হেমকান্ত চৌধুরীকে আপনি যত নিরীহ ভাবেন তত নিরীহ যে তিনি নন সেটা আমিই বুঝিয়ে দেব আপনাকে। বাবা বরিশাল থেকে ফিরুন, তারপর বুঝবেন। কী বুঝব? কী করবে তোমরা আমার? লেঠেল দিয়ে ঘরবাড়ি ভেঙে দেব। ভিটেছাড়া করব। আর কখনও এ বাড়িতে ঢুকবেন না। যান! এর জবাবে উকিল শচীনের মুখে কোনও কথা এল না। কিন্তু তার ডান হাতটা নিজের অজান্তেই ওপরে উঠে গেল… তারপর সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত আচমকা একটা চড় এসে ফেটে পড়ল বিশাখার বাঁ গালে। অবিশ্বাস, দুর্বোধ্যতা এবং মানসিক বিকলতার দরুন চড়টাকে আসতে দেখেও বিশাখা নড়েনি। চড়টা বাঁ গালে পড়তেই সে চোখে অন্ধকার দেখল। দুলে উঠল শরীর। বিশাখা উবু হয়ে বসে পড়ল মেঝের ওপর। মাগো! যে-কোনও কাপুরুষের পক্ষে এ সময়ে পালিয়ে যাওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু শচীন পালাল । খুব অবিশ্বাসের সঙ্গে সে কিছুক্ষণ নিজের ডান হাতের চেটোটার দিকে চেয়ে রইল। তারপর তাকাল কুঁজো হয়ে থাকা বিশাখার দিকে। দাস-দাসীরা ছুটে আসছিল বিশাখাকে ধরে তুলতে। তাদের অবাক করে দিয়ে শচীন নিজেই শেষ ধাপটায় নেমে নিচু হয়ে পাঁজাকোলায় তুলে নেয় বিশাখাকে। নিঃশব্দে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে আসে। ঘরে নিয়ে শুইয়ে দেয় বিছানায়। বিশাখার তেমন কিছু হয়নি। একটা চড় আর কতটাই বা মারাত্মক? তবে তার দুই চোখে বিশ্বের বিস্ময়। তার নিজের মা-বাবাই তাকে কখনও মারেনি। পিঠোপিঠি ভাই কৃষ্ণকান্ত কখনও-সখনও কিলটা চড়টা দিলেও সে নিতান্তই খুনসুটি। সত্যিকারের মার জীবনে সে এই প্রথম খেল। তাও এক পরপুরুষের হাতে। দু’জনেই ভীষণ অবাক হয়ে চেয়ে থাকে দু’জনের দিকে। ঘরে লোকজনের ভিড় হয়ে যাচ্ছিল। শচীন একটু চমকাল কেন যেন। তারপর বিশাখার দিকে চেয়ে বলল, আমারই ভুল হয়েছিল। শুধু এইটুকু বলেই শচীন ঘর থেকে বেরিয়ে নীচে এসে সাইকেলে উঠে চলে গেল। তিন দিন শচীন আর এমুখো হল না। তিন দিন বিশাখারও কাটল এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে। বাঁ গালটা ফুলে লাল হয়ে ছিল অনেকক্ষণ। কিন্তু সে জ্বালা জুড়োতে দেরি হয়নি। জ্বালা মনের মধ্যে। তিন দিন ভাল করে দিনরাত ঠাহর করতে পারল না সে। অনুভব করতে পারল না তার চারদিককার বাস্তবতা। টের পেল না সে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে, না কি জেগে আছে। এত অপমান সয়ে মানুষ বেঁচে থাকে কী করে? এত অপমান একজনকে করতেই বা পারে কী করে আর-একজন? রঙ্গময়ী সবই জানে। কিন্তু সে উচ্চবাচ্য করে না। শুধু লক্ষ রাখে আর বাড়ির অন্যান্যদের ইশারায় তফাত থাকার নির্দেশ দেয়। বিশাখা তিনটে দিন চলল পুতুলের মতো রঙ্গময়ীর নির্দেশে। খেতে বললে খেল, স্নান করতে বললে করল। যেনবা ঠিক বুঝতে পারছে না সে আসলে কী করছে। কথা প্রায় ছিলই না তার মুখে। তিন দিনের দিন ভোরবেলা উঠে রঙ্গময়ী লক্ষ করল, বিশাখাব মুখ-চোখ একটু স্বাভাবিক। রাতে ঘুম হয়েছে। চোখের কোল ভরাট। রঙ্গময়ী একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলল। দুপুরবেলা খেতে বসে একটু ঠাট্টা-তামাসাও করল বিশাখা রঙ্গময়ীর সঙ্গে। তারপর দুজনে ঘরে এসে মুখোমুখি বসল। বিশাখা হঠাৎ বলল, কী গো মনুপিসি, কী ভাবছ? কই, কিছু তো ভাবছি না। ভাবছ না কেন? একটু ভাবো। কী ভাবব? আমার কী করা উচিত একটু ভেবে বলো তো! গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ব, না কি বিষ খাব? বালাই ষাট। তুই ওসব করতে যাবি কেন? অপমানটা তো দেখলে। নিজের চোখে দেখিনি, তবে শুনেছি। এর পরেও বেঁচে থাকতে বলো! বেঁচে থাকবি না কেন? পাগল নাকি? পাঁচজনকে মুখ দেখাব কী করে? সে যদি দেখায় তোর দেখাতে দোষ কী? সে তো ছেলে। ছেলেদের তো সবই মানায়, মনুপিসি। তোকে বলেছে! পুরুষমানুষ হয়ে একটা মেয়ের গায়ে হাত তুলেছে লোকে তাকে দুয়ো দেবে? তার নিজেরও কি কম লজ্জা! ওর কি লজ্জা বলে কিছু আছে! রঙ্গময়ী কথাটার জবাব চটজলদি দেয় না। একটু চুপ করে থেকে বলে, শুনেছি, তিন দিন জলস্পর্শ করেনি। বিশাখা কথাটা শুনে চুপ করে থাকে। বুকের মধ্যে কেমন এক অচেনা ব্যথা চিনচিন করতে থাকে। কেমন অদ্ভুত লাগে একটা সিরসিরে ভাব। অনেকক্ষণ বাদে সে বলে, জলস্পর্শ করেনি কেন? তা কী করে বলব? তবে মনে হয় প্রায়শ্চিত্ত করছে। আর প্রায়শ্চিত্ত করে কী হবে? যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। শহরে ঢি ঢি পড়ে যায়নি এতক্ষণে? রঙ্গময়ী মাথা নেড়ে বলে, দূর বোকা! দাস-দাসীরা কানাকানি করবে সে তত ঠেকানোর উপায় নেই। তবে লোক জানাজানি হয়নি। হবেও না। শহরে এখন অন্য সব সাংঘাতিক কাণ্ড হচ্ছে। কে কাকে চড় মারল তা নিয়ে কে মাথা ঘামাবে? কী কাণ্ড, মনুপিসি? রেললাইনের ধারে গুদাম থেকে বিদেশি কাপড় বের করে আগুন লাগানো হল সেদিন। গুলিগোলা চলেছে। ধরপাকড় হল কত। আহা! কিন্তু স্বদেশি আন্দোলনের ঘটনা মোটেই
false
shirshendu
তা কেন? কম খেলেই শরীর ভাল থাকে। বেশি খেলেই নানারকম ট্রাবল হয়। আর একটা কথা শোন, আমি আজকাল মাছ মাংস একদম খাই না। ওসব কোরো না বরং একটু স্যালাড কোরো। তা হলেই হবে। আচ্ছা, তাই করব। রাতে খাওয়ার সময়েই কথাটা তুলল বামাচরণ, দাদা, আমি একটা কথা ভাবছিলাম কদিন ধরে। কী কথা? আমার চাকরিটা তো কিছুই নয়। পিওনের আর কতই বা বেতন? তা ছাড়া মাঝে মাঝে শরীরটাও খাবাপ করছে আজকাল। যাতায়াতের ধকল সহ্য হয় না। কৃষ্ণজীবন একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কথাটা মিথ্যে নয়। বামা অনেক রোগা হয়ে গেছে। চেহারাটা একসময়ে বেশ ভাল ছিল। সুপুরুষ বলতে যা বোঝায়। এখন দড়কচা মেরে গেছে। মাঝে মাঝে মাথা খারাপ হয়ে যায়, তখন শরীর জীৰ্ণ শীর্ণ হয়ে পড়ে। শ্যামলী বলল, জানেন তো, রামজীবনের শুণ্ডারা ওকে বেদম মেরেছিল। তখন মাথায় চোট হয়েছিল খুব। আর সেই থেকেই মাথার গণ্ডগোল। কৃষ্ণজীবনের ভিতরটা একটা ব্যথায় ভরে গেল। ঘটনাটা সে শুনেছে। বামা যেমনই হোক, মার খাওয়ার কথা শুনে বড় কষ্ট হতে থাকে কৃষ্ণজীবনের। পৃথিবীতে কত অনভিপ্রেত ঘটনাই যে রোজ কত ঘটে? কেন যে ঘটে। সভ্যতার ইতিহাস তত কম পুরনো নয়, তবু মানুষ সভ্যতার এলাকাতেই ঢুকতে পারল না এখনও। শুধু বস্তুপুঞ্জ দিয়ে কি কিছু প্রমাণ করা যায়? শ্যামলী ধরা-ধরা গলায় বলল, এ বাড়িতে আমাদের পক্ষে তো কেউ নেই। আমরা হলাম একঘরে। ওকে মারার পর ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম। শ্বশুরমশাই ভরসা দেওয়ায় ফিরে এসেছি। কিন্তু আপনার ভাইয়ের শরীরের অবস্থা ভাল নয়। অনেক ছুটি নিতে হয়েছে বলে আজকাল মাইনে কাটে। ওরও চাকরির আর ধকল পোষাচ্ছে না। চোখ তুলে কৃষ্ণজীবন বলল, কী করতে চাও? শ্যামলী চুপ করে রইল। বামাচরণ বলল, রেমো তো দোকান দিয়ে বসেছে। চলছেও ভাল। বিটুপুর এখন বেশ গঞ্জ জায়গা। লোকজনের যাতায়াত আছে। ব্যবসা করতে পারলে চলে। শ্যামলী বলল, আপনার অনেক টাকা বাড়ির পিছনে খরচ হয়ে গেছে, রামজীবনকেও দোকান করতে টাকা দিয়েছেন। কোন মুখে যে আপনার কাছে হাত পাব তা ভেবে পাচ্ছি না। আপনার ভাইয়ের ইচ্ছে একটা স্টেশনারি দোকান দিয়ে বসে। কিন্তু অত টাকা আমরা কোথায় পাব বলুন। আমার গয়না বেচে দু-চার হাজার টাকা হতে পারে। কিন্তু তাতে তো হবে না! কৃষ্ণজীবন বড় বিব্রত বোধ করতে লাগল। বামাচরণ বলল, লাখ খানেক টাকা ঢালতে পারলে ভালই হবে। কিন্তু আপাতত যদি কমের মধ্যেই করি তা হলেও পঞ্চাশ হাজারের নিচে হবে না। কৃষ্ণজীবনের মুখে রুটির টুকরো বিস্বাদ ঠেকছিল। তার কারণ, সে জানে, শেষ অবধি সে এদের সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না। লোভী, হয়ত অভাবে পড়েই হয়েছে, হয়ত টাকাটা শোধ দেওয়ার ইচ্ছে নেই, তবু কি পারবে কৃষ্ণজীবন না দিয়ে? রামজীবন বারণ করেছে ঠিকই, কিন্তু সে কি করে ঠেকাবে এদের? কৃষ্ণজীবন শান্ত গলায় বলল, তুই পারবি দোকান করতে? কেন পারব না? রেমো পারলে আমিও পারব। দোকান করা তো সোজা কাজ। আমার বিশ্রামও হবে। শ্যামলী বোধ হয় ভাবল, টাকার অঙ্কটা বেশিই বলা হয়ে গেছে। হয়ত তত টাকা কৃষ্ণজীবন দিতে চাইবে না। সে বলল, আমরা ধারই চাইছি। দু-দশ হাজার কম হলেও কষ্টেসৃষ্টে দোকান খুলতে পারব। কৃষ্ণজীবন খাওয়া শেষ করে বলল, ভেবে দেখবখন। তবে একটা কথা বলে রাখি, রামজীবন কিন্তু মাত্র চল্লিশ হাজার টাকায় দোকানটা খুলেছে। তারও দশ হাজার টাকা দিয়েছে ও নিজেই। বামাচরণ বলল, চল্লিশ হাজারেও হয়। দু-পাঁচ হাজার টাকা আমরাও জোগাড় করতে পারব। চাকরি ছেড়ে দিলে প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাটাও পাওয়া যাবে। ভাল করে ভেবে দেখ। ভেবে বলিস। আমি মাসখানেকের জন্য বিদেশে যাচ্ছি। ফিরে এসে একবার আসব। বামাচরণ আর শ্যামলীকে নিয়ে মাথা ঘামাতে আর ইচ্ছে হল না কৃষ্ণজীবনের। মানুষের আগুণ আর দোষঘাটের কথা ভাবলেই তার মন খারাপ হতে থাকে। এসব ভাবনাকে তাড়ানো দরকার। শীত পড়তে শুরু করেছে। তবে তেমন তীব্র কিছু নয়। খেয়ে এসে মায়ের সঙ্গে একটু কথা বলে গায়ে একটা চাঁদর। জড়িয়ে ছাদে উঠে এল সে। এখন কোনও মহান চিন্তা ছাড়া এইসব জাগতিক চিন্তাভাবনা থেকে মনকে মুক্ত করা যাবে না। কিছু অৰ্থক্ষতি কপালে আছে। যাক, কিছু টাকা যাক। তবু মনটা যেন নীচুতলায় না থিতিয়ে থাকে। আকাশ এখানে বড় পরিষ্কার। নক্ষত্রমণ্ডলী হীরের ঝাঁপির মতো ঢাকনা খুলে দিয়েছে। আকাশ তার প্রিয় বিষয়। ওই অন্ধকার ও নিস্তব্ধ জগতে আর কোথাও কি আছে পৃথিবীর মতো একটি সজীব গ্রহ? থাকলেই বা তা জানা যাবে কি করে? মানুষের বৈজ্ঞানিক প্রয়াস সীমাবদ্ধ রয়েছে সামান্য পরিধিতে। পৃথিবীর নিকটতম নক্ষত্রটিও চার আলোকবর্ষ দূরে। কোনওদিনই মানুষ আলোর গতি সঞ্চার করতে পারবে কি কোনও মহাকাশযানে? যদিবা পারে তা হলে আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুযায়ী সেই মহাকাশযান যেইমাত্র আলোর গতি পাবে অমনি সে নিজেই পর্যবসিত হবে এনার্জিতে। সে আর বস্তু থাকবে না। যদি দুৰ্মরতর কল্পনায় ধরে নেওয়া যায়, মানুষ তাও পারল, তা হলেই বা লাভ কি? সবচেয়ে কাছের নক্ষত্রটির পরিমণ্ডলে পৌঁছতেই লেগে যাবে চার বছর। মানুষ পারবে না যেতে ওই গতিতে। কারণ মানুষের শরীর ওই অবিশ্বাস্য গতিবেগ সহ্য করার উপর্যুক্ত নয়। তা হলে কোটি কোটি অর্ব-খর্ব আলোকবর্ষ দূরে দূরে ছড়িয়ে থাকা কোটি কোটি নক্ষত্রপুঞ্জের কাছে কোনওদিনই পৌঁছবে না মানুষ। কখনও নয়। কিছুতেই নয়। কল্পবিজ্ঞানে কত কী হয়। কিন্তু মানুষের বিজ্ঞান এখনও সেই অসম্ভব কল্পনার ধারেকাছে পৌঁছয়নি। তার বিজ্ঞান ততদূর পৌঁছতে না পৌঁছতেই শেষ হয়ে
false
humayun_ahmed
কারো হবার হয়। সেটা হবে আমার। তোমার হবে না। তোমার মধ্যে রাগ বলে কিছু নেই। থাকলে এত দিন লোকটার সঙ্গে থাকতে পারতে না। সোমা বলল, তোর কাছে আমার অনুরোধ বুঝলি বিজু, রাস্তায় যদি কোনোদিন ওর সঙ্গে দেখা হয় তা হলে হৈ চৈ করব না। বিজু চুপ করে রইল। তার খুব রাগ লাগছে। এসব আপা কী বলছে? সোমা বলল, সব তো চুকেবুকেই গেছে আর হৈ চৈ কেন? ঠিক না? আচ্ছা ঠিক আছে। যাও হৈ চৈ করব না। এখন ঘুমুতে যাও। আমার বিছানায় ঘুমিও আপা। দু-একদিনের মধ্যে ফ্যানের ব্যবস্থা করব। তখন আরাম হবে। সোমা আবার তার ঘরে ঢুকল। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। অস্থির অস্থির লাগছে। ঊর্মি বলল, আপা ঘুমুবে না? সোমা জবাব দিল না। তার খুব ইচ্ছা করছে প্রফেসর সাহেবের কথা জিজ্ঞেস করতে। ঊর্মি তাতে কিছু মনে করবে কি না কে জানে। মনে করার অবশ্যি কিছুই নেই। আর যদি মনে করে তাতেই বা কি। আপা। কি? এ বাড়িতে এসে তোমার কি খারাপ লাগছে? না। আমার নিজের খুবই ভালো লাগছে। এ বাড়িতে আমার গল্প করার কেউ নেই। তোমার সঙ্গে গল্প করতে পারব। দোতলায় যাঁরা থাকেন তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই? না। বুডোমতো এক ভদ্রলোক থাকেন। আর তাঁর এক খালা না কি কে যেন থাকেন। আমি ও বাড়িতে যাই না। চাচাঁদের বাসাতেও যাই না। আমার জীবন এই ঘরটার মধ্যে কেটে যাচ্ছে আপা। সোমা চুপ করে রইল। পাশের ঘর থেকে চাপা অথচ রাগী গলা শোনা যাচ্ছে। সোমা বলল, এরকম করে কথা বলছে কে রে? বড় চাচা। মাঝেমাঝে চাচা এরকম করে। মাথা গরম হয়ে যায় তখন এই সব শুরু করে। তাই নাকি? হুঁ। আমার মনে হয় বড়ো চাচা পাগলটাগল হয়ে যাচ্ছে। সোমা চুপ করে বড়ো চাচার কথাগুলো শুনতে চেষ্টা করল। তেমন কিছু বোঝা যায় না তবে কেটে ফেলব পুতে ফেলব—এইসব শব্দ কানে আসছে। ঊর্মির ঘরে নতুন ফ্যান লাগানো হচ্ছে। কড়ই গাছ বিক্রির টাকায় কেনা ফ্যান। বিজুর উৎসাহের সীমা নেই। যদিও নীল গেঞ্জি গায়ে এক জন ইলেকট্রিশিয়ান আনা হয়েছে তবু পুরো কাজটা করল বিজু। কানেকশন দিয়ে সুইচ টিপল। ফ্যান ঘুরল না। ইলেকট্রিশিয়ান টেস্টার দিয়ে দেখে বলল, লাইন তো ভাইজান ঠিক আছে। ঊর্মি বলল, ফ্যান ঠিক আছে তো? দোকানে চালিয়ে দেখেছ? বিজু বিরক্ত গলায় বলল, না চালিয়ে ফ্যান কিনব না-কি? ঊর্মি বলল, লোক-ঠকানো টাকায় কেনা তো, তাই ঘুরছে না। বিজু চোখ লাল করে বলল, লোক-ঠকানো টাকা মানে? কি বলছিস তুই? গাছটা কার, আমাদের না অন্যদের? আচ্ছা বাবা যাও—আমাদের। চিৎকার করছ কেন? এমন চড় দেব না—জন্মের শিক্ষা হয়ে যাবে। ঊর্মি বলল, চেঁচামেচি না করে চড় দিয়ে ফেল। তাও ভালো। বিজু সত্যি-সত্যি চড় বসিয়ে দিল। ঊর্মি হতভম্ব হয়ে গেল। বিজ যে বাইরের একটা মানুষের সামনে চড় মারতে পারে তা তার কল্পনাতেও আসে নি। কেমন করে এটা সম্ভব হল? হচ্ছে কি এসব? নীল গেঞ্জি পরা ইলেকট্রিশিয়ান ব্যাপারটায় খুব মজা পাচ্ছে। দাঁত বের করে আসছে। ঊর্মির ইচ্ছা করছে বিজুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে। ছোটবেলায় এই জিনিসই করত। ছোটবেলায় যা করা যায় এখন তা করা সম্ভব না। সে নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বারান্দায় জাহানারা কেলি থেকে কাপে চা ঢালছেন। তাঁর মুখ গম্ভীর। কাজের ছেলেটা সকালে বাজারের টাকা নিয়ে পালিয়েছে, আর ফেরে নি। সত্তর টাকা নিয়ে ভেঙ্গে গেছে। অথচ তার বেতন পাওনা ছিল দেড় শ টাকার ওপরে। জাহানারা বললেন, সোমা কোথায় গেছে তুই জানিস? ঊর্মি জবাব দিল না। সে কান্না থামাবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। জাহানারা বললেন, কথা বলছি না কেন? সোমা কোথায় গেছে জানিস? না। চাটা বিজুকে দিয়ে আয়। আমি পারব না মা। জাহানারা কঠিন চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর ফর্সা গাল রাগে লাল হয়ে উঠতে শুরু করেছে। তিনি তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, কি বললি? কিছু বলি নি, দাওচা দাও দিয়ে আসছি। ঊর্মি চায়ের কাপ বিজুর সামনে রেখে সহজ গলায় বলল, বিজু ভাইয়া চায়ে চিনি হয়েছে কি-না দেখ। বিজু বলল, যা রহমানের জন্যে চা নিয়ে আয়—দেখ তাকিয়ে, প্রবলেম সলন্ড। ফ্যান বন-বন করছে। হা-হা। ঊর্মি তাকাল। নীল-রঙা ফ্যান ঘুরছে। ঘরে প্রচুর বাতাস। অথচ তার নিজের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। সে বারান্দার দিকে রওনা হল রহমানের জন্যে চা আনতে হবে। যে একটু আগে তাকে চড় খেতে দেখেছে। দেখে দাঁত বের করে হেসেছে। ঊর্মি চা ঢালছে। জাহানারা পাশের চেয়ারে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে আছেন। তিনি বিরস মুখে বললেন, কার চা? রহমানের। রহমানটা কে? ইলেকট্রিশিয়ান। ইলেকট্রিশিয়ানকে আবার চা-বিসকিট খাওয়াতে হচ্ছে? সোমা কোথায় গেছে। তুই জানিস না? না, জানি না। কাউকে কিছু না বলে গেল কোথায়? ঊর্মি চা নিয়ে চলে গেল। বিজু এসে বলল, ফ্যান কেমন ঘুরছে দেখে যাও মা। বন- বন-ফন-ফন। ঘরে বাতাসের ফ্লাড হয়ে যাচ্ছে। জাহানারা বললেন, সোমা কোথায় গেছে জানিস? না। কাউকে কিছু না বলে কোথায় গেল? বিজু চিন্তিত গলায় বলল, কখন গেছে? দুপুর থেকে তো দেখছি না। মাই গড। দুজনের মনেই যে চিন্তা একসঙ্গে কাজ করল তা হচ্ছে—আগের জায়গায় ফিরে যায় নি তো? কাউকে কিছু না বলে যাওয়ার অর্থ তো একটাই। বিজু বলল, এক বার চট করে দেখে আসব প্রফেসরের বাসাটায় আছে কি না? সন্ধ্যা পর্যন্ত
false
shirshendu
হয় তার ব্যাখ্যা মনীষা কখনও করতে পারবে না। সে বলল, না না। অলককে নিয়ে প্রবলেম হবে কেন? অলক প্রবলেম হলেই বা সত্যকামের কী, না হলেই বা কী? সে তরল আনন্দে ভেসে গেল। কিন্তু সেই রাতে শোয়ার সময় হঠাৎ সত্যকামের মনে পড়ল, একসময়ে সে সুছন্দার সঙ্গে অলককে ভিড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। এমনকী সুছন্দাকে পুত্রবধু করার প্রস্তাবও দিয়েছিল সে। অথচ— একা একা খুব হাসল সত্যকাম আপনমনে। দুনিয়াটা যে কী হয়ে গেল! ওফ! যদি সত্যিই সুছন্দাকে বিয়ে করত অলক? তা হলে কী হত? মনীষা জিজ্ঞেস করল, ওরকম হাসছ কেন? খুব নেশা হয়েছে বুঝলে! দুনিয়াটাই অন্যরকম লাগছে। অন্যরকম লাগানোর জন্যই তো নেশা করো তুমি। তা ঠিক, তবে এতটাই অন্যরকম হওয়া ঠিক নয়। অন্যরকম মানে কীরকম তা বুঝিয়ে বলো! সত্যকাম গম্ভীর হয়ে গেল। আর কিছুই বলল না। সে মনে মনে সুছন্দাকে অলকের পাশে দাড় করাল। সুছন্দার মাথায় ঘোমটা, কপালে সিঁদুর। শিউরে উঠে সত্যকাম ছবিটা মুছে ফেলল। বনানীর এক অদ্ভুত সুখকর অস্বস্তি শুরু হল। সৌরীন্দ্রমোহন, বনলতা, সোনালি সকলেই আজকাল কেমন যেন বিস্ময়ভরে এবং বিমূঢ়ের মতো তার দিকে তাকায়। তারা এমন কিছু দেখে বনানীর মধ্যে, যা বিশ্বাসযোগ্য নয়। ঠিকে ঝি একদিন বলে উঠল, ও মা, এ যে অশৈলী কাণ্ড গো! সেই পেটমরা মেয়েটা যে একেবারে ধান ফুটে খই হল গো। গয়লা দুধ দিতে এসে হাঁ করে তাকে দেখে। দেখে সৌরীন্দ্রমোহনকে খেউড়ি করতে এসে বিশে নাপিত। দেখে পাড়াপড়শি। প্রত্যেকের চোখেই অবিশ্বাস। বনানীর আয়না লাগে না। অন্যের চোখেই সে আজকাল নিজেকে দেখতে পায়। বাস্তবিকই আয়নার দিকে তাকায় না বনানী। কী দেখবে তা নিয়ে তার যত ভয়। সে যে বদলে গেছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু বদলটা কেমন হল তা সে জানতে চায় না। সোনালি পছন্দ করে না বলে সে পারতপক্ষে বারান্দায় যায় না। নিজেকে সে প্রাণপণে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতেই চেষ্টা করে। তার জীর্ণ শরীরে প্লাবন আসার এই ঘটনা তার কাছে এখনও তেমন বিশ্বাসযোগ্য নয়। একা, ঘরে বসে মাঝে মাঝে নিজের স্তনভার অনুভব করতে করতে সে লজ্জায় ঘেমে ওঠে। স্নানঘরে পুরন্ত ঊরু, গভীর নাভি, মসৃণ হাতের গঠন দেখে সে তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নেয়। অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে, ভগবান! একদিন সোনালি তীক্ষ্ণ গলায় বলল, এই সর্বনাশী রূপ এতকাল কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলি রে হারামজাদি? তুই যে বহু সংসারে আগুন লাগাবি! রূপ! রূপের কথা বনানী আজকাল বিশ্বাস করে। সোনালি ফতোয়া দিল, খবরদার সাজবি না। লোকের সামনে ধিঙ্গির মা সিঙ্গি হয়ে গিয়ে দাঁড়াবি না। বনানী ম্লান মুখে বলে, কারও সামনে যাই নাকি? সোনালি বড় বড় চোখে চেয়ে থেকে বলে, মনে কোনও পাপ নেই তো রে মুখপুড়ি? খুব সাবধান কিন্তু! পাপ! বনানী পাপের কথা ভাবতে গিয়ে বড় অস্থির হয় মনে মনে। একা ঘরে টপ টপ করে চোখের জল পড়ে। পাপ! পাপ কি না তা তো সে জানে না। কিন্তু ওই যে একজন এসেছিল একদিন, তারপর বহুদিন আর আসেনি, ওই একজন লোক তার জীবনের সব এলোমেলো করে দিল। কেন এল ও? কিছুতেই যে বনানী ওকে মন থেকে, চোখ থেকে মুছে দিতে পারে না! প্রায় ছ’মাস বাদে আবার বনানী পড়ল ভূমিকম্পে, ঝড়ে, বজ্রপাতে। দুপুরবেলা। বুড়োবুড়ি ঘুমোচ্ছ। সোনালি ইস্কুলে। এমন সময় কলিং বেল-এর শব্দ। বনানী ভাবল, পিয়োন বুঝি। নীচে নেমে দরজা খোলার আগে সে নিয়মমতো জিজ্ঞাসা করল, কে? আমি। আমি অলক। কে, পিসি নাকি? শিগগির দরজা খোলো, ভীষণ খিদে পেয়েছে। বনানী দরজা খুলল না। তাড়া-খাওয়া হরিণের মতো ছুটে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে গায়ে কাপড় জড়িয়ে পড়ে গেল ভীষণ জোরে। মা গো! শব্দে বনলতা নেমে এলেন, ও মা! এ কী রে? কী হল তোর? ওদিকে কলিং বেল বেজে যাচ্ছিল, সঙ্গে অলকের গলা, কী হল? ও পিসি? বনলতা দরজা খুলে দিয়ে বললেন, আয় দাদা, আয়। দেখ তো কী কাণ্ড! মেয়েটা আছাড় খেয়েছে, কী যে করি! হাত পা ভাঙল কি না। হাঁটু, গোড়ালি, কনুই, তিন জায়গাতেই প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছিল বনানী। এমন ব্যথা যে তার মুখ নীল হয়ে গিয়েছিল যন্ত্রণায়। তবু অলক ঢুকতেই সে ফের ‘মা গো’ বলে একটা আর্ত চিৎকার করে দুড়দাড় সিঁড়ি ভেঙে নিজের ঘরে এসে বুক চেপে শুয়ে পড়ল বিছানায়। সে পারবে না। সে আর বেঁচে থাকতে পারবে না। সে মরে যাবে। বালিশে মুখ চেপে সে পাগলের মতো কাঁদতে লাগল। পাপ! পাপ! নিশ্চয়ই পাপ? সে যে মরে যাবে। ঘরে কেউ এল। মাথায় হাত রাখল। দিদিমার গলা পাওয়া গেল, খুব লেগেছে তোর? দেখি কোথায় লাগল। কাঁদছিস কেন? কাদিস। আমি ডাক্তার ডেকে পাঠাচ্ছি। না। মাথা নাড়ল বনানী। একটু বরফ লাগা ব্যথার জায়গায়। ফ্রিজ থেকে এনে দিচ্ছি। লাগবে না দিদিমা। সেরে গেছে ব্যথা। দিদিমা অর্থাৎ বনলতা একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তুই পালিয়ে আসছিলি কেন বল তো! ভয় পেয়েছিলি? বনানী কী করে বলবে যে, হ্যাঁ ভয়, ভীষণ ভয়। বনলতা একটু হেসে বললেন, মেয়েমানুষের ভয় থাকা ভাল। হড়াস করে যে দরজা খুলে দিসনি সেটা ভালই করেছিস। অলকের বদলে গুন্ডা বদমাশও হতে পারত তো। বনলতা চলে গেলে একা ঘরে বনানী আক্রোশে পা দাপাতে দাপাতে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, গুডাই তো! গুন্ডা! ডাকাত! কেন এল ও? কেন এল? আমার যে পাপ হচ্ছে। আমার যে ভীষণ পাপ
false
shorotchandra
আসন্নকালেও মেয়ে লইয়া আর একবার হরিপাল যাইতে পারিতেন, কিন্তু সেখানে সেই যে পাত্র, যে নিজের পাঁচ-ছয়টি সন্তানের জননীকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় লাথি মারিয়া হত্যা করিয়াছে, তাহার কথা মনে হইলেই তাঁহার হৃৎকম্প উপস্থিত হইত। পরদিন অনাথকে নিজের শয্যাপার্শ্বে ডাকাইয়া আনিয়া দুর্গা তাহার হাতদুটি চাপিয়া ধরিয়া কাঁদিয়া কহিলেন, ঠাকুরপো, সম্পর্কে বড় না হলে, আজ তোমার পায়ে ধরে ভিক্ষে চাইতাম ভাই, তোমার যাকে ইচ্ছে হয় একে দাও, কিন্তু মেয়েকে এ সময়ে আমার কাছ-ছাড়া ক’র না। বলিয়া জ্ঞানদার হাতখানি তুলিয়া লইয়া তাহার কাকার হাতের উপর রাখিলেন। অনাথ হাতটা টানিয়া লইয়া বিরক্ত হইয়া কহিল, পরের দায়ে আমার জাত যায়। আমি কি চেষ্টার ত্রুটি করচি মেজবৌঠান? কিন্তু ঘাটের মড়াও যে এ শকুনিকে বিয়ে করতে চায় না। বলি, তোমার সেই বালাজোড়াটা যে ছিল, কি করলে? সে ত তোমার দাদার শ্রাদ্ধের সময়েই গেছে ঠাকুরপো। অনাথ হাতটা উল্টাইয়া কহিল, তা হলে আর আমি কি করব! একটা পয়সাও দেবে না, মেয়েও ছাড়বে না,—তার মানে, আমাকে মাথায় পা দিয়ে ডুবোতে চাও আর কি! বলিয়া রাগ করিয়া চলিয়া গেল। সে চলিয়া গেলে দুর্গা ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া, অকস্মাৎ মেয়ের হাতটা সজোরে ঠেলিয়া দিয়া বলিলেন, বসে আছিস! ঘরে সন্ধ্যা দিবিনে? যে-সমস্ত আলোচনা এইমাত্র হইয়া গেল, তাহারই দহনে বোধ করি জ্ঞানদা একটুখানি অন্যমনস্ক হইয়া পড়িয়াছিল। জবাব দিবার পূর্বেই মা নিরতিশয় কঠিন হইয়া বলিয়া উঠিলেন, মরণ আর কি! রাজকন্যার মত আবার অভিমান করে বসে আছেন! হাঁ লা গেনি, এত ধিক্কারেও তোর ত প্রাণ বেরোয় না! যদু ঘোষের এক ছেলে সেদিন তিনদিনের জ্বরে ম’লো—আর এই একটা বছর ধরে তুই নিত্যি জ্বরের সঙ্গে যুঝচিস্‌, কিন্তু তোকে ত যম নিতে পারলে না! তুই বলে তাই এখনও মুখ দেখাস, আর কোন মেয়ে হলে মনের ঘেন্নায় এতদিন জলে ডুবে মরত। যা যা, সুমুখ থেকে একটু নড়ে যা শুকুনি,—একদণ্ড হাঁফ ফেলে বাঁচি। দিবারাত্রি আমাকে যেন জোঁকের মত কামড়ে পড়ে আছে। বলিয়া একটা ঠেলা দিয়া মুখ ফিরাইয়া শুইলেন। বাস্তবিক মায়ের কথাটা সত্য যে, আর কোন মেয়ে হইলে সুদ্ধমাত্র মনের ঘৃণাতেই আত্মহত্যা করিত,—এমন কত মেয়েই ত করিয়াছে,—কিন্তু এই মেয়েটিকে ভগবান যেন কোন নিগূঢ় কারণে মা বসুন্ধরার মতই সহিষ্ণু করিয়া গড়িয়াছিলেন। সে নীরবে উঠিয়া গিয়া নিয়মিত গৃহকার্যে প্রবৃত্ত হইল। এতবড় নির্দয় লাঞ্ছনাতেও মুহূর্তের জন্য আত্মবিস্মৃত হইয়া বলিল,—না মা, মরিতে আমিও জানি! শুধু তুমি ব্যথা পাইবে বলিয়াই সব সহিয়া বাঁচিয়া আছি। ঘরে প্রদীপ দিয়া গঙ্গাজল ছড়া দিয়া ধুনা দিয়া সে আর একটি ক্ষুদ্র দীপ হাতে করিয়া তুলসী-বেদীমূলে দিতে গেল। বাঙ্গালীর মেয়ে শিশুকাল হইতেই এই ছোট গাছটিকে দেবতা বলিয়া ভাবিতে শিখিয়াছে। এইখানে আসিয়া আজ আর সে কিছুতেই সামলাইতে পারিল না। গলায় আঁচল দিয়া প্রণাম করিতে গিয়া আর উঠিতে পারিল না। দুই হাত সুমুখে ছড়াইয়া দিয়া কাঁদিয়া সাষ্টাঙ্গে লুটাইয়া পড়িল। ঠাকুর! দয়াময়! এইখানে তুমি আমার বাবাকে লইয়াছ—এইবার আমার মাকে আর আমাকে কোলে লইয়া আমার বাবার কাছে পাঠাইয়া দাও ঠাকুর! আমরা আর সহিতে পারিতেছি না। নয় চৈত্রের শেষের কয়টা দিন বলিয়া ছোটবৌয়ের বাপের বাড়ি যাওয়া হয় নাই। মাসটা শেষ হইতেই তাহার ছোটভাই তাহাকে এবং মাধুরীকে লইয়া যাইবার জন্য আসিয়া উপস্থিত হইল। আজ ভাল দিন—খাওয়া-দাওয়ার পরেই যাত্রার সময়। অতুল বাড়ি আসিয়াছিল বলিয়া স্বর্ণ তাহাকেও নিমন্ত্রণ করিয়াছিলেন। দুপুরবেলা এই দুটি যুবক আহারে বসিল, স্বর্ণ কাছে আসিয়া বসিলেন। শখ করিয়া তিনি মাধুরীর উপর পরিবেশনের ভার দিয়াছিলেন। সকালবেলা আঁশ-রান্নাটা জ্ঞানদাকে দিয়াই রাঁধাইয়া লওয়া হইত, কিন্তু তাহা গোপনে। বাহিরের কেহ জিজ্ঞাসা করিলেই স্বর্ণ অসঙ্কোচে কহিতেন, মা গো! সে কি কথা! ওকে যে আমরা রান্নাঘরেই ঢুকতে দিইনে; সুতরাং পরিবেশন করা তাহার পক্ষে একেবারে নিষিদ্ধ ছিল। তাছাড়া নিজের লজ্জাতেই সে কাহারও সাক্ষাতে বাহির হইত না—যতদূর সাধ্য ঘরের বাহিরের সকলের দৃষ্টি এড়াইয়াই সে চলিত। অতুলের সহিত মাধুরীর বিবাহ হইবে। তাই, এই সুন্দরী মেয়েটি সর্বাঙ্গে সাজসজ্জা এবং ব্রহ্মাণ্ডের লজ্জা জড়াইয়া লইয়া অপটু হস্তে যখন পরিবেশন করিতে গিয়া কেবলি ভুল করিতে লাগিল—এবং জ্যাঠাইমা সস্নেহ-অনুযোগের স্বরে, কখনো বা ‘পোড়ামুখী’ বলিয়া, কখনো বা ‘হতভাগী’ বলিয়া, হাসিয়া তামাশা করিয়া কাজ শিখাইতে লাগিলেন—তখন বিশ্বের পায়ে-ঠেলা আর একটি মেয়ে ইহারই জন্য রন্ধনশালায় নিভৃতে একান্তে বসিয়া মাথা হেঁট করিয়া সর্বপ্রকার আহার্য গুছাইয়া দিতে লাগিল। স্বর্ণ মাধুরীর বিবাহের কথা তুলিতেই সে ছুটিয়া রান্নাঘরে আসিয়া উপস্থিত হইল। জ্ঞানদা জিজ্ঞাসা করিল, কি চাই ভাই? কিছু না দিদি; আমি আর পারিনে। বলিয়া হাতের খালি থালাটা দুম করিয়া মাটিতে নিক্ষেপ করিয়া ছুটিয়া পলাইয়া গেল। পরক্ষণেই স্বর্ণ চেঁচাইয়া ডাকিলেন, একটু নুন দিয়ে যা দেখি মা। কিন্তু নুন লইবার জন্য মাধুরী ফিরিয়া আসিল না। তিনি আবার ডাকিলেন, কৈ রে—তোর ছোটমামা যে বসে আছে। তথাপি কেহ ফিরিল না। এবার তিনি রাগ করিয়া উচ্চকণ্ঠে বলিলেন,—কথা কি কারু কানে যায় না? এরা কি উঠে যাবে নাকি? তবুও যখন মাধুরী ফিরিয়া আসিল না, তখন জ্ঞানদা আর চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতে পারিল না। ভাবিল, নুন জিনিসটা ত আর ছোঁয়া যায় না—তাই বোধ করি, এ আদেশটা তাহারই উপরে হইয়াছে। তখন মলিন শতচ্ছিন্ন পরিধেয়খানিতে সর্বাঙ্গ সতর্কে আচ্ছাদিত করিয়া লইয়া, সে নুন হাতে করিয়া ধীরে ধীরে দোরগোড়ায় আসিয়া দাঁড়াইল। ছেলে দুটি তাহাকে দেখিতে পাইল না। জ্যাঠাইমা তাহার আপাদমস্তক বার-দুই নিরীক্ষণ করিয়া মৃদু কঠোর স্বরে প্রশ্ন করিলেন, তোমাকে আনতে কে বললে? মাধুরী
false
MZI
ঘামিয়ে দ্রুত সেদিকে এগিয়ে গেল—সে দুই হাত নেড়ে অদৃশ্য কিছু খুঁজতে থাকে এবং হঠাৎ করে তার হাত একজন মানুষের শরীর স্পর্শ করে। জহুর সাথে সাথে তাকে জাপটে ধরে পানির ওপর টেনে আনে। মেয়েটির শরীর নেতিয়ে আছে, জহুর তাকে তুলে ধরে তার মুখের দিকে তাকালো, চোখ দুটো বন্ধ এবং মুখে প্রাণের চিহ্ন নেই। জহুর সেটা নিয়ে মাথা ঘামালো না, মেয়েটাকে চিৎ করে ভাসিয়ে তীরের দিকে সাঁতরাতে থাকে। সমুদ্রের তীরে এসে সে মেয়েটাকে পাজাকোলা করে এনে বালুবেলায়। শুইয়ে দেয়। মেয়েটা নিঃশ্বাস নিচ্ছে কি না ভালো করে বোঝা গেল না, জহুর তার মাথাটা একটু ঘুরিয়ে দেয়, যেন নিঃশ্বাস নেয়া সহজ হয়। তারপর তাকে ধরে একটা ছোট ঝাকুনি দিল, ঠিক তখন মেয়েটি খকখক করে কেশে নড়ে ওঠে। জহুর মেয়েটাকে একটু সোজা করে বসিয়ে দেয়, কাশতে কাশতে মেয়েটা বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিতে নিতে চোখ খুলে তাকালো, তাকিয়ে জহুরকে দেখে সে একটা আর্ত চিৎকার করে ওঠে। জহুর জোর করে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, তোমার কোনো ভয় নেই মেয়ে। মেয়েটা তীব্র দৃষ্টিতে জহুরের দিকে তাকিয়ে থেকে কাশতে কাশতে বলল, আমাকে কেন তুলে এনেছ? জহুর মুখে হাসি ধরে রেখে বলল, কেন আনব না? একজন মানুষ পানিতে ড়ুবে মারা যাবে আর আমি সেটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখব, সেটা তো হতে পারে না। মেয়েটা চোখ বন্ধ করে বলল, আমাকে মরে যেতে হবে। আমাকে এক্ষুনি মরে যেতে হবে। কেন? আমার পেটের ভেতরে একটা রাক্ষস। কিলবিল কিলবিল করছে বের হওয়ার জন্যে। বের হয়ে সে সবাইকে মেরে ফেলবে। সে বের হবার আগে আমাকে মরে যেতে হবে যেন সে বের হতে না পারে। জহুর কী বলবে ঠিক বুঝতে পারল না, ইতস্তত করে বলল, তুমি এসব কী বলছ? আমি সত্যি বলছি। পারুলের পেটে একটা বাচ্চা ছিল তার অর্ধেকটা মানুষ অর্ধেকটা সাপের মতো। রাহেলরি পেটে একটা রাক্ষস ছিল তার দুইটা মাথা এত বড় বড় দাঁত। বিলকিসের পেটের বাচ্চাটার ছিল লম্বা লম্বা শুঁড়। আমার পেটের বাচ্চাটা শকুনের মতো— ছি! তুমি কী বলছ এসব। তোমাদের নিয়ে চিকিৎসা করে সবকিছু ঠিক করে দেবে। মেয়েটা মাথা নাড়ল, বলল, আমাদের কেমন করে চিকিৎসা করবে? আমাদের বিয়ে হয়নি পেটে বাচ্চা এসেছে, আমরা সব হচ্ছি শয়তানি। আমরা সব রাক্ষুসী। আমরা সব— মেয়েটা হঠাৎ বিকারগ্রস্ত মানুষের মতো কাঁদতে শুরু করে। জহুর কী করবে ঠিক বুঝতে পারে না। সে বহুদিন নরম গলায় কারো সাথে কথা বলেনি, কোমল গলায় কাউকে সান্ত্বনা দেয়নি। কেমন করে দিতে হয় সে ভুলেই গেছে। কী করবে বুঝতে না পেরে সে মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, দেখবে তুমি সব ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে। হবে না। হবে না। হবে না— হবে। জহুর জোর গলায় বলল, আমার একটা মেয়ে ছিল তোমার মতোন, তাকে আমি বাঁচাতে পারি নাই। বেঁচে থাকলে সে এখন তোমার বয়সী হতো। তুমি আমার সেই মেয়ের মতোন, আমি তোমাকে আমার মেয়ের মতোন রাখব। মেয়েটি হঠাৎ ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতে শুরু করে। জহুর কী করবে বুঝতে না পেরে মেয়েটাকে শক্ত করে ধরে রাখল। মেয়েটি হাসপাতালের ভেতর ঢুকতে রাজি হয়নি বলে জহুর তাকে মারকেল গাছের নিচে একটা বিছানা করে দিল। শুকনো কাপড় পরিয়ে একটা কম্বল দিয়ে তাকে বুক পর্যন্ত ঢেকে দিয়েছে, সে শক্ত করে কম্বলটা ধরে উদভ্রান্তে র মতো সামনে কোথায় জানি তাকিয়ে রইল। জহুর মেয়েটার কাছে চুপচাপ বসে তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে, হঠাৎ করে মেয়েটি কেন জানি চুপ করে গেছে। জহুর বলল, মানুষের জীবনে আসলে অনেক দুঃখ-কষ্ট আসে। ধৈর্য ধরে সেইগুলো সহ্য করতে হয়। যদি মানুষ সেটা সহ্য করে তাহলে দেখবে সবকিছু ঠিক হয়ে যায়। মেয়েটা জহুরের কথা শুনতে পেল কি না বোঝা গেল না সে একদৃষ্টে বহুদূরে তাকিয়ে রইল। জহুর বলল, তুমি একটু বিশ্রাম নাও। এই দ্বীপটাতে এখন কেউ নাই, শুধু তুমি আর আমি। একটু পরে নিশ্চয়ই কেউ আসবে তখন আমরা যাব। তোমার কোনো ভয় নাই। বড় বড় ডাক্তারের তোমাকে দেখবে। তোমার চিকিৎসা হবে। মেয়েটা এবারেও কোনো কথা বলল না। জহুর বলল, তুমি যদি আমাকে তোমার বাড়ির ঠিকানা দাও তাহলে আমি তোমার বাবা-মা আত্মীয়-স্বজনকে খবর দিতে পারি, তারা এসে তোমাকে নিয়ে যাবে। একটু থেমে যোগ করল, এখন যদি তাদের কাছে যেতে না চাও তুমি ইচ্ছা করলে আমার সাথেও থাকতে পার। আমার সংসার ঘর বাড়ি কিছু নাই, তুমি হবে আমার মেয়ে। আমার সাথে তুমি থাকবে— মেয়েটা হঠাৎ যন্ত্রণার মতো একটা শব্দ করল। জহুর চমকে তার দিকে তাকায়, মেয়েটার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে আছে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, সে বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। জহুর তার হাত ধরে বলল, কী হয়েছে? মেয়েটা ফিসফিস করে বলল, আমি মরে যাচ্ছি। কেন তুমি মরে যাবে? ব্যথা। মেয়েটা দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল, ভয়ানক ব্যথা। কোথায় ব্যথা? পেটে। ব্যথাটা কী আসছে যাচ্ছে? মেয়েটা মাথা নাড়ল। জহুর জিজ্ঞেস করল, একটু পরে পরে আসছে? আস্তে আস্তে ব্যথাটা বাড়ছে? মেয়েটা আবার মাথা নাড়ল। জহুর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। এই মেয়েটি এখন তার পেটে ধরে রাখা সন্তানটি জন্ম দিতে যাচ্ছে। উক্টর কাদের তার ভয়ঙ্কর গবেষণা করে এই অসহায় মেয়েটির পেটে যে হতভাগ্য একটা শিশুর জন্ম দিয়েছে সেই
false
shomresh
সামনে দাঁড়িয়ে। মালপত্র নিয়ে কুলিরা। লাইনটা এগোচ্ছে না অনেকক্ষণ। অথচ এ নিয়ে কারো কোন চিন্তা নেই। সামনের এক ভদ্রলোক বললেন, অনেকক্ষণ গাড়ি আসছে না, বোধহয় বড়বাজারে জ্যাম হয়েছে। বড়বাজার মানে? অলোক জিজ্ঞাসা করল। বাইরে থাকেন বুঝি? গেটওয়ে অফ ক্যালকাটা। ওয়ান অফ দি মোস্ট ইনডিসিপ্লিন্ড, ঘিঞ্জি এলাকা। দেখলে মনে হবে পশ্চিম বাংলা নয়। রাস্তা সরু, যে যার মত তা আটকে রাখে তাই জ্যামটা হয়ে যায়। ট্যাক্সি পেলে দেখবেন পেরোতে একঘণ্টা লাগবে। বেশ জব্বর খবর দিচ্ছেন এমন ভঙ্গীতে বললেন ভদ্রলোক। দীপাবলীর অবাক লাগত। অলোক কি জেনেশুনে ভান করছে? যে লোক এতবার হাওড়া দিয়ে কলকাতায় ঢুকেছে সে বড়বাজারের নাম শোনেনি? মাহাত্ম্য জানে না? নাকি ভদ্রলোকের মুখ থেকে কথাগুলো শোনার জন্যে অমন ভাব দেখাল। সে লাইনটার দিকে তাকাল। অন্তত শ দেড়েক লোক দাঁড়িয়ে। দুটো ট্যাক্সি এসে থামতেই কিছু লাইন ভেঙে কিছু লোক হৈ হৈ করে এগিয়ে যাচ্ছিল। একজন পুলিশ তাদের সামলাতে পারছিল না। অলোক বলল, অসম্ভব। ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করতে হলে এক জন্ম কেটে যাবে। কলকাতার মানুষ এত ধৈর্য কোথায় পায় বলতো? এই সময় দালালগুলোকে দেখা গেল। শ্রবণসীমায় এসে গুন গুন করে বলছে, ট্যাক্সি চাই দাদা, প্রাইভেট ট্যাক্সি। অলোক উৎসাহিত হল, এই যে ভাই? লোকটি সুড়ৎ করে কাছে চলে এল। অলোক জিজ্ঞাসা করল, লেকগাৰ্ডেন্স যাব। গাড়ি আছে? আছে। ৫০ টাকা লাগবে। সেই ভদ্রলোক চিৎকার করে উঠলেন, কি? ১০ টাকাও মিটারে ওঠে না আর ৫০ চাইছ? নতুন লোক পেয়ে টুপি পরানোর মতলব? দালালটি বলল, এই যে দাদু, আপনার সঙ্গে কে কথা বলছে। যার দরকার তাকে বলেছি, যেতে ইচ্ছে হলে যাবে নইলে না। অত কথা কিসের? অলোক জিজ্ঞাসা করল, একটু কম করা যায় না? না দাদা! একটু বাদে আর রাস্তায় ট্যাক্সি পাবেন না। বেহালায় এক ট্যাক্সি ড্রাইভারকে ঝেড়েছে, ওরা গাড়ি তুলে নিচ্ছে। যেতে হলে চলুন। ওপাশে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। অলোক দীপাবলীর দিকে তাকাল, অগত্যা, কি বল? দীপাবলী মাথা নাড়ল, না। আমি অত টাকা দিতে পারব না। আঃ, টাকার কথা তুলছ কেন? নিশ্চয়ই, আমার প্রয়োজনে তুমি কলকাতায় এসেছ। টাকাটা তাই আমি দেব। কাঁধ চাল অলোক। ওর মুখের চেহারা পাল্টাচ্ছে। অর্থাৎ স্বরূপটাও পাল্টাতে শুরু করবে এখনই। দীপাবলী অপেক্ষা করল। কিন্তু নিজেকে সামলে নিল অলোক নিয়ে মুখ। ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। দীপাবলীর কষ্ট হচ্ছিল দাঁড়াতে কিন্তু সেটা সে প্রকাশ করল না। দু ঘন্টা অপেক্ষা করার পরে ওরা লাইন থেকেই ট্যাক্সি পেল। মালপত্র তুলে ট্যাক্সিতে বসে মনে হল বাঁচা গেল। অলোক জিজ্ঞাসা করে সারজী ড্রাইভারের কাছে জানল কয়েকটা বড় মিছিলের জন্যে শহরে জ্যাম হয়েছে। বেহালার ব্যাপারটা ভদ্রলোক শোনেননি। অলোক চিড়বিড় করল, লোকটা ভাঁওতা দিয়ে আমাদের নিতে চাইছিল। দীপাবলী কিছু বলল না। হাওড়া ব্রিজ পার হবার আগেই গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। সামনে বড় বড় লরি, বাস, মিনি, ট্রাম থেকে ঠেলা কোন কিছুই বাদ নেই। সমস্ত শহর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কারো কোন দুশ্চিন্তা নেই। ট্যাক্সির মিটার উঠছে। অলোক মুখ ফিরিয়ে বলল, দিল্লি ছেড়ে কোথায় এলে দ্যাখো একমাত্র উন্মাদ হয়ে গেলেই কলকাতায় থাকা যায়। দীপাবলী হাসল, আমি নিজে থেকে আসিনি, আমাকে আসতে বাধ্য করা হয়েছে। আর সব কিছুই ধীরে ধীরে অভ্যেসে এসে যায়। প্রথম প্রথম যা খারাপ তা পরে তেমন লাগে না। অলোক সুযোগ নিল, কথাটা সত্যি নয়। আমাদের ক্ষেত্রে তো নয়ই। দীপাবলী মুখ ঘুরিয়ে নিল। এ প্রসঙ্গে কথা বলার মত শক্তি আর অবশিষ্ট নেই। তার চোখ পড়ল গঙ্গার ঘাটে। সেখানে কিছু লোক স্নান করছে। অদূরেই জলে কিছু একটা ভেসে যাচ্ছে। দুটো কাক তার ওপরে বসে পরমানন্দে ঠুকরে চলেছে। স্নানার্থীরা এ নিয়ে একটুও মাথা ঘামাচ্ছে না। কোথায় যেন পড়েছিল দীপাবলী ঈশ্বরকে পেতে হলে চারপাশের সমস্ত কিছু উপেক্ষা করতে হয়। নিৰ্লিপ্ত হয়ে নিজের কাজ করে যাও। এখন মনে হচ্ছে কলকাতার মানুষেরা ওইভাবে স্বর্গের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। দেড় ঘণ্টা সময় লাগল পৌঁছাতে। তার পরেও কিছুটা সময় বাড়িটাকে খুঁজে বের করতে গেল। অলোক হোটলে উঠতে চেয়েছিল, দীপাবলী রাজী হয়নি। কলকাতার হোটেলে দু-জনে দুটো ঘর নিলে অনেক কৌতূহল তৈরী হবে। তাছাড়া, হোটলে পৌঁছে অলোক যদি দুটো ঘরের প্রস্তাব উড়িয়ে দেয় তাহলে আর একটা সমস্যা হবে। দারোয়ানকে ডেকে চিঠিপত্র দেওয়ার পর জানা গেল তারা ইতিমধ্যে খবর পেয়ে গিয়েছে। সিড়ি ভেঙ্গে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দীপাবলী খুশী। ঘরগুলো সুন্দর, জানলা খুলে দিতেই অনেক আলো অনেক হাওয়া হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল। বাথরুমেও পর্যাপ্ত জল। কিন্তু সমস্যা হল ফ্ল্যাটে কোন ফার্নিচার নেই। বসার জায়গা পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। অলোক বিরক্ত গলায় বলল, এভাবে চলে এসে কি লাভ হল? কালকের মধ্যে কিছু কিছু কিনে নেব। কালকের কথা কালকে। আজ কি হবে? দারোয়ান চুপচাপ শুনছিল। সে বলল, পাশের ফ্ল্যাটে ফার্নিচার খাটটাট সব আছে। ওর চাবিও আমাদের কাছে। কেউ নেই ওখানে। আজকের রাতটা ইচ্ছে করলে ওখানে থেকে সব ব্যবস্থা করে নিতে পারেন। লোকটাকে দেবদূত বলে মনে হচ্ছিল। অলোক ওকে কিছু টাকা দিল খাবার আনার জন্যে। পাশের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে দিয়ে চলে গেল লোকটা। ভেতরে ঢুকেই বিছানায় শুয়ে পড়ল অলোক, আঃ কি আরাম। নিজের সুটকেস দ্বিতীয় ঘরটায় নিয়ে গিয়ে দীপাবলী দেখল সেখানেও খাট-বিছানা পাতা আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ব্যবহার করা হয়নি অনেকদিন।
false
toslima_nasrin
আছে এই জমিদারি। মিঠেখালির জমি থেকে যা আয় হয়, তার মায়ের ভাগ সে নিয়ে যায় এখান থেকে। বহু বছর হল এভাবেই নিচ্ছে সে ভাগটি। ভাগ নিয়ে কিছু সে নিজের জন্য রেখে বাকিটা রেখে যায় বন্দরের সংসার-কাজে। কিন্তু রুদ্র এখন ভাগের ধান বিক্রিতে বিশ্বাসী নয় আর। অনেকদিন থেকে সে তার মাকে বলছে যেন মেজ মামা জমি ভাগের ব্যবস্থা করেন। তার মায়ের ভাগেরটুকু থেকে কিছু বিক্রি করে সে ঢাকায় ছাপাখানার ব্যবসা শুরু করবে। রুদ্র ঢাকার পঞ্চাশ লালবাগের বাড়িটিতেও তার মায়ের ভাগ দাবি করে, ওটিও ছেড়ে দিতে সে রাজি নয়। বীথি তার দাদাকে লোক চক্ষুর অন্তরালে সমর্থন জানিয়ে যায়। জমি ভাগ করতে মেজ মামা রাজি হন না। বড়মামার পর এখন মেজই হর্তকর্তা, তিনি না চাইলে ভাগ সম্ভব নয়। জমিজমা বিষয়ক জটিলতা থেকে আমার মন উঠে দৌড়ে যায় শান বাধাঁনো পুকুরঘাটে। চল যাই, হাঁসের সাঁতার দেখি বসি। চল, পুকুরে গোসল করি। আমার আবদার শুনে বাড়ির সবাই হাসে, রুদ্রও হাসে। যেন আমার বোধ হয়নি বুদ্ধি হয়নি, যেন জীবন কাকে বলে তার কিছুই আমি এখনও জানি না। আমি আমার শিশুসুলভ অপরিপক্বতা দিয়ে কেবল লোক হাসাতে পারি। পুকুরে বাইরের মানুষ গোসল করতে আসে, ও পুকুরে বাড়ির বউএর নাওয়া চলবে না। গোসল করতে হলে বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে ভেতরের পুকুরে। ভেতরের ঘোলা পুকুরে আমি পা ডুবিয়ে বসে থাকি। দোতলার জানালা থেকে আমি তাকিয়ে থাকি পুকুরটির দিকে। পুকুরটিকেও আমার মত খুব একলা মনে হয়। যেন দীর্ঘ দীর্ঘ দিন তারও কোথাও কোনও পুকুরে গোসল সারা হয়নি। গায়ে শ্যাওলা জমে আছে পুকুরের। এই পুকুরটির পানি দিয়েই এ বাড়ির রান্নাবান্না ধোয়া পাকলা অযু গোসল সব হয়। পানি খাওয়াও হয়। বড় বড় মটকিতে বর্ষার সময় বর্ষার জল জমিয়ে রাখার নিয়ম। মটকিগুলো উঠোনেই পড়ে থাকে। সারাবছর মটকির পানিও খাওয়া হয়। ফুরিয়ে গেলে পুকুরের পানি। একদিন পানি খেতে গিয়ে গেলাসের পানিতে দেখি অনেকগুলো কিড়ে কিলবিল করে সাঁতার কাটছে। অন্যরা দিব্যি কিড়েঅলা পানি খেয়ে নিচ্ছে। আমি হা হা করে থামাতে এলে বীথি বলল, ও কিড়ে কোনও ক্ষতি করে না, ও খাওয়া যায়। বীথি আমাকে পানির উৎসের কথা বলে, বলে কি করে খাবার পানি সংগ্রহ করে ওরা। আমি থ হয়ে বসে থাকি। দেখে হাসে সবাই। আমাকে খুব অদ্ভুত চিড়িয়া কিছু ভাবে নিশ্চয়ই ওরা। পানিহীন দিন কাটতে থাকে আমার। দিনে যে দুকাপ চা খাওয়া হয়, তা দিয়ে পানির অভাব পুরণ করি শরীরের। রুদ্র মোংলা বন্দর থেকে অনেকগুলো ফানটা কোকোকোলা আনিয়ে দিয়েছে আমার জন্য। জানালায় দাঁড়িয়ে দেখি পুকুরটিতে লোকেরা সাবান মেখে গোসল করছে। বুঝি না, কি করে এত নিশ্চিন্তে এই পুকুরের পানিই পান করছে সবাই! এত জমি এত টাকা, অথচ কোনও বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা কি কেউ করতে পারে না? রুদ্র বলে, ব্যবস্থা করার কোনও প্রয়োজন নেই। এই পানি খেয়ে আসছি সেই ছোটবেলা থেকে, কখনও কোনও অসুখ হয়নি। কাকুর ঘরটিতে বসে আমার অলস অবসর সময় কাটতে থাকে। এ বাড়িতেও বই খুঁজি। হাদিস কোরানের ওপর কিছু বই ছাড়া অন্য কোনও বই নেই, কিছু পঞ্জিকা আছে শুধু এ ঘরে বসেই পুরোনো পঞ্জিকা খুলে রুদ্র একদিন আমার জন্মতারিখ বের করেছিল। আরবি সালের বারোই রবিউল আওয়াল আগস্ট মাসের মাঝামাঝি পড়েছে ইংরেজি কোন সালে, আটান্ন থেকে চৌষট্টি পর্যন্ত খুঁজে বের করে জানিয়েছিল বাষট্টি সালে। বাষট্টি সালের পঁচিশে আগস্টে। এই কাকুর ঘরে খামোকা কাজকম্মহীন বসে থাকতে রুদ্রর কোনও অসুবিধে হয় না। দীর্ঘ দীর্ঘ মাস এ ঘরেই বসে থাকে সে। এ ঘরে বসেই কবিতা লেখে, এ ঘরে বসেই ডাকে পাঠানো আমার চিঠি পড়ে, নিজেও লেখে। ঘরে বসে থাকতে থাকতে জীবন স্যাঁতসেঁতে লাগে, রুদ্রকে যখনই বলি, চল ঢাকা ফিরে যাই। রুদ্র এক কথাই বলে টাকার যোগাড় হোক আগে। কি করে টাকার যোগাড় হবে আমার বোঝা হয় না। যেদিন আমরা মিঠেখালি ছাড়ি, তার আগের রাতে রুদ্র মোংলা বন্দর থেকে মদ খেয়ে ফিরেছে। প্রায়-মাতাল রুদ্র একটি কাণ্ড ঘটাতে চায়। আমার বাধা না মেনে সে কাণ্ডটি ঘটায়। তার মেজ মামার আলমারির তালা ভেঙে জমির দলিল বের করে আনে। দলিল হাতে তার। যে দলিলটি পেতে বছরের পর বছর সে অপেক্ষা করেছে। সে এখন দিব্যি কোনওরকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই তার মার ভাগের জমি বিক্রি করে দিতে পারে যে কারও কাছে। কিন্তু বাড়ির কেউই রুদ্রর এই কাণ্ডটিকে সমর্থন করে না। কাকু এত যে তার আদরের, তিনিও করেন না, রুদ্রর মা, যাঁর জমি, তিনিও তার পুত্রের এমন অসভ্যতা মেনে নেন না, বীথিও না, যে কি না তার দাদার প্রতি কাজে বাহবা দিয়ে আসছে। রুদ্রর পদক্ষেপটি সম্পূর্ণই বিফলে যায়। মেজমামার কাছে ক্ষমা চেয়ে তাঁর হাতেই শেষ অবদি তুলে দিতে হয় দলিলটি। চলে যাওয়ার দিন রুদ্র আমাকে ঠেলে পাঠায় মেজমামাকে যেন পা ছুঁয়ে সালাম করি, কদমবুসি করি। রুদ্রর আদেশ আমি নতমুখে পালন করি, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর একশ কর্তব্যের এটি একটি। রুদ্রর অনেক কিছু বিফলে যায়। নটা পাঁচটা চাকরি তার পোষাবে না বলেছিল, তারপরও ঢাকায় সে চাকরির জন্য ধরনা দেয়। চাকরি পাওয়া হয় না। পত্রিকা অফিসগুলোয় ঘোরে, ওখানেও ব্যবস্থা হয় না কিছুর। অন্তত কোনও পত্রিকায় যদি সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে তার একটি চাকরি জুটত। কে দেবে চাকরি! নামি লেখক সৈয়দ
false
shottojit_roy
পর্যন্ত কার কার সঙ্গে আলাপ হল?’ প্রশ্নটার জন্য মোটেই তৈরি ছিলাম না, তাই প্রথমটা কী রকম হকচকিয়ে গেলাম। ঢোক গিলে বললাম, ‘একেবারে বাগডোগরা থেকে শুরু করতে হবে নাকি?’ ‘দূর গর্দভ। এখন যারা গ্যাংটকে রয়েছে, তার মধ্যে বল৷’ ‘এক—শশধরবাবু।’ ‘পদবি?’ ‘দত্ত।‘ ‘তোর মুণ্ডু।’ ‘সরি–বোস।’ ‘কেন এসেছেন। এখানে?’ ‘ওই যে বললেন কী সুগন্ধী গাছের ব্যাপার।’ ‘অতি দায়সারাভাবে বললে চলবে না।’ ‘দাঁড়াও। ভদ্রলোকের পাটনার মিস্টার শৈলভাঙ্কারকে মিট করতে। ওদের একটা কেমিক্যাল কোম্পানি আছে, যার অনেক কাজের মধ্যে একটা কাজ হল—‘ ‘ও কে–ও কে; নেক্সট?’ ‘হিপি।‘ ‘নাম?’ ‘হেলমেট—‘ ‘মুট। মেট নয়। হেলমুট।’ ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ৷’ ‘পদবি?’ ‘উঙ্গার ‘আসার উদ্দেশ্য?’ ‘প্রোফেশনাল ফোটোগ্রাফার। সিকিমের ছবি তুলে একটা বই করতে চায়। তিনদিনের ভিসা পেয়েছিল, বলে-কয়ে বাড়িয়ে নিয়েছে।’ ‘নেক্সট?’ ‘নিশিকান্ত সরকার। দার্জিলিং-এ থাকেন। তিন পুরুষের বাস। কী করেন জানি না। একটা তিব্বতি মূর্তি ছিল, শেলভাঙ্কারকে—’ দরজায় টোকা পড়ল। ‘কাম ইন ‘ ফেলুদা ভীষণ সাহেবি কায়দায় বলে উঠল। ‘ডিসটার্ব করছি না তো?’ নিশিকান্ত সরকারের প্রবেশ! ‘একটা খবর দিতে এলুম।’ ফেলুদা সোজা হয়ে বসে ভদ্রলোককে খাটের পাশের চেয়ারটা দেখিয়ে দিল। নিশিকান্তবাবু তার সেই অদ্ভুত হাসি নিয়ে চেয়ারে বসে বললেন, ‘কাল লামা ডান্স হচ্ছে।’ ‘কোথায়?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল। ‘রুমটেক। এখান থেকে মাত্র দশ মাইল। দারুণ ব্যাপার। ভুটান কালিম্পং থেকে সব লোক আসছে। রুমটেকের যিনি লামা—তাঁর পোজিশন খুব হাই–জানেন দলাই, পাঞ্চেন, তারপরেই ইনি। ইনি তিব্বতেই থাকতেন। ইদানীং এসেছেন। মঠটাও নতুন। একবার দেখে আসবেন নাকি?’ ‘সকালে হবে না৷’ ফেলুদা ভদ্রলোককে একটা চারমিনার অফার করল।’দুপুরে খাওয়া-দাওয়া সেরে যাওয়া যেতে পারে।’, ‘অ্যার পরশু। যদি যান, তা হলে হিজ হোলিনেস-এর দর্শনও পেতে পারেন। বলেন তো গুটি চারেক সাদা স্কার্ফ জোগাড় করে রাখি।’ আমি বললাম, ‘স্কার্ফ কেন?’ নিশিকান্ত হেসে বললেন, ‘ওইটেই এখানকার রীতি। হাইক্লাস কোনও তিব্বতির সঙ্গে দেখা করতে গেলে স্কার্ফ নিয়ে যেতে হয়। তুমি গিয়ে তাঁকে স্বার্ফটা দিলে, তিনি আবার সেটা তোমাকে ফেরত দিলেন–বাস, ফরম্যালিটি কমপ্লিট।’ ফেলুদা বলল, ‘লামাদর্শনে কাজ নেই। তার চেয়ে নাচটাই দেখা যাবে।’ ‘আমারও তাই মত। আর গেলে কালই যাওয়া ভাল। যা দিন পড়েছে, এর পরে রাস্তাঘাটের কী অবস্থা হবে বলা যায় না।’ ‘ভাল কথা।–আপনি আপনার মূর্তির কথা কি শৈলভাস্কার ছাড়া আর কাউকে লছিলেন?’ নিশিকান্তবাবুর জবাব দিতে দেরি হল না।’ঘুণাক্ষরেও না। নট এ সোল। কেন বলুন তো?’ ‘না-এমনি জিজ্ঞেস করছি।’ ‘এখানকার দোকানে গিয়ে ওটা একবার যাচাই করব ভেবেছিলাম, তবে তারও প্রয়োজন হয়নি। দোকানেই শেলভাঙ্কারের সঙ্গে আলাপ হয়, তারপর সোজা ডাকবাংলোয় গিয়ে জিনিসটা দিয়ে আসি। অবিশ্যি উনি একদিন রেখে তারপর দামটা দিয়েছিলেন।’ ‘নগদ টাকা?’ ‘না না। সেটা হলে আমার সুবিধেই হত, কিন্তু ক্যাশ ছিল না ওঁর কাছে। চেক দিয়েছিলেন। দাঁড়ান—‘ নিশিকান্তবাবু তাঁর ওয়ালেট থেকে একটা ভাঁজ করা চেক বার করে ফেলুদাকে দেখালেন। আমিও বুকে পড়ে দেখে নিলাম। ন্যাশনাল অ্যান্ড গ্রিন্ডলেজ ব্যাঙ্কের চেক–তলায় দারুণ পাকা সই–এস শেলভাঙ্কার। ফেলুদা চেকটা ফেরত দিয়ে দিল। ‘কোথাও কোন সাস-মানে, সাসপিশাস কিছু দেখলেন নাকি?’ মুখে সেই হাসি নিয়ে নিশিকান্তবাবু জিজ্ঞেস করলেন। ‘নাঃ!‘ফেলুদা হাই তুলল। ভদ্রলোক উঠে পড়লেন। বাইরে একটা চোখ-ঝলসানো নীল বিদ্যুতের পর একটা প্রচণ্ড বাজের শব্দে ঘরের কাচের জানালা ঝন ঝন করে উঠল। নিশিকান্তবাবু দেখলাম ফ্যাকাসে হয়ে গেছেন। ‘বাজ জিনিসটাকে মোটেই বরদাস্ত করতে পারি না, হেঁ হেঁ। আসি…’ যখন ডিনার খাচ্ছি তখনও বৃষ্টি, যখন শুতে গেলাম তখনও বৃষ্টি, যখন ঘুমোচ্ছি তখনও এক-একবার বাজের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেছে—আর বৃষ্টির শব্দ পেয়েছি। একবার ঘুম ভেঙে জানালার দিকে চোখ পড়াতে মনে হল, কে যেন জানালার বাইরের কাঠের বারান্দা দিয়ে হেঁটে গেল। কিন্তু এই দুর্যোগের রাতে কে আর বাইরে বেরোবে? নিশ্চয়ই আমার দেখার ভুল। কিংবা হয়তো ঘুমাই ভাঙেনি। পাহাড়ের দিকের জানালার কাচের মধ্যে দিয়ে বিদ্যুতের আলোয় দেখা লাল পোশাক পরা লোকটা হয়তো আসলে আমার স্বপ্নে দেখা। ভোরে বৃষ্টি থেমেছে কোন ভোরে বৃষ্টি থেমেছে জানি না। সাড়ে ছ’টায় উঠে জানালার কাছে গিয়ে দেখি আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার, চারিদিকে রোদ-ঝলমল, আর আমার ঠিক সামনের পাহাড়ের সারির পিছন দিয়ে মাথা উচিয়ে রয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা৷ দার্জিলিং-এর চেয়ে অন্য রকম দেখতে, হয়তো অত সুন্দরও না, কিন্তু তা হলেও চেনা যায়, তা হলেও কাঞ্চনজঙ্ঘা৷ ফেলুদা আমার আগেই উঠে যোগব্যায়াম সেরে স্নানে ঢুকেছিল, এইমাত্র বেরিয়ে এসে বলল, ‘চটপট সেরে নে—অনেক কাজ৷’ পনেরো মিনিটের মধ্যেই আমার সব কিছু সারা হয়ে গেল। ব্রেকফাস্ট খেতে যখন নীচে নেমেছি তখন সবে সাতটা বেজেছে। একটু অবাক লািগল দেখে যে নিশিকান্তবাবু আমাদের আগেই ডাইনিং রুমে এসে হাজির হয়েছেন। ফেলুদা বলল, ‘আপনি তো খুব আর্লি রাইজার মশাই?’ কাছে গিয়ে বুঝলাম, মুখে সেই হাসিটা থাকা সত্ত্বেও ভদ্রলোককে কেমন জানি একটু নার্ভাস বলে মনে হচ্ছে। ‘আপনাদের, ইয়ে, মানে ভাল ঘুমটুম হয়েছিল?’ বুঝলাম আসলে ওর অন্য কিছু বলার দরকার, আগে একটু পাঁয়তাড়া কষছেন। ভদ্রলোকের গলাটা শুকনো শোনাল। ‘মন্দ কী?’ ফেলুদা বলল। ‘কেন বলুন তো? ভদ্রলোক এ দিক ও দিক দেখে নিয়ে তার কোটের বুক পকেট থেকে একটা হলদেটে কাগজ বার করে ফেলুদার দিকে এগিয়ে দিলেন। ‘এটা কী ব্যাপার বলুন তো?’ দেখি কাগজটার উপর কালো কালি দিয়ে কয়েকটা অদ্ভুত অক্ষরে কী যেন লেখা রয়েছে! ফেলুদা বলল, ‘এ তো তিব্বতি লেখা বলে মনে হচ্ছে। কোথায় পেলেন? ‘কাল রাত্ৰে-মানে মাঝরাত্রেী-অ্যাট, মানে অ্যাট ডেড অফ নাইট–কেউ আমার
false
humayun_ahmed
ফেলল মারুফ না আসা পর্যন্ত সে কিছুই খাবে না। সে যদি আজ রাত এগারোটায় আসে তিথি রাত এগারোটা পর্যন্ত না খেয়ে অপেক্ষা করবে। মারুফের সবচে বড় সমস্যা হল সে বেশীর ভাগ সময়ই কথা দিয়ে কথা রাখে। তার জন্যে সে মন খারাপ করে না বা দুঃখিতও হয় না। যেন কথা দিয়ে কথা না রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ কোন ব্যাপার না। স্বাভাবিক ব্যাপার। তিথি ঘড়ি দেখে ঠিক এগারোটা বাজার দশমিনিট আগে ঘর তালা দিয়ে বের হল। নিউমার্কেট যেতে লাগবে দশ মিনিট। ছবি তুলে এক ঘণ্টা ঘোরাফেরা করবে। বারোটায় ছবি ডেলিভারী নিয়ে বেবীটেক্সী করে বাবার কাছে চলে যাবে। সেখান থেকে পাসপোর্ট অফিস। জাফর সাহেব অফিসে এসে দেখেন তার ঘর খোল। ঘরে তিথির বড় মামা বিরক্ত মুখে বসে আছেন। শুধু বসে আছেন বললে ভুল হবে পাইপ টানছেন। পাইপের ধোয়ায় ঘর অন্ধকার। এয়ার কুলার বসানো ঘরে দরজা জানালা বন্ধ থাকে। ধোয়া ঘর থেকে বেরুতে পারে না। তিথির বড় মামা সাইদুর রহমান আর্মি শটকোর্সে মিলিটারীতে ছিলেন। দশ বছর চাকরির পর লেফটেন্যান্ট কর্ণেল হয়ে রিটায়ার করেছেন। বর্তমানে ব্যবসা করেন। সারাক্ষণই বলেন, ব্যবসার অবস্থা ভয়াবহ। কিন্তু তিনি ভয়াবহ অবস্থায় আছেন বলে মনে হয় না। ধানমন্ডিতে আশি লক্ষ টাকায় দশ কাঠা জমি কিনেছেন। সেখানে পাঁচতলা ফ্ল্যাট বাড়ি হবে। প্রতি তলায় দুটা করে ফ্ল্যাট। একেকটি বিক্রি হবে চল্লিশ লক্ষ টাকায়। এর মধ্যে ৬টি বিক্রি হয়ে গেছে। উত্তরার কাছে উত্তরখান নামের জায়গায় ছ বিঘার মত জমি কিনেছেন। সেখানে বাগানবাড়ি হচ্ছে। বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। সামনে ঝিল, ঝিলে নৌকা। বলতে গেলে হুলুস্থুল ব্যাপার। যে এমন হুলুস্থূল ব্যাপার শুরু করে তার মুখে সারাক্ষণ বিজনেসের অবস্থা ভয়াবহ–এই কথা শুনতে ভাল লাগে না। জাফর সাহেবের অসহ্য লাগে। তিনি রিটায়ার্ড লেফটান্যান্ট কর্ণেল সাইদুর রহমানকে দু চোখে দেখতে পারেন না। মাস খানিক আগে সাইদুর রহমানের ছোটমেয়ে পিঙ্গলার জন্মদিন উপলক্ষ্যে রিভার ক্রুজ হল। জাহাজে করে পাগলা থেকে চাদপুরে যাওয়া এবং ফিরে আসা। রিভার ক্রুজে সবাই গিয়েছে তিনি যাননি। শরীর খারাপের অজুহাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন। সাইদুর রহমান জাফর সাহেবকে দেখে মুখ থেকে পাইপ নামিয়ে কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। জাফর সাহেব বললেন, খবর সব ভাল? সাইদুর রহমানের ভ্রু কুঁচকে গেল। তিনি পাইপে নতুন করে তামাক ভরতে লাগলেন। জাফর সাহেব বললেন, কতক্ষণ হল এসেছেন? অনেকক্ষণ। আমি এসেছি আটটা চল্লিশে এখন বাজে নটা পঞ্চাশ। তুমি কি সবসময়ই অফিসে এমন দেরী করে আস? অপমান সূচক প্রশ্ন। এ জাতীয় প্রশ্নের জবাব দেয়াও এক ধরনের অপমান। জাফর সাহেব বললেন, চা দিতে বলব চা খাবেন? চা খেতে পারি। বেয়ারাকে চায়ের কথা বলে জাফর সাহেব নিজের চেয়ারে বসলেন। তিনি খানিকটা চিন্তিত। লেফটেন্যান্ট কর্ণেল সাহেব ঠিক কি উদ্দেশ্য এসেছেন বোঝা যাচ্ছে না। সাইদুর রহমান পাইপে লম্বাটান দিয়ে বললেন, আমি তোমার বাসাতেই। যেতাম। শেষ পর্যন্ত অফিসে আসলাম। কিছু ট্যাকনিক্যাল কথাবার্তা আছে যা অফিসে বলা যায় না। কি ট্যাকনিক্যাল কথা? আমি অনেকদিন থেকেই ভাবছি–তোমার সঙ্গে একটা ফুল ডিসকাশান হওয়া উচিত। তোমার কি বলার আছে আমি শুনতে চাই। এক তরফা কথা শুনলে তো হবে না। এক তরফা কি কথা শুনেছেন? আমি বুঝতে পারছি না। চা আসুক। তারপর বলি। সাইদুর রহমান চোখ বন্ধ করে পাইপ টানছেন। জাফর সাহেবের ইচ্ছা করছে তার বেয়ারাকে ডেকে বলেন, এই হামবাগটাকে ঘাড় ধরে ঘর থেকে বের করে দাও। বের করে দেবার পর যে চেয়ারে হামবাগটা বসেছে সেটা ডেটল পানিতে ধুয়ে দাও। মনে যা ভাবা যায় অধিকাংশ সময়ই তার উল্টোটা করতে হয়। জাফর সাহেব বেয়ারাকে তাড়াতাড়ি চা আনতে বললেন। সাইদুর রহমান বললেন, তোমার ঘরের দরজায় কি লালবাতি জ্বালানোর সিস্টেম আছে? সিস্টেম থাকলে লালবাতী জ্বালিয়ে দাও–আমি চাইনা আমার কথাবার্তায় ইনটারাপসান হোক। আপনার এমন কি কথা যে লালবাতি জ্বালিয়ে বলতে হবে? সাইদুর রহমান আবার ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। চা এসে গেছে। তিনি এক চুমুক খেয়ে বললেন, চা তো ভাল বানিয়েছে। যাবার সময় আরেক কাপ খেতে হবে। মনে করিয়ে দিও তো। মনে করিয়ে দেব। এখন বলুন কি ব্যাপার? লালবাতি জ্বালিয়ে দিয়েছি ঘরে কেউ ঢুকবে না। সাইদুর রহমান গম্ভীর গলায় বললেন, শায়লা আমাকে কমপ্লেইন করেছে তুমি নাকি তাকে মারধর কর। ব্যাপারটা কি? ও আপনাকে বলেছে? না বললে তো জানতে পারতাম না। আমার কাছে ওহী নাজেল হয় নি। আমি শায়লার কথা শুনে স্তম্ভিত। যার মেয়ে এম. এ. পাশ করেছে তাকে মারধোর করতে সাহস লাগে। তোমার সাহস আছে বোঝা যাচ্ছে। . আপনি কি আমাকে শাস্তি দিতে এসেছেন? না। শাস্তির প্রশ্ন আসে না। তবে শায়লা তোমাকে শাস্তি দিতে চায়। সে ঠিক করেছে তোমার সঙ্গে আর বাস করবে না। এই কথাটাই তোমাকে বলতে এসেছি। বলুন শুনছি। ও যা চাচ্ছে তা হল সে তার মেয়েদের নিয়ে থাকবে তুমি আলাদা কোথাও থাকবে। বাড়ি ভাড়া করে থাকতে পার। কিংবা কোন হোটেলে ঘর নিয়ে থাকতে পার। এবং আমার কাছে মনে হয় এটা দুজনের জন্যেই মঙ্গলজনক হবে। সমস্যার ভদ্র সমাধান হবে। কিছুদিন এই ভাবে থাকার পর লোকলজ্জার ভয়েই হোক কিংবা মেয়েদের কারণেই হোক আবার তোমরা একত্রে থাকা শুরু করতে পারবে। শায়লা এটা চায়? সে যা চায় তা ভয়াবহ। সে চায় ডিভোর্স। তারতো এম্নিতেই মাথা গরম। উকিল ডেকে এনে হুলুস্থুল কাণ্ড! বুঝিয়ে সুঝিয়ে
false
humayun_ahmed
র‍্যাব। একটা পান খেতে পারলে ভালো হতো। পান আনিয়ে দিচ্ছি। জর্দা লাগবে? জি লাগবে। জর্দা ছাড়া পান। আর নিকোটিন ছাড়া সিগারেট একই জিনিস। জর্দা দেয়া পান আনিয়ে দিলাম। তিনি যেরকম তৃপ্তির সঙ্গে খাবার খেয়েছেন সেরকম তৃপ্তির সঙ্গে জর্দা দেয়া পান চিবাতে লাগলেন। আমি বললাম, সিগারেট খাবেন? ভদ্রলোক বললেন, সিগারেটের অভ্যাস নাই। তারপরেও একটা দিন, খাই। সমুদ্রে পেতেছি শয্যা শিশিরে কী ভয়! শয্যা যখন পেতেছেন ঠিকমতো পাতেন। শুয়ে একটা ঘুম দেন। ঘুম দিব মানে? ভালো খাওয়ার পর আরামের একটু ঘুমাও খাবারেরই অংশ। পাঁচ দশ মিনিট না ঘুমালো লাঞ্চ কমপ্লিট হবে না। সত্যি ঘুমাতে বলছেন? আপনার ইচ্ছ। আমি ঘর ছেড়ে দিলাম। আমার ঘরের দরজায় কখনো তালা দেয়া থাকে না। সবসময় খোলা। যখন চলে যেতে ইচ্ছা করবে চলে যাবেন। আপনি যাচ্ছেন কোথায়? আমি চা এবং কফি ফেরি করব। ফিরবেন কখন? বলতে পারছি না। তাহলে কিছুক্ষণ শুয়েই থাকি? থাকুন। আপনার নাম জানা হলো না। আমার নাম হারুন। হারুন-আল-রশিদ। বাগদাদের খলিফা। আমি বললাম, বাগদাদের খলিফা দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়ার পর কিছুক্ষণের জন্য হলেও চোখ বন্ধ করে আরাম করবে না তা হয় না। হারুন-আল-রশিদ আনন্দিত গলায় বললেন, অতি সত্যি কথা। হিমু ভাই, আমি শুয়ে পড়লাম। আজ প্রথমদিনের মতো বিক্রি হচ্ছে না। অনেকেই কাছে আসছে, তবে চাকফির জন্যে না, গলা নিচু করে বলছে–পুরিয়া আছে? পুরিয়া? শুরুতে ভেবেছিলাম পুরিয়া হলো গাঁজা। পরে বুঝলাম পুরিয়া বলতে হিরোইনের পুরিয়া বোঝাচ্ছে। ঢাকা শহরের পার্কগুলিতে প্ৰকাশ্যে পুরিয়া কেনাবেচা হয় এই তথ্য জানা ছিল না। এর মধ্যে মাজেদা খালার টেলিফোন। অ্যাই তুই কোথায়? পার্কে? দাড়িগোঁফ লাগিয়ে গিয়েছিস? হুঁ। সত্যি, না আমার সঙ্গে লাফাংগায়িং করছিস? সত্যি পার্কে। তোর খালুর দেখা পেয়েছিস? না। সে তো কেডস ফেডস পরে সেজেগুজে বের হয়েছে। খুঁজে দেখা। মেয়েটার নাম মনে আছে, না ভুলে গেছিস? নাম মনে আছে–সানফ্লাওয়ার। সূৰ্যমুখি। তোর মতো গাধাকে দিয়ে তো কোনো কাজই হবে না। সানফ্লাওয়ার না। শুধু ফ্লাওয়ার। পুষ্প। খালা এক মিনিট, খালু সাহেবের মতো একজনকে দেখা যাচ্ছে। আজ কি উনার মাথায় সবুজ ক্যাপ? হুঁ। তাড়াতাড়ি পিছনে লেগে যা। ছবি কীভাবে তুলতে হয় মনে আছে? মনে আছে। দশ মিনিট পর আমি আবার টেলিফোন করব। তোমার করতে হবে না। আমিই করব। না না তোকে করতে হবে না। তুই ভুলে যাবি। আমিই টেলিফোন করব। দশ মিনিট পর করব। মাজেদা খালা পাঁচ মিনিটের মাথায় টেলিফোন করলেন। কথা বলছেন ফিসফিস করে। হিমু। অ্যাই হিমু। হুঁ। তোর খালু কোথায়? বাদাম খাচ্ছে। বাদাম খাচ্ছে? হুঁ। হেভি খাওয়া দাওয়ায় আছে। ঐ মেয়ে কোথায়? মনে হয় তার পাশে। তুই কি গুছিয়ে কথা বলা ভুলে গেছিস। তার পাশে মানে কী? উনার পাশে একটা মেয়ে বসে আছে। সে সূর্যমুখি কি-না তা জানি না। তুই বারবার সূর্যমুখি বলছিস কেন? ঐ বদ মেয়েটার নাম ফ্লাওয়ার। শুধু ফ্লাওয়ার। এই মেয়েটাই ফ্লাওয়ার কি-না তা তো জানি না। আমি তো তাকে আগে দেখি নি। মেয়েটা দেখতে কেমন? দেখতে খুবই সুন্দর। পরী টাইপ। তোদের পুরুষদের চোখে পৃথিবীর সব মেয়েই খুবই সুন্দর। মেয়েটা করছে কী? বাদাম খাচ্ছে। সেও বাদাম খাচ্ছে? হুঁ। ছবি তুলেছিস? না। আরে গাধা এক্ষুনি ছবি তোল। আলো কমে গেলে ছবি উঠবে? এমনভাবে তুলিবি যেন মেয়েটার পুরোপুরি পাওয়া যায়। তারপর জুম করৰি। মেয়েটা কী পরেছে? শাড়ি। শাড়ির রঙ কী? শাড়ির রঙ দিয়ে কী হবে? দরকার আছে। গোলাপি। ছবি তোল। ছবি তোলার পর আমাকে জানা। জুম করার কথা মনে আছে? আছে। আমি টেনশন আর নিতে পারছি না। তুই ছবি তোল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি খালাকে জানালাম যে ছবি তোলা হয়েছে এবং জুম করা হয়েছে। মাজেদা খালা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। আমি বললাম, খালু সাহেবকে কি আজই ধরা হবে? মাজেদা খালা বললেন, ছয়-সাতদিন ধরে ক্রমাগত তার ছবি তোলা হবে। তারপর তাকে ধরব। কচ্ছপের কামড়। এই সাতদিনে তোর খালু সাহেব কিছুই বুঝতে পারবে না। আমি লক্ষ্মী বউয়ের মতো আচার আচরণ করব। আমি বললাম, গুড গার্ল। খালা ধমক দিয়ে বললেন, কী বললি? গুড গার্ল বলেছি। আমি তোর কাছে গুড গার্ল। সবসময় ইয়ারকি? সবসময়? সরি। হিমু শোন, নায়ক-নায়িকা এখন কী করছে? এখন কী করছে তা তো জানি না। আমি তো আর ওখানে নাই। খালা হাহাকার করে উঠলেন, ওদেরকে এইভাবে রেখে চলে এসেছিস? তুই কি পাগল? তোর কি ব্রেইন পচে গু হয়ে গেছে? আমি সারাক্ষণ পিছনে লেগে থাকব? অবশ্যই। ডিটেকটিভ বই-এ কী লেখা থাকে? টিকটিকি কী করে? ছায়ার মতো লেগে থাকে। এখন থেকে তুই আমার টিকটিকি! যা, আবার ফিরে যা। কী করছে দেখা। যদি দেখিস হাত ধরাধরি করে বসে আছে, ছবি তুলবি। ছবি তুলব। কীভাবে! অন্ধকার হয়ে গেছে তো। অন্ধকার হোক আর যাই হোক, ছবি তুলবি। খালা, আমার দাড়ি খানিকটা লুজ হয়ে গেছে, যে-কোনো মুহুর্তে খুলে পড়তে পারে। খুলে পড়লে খুলে পড়বে। তুই তো দাড়ি দিয়ে ছবি তুলবি না। তুই ছবি তুলবি সেল ফোনে। ওকে ফাঁকে বাদ দে। ছবি তোল। বজলু ছেলেটা যথেষ্ট ভোগাল। যে ঠিকানাটা পাওয়া গেছে সেটা ঠিক কি-না কে জানে। ঢাকা শহরের মানুষ উল্টাপাল্টা ঠিকানা দিতে পছন্দ করে। ঠিকানাবিহীন মানুষজনের ঠিকানা হয় ভাসমান। এক জায়গায় স্থির থাকে না। ভাসতে থাকে। ভেসে দূরে চলে যাবার আগেই ধরে ফেলতে
false
tarashonkor
তাই নয়-অপরাধের ক্ষেত্রে বিচারে তিনি ক্ষমাহীন। একটি নিজস্ব তুলাদণ্ড হাতে নিয়ে তিনি ক্ষুরের ধারের উপর পদক্ষেপ করে শেষ প্রান্তে এসে তুলদণ্ডের আধারে যে আধেয়টি জমে ওঠে তাই অকম্পিত হাতে তুলে দেন, সে বিষই হোক আর অমৃতই হোক। খ. কর্মক্লান্ত জ্ঞানেন্দ্রনাথ বিশ্রাম নেবার জন্যই এই ছোট এবং শান্ত জেলাটিতে মাসকয়েক আগে এসেছেন। ইতিমধ্যেই উকিল এবং আমলা মহলে নানা গুজবের রটনা হয়েছে। জ্ঞানেন্দ্রনাথের আরদালিটি হাল-আমলের বাঙালির ছেলে। এদিকে ম্যাট্রিক ফেল। কৌতুহলী উকিল এবং আমলারা তাকে নানান প্রশ্ন করে। জ্ঞানেন্দ্রনাথ সাধারণত আদালত এবং নিজের কুঠির মধ্যেই আবদ্ধ থাকেন। ক্লাবের সভ্য পর্যন্ত হন নি। এ নিয়ে উচ্চপদস্থ কর্মচারীমহলেও গবেষণার অন্ত নেই। এ প্রসঙ্গে তাঁরা বলেন–জ্ঞানেন্দ্রনাথ নাকি বলেন যে, তাঁর স্ত্রী আর বই এই দুটিই হল তার সর্বোত্তম বন্ধু। আর বন্ধু তিনি কামনা করেন না। প্রবাদ অনেক রকম তার সম্বন্ধে। কেউ বলে তিনি শুচিবায়ুগ্রস্ত ব্রাহ্ম। কেউ বলে তিনি পুরো নাস্তিক। কেউ বলে লোকটি জীবনে বোঝে শুধু চাকরি। কেউ বলে ঠিক চাকরি নয়, বোঝে শুধু আইন। পাপ-পুণ্য, সৎ-অসৎ ধৰ্ম-অধৰ্ম, এসব তার কাছে কিছু নেই, আছে শুধু আইনানুমোদিত আর বেআইনি। ইংরেজিতে যাকে বলে—লিগাল আর ইলিগাল। তাঁর স্ত্রী সুরমা দেবীও জজের মেয়ে। জাস্টিস চ্যাটার্জি নামকরা বিচারক। এখনও লোকে তার নাম করে। ব্যারিস্টার থেকে জজ হয়েছিলেন। সুরমা দেবী শিক্ষিতা মহিলা। অপরূপ সুন্দরী ছিলেন সুরমা দেবী এক সময়। আজও সে-সৌন্দর্য ম্লান হয় নি। নিঃসন্তান সুরমা দেবীকে এখনও পরিণত বয়সের যুবতী বলে ভ্ৰম হয়। এই সুরমা দেবীও যেন তাঁর স্বামীর ঠিক নাগাল পান না। জজসাহেবের আরদালিটি সাহেবের গল্পে পঞ্চমুখ। সেসব গল্পের অধিকাংশই তার শুনে সংগ্রহ করা। কিছু কিছু নিজের দেখা। সে বলে—মেমসাহেবও হাঁপিয়ে ওঠেন এক এক সময়। ঘাড় নেড়ে সে হেসে বলে রাত্রি বারটা তো সাহেবের রাত নটা। বারটা পর্যন্ত রোজ কাজ করেন। নটায় আরদালির ছুটি হয়। মেমসাহেব টেবিলের সামনে বসে থাকেন; সাহেব। নথি ওলটান, ভবেন, আর লেখেন। আশ্চর্য মানুষ, সিগারেট না, মদ না, কফি না; চা দু কাপ দু বেলা—বড়জোর আর এক-আধ বার। চুপচাপ লিখে যান। মধ্যে মধ্যে কাগজ ওলটানোর খসখস শব্দ ওঠে। কখনও হঠাৎ কথা—একটা কি দুটো কথা, বইখানা দাও তো! বলেন। মেমসাহেবকে। আউট হাউস থেকে আরদালি বয়েরা দেখতে পায় শুনতে পায়। এখানকার দু-চার জন উকিল, উকিলবাবুদের মুহুরি এবং জজ-আদালতের আমলারা এসব। গল্প সংগ্রহ করে আরদালিটির কাছে। আরদালি বলে–তবে মাসে পাঁচ-সাত দিন আবার রাত দুটো পর্যন্ত। ঘরে ঘুমিয়ে পড়ি। দেড়টা-দুটোর সময় আমার রোজই একবার ঘুম ভাঙে। তেষ্টা পায় আমার। ছেলেবেলা থেকে। ওটা আমার অভ্যেস। উঠে দেখতে পাই সাহেব তখনও জেগে। ঘরে আলো জ্বলছে। প্রথম প্রথম আশ্চর্য হতাম, এখন আর হই না। প্রথম প্রথম সাহেবের ঘরের দিকে এগিয়ে গিয়েও থমকে দাঁড়াতাম, সাহেব না ডাকলে যাই কী করে? দুই-এক দিন চুপিচুপি ঘরের পিছনে জানালার পাশে দাঁড়াতাম। দেখতাম টেবিলের উপর ঝুঁকে সাহেব তখনও লিখছেন। এক-একদিন শুনতাম শুধু চটির সাড়া উঠছে। বুঝতে পারতাম সাহেব ঘরময় পায়চারি করছেন। এখনও শুনতে পাই। কোনো কোনো দিন বাথরুমের ভেতর আলো জ্বলে, জল পড়ার শব্দ ওঠে, বুঝতে পারি মাথা ধুচ্ছেন সাহেব। ওদিকে সোফার উপর মেমসাহেব ঘুমিয়ে থাকেন। খুটখাট শব্দ উঠলেই জেগে ওঠেন। বলেন-হল? এক-একদিন মেমসাহেব ঝগড়া করেন। এই তো আমার চাকরির প্রথম বছরেই; বুঝেছেন, আমি ওই উঠে সবে বাইরে এসেছি; দেখি মেমসাহেব দরজা খুলে বাইরে এলেন। খানসামাকে ডাকলেন–শিউনন্দন! ওরে! ভিতর থেকে সাহেব বললে-না না। ও কি করছ? ডাকছ কেন ওদের? মেমসাহেব বললেন– ইজিচেয়ারখানা বের করে দিক। আমি নিজেই নিচ্ছি—ওরা সারাদিন খেটে ঘুমাচ্ছে। ডেকো না। সারাদিন খেটে রাত্রে না-ঘুমালে ওরা পারবে কেন। মানুষ তো! আরদালি বিস্ময় প্রকাশের অভিনয় করে বলে—দেখি সাহেব নিজেই ইজিচেয়ারখানা টেনে বাইরে নিয়ে আসছেন। আমি যাচ্ছিলাম ছুটে। কিন্তু মেমসাহেব ঝগড়া শুরু করে দিলেন। আর কী করে যাই? চুপ করে দাঁড়িয়ে শুধু শুনলাম। মেমসাহেব নাকি বলেন-আরদালি এবার বলে যায় তার শোনা গল্প, পুরনো আরদালির কাছে শুনেছে সে, সুরমা নাকি আগে প্রায়ই ক্ষুব্ধভাবে বলতেন—দুনিয়ার সবাই মানুষ। রাত্রে ঘুম না-হলে কারুরই চলে না। ফলে শুনেছি এক ভগবানের। তা জানতাম না যে, জজিয়তি আর ভগবানগিরিতে তফাত নেই। তারপর বলেন, তাই-বা কেন? আমার বাবাও জজ ছিলেন। জ্ঞানেন্দ্রনাথ হাসতেন। হেসে আর-একখানা চেয়ার এনে পেতে দিয়ে বলতেন–বোসো রায় লেখা তখন শেষ হয়ে যেত। সুরমাও বুঝতে পারতেন। স্বামীর মুখ দেখলেই তিনি তা বুঝতে পারেন। রায় লেখা শেষ না-হলে সুরমা কোনো কথা বলেন না। ওই দুটো-চারটে কথা-চা খাবে? টেবিলফ্যানটা আনতে বলব? এই। বেশি কথা বলবার তখন উপায় থাকে না। বললে জ্ঞানেন্দ্রনাথ বলেন, প্লিজ, এখন না, পরে বোলো যা বলবে। রায় লেখা হয়ে গেলে তখন তিনি কিন্তু আরেক মানুষ। সুরমা বলতেন—মুনসেফ থেকে তো জজ হয়েছ। ছেলে নেই, পুলে নেই। আর কেন? আর কী হবে? হাইকোর্টের জজ, না সুপ্রিমকোর্টের জজ? ওঃ! এখনও আকাঙা গেল না? জ্ঞানেন্দ্রনাথের একটি অভ্যেস-করা হাসি আছে। সেই হাসি হেসে বলতেন বা বলেন না। আকাঙ্ক্ষা আমার নেই। ঠিক সময়ে রিটায়ার করব এবং তারপর সেই ফাষ্ট্র বুকের নির্দেশ মেনে চলব। গেট আপ অ্যাট ফাইভ, গো টু বেড অ্যাট নাইন। তা-ই বা কেন—এইট। সকালে উঠে মর্নিং-ওয়াক করব; তারপর থলে নিয়ে বাজার যাব। বিকেলে মার্কেটে গিয়ে তোমার বরাতমত উলসুতো কিনে আনব। এবং বাড়িতে তুমি ক্রমাগত বকবে, আমি
false
shomresh
চেহারা বিদেশে ব্যাপক চাহিদা তৈরি করেছে। তা হলে আর-পাঁচটা পাহাড়ি গ্রামের তুলনায় আপনাদের অবস্থা বেশ ভাল। তা বলতে পারেন। আপনারা কি শুধু ইংরেজিতেই কথাবার্তা বলেন? হেসে ফেলল ডেরেক, তা কি সম্ভব? আমরা নেপালি এবং হিন্দিও বলি। না বললে কোনও কাজকর্মই করা যাবে না। বৃষ্টি একটু কমে আসতেই ডেরেক জিপ চালু করল। অর্জুন চুপচাপ ভাবছিল। এত বছর এদেশে থেকেও ডেরেকরা কতখানি নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে তা ওদের গ্রামে না গেলে বোঝা যাবে না। কিন্তু ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত ধরনের। এরকম একটা ঘটনার কথা সে এর আগে কখনও শোনেনি। এমন তো নয় যে, ওরা নিজেদের গ্রামের বাইরে যায় না। সভ্য মানুষের সঙ্গে মেশে না। এই যে ডেরেক জিপ চালাচ্ছে, নিশ্চয়ই ওর লাইসেন্স আছে। জিপ কিনতে হয়েছে বাইরে থেকে। এক্সপোর্ট করে যখন, তখন এক্সপোর্ট লাইসেন্স রয়েছে। তা হলে? তিরিশজনের একটা দল দুশো বছর আগে ইংল্যান্ড থেকে জাহাজে চেপে এদেশে এসে পাহাড়ে বসতি করেছিল, যাদের সংখ্যা এখন সাড়ে সাতশো, তারা তো ইংরেজই। অথচ এদের কথা বইয়ে দুরের কথা, খবরের কাগজে বের হয় না। মাঝখানে একবার পেট্রল নিতে জিপ থামিয়েছিল ডেরেক। তখন বাক্স খুলে খাবার এগিয়ে দিয়েছিল। পিঠেজাতীয় জিনিস। অর্জুন অমল সোমের বাড়ি থেকে খিচুড়ি খেয়ে বেরিয়েছিল বলে খেতে চায়নি আর। ডেরেক খেল। তারপর ফ্লাস্ক থেকে কফি। কালো কফি। স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় কফিটা চমৎকার লাগল অর্জুনের। শেষ পর্যন্ত সমতল থেকে পাহাড়ে উঠতে লাগল গাড়ি। মেঘ থাকায় আজ সন্ধে নেমে পড়েছে বেশ আগেই। ডেরেক হেডলাইট জ্বেলে দিয়েছে। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে ধাক্কা খেতে-খেতে আলো তাদের পথ দেখাচ্ছে। ক্রমশ তিস্তার গর্জন কানে এল। অনেক নীচ দিয়ে তিস্তা বয়ে যাচ্ছে। এবার পিচের পথ ছেড়ে কাঁচা মাটির পথ ধরল জিপ। বৃষ্টিতে ভেজা বলেই ডেরেক খুব সন্তর্পণে চালাচ্ছিল। রাস্তা খারাপ বলেই বেশি সময় লাগছে। চারপাশে জঙ্গল এবং তাদের চেহারা অন্ধকারে ভয়ঙ্কর। বৃষ্টির মধ্যেই ঝিঝি আওয়াজ করে চলেছে সমানে। ড়ুয়ার্স-দার্জিলিঙের রাস্তাঘাট অর্জুন চেনে। এই অন্ধকারে জিপের আলোয় সে চিনতে চেষ্টা করছিল কোন পথে যাচ্ছে। কিন্তু কাঁচা মাটির পথ ধরার পর থেকেই তার সবকিছু গুলিয়ে গেল। আধঘণ্টা চলার পর সে আবিষ্কার করল কাঁচা রাস্তা শেষ হয়ে আবার পিচের রাস্তা শুরু হয়েছে। খুব মসৃণ রাস্তায় বৃষ্টির জল টুপটাপ পড়ে চলেছে। রাস্তাটা বাঁক নিচ্ছে ঘন-ঘন। হঠাৎ ডেরেক বলল, এই রাস্তা আমরাই বানিয়েছি। আপনারা মানে গ্রামের লোকেরা? হ্যাঁ। পুরো পথটায় পিচ ফেলা হয়নি, কারণ অনুমতি পাওয়া যায়নি। হাওয়া বইছে খুব। অর্জুন বাইরে হাত বের করে দেখল জলের ফোঁটা পড়ছে। ডেরেক বলল, আমরা এসে গেছি। আপনাকে বৈশ কষ্ট দিলাম। অর্জুন উত্তর দিল না। তার সামনে শুধুই পাহাড়ের আড়াল। কোথায় যে এলাম তা বোধগম্য হচ্ছে না। কিন্তু হঠাৎ গাড়িটা বাঁক নিতেই চমৎকার দৃশ্য চোখে পড়ল। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে হিরের মতো আলো জ্বলছে থোকা-থোকা। ঘরবাড়ির আদল দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে। ডেরেক গাড়ি থামাল। বলল, ওই হল আমাদের গ্রাম। পাহাড়ি রাস্তার অভিজ্ঞতা থেকে অর্জুন বুঝতে পারছিল এখনও সিকি মাইল পথ ভাঙতে হবে গ্রামে পৌঁছতে গেলে। পাহাড়ের আড়ালে এমন একটা জনপদের কথা সে জানত না, সাধারণ মানুষও জানে বলে মনে হয় না। ডেরেক বলল, উত্তরদিকের ওই যে পাহাড়, গ্রাম থেকে দূরত্ব খুবই অল্প, আগুন জ্বলে ওঠে ওখানেই। অর্জুন দেখল ডেরেকের দেখানো জায়গাটা নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে ঢাকা। ওদিকে কোনও ঘরবাড়ি আছে বলে মনে হয় না। গাড়ি গ্রামে ঢুকল। এখন বেশ রাত হয়ে গেছে। রাস্তা পরিষ্কার এবং লোকজন নেই। ইংরেজিতে পাব লেখা একটা সাইনবোর্ড লাগানো বাড়ি থেকে হইহই। চিৎকার ভেসে এল। ডেরেক তাকে নিয়ে এসে যেখানে থামল সেটা দোতলা বাড়ি। বাড়ির গায়ে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে ভিলেজ সেন্টার। গাড়ি থামতেই তিনজন পুরুষ এবং একজন মহিলা বাইরে বেরিয়ে এলেন। সবচেয়ে প্রবীণ টেকোমাথা মানুষটা এগিয়ে এসে বললেন, কী খবর ডেরেক? ডেরেক অর্জুনকে ইশারা করে গাড়ি থেকে নামল, কোনও চিন্তা নেই আঙ্কল। আমি মিস্টার সোমের সঙ্গে কথা বলেছি। উনি দুদিন পরে আসবেন। তার আগে ওঁর সহকারীকে পাঠিয়ে দিয়েছে তদন্তের জন্যে। ওঁর নাম অর্জুন, ইনি আমাদের গ্রামের চেয়ারম্যান মিস্টার জোন্স, ইনি ডেপুটি মিস্টার স্মিথ আর ইনি ট্রেজারার মিসেস বেনসন। তিনটে বাড়ানো হাতের সঙ্গে হাত মেলাল অর্জুন। মিসেস বেনসন বলে উঠলেন, আরে, এ যে দেখছি নেহাতই ছেলেমানুষ। ও কী তদন্ত করবে! ডেরেক বলল, মিস্টার সোম ওর ওপর আস্থা রাখেন। অর্জুনকে ওরা বেশ সমীহ করেই ভেতরে নিয়ে গেল। একতলাটা অফিসঘর। দোতলায় গেস্ট হাউস। দীর্ঘ পথ গাড়িতে আসা এবং রাত হয়ে যাওয়ার কারণে অর্জুনকে বিশ্রাম নিতে বলা হল। দোতলার যে ঘরটি ওকে বরাদ্দ করা হল সেটি সুন্দর করে সাজানো। ওঁরা চলে গেলে অর্জুন বাথরুমে ঢুকল। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। কিন্তু এখানে যা ঠাণ্ডা তাতে গরম জলের দরকার। ব্যাপারটা ভাবামাত্র দরজায় শব্দ হল। অর্জুন ফিরে গিয়ে সেটা খুলতে একটা বেঁটে সাহেবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। সাহেব কথা বলতে চেষ্টা করছে কিন্তু শব্দ পিছলে যাচ্ছে। সাহেবের হাতে একটা মুখ ঢাকা দেওয়া বালতি। এই প্রথম কোনও সাহেবকে সে তোতলাতে দেখল। চারবারের চেষ্টায় সাহেব বলল, গরম জল। অর্জুন সেটা সাগ্রহে নিতে চাইলেও সাহেব বালতিটা হস্তান্তর করল না। ঘরে ঢুকে বাথরুমে বালতি রেখে হাসল, আ-আ-আমার নাম পল। অনেক ধন্যবাদ মিস্টার পল। গরম জলের খুব দরকার ছিল। কথাটা শুনে লোকটা দুবার মাথা নামাল
false
toslima_nasrin
এই ফ্রিজটা কয়দিন পরেই নষ্ট হইয়া যাইব। হাসিনার এই আমার শব্দটি শুনে মনে হয় আমরা যেন এ বাড়িতে দুটো দল, এক দলে আমরা, আমি বাবা মা ইয়াসমিন, অন্য দলে দাদা আর হাসিনা। রিয়াজউদ্দিনের ছেলে জয়নাল টিনের ঘরে থাকে, ইশকুলে পড়ছে শহরে। জয়নালকে দেখলে হাসিনা বলে, এই ছেড়া এক গ্লাস পানি দে তো অথবা এই ছেড়া দৌড়াইয়া একটা রিক্সা লইয়া আয়, যা। জয়নাল পানি নিয়ে দেয়। দৌড়ে রিক্সা ডেকে আনে। হাসিনা শাড়ি পরছে, আশেপাশেই ছিল জয়নাল,এই ছেড়া জুতাডা মুইছা দে তো। জয়নাল হাসিনার পায়ের কাছে বসে ছেঁড়া ত্যানায় তার জুতো মুছে দেয়। মা একদিন বললেন, জয়নালরে এইভাবে কইও না বৌমা। জয়নাল ত বাড়ির কাজের ছেলে না, নোমানের আপন চাচাতো ভাই লাগে। হাসিনা খসখসে গলায় বলে, ছেড়ারে কইতাম না তো কারে কইতাম? বেডি যে একটা আছে, ও তো পাকঘরেই পইড়া থাহে। ডাইকা পাওয়া যায় না। আনুর মা তো সারাদিন কাম করে। সারাদিন কি কাম করে যে এই দিকে আমার কাম করার সময় কেউ পায় না! আনুর মার কাছে চাও কি চাইবা। সে কি না করছে যে করব না কাম? এরপর হাসিনা অর্জুনখিলা থেকে তার জুতো মোছা, তার জন্য গোসলের পানি তোলা, গোসলে যাওয়ার আগে তার তোয়ালে আর সাবান গোসলখানায় রেখে আসার জন্য, শুয়ে থাকলে তার মাথায় বিলি কেটে দেওয়ার জন্য ফুলেরা নামের একটি মেয়ে নিয়ে এল। এক বাড়িতে এক চুলোয় সবার জন্য খাবার রান্না হলেও ধীরে ধীরে দুটো সংসার গড়ে উঠছে। হাসিনার গলার স্বর, আমরা সবাই লক্ষ করি খসখসেই কেবল নয়, উঁচওু । এ বাড়িতে বাবার গলাই এমন উঁচুতে ওঠার স্পর্ধা রাখে। হাসিনার এরকম ঘরে বসে থাকা সইতে না পেরে বাবা তাকে শিক্ষিকা প্রশিক্ষণ কলেজে ভর্তি করে দিয়েছেন। বইপত্র খাতা কলম যা দরকার কিনে দিয়েছেন, টেবিল সাজিয়ে দিয়েছেন ঘরে। বিয়ের পর আর লেখাপড়ার ঝামেলা নেই বলে দিব্যি ছিল হাসিনা। দাদারও আপত্তি ছিল না। কিন্তু বাবার আপত্তি। তিনি হাসিনাকে নিজের কন্যাদের যেমন মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করার পরামর্শ দেন, নিজের পুত্রবধূকেও দেন। মনীষীদের বাণীর বষর্ণ এবার হাসিনার ওপর, যেন সে বাবার আরেক মেয়ে, তবে একটি সুবিধে তার, বাবার চড় থাপড়, সন্ধিবেত আর চাবুকের চেহারা তাকে দেখতে হয় না। মাও আমাদের যেমন যত্ন করে খাওয়ান, তার চেয়ে অধিক যত্ন করে হাসিনাকে খাওয়ান, হাসিনার এখানেও সুবিধে যে, মা মাঝে মাঝে আমাদের যে ধমক দেন গালাগাল দেন, তা হাসিনাকে দেন না। বাড়ির মানুষগুলো হাসিনার সেবায় নিয়োজিত, সবচেয়ে বেশি নিয়োজিত দাদা। মধুচন্দ্রিমা উদযাপন করতে বউ নিয়ে কক্সবাজার ঘুরে এসেছেন। রেলগাড়িতে নয়, উড়োজাহাজে। সমুদ্রের পাড়ে বড় হোটেলে ছিলেন, নরম বিছানায় শুয়েছেন, হোটেলের লোকেরা তিনবেলা খাবার দিয়ে গেছে ঘরে। হাসিনা সুখে আছে, বুঝি। এত সুখের কথা সে বিয়ের আগে কল্পনা করেছিল বলে মনে হয় না। জীবন বদলে যাচ্ছে, একসময় রান্নাঘরে চুলোর পাড়ে পিঁড়িতে বসে ভাত খেতাম, পিঁড়ি থেকে পরে শোবার ঘরের মেঝেয় শীতল পাটিতে বসে, পরে খাবার ঘরে শাদামাটা চেয়ার টেবিলে, ধীরে ধীরে টেবিল বড় হল, মসৃণ হল আরও, চেয়ারের মাথা মানুষের মাথা পেরিয়ে ওপরে উঠল। বেতের সোফা সরে কাঠের সোফা এল। হারিকেন থেকে বিদ্যুৎ বাতি এল। হাতপাখা থেকে বৈদ্যুতিক পাখা।টিনের থালা থেকে চিনেমাটির থালা এল। মেঝেয় কয়লা গুঁড়ো করে সেই গুঁড়ো আঙুলে তুলে দাঁত মাজতাম—এরপর নিমের ডাল দিয়ে, ডালের মাথাটা দাঁতে কামড়ে নরম করে নিয়ে—এরপর এল টুথপেস্ট, তিব্বত কোম্পানি থেকে কোলগেট। ঋতুর রক্ত শুষে নেওয়ার জন্য পুরোনো শাড়ির টুকরো বা ত্যানাতুনোর বদলে বাজার থেকে কিনে তুলোর প্যাড ব্যবহার করি। কোরবানির ঈদের সময় আস্ত একটি গরু জবাই করা হল, এর মাংস রাখা হবে কোথায়, বড় বড় পাতিলে ওসব হলুদ আর লবণ মিশিয়ে সেদ্ধ করে রাখা হত, এরপর রান্না করতে হলে সেদ্ধ মাংস তেলে মশলায় নেড়ে রান্না হত, আর অনেকটাই চলে যেত রোদে শুকিয়ে শুটকি করায়। মাংসের টুকরোগুলোর মাঝখানে ফুটো করে দড়ির ভেতর ঢুকিয়ে রোদে টাঙিয়ে দেওয়া হত। সন্ধের আগে আগে রোদে শুকোনো কাপড় যেমন করে তোলা হয়, রোদে শুকোনো মাংসও তেমন তোলা হত। পরদিন সকালে আবার রোদে দেওয়া। ফ্রিজ আসার পর নিয়মগুলো পাল্টো গেছে। এখন আর হলুদ লবণ মিশিয়ে সেদ্ধ করে রাখা হয় না মাংস, শুটকি করাও হয় না খুব, মাংসগুলো ঢুকে যায় রেফ্রিজারেটরের হিমায়িত চেম্বারে। নানারকম যন ্ত্র এসেছে বাড়িতে, রেডিওই ছিল ভরসা, এখন টেলিভিশন, শাদা কালো থেকে রঙিন। আগে কেবল শোনা ছিল, এখন দেখা আর শোনা দুটোই। নাটক সিনেমা দেখার জন্য বাড়ির বাইরে যেতে হয় না, ঘরে বসেই দেখা যায়। নাচ গানও বোতাম টিপলেই। বড় বড় ক্রিকেট ফুটবল খেলা দেখার জন্য কোনও মাঠে দৌড়োতে হয় না, সেও বোতাম টিপলেই। ছবি তোলার জন্য কোনও ছবিঘরে যেতে হয় না আর, কেনা ক্যামেরা দিয়েই যত চাই যে ভঙ্গিমায়, তোলা যায়। জীবন অনেক পাল্টো গেছে। অনেক কিছুই আর আগের মত নয়। এভাবেই একটু একটু করে জীবন পাল্টো যাচ্ছে, সামনে এসে পেছনের দিকে খুব একটা তাকাই না, যেন ফেলে আসা জীবন ভুলে যাবার জীবন। একটি জিনিস কেবল সেই আগের মত রয়ে গেছে, বাড়িতে তিনবেলা ভাত রান্না হত, এখনও হয়। মাটির চুলোয় উঠোনের মাটিতে ঝরে পড়া ডাল পাতা জড়ো করে আগুন ধরাও, আগুন বার
false
MZI
মার্ডার করবে। এর চেহারাটা একবার দেখেন। এর কতো বড় সাহস, ক্লাসে আমাকে থ্রেট করে। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আমার দিকে ভাল করে তাকালেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, সত্যি? আমি এবারেও কিছু না বলে দাড়িয়ে রইলাম। কথা না বলতে বলতে আমি ঠিক করে কথা বলতেই ভুলে গেছি। মুখ খুলে কিছু একটা বলতে গেলেই উল্টাপাল্টা কিছু একটা বলে ফেলব তখন আরো বড় ঝামেলা হয়ে যাবে। এর থেকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকাই ভাল। রাজাকার স্যার থামলেন না, বললেন, আপনি নতুন এসেছেন তাই আপনি জানেন না। এ একসময়ে খুব ভাল ছাত্র ছিল। তারপর হঠাৎ করে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে বদমাইশ হয়ে গেলো–এখন পরীক্ষায় পাস করতে পারে না। দিনরাত রাস্তাঘাটে মারামারি করে। রীতিমতো গুণ্ডা। সন্ত্রাসী। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আবার আমার দিকে তাকালেন, খানিকক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, সত্যি? আমি এবারেও কিছু বললাম না। এই পৃথিবীতে বিচার বলে যে কিছু নেই সেটা আমার থেকে ভাল করে কেউ জানে না, কাজেই প্রিন্সিপাল ম্যাডাম যে রাজাকার স্যারের কথা বিশ্বাস করে আমাকে টিসি, দিয়ে বিদায় করে দেবেন সে ব্যাপারে আমার একটুও সন্দেহ নাই। তবে এখন তাতে আর কিছু আসে যায় না, আমি বাসা থেকে যখন পালিয়েই যাব তখন টিসি নিয়ে আর না নিয়ে পালিয়ে যাবার মাঝে পার্থক্য কী? রাজাকার স্যার বললেন, এক ঝুড়ি আপেলের মাঝে একটা পচা আপেল থাকলে সব আপেল পচে যায়। এ হচ্ছে পচা আপেল, একে যদি এখনই বিদায় করেন পুরো ক্লাসকে কিন্তু নষ্ট করে দেবে। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আমার দিকে তাকালেন, তোমার কিছু বলার আছে? আমার অনেক কিছুই বলার আছে কিন্তু আমি তো গুছিয়ে কথা বলতে পারব না। তবে সারা জীবনের জন্যে যখন চলেই যাচ্ছি তখন যা খুশি বলে দিলে ক্ষতি কী? আর কেউ তো কখনো এটা করতে পারবে না। আমি প্রিন্সিপাল ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বললাম, জি ম্যাডাম। বলার আছে। কী বলার আছে? আমাকে যদি বের করতেই হয় তাহলে ঐ স্যারকেও বের করে দিতে হবে। কথাটা আমি ভেবে বলি নাই, বলে ফেলার পর কথাটা শুনে আমি নিজেই চমকে উঠলাম, বলেছি কী আমি? কিন্তু বলে যখন ফেলেছিই এটা তো আর ফিরিয়ে নেয়ার উপায় নেই। রাজাকার স্যারের চোয়ালটা কেমন যেন ঝুলে পড়ল, মাছের মতো খাবি খেলেন কয়েকবার। প্রিয়াংকা বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যে মনে হলো আমার কথা বুঝতে পারছেন না। খুব ধীরে ধীরে তার মুখটা পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেলো, শোনা যায় না এরকম গলায় আস্তে আস্তে বললেন, ছেলে, তোমার তো সাহস কম না, তুমি আমার সামনে দাড়িয়ে তোমার স্যারের সম্পর্কে এরকম একটা কথা বলো? প্রিয়াংকা আমার জায়গায় হলে নিশ্চয়ই কী চমৎকার একটা উত্তর দিতে পারতো, আমি কিছুই বলতে পারলাম না। কী বলা যায় সেটা চিন্তা করতে করতে আবার নিজের অজান্তেই বলে ফেললাম, আমি যদি পচা আপেল হই তাহলে স্যারও পচা আপেল। আমার কথা শুনে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের চোখগুলো বড় বড় হয়ে উঠল। ম্যাডাম তার চশমাটা খুলে টেবিলে রেখে বললেন, ছেলে, তোমার কী মাথা খারাপ হয়েছে? আমি মাথা নাড়লাম, না। তাহলে? আমি চুপ করে দাড়িয়ে রইলাম। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, তুমি এভাবে কথা বলছ কেন? রাজাকার স্যার আমার জন্যে উত্তরটা দিয়ে দিলেন, বললেন, এই পাজী ছেলেটা এইভাবেই কথা বলে। এর মতো বেয়াদব ছেলে স্কুলে আর একটাও নাই। আমি রাজাকার স্যারের দিকে না তাকিয়ে প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে বললাম, ম্যাডাম, আমাকে তো স্কুল থেকে তাড়িয়েই দিবেন, তাই যাওয়ার আগে আপনাকে সত্যি কথাটা বলে যাই। রাজাকার স্যার চিৎকার করে বললেন, চোপ। চোপ বেয়াদব ছেলে- আমি তখন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছি, আরও গলা উঁচিয়ে বললাম, এই স্যার ক্লাসে কখনো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোন কবিতা পড়ান না। এই স্যার মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে ক্লাসে টিটকারি মারেন। এই স্যার হিন্দু ছাত্রদের পিটান রাজাকার স্যারের মুখটা ভয়ংকর রাগে কেমন যেন বিকৃত হয়ে গেল, ঘরে আর কেউ না থাকলে একেবারে নিশ্চয়ই আমাকে খুন করে ফেলতেন। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কেমন যেন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন, বললেন, তুমি কী বলছ ছেলে? আমি সোজাসুজি প্রিন্সিপাল ম্যাডামের চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি সত্যি কথা বলছি। রাজাকার স্যার হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন, প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে বললেন, আপনি আমার সাথে আসেন ম্যাডাম। ক্লাসে গিয়ে জিজ্ঞেস করবেন প্রিন্সিপাল ম্যাডাম এক ধরনের অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর ঘুরে রাজাকার স্যারের দিকে তাকালেন, বললেন, তার কোন প্রয়োজন নেই সরকার সাহেব। তাহলে, তাহলে– প্রিন্সিপাল ম্যাডাম এক ধরনের ঠাণ্ডা গলায় বললেন, আমি ব্যাপারটা দেখছি। আপনি এখন আসুন। রাজাকার স্যার হঠাৎ করে কেমন জানি চুপসে গেলেন। দাড়িয়ে থেকে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন, ঠিক বলতে পারলেন না, একবার আমার মুখের দিকে তাকালেন তারপর বের হয়ে গেলেন। আমি আর প্রিয়াংকা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম, প্রিন্সিপাল ম্যাডাম অন্যমনস্কভাবে টেবিলে আঙুল দিয়ে শব্দ করতে করতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন। তাকে দেখে মনে হতে লাগলো যেন ভুলেই গেছেন আমরা এখানে দাঁড়িয়ে আছি। আমরা কী করব বুঝতে পারছিলাম না তখন ম্যাডাম আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা ক্লাসে যাও। আমি আর প্রিয়াংকা প্রিন্সিপাল ম্যাডামের অফিস থেকে বের হয়ে এলাম। ০৪ কবিতা এবং মুক্তিযুদ্ধ জ্যামিতির ক্লাস টেস্টে মামুন পেলো আশি, জয়ন্ত সত্ত্বর অন্যেরা তার থেকে
false
humayun_ahmed
একজন কথা বলছে, অন্যজন একটু পর পর গলা খাকারি দিয়ে থুথু ফেলছে। প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছি, জবাব দেন না। কী জন্যে? আপনের নাম শুভ্ৰ? শুভ্ৰ বলল, হ্যাঁ। ভালো আছেন? হ্যাঁ, ভালো আছি। পক্ষী দেখেন? হ্যাঁ। আমাদের সঙ্গে একটু আসতে হবে। কেন? কাজ আছে। কী কাজ? সেটা যথাসময়ে জানবেন। আপনাদের সঙ্গে কোথায় যাব? লাঞ্চে। একটা লঞ্চ পাড়ে ভিড়ছে, দেখেন নাই? লঞ্চের নাম এম এল সকিনা। শুভ্র বলল, চলুন যাই, তবে মর্জিনাকে একটা খবর দেওয়া দরকার। সে দুশ্চিন্তা করবে। তারে নিয়া আপনের ভাবার কিছু নাই। নিজেরে নিয়া ভাবেন। শুভ্র বলল, নিজেকে নিয়ে তো আমি কখনো ভাবি না। এখন ভাবেন। ভাবনার সময় হয়েছে। এম এল সকিনা লঞ্চটি একতলা। চর থেকে বেশ কিছুটা দূরে নোঙ্গর করে আছে। শুভ্ৰকে নৌকায় করে সেখানে নেওয়া হলো। লঞ্চের পেছন দিকে ছোট্ট একটা রুমে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। রুমের একটাই জানালা, সেই জানালাও পুরোপুরি খোলা না। সামান্য খোলা। ভেতরটা অন্ধকার। সেখানে পার্টি পাতা। পার্টির ওপর আধশোয়া হয়ে এক লোক। অন্ধকারেও তার চোখে সানগ্লাস। তার নাম মোবারক। মোবারকের সামনে গামলাভর্তি পাকা কাঁঠাল। কাঁঠালের ওপর নীল রঙের বেশ কিছু পুরুষ্টু মাছি। মোবারক হাত দিয়ে মাছি সরিয়ে কাঁঠালের বিচি মুখে দিচ্ছে। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই খু করে বিচি ফেলছে। বিচিগুলি টিনের বেড়ায় লেগে ঢং করে শব্দ করছে। শব্দটা মনে হয় তার পছন্দ হচ্ছে। প্রতিবারই শব্দ শোনার পর তার মুখ হাসি হাসি হয়ে যাচ্ছে। সে শুভ্রর দিকে না তাকিয়েই বলল, কাঁঠাল খাওয়ার অভ্যাস আছে? শুভ্ৰ বলল, কাঁঠাল আমার পছন্দ না। গরিবের খানা, এইজন্যে পছন্দ না? শুভ্র বলল, ধনী-গরিবের ব্যাপার না। যে খাবার ধনী মানুষ খেতে পারে সেই খাবার গরিব মানুষও খেতে পারে। লোকটা শুভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, ধনী-গরিবের খানা এক না। খানা ভিন্ন। তবে গু একই। ধনীর গুতে গন্ধ, গরিবের গুতেও গন্ধ। ঠিক বলেছি না? শুভ্র কিছু বলল না। লোকটা চোখ থেকে চশমা খুলতে খুলতে বলল, আপনেরে নিয়া প্যাচাল পারার কিছু নাই। আমি প্যাচালের লোক না। কাজের লোক। আমার উপর হুকুম হয়েছে আপনেরো অফ করে দেয়া। এই কাজটা কিছুক্ষণের মধ্যে করব। শেষ মুহুর্তে কিছু মনে চাইলে বলেন। সিগারেট খাবেন? সিগারেট আমি খাই না। আপনার কথা বুঝতে পারছি না। আমাকে অফ করে দিবেন। মানে কী? অফ করা বুঝেন না? না। ইলেকট্রিক বাত্তি সুইচ টিপলে অফ হয়—এইটা তো জানেন? জানি। কিন্তু আমি ইলেকট্রিক বাতি না। আমি মানুষ। আপনেরে বস্তায় ভরে দূরে নিয়ে পানিতে ফেলা দেওয়া হবে। বস্তার ভিতর ইট থাকবে। আপনে শান্তিমতো নদীর তলে ঘুমায়া থাকবেন। কেউ আপনেরে ডিসটর্ব করবে না। আপনেও কাউরে ডিসটর্ব করতে পারবেন না। সাইন্সের বক্তৃতা শেষ। এখন বুঝছেন, অফ করা মানে পানিতে ড়ুইবা মরা? মরলেই অফ। পানিতে ড়ুবলেও অফ, ইটের ভাটার আগুনে পুড়লেও অফ। আমাকে অফ করবেন কেন? কারণ আপনে বিরাট ঝামেলার লোক। এই চরের নামই হয়ে গেছে। শুভ্রর চর। আপনেরো অফ কইরা ঝামেলা মিটাইতে হইবে। এই হুকুম। হুকুম কে দিয়েছে? তার নাম দিয়া কী করবেন? এখন তৈরি হয় যান। কিসের জন্যে তৈরি হব? মরণের জনে। শুভ্ৰ অবাক হয়ে বলল, যে মানুষটা আপনার কোনো ক্ষতি করে নি তাকে খুন করতে পারবেন? টাকার জন্যে মানুষ পারে না। এমন কাজ নাই। তবে আপনেরে সত্য কথা বলি! কাজটা আমি করব না। অন্য একজন করবে। মৃত্যুর আগে মনে কিছু চায়? চাইলে বলেন। তবে এখন যদি বলেন, পোলাও কোর্মা খাব, খাসির রেজালা খাব, তা পারব না। কাঁঠাল খাইতে মন চাইলে খান। শুভ্ৰ তাকিয়ে আছে। লোকটার কথা এখনো তার বিশ্বাস হচ্ছে না। কোনো ঠাট্টা-তামাশা নয় তো? আল্লাখোদার নাম নিতে চাইলে নাম নেন। তওবা করতে চাইলে তওবা করেন। নিজে নিজে তওবা করবেন। মাওলানা দিতে পারব না। অজুর পানি দিতে বলব? ভয়ঙ্কর কোনো ঘটনার মুখোমুখি হলে প্রকৃতি ব্যবস্থা নেয়। শরীরে হঠাৎ করেই প্রচুর এড্রেলিন জারিক রস চলে আসে। তখন ভয়ঙ্কর বিষয়টাকেও তেমন অস্বাভাবিক মনে হয় না। শুভ্রর মনে হয় তা-ই হলো। সে স্বাভাবিক গলায় বলল, একটা চিঠি লিখব। চিঠিটা পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। পারবেন? ব্যবস্থা করা যাবে। চিঠি কারে লিখবেন? পিতামাতাকে? না। তারা আমার এই চিঠি সহ্য করতে পারবেন না। চিঠিটা লিখব যুথীকে। সে শক্ত মেয়ে আছে, সে সহ্য করতে পারবে। যুথী কে? আপনার লাভার? সে আমার প্রেমিকা না। আমার পছন্দের একজন। তার গলার স্বর অস্বাভাবিক মিষ্টি। তার সঙ্গে সেক্স করেছেন? শুভ্র বলল, আপনারা যে আমাকে মেরে ফেলবেন সেটা আমি বুঝতে পারছি। মৃত্যুর আগে নোংরা কথা শুনতে ভালো লাগছে না। কাঁঠালের বিচি দিয়ে যে চং ঢং শব্দ করছেন এটাও শুনতে ভালো লাগছে না। আমাকে কাগজ-কলম দিন। চিঠি লেখা শুরু করি। লঞ্চে চিঠি লেখার মতো কাগজ পাওয়া গেল না। দুটা বলপয়েন্ট পাওয়া গেল। মোবারক কাগজের জন্যে লোক পাঠাল। বস্তার ঝামেলাটা দ্রুত সেরে ফেলতে পারলে ভালো হতো। মোবারক কাজটা করতে পারছে না, কারণ যুথী নামের মেয়েটাকে এই লোক কী লেখে তা তার জানতে ইচ্ছা করছে। সে তার একজীবনে অনেক অদ্ভুত মানুষ দেখেছে। এরকম দেখে নি। ছেলেটিকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষীণ ইচ্ছা তার হচ্ছে। ইচ্ছাটাকে সে আমল দিচ্ছে না। যে কাগজ-কলম আনতে গেছে সে ফিরছে না, তবে লিঞ্চের সারেং-এর ঘরে রুলটোনা একটা খাতার কয়েকটা
false
shirshendu
চেয়ে দেখে নিল একবার। দীপনাথ নিজের উপস্থিতি জানান দিতে উঠে দাঁড়িয়েছিল। বোস সাহেব একবার তাকালও তার দিকে, কিন্তু কোনও ইশারা করল না। দীপনাথ আবার বসে পড়ল। এই দাঁড়ানোর অবস্থায় তাকে দেখলে মণিদীপা অবশ্যই চাপা হিংস্র গলায় বলত, স্লেভ! স্লেভ! বন্ডেড লেবারার। ওরা বেরিয়ে যেতেই অফিসে একটা চাপা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল, নানা রকম অনুমান, আন্দাজ। হাতে একটা কাজ আছে। সেরে ফেলি। বলে রঞ্জন তার টাইপ মেশিনে খটাখট শব্দ তুলতে লাগল। দীপনাথ উঠে সামনের দিকে জানালায় এসে উঁকি দিয়ে দেখল, মস্ত একটা গাড়িতে বোঝাই হয়ে বোস সাহেব সমেত মালিকরা কোথাও যাচ্ছে। অর্থাৎ এখন তার কোনও কাজ থাকছে না। দীপনাথ বোকা নয়। সে জানে এই কোম্পানির যা ক্যাপিট্যাল ইনভেস্টমেন্ট আছে তাতে অনায়াসে এটাকে উঁচু গ্রেডে তোলা যায়। কিন্তু ব্যবসায়িক কারণে মালিকরা তা চাইছে না। বোস চাইছে। শুধু ব্যক্তিগত বেতন বা ভাতা বাড়ালেই বোস খুশি হওয়ার লোক নয়। সে যে এ কোম্পানিকে হায়ার গ্রেডে তুলেছে তার স্বীকৃতি না দিলে সে খুশি হবেও না। টাকার সঙ্গে প্রেস্টিজও তার দরকার! মালিকরা সেই মৌলিক ব্যবসাগত নীতিতে নরম হল কি না সেটাই বড় কথা। সুতরাং দীপনাথের অনিশ্চয়তা কাটে না। বোস সাহেবের বেয়ারাকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, সাহেব লাঞ্চের পর অফিসে আসবে। লাঞ্চের এখনও দেরি আছে দেখে দীপনাথ সন্তর্পণে গিয়ে বোস সাহেবের চেম্বারে ঢুকে দরজাটা টেনে দিল। এই চেম্বারে ঢুকতে তার কোনও বাধা নেই। প্রায়ই ঢোকে। চেম্বারে এয়ারকন্ডিশনার চলছে। বিশাল ঝকঝকে সেক্রেটারিয়েট টেবিল, ঘোরানো চেয়ার। মেঝেয় সত্যিকারের উলের কার্পেট। মালিকরা বোস সাহেবকে যথেষ্ট আদরে রেখেছে। এত আদরে থাকলে দীপনাথ বর্তে যেত, আর কিছু চাইত না। মালিকদের কথায় উঠত, বসত। কিন্তু নাল্পে সুখমন্তি। বোস আরও চায়। কেন চায় কে জানে! এ পৃথিবীতে কিছু মানুষের আছে রাক্ষুসে চাওয়া। আলাদিনের দৈত্য কিংবা জিন পরিরাই বোধহয় সেই চাহিদা কেবলই মিটিয়ে যাচ্ছে। দীপনাথ খবর রাখে, এক আধা-সাহেবি কোম্পানির এক ডিরেক্টর বিশ হাজার টাকা মাইনে এবং আর-সব খরচপত্র পায়। এত পাওয়া পছন্দ করে না দীপ। এত পেলে কি জীবনটা বিস্বাদ হয়ে যায় না! ডাইরেক্ট লাইনে সে বোস সাহেবের বাড়ির নম্বর ডায়াল করল। মণিদীপা বোধ হয় আর-কারও অপেক্ষায় টেলিফোন কোলে করেই বসে ছিল। প্রথম রিং-এর শব্দটা হতে না হতেই রিসিভার তুলে বলল, হ্যালো। আমি দীপ। হুঁ। কী খবর? একটা খবর বোধহয় দিতে পারি। কী সেটা? খবরটা ভাল হলে খাওয়াবেন তো! আপনার প্রিমিটিভিনেসটা কবে যাবে বলুন তো? ব্যথাহত দীপনাথ বলে, কেন? প্রিমিটিভিনেসটা কী দেখলেন? ওই যে খাওয়ার কথা। খাওয়াটা এমন বড় প্রবলেম কি? দীপনাথ বিষণ্ণ হেসে বলে, আপনার মতো একজন মার্কসবাদীর মুখে কথাটা কি মানাল? দেশের লক্ষ মানুষের মূল প্রবলেমটাই তো এই প্রিমিটিভ প্রবলেম। যা নিয়ে আপনি ভাবছেন, স্নিগ্ধদেব ভাবছেন। স্নিগ্ধর কথা ওঠে কেন? কথা হচ্ছে আপনার আর আমার মধ্যে। লিভ স্নিগ্ধ। আমি ওঁর নাম উচ্চারণ করলেও বুঝি ওঁকে অপমান করা হয়? মণিদীপা অধৈর্যের গলায় বলে, ইউ আর স্টিল প্রিমিটিভ। ইউ আর জেলাস। দীপনাথ একটু চোখ বুজে দম ধরে রইল। তারপর বলল, আমার জেলাসির কোনও কারণ নেই। নিশ্চয়ই জেলাস। আপনি জেলাস, মিস্টার বোস জেলাস। আপনারা স্নিগ্ধকে হিংসে করেন, কারণ আপনারা জন্মেও ওর মতো হতে পারবেন না। সবাই কি নেতা হতে পারে? কাউকে কাউকে তো জনগণও হতে হবে। স্নিগ্ধ নেতা নয়। আমরা ব্যক্তিপূজায় বিশ্বাস করি না, নেতৃত্বেও নয়। তা হলে কি কালেকটিভ লিডারশিপ? ও বাবা। তাও জানেন দেখছি। একটু একটু শিখছি। এবার খবরটা কি দয়া করে বলবেন? তাই তো বলতে চাইছিলাম। কিন্তু আপনি বলতে দিচ্ছেন কই? সরি। এবার বলুন। বোস সাহেব বাংগালোরের চাকরি নাও নিতে পারেন। আজ মালিকদের সঙ্গে কনফারেন্স হল। শুনে মণিদীপা একটু চুপ করে থাকে। তারপর নিস্পৃহ গলায় বলে, তাতে আমার কী? কিছুই কি নয়? বোস সাহেবের বাংগালোরে যাওয়া না-যাওয়া নিয়ে তো কোনও প্রবলেম হয়নি। আমাদের প্রবলেম অন্য। সে আপনি বুঝবেন না। দীপনাথ বিষণ্ণ হয়ে বলে, ও। আমি অবশ্য আপনাদের প্রাইভেট ব্যাপারে কিছু জানতে চাইছিলাম না। জাস্ট খবরটা দিলাম, যদি তাতে আপনার মত বদলায়। না, খবরটার তেমন কোনও দাম নেই আমার কাছে। বোস কি ফাইন্যালি ডিসিশন চেঞ্জ করেছে? তা এখনও জানি না। তবে ভাবসাব দেখে মনে হয়, মালিকরা এ রকম একজন এফিসিয়েন্ট লোককে ছাড়বে না। এফিসিয়েন্ট!–বলে একটু শ্লেষের হাসিই যেন হাসল মণিদীপা। তারপর বলল, আপনি কষ্ট করে খবরটা দিলেন বলে ধন্যবাদ। যদিও খবরটার কোনও ইমপট্যান্সই আমার কাছে নেই। শুনুন, মিসেস বোস। শুনছি। কিন্তু মিসেস বোস নয়, মণিদীপা। আমার নিজস্ব পরিচয়টাই আমার একমাত্র পরিচয়, কথাটা কতবার বলেছি? মনে রাখতে পারি না। আমরা একটু সেকেলে। হ্যাঁ, আপনারা কিছু অভ্যাসের দাস। তাই হবে। কী বলছিলেন? কাল রাতে আমি আপনাকে যা বলেছি তার জন্য খুব লজ্জিত। লজ্জার কী আছে? ফ্র্যাংকনেস আমি পছন্দই করি। আমিও তো আপনাকে কিছু কথা বলেছি। ওসব তো সত্যি নয়। কোনটা সত্যি নয়? ওই যা সব বললেন। বোস সাহেব আপনাকে আর আমাকে সন্দেহ করে কি না? দীপনাথের কান লাল হল এত দূরে থেকেও। বলল, ওসব উনি যদি ভেবে থাকেন তো ভুল ভেবেছেন। ভুল ভাবতে পারেন। তবে সত্যি হলেও লজ্জার কিছু নেই। কী যে বলেন! আপনি মেয়েদের বোকা ভাবেন, না? না তো। কেন? সব পুরুষই তাই ভাবে।
false
shorotchandra
করিলাম, এত অন্ধকারে ডিঙিতে চড়বে? সে আবার হাসিল। কহিল, ভয় কি রে! সেই ত মজা। তা ছাড়া অন্ধকার না হ’লে কি মাছ পাওয়া যায়? সাঁতার জানিস? খুব জানি। তবে আয় ভাই! বলিয়া সে আমার একটা হাত ধরিল। কহিল, আমি একলা এত স্রোতে উজোন বাইতে পারিনে—একজন কাউকে খুঁজি, যে ভয় পায় না। আমি আর কথা কহিলাম না। তাহার হাত ধরিয়া নিঃশব্দে রাস্তার উপর আসিয়া উপস্থিত হইলাম। প্রথমটা আমার নিজেরই যেন বিশ্বাস হইল না—আমি সত্যিই এই রাত্রে নৌকায় চলিয়াছি। কারণ, যে আহ্বানে এই স্তব্ধ-নিবিড় নিশীথে এই বাড়ির সমস্ত কঠিন শাসনপাশ তুচ্ছ করিয়া দিয়া, একাকী বাহির হইয়া আসিয়াছি, সে যে কত বড় আকর্ষণ, তাহা তখন বিচার করিয়া দেখিবার আমার সাধ্যই ছিল না। অনতিকাল পরে গোঁসাইবাগানের সেই ভয়ঙ্কর বনপথের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলাম এবং ইন্দ্রকে অনুসরণ করিয়া স্বপ্নাবিষ্টের মত তাহা অতিক্রম করিয়া গঙ্গার তীরে আসিয়া দাঁড়াইলাম। খাড়া কাঁকরের পাড়। মাথার উপর একটা বহু প্রাচীন অশ্বত্থবৃক্ষ মূর্তিমান অন্ধকারের মত নীরবে দাঁড়াইয়া আছে এবং তাহারই প্রায় ত্রিশ হাত নীচে সূচিভেদ্য আঁধার-তলে পরিপূর্ণ বর্ষার গভীর জলস্রোত ধাক্কা খাইয়া আবর্ত রচিয়া উদ্দাম হইয়া ছুটিয়াছে। দেখিলাম, সেইখানে ইন্দ্রের ক্ষুদ্র তরীখানি বাঁধা আছে। উপর হইতে মনে হইল, সেই সুতীব্র জল ধারার মুখে একখানি ছোট্ট মোচার খোলা যেন নিরন্তর কেবলই আছাড় খাইয়া মরিতেছে। আমি নিজেও নিতান্ত ভীরু ছিলাম না। কিন্তু ইন্দ্র যখন উপর হইতে নীচে একগাছি রজ্জু দেখাইয়া কহিল, ডিঙির এই দড়ি ধ’রে পা টিপে টিপে নেমে যা, সাবধানে নাবিস্, পিছলে পড়ে গেলে আর তোকে খুঁজে পাওয়া যাবে না; তখন যথার্থই আমার বুক কাঁপিয়া উঠিল। মনে হইল, ইহা অসম্ভব। কিন্তু তথাপি আমার ত দড়ি অবলম্বন আছে, কিন্তু তুমি? সে কহিল, তুই নেবে গেলেই আমি দড়ি খুলে দিয়ে নাব্‌ব। ভয় নেই, আমার নেবে যাবার অনেক ঘাসের শিকড় ঝুলে আছে। আর কথা না কহিয়া আমি দড়িতে ভর দিয়া অনেক যত্নে অনেক দুঃখে নীচে আসিয়া নৌকায় বসিলাম। তখন দড়ি খুলিয়া দিয়া ইন্দ্র ঝুলিয়া পড়িল। সে যে কি অবলম্বন করিয়া নামিতে লাগিল, তাহা আজও আমি জানি না। ভয়ে বুকের ভিতরটা এমনি ঢিপঢিপ করিতে লাগিল যে, তাহার পানে চাহিতেই পারিলাম না! মিনিট দুই-তিন কাল বিপুল জলধারার মত্তগর্জন ছাড়া কোনও শব্দমাত্র নাই। হঠাৎ ছোট্ট একটুখানি হাসির শব্দে চকিত হইয়া মুখ ফিরাইয়া দেখি, ইন্দ্র দুই হাত দিয়া নৌকা সজোরে ঠেলিয়া দিয়া লাফাইয়া চড়িয়া বসিল। ক্ষুদ্র তরী তীব্র একটা পাক খাইয়া নক্ষত্রবেগে ভাসিয়া চলিয়া গেল। দুই কয়েক মুহূর্তেই ঘনান্ধকারে সম্মুখ এবং পশ্চাৎ লেপিয়া একাকার হইয়া গেল। রহিল শুধু দক্ষিণ ও বামে সীমান্তরাল প্রসারিত বিপুল উদ্দাম জলস্রোত এবং তাহারই উপর তীব্রগতিশীলা এই ক্ষুদ্র তরণীটি এবং কিশোরবয়স্ক দুটি বালক। প্রকৃতিদেবীর সেই অপরিমেয় গম্ভীর রূপ উপলব্ধি করিবার বয়স তাহাদের নহে, কিন্তু সে কথা আমি আজও ভুলিতে পারি নাই! বায়ুলেশহীন, নিষ্কম্প, নিস্তব্ধ, নিঃসঙ্গ নিশীথিনীর সে যেন এক বিরাট্ কালীমূর্তি। নিবিড় কালো চুলে দ্যুলোক ভূলোক আচ্ছন্ন হইয়া গেছে, এবং সেই সূচিভেদ্য অন্ধকার বিদীর্ণ করিয়া করাল দংষ্ট্রারেখার ন্যায় দিগন্তবিস্তৃত এই তীব্র জলধারা হইতে কি এক প্রকারের অপরূপ স্তিমিত দ্যুতি নিষ্ঠুর চাপাহাসির মত বিচ্ছুরিত হইতেছে। আশেপাশে সম্মুখে কোথাও বা উন্মত্ত জলস্রোত গভীর তলদেশে ঘা খাইয়া উপরে উঠিয়া ফাটিয়া পড়িতেছে, কোথাও বা প্রতিকূল গতি পরস্পরের সংঘাতে আবর্ত রচিয়া পাক খাইতেছে, কোথাও বা অপ্রতিহত জলপ্রবাহ পাগল হইয়া ধাইয়া চলিয়াছে। আমাদের নৌকা কোণাকুণি পাড়ি দিতেছে, এইমাত্র বুঝিয়াছি। কিন্তু পরপারের ঐ দুর্ভেদ্য অন্ধকারের কোনখানে যে লক্ষ্য স্থির করিয়া ইন্দ্র হাল ধরিয়া নিঃশব্দে বসিয়া আছে তাহার কিছুই জানি না। এই বয়সেই সে যে কত বড় পাকা মাঝি, তখন তাহা বুঝি নাই। হঠাৎ সে কথা কহিল, কি রে শ্রীকান্ত, ভয় করে? আমি বলিলাম, নাঃ— ইন্দ্র খুশি হইয়া কহিল, এই ত চাই—সাঁতার জানলে আবার ভয় কিসের! প্রত্যুত্তরে আমি একটি ছোট্ট নিশ্বাস চাপিয়া ফেলিলাম—পাছে সে শুনিতে পায়। কিন্তু এই গাঢ় অন্ধকার রাত্রিতে, এই জলরাশি এবং এই দুর্জয় স্রোতের সঙ্গে সাঁতার জানা, এবং না-জানার পার্থক্য যে কি, তাহা ভাবিয়া পাইলাম না। সেও আর কোন কথা কহিল না। বহুক্ষণ এই ভাবে চলার পরে কি একটা যেন শোনা গেল—অস্ফুট এবং ক্ষীণ; কিন্তু নৌকা যত অগ্রসর হইতে লাগিল, ততই সে শব্দ স্পষ্ট এবং প্রবল হইতে লাগিল। যেন বহুদূরাগত কাহাদের ক্রুদ্ধ আহ্বান। যেন কত বাধাবিঘ্ন ঠেলিয়া ডিঙ্গাইয়া সে আহ্বান আমাদের কানে আসিয়া পৌঁছিয়াছে—এম্‌নি শ্রান্ত, অথচ বিরাম নাই, বিচ্ছেদ নাই—ক্রোধ যেন তাহাদের কমেও না বাড়েও না, থামিতেও চাহে না। মাঝে মাঝে এক-একবার ঝুপঝাপ্ শব্দ। জিজ্ঞাসা করিলাম, ইন্দ্র, ও কিসের আওয়াজ শোনা যায়? সে নৌকার মুখটা আর একটু সোজা করিয়া দিয়া কহিল, জলের স্রোতে ওপারের বালির পাড় ভাঙার শব্দ। জিজ্ঞাসা করিলাম, কত বড় পাড়? কেমন স্রোত? সে ভয়ানক স্রোত। ওঃ, তাইত, কাল জল হয়ে গেছে, আজ ত তার তলা দিয়ে যাওয়া যাবে না। একটা পাড় ভেঙ্গে পড়লে ডিঙ্গিসুদ্ধ আমরা সব গুঁড়িয়ে যাব। তুই দাঁড় টানতে পারিস? পারি। তবে টান্। আমি টানিতে শুরু করিলাম। ইন্দ্র কহিল, উই—উই যে কালো মত বাঁদিকে দেখা যায় ওটা চড়া। ওরি মধ্যে দিয়ে একটা খালের মত আছে, তারি ভিতর দিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে, কিন্তু খুব আস্তে—জেলেরা টের পেলে আর ফিরে আসতে হবে না। লগির ঘায়ে মাথা ফাটিয়ে
false
shordindu
যাইতেছে না কিন্তু তাহার কলধ্বনি কানে আসিতেছে। সম্মুখে বিহারের উধ্বোঙ্খিত চূড়া বিপুলায়তন প্রস্তরীভূত অন্ধকারের আকার ধারণ করিতেছে; বিহারভূমি হইতে কোলাহলের শব্দ আসিতেছে…কয়েকটি মশাল জ্বলিয়া উঠিল… সেনা-মণ্ডলীর সীমান্ত পরিক্রমণ করিতে করিতে যুবরাজ বিগ্রহপাল চিন্তা করিতেছিলেন বুড়া লক্ষ্মীকর্ণ একটা গ্রন্থিচ্ছেদক…চোর…দিব্য বিহারে ঢুকিয়া চক্চুষ্য খাইতেছে, আর আমরা…দূর হোক। আজ যদি প্রিয়বয়স্য অনঙ্গপাল সঙ্গে থাকিত নিশ্চয় একটা বুদ্ধি বাহির করিত…অন্ধকারে চুপি চুপি বিহারে ঢুকিয়া পড়িলে কেমন হয়? আমাকে তো কেহ চেনে না।…কিন্তু পিতৃদেবের নিষেধ সশস্ত্রভাবে বিহারে প্রবেশ করিবে না।…কী উপায়! আজ রাত্রে খাদ্যসংগ্রহ করিতেই হইবে। নিরস্ত্র হইয়া বিহারে প্রবেশ করিলে কেমন হয়? একবার আর্য দীপঙ্করের কাছে পৌঁছিতে পারিলে আর ভয় নাই…কিন্তু আর্য দীপঙ্কর কিরূপ আছেন কে বলিতে পারে! হয়তো মহাপিশুন লক্ষীকর্ণ তাঁহাকে বাঁধিয়া রাখিয়াছে। তা যদি করিয়া থাকে, পাষণ্ডের মুণ্ড লইয়া গেণ্ডুয়া খেলিব… এই সব চিন্তার জালে বিগ্রহপালের মন জড়াইয়া গিয়াছে এমন সময় বিহারভূমি হইতে বিকট শব্দ আসিল—দুম্! তারপর দ্রুত পরম্পরায়—দুম্ দাম্ দড়াম্! নয়পালের দুই হাজার সৈন্য একযোগে উঠিয়া দাঁড়াইল। এ কি ভয়ানক শব্দ! সকলে কাষ্ঠপুত্তলির ন্যায় দাঁড়াইয়া বিহারের দিকে চাহিয়া রহিল। শব্দটা বিহারের প্রাচীর বেষ্টনের মধ্যে আবদ্ধ আছে তাই কেহ পলায়ন করিল না, নচেৎ অবশ্য পলায়ন করিত। বিগ্রহপাল ক্ষণেকের জন্য বিমূঢ় হইয়া গেলেন, তারপর কটি হইতে তরবারি খুলিয়া ফেলিয়া দ্রুতহস্তে দেহের বর্মচর্ম মোচন করিতে লাগিলেন। যেখানে উত্তেজক ব্যাপার ঘটিতেছে সেখান হইতে বিগ্রহপালকে ঠেকাইয়া রাখা অসম্ভব। দুম্ দাম্ শব্দ চলিতে লাগিল। কিয়ৎকাল পরে তাহার সহিত ভীত মনুষ্যকণ্ঠের কলকল শব্দ মিশিল। তারপর বিহারের চারিদিক হইতে ছায়ামূর্তির মত মানুষ ছুটিয়া বাহির হইতে লাগিল; বল্মীকস্তুপের উপর পদাঘাত করিলে যেমন পিপি করিয়া কীট বাহির হয় তেমনি। নয়পালের সৈন্যদল যেখানে যূথবদ্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া ছিল সেদিকে কেহ আসিল না, বিভিন্ন দিকে ছুটিয়া পলাইতে লাগিল। বিগ্রহপালের কৌতূহল ও আগ্রহ আর বাধা মানিল না। পিতার অনুমতি লইতে গেলে অনেক সময় লাগিবে, তিনি কাহাকেও কিছু না বলিয়া বিহারের দিকে ছুটিলেন। দুম্ দাম্ শব্দ এতক্ষণে থামিয়া আসিয়াছে, পলায়মান মানুষগুলাও অদৃশ্য হইয়াছে। বিগ্রহপাল বিহার-তোরণের সম্মুখে যখন পৌঁছিলেন তখন বিহার নিস্তব্ধ ও অন্ধকার। বিড়ালের ন্যায় লঘুপদক্ষেপে তিনি সোপান অতিক্রম করিয়া বিহারভূমিতে প্রবেশ করিলেন। বিহারভূমি জনশূন্য, কেবল একটি কটু ধূমের গন্ধ চারিদিকে ব্যাপ্ত হইয়া আছে। বিগ্রহপাল বিহারের কেন্দ্রস্থিত ভবনে প্রবেশ করিলেন। তিনি পূর্বে কয়েকবার পিতার সঙ্গে বিক্রমশীল বিহারে আসিয়াছেন, স্থানটি তাঁহার অপরিচিত নয়। মহাচার্য দীপঙ্কর ছাদের কাষ্ঠ-প্রকোষ্ঠে বাস করেন তাহাও তিনি জানেন। তবু ছাদে উঠিবার সিঁড়িটা সহসা খুঁজিয়া পাইলেন না। একে সূচীভেদ্য অন্ধকার, তার উপর কোথাও জনমানবের চিহ্ন নাই। সতর্কভাবে এদিক ওদিক হাতড়াইতে হাতড়াইতে সহসা দূরে আলোকের প্রভা তাঁহার চোখে পড়িল। তিনি অতি সন্তর্পণে সেইদিকে চলিলেন। সংঘ শত্ৰু কিম্বা মিত্র কাহার অধিকারে তাহা জানা নাই, সাবধানে চলা ভাল। আলোকপ্রভার কাছাকাছি আসিয়া তিনি দেখিলেন একটি প্রকোষ্ঠে তিন-চারিটি দীপ জ্বলিতেছে, কয়েকজন লোক আহারে বসিয়াছে। দুইজন ভিক্ষু পরিবেশন করিতেছে। ভোক্তাদের মধ্যে একজন বিশালকায় পুরুষ গোগ্রাসে আহার করিতেছে, তাহার পাত্রে খাদ্যদ্রব্য পড়িতে পড়িতে অদৃশ্য হইয়া যাইতেছে। আজ দ্বিপ্রহরে বিগ্রহপাল এই বিশালকায় লোকটাকে যুদ্ধক্ষেত্রে বহুদূর হইতে দেখিয়াছিলেন—নিশ্চয় লক্ষ্মীকর্ণ। বিগ্রহপাল বাহিরের অন্ধকারে দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিলেন। ক্রমে তাঁহার কর্ণে আসিল একটি শান্ত পরিচিত কণ্ঠস্বর। দীপঙ্কর প্রকোষ্ঠের মধ্যেই আছেন, বাহির হইতে তাঁহাকে দেখা যাইতেছে না। বিগ্রহপাল শুনিতে পাইলেন, দীপঙ্কর বলিতেছেন—মহারাজ লক্ষীকর্ণ, বৌদ্ধবিহারে রাজকীয় খাদ্য-পানীয় নেই, রাজকীয় রতিগৃহের পালঙ্কশয্যাও নেই। আজ ভিক্ষুর খাদ্য এবং ভিক্ষুর শয্যাতে আপনাকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। আপনারা পথক্লান্ত, আহারের পর বিশ্রাম করুন। পাশের প্রকোষ্ঠে আপনাদের তৃণশয্যা রচিত হয়েছে। ভয় নেই, প্রেত পিশাচ বা মানুষ, কেউ আপনাদের বিরক্ত করবে না। কাল প্রাতে আপনার সঙ্গে কিছু আলোচনা করবার আছে। তারপর আপনি যদি ইচ্ছা করেন নিজ রাজ্যে ফিরে যেতে পারবেন। আজ আমি চললাম। আমার কিছু অন্য কাজ আছে। —আরোগ্য। উত্তরে লক্ষ্মীকর্ণ গলার মধ্যে ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ করিলেন। দীপঙ্কর একটি দীপ হস্তে লইয়া কক্ষের বাহিরে আসিলেন। বিগ্রহপালকে তিনি দেখিতে পাইলেন না, অলিন্দ দিয়া একদিকে চলিতে আরম্ভ করিলেন। বিগ্রহপাল নিঃশব্দে তাঁহার অনুসরণ করিলেন। অলিন্দের প্রান্তে ছাদে উঠিবার সিঁড়ি। দীপঙ্কর সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা দিয়াছেন এমন সময় পিছনে অস্পষ্ট শব্দ শুনিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। বিগ্রহপাল তাঁহার কাছে আসিয়া নত হইয়া তাঁহার পদস্পর্শ করিলেন। প্রদীপ তুলিয়া ধরিয়া দীপঙ্কর বিগ্রহপালের মুখ দেখিলেন, বিস্ময়োফুল্ল স্বরে বলিলেন—এ কি বিগ্রহ! তুমি এখানে কোথা থেকে এলে? ভয়ঙ্কর শব্দ শুনে এসেছি আর্য। বলিয়া দ্রুত নিম্নকণ্ঠে সকল কথা বলিলেন। শুনিয়া দীপঙ্কর হাসিতে লাগিলেন, বলিলেন—এতক্ষণে লক্ষ্মীকণের ব্যাপার বুঝলাম। ভাল হয়েছে, ভাল হয়েছে। তুমি এখন ফিরে যাও, তোমার পিতৃদেবকে সঙ্গে করে নিয়ে এস। তাঁর সঙ্গে অনেক কথা আছে। যে আজ্ঞা। কিন্তু আর্য, কিসের এমন বিকট শব্দ হচ্ছিল? পরে শুনো। এখন যাও, শীঘ্র মহারাজকে নিয়ে এস। আজ্ঞা। কিন্তু আর্য, বড় পেট জ্বলছে, ফিরে এসে যেন খেতে পাই। দীপঙ্কর তাঁহার স্কন্ধে হাত রাখিয়া বলিলেন—পাবে। সাত রাত্রির প্রথম প্রহর উত্তীর্ণ হইয়াছে। বিহারের একটি কক্ষে খড়ের শয্যায় শয়ন করিয়া মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ সানুচর নিদ্রা যাইতেছেন। তৃণশয্যার জন্য নিদ্রার কোনও ব্যাঘাত হয় নাই, মহারাজের নাসারন্ধ্র হইতে থাকিয়া থাকিয়া বীরোচিত সিংহনাদ বাহির হইতেছে। অন্যথা বিহার নিস্তব্ধ এবং অন্ধকারে আচ্ছন্ন। কেবল ছাদে দীপঙ্করের দারু-কক্ষে দীপ জ্বলিতেছে। কক্ষটি আয়তনে প্রশস্ত, ভূমির উপর তৃণাস্তরণ; চারি কোণে তূপীকৃত তালপাতার পুঁথি ছাড়া কক্ষে আর কিছু নাই। এই কক্ষের মাঝখানে পাঁচটি মানুষ
false
tarashonkor
সে কি? সে আসর থেকে বেরিয়ে এল, তুমি এলে সঙ্গে সঙ্গে। আমি বলেও দিলাম তোমাকে। তারপর আমি খোঁজও করলাম; শুনলাম, তোমার ঘরেই— নিতাই বলিল—হ্যাঁ, কজন লোক বিরক্ত করছিল ব’লে আমার ঘরেই এসেছিল। আমি এসে দেখলাম শুয়ে আছে, গায়ে অনেকটা জ্বর। কিন্তু খানিক পরেই বেরিয়ে সেই লোকের সঙ্গেই চলে গেল। প্রৌঢ়া চিন্তিত হইয়া উঠিল; রাজার কৌতুক-হাস্য স্তব্ধ হইয়া গেল! নিতাই বলিল—কাসেদ সেখের ছেলে নয়ানের সঙ্গে গিয়েছে। ওই বোঁপ মত বটগাছটার তলাতেই যেন কথা কইছিল। আসুন দেখি। তাহারা আগাইয়া গেল। সেখানেই তাহাকে পাওয়া গেল। সে হতচেতনের মত অসম্বৃত দেহে পড়িয়া ছিল। বিপুলপরিধি ছায়ানিবিড় বটগাছটির তলদেশটা ছায়ান্ধকারের জন্য তৃণহীন পরিষ্কার; সেইখানেই মাটির উপর বসন্ত তখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়া আছে। কেশের রাশ বিস্রস্ত অসম্বৃত, সর্বাঙ্গ ধূলায় ধূসর, মুখের কাছে কতকগুলো মাছি ভন ভন করিয়া উড়িতেছে; পাশেই পড়িয়া আছে একটা খালি বোতল, একটা উচ্ছিষ্ট পাতা। কাছে যাইতেই দেশী মদের তীব্র গন্ধ সকলের নাকে আসিয়া ঢুকিল। প্রৌঢ়া বলিল—মরণ! এই করেই মরবে হারামজাদী! বসনা, ও বসন! রাজা হাসিয়া বলিল—বহুত মাতোয়ারা হেগেয়া। নিতাই দ্রুত সেখান. হইতে চলিয়া গেল। কিছুক্ষণ পরেই ফিরিয়া আসিল এক কাপ ধূমায়মান চা হাতে লইয়া। দুধ না দিয়া কাঁচা চা, তাহাতে একটু লেবুর রস। কাঁচা চায়ে নাকি মদেয় নেশা ছাড়ে। মহাদেব কবিয়ালকে সে কাঁচা চা খাইতে দেখিয়াছে। বসন্ত তখন উঠিয়া বসিয়াও ঢুলিতেছে অথবা টলিতেছে। প্রৌঢ়া বলিতেছে—এ আমি কি করি বল দেখি? —এই চা-টা খাইয়ে দিন, এখুনি ছেড়ে যাবে নেশা। চা খাইয়া সত্যই বসন্ত খানিকট সুস্থ হইল। এতক্ষণে সে রাঙা ডাগর চোখ মেলিয়া চাহিল নিতাইয়ের দিকে। প্রৌঢ়া তাড়া দিয়া বলিল—চল এইবার। নিতাই বলিল—চান করিয়ে দিলে ভাল করতেন। সোরও হত, আর সর্বাঙ্গে ধুলো লেগেছে— তাহার কথা ঢাকা পড়িয়া গেল বসন্তর মত্ত কণ্ঠের খিলখিল হাসিতে। সে টলিতে টলিতে উঠিয়া দাঁড়াইল, নিতাইয়ের সম্মুখে আসিয়া জড়িত-কণ্ঠে বলিল—মুছিয়ে দাও না নাগর, দেখি কেমন দরদ! নিতাই তাহার মুখের দিকে চাহিয়া একটু হাসিল—হাসিয়া কাঁধের গামছাখানি লইয়া সযত্নে বসন্তর সর্বাঙ্গের ধূলা মুছাইয়া দিয়া বলিল—আচ্ছা, নমস্কার তা হ’লে। প্রৌঢ়া তাহাকে ডাকিল—বাবা! নিতাই ফিরিল। —আমার কথাটার কি করলে বাবা? দলে আসবার কথা? নিতাই কিছু বলিবার পূর্বেই নেশায় বিভোর মেয়েটা আবার আরম্ভ করিয়া দিল সেই হাসি। সে হাসি তাহার যেন আর থামিবে না। বিরক্ত হইয় প্রৌঢ়া বলিল—মরণ! কালামুখে এমন সর্বনেশে হাসি কেনে? বুক ফেটে মরবি যে! সেই হাসির মধ্যেই বসন্ত কোনরূপে বলিল—ওলো মাসী লো—কয়লা-মাণিকেরও মনের মানুষ আছে লো! কাল রাতে—হি-হি-হি—হি-হি-হি—হি-হি-হি— . রাজা এবার অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া মেয়েটাকে একটা ধমক দিয়া উঠিল—কেঁও এইসা ফ্যাক্‌ ফ্যাক্ করতা হ্যায়? বসন্তর চোখ দুইটা জলিয়া উঠিল। কিন্তু পরক্ষণেই সে আবার হাসিতে আরম্ভ করিল— হি-হি-হি—হি-হি-হি— ওদিকে স্টেশনে ট্রেনের ঘণ্টা পড়িল; স্টেশন-মাস্টার নিজে ঘণ্টা দিতে দিতে হাঁকিতেছিল—রাজা! এই রাজা! রাজা ছুটিল, নতুবা একটা অঘটন ঘটা অসম্ভব ছিল না। নিতাই হাসিয়া বলিল—আচ্ছা, আসুন তা হ’লে। সঙ্গে সঙ্গে সেও আপনার বাসার দিকে ফিরিল। প্রৌঢ়া এবার কঠিন-স্বরে বলিল—বসন! আসবি, না এইখানে মাতলামি করবি? বসন্ত ক্লাস্তিতে শিথিল পদে চলিতে আরম্ভ করিল, কিন্তু হাসি তাহার তখনও থামে নাই। সহসা ফিরিয়া দাঁড়াইয়া হাত নাড়িয়া ইশারা করিয়া সে চীৎকার করিয়া বলিল— চললাম হে! * * * নিতাই আসিয়া বসিল কৃষ্ণচূড়া গাছটির তলায়। ওদিকে ট্রেনটা ছাড়িয়াছে। ট্রেনটা স্টেশন হইতে ছাড়িয়া সশব্দে সম্মুখ দিয়া পার হইয়া যাইতেছিল। কামরার পর কামরা। একটা কামরায় ঝুমুরের দলটাকে দেখা গেল। বসন্ত মেয়েটি একধারে দরজার পাশেই জানালায় মাথা রাখিয়া যেন একেবারে এলাইয়া পড়িয়ছে। অদ্ভুত মেয়ে! নিতাই হাসিল। ঝুমুর সে অনেক দেখিয়াছে! কবিগান করিতে ইহাদের সঙ্গে মেলা-মেশাও অনেক করিয়াছে, কিন্তু এমন নিষ্ঠুর ব্যবসায়িনী ক্ষুরধার মেয়ে সে দেখে নাই। ক্ষুরধার নয়, জলন্ত। মেয়েটা যেন জ্বলিতেছে। তবে মেয়েটার গুণ আছে, রূপও আছে। আশ্চর্য মেয়ে! গত রাত্রের গানটা তাহার গানটা তাহার মনে পড়িয়া গেল— “করিল কে ভুল—হায় রে! মন-মাতানো বাসে ভরে দিয়ে বুক করাত-কাঁটার ধারে ঘেরা কেয়াফুল। করিল কে ভুল! হায়রে!” ট্রেনট চলিয়া গেল। নিতাই বসিয়াই রহিল। চাহিয়া রহিল রেল-লাইনের বাঁকে যেখানে সমান্তরাল লাইন দুইটি এক বিন্দুতে মিশিয়া গিয়াছে বলিয়া মনে হয় সেইখানের দিকে। বসন্ত তো চলিয়া গেল, আর হয়তো কখনও দেখাই হইবে না। অদ্ভূত মেয়ে! ক্ষণে ক্ষণে মেয়েটার এক একটি রূপ, এক রাত্রে উহাকে লইয়াই তিন-তিনখান গান মনে আসিয়াছে। সে খানিকট উদাস হইয়া রহিল। অকস্মাৎ কোথা হইতে একটা সচেতনতা আসিয়া তাহাকে নাড়া দিল। ওইখানেই বাঁকের ওই বিন্দুটিতে এক সময় একটি স্বর্ণবিন্দু ঝকমক করিয়া উঠিবে, তাহার পর দেখা যাইবে—ও স্বর্ণবিন্দুটির নীচে চলন্ত একটি কাশফুল। স্বর্ণবিন্দু বিচ্ছুরিত জ্যোতিরেখাটির মধ্যে মধ্যে এক একটি চকিত চমকে চোখে লাগিয়া চোখ ধাধিয়া দিবে। অসমাপ্ত গানগুলি তাহার অসমাপ্তই রহিল, পথের উপর স্থিরদৃষ্টি পাতিয়া নিতাই যেন প্রত্যাশা-বিভোর হইয়া বসিয়া রহিল। ঠাকুরঝি কখন আসিবে? কই, ঠাকুরঝি আসিতেছে কই? ওই কি? না, ও তো নয়! নিতান্তই চোখের ভ্রম। মনের প্রত্যাশিত কল্পনা–এই দিকের আলোর মধ্যেও মরুভূমির মরীচিকার মত মধ্যে মধ্যে স্পষ্ট হইয়া ফুটিয়া উঠিতেছে। এমনি দেখা যায়, আবার মিলাইয়া যায়। নিতাই হাসিল। এই তো বেলা সবে দশটা। ঠাকুরঝি আসে ঘড়ির কাঁটাটির মত বারোটার ট্রেনটির ঠিক আগে। তবু সে উঠিয়া গেল না। গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়া ঘুমাইতে চেষ্টা করিল। ঘণ্টাগুলো আজ যেন যাইতেই চাহিতেছে না। ওই! হ্যাঁ, ওই আসিতেছে। চলন্ত সাদা
false
robindronath
ভিতরকার আসল কথাটা এই যে, পরেশকে সুচরিতা এক জায়গায় দৃঢ় করিয়া ধরিয়া বলেতেছে–“তোমাকে ছাড়িব না, আমি এখনো তোমার সমাজের, তোমার মতের, তোমার শিক্ষার বন্ধন কোনোমতেই ছিঁড়িতে দিব না।’ পরেশ কহিলেন, “বিবাহ-অনুষ্ঠানে শালগ্রামের সংস্রব বাদ দিতে বিনয় রাজি হয়েছে।” সুচরিতা চৌকির পিছন হইতে আসিয়া পরেশের সম্মুখে চৌকি লইয়া বসিল। পরেশ তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এতে তুমি কী বল?” সুচরিতা একটু চুপ করিয়া কহিল, “আমাদের সমাজ থেকে ললিতাকে তা হলে বেরিয়ে যেতে হবে।” পরেশ কহিলেন, “এই কথা নিয়ে আমাকে অনেক চিন্তা করতে হয়েছে। কোনো মানুষের সঙ্গে সমাজের যখন বিরোধ বাধে তখন দুটো কথা ভেবে দেখবার আাছে, দুই পক্ষের মধ্যে ন্যায় কোন্‌ দিকে এবং প্রবল কে? সমাজ প্রবল তাতে সন্দেহ নেই, অতএব বিদ্রোহীকে দুঃখ পেতে হবে। ললিতা বাবংবার আমাকে বলছে, দুঃখ স্বীকার করতে সে যে শুধু প্রস্তুত তা নয়, এতে সে আনন্দ বোধ করছে। এ কথা যদি সত্য হয় তা হলে অন্যায় না দেখলে আমি তাকে বাধা দেব কী করে?” সুচরিতা কহিল, “কিন্তু বাবা, এ কী রকম হবে!” পরেশ কহিলেন, “জানি এতে একটা সংকট উপস্থিত হবে। কিন্তু ললিতার সঙ্গে বিনয়ের বিবাহে যখন দোষ কিছু নেই, এমন-কি, সেটা উচিত, তখন সমাজে যদি বাধে তবে সে বাধা মানা কর্তব্য নয় বলে আমার মন বলছে। মানুষকেই সমাজের খাতিরে সংকুচিত হয়ে থাকতে হবে এ কথা কখনোই ঠিক নয়–সমাজকেই মানুষের খাতিরে নিজেকে কেবলই প্রশস্ত করে তুলতে হবে। সেজন্যে যারা দুঃখ স্বীকার করতে রাজি আছে আমি তো তাদের নিন্দা করতে পারব না।” সুচরিতা কহিল, “বাবা, এতে তোমাকেই সব চেয়ে বেশি দুঃখ পেতে হবে।” পরেশ কহিলেন, ” সে কথা ভাবার কথাই নয়।” সুচরিতা জিজ্ঞাসা করিল, “বাবা, তুমি কি সম্মতি দিয়েছ?” পরেশ কহিলেন, ” না, এখনো দিই নি। কিন্তু দিতেই হবে। ললিতা যে পথে যাচ্ছে সে পথে আমি ছাড়া কে তাকে আশীর্বাদ করবে আর ঈশ্বর ছাড়া কে তার সহায় আছেন?” পরেশবাবু যখন চলিয়া গেলেন তখন সুচরিতা স্তম্ভিত হইয়া বসিয়া রহিল। সে জানিত পরেশ ললিতাকে মনে মনে কত ভালোবাসেন, সেই ললিতা বাঁধা পথ ছাড়িয়া দিয়া এতবড়ো একটা অনির্দেশ্যের মধ্যে প্রবেশ করিতে চলিয়াছে, ইহাতে তাঁহার মন যে কত উদ্‌বিগ্ন তাহা তাহার বুঝিতে বাকি ছিল না–তৎসত্ত্বে এই বয়সে তিনি এমন একটা বিপ্লবে সহায়তা করিতে চলিয়াছেন, অথচ ইহার মধ্যে বিক্ষোভ কতই অল্প! নিজের জোর তিনি কোথাও কিছুমাত্র প্রকাশ করেন নাই, কিন্তু তাঁর মধ্যে কতবড়ো একটা জোর অনায়াসেই আত্মগোপন করিয়া আছে! পূর্বে হইলে পরেশের প্রকৃতির এই পরিচয় তাহার কাছে বিচিত্র বলিয়া ঠেকিত না, কেননা পরেশকে শিশুকাল হইতেই তো সে দেখিয়া আসিতেছে। কিন্তু আজই কিছুক্ষণ পূর্বেই নাকি সুচরিতার সমস্ত অন্তঃকরণ গোরার অভিঘাত সহ্য করিয়াছে, সেইজন্য এই দুই শ্রেণীর স্বভাবের সম্পূর্ণ পার্থক্য সে মনে মনে সুস্পষ্ট অনুভব না করিয়া থাকিতে পারিল না। গোরার কাছে তাহার নিজের ইচ্ছা কী প্রচণ্ড! এবং সেই ইচ্ছাকে সবেগে প্রয়োগ করিয়া সে অন্যকে কেমন করিয়া অভিভূত করিয়া ফেলে! গোরার সহিত যে- কেহ যে-কোনো সম্বন্ধ স্বীকার করিবে গোরার ইচ্ছার কাছে তাহাকে নত হইতে হইবে। সুচরিতা আজ নত হইয়াছে এবং নত হইয়া আনন্দও পাইয়াছে, আপনাকে বিসর্জন করিয়া একটা বড়ো জিনিস পাইয়াছে বলিয়া অনুভব করিয়াছে, কিন্তু তবু আজ পরেশ যখন তাহার ঘরের দীপালোক হইতে ধীরপদে চিন্তানত মস্তকে বাহিরের অন্ধকারে চলিয়া গেলেন তখন যৌবনতেজোদীপ্ত গোরার সঙ্গে বিশেষভাবে তুলনা করিয়াই সুচরিতা অন্তরের ভক্তি-পুষ্পাঞ্জলি বিশেষ করিয়া পরেশের চরণে সমর্পণ করিল এবং কোলের উপর দুই করতল জুড়িয়া অনেকক্ষণ পর্যন্ত শান্ত হইয়া চিত্রার্পিতের মতো বসিয়া রহিল। ৬১ আজ সকাল হইতে গোরার ঘরে খুব একটা আন্দোলন উঠিয়াছে। প্রথমে মহিম তাঁহার হুঁকা টানিতে টানিতে আসিয়া গোরাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তা হলে, এতদিন পরে বিনয় শিকলি কাটল বুঝি?” গোরা কথাটা বুঝিতে পারিল না, মহিমের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। মহিম কহিলেন, “আমাদের কাছে আর ভাঁড়িয়ে কী হবে বল? তোমার বন্ধুর খবর তো আর চাপা রইল না–ঢাক বেজে উঠেছে। এই দেখো-না।” বলিয়া মহিম গোরার হাতে একখানা বাংলা খবরের কাগজ দিলেন। তাহাতে অদ্য রবিবারে বিনয়ের ব্রাহ্মসমাজে দীক্ষাগ্রহণের সংবাদ উপলক্ষ করিয়া এক তীব্র প্রবন্ধ বাহির হইয়াছেন। গোরা যখন জেলে ছিল সেই সময়ে ব্রাহ্মসমাজের কন্যাদায়গ্রস্ত কোনো কোনো বিশিষ্ট সভ্য এই দুর্বলচিত্ত যুবককে গোপন প্রলোভনে বশ করিয়া সনাতন হিন্দুসমাজ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া লইয়াছে বলিয়া লেখক তাঁহার রচনায় বিস্তর কটু ভাষা বিস্তার করিয়াছেন। গোরা যখন বলিল সে এ সংবাদ জানে না তখন মহিম প্রথমে বিশ্বাস করিলেন না, তার পরে বিনয়ের এই গভীর ছদ্মব্যবহারে বার বার বিস্ময় প্রকাশ করিতে লাগিলেন। এবং বলিয়া গেলেন, স্পষ্টবাক্যে শশিমুখীকে বিবাহে সম্মতি দিয়া তাহার পরেও যখন বিনয় কথা নড়চড় করিতে লাগিল তখনই আমাদের বোঝা উচিত ছিল তাহার সর্বনাশের সূত্রপাত হইয়াছে। অবিনাশ হাঁপাইতে হাঁপাইতে আসিয়া কহিল, “গৌরমোহনবাবু, এ কী কাণ্ড! এ যে আমাদের স্বপ্নের আগোচর! বিনয়বাবুর শেষকালে–” অবিনাশ কথা শেষ করিতেই পারিল না। বিনয়ের এই লাঞ্ছনায় তাহার মনে এত আনন্দ বোধ হইতেছিল যে, দুশ্চিন্তার ভান করা তাহার পক্ষে দুরূহ হইয়া উঠিয়াছিল। দেখিতে দেখিতে গোরার দলের প্রধান প্রধান সকল লোকই আসিয়া জুটিল। বিনয়কে লইয়া তাহাদের মধ্যে খুব একটা উত্তেজনাপূর্ণ আলোচনা চলিতে লাগিল। অধিকাংশ লোকই একবাক্যে বলিল–বর্তমান ঘটনায় বিস্ময়ের বিষয় কিছুই নাই, কারণ বিনয়ের ব্যবহারে তাহারা বরাবরই একটা দ্বিধা এবং দুর্বলতার লক্ষণ দেখিয়া
false
robindronath
ওর স্নানাহারের নিয়মের এমন ব্যতিক্রম ঘটে নি। আজ বড়োই ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে বাড়িতে যেই এল, প্রথম কথাই মনে হয়, কুমু তার দাদার ওখানে চলে গেছে এবং খুশি হয়েই চলে গেছে। এতকাল মধুসূদন আপনাতে আপনি খাড়া ছিল, কখন এক সময়ে ঢিল দিয়েছে, শরীরমনের আতুরতার সময় কোনো মেয়ের ভালোবাসাকে আশ্রয় করবার সুপ্ত ইচ্ছা ওর মনে উঠেছে জেগে, সেইজন্যেই অনায়াসে কুমর চলে যাওয়াতে ওর এমন ধিক্‌কার লাগল। আজ ওর খাবার সময়ে শ্যামাসুন্দরী ইচ্ছা করেই কাছে এসে বসে নি; কী জানি কাল রাত্রে নিজেকে ধরা দেবার পরে মধুসূদন নিজের উপর পাছে বিরক্ত হয়ে থাকে। খাবার পর মধুসূদন শোবার ঘরে এসে একটুখানি চুপ করে থাকল, তার পরে নিজেই শ্যামাকে ডেকে পাঠালে। শ্যামা লাল রঙের একটা বিলিতি শাল গায়ে দিয়ে যেন একটু সংকুচিতভাবে ঘরে ঢুকে একধারে নতনেত্রে দাঁড়িয়ে রইল। মধুসূদন ডাকলে, “এসো, এইখানে এসো, বসো।” শ্যামা শিয়রের কাছে বসে “তোমাকে যে বড়ো রোগা দেখাচ্ছে আজ” বলে একটু ঝুঁকে পড়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। মধুসূদন বললে, “আঃ, তোমার হাত বেশ ঠাণ্ডা।” রাত্রে মধুসূদন যখন শুতে এল শ্যামাসুন্দরী অনাহূত ঘরে ঢুকে বললে, “আহা, তুমি একলা।” শ্যামাসুন্দরী একটু যেন স্পর্ধার সঙ্গেই কোনো আর আবরণ রাখতে দিলে না। যেন অসংকোচে সবাইকে সাক্ষী রেখেই ও আপনার অধিকার পাকা করে তুলতে চায়। সময় বেশি নেই, কবে আবার কুমু এসে পড়বে, তার মধ্যে দখল সম্পূর্ণ হওয়া চাই। দখলটা প্রকাশ্য হলে তার জোর আছে, কোনোখানে লজ্জা রাকলে চলবে না। অবস্থাটা দেখতে দেখতে দাসীচাকরদের মধ্যেও জানাজানি হল। মধুসূদনের মনে বহুকালের প্রবৃত্তির আগুন যতবড়ো জোরে চাপা ছিল, ততবড়ো জোরেই তা অবারিত হল, কাউকে কেয়ার করলে না; মত্ততা খুব স্থূলভাবেই সংসারে প্রকাশ করে দিলে। নবীন মোতির মা দুজনেই বুঝলে এ বান আর ঠেকানো যাবে না। “দিদিকে কি ডেকে আনবে না? আর কি দেরি করা ভালো?” “সেই কথাই তো ভাবছি। দাদার হুকুম নইলে তো উপায় নেই। দেখি চেষ্টা করে।” যেদিন সকালে কৌশলে দাদার কাছে কথাটা পাড়বে বলে নবীন এল, দেখে যে দাদা বেরোবার জন্য প্রস্তুত, দরজার কাছে গাড়ি তৈরি। নবীন জিজ্ঞাসা করলে, “কোথাও বেরোচ্ছ নাকি?” মধুসূদন একটু সংকোচ কাটিয়ে বললে, “সেই গনৎকার বেঙ্কটস্বামীর কাছে।” নবীনের কাছে দুর্বলতা চাপা রাখতেই চেয়েছিল। হঠাৎ মনে হল ওকে সঙ্গে নিয়ে গেলেই সুবিধা হতে পারে। তাই বললে, “চলো আমার সঙ্গে।” নবীন ভাবলে, সর্বনাশ। বললে, “দেখে আসি গে সে বাড়িতে আছে কিনা। আমার তো বোধ হচ্ছে সে দেশে চলে গেছে, অন্তত সেইরকম তো কথা।” মধূসূদন বললে, “তা বেশ তো, দেখে আসা যাক-না।” নবীন নিরুপায় হয়ে সঙ্গে চলল, কিন্তু মনে মনে প্রমাদ গনলে। গনৎকারের বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়াতেই নবীন তাড়াতাড়ি নেমে গিয়ে একটু উঁকি মেরেই বললে, “বোধ হচ্ছে কেউ যেন বাড়িতে নেই।” যেমন বলা, সেই মুহূর্তেই স্বয়ং বেঙ্কটস্বামী দাঁতন চিবোতে চিবোতে দরজার কাছে বেরিয়ে এল। নবীন দ্রুত তার গা ঘেঁষে প্রণাম করে বললে, “সাবধানে কথা কবেন।” সেই এঁদো ঘরে তক্তপোশে সবাই বসল। নবীন বসল মধুসূদনের পিছনে। মধুসূদন কিছু বলবার আগেই নবীন বলে বসল, “মহারাজের সময় বড়ো খারাপ যাচ্ছে, কবে গ্রহশান্তি হবে বলে দাও শাস্ত্রীজি।” মধুসূদন নবীনের এই ফাঁস-করে-দেওয়া প্রশ্নে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বুড়ো আঙুল দিয়ে তার ঊরুতে খুব একটা টিপনি দিলে। বেঙ্কটস্বামী রাশিচক্র কেটে একেবারে স্পষ্টই দেখিয়ে দিলে মধুসূদনের ধনস্থানে শনির দৃষ্টি পড়েছে। গ্রহের নাম জেনে মধুসূদনের কোনো লাভ নেই, তার সঙ্গে বোঝাপড়া করা শক্ত। যে যে মানুষ ওর সঙ্গে শত্রুতা করছে স্পষ্ট করে তাদেরই পরিচয় চাই, বর্ণমালার যে বর্গেই পড়ুক নাম বের করতে হবে। নবীনের মুশকিল এই যে, সে মধুসূদনের আপিসের ইতিবৃত্তান্ত কিছুই জানে না। ইশারাতেও সাহায্য খাটবে না। বেঙ্কটস্বামী মুগ্ধবোধের সূত্র আওড়ায় আর মধুসূদনের মুখের দিকে আড়ে আড়ে চায়। আজকের দিনের নামের বেলায় ভৃগুমুনি সম্পূর্ণ নীরব। হঠাৎ শাস্ত্রী বলে বসল, শত্রুতা করছে একজন স্ত্রীলোক। নবীন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সেই স্ত্রীলোকটি যে শ্যামাসুন্দরী এইটে কোনোমতে খাড়া করতে পারলে আর ভাবনা নেই। মধুসূদন নাম চায়। শাস্ত্রী তখন বর্ণমালার বর্গ শুরু করলে। “ক’বর্গ শব্দটা বলে যেন অদৃশ্য ভৃগুমুনির দিকে কান পেতে রইল–কটাক্ষে দেখতে লাগল মধুসূদনের দিকে। “ক’বর্গ শুনেই মধুসূদনের মুখে ঈষৎ একটু চমক দিলে। ও দিকে পিছন থেকে “না’ সংকেত করে নবীন ডাইনে বাঁয়ে লাগাল ঘাড়-নাড়া। নবীনের জানাই নেই যে মাদ্রাজে এ সংকেতের উলটো মানে। বেঙ্কটস্বামীর আর সন্দেহ রইল না– জোরগলায় বললে, “ক’বর্গ। মধুসূদনের মুখ দেখে ঠিক বুঝেছিল “ক’ বর্গের প্রথম বর্ণটাই। তাই কথাটাকে আরো একটু ব্যাখ্যা করে শাস্ত্রী বললে, এই কয়ের মধ্যেই মধুসূদনের সমস্ত কু। এর পরে পুরো নাম জানবার জন্যে পীড়াপীড়ি না করে ব্যগ্র হয়ে মধুসূদন জিজ্ঞাসা করলে, “এর প্রতিকার?” বেঙ্কটস্বামী গম্ভীরভাবে বলে দিলে, “কণ্টকেনৈব কণ্টকং– অর্থাৎ উদ্ধার করবে অন্য একজন স্ত্রীলোক।” মধুসূদন চকিত হয়ে উঠল। বেঙ্কটস্বামী মানবচরিত্রবিদ্যার চর্চা করেছে। নবীন অস্থির হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, “স্বামীজি, ঘোড়দৌড়ে মহারাজার ঘোড়াটা কি জিতেছে?” বেঙ্কটস্বামী জানে অধিকাংশ ঘোড়াই জেতে না, একটু হিসাবের ভান করে বলে দিলে, “লোকসান দেখতে পাচ্ছি।” কিছুকাল আগেই মধুসূদনের ঘোড়া মস্ত জিত জিতেছে। মধুসূদনকে কোনো কথা বলবার সময় না দিয়ে মুখ অত্যন্ত বিমর্ষ করে নবীন জিজ্ঞাসা করলে, “স্বামীজি, আমার কন্যাটার কী গতি হবে?” বলা বাহুল্য, নবীনের কন্যা নেই। বেঙ্কটস্বামী নিশ্চয় ঠাওরালে পাত্র খুঁজছে।
false
toslima_nasrin
না। আমরা ছিলামই ও বাড়িতে দাঁড়িয়ে। মিন্টুর বোন, মনু, পাড়া কাঁপিয়ে কাঁদছিল। মাথার ওপর ছিলই কাকের কা কা কা। পাড়ার মায়েরা মুকুলদের বারান্দা থেকে ফিরে এসে পানি ঢালছিলেন কেঁদে বেঁহুশ হয়ে পড়া মিন্টুর মা’র মাথায়। মনু থেকে থেকে মা’কে বলছিল ও ঈদুন আপা, আমার ভাইরে যারা মারছে, তাগোরে আমি খুন করুম। মনু বেরিয়ে যেতে চাচ্ছিল বাড়ির বাইরে। মা তাকে ফেরাচ্ছিলেন দু’হাতে। মনু কি করে খুন করবে খুনীদের। খুনীদের হাতে বন্দুক, কেউ কি পারে খালি হাতে সশস্ত্র কারও সঙ্গে যুদ্ধ করতে! পাড়ার লোকেরা মিন্টুর ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে বলাবলি করছিল কী করে মিছিল এগোচ্ছিল পশু হাসপাতালের পাশ দিয়ে, তখন বলা নেই কওয়া নেই, কারও কিছু বুঝে ওঠার আগেই দ্রিম দ্রিম, ছেলেরা উল্টো দিকে দৌড়োল, কেবল মিন্টু পারেনি। মিন্টুদের বাড়িতে তখন ভিড় আরও বাড়ছে। খোকন, বাμচু, হুমায়ুন মিন্টুর ভাইগুলো ভিড় ঠেলে বাড়িতে ঢুকল। মিন্টুকেও আনা হল, খাটিয়ায় শাদা কাপড়ে ঢেকে। আমি বরই গাছের তলে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম মিন্টুর গা মাথা ঢাকা। চুপচাপ লাজুক ছেলেটি, যে ছেলে সকালেও দরজায় দাঁড়িয়ে থেকেছে উদাসীন, নাস্তা খেতে বাড়ির ভেতর ডাক পড়লে মা’কে বলেছে যে সে বাইরে বেরোচ্ছে খানিকক্ষণের জন্য, এই ফিরছে। রান্নাঘরে ঢেকে রেখেছিলেন মা তাঁর ছেলের নাস্তা। মিন্টু যখন ফিরে এল, তখনও তার নাস্তা ঢাকা। বরই পড়ে তলাটি ভরে ছিল, পাড়ার সবচেয়ে মিষ্টি বরই। একটি বরইও আমার কুড়োতে ইচ্ছে করেনি সেদিন। সেদিন কেউ কান মলে দেবে বলে ভয় ছিল না, তবু ইচ্ছে করেনি। মা’কে দেখেছি মিন্টুর মা’র মাথায় হাত বুলিয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলছেন কাইন্দোন না। মিন্টুর রক্ত ছুঁইয়া কত ছেলেরা কইতাছে এর শোধ তারা নিবই নিব। দিন পাল্টাইব, দিন ঠিকই পাল্টাইব। মিন্টু লাশ হয়ে বাড়ি ফিরে আসার পর পাড়ার মানুষও, কেবল মিন্টুর আত্মীয়রা নয়, কেঁদেছে। লিকলিকে ছেলেটিকে মানুষ এত ভালবাসত আমার জানা ছিল না। ছোটদাও গুম হয়ে বসে থাকলেন। তিনি ছিলেন মিছিলে মিন্টুর ঠিক ডানে দাঁড়ানো। গুলি তাঁর ডান বাহু ঘেঁসে উড়ে গেছে মিন্টুর বুকে। গুলি ছোটদার বুকেও লাগতে পারত। সেদিন ছোটদাও মরতে পারতেন। মিন্টুকে আকুয়ার কবরখানায় কবর দেওয়া হল সেদিন। পাড়ায় এত বিষাদ এর আগে আমি কখনও দেখিনি। বিকেলে বাচ্চারা খেলতে গেল না মাঠে। বড়রা গলির রাস্তার কিনারে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে নিচু গলায় কথা বলল। যেন পুরো পাড়া সেদিন আর খাবে না, দাবে না, হাসবে না, খেলবে না, ঘুমোবে না। ক’দিন পর শেখ মুজিব এলেন মিন্টুদের বাড়িতে। সে কী ভিড় শেখ মুজিবকে দেখতে। ছোটদা বলেছিলেন আহা সেদিন আমি মরলে আমগোর বাড়িতে ভিড় হইত, দেখতে শেখ মুজিব আসত। পুলিশের গুলিতে সেদিন মিন্টুর বদলে নিজের মরণ হলেই তিনি খুশি হতেন। মৃত্যু হল না বলে কাউকে এমন হা পিত্যেশ করতে আমি আর দেখিনি। আমিও দেখতে গিয়েছিলাম শেখ মুজিবকে। হাজার লোকের ভিড়ে শেখ মুজিবকে দেখা চাট্টিখানি কথা নয়। প্রথম পায়ের আঙুলের ওপর ভর রেখে, এরপর ইটের ওপর ইট রেখে তার ওপর, এরপর দেয়ালে, প্রথম নিচু দেয়াল পরে পড়ে মরার ভয় তুচ্ছ করে উঁচু দেয়ালে দাঁড়িয়ে শেষ অবদি দেখেছিলাম শেখ মুজিবকে। গায়ে কালো কোট, চশমা পরা লম্বা একটি লোক। দেখতে আমাদের পাড়ার সাহাবউদ্দিনের মত। সাহাবউদ্দিনকে দেখতে তো এত লোকের ভিড় হয় না! শেখ মুজিব নামের মানুষটি যেন সাত আসমান থেকে নেমে এসেছেন এ পাড়ায়, যেন তিনি ঠিক আর সবার মত মানুষ নন। শেখ মুজিব মিন্টুর মা’র মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। বরই তলায় সেদিনও পড়ে ছিল মিষ্টি মিষ্টি বরই। বরই কুড়োনোর কোনও ইচ্ছে আমার হয়নি সেদিনও। মানুষের নিয়মই এই, মানুষ বেশিদিন শোক বইতে পারে না। মাস পার হয়নি, আবার যে যার জীবনে ফিরে গেল। মাঠে খেলতে শুরু করল বাচ্চারা, পুরুষেরা থলে ভরে বাজার করতে লাগল, উনুনে ফুঁকনি ফুঁকতে লাগল বাড়ির মেয়েরা। আমিও সন্ধে নামলে উঠোনে পাটি পেতে হারিকেনের আলোয় দুলে দুলে পড়তে থাকলাম আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে। কেবল কবরখানার পাশ দিয়ে যেতে, ওটিই ছিল আমার ইস্কুলে যাওয়ার, মনু মিয়ার কিম্বা ঠান্ডার বাপের দোকানে যাওয়ার পথ, মা যেমন বলেছিলেন, দু’হাত মুঠো করে মাথা নিচু করে নিঃশব্দে হেঁটেছি। মা বলেননি, কিন্তু কোথাও ফুল ফোটা কোনও গাছ দেখলে, সে যার বাড়ির ফুলই হোক, ছিঁড়ে দৌড়ে দিয়ে এসেছি মিন্টুর বাঁধানো কবরে। আমার মনে হত মিন্টু ঘ্রাণ পাচ্ছে সে ফুলের। এই ঠুনকো পাকিস্তানও ভাঙবে বলে মা’র মনে হয়, লোকের কথাবার্তার ধরনও মা দেখেন পাল্টে গেছে, আয়ুব খানের গুষ্ঠি তুলে লোকে বড় রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে গাল দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ব শাসনের দাবি তুলে ছেলেরা রাস্তায় নামছেই। পাকিস্তান সরকার ক’দিন পর পরই সারা দেশে কারফিউ দিচ্ছে, বাইরে বেরোনো মানা, ব্ল্যাকআউট ঘোষণা করছে, বাড়িঘর অন্ধকার করে বসে থাকতে হয়। সব শাসকের এক চরিত্র, মা ভাবেন। ইংরেজের চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিরা কম অনাচার করছে না! পূবের ধন পশ্চিমে পাচার হয়ে যাচ্ছে, এ ঠিক ভারতের ধন ইংরেজ যেমন জাহাজ ভরে নিয়ে গেছে নিজেদের দেশে। পাকিস্তান দিয়ে মা’র হবে কি! দেশ ভেঙে আরও টুকরো হোক, দেশ কাকে খাক, চিলে নিক, কিছু তাঁর যায় আসে না, তিনি তাঁর ছেলেদের মিছিলে মরতে দিতে চান না। ছেলে মেয়ে ছাড়া তাঁর আর আছে কি! এদের নিয়ে দাঁড়াবার মাটি
false
humayun_ahmed
দেব। তবে অন্য অন্য কলে আগের মতো পাঁচ টাকা। ভাই যাই? বলে আমি হন।হন করে পথে চলে এসেছি— দোকানের এক কর্মচারী এসে আমকে ধরল। শতাব্দী স্টোরের মালিক ডেকেছেন। আমাকে যেতেই হবে, না গেলে তার চাকরি থাকবে না। আমি মালিকের সঙ্গে দেখা করার জন্যে ফিরে গেলাম। নিতান্ত অল্পবয়েসি একটা ছেলে। গোলাপি রঙের হাওয়াই শার্ট পরে বসে আছে। সুন্দর চেহারা। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মালিক হিসেবে তাকে মানাচ্ছে না। তাকে সবচে মানাত যদি টিভি সেটের সামনে বসে ক্রিকেট খেলা দেখত এবং কোনো ব্যাটসম্যান ছক্কা মারলে লাফিয়ে উঠত। শতাব্দী স্টোরের মালিক আমাকে অতি যত্নে বসাল। কফি খাওয়াল। আমি কফি খেয়ে বললাম, অসাধারণা জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতোই অসাধারণ। সে বলল, কোন কবিতা? আমি আবৃত্তি করলাম “পুরানো পেঁচারা সব কোটরের থেকে এসেছে বাহির হয়ে অন্ধকার দেখে মাঠের মুখের পরে, সবুজ ধানের নিচে–মাটির ভিতরে ইঁদুরেরা চলে গেছে–আঁটির ভিতর থেকে চলে গেছে চাষা, শস্যের ক্ষেতের পাশে আজ রাতে আমাদের জেগেছে পিপাসা।“ শতাব্দী স্টোরের মালিক তাঁর এক কর্মচারীকে ডেকে বলল, ওনাকে সবচে ভালো কফি একটিন দাও, ইভাপেরেটেড দুধের একটা টিন, সুগার কিউব দাও। আমি থ্যাংকস বলে উপহার গ্রহণ করলাম। তারপর ছেলেটা বলল, এখন থেকে দোকানে উনি এলে প্ৰথম জিজ্ঞেস করবে। ওনার কী লাগবে। যা লাগবে দেবে। কোনো বিল করতে পারবে না। উনি ঢোকামাত্র আমার ঘরে নিয়ে যাবে। সেখানে টেলিফোন আছে। উনি যত ইচ্ছা টেলিফোন করতে পারবেন। ব্যবসায়ী মানুষ (তার বয়স যত অল্পই হোক) এমন ফ্রী পাশ দেয় না। আমি বিস্মিত হয়ে তাকালাম। ছেলেটা বলল, আমি আপনাকে চিনি। আপনি হিমু। দোকানের লোকজন আপনাকে চিনতে পারেনি–ওদের অপরাধ ক্ষমা করবেন। এখন বলুন আপনি কোথায় যাবেন। ড্রাইভার আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে। ড্রাইভার আমাকে মিসির আলির সাহেবের বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে গেছে। আমি কড়া নেড়ে অপেক্ষা করছি কখন মিসির আলি সাহেব দরজা খোলেন। দ্বিতীয়বার কড়া নাড়তে ইচ্ছা করছে না। সাধারণ মানুষের বাসা হলে কড়া নাড়তাম, এই বাসায় থাকেন। মিসির আলি–কিংবদন্তি পুরুষ। প্রথম কড়া নাড়ার শব্দেই তার বুঝে যাবার কথা কে এসেছে, কেন এসেছে। দরজা খুলল। মিসির আলি সাহেব বললেন, কে? হিমু সাহেব? জি স্যার। মাথা কামিয়েছেন। আপনাকে ঋষি-ঋষি লাগছে। আমি ঋষিসুলভ হাসি হাসলাম। তিনি সহজ গলায় বললেন, আজ এত সকালসকাল এসেছেন, ব্যাপার কী? রাত মোটে নটা বাজে। হাতে কী? আপনার জন্যে সামান্য উপহার। কফি, দুধ, চিনি। মিসির আলি সাহেবের চোখে হাসি বিলিক দিয়ে উঠল। আমি বলললাম, স্যার, আপনার রাতের খাওয়া কি হয়ে গেছে? হ্যাঁ, হয়েছে। তা হলে আমাকে রান্নাঘরে যাবার অনুমতি দিন, আমি আপনার জন্যে কফি বানিয়ে নিয়ে আসি। আসুন আমার সঙ্গে। আমি মিসির আলি সাহেবের সঙ্গে রান্নাঘরে ঢুকলাম। রান্নাঘরটা আমার পছন্দ হল। মনে হচ্ছে রান্নাঘরটাই আসলে তার লাইব্রেরি। তিনটা উঁচু বেতের চেয়ার, শেলফভরতি বই। রান্না করতে করতে হাত বাড়ালেই বই পাওয়া যায়। রান্নাঘরে একটা ইজিচেয়ারও আছে। ইজিচেয়ারের পায়ের কাছে ফুটরেস্ট। বোঝাই যাচ্ছে ফুটরেস্টে পা রেখে আরাম করে বই পড়ার ব্যবস্থা। মিসির আলি চুলা ধরাতে ধরাতে বললেন, রান্নাঘরে এত বইপত্র দেখে আপনি কি অবাক হচ্ছেন? জি না। আমি কোনোকিছুতেই অবাক হই না। আসলে কী হয় জানেন? হয়তো চা খাবার ইচ্ছা হলো। চুলায় কেতলি বসালাম। পানি ফুটতে অনেক সময় লাগছে। চুপচাপ অপেক্ষা করতে খুব খারাপ লাগে। তখন বই পড়া শুরু করি। চুলায় কেতলি বসিয়ে আমি একুশ পৃষ্ঠা পড়তে পড়তে পানি ফুটে যায়। এই থেকে আপনি আমার বই বড়ার স্পিড সম্পর্কে একটা ধারণা পাবেন। আমরা কফির পেয়ালা হাতে নিয়ে বসার ঘরে এসে বসলাম। মিসির আলি বললেন, আপনার গলায় কি মাছের কাঁটা ফুটেছে? লক্ষ্য করলাম অকারণে ঢোক গিলছেন। আমি বললাম, জি। শুধু শুধু কষ্ট করছেন কেন? কাঁটা তোলার ব্যবস্থা করেন–মেডিক্যাল কলেজের ইমার্জেন্সিতে গেলেই ওরা চিমটা দিয়ে কাঁটা তুলে ফেলবে। আমি কাঁটার যন্ত্রণা সহ্য করার চেষ্টা করছি। মানুষ তো ক্যানসারের মতো ব্যাধিও শরীরে নিয়ে বাস করে, আমি কাঁটা নিয়ে পারব না? মিসির আলি হাসলেন। ছেলেমানুষি যুক্তি শুনে বয়স্করা যে-ভঙ্গিতে হাসে সেই ভঙ্গির হাসি। দেখতে ভালো লাগে। হিমু সাহেব! জি স্যার? আমি আপনার ভয় পাবার ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছি। রহস্যের সমাধান হয়েছে? ভয়ের কার্যকারণ সম্পর্কে একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছি। এইটিই সঠিক ব্যাখ্যা কি না তা প্ৰমাণসাপেক্ষ। ব্যাখ্যা শুনতে চান? বলুন। মিসির আলি কফির কাপ নামিয়ে সিগারেট ধরালেন। সামান্য হাসলেন। সেই হাসি অতি দ্রুত মুছেও ফেললেন। কথা বলতে শুরু করলেন শান্ত গলায়। যেন তিনি নিজের সঙ্গেই কথা বলছেন, অন্য কারোর সঙ্গে নয়। যেন তিনি যুক্তি দিয়ে নিজেকেই বোঝানোর চেষ্টা করছেন– হিমু সাহেব, আমার ধারণা যে–ভয়ের কথা। আপনি বলছেন–এই ভয় অতি শৈশবেই আপনার ভেতর বাসা বেঁধেছে। কেউ-একজন হয়তো এই ভয়ের বীজ। আপনার ভেতর পুতে রেখেছিল যাতে পরবর্তী কোনো একসময় বীজের অন্ধুরোদগম হয়। তীব্র ভয় আপনাকে আচ্ছন্ন করে। অতি শৈশবের তীব্র ভয় অনেক অনেককাল পরে ফিরে আসে। এটা একটা রিকারিং ফনোমেনা। মনে করুন। তিন বছরের কোনো শিশু পানিতে ডুবে মৃত্যুর কাছাকাছি চলে গেল তাকে শেষমূহুর্তে পানি থেকে উদ্ধার করা হলো। সে বেঁচে গেল। পানিতে ডোবার ভয়ংকর স্মৃতি তার থাকবে না। সে স্বাভাবিকভাবে বড় হবে। কিন্তু ভয়ের এই অংশটি কিন্তু তার মাথা থেকে যাবে না। মস্তিস্কের স্মৃতি-লাইব্রেরিতে সেই স্মৃতি জমা থাকবে। কোনো কারণে যদি হঠাৎ
false
shottojit_roy
পারলাম। এখানে কর্ডোবা এসেছিল, কারণ মাটিতে পড়ে আছে একটা আধখাওয়া কালো রঙের সিগারেট, যেমন সিগারেট একমাত্র কর্ডোবাকেই খেতে দেখেছি। কিন্তু এ ছাড়া মানুষের আর কোনও চিহ্ন চোখে পড়ল না। পাথরের উপর যখন পায়ের ছাপা পড়ে না, তখন আর কী চিহ্নই বা থাকবে? সেই বিরাট হলঘরের ভিতর এসে, এবারে আর না থেমে সোজা বিপরীত দিকের সুড়ঙ্গ ধরে চলতে লাগলাম। সুড়ঙ্গ হলেও, এখানে রাস্তা বেশ চওড়া, মাথা হেঁট করে হাঁটতে হয় না। একটা আওয়াজ কানে আসছে। একটা মৃদু গৰ্জনের মতো শব্দ। ডাম্‌বার্টনও শুনল সেটা। গর্জনের মধ্যে বাড়া কমার ব্যাপারও লক্ষ করলাম। আসল আওয়াজটা কত জোরে, বা সেটা কতদূর থেকে আসছে, তা বোঝার কোনও উপায় নেই। ডাম্‌বার্টন বলল, গুহার ভিতর জানোয়ার টানোয়ার নেই তো? সত্যিই আওয়াজটা ভারী অদ্ভুত—একবার উঠছে, একবার পড়ছে—অনেকটা গোঙানির মতো। সামনে সুড়ঙ্গটা ডানদিকে বেঁকে গেছে। মোড়টা পেরোতেই দেখলাম আরেকটা বড় ঘরে এসে পড়েছি। টর্চের আলো এদিক ওদিক ফেলে বুঝলাম এ এক বিচিত্র ঘর, চারিদিকে অদ্ভুত অজানা যন্ত্রপাতি দিয়ে ঠাসা, আর দেওয়ালে ছবির বদলে কেবল অঙ্ক আর জ্যামিতিক নকশা আঁকা। যন্ত্রপাতিগুলোর কোনওটাই কাচ বা লোহা বা ইস্পাত বা আমাদের চেনা কোনও ধাতু দিয়ে তৈরি নয়। এছাড়া রয়েছে সরু সরু লম্বা লম্বা তারের মতো জিনিস, যেগুলো দেওয়ালের গা বেয়ে উঠে এদিক ওদিক গেছে। সেগুলোও যে কীসের তৈরি সেটাও দেখে বোঝা গেল না। মেঝেতে কিছু আছে কি না দেখবার জন্য টর্চের আলোটা নীচের দিকে নামাতেই একটা দৃশ্য দেখে আমার রক্ত জল হয়ে গেল। দেওয়ালের কাছেই, তাঁর ডান হাত দিয়ে একটা তার আঁকড়ে ধরে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন প্রোফেসর কাডোবা। কর্ডোবার পিঠে মাথা রেখে চিত হয়ে মুখ হাঁ করে পড়ে আছে তাঁর জিপের ড্রাইভার, আর ড্রাইভারের পায়ের কাছে ডান হাতে একটি বন্দুক আকড়ে ধরে পড়ে আছে আরেকটি অচেনা লোক। তিনজনের কারুরই দেহে যে প্ৰাণ নেই। সে কথা আর বলে দিতে হয় না! আমার মুখ দিয়ে আপনা থেকেই বেরিয়ে এল—ইলেকট্রিক শক। তারপর বললাম, ওদের ছুয়ো না, ডাম্‌বার্টন। ডাম্‌বার্টন চাপা গলায় বলল, সেটা বলাই বাহুল্য, তবে তাও ধন্যবাদ। আর ধন্যবাদ কর্ডোবাকে, কারণ ওরা দশা না দেখলে আমরাও হয়তো ওই তারে হাত দিয়ে ফেলতে পারতাম। কর্ডোবাকে বাঁচাতে গিয়েই অন্য দুজনেও পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হয়েছে। কী সাংঘাতিক ব্যাপার বলো তো। আমি বললাম, এ থেকে একটা জিনিস প্রমাণ হচ্ছে-ফরমুলাগুলো কর্ডোবার লেখা নয়। সেই মৃদু গর্জনটা এখন আর মৃদু নয়। সেটা আসছে আমাদের বেশ কাছ থেকেই। আমি টর্চ হাতে এগিয়ে গেলাম, আমার পিছনে ডাম্‌বার্টন। গর্জনটা বেড়ে চলেছে। যন্ত্রপাতি ইত্যাদি বাঁচিয়ে অতি সাবধানে মিনিটখানেক হাঁটার পর সামনে আরেকটা দরজা দেখতে পেলাম। এবং বুঝলাম যে সে দরজার পিছনে আরেকটি ঘর, এবং সে ঘরে একটি আলো রয়েছে। ডাম্‌বার্টনকে বললাম, তোমার টর্চটা নেভাও তো। দুজনের আলো নেভাতেই একটা মৃদু লাল কম্পমান আলোয় গুহার ভিতরটা ভরে গেল। বুঝলাম ঘরটায় আগুন জ্বলছে, এবং গর্জনটাও ওই ঘর থেকেই আসছে। ডামবার্টনের গলা পেলাম– তোমার বন্দুকটা তৈরি রাখে। বন্দকুটা বাগিয়ে ধরে অতি সন্তৰ্পণে আমরা দুজনে ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকলাম। প্রকাণ্ড ঘর। তার এক কোণে একটা চুল্লিতে আগুন জ্বলছে, তার সামনে কিছু জন্তুর হাড় পড়ে আছে। ঘরের মাঝখানে একটা পাথরের বেদি বা খাট, তাতে চিত হয়ে শুয়ে আছে একটি প্রাণী, ঘুমন্ত। গর্জনটা আসছে তার নাক থেকে। আমরা নিঃশব্দে এক পা এক পা করে খাটের দিকে এগিয়ে গেলাম। প্রাণীটিকে মানুষ বলতে বাধে। তার কপাল ঢালু, মাথার চুল নেমে এসেছে প্রায় ভুরু অবধি। তার ঠোঁট দুটো পুরু, থুতনি চাপা, কান দুটো চ্যাপটা আর ঘাড় নেই বললেই চলে। তার সবঙ্গে ছাই রঙের লোমে ঢাকা। আর মুখের যেখানে লোম নেই, সেখানের চামড়া অবিশ্বাস্য রকম কুঁচকোনো। তার বা হাতটা বুকের উপর আর অন্যটা খাটের উপর লম্বা করে রাখা। হাত এত লম্বা যে আঙুলের ডগা গিয়ে পৌঁছেছে। হাঁটু অবধি। ডাম্‌বার্টন অস্ফুটম্বরে বলল, কেভম্যান! এখনও বাঁদরের অবস্থা থেকে পুরোপুরি মানুষে পৌঁছোয়নি। গলার স্বর যথাসম্ভব নিচু করে আমি জবাব দিলাম, কেভম্যান শুধু চেহারাতেই, কারণ আমার বিশ্বাস গুহার মধ্যে যা কিছু দেখছি সবই এরই কীর্তি। ডাম্‌বার্টন হঠাৎ কাঁধে হাত দিয়ে বলল, শ্যাঙ্কস-ওটা কী লেখা আছে পড়তে পারছ? ডাম্‌বার্টন দেয়ালের একটা অংশে আঙুল দেখাল। বড় বড় অক্ষরে কী যেন লেখা রয়েছে। অক্ষরগুলো ফরমুলা থেকেই চিনে নিয়েছিলাম, সুতরাং লেখার মানে বার করতে সময় লাগল না। বললাম, আশ্চর্য! কী? লিখছে-আর সবাই মরে গেছে। আমি আছি। আমি থাকব। আমি একা। আমি অনেক জানি। আরও জানব। জানার শেষ নেই। পাথর আমার বন্ধু। পাথর শত্ৰু! ডাম্‌বার্টন বলল, তা হলে বুঝতে পারছি—এই সেই প্রাগৈতিহাসিক মানুষেরই একজন—কোনও আশ্চর্য উপায়ে অফুরন্ত আয়ু পেয়ে গেছে। হুঁ—আর হাজার হাজার বছর ধরে জ্ঞান সঞ্চয় করে চলেছে। কেবল চেহারাটা রয়ে গেছে সেই গুহাবাসী মানুষেরই মতন। …কিন্তু শেষের দুটো কথার কী মানে বুঝলে? পাথর যে এর বন্ধু সে তো দেখতেই পাচ্ছি। এর ঘরবাড়ি আসবাবপত্র যন্ত্রপাতি সবই পাথরের তৈরি। কিন্তু শত্রু বলতে কী বুঝছে জানি না। আমারই মতো ডাম্‌বার্টনও বিস্ময়ে প্রায় হতবাক হয়ে গিয়েছিল। বলল, গুহায় থাকে, তাই দিনরাত্রের তফাত সব সময়ে বুঝতে পারে না। হয়তো রাত্রে জেগে থাকে, তাই দিনে ঘুমোচ্ছে। ছবি তোলার সাহস হচ্ছিল না-যদি ক্যামেরার শব্দে ঘুম ভেঙে যায়! আমাদের মতো মানুষকে
false
humayun_ahmed
হয়ে বসে থাক। আমি কিন্তু স্পিড আরো বাড়াচ্ছি। রেডি। গেট সেট গো। এমন স্পিড দেব যে মোটর সাইকেল নিয়ে আকাশে উড়ে যাব। স্যারের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে মোটর সাইকেল সত্যি সত্যি আকাশে উঠে গেল। ওপর থেকে নিচের ঢাকা শহর দেখা যাচ্ছে। আমার সামান্য ভয় ভয় লাগছে। তবে ভয়ের চেয়ে আনন্দ হচ্ছে অনেক বেশি। ভয়ঙ্কর ভয়ের স্বপ্নে মানুষের ঘুম ভাঙে, আবার অস্বাভাবিক আনন্দের স্বপ্নেও মানুষের ঘুম ভাঙে। আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি বিছানায় উঠে বসতে বসতে ভাবলাম কেন এরকম স্বপ্ন দেখলাম? আমি কি একপলকের দেখাতেই একটা মানুষের প্রেমে পড়ে গেছি? প্রেম এত সস্তা? রাত দেড়টা বাজে। বেশির ভাগ মানুষের জন্যেই গভীর রাত— আমার জন্যে রজনীর শুরু। ডিজাইনের মূল কাজগুলো আমি এই সময় শুরু করি। আগামীকাল ডুপলেক্স বিল্ডিং-এর ফটোগ্রাফ দিয়ে করা একটা কোলাজ জমা দিতে হবে। বিল্ডিং-এর। ফটোগ্রাফ সাজানো হয়েছে। এদের মাঝখানে ফাক ভরার জন্যে রং দিতে হবে। রং তৈরির কাজটা রাত যত গভীর হয় তত ভালো হয়। দিন হলো কাজের সময়, প্রয়োজনের কাজ যেমন–ব্যবসা বাণিজ্য, অফিস আদালত। রাত হলে অপ্রয়োজনের কাজের সময়। কবিতা লেখা হবে, ছবি আঁকা হবে। ঔপন্যাসিক চোখ বন্ধ করে তাঁর চরিত্রদের নিয়ে খেলা করবেন। সাধু সন্তরা বসবেন ধ্যানে। জীবনানন্দ দাশ নিশ্চয়ই চৈত্র মাসের দুপুরে গরমে ঘামতে ঘামতে লিখেন নি এখানে বনের কাছে ক্যাম্প আমি ফেলিয়াছি সারারাত দখিনা বাতাসে। আকাশের চাঁদের আলোয় এক ঘাই হরিণীর ডাক শুনি, কাহারে সে ডাকে। আমার ধারণা এই লাইনগুলো তিনি লিখেছেন মধ্যরাত পার করে। তখন চারদিকে সুনসান নীরবতা। বরিশালে তাঁর বাড়ির পাশের বাঁশঝাড়ের বাঁশ পাতা বাতাসে কাঁপছে। এবং তিনি কল্পনায় বনের ভেতর ঘাই হরিণীর ডাক স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন। আচ্ছা, ঘাই হরিণী ব্যাপারটা কী? চিত্রা হরিণ, শাম্বা হরিণ আছে। ঘাই হরিণ কোথেকে এসেছে। ঘাই কি নাম, নাকি বিশেষণ? কাওসার স্যার ক্লাসের ব্ল্যাকবোর্ড বড় বড় করে তাঁর টেলিফোন নাম্বার লিখে বলেছিলেন, ডিজাইন সংক্রান্ত কোনো জটিলতায় তোমরা যদি পড় তাহলে এই নাম্বারে যে-কোনো সময় আমাকে টেলিফোন করতে পারো। রাত দুটা, তিনটা, চারটা কোনো সমস্যা নেই। আমি এখন ডিজাইন সংক্রান্ত জটিলতাতেই পড়েছি। মাথার ভেতর থেকে ঘাই শব্দ দূর না করা পর্যন্ত কাজে মন দিতে পারছি না। কাজেই স্যারকে টেলিফোন করার অধিকার আমার আছে। আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললাম। অধিকার কাজে লাগানো ঠিক হবে না। সব অধিকার কাজে লাগাতে নেই। তারচে মন অন্যদিকে নেবার ব্যবস্থা করা যাক। আমি হাতে রিমোট কনট্রোল নিয়ে সিডি প্লেয়ার চালু করলাম। ঝড় বৃষ্টির একটা সিডি চালু হয়ে গেল। এই সিডিটা জন্মদিনে ফরিদা আমাকে দিয়েছে। গান বাজনা কিছু নেই শুধুই সাউন্ড এফেক্ট। বাতাসের শব্দ, বৃষ্টির শব্দ, মাঝে মাঝে বজ্ৰপাতও হচ্ছে। স্টুডিওতে তৈরি শব্দ না। মন্টানার এক বনের ভেতরে রেকর্ড করা ঝড়ের শব্দ। সিডির গায়ে সেরকমই লেখা। শুনতে ভালো লাগে। টেলিফোন বাজছে। আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। একটা চল্লিশ। এত রাতে টেলিফোন করার মতো আমার কেউ নেই। ট্র্যাংক কল হবার সম্ভাবনা। রিসিভার তুলতেই মার আবদারি গলা শুনা গেল— মৃ আজ আমি তোর সঙ্গে ঘুমাব। আমি বললাম, আচ্ছা। টেলিফোনের রিং পেয়ে কী ভেবেছিলি? কিছু ভাবি নি মা। পাশের কামরা থেকে আমি টেলিফোন করেছি এটা নিশ্চয়ই ভাবিস নি। না তা ভাবি নি। আমার ঘরে ঘুমুলে চাইলে চলে এসো। তবে আমাকে বিরক্ত করতে পারবে না। তুমি ঘুমাবে তোমার মতে, আমি বাতি জ্বালিয়ে কাজ করব। মৃ তোর ঘর থেকে ঝড়ের শব্দ আসছে কেন? ঝড়ের সিডি বাজছে এই জন্যে ঝড়ের শব্দ। ঝড়ের সিডি আবার কী? এসে শুনে যাও কী। এক্সপ্লেইন করতে পারব না। তুই এত বিরক্ত হচ্ছিস কেন? সবাই দেখি আমার কথা শুনলে বিরক্ত হয়। আমার বাবা-মার ফ্যামিলির সবাই হয়। তোর বাবা হয়। তুই হোস। ব্যাপার কী? টেলিফোনে এত কথা শুনতে ভালো লাগছে না মা। তুমি আসতে চাইলে চলে এসো। আমার তো টেলিফোনে কথাবার্তা চালাতে খুবই ভালো লাগছে। খুব যারা ঘনিষ্ঠ তাদের মাঝে মাঝে উচিত টেলিফোনে কথা বলা। টেলিফোনে গলার শব্দ বদলে যায় তো– পরিচিত জনকে তখন মনে হয় অপরিচিত। খুব পরিচিত জনের সঙ্গে যত কথা বলা যায় মোটামুটি পরিচিত জনের সঙ্গে তারচে বেশি কথা বলা যায়। হ্যালো তুই কি টেলিফোন রেখে দিয়েছিল? না। মা গলার আওয়াজ নামিয়ে ফিসফিস পর্যায়ে নিয়ে এসে বললেন, তোকে টেলিফোন করার সময় মজার একটা কাণ্ড হয়েছে। তোর বাবা হঠাৎ ঘরে ঢুকেছে। কিছুক্ষণ ভুরু টুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে চলে গেছে। এতে মজার কী হলো? ওমা মজার না! তোর বাবা ভাবছে— গভীর রাতে হাসিহাসি মুখে কার সঙ্গে কথা? রহস্যটা কী? তোর বাবার মনে একটা কিন্তু তৈরি হয়েছে। বাবার মনে এত সহজে কিন্তু তৈরি হয় না। বাবা এত রাত পর্যন্ত জেগে আছে কেন? কয়েক রাত ধরেই তো এই অবস্থা। ঘুমাচ্ছে না, জেগে থাকছে। একটু পরপর বিছানা থেকে উঠে পানি খায়। কিছুক্ষণ বই পড়ার চেষ্টা করে, কিছুক্ষণ লেখার টেবিলে বসে হিসাব নিকাশ করে। বাকি সময়টা বারান্দায় হাঁটাহাটি করে। কী ব্যাপার, তুমি কিছু জিজ্ঞেস করো নি? না। আমি কোনো প্রশ্ন করলেই তো তোর বাবা রেগে যায়। কী দরকার তাকে রাগিয়ে! মৃ তোর সিডি বন্ধ হয়ে গেছে, আবার দে। টেলিফোনে শুনছি তো আওয়াজটা রিয়েল মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে সত্যি সত্যিই ঝড়
false
shunil_gongopaddhay
বলল, না স্যার, আমি কতবার দেখেছি। রাজবাড়িতে কোনও অতিথি এলে তো আমাকেই দেখাতে আনতে হয়। কাকাবাবু বললেন, তা তো ঠিকই। আচ্ছা, তুমি গুরুপদ রায়কে চেনে? গৌরাঙ্গ বলল, কোন গুরুপদ? মুখপোড়া গুরুপদ? মোটর গ্যারাজে কাজ করে? কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ। গাড়িও চালায়। ওর মুখোনা ওইভাবে পুড়ল কী করে? গৌরাঙ্গ বলল, তা কে জানে! ও মাঝে মাঝে কোথায় যেন চলে যায়, দুমাস-তিন মাস ফেরে না। একবার ফিরল, ওইরকম কালো পোড়া-মুখ নিয়ে। কেউ জিজ্ঞেস করলে শুধু বলে অ্যাকসিডেন্ট। আর কিছু না। একবার ও এক জায়গায় ডাকাতির দায়ে ধরা পড়েছিল। হয়তো নিজে ডাকাতি করেনি, দলের লোকদের চিনত। সেবার তো আমাদের বাবুই ওকে বাঁচিয়ে দিলেন। তোমাদের কোন বাবু? কিরণচন্দ্র… আজ্ঞে না। তিনি তো এখানে প্রায় থাকেনই না। ছোটবাবু। উনি অনেক মানুষের উপকার করেন। আচ্ছা, তোমাদের এই ছোটবাবু কি যাত্রা-থিয়েটার করেন? গৌরাঙ্গ চমকে উঠে বলল, আপনি স্যার কী করে জানলেন? হঠাৎ কেন জিজ্ঞেস করলেন? কাকাবাবু বললেন, এমনিই। কেন যেন মনে হল। গৌরাঙ্গ বলল, হ্যাঁ, স্যার, এখানে মাঝে মাঝেই থিয়েটার হয়। ছোটবাবুকে ছাড়া চলেই না। রাজা-মহারাজার পার্টে ওঁকে খুব ভাল মানায়। কাকাবাবু বললেন, তা তো মানাবেই। এখন রাজত্ব নেই বটে, তবু তো রাজবংশের সন্তান। গল্প করতে করতে খানিকটা সময় কেটে গেল। তারপর ফিরে এল সন্তুরা। কমলিকা বলল, মাথার খুলিগুলো ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে ফেলেছে। দেখলে আর ভূত-ভূত মনে হয় না। সন্তু বলল, কপালে আবার চন্দনের ফোটা পরিয়ে দিয়েছে। জোজো বলল, আমি একজন পুরুতঠাকুরকে জিজ্ঞেস করলুম, আগে কি এই মন্দিরে হিউম্যান স্যাক্রিফাইস, মানে নরবলি হত? তিনি খুব জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললেন, না, না, না! আসলে নরবলি হত। কমলিকা বলল, তুমি কী করে জানলে? জোজো বলল, পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছি, একটা খুলি আমায় ফিসফিস করে বলল, আমাদের বলি দিয়েছে। মুন্ডু কেটে জলে ফেলে দিয়েছে! কমলিকা বলল, ওঃ, সন্তুটা কী গুল মারে! সন্তু বলল, সত্যি, সন্তুকে নিয়ে আর পারা যায় না। আমাকে নকল করতে চায়, কিন্তু জানে না কিছুই! প্ৰবীর বলল, চলুন, তা হলে পুকুরটার কাছে যাওয়া যাক। কাকাবাবু জিপ থেকে নেমে পড়লেন। মন্দিরগুলোর পিছন দিক দিয়ে খানিকটা হাঁটতে হল। পুকুরটা বেশ বড়। বাঁধানো ঘাট আছে, কিন্তু জল প্রায় নেই। মাঝখানে থিকথিকে কাদা। কিছু লোক আজ মাটি খোঁড়ার কাজ করছে। কমলিকা বলল, ওই যে দেখছেন এক জায়গায় একটা বাঁশ পোতা, ওইখানে সিন্দুকটা পাওয়া গেছে। সেই সিন্দুকের মধ্যে সাতটা মানুষের মুন্ডু! প্ৰবীর বলল, আবার তুই উলটোপালটা বকছিস? সিন্দুকটা তো খোলাই যায়নি। মুন্ডুগুলো ভিতরে থাকবে কী করে? কমলিকা বলল, সরি, সরি! কাকাবাবু ঘাটের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, সন্তু, দ্যাখ তো, এখানে একটা পাথরের ফলকে কী লেখা আছে? উপরে শ্যাওলা জমে গেছে। সন্তু একটা রুমাল ঘষে ঘষে শ্যাওলা খানিকটা তুলে ফেলল। পাশে দাঁড়িয়ে জোজো বলল, কী সব লেখা আছে হিন্দিতে। সন্তু বলল, হিন্দি না, সংস্কৃত। অনেক অনুস্বর বিসর্গ আছে। সব পড়া যাচ্ছে না। মাতৃ… উৎসর্গ। কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কোনও তারিখ লেখা আছে? সন্তু বলল, হ্যাঁ, সন বারোশো দশ। কাকাবাবু বললেন, তার মানে কেউ তার মায়ের নামে এই পুকুরটা উৎসর্গ করেছিল। আগেকার দিনে লোকে মনে করত, পুকুর কাটালে পুণ্য হয়। ঠিকই মনে করত। কত লোক ব্যবহার করতে পারত সেই পুকুর। এটা বেশ পুরনো। কমলিকা বলো তো, এটা বাংলা কত সন? কমলিকা জানে না। প্রবীর, জোজোও বলতে পারল না। সন্তু একটু চিন্তা করে বলল, চোদ্দোশো এগারো। কাকাবাবু বললেন, তার মানে পুকুরটার বয়স কত? কমলিকা বলল, নাইনটি নাইন। কাকাবাবু বললেন, তুমি দেখছি অঙ্কে খুব ভাল। চট করে বলে দিলে। সন্তু আর জোজো হাসছে দেখে কমলিকা বলল, ভুল হয়েছে, তাই না? আসলে তো আমি ভাল ছবি আঁকতে পারি, তাই অঙ্ক জানি না। জোজো বলল, আমি তো ইংরেজিতে ফার্স্ট হই, তাই আমি সাঁতার জানি না। সন্তু বলল, আমি তো শিঙাড়া খেতে ভালবাসি, তাই আমাকে মশা কামড়ায়। কমলিকা বলল, এই, আমার সঙ্গে ইয়ারকি হচ্ছে! এমন মজা দেখাব! প্ৰবীর বলল, তোমরা আমার বোনকে আর রাগিয়ো না, তা হলেই ভা করে কেঁদে ফেলবে! কমলিকা বলল, মোটেই আমি ভা করে কাঁদি না। আমি উউ করে কাদি। কাকাবাবু হাসছিলেন ওদের কথা শুনে। এবার বললেন, ওই পাশের বাড়িটা কী বলো তো? ওখানেও ভিড় দেখছি। প্রবীর বলল, ওটা একটা খুব পুরনো ভাঙা বাড়ি। কেউ থাকে না। আমার জন্ম থেকেই এরকম দেখছি। লোকে বলে ভূতের বাড়ি। কাকাবাবু বললেন, ওই লোকগুলো কি ভিড় করে ভূত দেখতে যাচ্ছে। নাকি? এই দিনেরবেলা! প্ৰবীর বলল, ওই বাড়িটায় একটা সুড়ঙ্গ আছে। ভিতরে গেলে গা ছমছম করে। বাচ্চা বয়সে আমরা ওর মধ্যে খেলতে যেতাম। তবে বেশি দূর যাওয়া যায় না। কাকাবাবু বললেন, আগেকার দিনে অনেক জমিদার বাড়িতে কিংবা রাজবাড়িতে এরকম সুড়ঙ্গ থাকত। শত্রুসৈন্য কিংবা ডাকাতের দল আক্রমণ করলে ওখানে লুকিয়ে থাকা যেত কিংবা পালিয়েও যাওয়া যেত অন্য দিক দিয়ে। কথা বলতে বলতে কাকাবাবু এগিয়ে গেলেন সেই বাড়িটার দিকে। সেখানে একজন লোক নোম বিক্রি করছে। অনেক লোক কিনছে একটা করে লাল রঙের মোম। যে-লোকটি বিক্রি করছে তার পিছনে একটা চৌকো টিনের সাইন বোর্ড। তাতে ইংরেজিতে লেখা, আব্দুল লতিফস ফেমাস ক্যান্ডেল শপ। ইচ রুপিজ ফাইভ। লোকটির চেহারা বেশ সুন্দর, সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা। কাকাবাবুদের দেখে
false
humayun_ahmed
যাবেন? এখন যাব। আমি কি স্যার আপনার সঙ্গে আসব? তুমি আসতে চাচ্ছ কেন? আপনাকে খুব অস্থির লাগছে। সে জন্যেই আসতে চাচ্ছি। না আমি অস্থির না। আমি ঠিক আছি। আমি মারলা লির সঙ্গে দেখা করব। তার কাছ থেকে আমি আরো কিছু গ্রন্থও আনতে চাই। তুমি আমার টুপি এনে দাও। আপনি কি আপনার স্ত্রীকে কিছু বলে যাবেন না? না। ওর সামনে পড়তে কেন জানি লজ্জাও লাগছে। আচ্ছা পাঠক, মেয়েরা কি উপহার পেলে সবচে খুশি হয় বলত? আমি ফেরার পথে ওর জন্যে কিছু উপহার আনতে চাই। | পাঠক মৃদু স্বরে বলল, ভালবাসার চেয়ে বড় উপহার আর কি হতে পারে, স্যার! ভালো বলেছ পাঠক। ভালো বলেছ। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার হচ্ছে ভালবাসা। আশ্চর্যের ব্যাপার কি জান—এই উপহার আমি একমাত্র আমার পালক পিতামাতার কাছ থেকেই পেয়েছি। যারা দুজনই মেন্টালিস্ট। স্যার, আপনি আমাদের ভালবাসাও পেয়েছেন। তবে আমরা যন্ত্র। আমাদের ভালবাসা মূল্যহীন। পাঠক, ভালবাসা মূল্যহীন নয়। আজ সম্ভব না, কিন্তু একদিন নিশ্চয়ই ভালবাসাকে অঙ্কে নিয়ে আসা যাবে। অঙ্কের মডেল তৈরি করা হবে। হয়তো আমিই তা করব… আমি কি আপনাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দেব স্যার? দাও এগিয়ে দাও। গাধা লীম দেখি এখনো গান গাইছে। ব্যাটার গলা এত। সুন্দর তাতো জানতাম না। তাকে বার বার গাধা বলা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না। মারলা লি বললেন, এই সামান্য বিষয় নিয়ে আপনার আসার প্রয়োজন ছিল না। বিয়ের লাইসেন্স এমন জরুরি কিছু নয়। ফিহা বললেন, আরেকটা জরুরি বিষয় আমার আলোচ্যসূচিতে আছে। আপনার কি সময় হবে? আমার সময়ের একটু টানাটানি যাচ্ছে। কিন্তু আপনার জন্যে সময় বের করা হবে। মেন্টালিস্টদের উপর লেখা আরো কিছু বই পড়তে চাচ্ছি। কেন? যে বইটি দিয়েছেন সেটি অস্পষ্ট। সব বইই অস্পষ্ট। বিজ্ঞানের বই এগুলি নয়। মেন্টালিস্টদের জীবনযাপন পদ্ধতি, এদের আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে যদি কোনো বই থাকে। শুনুন মহামতি ফিহা, আপনি যেভাবে কথা বলছেন তার থেকে মনে হতে পারে আমরা মানুষ নই। আমরা জন্তু বিশেষ। শুধু শুধুই আপনি রাগ করছেন। আমি মোটেই রাগ করছি না। আপনাকে মেন্টালিস্ট সম্পর্কে আর কোনো বই দেয়া যাবে না। আপনি সমাজবিজ্ঞানী নন। আপনি তাত্ত্বিক পদার্থবিদ। বাজে কাজে সময় নষ্ট করবেন কেন? সবার কাজ নির্দিষ্ট করা আছে। আপনি আপনার কাজ করবেন। ফিহা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, সবার সব কাজ তো আপনারা করিয়ে নিচ্ছেন। আমি জানতে চাচ্ছি আপনাদের কাজটা কি। আপনারা কি করেন? মাটির নিচে শহর বানিয়ে বাস করেন জানি। কিন্তু বেঁচে থাকা ছাড়া আর কি করেন? আমরা ভাবি। কি ভাবেন? পৃথিবীর মঙ্গল নিয়ে ভাবি। মানুষকে পরিচালনা করার সর্বোত্তম পন্থা নিয়ে ভাবি। ভবিষ্যত পৃথিবী কি করে সাজানো হবে তা নিয়ে ভাবি। ভবিষ্যত পৃথিবীতে আমাদের স্থান কোথায়? আমার জানা নেই। শুনুন মহামতি ফিহা, আজ আপনি বিয়ে করেছেন। একটি তরুণী মেয়ে ঘরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে—আজ কেন বাজে তর্ক করে সময় নষ্ট করছেন। তার কাছে যান। যাবার পথে ফুল কিনে নিয়ে যান। ফুলের দোকান এত রাতে নিশ্চয়ই বন্ধ হয়ে গেছে। আমি খোলাবার ব্যবস্থা। করছি। কোনো প্রয়োজন দেখছি না। আপনার প্রয়োজন নেই। কিন্তু মেয়েটির প্রয়োজন আছে। আপনারা মেন্টালিস্ট নন। আপনাদের একেকজনের চিন্তা-ভাবনা একে রকম। ফুল একজনের কাছে অর্থহীন, অন্যজনের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ফিহা উঠে দাঁড়ালেন। মারলা লি বললেন, আমি দুঃখিত যে আপনি খানিকটা হলেও মন খারাপ করে যাচ্ছেন। আপনার মন ভালো করার জন্য কিছু কি করতে পারি? আমি আমার পালক বাবা-মার সঙ্গে দেখা করতে চাই। তা-কি সম্ভব হবে? না। তা সম্ভব হবে না। তাঁরা যদি ভূগর্ভস্থ শহরে না থাকতেন তাহলে সম্ভব হত। ভূগর্ভস্থ শহর শুধু মেন্টালিস্টদের জন্যে। সাধারণ মানুষ সেখানে গেলে শহর কি অশুচি হয়ে যাবে? শুচি-অশুচির প্রশ্ন নয়। এটা হচ্ছে আইন। আইনের পেছনে যুক্তি থাকে। এই আইনের পেছনের যুক্তিটি কি? আমরা মানুষ হিসেবে আপনাদের থেকে অনেকখানিই আলাদা। সহাবস্থান আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় বলেই এই ব্যবস্থা। আপনারা আমাদের সম্পর্কে যত কম জানবেন ততই মঙ্গল। আপনারা আমাদের সম্পর্কে সবকিছুই জানবেন, আর আমরা কিছু জানব না? আপনাদের সম্পর্কে জানা আমাদের প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের সম্পর্কে আপনাদের জানা প্রয়োজন নয়। আলোচনা যথেষ্ট হয়েছে ফিহা। এখন বাড়ি যান। ফুলের দোকান কি খোলাবার ব্যবস্থা করব? ফিহা জবাব না দিয়ে বের হয়ে এলেন। রাস্তায় তেমন আলো নেই। ঝড়ে বিদ্যুত ব্যবস্থায় যে সমস্যা হয়েছিল সে সমস্যা এখনো কাটিয়ে ওঠা যায় নি। ফিহা হাঁটছেন অন্ধকারে। তীব্র হতাশাবোধ তাঁকে গ্রাস করতে শুরু করেছে। ফিরে এসেছে পুরোনো অস্থিরতা। স্যার। তিনি চমকে তাকালেন। অন্ধকারে রাস্তার পাশে বিশালদেহী একজন। যুবক। আপনি কে? স্যার আমি টহল পুলিশ। আপনি কোথায় যেতে চান বলুন, আমি আপনাকে পৌঁছে দেব। তাঁর কোনো প্রয়োজন নেই, আপনাকে ধন্যবাদ। আমি যদি আপনার পেছনে পেছনে আসি আপনার কি অসুবিধা হবে? হ্যাঁ হবে। আমি একা হাঁটতেই পছন্দ করি। ভালো কথা, এরিন নামের একজন টহল পুলিশের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। তাকে কি একটা খবর দিতে পারবেন? তাকে কি বলবেন যে আমি বিয়ে করেছি? এরিনকে খবর দেয়া যাবে না স্যার। কেন? ঝড়ের রাতে সে মারা গেছে। রাস্তায় ডিউটি ছিল। রাস্তা ছেড়ে কোথাও আশ্রয় নেবার অনুমতি ছিল না। কাজেই সে ঝড়ের সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। প্রাণ বাঁচানোর জন্যেও সে কোথাও যেতে পারে নি? না। আমরা মানসিকভাবে নিয়ন্ত্রিত। ও
false
MZI
নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করে কোথাও এক পা আগ্রসর হতাম না। ম্যাঙ্গেল ক্বাস নিয়ন্ত্রণ প্যানেলে তার দলের লোকজনের সাথে যোগাযোগ নিশ্চিত করতে করতে আমাকে বলল, তুমি স্কাউটশিপটা প্রস্তুত কর, আমরা কিছুক্ষণের মাঝেই রওনা দিতে চাই। স্কাউটশিপে যাবার আগে আমি মিত্তিকাকে ডেকে পাঠালাম, সে একধরনের ভয়ার্ত চোখে হাজির হলো, ফ্যাকাশে মুখে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে ইবান?। ম্যাঙ্গেল ক্বাস কিছুক্ষণের মাঝে এই উপগ্রহটাতে নামছে। মিত্তিকা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল, এই তথ্যটি তাকে জানানোর কারণটি সে বুঝতে পারছে না। আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, সে এই উপগ্রহটাতে একা যাবে না, তোমাকে আর আমাকে নিয়ে যাবে। কথাটি শুনে মিত্তিকা যেরকম ভয় পেয়ে যাবে বলে ভেবেছিলাম দেখা গেল সে সেরকম ভয় পেল না, বরং তার মাঝে বিচিত্র একধরনের কৌতূহলের জন্ম হলো। চোখ বড়-বড় করে বলল, এই উপগ্রহে সত্যি-সত্যি বুদ্ধিমান প্রাণী আছে? আমি ভুর কুঁচকে বললাম, আমি আশা করছি নেই। কেন? তুমি বুদ্ধিমান মহাজাগতিক প্রাণী পছন্দ কর না? সত্যি কথা যদি বলতে বল তাহলে বলব যে, না যে বুদ্ধিমান প্রাণীর সাথে আমার যোগাযোগ হয় নি তাকে আমি পছন্দ করি না। কেন? প্রথমত বুদ্ধিমান প্রাণী কৌতুহলী হয়। কাজেই তারা আমাদের নিয়ে কৌতুহলী হবে। কৌতুহলী হলে সমস্যা কিসের? মিত্তিকা ঠিক বুঝতে পারল না আমি কী নিয়ে কথা বলছি। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, যদি এরা মোটামুটি আমাদের মতো বুদ্ধিমান হয় তাহলে আমাদের কেটেকুটে দেখবে। আমাদের ধরে তাদের ল্যাবরেটরিতে নিয়ে রাখবে। যদি অনেক বেশি বুদ্ধিমান হয় তাহলে আমাদের মস্তিষ্কের নিউরণগুলি বিশ্লেষণ করবে, আমাদের নতুন করে তৈরি করবে। মিত্তিকাকে এবারে একটু আতংকিত হতে দেখা গেল। আমি সাহস দিয়ে বললাম, তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ম্যাঙ্গেল ক্বাসের দলবল যেহেতু এই উপগ্রহে বেঁচে আছে এখানে নিশ্চয়ই বুদ্ধিমান কোনো মহাজাগতিক প্রাণী নেই। যদি থেকেও থাকে তাহলে সেটা নিশ্চয়ই বন্ধুভাবাপন্ন– দেখতে কী রকম হবে বলে তোমার মনে হয়? অনেকগুলো চোখ, এঁড়ের মতো হাত-পা– আমি উচ্চস্বরে হেসে উঠে বললাম, তুমি নিশ্চয়ই বিনোদন চ্যানেলে নানা ধরনের ছায়াছবি দেখ। প্রকৃত বুদ্ধিমান প্রাণী হলে সেটি যে আমাদের মতো হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। হয়ত তারা এত ক্ষুদ্র যে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে। দেখতে হয়, কিংবা এত বড় যে পুরোটা নিয়েই তারা একটা গ্রহ! কিংবা তারা বাতাসের মতো দেখা যায় না কিংবা তরল সমুদ্রের মতো– মিত্তিকার এবারে খুব আশাভঙ্গ হলো বলে মনে হলো। আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, তোমার এত মন খারাপ করার কিছু নেই, হয়ত সত্যিই দেখবে ছোট ছোট পুতুলের মতো হাসিখুশি মহাজাগতিক প্রাণী, তোমাকে দেখে আনন্দে নাচানাচি করছে! স্কাউটশিপটি কিছুক্ষণের মাঝেই আমি প্রস্তুত করে নিলাম, মূল মহাকাশ্যানের মতো এর এত বড় ইঞ্জিন নেই কিন্তু কাজ চালানোর মতো দুটি শক্তিশালী প্লাজমা ইঞ্জিন রয়েছে। মূল মহাকাশযান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে বলে এর মাঝে কয়েকদিন থাকার মতো প্রয়োজনীয় অক্সিজেন, খাবার পানীয় বা জ্বালানি রয়েছে, শক্তিশালী যোগাযোগব্যবস্থা এমনকি ভয়ঙ্কর ধরনের অস্ত্রও রয়েছে। আমি স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের সামনে বসে সেটার ইঞ্জিন চালু করতে করতে ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে বললাম, তোমার কাছে আমি একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চাই। কী ব্যাপার? উপগ্রহটিতে নামার পর যদি তুমি আমাকে কিংবা মিত্তিকাকে তোমার সাথে নিতে চাও তাহলে আমাদের অস্ত্র নিতে দিতে হবে। ম্যাঙ্গেল ক্বাস কয়েক মুহূর্ত কিছু-একটা ভাবল তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে। স্কাউটশিপটি ফোবিয়ান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিছুক্ষণের মাঝেই প্রচণ্ড গর্জন করে উপগ্রহের দিকে ছুটে চলল। উপগ্রহটি বিশাল, নিজের একটা বায়ুমণ্ডলও রয়েছে। বায়ুমণ্ডলের ঘর্ষণে স্কাউটশিপটি উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে, তাপ নিরোধক আস্তরণ থাকার পরও আমরা সেটা অনুভব করতে শুরু করেছি। স্কাউটশিপের সংবেদনশীল মনিটর উপগ্রহের বায়ুমণ্ডল, তার তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, প্রাণের চিহ্ন বা বিদ্যুৎ চৌস্বকীয় তরঙ্গের অবশিষ্ট খুঁজতে থাকে। ম্যাঙ্গেল ক্বাসের দলবলের দুর্বল সংকেত ছাড়া এই উপগ্রহটিতে অবশ্যি অন্য কোনো ধরনের প্রাণের চিহ্ন পাওয়া গেল না। ধীরে ধীরে স্কাউটশিপটি আরো নিচে নেমে আসে, বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি, স্কাউটশিপের গতিবেগ অনেক কমিয়ে আনতে হলো, উপগ্রহটির ভেতরে একধরনের আবছা সবুজ আলো। বায়ুমণ্ডলে শক্তিশালী আয়নের২৭ আঘাতে এই আলো বের হয়ে আসছে। আমি স্কাউটশিপটিকে উপগ্রহের মাটির কাছাকাছি নামিয়ে এনে। নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুর কাছে এসে ঘুরপাক খেতে থাকি। ম্যঙ্গেল ক্বাস তার দলের লোকজনের সাথে যোগাযোগ করে কিছুক্ষণ নিচু গলায় কথা বলল, তারপর ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি স্কাউটশিপটাকে নিচে নামিয়ে নাও। আমি মনিটরে একটি সমতল জায়গা দেখে স্কাউটশিপকে নিচে নামিয়ে আনলাম। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মিত্তিকা ভয়-পাওয়া-গলায় বলল, কী সর্বনাশ! এটা তো দেখি নরকের মতো। ম্যাঙ্গেল ক্বাস একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার দলের সবচেয়ে চৌকস মানুষগুলো এই নরকে আটকা পড়ে আছে। এখানে কেমন করে আটকা পড়ল? মহাজাগতিক নিরাপত্তারক্ষীর সাথে সংঘর্ষ হয়ে মহাকাশযানটি বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। তারা নিশ্চয়ই খুব সৌভাগ্যবান যে মহাকাশযান বিধ্বস্ত হওয়ার পরও প্রাণে বেঁচে গিয়েছে। ম্যাঙ্গেল ক্বাস বলল, শুধু সৌভাগ্য নয়, এ ব্যাপারে তাদের নিজস্ব কিছু কৃতিত্ব রয়েছে। আমি বলেছি তারা চৌকস। নিরাপত্তারক্ষী বা সৈনিক কিংবা কলকারখানার চৌকস হলে সেটি আমি বুঝতে পারি কিন্তু একটা দস্যুদলকে যখন চৌকস বলা হয় তার অর্থ ঠিক কী আমি সেটা ঠিক বুঝতে পারি না কিন্তু সেটা নিয়ে আমি আর কোনো প্রশ্ন না করাই বুদ্ধিমান কাজ বলে মনে করলাম। আমি স্কাউটশিপের ভল্ট খুলে সেখান থেকে পোশাক বের
false
robindronath
পাপের প্রায়শ্চিত্ত এমন সর্বনেশে ঘটা করে কেন! এত লোককে নিমন্ত্রণ! আমার একলায় কুলোল না? এত মানুষকে দিয়ে তার ভার বহন করাবে! আহা, ঐ ছেলেমানুষকে কেন মারবে? তাকে ফিরে ডাকলুম, অমূল্য! আমার গলা এমন ক্ষীণ হবে বাজল সে শুনতে পেলে না। দরজার কাছে গিয়ে আবার ডাকলুম, অমূল্য! তখন সে চলে গেছে। বেহারা, বেহারা! কী রানীমা? অমূল্যবাবুকে ডেকে দে। কী জানি, বেহারা অমূল্যর নাম বোধ হয় জানে না, তাই সে একটু পরেই সন্দীপকে ডেকে নিয়ে এল। ঘরে ঢুকেই সন্দীপ বললে, যখন তাড়িয়ে দিলে তখনই জানতুম ফিরে ডাকবে। যে চাঁদের টানে ভাঁটা সেই চাঁদের টানেই জোয়ার। এমনি নিশ্চয় জানতুম তুমি ডাকবে যে, আমি দরজার কাছে অপেক্ষা করে বসেছিলুম। যেমনি তোমার বেহারাকে দেখেছি অমনি সে কিছু বলবার পূর্বেই তাড়াতাড়ি বলে উঠলুম, আচ্ছা, আচ্ছা, আমি যাচ্ছি, এখনই যাচ্ছি। ভোজপুরীটা আশ্চর্য হয়ে হাঁ করে রইল। ভাবলে লোকটা মন্ত্রসিদ্ধ। মক্ষীরানী, সংসারে সব চেয়ে বড়ো লড়াই এই মন্ত্রের লড়াই। সম্মোহনে সম্মোহনে কাটাকাটি। এর বাণ শব্দভেদী বাণ। আবার, নিঃশব্দভেদী বাণও আছে। এতদিন পরে এই লড়াইয়ে সন্দীপের সমকক্ষ মিলেছে। তোমার তূণে অনেক বাণ আছে রণরঙ্গিণী! পৃথিবীর মধ্যে দেখলুম, কেবল তুমিই সন্দীপকে আপন ইচ্ছামতে ফেরাতে পারলে, আবার আপন ইচ্ছামতে টেনে আনলে। শিকার তো এসে পড়ল। এখন একে নিয়ে কী করবে বলো। একেবারে নিঃশেষে মারবে, না তোমার খাঁচায় পুরে রাখবে? কিন্তু আগে থাকতে বলে রাখছি, রানী, এই জীবটিকে বধ করাও যেমন শক্ত, বন্ধ করাও তেমনি। অতএব দিব্য অস্ত্র তোমার হাতে যা আছে তার পরীক্ষা করতে বিলম্ব কোরো না। সন্দীপের মনের ভিতরে একটা পরাভবের সংশয় এসেছে বলেই সে আজ এমন অনর্গল বকে গেল। আমার বিশ্বাস, ও জানত আমি অমূল্যকেই ডেকেছি; বেহারা খুব সম্ভব তারই নাম বলেছিল; ও তাকে ফাঁকি দিয়ে নিজে এসে উপস্থিত হয়েছে। আমাকে বলতে দেবার সময় দিলে না যে, ওকে ডাকি নি, অমূল্যকে ডেকেছি। কিন্তু আস্ফালন মিথ্যে, এবার দুর্বলকে দেখতে পেয়েছি। এখন আমার জয়লব্ধ জায়গাটির সূচ্যগ্রভূমিও ছাড়তে পারব না। আমি বললুম, সন্দীপবাবু, আপনি গল্‌গল্‌ করে এত কথা বলে যান কেমন করে? আগে থাকতে বুঝি তৈরি হয়ে আসেন? এক মূহূর্তে সন্দীপের মুখ রাগে লাল হয়ে উঠল। আমি বললুম, শুনেছি কথকদের খাতায় নানা রকমের লম্বা লম্বা বর্ণনা লেখা থাকে, যখন যেটা যেখানে দরকার খাটিয়ে দেয়। আপনার সেরকম খাতা আছে নাকি? সন্দীপ চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগল, বিধাতার প্রসাদে তোমাদের তো হাবভাব-ছলাকলার অন্ত নেই, তার উপরেও দর্জির দোকান স্যাকরার দোকান তোমাদের সহায়, আর বিধাতা কি আমাদেরই এমনি নিরস্ত্র করে রেখেছেন যে — আমি বললুম, সন্দীপবাবু, খাতা দেখে আসুন; এ কথাগুলো ঠিক হচ্ছে না। দেখছি এক-একবার আপনি উল্টোপাল্টা বলে বসেন; খাতা-মুখস্থর ঐ একটা মস্ত দোষ। সন্দীপ আর থাকতে পারলে না; একেবারে গর্জে উঠল, তুমি! তুমি আমাকে অপমান করবে! তোমার কী না আমার কাছে ধরা পড়েছে বলো তো! তোমার যে– ওর মুখ দিয়ে আর কথা বেরোল না। সন্দীপ যে মন্ত্রব্যবসায়ী, মন্ত্র যে-মুহূর্তে খাটে না সে-মুহূর্তেই ওর আর জোর নেই। রাজা থেকে একেবারে রাখাল হয়ে যায়। দুর্বল! দুর্বল! ও যতই রূঢ় হয়ে উঠে কর্কশ কথা বলতে লাগল ততই আনন্দে আমার বুক ভরে উঠল। আমাকে বাঁধবার নাগপাশ ওর ফুরিয়ে গেছে, আমি মুক্তি পেয়েছি। বাঁচা গেছে, বাঁচা গেছে! অপমান করো, আমাকে আপমান করো, এইটেই তোমার সত্য। আমাকে স্তব কোরো না, সেইটেই মিথ্যা। এমন সময় আমার স্বামী ঘরের মধ্যে এলেন। অন্য দিন সন্দীপ মুহূর্তেই আপনাকে যে-রকম সামলে নেয় আজ তার সে শক্তি ছিল না। আমার স্বামী তার মুখের দিকে চেয়ে একটু আশ্চর্য হলেন। আগে হলে আমি এতে লজ্জা পেতুম। কিন্তু স্বামী যাই মনে করুন-না আমি আজ খুশি হলুম। আমি ঐ দুর্বলকে দেখে নিতে চাই। আমরা দুজনেই স্তব্ধ হয়ে রইলুম দেখে আমার স্বামী একটু ইতস্তত করে চৌকিতে বসলেন; বললেন, সন্দীপ, আমি তোমাকেই খুঁজছিলুম, শুনলুম এই ঘরেই আছ। সন্দীপ কথাটার উপর একটু বিশেষ ঝোঁক দিয়ে বললে, হাঁ মক্ষীরানী সকালেই আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আমি যে মউচাকের দাসমক্ষিকা, কাজেই হুকুম শুনেই সব কাজ ফেলে চলে আসতে হল। স্বামী বললেন, কাল কলকাতায় যাচ্ছি, তোমাকে যেতে হবে। সন্দীপ বললে, কেন বলো দেখি। আমি কি তোমার অনুচর নাকি? আচ্ছা, তুমিই কলকাতায় চলো, আমিই তোমার অনুচর হব। কলকাতায় আমার কাজ নেই। সেইজন্যেই তো কলকাতায় যাওয়া তোমার দরকার। এখানে তোমার বড্ড বেশি কাজ। আমি তো নড়ছি নে। তা হলে তোমাকে নাড়াতে হবে। জোর? হাঁ, জোর। আচ্ছা বেশ, নড়ব। কিন্তু জগৎটা তো কলকাতা আর তোমার এলেকা এই দুই ভাগে বিভক্ত নয়। ম্যাপে আরো জায়গা আছে। তোমার গতিক দেখে মনে হয়েছিল, জগতে আমার এলেকা ছাড়া আর-কোনো জায়গাই নেই। সন্দীপ তখন দাঁড়িয়ে উঠে বললে, মানুষের এমন অবস্থা আসে যখন সমস্ত জগৎ এতটুকু জায়গায় এসে ঠেকে। তোমার এই বৈঠকখানাটির মধ্যে আমার বিশ্বকে আমি প্রত্যক্ষ করে দেখেছি, সেইজন্যেই এখান থেকে নড়ি নে। মক্ষীরানী, আমার কথা এরা কেউ বুঝতে পারবে না, হয়তো তুমিও বুঝবে না। আমি তোমাকে বন্দনা করি। আমি তোমারই বন্দনা করতে চললুম। তোমাকে দেখার পর থেকে আমার মন্ত্র বদল হয়ে গেছে। বন্দে মাতরং নয় — বন্দে প্রিয়াং, বন্দে মোহিনীং। মা আমাদের রক্ষা করেন, প্রিয়া আমাদের বিনাশ করেন– বড়ো সুন্দর সেই বিনাশ। সেই মরণনৃত্যের নূপুর-ঝংকার
false
manik_bandhopaddhay
না কাল সে কোমরে চোট খাইয়া শয্যাগত ছিল। শশীর মনে বর্ষার মতো বিষন্নতা ঘনাইয়া আসে। কুসুম শেষে এমন দুর্বোধ্য হইয়া উঠিল! সে কত আশা করিয়াছিল কুসুম ধীর শাস্তভাবে তার সমস্ত কথা শুনিবে, সমস্ত বুঝিতে পারবে। কোথাও একটুকু না-বোঝার কিছু না-থাকায় তাদের দুজনের করো মনে দুঃখ থাকিবে না, অভিমান থাকিবে না, লজ্জাও থাকিবে না। বোঝাপড়া শেষ হইবে গভীর অন্তরঙ্গতায়,–নিবিড় সহানুভূতিতে। তার বদলে এ কী হইল? ভাবিয়া ভাবিয়া শশীর মনে হইল, গ্রাম্য মন কুসুমের, কিছু তার বুঝিবার ক্ষমতা নাই। পরদিন পরাণের কাছে সে খবর পাইল, কুসুমের হাত আর কোমরের ব্যথা কমিয়াছে, কাল সে বাপের বাড়ি যাইবে। কদিন থাকবে বাপের বাড়ি? বলছে তো পুজো পেরিয়ে আসবে। কদিন থাকে এখন। তোমার কষ্ট হবে পরাণ।–শশী বলিল। পরাণ গম্ভীরমুখে বলিল, কিসের কষ্ট, দুবেলা ভাত দুটো মা-ই ফুটিয়ে দিতে পারবে। ভেবেচিন্তে আমিই একরকম পাঠাচ্ছি ছোটোবাবু। বাপের বাড়ি যেতে না পেলে মেয়েমানুষের মাথা বিগড়ে যায়। রাত্রে কিছু ঠিক ছিল না, ভোর রাত্রে গোবর্ধন এবং আরও দুজন মাঝিকে তুলিয়া শশী বাজিতপুরে যাইবে বলিয়া বাহির হইয়া পড়িল। একা বাজিতপুর যাইতে বড় নৌকা সে ব্যবহার করে না, ছোট নৌকোয় গোবর্ধন একাই তাহাকে লইয়া যায়। আজ তাহার বড়ো নৌকাটির প্রয়োজন হইল কেন কেহ বুঝিতে পারিল না। বিছানা পাতিয়া, জলের কুঁজো, বাড়ির তৈরি খাবার ভরা টিফিন ক্যারিয়ার, এক ডালা পাকা আম, চায়ের সরঞ্জাম, ওষুধের ব্যাগ প্রভৃতি নৌকায় তুলিয়া গোবর্ধন সব ঠিক করিয়া ফেলিল। শশী কিন্তু নৌকা খুলিল না। তীরে দাঁড়াইয়া টানিতে লাগিল সিগারেট। রোদ উঠিবার পর কুসুমের ভুলি আসিল ঘাটে। সঙ্গে অনন্ত আর পরাণ। শশীকে দেখিয়া পরাণ বলিল, ছোটোবাবু যে এখানে? শশী বলিল, বাজিতপুর যাব পরাণ। তোমাদের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম। তোমাদের ও ছোট নৌকায় এদের দিয়ে কাজ নেই, বাজিতপুর পর্যন্ত আমার নৌকায় চলো। সেখানে ভালো দেখে একটা নৌকা ঠিক করে দেব। তাই হোক। কারো আপত্তি নাই। পরাণকে ধরিয়া কুসুম শশীর নৌকায় উঠিল। তার তোরঙ্গ, বোঁচকা ও অন্য সব জিনিস তোলা হইলে শশী বলিল, তুমি ছইয়ের মধ্যে বিছানায় বসবে যাও বউ। সামনের দিকে এগিয়ে বসো, তাহলে চাদ্দিক দেখে যেতে পারবে। নৌকার দোলনে দুলিয়া চুলিয়া কুসুমের বাবার ঘুম আসে। কুসুম ছইয়ের মধ্যে পিছনে হালের দিকে তাহার শোবার ব্যবস্থা করিয়া দিল। সে ঘুমাইয়া পড়িলে শশীকে ডাকিয়া বলিল, হঠাৎ আমাকে বাপের বাড়ি পৌঁছে দেবার শখ হল কেন শুনি? বলিয়া মৃদু হাসিল কুসুম। শশী বলিল, তুমি ভাবছ কাজ নেই, না? তোমার জন্য যাচ্ছি শুধু? উকিলের সঙ্গে দেখা করব। মামলা আছে বুঝি? মামলা তো দুটো-একটা লেগেই আছে, সেজন্য নয়। কী কারণে যেতে লিখেছেন, জরুরি। তবে আজ না-গেলেও চলত। কুসুম একটু হাসিল। আড়চোখে একবার বাপের দিকে চাহিয়া কুসুম বলিল, আমার জন্য এলেন আজ, না? শশী বলিল, হ্যা। গভীর সুখে কুসুমের মুখখানা উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। তবু নিশ্বাস ফেলিয়া দুঃখের সঙ্গেই বলিল, ভেবেছিলাম বাপের বাড়ি গিয়ে কমাস থাকব, তা আর হবে না বুঝতে পারছি। আশ্চর্য চরিত্র কুসুমের! এতক্ষণে শশী একটু লজ্জা বোধ করিলা সেদিন রহস্য সৃষ্টি করে নাই কুসুম। ওরকম বাঁকা তার মনের কথা বলিবার ধরন। সে কিছু বুঝিবে না, কিছু মানিবে না। কেন ভাবিয়া মরে শশী? সেদিন কুসুমের ব্যবহারের মানে ছিল শুধু এই। আর এক বিষয়ে শশী বিস্মিত হয়! সেদিন সে গ্রাম ছাড়িয়া চলিয়া যাইবার কথা বলিয়াছিল। সে সম্বন্ধে কুসুমের কি বলিবার কিছু নাই? কথাটা সে বিশ্বাস করে নাই নাকি? বাজিতপুরের ঘাটে নৌকা বাঁধিয়া শশী নামিয়া গেল। গোবর্ধনকে বলিয়া দিল, কুসুমকে বাপের বাড়ি পৌঁছাইয়া দিয়া বিকালে যেন নৌকা আনিয়া ঘাটে রাখে। বাজিতপুরের সিনিয়র উকিল রামতারণবাবুর কাছে মকদ্দমা উপলক্ষে শশীকে মাঝে মাঝে আসিতে হয়, এবারেও দেখা করিবার জন্য দিনতিনেক আগে তার একখানা চিঠি পাইয়া শশীর কোনো অসাধারণ প্রত্যাশা জাগে নাই। ব্যাপার শুনিয়া খানিকক্ষণ তাই সে বিস্ময়ে হতবাক হইয়া রহিল। দশটা গ্রামকে বিচলিত ও উত্তেজিত করিয়া যাদব মরিয়াছেন, কিন্তু আরও যে চমক তিনি সঞ্চিত করিয়া রাখিয়া গিয়াছেন সকলের জন্য, শশী তো তাহা ভাবিতেও পারে নাই। গ্রামে একটি হাসপাতাল করার জন্য যা-কিছু ছিল যাদবের, সব তিনি দান করিয়া গিয়াছেন। ব্যবস্থার ভার শশীর, দায়িত্ব শশীর। কী ছিল যাদবের? হাসপাতাল করার উপযুক্ত দান হিসাবে অত্যধিক কিছু নয়, যাদবের দান হিসাবে বিস্ময়কর, প্রচুর। হাজার পনেরো টাকার কোম্পানির কাগজ, বারো-তেরো হাজার নগদ, আর যেখানে যাদব বাস করিতেন সেই বাড়ি ও জমি। এত টাকা ছিল যাদবের? পুরানো ভাঙা বাড়িটার সাতস্যাতে ঘরে যাদব ও পাগলদিদির সাদাসিধে ঘরকন্নার ছবি শশীর মনে পড়িতে লাগিল, ক-খানা বাসন, মাটির হাড়িকলসি, কাঠের জীর্ণ সিন্দুক-গৃহসজ্জার অভাবজনিত দীনতা। তাও অপূর্ব ছিল সত্য,– সে ঘরের পরিচ্ছন্নতা, ধূপগন্ধী শান্ত আবহাওয়া চিরদিন শশীকে অভিভূত করিয়াছে, কিন্তু টাকার ছাপ তো কোথাও ছিল না সেই গৃহী সন্ন্যাসীর গৃহে! রামতারণের বয়স হইয়াছে। আদালতে যাওয়া তিনি অনেক কমাইয়া ফেলিয়াছেন। ভোর চারটেয় উঠিয়া আহ্নিক করিতে বসেন,–মানুষটা ধাৰ্মিক। বলিলেন, স্বেচ্ছায় দেহত্যাগ করবেন এরকম একটা খবর কানে এসেছিল, গুজব বলে বিশ্বাস করিনি। নইলে একবার দেখতে যেতাম। এখন আপসোস হয়। কতবার পায়ের ধূলো দিয়েছেন, এর বড়ো মহাপুরুষ ছিলেন জানলে পরকালের কিছু কাজ করে নিতাম। এসেছেন গিয়েছেন, টেরও পাইনি কী জিনিস ছিল তার মধ্যে। শশী বলিল, অনেকে সিদ্ধপুরুষ বলত। তাই ছিলেন। এমন আত্মগোপন করে থাকতেন, বুঝবার কোনো উপায় ছিল
false
shordindu
তারপর ধীরে ধীরে তাহার চোখে শঙ্কা ও সতর্কতা ফুটিয়া উঠিল। সে সোজা হইয়া বসিয়া একটু বিহুলভাবে বলিল‌, ‘কী—কী—?’ ব্যোমকেশ প্রফুল্ল স্বরে বলিল, ‘আপনার শোবার ঘরে একটা ছোট লোহার সিন্দুক রয়েছে দেখলাম। ওতে কী আছে?’ শাস্তা বলিল‌, ‘দারোগাবাবুকে তো বলেছি‌, কি আছে আমি জানি না। আমার স্বামী সিন্দুকের চাবি নিজের কাছে রাখতেন।’ বিজয়বাবু বলিলেন‌, ‘সিন্দুকের তালা ভাঙবার ব্যবস্থা করেছি।’ ‘বেশ বেশ‌, ওতে অনেক মাল পাবেন; চোরাই মাল‌, দুপুরে ডাকাতির গয়নাপত্র।’–ব্যোমকেশ শান্তার দিকে ফিরিল‌, ‘আচ্ছা‌, বলুন দেখি‌, আপনার স্বামী কি দাড়ি কামাতেন না? বাড়িতে দাড়ি কামানোর সরঞ্জাম নেই।’ শান্তার মুখ ফ্যাকাসে হইয়া গিয়াছিল‌, সে অস্পষ্ট স্বরে বলিল‌, ‘তিনি সেলুনে দাড়ি কামাতেন।’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ও। আপনার স্বামী দেখছি অসামান্য লোক ছিলেন। তিনি সেলুনে দাড়ি কামাতেন‌, কিন্তু বাড়িতে চটি জুতো পরতেন না। কোনো কারণ ছিল কি?’ শান্তা চক্ষু নত করিয়া বলিল‌, ‘ওঁর চটি ছিঁড়ে গিয়েছিল‌, নতুন চটি কেনা হয়নি। যখন বাড়িতে থাকতেন। আমার চটি পরতেন।’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তাই নাকি। আপনাদের দু’জনের পায়ের মাপ তাহলে সমান?’ শান্তা বলিল‌, ‘প্ৰায় সমান।’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বাঃ! কত সুবিধে! আপনাদের স্বামী-স্ত্রীর দেখছি প্ৰায় সবই সমান‌, কেবল চুলের রঙ আলাদা। চিন্তামণিবাবু জানিয়েছিলেন তপনের চুলের রঙ তামাটে। ঠিক তো?’ শান্তা ঢোক গিলিয়া বলিল‌, ‘হ্যাঁ।’ বিজয়বাবু এতক্ষণ চোখ বাহির করিয়া প্রশ্নোত্তর শুনিতেছিলেন‌, হঠাৎ উঠিয়া দাঁড়াইয়া তীব্র উত্তেজনার কণ্ঠে বলিলেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু–!’ ব্যোমকেশ হাত তুলিয়া বলিল‌, ‘দাঁড়ান। তৈরি থাকুন‌, এবার আমার শেষ প্রশ্ন।–শান্তা দেবি‌, চিন্তামণিবাবু দেখেছিলেন। আপনার গালে মসুরের মত লাল তিল আছে‌, সে তিলটা গেল কোথায়?’ শান্তা চকিতে নিজের বা গালে হাত দিল‌, তারপর সামলাইয়া লইয়া বলিল‌, ‘তিল! আমার গালে তো তিল নেই‌, চিন্তামণিবাবু ভুল দেখেছেন। হয়তো লাল কালির ছিটে লেগেছিল–’ ব্যোমকেশের মুখে হিংস্ব হাসি ফুটিয়া উঠিল‌, সে বলিল‌, ‘সব প্রশ্নেরই জবাব তৈরি করে রেখেছেন দেখছি। কিন্তু এ প্রশ্নের কি জবাব দেবেন।’ ক্ষিপ্রহস্তে সে শান্তার চুল ধরিয়া টান দিল, সঙ্গে সঙ্গে পরচুলা খসিয়া আসিল‌, ভিতর হইতে থাকেইটা তামাটে রঙের চুল বাহির হইয়া আসিল। শান্তাও বিদ্যুৎবেগে জবাব দিল। একটু অবনত হইয়া সে নিজের ডান পা হইতে শাড়ির প্রান্ত তুলিল। পায়ের সঙ্গে রবারের গীটার দিয়া আটকানো ছিল একটা লিকলিকে ছুরি। ক্ষিপ্রহস্তে ছুরি মুষ্টিতে লইয়া শান্তা ব্যোমকেশের কণ্ঠ লক্ষ্য করিয়া ছুরি চালাইল। আমি ভয়ার্তা সম্মোহিতভাবে শুধু চাহিয়া রহিলাম; একটি স্ত্রীলোকের সুশ্ৰী কোমল মুখ যে চক্ষের নিমেষে। এমন কুশ্রী ও কঠিন হইয়া উঠিতে পারে তাহা কল্পনা করা যায় না। দারোগা বিজয়বাবু যদি প্রস্তুত না থাকিতেন তাহা হইলে ব্যোমকেশের প্রাণ বাঁচিত কিনা সন্দেহ। তিনি বাঘের মত লাফাইয়া পড়িয়া শান্তার কজি ধরিয়া ফেলিলেন; ছুরি শান্তার মুষ্টি হইতে স্বলিত হইয়া মাটিতে পড়িল। সে বিষাক্ত চক্ষে ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া সৰ্প-তর্জনের মত নিশ্বাস ফেলিতে লাগিল। ব্যোমকেশ হাসিমুখে উঠিয়া দাঁড়াইল‌, ‘বিজয়বাবু্‌, এই নিন। আপনার খুনী আসামী‌, আর এই নিন খুনের অস্ত্র!’ বিজয়বাবু একটু দ্বিধাগ্রস্তভাবে বলিলেন‌, ‘কিন্তু চিন্তামণিবাবু বলেছিলেন তপন সেন–’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তপন সেনের অস্তিত্ব নেই‌, বিজয়বাবু। আছেন কেবল অদ্বিতীয় শান্তা সেন; ইনিই রাত্রে তপন সেন‌, দিনে শান্তা সে্ন-সাক্ষাৎ অর্ধনারীশ্বর মূর্তি। মহীয়সী মহিলা ইনি। ভাববেন না যে‌, বিধুভুষণ আইচকে খুন করাই এর একমাত্র কীর্তি। মাস দুই আগে ইনি বর্ধমান জেলের এক গার্ডকে খুন করে জেল থেকে পালিয়েছিলেন। এঁর আসল নাম আমার জানা নেই; আপনি পুলিসের লোক‌, ফেরারী কয়েদীর নাম জানতে পারেন।’ বিজয়বাবু শান্তার হাত বজ্রমুষ্টিতে ধরিয়া সুবর্তুল চোখে তাহার পানে চাহিয়া রহিলেন, চিবাইয়া চিবাইয়া বলিলেন‌, ‘প্রমীলা পাল। এবার সব বুঝেছি। স্বামীকে বিষ খাওয়ানোর জন্যে তোমার যাবজীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। দু’বছর জেল খাটবার পর তুমি জেলের গার্ডকে খুন করে পালিয়েছিলে। পালিয়ে এখানে এসে একাই স্বামী-স্ত্রী সেজে লুকিয়েছিলে। তারপর সে-রাত্রে বিধুভুষণ তোমাকে দেখতে পায়। বিধুভুষণ তোমাকে চিনতে পেরে তোমার পিছু নিয়েছিল। এইখানে বাড়ির সামনে এসে তুমি তাকে খুন করেছ।’ ব্যোমকেশের দিকে চক্ষু ফিরাইয়া বিজয়বাবু বলিলেন‌, ‘কেমন—এই তো?’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘মোট কথা এই বটে।’ বিজয়বাবু হুঙ্কার ছাড়িলেন, ‘জমাদার।’ জমাদার ঘরের বাহিরেই ছিল‌, প্রবেশ করিল। বিজয়বাবু বলিলেন‌, ‘হাতকড়া লাগাঁও।’ চিন্তামণিবাবুর ঘরে বসিয়া চা পান করিতে করিতে ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আপনার চিঠি পড়ে খটকা লেগেছিল‌, চিন্তামণিবাবু। আপনি ওদের দু’জনকে একসঙ্গে কখনো দেখেননি‌, দূরবীন লাগিয়েও ওদের ব্যূহ ভেদ করতে পারেননি। কেন? পুরুষটা বেঁটে‌, মেয়েটা লম্বা; হরে দরে হাঁটু জল। ওরা সদর দরজা দিয়ে যাতায়াত করে না‌, খিড়কি দিয়ে আসে যায়; পুরুষটা চেরা-চেরা গলায় কথা বলে। কেন? সন্দেহ হয় যে কোথাও লুকোচুরি চলছে। ‘কিন্তু বেশি ফলাও করে সব কথা বলবার দরকার নেই। স্থূলভাবে ব্যাপারটা এই—জেল ভেঙে পালাবার পর প্রমীলা পালের দুটো জিনিস দরকার হয়েছিল; ছদ্মবেশ আর রোজগার। তার মাথার চুল তামাটে রঙের‌, সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে; তাই তাকে চুল ছেঁটে পুরুষ সাজতে হল। কিন্তু দুপুরে ডাকাতি করে রোজগার করার জন্য তার মেয়েমানুষ সাজা দরকার‌, তাই সে একটি সুন্দর বিলিতি পরচুলো যোগাড় করল। কোথায় চুল ছেটেছিল‌, কোথা থেকে পরচুলো যোগাড় করল আমি জানি না; কিন্তু তার দ্বৈত-জীবন আরম্ভ হল। এখন শীতকাল চলছে‌, স্ত্রীলোকের পক্ষে পুরুষ সাজার খুব সুবিধা। সে নাকের নীচে একটি ছোট্ট প্রজাপতি-গোঁফ লাগালো‌, গায়ে কোট-প্যান্টের ওপর ওভারকেট চড়ালো‌, তারপর আপনার কাছে বাড়ি ভুগড়া নিতে এল; পাছে মেয়েলি গলা ধরা পড়ে। তাই আপনার সঙ্গে চেরা-চেরা গলায় কথা কইল। কলকাতা শহরে ছদ্মবেশে থাকার
false
shomresh
ছেলেদের সঙ্গে সাদামাটা কথা বলার দায়ে তাকে অনেক অভিযোগের সামনে দাঁড়াতে হয়েছে। এখন কলেজে কোন ছেলের দৃষ্টি দেখলেই অস্বস্তি হয়। ছেলেরা এই বয়সে সহজ চোখে তাকাতে পারে না। অথচ দুজন একই রকম বয়ে গেছে। ওরা মিলিটারিতে চলে গেলে সে দুজন ভাল বন্ধুকে হারাবে। অথচ এতদিন সে এদের কোন খোঁজ খবর করেনি। চিঠি দেওয়ার কথা মনে আসেনি। অথচ চলে যাওয়ার মুহুর্তে ওরা তো মনে করে এসেছে। দীপা মাথা নাড়ল, চল, তাহলে। আমি বড়দিকে বলে আসি। তোদের কাছে টাকা পয়সা আছে? একশো টাকা করে আছে? খোকন জানাল। থাক। আমি দেখছি কি আনতে পারি। আজ আমি তোদের খাওয়াবো। দীপা উঠে পড়ল। বড়দির মুখোমুখি হয়ে দীপা খুব সহজ গহ্বায় বললো, আমি একটু বেরুবো। ভদ্রমহিলা শরৎচন্দ্র পড়ছিলেন। চোখ তুলে জানতে চাইলেন, কোথায়? ওই যাদের দেখলেন। ওদের সঙ্গে। চা-বাগানে আমাদের বাড়ির গায়ে থাকে। ওরা আজ মিলিটারিতে চাকরি নিয়ে চলে যাচ্ছে। যাওয়ার আগে কিছু কেনাকাটা করতে চায়। মিলিটারিতে! ওইটুকু ছেলে।! নিশ্চয়ই বদ। পড়াশুনায় ইতি দিয়ছে। কোন গতি নেই তাই। ঠিক আছে, যা ভাল বোঝা কব। কিছুদিন তো বেশ লক্ষ্মী মেয়ের মত ছিলে। যাও, কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবে ভাই, বন্ধু বলার দরকার নেই। বড়দি বই-এর পাতায্য চোখ রেখে হঠাৎ মুখ তুলে দীপাকে ডাকলেন, শোন। দীপা দাঁড়াল। বড়দি জিজ্ঞাসা করলেন, বন্ধু বললে, কি ধরনের বন্ধু? দীপা বড় চোখে তাকাল। তারপর বলল, আমরা কখনও ভাবিনি কে ছেলে কে মেয়ে। বড়দি হতবাক। কথা না বলে ঘাড় নাড়তে পারলেন শুধু। দীপা বেরিয়ে এল। বুদ্ধি করে রুমমেটের কাছ থেকে ছাতা চেয়ে এনেছিল দীপা। রাস্তায় বেরিয়ে বলল, যাচ্চলে, আবার বৃষ্টি আসছে। তোদের সঙ্গে ছাতা নেই, ভিজে যাবি। বিশু বলল, ঘণ্টা দুয়েকোব মধ্যে বৃষ্টি নামবে না। কি করে বুঝলি? মেয়েদের চরিত্র আমি জানি। বাপস। দীপা শব্দ করে হাসল। এবং তুখনই তার মনে পড়ল অনেক মাস পরে সে এভাবে হাসতে পারল। সে জিজ্ঞাসা করল, মিলিটারিতে গিয়ে তোরা কোথায় থাকবি? জানি না। কোলকাতার ফোর্ট উইলিযামে দেখা করতে বলেছে। তোরা দুজন একসঙ্গে থাকবি? কি জানি! হয়তো না। কিছুদিন একসঙ্গে থাকতে পাবি। ওই যখন ট্রেনিং হবে। তারপর আমি হয়তো আসামে আর ও পাঞ্জাবে। দীপা নিশ্বাস ফেলল, তোদের সঙ্গে আমার আর দেখা হবে? খোকন বলল, বাঃ, কেন হবে না। বছরে ছুটি পাবো তো। বাধা যদ্দিন চা-বাগানে চাকরি করবে তদ্দিন দেখা হবেই। আর তুই যদি অনেক পড়াশুনা করে মাস্টারনি হয়ে যাস আর তখন যদি আমাদের মত অশিক্ষিত মানুষের সঙ্গে কথা না বলিস। খোকন কথা শেষ করতে পারল না, তার আগেই দীপা প্ৰায় চিৎকার করে উঠল, এক থাপ্পড় খাবি। বলেই চারপাশে তাকাল। ওরা এখন রূপ।শ্ৰী সিনেমাব সামনের রাস্তায়। ভাগ্যিস এখন পথে তেমন মানুষ নেই। নইলে এই নিয়ে আবার গল্প চালু হত। বিশু বলল, তুই জলপাইগুড়ির রাস্তাঘাট চিনে গিয়েছিস, না রে? কিছুটা। কয়েকদিন থাকলেই জানা যায়। বৃষ্টি পড়া শুরু হল আচমকা। ওরা দৌড়ে থানার সামনে রুবি বোর্ডিং-এর বারান্দায় উঠে পড়ল। দীপা এল ধীরে সুন্থে। এসে জিজ্ঞাসা করল, ভিজেছিস তো? ওরা অল্প ভিজেছিল। বিশু রুমালে চুল মুছে চিরুনি চালাল। এবার বৃষ্টি জোর পেয়েছে। দীপা বলল, মেঘেরা তাহলে মেঘেদের মত চলে। খোকন এপােশ ওপাশে তাকিয়ে বলল, বৃষ্টি এখনই থামবে বলে মনে হয় না। খেয়ে. নিলে হয়। তোর খিদে পায়নি বিশু? এখানে ভাত পাওয়া যায়? বিশু জিজ্ঞাসা করল। উত্তরটা দীপারও জানা নেই। সে ভেতরে পা বাড়াল। বেশ কয়েকটা টেবিল চেয়ার অনেকটা রেস্টটুরেন্টের মত, একটা কাউন্টারও রয়েছে। কিন্তু কোথাও কোন মানুষ নেই। একটা অদ্ভুত গন্ধ ভাসছে বাতাসে। অনেকটা রসুনের মত মনে হল দীপার। সে এপাশ ওপাশে তাকাচ্ছে এমন সময় একটি প্রৌঢ় লোক সামনে এসে দাঁড়াল, কিছু বলবেন দিদি? আপনাদের এখানে ভাত পাওয়া যায়? অবশ্যই। বোর্ডাররা তো এখানে এসে খান। কজন আছেন? তিনজন। কি খাবেন বলুন? ভাত, ডাল, এঁচোড়ের তরকারি, বেগুন ভাজা, ভেণ্ডি, রুই, কাতলা, চিতল মাছ এমন কি কই মাছ পর্যন্ত পারেন এখানে। ভাত ডাল ভাজা তরকারি। আর চিতল মাছের কত দাম? রিপিট না হলে আড়াই টাকা। তাই দিন। তিন জায়গায়। দীপা দশ টাকা নিয়ে বেরিয়েছিল হোস্টেল থেকে। খুব তৃপ্তি করে খেল ওরা দুজন। চিতল মাছের পেটি প্লেট ছাপিয়ে গিয়েছে। খোকন বলল, এরকম মাছ জীবনে বাড়িতে খাইনি রে। দীপার খুব ভাল লাগছিল। ওরা ভাত এবং ভাজা আবার নিলে ওর মনে ভয় ঢুকল। যদি দশ টাকার বেশী খরচ হয়ে যায় তাহলে মুশকিলে পড়তে হবে কিন্তু বিল এল মাত্র সাড়ে আট টাকার। বিশু বলল, দীপা, আজকের এই দুপুরের খাবার আমি চিবকাল মনে রাখব। দীপা বলল, বাড়িয়ে বলিস না। তোরা যখন প্ৰথম মাইনে পাবি তখন আমার নাম করে। খেয়ে নিস। তাহলেই আমার ভাল লাগবে। হঠাৎ বিশু বুকে পড়ল, দীপা, তোকে একটা কথা বলব? বল। দীপার মনে হল বিশু খুব একটা স্বাভাবিক নয়। আমরা তোর বন্ধু। আমাদের কথা শুনিবি? বল না! তুই আবার বিয়ে থাকবে সংসারী হবি। বুঝলি। তুই তো নিজেকে কখনও বিধবা বলে মনে করিসনি তাই চাকরি পেলে কাউকে বিয়ে করে ফেলিস। না পেলে করব না বলছিস? টাকা না থাকলে কেউ পাত্তা দেয় না, বুঝলি। খোকন বলল, আমরা যখন চাকরি করে। টাকা জমাবো। তখন সবাই আমাদের পাত্তা দেবে। বৃষ্টি আবার
false
tarashonkor
পায়। সে বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। কেমন করিয়া বসন্তকে এড়াইয়া চলিয়া যাইবে সে তা-ই ভাবিতে আরম্ভ করিল। ওদিকে নির্মলা, ললিতা তাহাদের প্রিয়জন বেহালাদার ও প্রধান দোহারকে লইয়া তখন মদের আসর পাতিয়া বসিয়া গিয়াছে। মহিষের মত বিরাটকায় লোকটা–প্রৌঢ়া দলনেত্রীর মনের মানুষ। লোকটা অদ্ভুত। ঠিক সেই একভাবেই বসিয়া আছে, অনাদি অনন্তর মত। উহাকে দেথিয়া নিতাই তাহার সমস্ত কথা স্মরণ না করিয়া পারে না। লোকটা কথাবার্তা বলে না, আমড়ার আঁটির মত সৌষ্ঠবহীন রাঙা চোখ মেলিয়া চাহিয়াই থাকে। রাক্ষসের মত খায়; প্রায় সমস্ত দিনটাই ঘুমায়, রাত্রে আকণ্ঠ মদ গিলিয়াও ঠাঁয় জাগিয়া বসিয়া থাকে। তাহার সামনেই থাকে একটা আলো-আর একটা প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ড। এই ভ্ৰাম্যমান পরিবারটির পথে-পাতা ঘরের গণ্ডির ভিতর রূপ ও দেহের খরিদ্দার যাহারা আসে তাহদের দৃষ্টি তাহার উপর না পড়িয়া পারে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুর্দান্ত মাতালগুলা চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া তাহাকে দেখিয়া—অনেকটা শান্ত প্রকৃতিস্থ হইয়া ভদ্র সুবোধ হইয়া উঠে। লোকটা ভাম হইয়া একটা মদের বোতল লইয়া বসিয়া আছে, নিৰ্বিকার উদাসীনের মত। রান্নাশালার চালায় প্রৌঢ়া তেলেভাজা ভাজিতে বসিয়াছে। ওই এক অদ্ভুত মেয়ে! মুখে হাসি লাগিয়াই আছে, আবার মুহুর্তে চোখ দুইটা রাঙা করিয়া এমন গম্ভীর হইয় উঠে যে, দলের সমস্ত লোক ত্রস্ত হইয়া পড়ে। আবার পরমুহূর্তেই সে হাসে। গানের ভাণ্ডার উহার পেটে। অনর্গল ছড়া, গান মুখস্থ বলিয়া যায়। গৃহস্থালি লইয়া চব্বিশ ঘণ্টাই ব্যস্ত। উন্মত্ত বুনো একপাল ঘোড়াকে রাশ টানিয়া চালাইয়া লইয়া চলিয়াছে। রথ-রথী-সারথি সবই সে একাধারে নিজে। নির্মলা হাসিয়া ডাকিল—এস গো দাদা, গরীব বুনের ঘরে একবার এস। হাসিয়া নিতাই বলিল—কি হচ্ছে তোমাদের? —কালকে নক্ষ্মীর বার গিয়েছে, পারণ করছি সকালে। বসন কই? সে আসছে না কেনে? মদের বোতলটা তুলিয়া দেখাইয়া সে খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। নিতাই সবিনয়ে নীরবে হাত দুইটি কেবল জোড় করিয়া মার্জনা চাহিল। বেহালাদার হাসিয়া বলিল—হ্যাঁ হ্যাঁ। তাকেই ডাক। কান টানলেই মাথা আসবে। নিতাইয়ের পিছনেই বসন্তের সকৌতুক কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হইয়া উঠিল—মাথা এখন পুণ্য করতে চলেছে, সঙ্গে সঙ্গে কানকেও যেতে হবে। তবে যদি কেটে লাও কানকে, সে আলাদা কথা! বসন্তর কথা কয়টি নিতাইয়ের বড় ভাল লাগিল। বাঃ, চমৎকার কথাটি বলিয়াছে বসন! খুশী হইরা নিতাই পিছন কিরিয়া দেখিল—গতকালকার ভক্তিমতী পূজারিণীর সাজে সাজিয়া বসন্ত দাঁড়াইয়া আছে। বসন্ত হাসিয়া বলিল—চল। পথের দুইধারেই দোকানের সারি। বসন্ত সামগ্রী কিনিল অনেক। ফলমূল মিষ্টিতে পুরা একটা টাকাই সে খরচ ফেলিল। একটা সিকি ভাঙাইয়া চার আনার আধলা লইয়া নিতাইয়ের হাতে দিয়া বলিল— পকেটে রাখ। নিতাই আবার চিন্তাকুল হইয়া উঠিয়াছিল। সে ভাবিতেছিল—এ বাঁধন কেমন করিয়া কাটিয়া ফেলা যায়, সেই কথা। মন্দির হইতে ফিরিলেই তাহাকে লইয়া আবার সকলে টানাটানি আরম্ভ করিয়া দিবে। বসন্তও তখন আর এ বসন্ত থাকিবে না। হিংস্র দীপ্তিতে তখন বসন্ত ক্ষুরধার হইয়া উঠিবে। বসন্তের রাত্রির রূপ তাহার তাহার চোখের উপর ভাসিতেছে। সে ঠিক করিল, ফিরিবার পথে বসন্তকে বাসায় পাঠাইয়া দিয়া পথ হইতেই সে সরিয়া পড়িবে। অজুহাতের অভাব হইবে না। তাহার কোন গ্রামবাসীর সন্ধান করিবার জন্য মেলাটা ঘুরিবার একটা অজুহাত হঠাৎ তাহার মনে আসিয়া গেল, সে সেটাকে আঁকড়াইয়া ধরিল। এই অবস্থায় বসন্ত আধলাগুলি তাহার হাতে দিতেই ভ্রূ তুলিয়া সে প্রশ্ন করিল—কি হবে? —ও মা গো! রাজ্যের কানা খোঁড়া মন্দিরের পথে বসে আছে। দান করব। মৃদু হাসিয়া নিতাইয়ের মুখের দিকে চাহিয়া সে বিস্ময়ের ভ্র কুঞ্চিত করিয়া প্রশ্ন করিল—কি ভাবছ তুমি বল দেখি? ব্যস্ত হইয়া নিতাই অভিনয় করিয়া হাসিয়া বলিল—কিছু না! —কিছু না? নিতাই আবার অভিনয় করিয়া বলিল, ভাবছি তোমাকে চিনতে পারলাম না। নিতাই হাসিল। সে অভিনয়ে বসন্ত ভূলিল, বলিল—আমার ভারি মায়া লাগে গো! আহা! কি কষ্ট বল দিকিনি কানা খোঁড়া রোগ লোকদের? বাপ রে! বলিতে বলিতে সে যেন শিহরিয়া উঠিল। নিতাই সত্যই এবার অবাক হইয়া গেল। একি! বসন্তের চোখ দুইটা জলে ভরিয়া উঠিয়৷ সে টলমল করিতেছে! চোখ মুছিয়া বসন্ত আবার হাসিয়া বলিল—সে হাসি বিচিত্র হাসি, এমন হাসি নিতাই জীবনে দেখে নাই—হাসিয়া বসন্ত বলিল—আমার কপালেও অনেক কষ্ট আছে গো! কাল তো তোমাকে বলেছি, আমার কাঁসির সঙ্গে রক্ত ওঠে। কাসের ব্যামো! এত পান-দোক্ত খাই তো ওই জন্যে। রক্ত উঠলে লোকে বুঝতে পারবে না। আর আমিও বুঝতে পারব না। দেখলেই ভয়, না দেখলেই বেশ থাকি। দলের কেউ জানে না, জানে কেবল মাসী। কিন্তু এখনও নাচতে গাইতে পারি, চটক আছে, পাঁচটা লোক দেখে বলেই দলে রেখেছে। যেদিন পাড়ু হয়ে পড়ব, সেদিন আর রাখবে না, নেহাৎ ভাল মানুষের কাজ করে তো নোক দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেবে। নইলে, যেখানে রোগ বেশী হবে, সেইখানেই ফেলে চলে যাবে, গাছতলায় মরতে হবে। জ্যাস্ততেই হয়তো শ্যালকুকুরে ছিঁড়ে খাবে। নিতাই শিহরিয়া উঠিল। বলিল—বসন। বসন বলিল—সত্যি কথা কবিয়াল—এই আমাদের নেকন। তবে আমার নেকন আরও খারাপ। তুমি সেই ইস্টিশানে গেয়েছিলে—‘ফুলেতে ধুলোতে প্রেম’ –কবিয়াল, তখন ধুলোর সঙ্গে মাটির সঙ্গে প্রেম হবে আমার। আরও কিছুক্ষণ চুপ করিরা থাকিরা সে আবার বলিল— দুৰ্ব্বো ঘাসের রসে আর কতদিন উপকার হবে। রোজ সকালে বসন্ত দূৰ্বাঘাস থেতো করিয়া রস খায়। অত্যন্ত গোপনে সে এই কাজটি করে। নিয়মিত খাওয়া হয় না। তাহার অনিয়মিত উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাত্রায় সম্ভব হইয়া উঠে না! মধ্যে মধ্যে প্রৌঢ়া মনে করাইয়া দেয়—বসন, সকালবেলায় দূৰ্ব্বোর রস থাস তো? বসন্ত কখনও কখনও সজাগ হইয়া উঠে, কখনও বা ঠোঁট উল্টাইয়া বলে—ম’লে ফেলে দিয়ে। মাসি। ও আমি আর
false
nihar_ronjon_gupta
টাকা মইনা পাই। বিয়ে-থা করিনি। একা মানুষ, মোটামুটি সচ্ছলতার মধ্যেই দিন কাটছে। কিন্তু যাক যা বলছিলাম-জিতেন্দ্ৰ চৌধুরীর মেজ ভাই হীরেন্দ্ৰ, চৌধুরী ওকালতি করে তেমন একটা কিছু উপার্জন করতে কোন দিনই পারেননি। তাঁরই পাঁচটি ছেলেমেয়ে—জগদীন্দ্র, মণীন্দ্ৰ, ফণীন্দ্র ও শচীন্দ্ৰ—চার ছেলে এবং একটিমাত্র মেয়ে স্বাতী। তাঁরও অকালেই মানে নীরেন্দ্ৰ চৌধুরীর মৃত্যুর বৎসর দুয়েকের মধ্যেই মৃত্যু হয়। ওদের মা আগেই মারা গিয়েছিলেন। এদিকে হীরেন্দ্ৰ চৌধুরীর মৃত্যুর পর জিতেন্দ্ৰ চৌধুরীর বিধবা স্ত্রী চিত্রাঙ্গদা দেবী দয়াপরবশ হয়ে ওদের নিজের কাছে নিয়ে যান ইন্দ্ৰালয়ে। সেও আজ বারো-তেরো বছর আগেকার কথা। হীরেন্দ্রর একটি ছেলে ও বলতে গেলে মানুষ হয়নি-মেয়ে ওই স্বাতী বি. এ. পাস করেছে। অতঃপর জয়ন্ত চৌধুরী তার জোঠতুতো ভাই-বোনদের একটা মোটামুটি পরিচয় দিল। বড় জগদীন্দ্র, বয়স ত্রিশ-একত্ৰিশ হোর—চিরদিনই রুগ্ন—ক্রনিক হ্যাঁপানীর রোগ। ম্যাট্রিক পরীক্ষা বার দুই দিয়েছিল, পাস করতে পারেনি। বাড়িতে সৰ্ব্বক্ষণ বসে থাকে—এবং বসে বসে পেসেন্স থেলে তাস নিয়ে। খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে একটু বিলাসী ও লোভী। দ্বিতীয় মণীন্দ্ৰ চৌধুরী-বড় ভায়ের চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট হবে। জগদীন্দ্ৰ তবু ম্যাট্রিক পরীক্ষণ দিয়েছিল, সে তাও দেয়নি। খেলাধূলায় খুব নেশা। ওই অঞ্চলের একজন নামকরা ফুটবল প্লেয়ার। সেন্টার ফরোয়ার্ডে খেলে। স্বাস্থ্য ভাল এবং সৌখিন প্রকৃতিরবেশভূষা ও সাজসজ্জার দিকে বিশেষ নজর। তৃতীয় ফণীন্দ্ৰ—ডান পা-টা খোঁড়া। চলার সময় পা-টা একটু টেনে টেনে চলে। ফণীন্দ্রর নেশা গান-বাজনায়। ভাল তবলা বাজায়। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ে পড়াশোনায় ইস্তফা দিয়ে দিয়েছে। স্বাস্থ্য মোটামুটি—এবং সেও তার দাদার মতই ভোজনবিলাসী। চতুর্থ শচীন্দ্ৰ—ভাইদের মধ্যে সেই দেখতে সবচেয়ে বেশি সুন্দর। ভাইদের মধ্যে ও-ই ম্যাট্রিকটা পাস করেছে। কবিতা লেখা ও রহস্য-রোমাঞ্চের বই পড়া তার একটা নেশা। স্বাতী-বোন; স্থানীয় কলেজ থেকে বি. এ. পাস করেছে—গত বছর। এম. এ. পড়ার ইচ্ছা। কিন্তু চিত্রাঙ্গদা দেবী স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, না-যথেষ্ট হয়েছে। চিত্রাঙ্গদা দেবী তার বিয়ের জন্য পাত্রের সন্ধান করছিলেন, এমন সময় হঠাৎ প্রকাশ পেলো চিত্রাঙ্গদা দেবীর ধানবাদ অফিসের যে তরুণ অ্যাসিস্টান্ট ম্যানেজারটি বছর দুই হল তার ধানবাদ অফিসে যোগ দিয়েছে।–অনিন্দ্য চক্রবর্তী—তাকেই নাকি স্বাতী বিয়ে করতে চায়। অনিন্দ্যও সেকথা চিত্রাঙ্গদা দেবীকে জানিয়েছিল। কিন্তু চিত্রাঙ্গদা দেবী রাজী হননি; শোনামাত্রই কথাটা নাকচ করে দিয়েছেন। বলেছেন, অসম্ভব-হতে পারে না। তবু স্বাতী জিজ্ঞাসা করেছিল তার বড়মাকে, (চিত্রাঙ্গদা দেবীকে সকলে ‘বড়মা’ বলে ডাকে বরাবর) কেন, অসম্ভব কেন? ‘কেন’র জবাব তোমাকে আমি দেবো না। অসম্ভব—এইটাই শুধু মনে রেখো। তবু তর্ক তুলেছিল স্বাতী। বলেছিল, অনিন্দ্য তোমার আফিসে চাকরি করে বলেই কি এ বিয়ে হতে পারে না? তর্ক করো না স্বাতী। চিত্রাঙ্গদা দেবী বলেছিলেন। ওর সঙ্গে আমার বিয়ে হলে সেটা তোমার ভুয়ো অর্থহীন ভ্যানিটিতে লাগবে, তাই কি— চুপ কর, ডেপোমি করো না-দুটো পাস করে ভাব যেন কি একটা হয়ে গিয়েছ, তাই না? ডেঁপোমি আমি করছি না—বরং তুমিই অন্যায়। জুলুম করবার চেষ্টা করছ। স্বাতী? তোমার ঐ চোখরাঙানোকে আর যে ভয় করুক আমি করি না তুমি জান— অকৃতজ্ঞ। কেন আশ্রয় দিয়ে খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করেছ বলে? কিন্তু ভুলে যেও না পায়ে ধরে আশ্রয় দিতে আমরা তোমাকে সাধিনি—তুমিই— হ্যাঁ, অন্যায় হয়েছে আমার। পথে ভেসে বেড়ানোই তোমাদের উচিত ছিল। সেটা হয়ত সুখেরই হত। ক্ৰোধে যেন অতঃপর একেবারে ফেটে পড়েছিলেন চিত্রাঙ্গদা দেবী। বলেছিলেন যেমন অপদাৰ্থ আমানুষ ছিল বাপ তেমনিই হবে তো তোমরা—একপাল ভেড়া জন্ম দিয়ে গিয়েছে– হ্যাঁ, বাপ আমাদের অপদাৰ্থ অমানুষ তো হবে—কারণ তুমি যে তার সন্তানদের প্রতি কৃপা দেখিয়ে আশ্রয় দিয়ে বাহাদুরী কুড়োবার সুযোগ পেয়েছ! স্বাতী, তুমি স্পর্ধার সীমা লঙঘন করছ। চাপা কণ্ঠে তর্জন করে উঠেছিলেন চিত্রাঙ্গদা দেবী অতঃপর। ভাগ্যে মণীন্দ্র ওই সময় সামনে এসে পড়েছিল, সে কোনমতে বোনকে সরিয়ে নিয়ে যায়। কিরীটী প্রশ্ন করে, আপনি কার কাছে শুনলেন এসব কথা? আপনি তো সেখানে থাকেন না? না, স্বতীই আমাকে চিঠি লিখে জানিয়েছিল সব কথা। তারপর কি হল? কি আর হবে, ব্যাপারটা ওইখানেই চাপা পড়ে গেল। জয়ন্ত চৌধুরী বললে। আর ওই অনিন্দ্য চক্রবর্তী—তার কি হল? সে এখনো চাকরি করছে। তা আপনি আমার কাছে এসেছেন কেন মিস্টার চৌধুরী এবার বলুন তো? কেন, আপনি চিঠিটা পড়েছেন তো। বড়মার ধারণা হয়েছে এই মাসের পনেরো তারিখে তার জন্মদিন-এবং তার কোষ্ঠীতেও আছে নাকি এই সময়টা তাঁর অপঘাতে মৃত্যুযোগ; কাজেই তিনি খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছেন। কোষ্ঠীতে মৃত্যুযোগ আছে বলে? হ্যাঁ, তার কোষ্ঠীতে যা যা ছিল, সব ফলে গিয়েছে আজ পর্যন্ত একেবারে ঠিক ঠিক। তাই কিন্তু এক্ষেত্রে আমি তাকে কি সাহায্য করতে পারি? দেখুন কথাটা তাহলে আপনাকে আমি আরো একটু স্পষ্ট করে বলি—জেঠিমার ঐ চিঠিটা পাবার পর থেকেই আমারও মনে হচ্ছে সত্যিই হয়ত জেঠিমকে ঘিরে একটা ষড়যন্ত্র ঘন হয়ে উঠছে— ষড়যন্ত্র! হ্যাঁ। আর তাই আমি আপনার কথা জেঠিমাকে ফোনে জানিয়েছিলাম—বলেছিলাম আপনার সাহায্য নিলে হয়ত সব ষড়যন্ত্র ফাস হয়ে যেতে পারে।– কিন্তু– মিঃ রায়, তাই জেঠিমা ও আমার দুজনেরই ইচ্ছে বিশেষ করে ঐ সময়টা সেখানেই আপনি উপস্থিত থাকুন—আপনি অমত করবেন না। কিরীটী অতঃপর কি যেন ভাবে কয়েক মূহুর্ত, তারপর বলে, আপনার কথা হয়ত মিথ্যে নয়। কিন্তু সেখানে আমি কি ভাবে যেতে পারি? সেটা আপনিই ভেবে বলুন।– আচ্ছা জয়ন্তবাবু, কোষ্ঠীর ব্যাপারে বুঝি চিত্রাঙ্গদা দেবীর খুব বিশ্বাস? কিরীটী মৃদু হেসে প্রশ্ন করে। হ্যাঁ। কিন্তু মিস্টার চৌধুরী, সত্যিই যদি তাঁর এই সময় অপঘাতে মৃত্যুযোগ থাকে, কারো সাধ্য আছে কি তাকে
false
shunil_gongopaddhay
কাছে। দ্বারকানাথ নিজে সংস্কৃত অবশ্য ভালো জানেন না, কিন্তু অধ্যাপক বুর্ণফ এবং ম্যাক্সমুলার সংস্কৃত শিক্ষার সূত্রে ভারতবর্ষ সম্পর্কে এমন সব কথা বলেন, যার সঙ্গে প্রকৃত ভারতবর্ষের সাদৃশ্য খুব কম—এ সব শুনে দ্বারকানাথ কৌতুক বোধ করেন। ম্যাক্সমুলার নামের যুবকটির কৌতূহলের আতিশয্য দেখে দ্বারকানাথ তাকে বললেন, যেদিন খুশী সকালবেলা সে তাঁর কাছে আসতে পারে। ম্যাক্সমুলার প্রায় নিয়মিতই আসতে লাগলেন। সংস্কৃত ভাষা ভালোভাবে না জানলেও পারিবারিক সূত্রে দ্বারকানাথ সংস্কৃত সাহিত্য ও ভারতীয় ঐতিহ্য সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত। তাঁর মুখ থেকে সেই সব কথা ম্যাক্সমুলার গোগ্রাসে গেলেন। ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে এই জামান যুবকটির আগ্ৰহ অসীম। দ্বারকানাথ এই সময় গান-বাজনার চাচায়ও মেতে উঠেছেন। ফরাসী ও ইতালীয় অপেরাগীতি তিনি অনুকরণ করতে পারেন অনবদ্যভাবে। তাঁর কণ্ঠস্বর জোরালো। মাঝে মাঝে সেই সব গান তিনি গেয়ে উঠলে ম্যাক্সমুলার শোনেন মুগ্ধভাবে। কখনো কখনো ম্যাক্সমুলার ওঁর গানের সঙ্গে পিয়ানো বাজান। খুব একটা চচাঁ না করলেও দ্বারকানাথের কণ্ঠে বেশ সুর আছে। একদিন ম্যাক্সমুলার দ্বারকানাথকে অনুরোধ করলেন একটি ভারতবর্ষীয় মার্গ সঙ্গীত শোনাবার জন্য। ভারতীয় প্রিন্স বললেন, ও গান বিদেশীরা বুঝবে না। তবু ম্যাক্সমুলার বারবার পেড়াপীড়ি করায় তিনি একটি গান গাইলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কী, এর মর্ম বুঝিলে কিছু? ম্যাক্সমুলার অকপটে স্বীকার করলেন যে, ঐ গানে তিনি কোনো রস পাননি, ওটি কোনো গান বলিয়া মনে হয় না। সুর তালি লয় কিছুই নেই। অমনি চটে উঠলেন দ্বারকানাথ। রুক্ষ স্বরে বললেন, এই তোমাদের এক দোষ। তোমরা সহজে কোনো নতুন জিনিস গ্রহণ করিতে পারো না। কোনো জিনিস। যদি প্রথমবারই তোমাদের মনোরঞ্জন করিতে না পারে, অমনি তোমরা তার প্রতি বিরূপ হও। আমি যখন প্রথম ইতালীয় গীতবাদ্য শুনি,। তখন মনে হইয়াছিল উহা বিড়ালের চ্যাঁচামেচি। ধৈর্য ধারণ করিয়া আমি তাহার রস গ্রহণ করিতে শিখিয়াছি। তোমরা মনে করো আমাদের ধর্ম ধর্মই নয়, আমাদের কাব্য কাব্যই নয়, আমাদের দর্শন দর্শনই নয়, যেহেতু তোমরা তা বোঝে না। ম্যাক্সমুলার চুপসে গেলেন একেবারে। ইদানীং দ্বারকানাথের মেজাজ প্রায়ই ভালো থাকে না। দেশ থেকে টাকা আসতে সামান্য দেরি হলে, তিনি জ্যেষ্ঠপুত্ৰকে তীব্র ভর্ৎসনা করে চিঠি লেখেন। দেবেন্দ্রকে তিনি জানিয়ে দেন, তিনি ভালোই বুঝতে পেরেছেন যে দেবেন্দ্ৰ যে পথে চলেছে, তাতে বিষয়সম্পত্তি কিছুই রক্ষা করতে পারবে না। এদিকে সত্যিই সেইপ্ৰকার ব্যাপার চলছে। পিতা বিদেশবাসী হবার পর দেবেন্দ্ৰ বিষয়কর্ম থেকে মন একেবারেই সরিয়ে ফেলেছেন যেন। সর্বক্ষণ তিনি ধর্ম সাধনায় ও ধর্ম বিস্তারের জন্য উন্মুখ। ইতিমধ্যেই দীক্ষিত ব্ৰাহ্মর সংখ্যা পাঁচশত ছড়িয়ে গেছে, এখন শহর ছেড়ে গ্রামাঞ্চলেও এই নব ধর্ম প্রচারের আয়োজন চলছে। একদিন সকালে দেবেন্দ্র তাঁদের বাহির বাটিতে বসে সংবাদপত্র পাঠ করছেন, এমন সময় তাঁদের হাউসের সরকার রাজেন্দ্ৰনাথ এসে তাঁর কাছে কেঁদে পড়লো। কাঁদতে কাঁদতে সে বললো, দেশে এত বড় অবিচার সংঘটিত হচ্ছে, অথচ তার প্রতিকার করার কেউ কি নেই? কাগজ মুড়ে রেখে দেবেন্দ্র বললেন, কান্না থামাও, আগে বৃত্তান্তটি কি তা খুলে বলো! রাজেন্দ্রনাথ যে কাহিনীটি বললো, তা এই : গত রবিবার রাজেন্দ্রনাথের স্ত্রী এবং তার ছোট ভাই উমেশচন্দ্রের স্ত্রী এক পালকিতে চেপে কোথাও নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাচ্ছিল এমন সময় তার ছোট ভাই উমেশচন্দ্ৰ পালকি থামিয়ে জোর করে নিজের স্ত্রীকে নামিয়ে নিয়ে যায় এবং উভয়ে খৃষ্টান হবার নিমিত্ত পাদ্রী ডফ সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করে। উমেশচন্দ্রের বয়স চোদ্দ এবং তারপত্নীর বয়েস এগারো, উভয়েই নাবালক-নাবালিকা। সুতরাং স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হবার অধিকার তাদের নেই। উমেশচন্দ্রের পিতা ডফ সাহেবের কাছে গিয়ে অনুনয় বিনয় করলেন, পুত্র ও পুত্রবধূকে ফিরিয়ে দেবার জন্য। ডফ সাহেব তা শুনলেন না। তখন সুগ্ৰীমকোটে নালিশ করা হলো, সুগ্ৰীমকোর্ট অচিরাৎ রায় দিয়ে দিল যে ছেলে যখন বাপের কাছে ফিরে যেতে চায় না, তখন আদালত সেখানে জবরদস্তি করবে। কেন? তখন রাজেন্দ্র এবং তার পিতা ডফ সাহেবের কাছে অনুরোধ করে বললো, তারা আবার আদালতে নালিশ আনবে, সেই বিচার সমাপ্ত হবার আগে পর্যন্ত যেন ডফ সাহেব উমেশচন্দ্র ও তাঁর স্ত্রীকে খৃষ্টান না করেন। ডফ সাহেব সে কথায় কৰ্ণপাত করলেন না। গতকল্য সন্ধ্যাবেলা ডফ সাহেব ওদের দুজনকে খৃষ্টধর্মে দীক্ষা দিয়ে ফেলেছেন। ঘটনাটি শুনে দারুণ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন দেবেন্দ্র। আদালত এমত প্রকার রায় দিয়েছে? নাবালক-নাবালিকাকেও জোর করে ধর্মান্তরিত করা যাবে। এ তো স্পষ্ট পক্ষপাতিত্ব। এই কি ব্রিটিশ ন্যায়-এর উদাহরণ? তিনি তাঁর কর্মচারী ও বয়স্য অক্ষয় দত্তকে ডেকে বললেন, আপনি এক্ষণেই এর বিরুদ্ধে কলম ধারণ করুন। অন্তঃপুরের স্ত্রীলোকেরাও এইভাবে ক্ৰমে ক্ৰমে স্বধৰ্ম ছেড়ে পরধর্ম গ্রহণ করবে? এই সাংঘাতিক ঘটনা প্ৰত্যক্ষ করেও কি আমাদের চৈতন্য হবে না! দেবেন্দ্র নিজে গাড়ি নিয়ে শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বাড়ি বাড়ি ঘুরতে লাগলেন। তাঁদের বোঝাতে লাগলেন যে, পাস্ত্রীরা বিনা পয়সায় লেখাপড়া শেখাবার প্রলোভন দেখিয়ে ছোট ছোট বালকদের নিজেদের বিদ্যালয়ে ভর্তি করাচ্ছে এবং তারপরই প্রথম সুযোগে তাদের খৃষ্টান করে নিচ্ছে। হাজার হাজার ছেলে এইভাবে খৃষ্টান হচ্ছে। এইভাবে চললে যে এদেশের সবাই খৃষ্টান হয়ে যাবে! পাদ্রীদের সংস্পর্শ থেকে এখনি ছেলেদের সরিয়ে আনা দরকার। সম্ভ্রান্তদের মধ্যে অনেকেই দেবেন্দ্রকে সুনজরে দেখেন না। ব্ৰাহ্মধর্ম প্রচার করে তিনি সনাতন হিন্দুধর্মকে আঘাত করার চেষ্টা করছেন বলে মনে করেন অনেকে। রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের শিরোমণি রাধাকান্ত দেব ব্ৰহ্মসভার বিরুদ্ধে একটি ধর্মসভা স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু তিনিও দেবেন্দ্রর এই ব্যাকুলতা দেখে তাঁর সঙ্গে একমত হলেন। উচ্চ ইংরেজি শিক্ষিতদের মধ্যে দু-একজন শুধু প্রশ্ন তুললেন, খৃষ্টান ধর্ম প্রসারে
false
humayun_ahmed
এখন দয়া করে ডাউনসেট হও। ডাউনসেটটা কী? ডাউনসেট হলো আপসেটের উল্টোটা। বারান্দায় বসে না থেকে চোখে মুখে পানি দিয়ে শুয়ে পড়। আমি বাবার ডান হাতটা ধরে নিজের কোলে রাখলাম। তিনি মনে হলে একটু লজ্জা পেয়ে গেলেন। আমার কাছ থেকে এ ধরনের ব্যবহার পেয়ে তিনি অভ্যস্ত না। আমি আবারো বললাম, বাবা যাও ঘুমুতে যাও। বাবা ক্লান্ত গলায় বললেন, বসি আরো কিছুক্ষণ। ঘুমের প্রথম স্পেলটা কেটে গেলে সমস্যা আছে। এখন বিছানায় গেলে কাজের কাজ কিছু হবে না। তুই শুয়ে পড়। আমার ঘুমুতে দেরি আছে। প্রজেক্ট শেষ করতে হবে। কাল জমা দেবার শেষ দিন। রাত তিনটায় ঘুমুতে গিয়ে সকাল নটায় ক্লাস ধরতে অসুবিধা হয় না? না হয় না। অভ্যাস হয়ে গেছে। কফি খাবে বাবা? মধ্যরাতের কফির অন্য এক মজা আছে। এমিতেই ঘুম হচ্ছে না–এর ওপর কফি? বিষে বিষক্ষয়–হয়তো দেখবে কফি খেয়ে তোমার ঘুম পেয়ে যাবে। আমাদের নতুন একজন টিচার এসেছেন কাওসার নাম উনি সারাদিনে একটা সিগারেট খান। কখন খান জানো? ঠিক ঘুমুতে যাবার আগে। সিগারেট হচ্ছে তার ঘুমের ট্যাবলেট। সিগারেট অর্ধেক শেষ হবার আগেই ঘুমে তাঁর চোখ জড়িয়ে যায়। এমনও হয়েছে জ্বলন্ত সিগারেট তাঁর মুখে, তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। সিগারেটের ছাকা খেয়ে তাঁর ঘুম ভেঙেছে। তোদের টিচাররা কি ক্লাসে এইসব গল্প করে? হ্যাঁ করে। আমাদের ক্লাসগুলো অন্যরকম . এখানে কোনো নিয়ম নেই। নিয়ম না থাকাটাই আমাদের নিয়ম। ভালো। যা কফি নিয়ে আয়। আমি উঠে দাঁড়ালাম। রান্নাঘরে যাবার আগে এক তলায় ভাইয়ার ঘরে উঁকি দিলাম। ভাইয়া গভীর ঘুমে। তার ঘরের দরজা খোলা। সে কখনো দরজা বন্ধ করে ঘুমুবে না। দরজা জানালা বন্ধ করলেই তার কাছে না-কি মনে হয় ঘরের বন্ধ দরজা জানালা আর খোলা যাবে না। কোনো কারণে আটকে যাবে। এই মনে করে তার দম বন্ধ হয়ে আসে এবং এক সময় নিঃশ্বাসের কষ্ট শুরু হয়। ভাইয়া জেগে থাকলে ভালো হতো। তাকে তার বন্ধুর কথা জিজ্ঞেস করতাম। নতুন কোনো এসাইনমেন্ট সে হাতে নিয়েছে কি-না। কত টাকার এসাইনমেন্ট। ছেলেটার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলে মন্দ হতো না। আমি মনে মনে ঠিক করে ফেললাম আবার কোনোদিন রাতে সে যদি ছাদে ঘুমুতে আসে তাহলে তাকে কয়েক লাইন কবিতা শুনিয়ে বলব। এর মানে কী বলুন। তো। পুলিশ আপনাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে এটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে বলুন দেখি এই দুটা লাইনের কী অর্থ– অলস মাছির শব্দে ভরে থাকে সকালের বিষন্ন সময় পৃথিবীরে মায়াবী নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়। মগ ভর্তি কফি নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দেখি বিছানায় এলোমেলো হয়ে মা ঘুমুচ্ছেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে চিন্তা ভাবনাহীন কিশোরী এক মেয়ে বড় বনের সঙ্গে ঘুমুতে এসেছে। তার আশা ছিল সে বোনের সঙ্গে স্কুলের কিছু মজার মজার কথা বলবে। আশা পূর্ণ হয় নি। বোন কাজ করছে। ছোট কিশোরী বিছানায় শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করছে কখন বড় বোনের কাজ শেষ হবে। কখন বড় বোন বাতি নিভিয়ে বিছানায় আসবে। অপেক্ষা করতে করতে বেদারি ঘুমিয়ে পড়েছে। কোলাজের কাজ শেষ হলো রাত সাড়ে তিনটায়। চোখে মুখে পানি দিয়ে বাতি নিভিয়ে আমি মার পাশে জায়গা করে শুয়ে পড়লাম। মা সহজ গলায় বললেন–ঝড়ের ক্যাসেটটা দিয়ে দে। ঝড় বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমাই। আমি বললাম, তুমি এতক্ষণ জেগেছিলে? হুঁ, ছিলাম। এতক্ষণ কি ঘুমের অভিনয় করছিলে? হুঁ, করছিলাম। অভিনয়টা ভালো হয়েছে না? বড় খালার পাটটা করলে মনে হয় ভালোই পারব, কী বলিস? নাটকের অভিনয়ের কথা বাদ দাও। নাটক ছাড়া এ রকম অভিনয় কি তুমি প্রায়ই করো? হুঁ, করি। তোর বাবা কিছু বুঝতে পারে না। আশ্চৰ্যতো! আশ্চর্য হবার কী আছে? মেয়ে হয়ে কেউ জন্মাবে আর অভিনয় করবে না, এটা হতেই পারে না। আমি কোনো অভিনয় করি না মা। তুই তাহলে মহা বিপদে পড়বি। বিপদে পড়লে পড়ব। আচ্ছা মা দেখি তোমার কেমন বুদ্ধি। আমি কবিতার দুটা লাইন বলব তুমি এর কী অর্থ বলবে। মা বিরক্ত গলায় বললেন, ঘুমাতে! বুড়ো বয়সে বাংলার পরীক্ষা দিতে পারব না। আহা চেষ্টা করে দেখই না! কবিতার লাইন দুটা হলো– অলস মাছির শব্দে ভরে থাকে সকালের বিষন্ন সময় পৃথিবীরে মায়াবী নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়। মা হাই তুলতে তুলতে বললেন, জীবনানন্দ দাশের কবিতা না? অবসরের গান। এই কবিতার সবচে সুন্দর লাইনটা কী জানিস? সবচে সুন্দর লাইন– এখানে পালঙ্কে শুয়ে কাটিবে অনেক দিন জেগে থেকে ঘুমাবার সাধ ভালোবেসে। মা চোখ বন্ধ করে পাশ ফিরলেন। আমি অবাক হয়ে মার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মা ঘুমুচ্ছ? হ্যাঁ ঘুমুচ্ছি। তুমি আমাকে খুবই অবাক করেছ। মাঝে মাঝে অবাক হওয়া খারাপ না। তুমি চোখ বন্ধ করে আছো কেন? এসে গল্প করি। রাত তত বেশি বাকি নাই। এসে গল্প করে রাতটা পার করে দেই। কী নিয়ে গল্প করবি? তোমার যা ইচ্ছা। বড় খালার যে রোলটা করতে চাচ্ছ সেটা নিয়েও কথা বলতে পারি। রোলটা কেমন? একটা মাত্র ডায়ালগ। আমি বসেউলের মোজা বানাচ্ছি, তখন নায়িকা এসে বলবে খালা কার জন্যে মোজা বানাচ্ছ? তার উত্তরে আমি বলব–জানি না। তখন নায়িকা বলবে তুমি মোজা বানাচ্ছ অথচ বলছ কার জন্যে মোজা বানাচ্ছ। জানোনা এটা কোন কথা? তার উত্তরে আমি রহস্যময় হাসি হাস। রহস্যময় হাসি প্রাকটিস করেছ? না।
false
MZI
ছিল, আর সে একেবারে শিশু বয়স থেকে শুধু বই পড়ে আসছে। আমার মনে হয় সে জন্যে সে এত সুন্দর লিখতে পারত। বই পড়ে সবাই যে সফল লেখক হয়ে যাবে তা নয় কিন্তু বই পড়লে নিশ্চিতভাবে নিজের ভেতরে একটা পরিবর্তন হয়। সেই কবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মারা গেছেন, জীবনানন্দ দাস ট্রামের তলায় চাপা পড়েছেন। মজার ব্যাপার হল, তাদের লেখাগুলো এখনও পুরোপুরি জীবন্ত। যখন পড়ি তখন মনে হয় তাঁরা বুঝি সামনে বসে আছেন। আমাদের দেশের মানুষের বইপড়ার অভ্যাসটি কম। যত দিন যাচ্ছে মনে হয় অভ্যাসটি আরও কমে যাচ্ছে। ইউরোপ-আমেরিকার বাস বা রেলস্টেশনে অপেক্ষা করার সময় দেখা যায় সবাই একটা না একটা বই পড়ছে (আজকাল ই-বুক রিডার দিয়েও পড়ে)। খুব যে গভীর জ্ঞানের বই তা নয়, জনপ্রিয় কোনো বই কিন্তু পড়ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই তুলনায় আমাদের দেশের বাস-ট্রেন-স্টেশনে গেলে দেখতে পাই মানুষজন খুবই বিরস বদনে কিছু না করে চুপচাপ বসে আছে (আজকাল মোবাইল টেলিফোন হয়েছে, তাই হয়তো মোবাইল ফোনে জোরে জোরে কথা বলছে)। কিন্তু বইপড়ার দৃশ্য খুবই কম। আমি লক্ষ্য করে দেখেছি, যদি-বা কেউ বই পড়ে সেটি হবে কমবয়সী ছেলে বা মেয়ে, বড় মানুষ নয়। বড় মানুষেরা পত্রিকা পড়তে পারে। বড়জোর ম্যাগাজিনে চোখ বুলায় কিন্তু বই পড়ে খুব কম। সারা পৃথিবীতেই বইয়ের প্রতিশব্দ এখন টেলিভিশন। বইপড়া যে রকম একটা অসাধারণ উঁচুমানের মানসিক প্রক্রিয়া, টেলিভিশন ঠিক সে রকম নিচুমানের মানসিক প্রক্রিয়া! বইপড়ার সময় মস্তিষ্কে যে রকম নানা ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকে, টেলিভিশন দেখার সময় তার কিছুই হয় না। আমরা টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে থাকলেই সবকিছু আমাদের মস্তিষ্কে ঢুকে যায়। আমি বেশকিছু কিশোর উপন্যাস লিখেছি। মাঝে মাঝেই টিভির লোকজন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে সেই উপন্যাসগুলো থেকে টিভির উপযোগী নাটক বানানোর অনুমতি চান। আমি কখনও তাদের অনুমতি দিই না। বিনয়ের সঙ্গে বলি, যখন কেউ আমার কিশোর উপন্যাসটি পড়ে, তখন সে চরিত্রগুলোকে নিজের মতো করে কল্পনা করে নিতে পারে। যার কল্পনাশক্তি যত প্রবল তার চরিত্রগুলো তত জীবন্ত। কিন্তু যখন সেটি থেকে টেলিভিশনের জন্যে নাটক (বা সিরিয়াল) তৈরি হবে তখন চরিত্রগুলোকে সে আর কখনও কল্পনা করতে পারবে না, সরাসরি তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হবে। একজন শিশু, কিশোর যদি কল্পনা করা না শিখল তাহলে তার জীবনের পাওয়ার মতো আর কী থাকল? পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছিলেন, জ্ঞান থেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কল্পনাশক্তি। এর চাইতে খাঁটি কথা আর কিছু হতে পারে না। জ্ঞান যদি হয় একটা দামি গাড়ি, তাহলে কল্পনাশক্তি হচ্ছে পেট্রল! পেট্রল নামের কল্পনা ছাড়া জ্ঞানের গাড়ি নিশ্চল হয়ে এক জায়গায় পড়ে থাকবে, তাকে দিয়ে কোনো কাজ করানো যাবে না। যারা টেলিভিশনের জন্যে নাটক তৈরি করতে খুবই আগ্রহী, তখন তারা আমাকে বোঝান বই খুব বেশি মানুষ পড়ে না, কিন্তু সবাই টেলিভিশন দেখে। আমি তখন তাদের উল্টো বুঝাই, সে জন্যেই বই নামে একটা বিষয়কে বাঁচিয়ে রাখতে হয়, যেন কেউ কেউ সেটা পড়ে অন্যসব সাধারণ মানুষ থেকে আলাদা হয়ে বড় হতে পারে। যারা বই পড়ে তারা অন্য রকম মানুষ। একসময় তারাই দেশ, সমাজ কিংবা পৃথিবীর নেতৃত্বে দেবে। এখন আউট বই পড়ার জন্যে, তারা তাদের বাবা-মা থেকে যতই বকুনি শুনুক, একসময় তারাই হবে গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্যে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানটি আমার খুব প্রিয় একটি উৎসব। আমি যদি সেখানে যাবার সুযোগ পাই তাহলে হাজার হাজার শিশু-কিশোরকে দেখার সুযোগ পাই যারা অন্যদের থেকে ভিন্ন, যারা বই পড়ে। আমি জানি যারা বড় হয়ে তারাই এই দেশকে চালাবে। বইয়ের প্রতিপক্ষ হিসেবে টেলিভিশনের সঙ্গে এখন আরও একটি বিভীষণ যুক্ত হয়েছে, সেটি হচ্ছে কম্পিউটার। কম্পিউটার নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটি তৈরি হয়েছিল কম্পিউট বা হিসাব করার জন্য। এখন মাঝে মাঝেই মনে হয় এটি ব্যবহার করে ‘কম্পিউট’ ছাড়া অন্য সব কাজই করা হয়! সারা পৃথিবীর সকল মানুষের ভেতরে এখন একটা দুর্ভাবনা কাজ করছে; সেটা হচ্ছে আগে যখন তরুণ প্রজন্ম তার সময়ের একটা অংশ পড়ার জন্যে ব্যবহার করত, বেশিরভাগ সময়েই সেই পড়া ছিল খাঁটি পড়া। এখন সেই পড়ার মাঝে ভেজাল ঢুকে যাচ্ছে। এখন তারা অনেক সময় নষ্ট করে সামাজিক নেটওয়ার্কের অপ্রয়োজনীয় ‘স্ট্যাটাস’ পড়ে! সেই পড়াটিও ভাসা ভাসা, যেটুকু পড়ে তার চাইতে বেশি দেখে। বিষয়টি নূতন, তাই কেউই সঠিকভাবে জানে না এর ফলাফলটা কী হবে। যখন কোনো একটা বিষয় সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না, তখন সেটা বিশ্লেষণ করতে হয় কমন সেন্স দিয়ে। আমাদের কমন সেন্স বলে, প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে হয়। যদি প্রযুক্তি আমাদের ব্যবহার করতে শুরু করে তখন বুঝতে হবে কোথাও বড় ধরনের সমস্যা আছে। আমার ধারণা সেটি ঘটতে শুরু করেছে। এই ব্যাপারে প্রযুক্তি আমাদের ব্যবহার করতে শুরু করেছে। ২ বই নিয়ে শুরু করেছিলাম, তাই বই নিয়ে বলতে চাই। আমাদের দেশে ফেব্রুয়ারির বই মেলা নামে একটা অসাধারণ ব্যাপার ঘটে। কেউ যেন ভুলেও মনে না করে এটা বই বিক্রি করার একটা আয়োজন। এটা মোটেও সেটি নয়। আমরা দেখেছি প্রকাশকেরা বিক্রি বাড়ানোর জন্যে মাঝে মাঝে মেলার সময় বাড়িয়ে ফেব্রুয়ারি থেকে ঠেলে মার্চে নিয়ে গেছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, দর্শকেরা ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিনটি পর্যন্ত হইচই করে উৎসাহ নিয়ে মেলায় গিয়েছেন কিন্তু মার্চ মাস আসা মাত্রই তারা মেলায় যাওয়া বন্ধ করে
false
nihar_ronjon_gupta
ছিল কি? হ্যাঁ, ওকে আমি চার বছর ধরে জানি— তার মানে আপনারা পরস্পর পরস্পরকে চার বছর ধরে জানেন? হ্যাঁ। খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল আপনাদের মধ্যে, তাই না? তা ছিল বৈকি— একটা অত্যন্ত ডেলিকেট প্রশ্ন করব— বেশ তো করুন। বিয়ের আগে আপনাদের পরস্পরের মধ্যে মানে বুঝতেই পারছেন কি আমি জানতে চাই– বুঝেছি–হ্যাঁ, আমরা তো জানতামই পরস্পর পরস্পরকে বিবাহ করব, তাই–কিন্তু তা হলেও আপনি যেটা মীন করছেন, দেহের দিক থেকে সেরকমের ঘনিষ্ঠতা কখনও আমাদের মধ্যে বিয়ের আগে হয়নি— হয়নি? না। ওর ধ্যান-ধারণাটা ঠিক আর দশজন পুরুষের মত নয়, ও বলত— কি? দেহের শেষপ্রান্তে উপনীত হয়ে পরস্পর পরস্পরের মধ্যে যে জানাজানি একজন পুরুষ ও স্ত্রীলোকের মধ্যেও বলত, বিয়ের আগে সেটা কাম্য নয়, আনন্দেরও নয়— কেন? ওর ধারণা ছিল—তাহলে তো পরস্পর পরস্পরকে জানার আর কিছুই বাকি রইল না। দেহের দিক থেকে দেউলিয়া হয়ে যাবার মত বিয়ের আগে নির্বুদ্ধিতা নাকি আর কিছু নেই। ডাঃ দাশগুপ্ত বিপাশার কথাগুলো শুনে মৃদু মৃদু হাসছিলেন। এবং এবারে সম্পূর্ণ অন্য প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা মিসেস বক্সী, ঐ মিঃ বক্সী ছাড়া আপনার আর কোন পুরুষ-বন্ধু মানে আর কারও সঙ্গে জানাশোনা ছিল না বিয়ের আগে? হ্যাঁ, ছিল— কে সে? রজতশুভ্র–ভবানীপুরে আমাদের পাড়াতেই থাকত—তার সঙ্গেও খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশেছি আমি একসময়। অনন্যবাবু সেটা জানতেন? জানতেন বৈকি। রজতশুভ্রকে নিয়ে কোনদিন কোন কথা আপনার স্বামী বলেন নি? না। বুঝতে পারছি আপনার প্রতি অনন্যবাবুর বিশ্বাস খুব গভীর ছিল। আচ্ছা, আপনার স্বামীর আপনি ছাড়া অন্য কোন বান্ধবী ছিলেন? বলতে পারব না। মানে–জানেন না? ছিল না বলেই আমার মনে হয়, আর থাকলে সেটা নিশ্চয়ই আমি জানতে পারতাম। ওঁর আর কোন ভাই বোন আছেন? না, বাপ-মায়ের ও একই ছেলে— ওর মা-বাবা বেঁচে আছেন? মা নেই আর ওর বাবা-মানে আমার শ্বশুরমশাই—বিপাশা হঠাৎ যেন থেমে গেল। বলুন? আমার শ্বশুরের মাথার গোলমাল আছে শুনেছি— পাগল? হ্যাঁ, রাঁচীতে মেন্টাল অ্যাসাইলামে আছেন— কতদিন হবে? শুনেছি আমার শাশুড়ির মৃত্যুর পরই ওঁর মাথার গোলমাল দেখা দেয়—একটা কথা আপনাকে বোধ হয় বলা আমার উচিত ডাঃ দাশগুপ্ত, আমার শাশুড়ির মৃত্যুর ব্যাপারটা ঠিক স্বাভাবিক নয়, যতদূর আমি শুনেছি– কি হয়েছিল তাঁর–মানে কিসে মৃত্যু হয় আপনি নিশ্চয়ই জানেন! বিশদভাবে ঠিক জানি না ব্যাপারটা– জানেন না? না। এইটুকু শুধু জানি—মানে ওর মুখেই একদিন শুনেছিলাম—বলতে বলতে বিপাশা যেন ইতস্তত করে থেমে যায়। বলুন—থামবেন না! আমার শাশুড়ির নাকি কি একটা দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল। দুর্ঘটনা! হ্যাঁ। অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন নাকি আমার শাশুড়ি, ওর যখন বছর দশ এগারো বয়েস তিনি দুর্ঘটনায় মারা যান। কি হয়েছিল ঠিক জানেন কিছু? না। আপনার স্বামীকে কথাটা কখনও জিজ্ঞাসা করেন নি? না। কেন? কারণ বুঝতে পেরেছিলাম, মায়ের অস্বাভাবিক মৃত্যুটা ওর মনের মধ্যে একটা প্রচণ্ড আঘাত, হেনেছিল। তাই পারতপক্ষে ওর মার সম্পর্কে কখনও কোন প্রশ্নই আমি করিনি। ডাঃ দাশগুপ্ত যেন কি ভাবছিলেন, আর কোন প্রশ্ন করলেন না। বিপাশা প্রশ্ন করল, ডাঃ দাশগুপ্ত! বলুন। আমার স্বামী আবার আগের মত সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে উঠবেন তো? মনে তো হয়— মনে তো হয় বলছেন কেন? কথাটা কি জানেন মিসেস বক্সী, ওঁর, মানে আপনার স্বামীর মনের মধ্যে কোন কিছুর প্রতিক্রিয়া খানিকটা কুয়াশার মত ঝাপসা হয়ে আছে—যে কুয়াশাটা উনি কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছেন না, সেটার ঠিক ঠিক বিশ্লেষণে না পৌছানো পর্যন্ত—অবিশ্যি আমি চেষ্টা করব, যাতে উনি আবার আগের মত সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারেন তবে আপনার স্বামীর কোঅপারেশন চাই সর্বাগ্রে এবং শুধু ওঁর নয়, আপনারও– আমাকে কি করতে হবে বলুন? কেসটা আমাকে একটু ভাবতে দিন মিসেস বক্সী, দিন পনেরো পরে আবার আসবেন আপনার স্বামীকে নিয়ে কিছুদিন পর পর আমি ওঁকে নিয়ে সিটিং দেবো! আসব। অতঃপর আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর ডাঃ দাশগুপ্তর নিকট হতে বিদায় নিয়ে বিপাশা ওঁর ঘর থেকে বের হয়ে এল। ওল্ড বালিগঞ্জ সারকুলার রোডে একটা আটতলা ফ্ল্যাটবাড়ির পাশেই বক্সীর বাড়ি। চারতলা বাড়ি। বাড়িটা তৈরি করেছিলেন অনন্য বক্সীর বাবার বাবা অরিন্দম বক্সী বার-এট-ল। অরিন্দম বক্সী ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের একজন নামজাদা ব্যারিস্টার। প্রচুর ইনকাম ছিল তাঁর। এক মেয়ে এক ছেলে—অনন্য বক্সীর বাবা অনিন্দ্য বক্সী আর শ্রীমতী। অনন্য বক্সীর বাবা অনিন্দ্য বক্সীও বিলাত গিয়েছিলেন ব্যারিস্টারি পড়তে, কিন্তু ব্যারিস্টার হয়েই ফিরে এসেছিলেন কয়েকটা বছর সেখানে স্ফুর্তি করে। অবিশ্যি ব্যারিস্টারি পাস করবার প্রয়োজনও ছিল না তার কারণ বাপের ঐ বাড়ি ছাড়াও প্রচুর ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স ছিল এবং সেটা একজনের পক্ষে যথেষ্ট। অনন্যর মা প্রতিমা নামেও প্রতিমা ছিলেন, দেখতেও যেন প্রতিমার মত—যে কলেজে পড়তেন প্রতিমা, সেখানকার কলেজ-বিউটি ছিলেন তিনি। অনিন্দ্য বক্সীর হবি ছিল গলফ আর পিংপংকলকাতা শহরের একটা নামজাদা ক্লাবের মেম্বার ছিলেন তিনি। অবিশ্যি সবই পরে ডাঃ দাশগুপ্ত একটু একটু করে প্রশ্ন করে করে অনন্য বক্সীর মুখ থেকেই শুনেছিলেন। আরও একটা ব্যাপার, অনিন্দ্য বক্সীর নেশা ছিল মদ্যপান। স্কচের একজন যাকে বলে কনোসিয়োর ছিলেন তিনি। বাড়ির মধ্যেই একটা বার তৈরি করেছিলেন। ক্লাবে তিনি কিন্তু মদ্যপান করতেন না—মদ্যপান করতেন গৃহে ফিরে। এবং একা নয়—সে সময় তার সঙ্গিনী হতেন তার স্ত্রী প্রতিমা। প্রতিমা অবিশ্যি দু-এক পেগের বেশী কোনদিনই পান করতেন না, কিন্তু মধ্যরাত্রি পর্যন্ত চালিয়ে যেতেন অনিন্দ্য বক্সী। ড্রাইভার রতন সিং গাড়ি চালাচ্ছিল। পিছনের সীটে পাশাপাশি বসেছিল অনন্য আর বিপাশা। বিপাশার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে টেনে নিয়ে
false
shirshendu
যাবে না তো! দেখি শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তোর পইতের দিন কবে ঠিক হল আগে জেনে নিই। ছোড়দি কেমন আছে গো, বউদি? ভালই তো! না। ছোড়দিটা বড় কান্নাকাটি করত। ওর জন্যই আরও আমি পালিয়ে চলে এসেছি। ভাবিস না। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। মেয়েরা কথায় কথায় কাঁদে।–বলতে বলতে আনমনে দরজার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে বলে, যোগীবর, তোমার ভয় নেই। আমি তোমাকে যোগভ্রষ্ট করতে এ ঘরে আসব না। তবে মাঝে মাঝে দেখে যাব। তাতে দোষ নেই তো! শৈশব ও যৌবনের মধ্যবর্তী একটা অদ্ভুত দ্বৈত সত্তার টানাপোড়েন চলছে এখন কৃষ্ণকান্তর মধ্যে। সে এবার যে হাসিটা হাসল তা শিশুর মতো। বলল, কী যে বলো না! চপলা অন্ধকার মাঠটা ধীর পায়ে পার হয়। ধীরে ধীরে নিজের ঘরে আসে সে। আজ সন্ধেবেলায় এই ঘরের দরজার কাছেই তাকে স্পর্শ করেছিল শচীন। তার সমস্ত শরীর শাঁখের মতো বেজে উঠেছিল সেই স্পর্শে। সাড়া দিয়েছিল। অনাবৃষ্টির তৃষিত শরীরও ছিল পুরুষ-স্পর্শের জন্য উন্মুখ। কিন্তু এই প্রাচীন বাড়ির পুরনো বদ্ধ বাতাসে সংস্কারের ভূতও তো কিছু আছে, যেমন আছে গুপ্ত প্রণয়ের অনেক কেলেঙ্কারি। চপলার অর্ধেক মন নত হয়েছিল শচীনের কাছে, বাকি অর্ধেক আড় হয়ে ছিল। চপলা জলে ভিজিয়ে খুব ধীরে ধীরে সাবধানে খামের জোড় খুলে ফেলে। বর্ষাকালের ভেজা বাতাসে আঠা তেমন জোড়েনি ভাল করে। চমৎকার নীলাভ একটা কাগজে ছোট ছোট সুন্দর হস্তাক্ষর। বিশাখা, তোমার চিঠি পেয়েছি। এত কিছু হয়ে যাওয়ার পর নতুন করে আবার তোমার কাছ থেকে এরকম প্রস্তাব আশা করিনি। হঠাৎ কেনই বা এরকম পাগলের মতো আচরণ করছ? আমার বিয়ে করবার কোনও সংকল্প নেই। বাড়ি থেকে যে প্রস্তাব উঠেছিল তাতে আমি অসম্মতি জানিয়ে দিয়েছি। জীবন অনেক বড় এবং জটিল। তোমাকে যদি আমি উদ্ধার না করি তবে তুমি গলায় দড়ি দেবে ইত্যাদি লিখেছ। ঠাকুর-দেবতার নামে অনেক ভয় দেখিয়েছ। এসব বড় বাড়াবাড়ি। আমার জন্য তোমার এত আগ্রহ এতকাল কোথায় ছিল? তুমি সুন্দরী, সুপাত্রের অভাব হবে না। উপরন্তু কোকাবাবুর নাতি শরতের প্রতি নিজের দুর্বলতার কথা তুমি নিজেই প্রচার করেছ। তারপরও এই নাটক কেন? আমি নাটক পছন্দ করি না। তবে তোমার প্রতি আমার স্নেহ আছে। কিন্তু তোমার প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়। আশা করি বুঝবে।–শচীন। রাজার ফ্ল্যাট যেমন ফাঁকা হবে বলে ভেবেছিল রেমি, তা নয়। আসলে রাজাদের বাসায় এর আগে কখনওই আসেনি রেমি। আসার প্রয়োজনও দেখা দেয়নি। সে শুনেছে, রাজার বাবা-মা দিল্লিতে থাকে। এখানে সে একা। কিন্তু একদম একা যে নয় তা রেমি জানত না। রাজার ফ্ল্যাটে তার এক বিধবা দিদি এবং তার মেয়ে থাকে। দিদির বয়স চল্লিশের ওপর। তার মেয়েটি যুবতী এবং দুর্দান্ত সুন্দরী। দরজা খুলে সে যখন চৌকাঠের ফ্রেমে দেখা দিল তখন বড় ম্লান হয়ে গেল রেমি। মেয়েটিকে দেখে এমন একটা ধাক্কা লাগল রেমির মনে যে, তার এতক্ষণের দুঃসাহস ও নিয়ম ভাঙার আগ্রহ উবে গেল। মেয়েটিকে দেখামাত্র সে নিজের সঙ্গে মেয়েটির একটা চটজলদি তুলনা সেরে নিল মনে মনে। না, সে সুন্দরী হলেও এ মেয়েটির কাছে দাঁড়াতেই পারবে না। রাজাকে দেখে মেয়েটি একটু অবাক হয়ে বলল, তুমি এই দুপুরে ফিরলে যে! এমনি।–বলে রেমির দিকে চেয়ে রাজা বলে, আমার ভাগনি। জয়িতা। জয়িতা রেমির পরিচয় পেয়ে চোখ বড় বড় করে বলে, ধ্রুবমামার বউ! উঃ, কী দারুণ! রেমি মৃদু একটু হেসে বলে, দারুণ কেন? জয়িতা দরজা ছেড়ে ভিতরের দিকে সরে গিয়ে বলল, আসলে দারুণ হল ধ্রুবমামা। আমরা সবাই কমামার ভক্ত। এ সময়ে ধ্রুবর প্রসঙ্গ ভাল না লাগারই কথা রেমির। কিন্তু আশ্চর্য–লাগল। জয়িতা তার হাত ধরে ড্রয়িংরুমের একধারে দেয়ালে একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট মুরালের নীচে চমৎকার নরম ডিভানে নিয়ে গিয়ে টেনে বসাল। বলল, তোমার কথাও ভীষণ শুনি। তুমি তো দারুণ সুন্দরী। তোমার কাছেও? আমি! আমার রংটাই যা ফরসা। চুল নেই, দেখো না!–বলে নিজের চুল সামনে টেনে এনে দেখায় জয়িতা। বলে, তুমি হচ্ছ সত্যিকারের সুন্দরী। আমি দেখন সুন্দরী। রেমি রাজার সঙ্গে কুলের মুখে কালি দিতে এসেছিল এখানে। মনটা ছিল উত্তেজনা ও রাগে টানটান। ধ্রুব তাকে বলেছে, গো আহেড। ভিতরটা পাগল-পাগল ছিল সেই থেকে। হঠাৎ সব ভুলে গিয়ে খুব হাসল রেমি, বলল, তুমি তো বেশ কথা বলো! জয়িতা আচমকা রেমিকে দু’হাতে ধরে বলল, জানো আমরা সবাই তোমাকে হিংসে করি? আমাকে? আমাকে হিংসে করার কী আছে? অনেক কিছু আছে। ওরকম জঁদরেল শ্বশুর, অত টাকা, ক্ষমতা। কিন্তু আমরা তোমাকে হিংসে করি তোমার স্বামী-ভাগ্যে। ধ্রুবমামার মতো একজন প্লেবয়কে কী করে বাগালে বলো তো! প্লে-বয় কী? ওঃ, তুমি তো আবার সেকেলে। মোটেই সেকেলে নই। ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্রী। তবে যাকে প্লে-বয় বলে, ও তো ঠিক তা নয়। নয় বুঝি! মোটেই নয়। বাইরে থেকে মনে হয়। আমরা তো বাইরে থেকেই মনে করি। তুমি মামি এবার ভিতরের খবর একটু আধটু বলো। রাজা ঘরে ঢোকবার পরই ভিতরের দিকে কোথায় যেন গেছে। এখনও দেখা নেই। তাতে বেঁচে গেছে রেমি। বাজার সঙ্গে নিভৃত হওয়ার চিন্তাটাই যেন তার কাছে অস্পৃশ্য মনে হচ্ছে। কেন যে এরকম হল তা বুঝল না রেমি। কিন্তু জয়িতাকে ধ্রুবর কথা বলার মধ্যে যে শিহরিত আনন্দ পেতে লাগল সে তা বলার নয়। একদম পাগল। বুঝলে, একদম পাগল! যখন ভাল তখন ওর মতো ভাল নেই, আবার যখন বিগড়ে যায় তখন সেই বাঁকা
false
humayun_ahmed
যেতে রাজি নয়। আমি একাই গেলাম। বিরাট একটা দরখাস্তও লেখা হলো। ক্লাস টেনের বগা ভাই (আসল নাম বদরুল ইসলাম। খুব লম্বা বলে আমরা তাকে ডাকি বগা ভাই) হেড স্যারের হাতে দরখাস্ত তুলে দিল। হেড স্যার বললেন, ব্যাপার কী? বগা ভাই তোতলাতে তোতলাতে বলল, দরখাস্তে সব লে-লে-লে-লেখা আছে স্যার। বগা ভাইয়ের এই একটা অসুবিধা, ভয় পেলে তোতলাতে শুরু করে। এবং প্রতিটি বাক্য দুবার করে বলে। সে আবার বলল, দরখাস্তে সব লে-লে-লে-লেখা আছে স্যার। লেখা যে আছে তা তো দেখতেই পাচ্ছি। ব্যাপারটা কী তোমাদের মুখ থেকে শুনতে চাই। আম-কাঁঠালের ছুটি দুই সপ্তাহ এগিয়ে দিলে ভালো হয় স্যার। কেন? আমরা সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। ছুটি এগিয়ে দিলে কেন ভালো হয়, তা নিয়ে আমরা আলোচনা করি নি। হেড স্যার হুংকার দিয়ে বললেন, চুপ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কথা বল। কেউ নড়াচড়া করছে না দেখে সাহসে ভয় করে আমিই মুখ খুললাম। মিনমিন করে বললাম, এইবার তো স্যার গরম খুব বেশি পড়েছে, আম-কাঁঠাল সব আগে আগে পেকে গেছে। এই জন্যে স্যার ছুটিটা যদি এগিয়ে দেন। আম-কাঁঠাল পাকানো কাকে বলে জানিস? জি-না স্যার। এক্ষুণি দেখবি কাকে বলে। কত বড় সাহস। বলে ছুটি এগিয়ে দিতে। যা ক্লাসে যা। ক্লাসে গিয়ে নীলডাউন হয়ে থাক। ক্লাসে ফিরে এসে নীলডাউন হয়ে আছি। বশির দাঁত বের করে হাসছে। কাউকে শাস্তি দিতে দেখলে তার ভারি আনন্দ হয়। সে আজ আর আনন্দ চেপে রাখতে পারছে না। কিছুক্ষণ পর পর সব কাটা দাঁত বের করে দিচ্ছে। টিফিন টাইমে দপ্তরি কালিপদ নোটিশ নিয়ে এলো। হেড স্যার নোটিশ পাঠিয়েছেনছাত্রদের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে এই বৎসরের গ্ৰীষ্মকালীন বন্ধের সময়সীমা দুই সপ্তাহ কমিয়ে দেয়া হলো। নির্ধারিত সময়ের দুই সপ্তাহ পর থেকে বন্ধ শুরু হবে। এই নিয়ে কোনো রকম দেন-দরবার না করবার জন্য ছাত্রদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। ছুটির পর খুবই মন খারাপ করে বাসায় ফিরলাম। কী করা যায় কিছুই বুঝতে পারছি না। এখন ছুটি এগিয়ে আনবার দরকার নেই; যথাসময় ছুটি আরম্ভ হলেই আমরা খুশি। তেমন কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। আমাদের হেড স্যার খুব কঠিন চিজ। সন্ধ্যার আগে আগে মুনির এসে উপস্থিত। সেও ছুটি কমে যাওয়ায় মন খারাপ করেছে। এই ছুটিতে তার মামাবাড়ি যাবার কথা। ছুটি কমে গেলে আর যাওয়া হবে না। মুনির বলল, চল তাঁর কাছে যাই। তিনি যদি কোনো বুদ্ধি দেন। কার কথা বলছিস? আমাদের যিনি ভূতেব বাচ্চা দিলেন। ঐ যে রবীন্দ্রনাথের মতো দেখতে। উনি বুদ্ধি দেবেন কেন? দিতেও তো পাবেন। আমাদের কথা তো উনি শোনেন। শোনেন না? চল চাই। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে উনি হেড স্যারের মতো রেগে যাবেন। সব বড়রা এক রকম হয়। তবু বলে দেখি। বুড়ো ভদ্রলোক দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে আমাদের সমস্যা শুনলেন। তারপর বললেন, অন্যায়, খুবই অন্যায়। ছুটি কমাবার কোনো রাইট নেই। বাচ্চা ছেলেগুলোকে সারাদিন স্কুলে আটকে রেখেও শখ মিটছে না, এখন আবার ছুটি কমিয়ে দিচ্ছে। রবি ঠাকুর বেঁচে থাকলে খুব রাগ করতেন। আমি বললাম, এখন আমরা কী করব বলুন। ভূতের বাচ্চাকে বলা ছাড়া তো কোনো পথ দেখছি না। আমি অবাক হয়ে বললাম, ভূতের বাচ্চাকে কী বলব? তোমাদের সমস্যার কথা বলবে। কবে থেকে স্কুল বন্ধ করতে চাও এটা বলে দেবে, তাহলেই হবে। কী যে আপনি বলেন। কী যে আমি বলি মানে? এক চড় লাগাব, বুঝলে। যা করতে বলছি করা। বোতলটা মুখের কাছে এনে ফিসফিস করে বলবে। বলবে যেন আগামীকাল থেকেই আম-কাঁঠালের ছুটি দেবার ব্যবস্থা করে। খুব ভদ্রভাবে বলবে। আরেকটা কথা, মাসে একবারের বেশি কিছু চাইবে না, ভূত এখনো খুবই বাচ্চা। ক্ষমতা কম। আরেকটু বড় হোক, তখন ঘনঘন চাইতে পারবে। আমি বললাম, থ্যাংক ইউ। বুড়ো আগুন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার সঙ্গে ইংরেজি? এর মানে কী? ক্ষমা করে দিন স্যার। আর বলব না। আমরা এখন যাই স্যার? না। আমি গতকাল একটা কবিতা লিখেছি, এটা শুনে তারপর যাও। তোমাদের নিয়েই লেখা। কবিতার নাম বীর শিশু। মনে কর যেন বিদেশ ঘুরে মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে। তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার পরে টগ্‌বগিয়ে তোমার পাশে পাশে। আমার কেন জানি মনে হলো এই কবিতাটা আগেও শুনেছি। তবে সেই কবিতাটার নাম ছিল বীরপুরুষ, বীবিশিশু নয়। তবে এটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি এখন না করাই আমার কাছে ভালো মনে হলো। বুড়োকে বাগানো ঠিক হবে না। আমরা বাড়ি চলে এলাম। বুড়োর কথা ঠিক বিশ্বাস হলো না। বোতলের ভেতর ভূত যদি থেকেও থাকে সে স্কুল বন্ধ করবে। কীভাবে? তবু রাতে শোবার আগে ট্রাংক থেকে বোতল বের করে ফিসফিস করে বললাম, ভাই বোতল ভূত, তুমি কেমন আছ? ভাই তুমি কি আমাদের স্কুলটা আগামীকাল থেকে বন্ধ করে দিতে পারবে? লক্ষ্মী ভূত, ময়না ভূত। দাও না বন্ধ করে। অরু আপা কী কাজে যেন ঘরে ঢুকেছিল। সে অবাক হয়ে বলল, এসব কী হচ্ছে রে? আমি বললাম, কিছু হচ্ছে না। কার সঙ্গে কথা বলছিস? বোতলের ভূতের সঙ্গে। অরু আপা গম্ভীর হয়ে বলল, বোতলের ভূতের সঙ্গে কী কথা হচ্ছিল শুনি। তোমার শোনার দরকার নেই। আহা শুনি না। বোতলের ভূতকে বলেছি আগামীকাল থেকে স্কুল বন্ধ করে দিতে। সে
false
shirshendu
কারও সঙ্গে তার তেমন সম্পর্ক রচিত হয় না বটে। কিন্তু এই অদ্ভুত প্রাণময় গ্রহটির প্রতি হয়। দোলন তার সরু গলায় খুব সাবধানে ডাকল, বাবা। উঁ! গভীর আনমনা কৃষ্ণজীবন জবাব দিল। কী ভাবছো বাবা? কৃষ্ণজীবন মাথাটা সামান্য নত করে বলে, আমরা যখন ছোটো ছিলাম তখন আমাদের গায়ে অনেক গাছপালা ছিল। তুমি কেন শুধু গাছপালার কথা ভাবছো বাবা? কেন ভাবছি! তোমাকে যে এই পৃথিবীতে রেখে যেতে হবে আমাকে। মানুষ যে কেন তার সন্তানের কথা ভাবে না। আমি গাছ কাটব না বাবা। আমি কখনও পৃথিবীর দাড়ি কামিয়ে দেবো না। মেঘলা দিনের কালো আলোয় ঘরের মধ্যে দুটি ছাইরঙা মানুষ দুজনের দিকে চেয়ে আছে। বাইরে সরু সরু অজস্র সাদা সুতোর মতো ঝুলে আছে বৃষ্টি। টিনের চালে ঝিমঝিম নেশাড় শব্দ। কথা নেই। বীণাপাণি আর নিমাই। সেদিন অনেকক্ষণ পগার আচমকা মৃত্যুসংবাদটা ভাল করে বসছিল না বীণাপাণির মাথায়। কাঁদবে, না হোঃ হোঃ করে লটারি জেতার মতো আনন্দে হেসে উঠবে, সেটা তার ভিতরে তখনও স্থির হয়নি। আর ওই উজবুক লোকটা, পাঁচ ফুটিয়া, রোগাভোগা, ভীতু আর ধার্মিক লোকটা, চোখ তুলে ভাল করে বীণার দিকে যে তাকাতেই পারল না আজ অবধি, সেই লোকটা কেমন যেন চোখা চোখে চেয়ে ছিল তার চোখে। লোকটার সামনে গোছানো সুটকেস। একটু বাদেই চৌকাঠ পার হবে। তারপর হয়তো আর কোনওদিনই উল্টোবাগে চৌকাঠ পেরিয়ে এসে ঢুকবে না বীণাপাণির ঘরে। বীণাপাণি এরকম অদ্ভুত অবস্থায় আর জীবনে পড়েনি। শোক, আনন্দ, উত্তেজনা, রাগ, ঘেন্না সব একসঙ্গে উথলে উঠছে ভিতরে। ঠিক এই সময়ে যদি চৌকির তলা থেকে তার পোষা বেড়াল কুঁচকি বেরিয়ে এসে তার কোলে না উঠে পড়ত, তাহলে কী যে করত বীণাপাণি কে জানে? কুঁচকিই সব কাটিয়ে দিল একটা আদুরে মিয়াও শব্দ তুলে। তার খিদে পেয়েছে। বীণাপাণি বেড়ালটাকে বুকে চেপে ধরল। তার বুদ্ধি এখন স্থির নেই। মাথার ভিতরটা পাগল-পাগল। বুকটায় বড় দাপাদাপি। কী বলতে কী বলবে, কী করতে কী করে বসবে, কে জানে বাবা! আর ওই আহাম্মক লোটা তাকে কেন যে ওরকম করে দেখতে লেগেছে! বীণাপাণির কি একটু কাঁদা উচিত? বাড়াবাড়ি হবে না তো! কদল না, তবে কাঁদার মতো একটা অবস্থায় সে থেমে রইল। চোখ ভরে উঠল জলে, কিন্তু গড়িয়ে পড়ল না। স্থির হয়ে জানালা দিয়ে বাইরের অজস্র সুতোর বুনটের মতো একঘেয়ে বৃষ্টির দিকে চেয়ে রইল। নিমাই এ সময়ে একটা গলা খাকারি দিল। তারপর তার সরু নরম মেয়েলি গলায় জিজ্ঞেস করল, ছেলেটা কি পগার খবর দিয়ে গেল? বীণা জবাব দিল না। নিমাই জবাবের জন্য অপেক্ষা করল একটু। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, এরকম সব কাণ্ড হয় বলেই তোমায় বারণ করেছিলাম। বীণা চুপ করে যেমন চেয়েছিল তেমনি চেয়ে রইল। বাইরে চুপ বটে, কিন্তু তার ভিতরে এ সময়ে একটা কথা কাটাকাটি হচ্ছিল। ঠিক এরকম একটা গোলমেলে ব্যাপারের মধ্যে নিমাই চলে গেলে তার কি হবে? ওকে চলে যেতে দেওয়া কি ঠিক হবে? রাগের মাথায়, কেঁকের মাথায় যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। কিন্তু এখন তো সেই অবস্থাটা নেই। তাকে বুদ্ধি দেবে কে? বুদ্ধি চাইলে অনেকেই মাথা ধার দিতে আসবে, কিন্তু বীণাপাণির ভাল-মন্দ বুঝে কথা কইবে কি কেউ? তার বন্ধু অনেক, কিন্তু আত্মীয় তো এই একজনই। মাদামারা, পান্তাভাত, সব ঠিক। তবু নিমাই তো লোভী নয়, পাজি নয়, ধান্দাবাজ নয়। বকাঝকা-অত্যাচার ওর ওপর কম করে না বীণা! তবু নির্ভর করে। ওকে চলে যেতে দেওয়া কি উচিত কাজ হবে! আটকানোই বা যায় কি করে? নিমাই উঠবার মতো একটু ভাব করে ফের বসে পড়ল উবু হয়ে, তারপর খুব সংকোচের সঙ্গে বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করি। এ কথাটার জবাব অন্তত মাথা নেড়ে হলেও দাও। পা কি কাল রাতে টাকা পয়সা কিছু তোমার কাছে গচ্ছিত রেখে গেছে? এই প্রশ্নটাকেই ভয় পাচ্ছিল বীণা। পগা এসেছিল সন্ধের মুখে। খুব তাড়া ছিল। বৃষ্টি হচ্ছিল তুমুল। নিমাই কোথায় বেরিয়েছে। খুব হাওয়া। হ্যারিকেনের আলোয় একখানা একসারসাইজ খাতা খুলে পরশমণি নামে একটা নতুন নাটকের পার্ট মুখস্থ করছিল বীণাপাণি। দরজায় ধাক্কা আর ডাকাডাকিতে উঠে দরজা খুলে দেখল, বর্ষাতি গায়ে পগা। জলে সপসপ করছে। মুখে একগাল হাসি। ফোম লেদারের ব্যাগ থেকে পলিথিনে মোড়া একটা প্যাকেট বের করে বীণার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, কাল সকালে নিয়ে যাবো। বেশ ভারী প্যাকেট। এরা যে তাকে বিশ্বাস করে, ভালবেসে এসব রেখে যায় তা নয়। এরা জানে এদের টাকা পয়সা মেরে দিয়ে বীণাপাণি পার পাবে না। সীমান্ত জুড়ে এদের জাল বিছিয়ে রাখা আছে। সেই জাল কেটে বীণাপাণি কত দূর যারে? যতদিন মাথা নিচু করে চলবে ততদিন ঠিক আছে। গড়বড় করলে রেহাই নেই। বীণা বাধ্য মেয়ের মতো প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বলল, ঠিক আছে। পগা আবার অন্ধকারে বাতাস-বৃষ্টির মধ্যে মিলিয়ে গেল। দরজা এঁটে বীণাপাণি প্যাকেটটা তেরঙ্গে রেখে তালা দিয়েছিল। এ সব প্যাকেটে কী থাকে তা তার জানতে নেই। জানতে চায়ও না সে। শুধু হেরোইন-টেরোইন না থাকলেই হল। পগা অবশ্য ও কারবার করে না। সে ডলার পাউন্ড আর টাকার লেনদেন করে। কেউ দেখেনি। কেউ জানে না। বীণাপাণির অভিনয়ের প্রতিভা এখন কাজে লাগল। সে অকপটে নিমাইয়ের দিকে চেয়ে কঠিন দৃঢ় গলায় বলে না। পগা রোজ আমার কাছে টাকা-পয়সা রেখে যায় না। পার্টটা চমৎকার হল। নিমাই চোখ নামিয়ে নিয়ে
false
robindronath
করিয়া দিল। সে বলিয়াছিল, সে বিনোদিনীকে ভালোবাসে না; কিন্তু যাহা শুনিল, যাহা দেখিল, তাহা তাহাকে সুস্থির হইতে দিল না, তাহাকে চারি দিক হইতে বিচিত্র আকারে পীড়ন করিতে লাগিল। আর কেবলই নিষ্ফল পরিতাপের সহিত মনে হইতে লাগিল, “বিনোদিনী শুনিয়াছে–আমি বলিয়াছি “আমি তাহাকে ভালোবাসি না” ২৪ মহেন্দ্র ভাবিতে লাগিল, “আমি বলিয়াছি মিথ্যা কথা, আমি বিনোদিনীকে ভালোবাসি না”। অত্যন্ত কঠিন করিয়া বলিয়াছি। আমি যে তাহাকে ভালোবাসি তাহা না-ই হইল, কিন্তু ভালোবাসি না, এ কথাটা বড়ো কঠোর। এ কথায় আঘাত না পায় এমন স্ত্রীলোক কে আছে। ইহার প্রতিবাদ করিবার অবসর কবে কোথায় পাইব। ভালোবাসি এ কথা ঠিক বলা যায় না; কিন্তু ভালোবাসি না, এই কথাটাকে একটু ফিকা করিয়া, নরম করিয়া জানানো দরকার। বিনোদিনীর মনে এমন-একটা নিষ্ঠুর অথচ ভুল সংস্কার থাকিতে দেওয়া অন্যায়।” এই বলিয়া মহেন্দ্র তাহার বাক্সর মধ্য হইতে আর-একবার তাহার চিঠি তিনখানি পড়িল। মনে মনে কহিল, “বিনোদিনী আমাকে যে ভালোবাসে, ইহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু কাল সে বিহারীর কাছে অমন করিয়া আসিয়া পড়িল কেন। সে কেবল আমাকে দেখাইয়া। আমি যখন তাহাকে ভালোবাসি না স্পষ্ট করিয়া বলিলাম, তখন সে কোনো সুযোগে আমার কাছে তাহার ভালোবাসা প্রত্যাখ্যান না করিয়া কী করিবে। এমনি করিয়া আমার কাছে অবমানিত হইয়া হয়তো সে বিহারীকে ভালোবাসিতেও পারে।” মহেন্দ্রের ক্ষোভ এতই বাড়িয়া উঠিতে লাগিল যে, নিজের চাঞ্চল্যে সে নিজে আশ্চর্য এবং ভীত হইয়া উঠিল। নাহয় বিনোদিনী শুনিয়াছে, মহেন্দ্র তাহাকে ভালোবাসে না–তাহাতে দোষ কী। নাহয় এই কথায় অভিমানিনী বিনোদিনী তাহার উপর হইতে মন সরাইয়া লইতে চেষ্টা করিবে–তাহাতেই বা ক্ষতি কী।ঝড়ের সময় নৌকার শিকল যেমন নোঙরকে টানিয়া ধরে, মহেন্দ্র তেমনি ব্যাকুলতার সঙ্গে আশাকে যেন অতিরিক্ত জোর করিয়া ধরিল। রাত্রে মহেন্দ্র আশার মুখ বক্ষের কাছে ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “চুনি, তুমি আমাকে কতখানি ভালোবাস ঠিক করিয়া বলো।” আশা ভাবিল, “এ কেমন প্রশ্ন। বিহারীকে লইয়া অত্যন্ত লজ্জাজনক যে-কথাটা উঠিয়াছে, তাহাতেই কি তাহার উপরে সংশয়ের ছায়া পড়িয়াছে।” সে লজ্জায় মরিয়া গিয়া কহিলল, “ছি ছি, আজ তুমি এমন প্রশ্ন কেন করিলে। তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমাকে খুলিয়া বলো–আমার ভালোবাসায় তুমি কবে কোথায় কী অভাব দেখিয়াছ।” মহেন্দ্র আশাকে পীড়ন করিয়া তাহার মাধুর্য বাহির করিবার জন্য কহিল, “তবে তুমি কাশী যাইতে চাহিতেছ কেন।” আশা কহিল, “আমি কাশী যাইতে চাই না, আমি কোথাও যাইব না।” মহেন্দ্র। তখন তো চাহিয়াছিলে। আশা অত্যন্ত পীড়িত হইয়া কহিল, “তুমি তো জান, কেন চাহিয়াছিলাম।” মহেন্দ্র। আমাকে ছাড়িয়া তোমার মাসির কাছে বোধ হয় বেশ সুখে থাকিতে। আশা কহিল, “কখনো না। আমি সুখের জন্য যাইতে চাহি নাই।” মহেন্দ্র কহিল, “আমি সত্য বলিতেছি চুনি, তুমি আর-কাহাকেও বিবাহ করিলে ঢের বেশি সুখী হইতে পারিতে।” শুনিয়া আশা চকিতের মধ্যে মহেন্দ্রের বক্ষ হইতে সরিয়া গিয়া, বালিশে মুখ ঢাকিয়া, কাঠের মতো আড়ষ্ট হইয়া রহিল–মুহূর্তপরেই তাহার কান্না আর চাপা রহিল না। মহেন্দ্র তাহাকে সান্ত্বনা দিবার জন্য বক্ষে তুলিয়া লইবার চেষ্টা করিল, আশা বালিশ ছাড়িল না। পতিব্রতার এই অভিমানে মহেন্দ্র সুখে গর্বে ধিক্‌কারে ক্ষুদ্ধ হইতে লাগিল। যে-সব কথা ভিতরে-ভিতরে আভাসে ছিল, সেইগুলা হঠাৎ স্পষ্ট কথায় পরিস্ফুট হইয়া সকলেরই মনে একটা গোলমাল বাধাইয়া দিল। বিনোদিনী মনে মনে ভাবিতে লাগিল–অমন স্পষ্ট অভিযোগের বিরুদ্ধে বিহারী কেন কোনো প্রতিবাদ করিল না। যদি সে মিথ্যা প্রতিবাদও করিত, তাহা হইলেও যেন বিনোদিনী একটু খুশি হইত। বেশ হইয়াছে, মহেন্দ্র বিহারীকে যে-আঘাত করিয়াছে, তাহা তাহার প্রাপ্যই ছিল। বিহারীর মতো অমন মহৎ লোক কেন আশাকে ভালোবাসিবে। এই আঘাতে বিহারীকে যে দূরে লইয়া গেছে, সে যেন ভালোই হইয়াছে–বিনোদিনী যেন নিশ্চিন্ত হইল। কিন্তু বিহারীর সেই মৃত্যুবাণাহত রক্তহীন পাংশু মুখ বিনোদিনীকে সকল কর্মের মধ্যে যেন অনুসরণ করিয়া ফিরিল। বিনোদিনীর অন্তরে যে সেবাপরায়ণা নারীপ্রকৃতি ছিল, সে সেই আর্ত মুখ দেখিয়া কাঁদিতে লাগিল। রুগ্‌ণ শিশুকে যেমন মাতা বুকের কাছে দোলাইয়া বেড়ায়, তেমনি সেই আতুর মূর্তিকে বিনোদিনী আপন হৃদয়ের মধ্যে রাখিয়া দোলাইতে লাগিল; তাহাকে সুস্থ করিয়া সেই মুখে আবার রক্তের রেখা, প্রাণের প্রবাহ, হাস্যের বিকাশ দেখিবার জন্য বিনোদিনীর একটা অধীর ঔৎসুক্য জন্মিল। দুই-তিন দিন সকল কর্মের মধ্যে এইরূপ উন্মনা হইয়া ফিরিয়া বিনোদিনী আর থাকিতে পারিল না। বিনোদিনী একখানি সান্ত্বনার পত্র লিখিল, কহিল- “ঠাকুরপো, আমি তোমার সেদিনকার সেই শুষ্ক মুখ দেখিয়া অবধি প্রাণমনে কামনা করিতেছি, তুমি সুস্থ হও, তুমি যেমন ছিলে তেমনিটি হও–সেই সহজ হাসি আবার কবে দেখিব, সেই উদার কথা আবার কবে শুনিব। তুমি কেমন আছ, আমাকে একটি ছত্র লিখিয়া জানাও। তোমার বিনোদ-বোঠান।” বিনোদিনী দরোয়ানের হাত দিয়া বিহারীর ঠিকানায় চিঠি পাঠাইয়া দিল। আশাকে বিহারী ভালোবাসে, এ কথা যে এমন রূঢ় করিয়া, এমন গর্হিতভাবে মহেন্দ্র মুখে উচ্চারণ করিতে পারিবে, তাহা বিহারী স্বপ্নেও কল্পনা করে নাই। কারণ, সে নিজেও এমন কথা স্পষ্ট করিয়া কখনো মনে স্থান দেয় নাই। প্রথমটা বজ্রাহত হইল–তার পরে ক্রোধে ঘৃণায় ছটফট করিয়া বলিতে লাগিল, “অন্যায়, অসংগত, অমূলক।” কিন্তু কথাটা যখন একবার উচ্চারিত হইয়াছে, তখন তাহাকে আর সম্পূর্ণ মারিয়া ফেলা যায় না। তাহার মধ্যে যেটুকু সত্যের বীজ ছিল, তাহা দেখিতে দেখিতে অঙ্কুরিত হইয়া উঠিতে লাগিল। কন্যা দেখিবার উপলক্ষে সেই যে একদিন সূর্যাস্তকালে বাগানের উচ্ছ্বসিত পুষ্পগন্ধপ্রবাহে লজ্জিতা বালিকার সুকুমার মুখখানিকে সে নিতান্তই আপনার মনে করিয়া বিগলিত অনুরাগের সহিত একবার চাহিয়া দেখিয়াছিল, তাহাই বার বার মনে পড়িতে লাগিল, এবং বুকের কাছে কী
false
humayun_ahmed
কিছুক্ষণ খোল করতাল বাজানো হলো। শব্দে অতিষ্ঠ হয়ে সে উড়ে গেল ঠিকই, আবার এসে বসল। এই দফায় দেখা গেল তার ঠোঁটে মাংস। কিসের মাংস কে জানে! মরা গরুর মাংস হলে সর্বনাশ। মন্দির অশুদ্ধ হয়ে যাবে। মন্দির শুদ্ধি বিরাট আয়োজনের ব্যাপার। এককড়ির উপদেশে বাঁশের আগায় খড় বেঁধে সেই খড়ে আগুন লাগিয়ে চেষ্টা শুরু হয়েছে। পশুপাখি আগুন ভয় পায়। এই শকুনটা যত হারামিই হোক আগুন দেখে অবশ্যই পালাবে। এককড়ি বললেন, আধঘণ্টা সময়, এর মধ্যে শকুন দূর করবা। প্রয়োজনে একজন কেউ মন্দিরের মাথায় উঠ। এতগুলি মানুষ একটা শকুন দূর করতে পার না, এটা কেমন কথা! এককড়ি তার আড়তে কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে থাকল। মন অস্থির লাগছে। শকুন দূর না হওয়া পর্যন্ত অস্থিরতা কাটবে না। তাঁর ব্যক্তিগত মন্দিরে শকুন বসেছে, বিপদ যা হবার তার হবে। বিপদের কিছু সম্ভাবনা তিনি দেখতে পাচ্ছেন। চালের দাম কমতে শুরু করেছে। কিছুদিনের মধ্যে বোরো ফসল উঠবে। এইবার ফসল ভালো হয়েছে। ইংরেজ সরকার ঘোষণা দিয়েছে, যুদ্ধ শেষ হবার পরপরই ভারতকে স্বাধীন করে দেয়া হবে। এটা আরেক যন্ত্রণা। ইংরেজ রাজার জাত। তারা যেভাবে রাজত্ব করেছে সেভাবে কে পারবে? হিন্দু-মুসলমান কাটাকাটি করেই তো মরে যাবে। এককড়ি শকুনের খবর নিল। শকুন এখনো যায় নাই। ঠিক হয়েছে। একজন মন্দিরের চূড়ায় অলঙ্গা দিয়ে চেষ্টা করবে। অলঙ্গা সুপারিকাঠের বর্শা। বর্শাধারী স্নান করে শুদ্ধ হয়ে নিচ্ছে। এককড়ি উঠে দাঁড়ালেন। ধনু শেখের সঙ্গে ব্যবসা বিষয়ে পরামর্শ করবেন। গুদামে রাখা চাল পার করতে ধনু শেখের সাহায্য লাগবে। একজন ব্যবসায়ী আরেকজনকে সাহায্য করে। এটাই নিয়ম। সেখানে হিন্দু-মুসলমান থাকে না। এককড়ি ছোট্ট ভুল করে ফেলেছেন। সব চাল আগেই বিক্রি করে দেয়া উচিত ছিল। তবে সময় এখনো আছে। ধনু শেখ যত্ন করে এককড়িকে বসিয়েছেন। পান-তামাক দেয়া হয়েছে। একজন গেছে মিষ্টি আনতে। মুসলমানের ঘরে দুগ্ধজাত খাদ্য ছাড়া অন্য খাদ্য গ্রহণ করা যায় না। দুধ এবং দুগ্ধজাত দ্রব্য সব অবস্থায় পবিত্র। ধনু শেখ বললেন, মসজিদটা ঠিক করে দিলা না? এক মাসের উপর হয়ে গেল জুম্মার নামাজ বন্ধ। এককড়ি বিস্মিত হয়ে বলল, আমি কেন মসজিদ ঠিক করে দেব? এটা কেমন কথা? ধনু শেখ তামাক টানতে টানতে বললেন, থানার দারোগা সাহেব তদন্তে পেয়েছেন— তুমি মসজিদ পোড়ানোর সাথে জড়িত। অনেকে সাক্ষী দিয়েছে। অনেকে আমার কাছে এসেও বলেছে। তোমার নিজের লোকই আমাকে বলে গেছে। আমার নিজের লোক আপনাকে বলেছে? সে কে? তার নামটা বলেন। শ্ৰীনাথ বলেছে। টিকেট বাবুর চাকরির জন্যে আমার কাছে এসেছিল। তখন বলল। আমি যদিও তার কথার একটা বর্ণ বিশ্বাস করি নাই। এককড়ি হতভম্ব হয়ে গেল। কী ভয়ংকর কথা। ধনু শেখ বললেন, শ্ৰীনাথকে ডেকে জিজ্ঞাস করা। তবে সে কিছু স্বীকার পাবে বলে মনে হয় না। তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে, এ ধরনের কথা যেন আর না বলে। মন্দ কথা লোকজন সহজে বিশ্বাস করে। রাগে এককড়ির শরীর জুলে যাচ্ছে। শ্ৰীনাথের বিষয়ে এক্ষুনি ব্যবস্থা নিতে হবে। সে উঠে দাঁড়াল। ধনু শেখ বললেন, বসে, মিষ্টি আনতে গেছে। দুষ্ট লোকের কথায় এত অস্থির হলে চলে না। এককড়ি বসল। চাল বিক্রির বিষয়টা আলাপ করতে হবে। নৌকা করে এত চাল নেয়া যাবে না। ধনু শেখের লঞ্চের সাহায্য লাগবে। এককড়ি বলল, আপনার কাছে একটা বিষয়ে সাহায্যের জন্যে এসেছি। সামান্য কিছু চাল কিনে রেখেছিলাম। বোরো ফসল উঠার আগে বিক্রি করে দিব। আপনার লঞ্চে করে চাল নিয়ে যাব। কলিকাতা। কোনো সমস্যা আছে? ধনু শেখ বললেন, কোনো সমস্যা নাই। তবে লোকজনের চোখের সামনে চালের বস্তা লঞ্চে তোলা ঠিক হবে না। নিশিরাতে তুলতে হবে। অবশ্যই। ধনু শেখ বললেন, চাল পঁচে যায় নাই তো? এককড়ি বিস্মিত হয়ে বলল, চাল পচবে কী জন্যে? লুকায়া রাখা চাল। আলো বাতাস পায় নাই। অনেকের এরকম হয়েছে। সিউরাম নামের এক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীর এক হাজার বস্তা চাল পঁচে গোবর হয়ে গেছে। সে এখন ন্যাংটা হয়ে পথে পথে ঘুরতেছে। আপনাকে বলেছে কে? কাগজে পড়লাম। ঢাকা প্ৰকাশে ছাপা হয়েছে। আমার চাল ঠিক আছে। তুমি সাবধানী মানুষ। তোমার সমস্যা হবার কথা না। যাই হোক, চাল কখন পাচার করতে চাও বলে। আমার লঞ্চ তৈয়ার থাকবে। ‘পাচার’ বলতেছেন কেন? আমি সৎভাবে চাল নিয়া যাব। বিক্রি করব। আমার মধ্যে দুই নম্বরি নাই। ঠিক আছে। ঠিক আছে। কথার কথা বলেছি। এককড়ি বাড়ি ফিরেই গুদামের চাল পরীক্ষা করল। তাঁকে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়তে হলো। দুটা গুদামের চাল টিনের। টিনের ফুটা দিয়ে বৃষ্টির পানি ঢুকেছে। চাল পঁচে গেজে উঠেছে। তালাবন্ধ গুদাম কেউ খুলে নাই। এতবড় সর্বনাশ যে হয়ে গেছে তা বোঝা যায় নাই। একজন এসে এককড়িকে জানাল যে, শকুন দূর হয়েছে। ত্ৰিশূলে আবার যেন এসে না বসে তার জন্যে বড়ই গাছের ডাল ভেঙে ত্রিশূলকে ঘিরে বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। বড়ই কাটার জন্যে শকুন বসতে পারবে না। বিপদ একা আসে না। সঙ্গী সাখী নিয়ে আসে। এককড়ি সন্ধ্যাবেলায় খবর পেল, কোলকাতায় তার দোকানটা লুট হয়েছে। এইখানেই শেষ না, তার নতুন খবরপাঠক দেবুকে টাকা ব্যাংকে জমা দিতে নেত্রকোনা পাঠানো হয়েছিল। সে টাকা জমা না দিয়ে উধাও হয়ে গেল। এককড়ি সারারাত মন্দিরে বসে রইল। তার মধ্যে সে-রাতেই পাগলামির কিছু লক্ষণ প্রকাশিত হলো। তার কাছে মনে হলো, ঠাকুর তাকে পছন্দ করেছেন এবং তার সঙ্গে কথা বলা শুরু করেছেন। ঠাকুরের
false
shordindu
দুই হাতে দু-পেয়ালা চা। আমরা উঠিয়া দাঁড়াইলাম‌, তিনি আমাদের হাতে চায়ের পেয়ালা দিয়া স্বামীর প্রতি ব্যগ্র উৎকণ্ঠার দৃষ্টি হানিয়া প্রস্থান করিলেন। নীরব প্রকৃতির মহিলা‌, কথাবার্তা বলেন না। আমরা আবার বসিলাম। দেখিলাম বিশু পাল সপ্রশ্ন নেত্ৰে বোমকেশের মুখের পানে চাহিয়া আছেন। ব্যোমকেশ চায়ের পেয়ালায় ক্ষুদ্র একটি চুমুক দিয়া বলিল‌, ‘আপনি যথাসাধ্য সাবধান হয়েছেন‌, আর কি করবার আছে। খাবারের ব্যবস্থা কি রকম? বিশু পাল বলিলেন‌, ‘একটা বামুন ছিল তাকে বিদেয় করে দিয়েছি। গিন্নি রাঁধেন। বাজার থেকে কোনো খাবার আসে না।’ ‘চাকর-বাকর?’ ‘একটা ঝি আর একটা চাকর ছিল‌, তাদের তাড়িয়েছি। সিঁড়ির মুখে গুখ বসিয়েছি। আর কি করব বলুন।’ ‘ব্যবসার কাজকর্ম চলছে কি করে?’ ‘সেরেস্তাদার কাজ চালায়। নেহাৎ দরকার হলে ওপরে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে যায়। কিন্তু তাকেও ঘরে ঢুকতে দিই না‌, দোরের কাছে দাঁড়িয়ে কথা বলে যায়। বাইরের লোক ঘরে আসে কেবল ডাক্তার।’ চায়ের পেয়ালা নিঃশেষ করিয়া ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইল‌, হাসিয়া বলিল‌, ‘যা-যা করা দরকার সবই আপনি করেছেন‌, আর কী করা যেতে পারে ভেবে পাচ্ছি না। কিন্তু সত্যিই কি অভয় ঘোষাল আপনাকে খুন করতে চায়?’ বিশু পাল উত্তেজিতভাবে উঠিয়া বসিবার চেষ্টা করিয়া আবার শুইয়া পড়িলেন‌, ব্যাকুল স্বরে বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ ব্যোমকেশবাবু্‌, আমার অন্তরাত্মা বুঝেছে ও আমাকে খুন করতে চায়। নইলে এত ভয় পাব কেন বলুন! কলকাতা শহর তো মগের মুল্লুক নয়।’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তা বটে। কিন্তু এভাবে কতদিন চলবে?’ বিশু পাল বলিলেন‌, ‘সেই তো ভাবনা‌, এভাবে কতদিন চলবে। তাই তো আপনার শরণ নিয়েছি‌, ব্যোমকেশবাবু। আপনি একটা ব্যবস্থা করুন।’ কামকেশ বলিল‌, ‘ভেবে দেখব। যদি কিছু মনে আসে‌, আপনাকে জানাব। —আচ্ছা‌, চলি। বিশু পাল বলিলেন‌, ‘ডাক্তার!’ ডাক্তার রক্ষিত অমনি পকেট হইতে একটি একশো টাকার নোট বাহির করিয়া ব্যোমকেশের সম্মুখে ধরিলেন। ব্যোমকেশ সবিস্ময়ে ভ্রূ তুলিয়া বলিল‌, ‘এটা কি?’ বিশু পাল বিছানা হইতে বলিলেন‌, ‘আপনার মর্যাদা। আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি‌, অনেক সময় নষ্ট করেছি।’ ‘কিন্তু এ রকম তো কোনো কথা ছিল না।’ ‘তা হোক। আপনাকে নিতে হবে।’ অনিচ্ছাভরে ব্যোমকেশ টাকা লইল। তারপর ডাক্তার আমাদের নীচে লইয়া চলিলেন। সিঁড়ির মুখে গুখ স্যালুট করিল। সিঁড়ি দিয়া নামিতে নামিতে ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এই লোকটা সারাক্ষণ পাহারা দেয়?’ ডাক্তার বলিলেন‌, ‘না‌, ওরা দু’জন আছে। পুরোনো লোক‌, আগে দোতলায় পাহারা দিত। একজন বেলা দশটা থেকে রাত্রি আটটা পর্যন্ত থাকে‌, দ্বিতীয় ব্যক্তি রাত্রি দশটা থেকে বেলা আটটা পর্যন্ত পাহারা দেয়।’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘সকালে দু-ঘণ্টা এবং রাত্রে দু-ঘণ্টা পাহারা থাকে না?’ ডাক্তার বলিলেন‌, ‘না‌, সে-সময় আমি থাকি।’ দ্বিতলে নামিয়া দেখিলাম দপ্তর বন্ধ হইয়া গিয়াছে কেরানির দ্বারে তালা লাগাইয়া বাড়ি গিয়াছে। নীচের তলায় নামিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আপনাকে দু-একটা প্রশ্ন করতে চাই‌, ডাক্তারবাবু।’ ‘বেশ তো‌, আসুন আমার ডিসপেন্সারিতে।’ আমরা সামনের ঘরে প্রবেশ করিলাম। এটি রোগীদের ওয়েটিং রুম‌, নূতন টেবিল চেয়ার বেঞ্চি ইত্যাদিতে সাজানো গোছানো। কম্পাউন্ডার পাশের দিকের একটি বেঞ্চিতে এক হাঁটু তুলিয়া বসিয়া ঢুলিতেছিল‌, আমাদের দেখিয়া পাশের ঘরে উঠিয়া গেল। ব্যোমকেশ ঘরের চারদিকে দৃষ্টি ফিরাইয়া বলিল, ‘খাসা ডাক্তারখানা সাজিয়েছেন।’ ডাক্তার শুষ্ক স্বরে বলিলেন‌, ‘সাজিয়ে রাখতে হয়; জানেন তো‌, ভেক না হলে ভিখ‌ মেলে না।’ ‘কতদিনের প্র্যাকটিস আপনার?’ ‘এখানে বছর তিনেক আছি‌, তার আগে মফঃস্বলে ছিলাম।’ ‘ভালই চলছে মনে হয়–কেমন?’ ‘মন্দ নয়–চলছে টুকটাক করে। দু-চারটে বাঁধা ঘর আছে। সম্প্রতি পসার কিছু বেড়েছে। বিশুবাবুকে যদি সারিয়ে তুলতে পারি–’ ব্যোমকেশ ঘাড় নাড়িল‌, ‘হ্যাঁ। — আচ্ছা ডাক্তারবাবু্‌, বিশু পালের এই যে মৃত্যুভয়‌, এটা কি ওঁর মনের রোগ? না সত্যিই ভয়ের কারণ আছে?’ ডাক্তার একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন‌, ‘ভয়ের কারণ আছে। অবশ্য যাদের অনেক টাকা তাদের মৃত্যুভয় বেশি হয়। কিন্তু বিশু পালের ভয় অমূলক নয়। অভয় ঘোষাল লোকটা সত্যিকার খুনী। আমি শুনেছি ও গোটা তিনেক খুন করেছে। এমন কি ও নিজের বোপকে বিষ খাইয়েছিল। কিনা সে বিষয়েও সন্দেহ আছে।’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তাই নাকি! ভারি গুণধর ছেলে তো। এখন মনে পড়ছে বছর দুই আগে ওর মামলার বয়ান খবরের কাগজে বেরিয়েছিল। ওর ঠিকানা আপনি জানেন নাকি?’ ডাক্তার বলিলেন‌, ‘জানি। এই তো কাছেই‌, বড়জোর মাইলখানেক। যদি দেখা করতে চান ঠিকানা দিচ্ছি।’ এক টুকরা কাগজে ঠিকানা লিখিয়া ডাক্তার ব্যোমকেশকে দিলেন‌, সে সেটি মুড়িয়া পকেটে রাখিতে রাখিতে বলিল‌, ‘আর একটা কথা। বিশুবাবুর স্ত্রীর কি কোনো রোগ আছে?’ ডাক্তার বলিলেন‌, ‘স্নায়ুর রোগ। স্নায়ুবিক প্রকৃতির মহিলা‌, তার ওপর ছেলেপুলে হয়নি–’ ‘বুঝেছি। — আচ্ছা‌, চললাম। বিশুবাবু একশো টাকা দিয়ে আমাকে দায়ে ফেলেছেন। তাঁর সমস্যাটা ভেবে দেখব।’ বাহিরে তখন‌, রাস্তার আলো জ্বলিয়াছে। ব্যোমকেশ হাতের ঘড়ি দেখিয়া বলিল‌, ‘সাড়ে ছটা। চল‌, খুনি আসামী দর্শন করে যাওয়া যাক। বিশু পাল যখন টাকা দিয়েছেন‌, তখন কিছু তো করা দরকার।’ মোড়ের মাথায় একটা রিকশা পাওয়া গেল‌, তাহাতে চড়িয়া আমরা উত্তর দিকে চলিলাম। লক্ষ্য করিয়াছি‌, আমহার্স্ট স্ত্রীটে লোক চলাচল অপেক্ষাকৃত কম; আশেপাশে সামনে পিছনে যখন জোয়ারের সমুদ্রের মত জনস্রোত ছুটিয়াছে‌, তখনও আমহার্স্ট স্ট্রীটে লোক চলাচল অপেক্ষাকৃত কম; আমহার্স্ট স্ট্রীট সমুদ্রের সমান্তরাল সঙ্কীর্ণ খালের মত নিস্তরঙ্গ পড়িয়া আছে। রাস্তায় উত্তর প্রাস্তে আসিয়া একটি নম্বরের সামনে রিকশা থামিল‌, আমরা নামিলাম। ব্যোমকেশ নম্বর মিলাইয়া বলিল‌, ‘এই বাড়ি।’ বাড়িটি ঠিক ফুটপাথের ধারে নয়‌, মাঝখানে একটু খোলা জমি আছে‌, তাহাতে কাঁঠালি চাঁপার ঝাড় বাড়িটিকে রাস্ত হইতে আড়াল করিয়া রাখিয়াছে। দ্বিতল বাড়ির
false
humayun_ahmed
তাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছে। কী কারণে মেয়ে চড় খেয়েছে এটা না জেনে তিনি নড়বেন না। প্রয়োজনে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকবেন। খালা আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, মেয়েটা চলে গেছে না কি? আমি বললাম, না। লুকিয়ে আছে। বাবার বাজনা না শুনে সে নড়বে না। এত লোকের সামনে এত বড় অপমান। তারপরও মেয়ে বসে আছে। তার কি আত্মসম্মান নেই? আত্মসম্মানের চেয়ে বেশি আছে বাবার প্রতি মমতা। কী জন্যে মেরেছে গুছিয়ে বল তো। জানি না তো কী জন্যে মেরেছে। অবশ্যই জানিস, তুই তো তখন আশেপাশেই ছিলি। কথাবার্তা শুনেছিস। আশপাশে থাকলেও কিছু শুনতে পাই নি। হঠাৎ চড়ের শব্দ শুনলাম। তুচ্ছ কোনো কারণ হবে। তুচ্ছ কারণ তো অবশ্যই না। তুচ্ছ কারণে এত লোকের সামনে এত বড় মেয়েকে বাবা মারে না। অবশ্যই জটিল কিছু আছে। আমি একটা সন্দেহ অবশ্যি করছি। শুনতে চাস? চাই–কিন্তু এখন না। বাজনা শুরু হবে। মেয়েটা কোথায় লুকিয়ে আছে? রেকর্ডিং-এর কয়েকটা স্টুডিও আছে, ওর একটাতে লুকিয়ে রেখেছি। তুমি এক কাজ কর, তোমাকেও সেখানে লুকিয়ে রাখি। তুমি স্পাইয়িং করে ঘটনা বের করে ফেল। তুই আমাকে ভাবিস কী? আমার কি স্পাইগিরি করা স্বভাব? আমি যদি ঐ ঘরে থাকি মেয়েটাকে সান্তুনা দেবার জন্যে থাকব। এত মানুষের সামনে অপমানিত হয়েছে। একটা মেয়ে মানুষ। প্রফেশনাল একজন সভাপতিকে আসতে বলা হয়েছিল। (অবসরপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলরা রাজনীতিতে আসেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের দৌড় এলেবেলে অনুষ্ঠানের সভাপতি পর্যন্ত।) গাড়ি না পাঠানোয় তিনি আসেন নি। তবে আমার টেলিফোনওয়ালা এসেছে। নিজের লোকের মতো ছাটোছুটি করে চা খাওয়াচ্ছে। পানি খাওয়াচ্ছে। মাইক অনা হয়েছে। সাউন্ড রেকর্ডিস্ট ওকে সিগন্যাল দিয়েছে। লালবাতি জ্বলেছে। ওস্তাদ শমসের উদ্দিন খাঁ এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। আমি কাছে গিয়ে বললাম, কিছু বলবেন? শমসের উদ্দিন বিব্রত গলায় বললেন, ফুলফুলিয়া কি সত্যি চলে গেছে? আমি বললাম, না। আপনার পাশের ঘরেই লুকিয়ে আছে। আপনার বাজনা না শুনে সে যাবে না। শমসের উদ্দিন বললেন, আপনি কি দয়া করে আমার মেয়েটাকে বলবেন, সে যেন আমাকে ক্ষমা করে দেয়। আমি অনেক অপরাধ অনেকবার করেছি, কখনো তার জন্যে ক্ষমা চাই নাই। আজ আমি আমার মেয়ের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। এইটা তাকে জানিয়ে আসুন, তারপর বাজনা শুরু করব। আপনার মেয়েকে কিছু বলতে হবে না। মাইক অন করা আছে। আপনার কথা সবাই শুনতে পাচ্ছে। ও আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনার কি শরীর বেশি খারাপ লাগছে? শরীর খারাপ লাগছে। কিন্তু অসুবিধা নাই। বিসমিল্লাহ। শমসের উদ্দিন খাঁ ব্যাঞ্জোর উপর বুকে পড়লেন। প্ৰথমে টুং করে একটা শব্দ হলো। তারপরে দুবার টুং-টাং! তারপরই মনে হলো টিনের চালে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। একেকবার দমকা হাওয়া আসছে বৃষ্টি উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে— আবার ফিরে আসছে, আবার চলে যাচ্ছে। না, এখন আর বৃষ্টির শব্দ বলে মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে শিকলপরা বন্দিনী রাজকন্যা কাঁদছে। তার কান্নার শব্দ আসছে একই সঙ্গে তার পায়ের শিকলের শব্দও আসছে। মায়া ধর্ম গ্রন্থে ঈশ্বর বলেছেন।– হে পতিত মানবসন্তান। তোমরা ভুল জায়গায় আমাকে অনুসন্ধান করো না। আমাকে অনুসন্ধান করা সঙ্গীতে। আমি ছন্দময় সঙ্গীত। আমার সৃষ্টি ছন্দময় সঙ্গীত। আমার ধ্বংস ছন্দময় সঙ্গীত। বাজনা শেষ হলো। ফুলফুলিয়ার ঘরে ঢুকে দেখি সে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। খালা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। আমাকে দেখেই খালা বললেন, ওস্তাদজীকে এ রকম মন খারাপ করা বাজনা বাজাতে নিষেধ করা। মেয়েটা কোঁদে অস্থির হচ্ছে। গান বাজনা মানুষকে আনন্দ দেবার জন্যে। কাদাবার জন্যে তো না। তুই এক্ষুণি গিয়ে উনাকে আমার কথা বলে নিষেধ করবি। আমার কথা উনাকে শুনতে হবে। আমি প্রডিউসার। টাকা আমি দিচ্ছি। টাকা তুমি দিচ্ছ? অবশ্যই। কত টাকা দিতে হবে বল। চেক বই সঙ্গে আছে। চেক লিখে দিচ্ছি। বাজনার দ্বিতীয় অংশ শুরু হয়েছে। ফুলফুলিয়ার কান্না থেমেছে। সে মন্ত্ৰমুগ্ধের মতো তাকিয়ে আছে। যেন সে এই ভুবনে নেই। তার যাত্রা শুরু হয়েছে। অন্য কোনো ভুবনের দিকে। খালার চোখে পানি টলমল করছে। আমার সামনে তিনি যদি চোখের পানি ফেলেন তাহলে খুব লজ্জায় পড়বেন। আমি ঘরের বাইরে চলে এলাম। হে মানবসন্তান আমি নানান রূপে তোমাদের সামনে নিজেকে উপস্থিত করেছি। চোখ মেললেই আমাকে দেখবে। কান পাতিলেই আমাকে শুনবে। কেন তোমরা চোখ ও কান দুই-ই বন্ধ করে রেখেছ? হিমু ভাইজান, এই চিঠি তোমার হাতে পৌঁছবে কি-না। আমি বুঝতে পারছি না। আমার হাতে এখন কোনো টাকা-পয়সা নেই। চিঠিটা লিখে খামে ভরে, খামের উপর তোমার মেসের ঠিকানা লিখে এক মুদির দোকানির হাতে দিয়েছি। সে যদি পাঠায় তাহলে হয়তো পাবে। মুদি দোকানির চেহারাটা সরল টাইপ। সে বিনে পয়সায় আমাকে একটা গায়ে মাখা সাবান দিয়েছে। তার দেয়া সাবান দিয়ে অনেক দিন পর সাবান মেখে গোসল করেছি। দোকানির নাম কুদ্দুস মিয়া। বাড়ি রংপুর। বিয়ে করেছে খুলনায়। এই চিঠি তোমার হাতে পৌছবে এটা ভেবেই লিখছি। শুরুতে আমার খবর সব দিয়ে নেই। প্রথম খবর আমি নর্থ বেঙ্গল হাঁটা শেষ করেছি। এখন আছি। যমুনা নদীর পড়ে। পা ফুলে গেছে বলে হাঁটতে পারছি না। এক দুদিন বিশ্রাম নিয়ে আবার শুরু করব। ঠিক করেছি। ঢাকা হয়ে যাব। আমাকে দেখলে এখন তুমি চিনতে পারবে না। দাড়ি গোঁফ গজিয়ে বিন লাদেনের মতো চেহারা হয়ে গেছে। শরীরের রঙও জ্বলে গেছে। আয়নায় নিজেকে দেখে খুবই মজা লাগে। সমুদ্রে ড়ুব দিয়ে দাড়ি গোঁফ কামিয়ে ফেলব
false
MZI
রাখা যায় নি। সেটা নিয়ে আমি অবশ্যি খুব বেশি ভাবছি না। আমার আম্মু যে আমাকে এভাবে মারেন সেটা কেউ জানে না। সবাই ধরে নেয় আমি পথেঘাটে মারামারি করে নিজের এ অবস্থা করি। স্কুলে আমাকে দেখে সবাই সরে গিয়ে জায়গা করে দিলো। আমাকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলো না, শুধু প্রিয়াংকা চোখ কপালে তুলে বললো, সে কী, তোর গালে কী হয়েছে? আমি বললাম, কিছু না। আমি বলতে চাইছি না দেখে প্রিয়াংকা আর কিছু জানতে চাইল না। বলল, তুই দুইদিন স্কুলে আসিস নি কেন? আমি একটু অবাক হয়ে প্রিয়াংকার দিকে তাকালাম, আমি স্কুলে এসেছি কী আসি নাই কেউ সেটা নিয়ে মাথা ঘামাতে পারে সেটা আমার বিশ্বাস হয় না। আমি আমতা আমতা করে বললাম, শরীর খারাপ ছিল। ও। প্রিয়াংকা হড়বড় করে বলল, তুই যা একটা ফাটাফাটি জিনিস মিস করেছিস! কী জিনিস? প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কালকে আবার ক্লাসে এসেছিলেন। সত্যি? হ্যাঁ। প্রিয়াংকা রহস্য করে বলল, বল দেখি কী নিয়ে কথা বলেছেন? মুক্তিযুদ্ধ? উঁহু। প্রিয়াংকা দাঁত বের করে হেসে বলল, হিন্দু-মুসলমান নিয়ে। এতো সুন্দর করে বলেছেন যে তুই শুনলে বেকুব হয়ে যেতি। তাই নাকি? হ্যাঁ। কী বলেছেন? আমি কী আর ম্যাডামের মতো বলতে পারব? প্রিয়াংকা গম্ভীর হয়ে বলল, বলেছেন যে পৃথিবীটা সুন্দর তার বৈচিত্র্যের জন্যে। তাই যেখানে বৈচিত্র্য বেশি সেখানে সৌন্দর্য বেশি। যেখানে কেউ হিন্দু কেউ মুসলমান কেউ বৌদ্ধ কেউ খ্রিস্টান এবং বাঙালি কেউ পাহাড়ি কেউ চাকমা কেউ সাঁওতাল এবং সবাই যখন মিলেমিশে থাকে আর একজন আরেকজনের বৈচিত্রটাকে উপভোগ করে সেটাই সবচেয়ে সুন্দর। আমি বললাম, ও। প্রিয়াংকা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি ঠিক করে বলতে পারলাম না তাই তুই বলছিস ও! যদি ম্যাডামের কথা শুনতি তাহলে তোর চোখ ভিজে আসত। আমি আবার বললাম, ও। প্রিয়াংকা এবারে তার মুখটা আমার কাছাকাছি এসে ষড়যন্ত্রীর মতো করে বলল, প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কেন হিন্দু-মুসলমান নিয়ে কথা বলছেন, বল দেখি? আমি বললাম, কেন? তোর জন্যে! তুই যে রাজাকার স্যারের কথা বলে দিয়েছিলি মনে আছে? ক্লাসে হিন্দু ছেলেমেয়েদের পেটাতেন– আমি বললাম, ও। প্রিয়াংকা বিরক্ত হয়ে বলল, তোর হয়েছেটা কী? তোকে যেটাই বলি তুই। বলিস, ও! আমি একটু লজ্জা পেলাম, বললাম, না মানে ইয়ে— তুই কী অন্য কিছু ভাবছিস? আমি আসলে অন্য কিছু ভাবছিলাম না, প্রিয়াংকা কী বলছে সেটাই খুব মন দিয়ে শুনছিলাম, কিন্তু আমার সমস্যা হলো মানুষের সাথে কতা না বলতে বলতে আমি আজকাল আর ঠিক করে কারো সাথে কথা বলতে পারি না। কেউ কিছু বললে তার উত্তরে ও তাই নাকী আচ্ছা এই রকম কথাবার্তা ছাড়া আর কিছু বলতে পারি না। কিন্তু প্রিয়াংকাকে সেটা বলতে আমার লজ্জা করল, তাই বললাম, হ্যাঁ আসলে একটা জিনিস ভাবছিলাম তো– কী জিনিস? মানে–ইয়ে একটা অঙ্ক। অঙ্ক? প্রিয়াংকা চোখ কপালে তুলে বলল, কী রকম অঙ্ক? ইয়ে একটা সমবাহু ত্রিভুজের তিন বাহুর মাঝখানে যদি আরো তিনটা ছোট সমবাহু ত্রিভুজ আঁকা যায়–আমি প্রিয়াংকাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম সে ঠিক বুঝতে পারল বলে মনে হলো না। তখন খাতা বের করে পুরোটা এঁকে বললাম, এই যে ক্ষেত্রটা দেখছ এটা খুব বিচিত্র খুব একটা ক্ষেত্র। কেন? আমি যদি তোমাকে বলি একটা কলম দিয়ে এর পরিসীমাটা আঁকো তুমি পারবে না। পৃথিবীর সমস্ত কলম দিয়ে আঁকার চেষ্টা করলেও পারবে না, কারণ এর পরিসীমা হচ্ছে অসীম! ইনফিনিটি? প্রিয়াংকা বলল, তাই নাকী? হ্যাঁ। কিন্তু তোমাকে যদি বলি এর ভেতরের ক্ষেত্রফলটা রং করে দাও তাহলে তুমি একটা কলম দিয়ে ঘষে ঘষে রং করে ফেলতে পারবে! ক্ষেত্রফল হচ্ছে সসীম কিন্তু পরিধি হচ্ছে অসীম–কী অদ্ভুত দেখেছ? বিষয়টা যে খুব অদ্ভুত সেটা প্রিয়াংকা প্রথমে ঠিক বুঝতে পারে নি। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে তাকে বোঝাতে হলো। যখন সত্যি সত্যি বুঝতে পারল তখন সে এতো অবাক হলো বলার মতো নয়। একটু পরে পরে বলতে লাগলো, এটা কেমন করে সম্ভব? এটা কেমন করে সম্ভব? আমি বললাম, খুব সম্ভব। তুমি নিজেই দেখছ। প্রিয়াংকা খানিকক্ষণ আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, তোর অঙ্ক করতে খুব ভাল লাগে? আমি ইতস্তত করে বললাম, তা তো জানি না। তুই বড় হয়ে গণিতবিদ হবি? আমি হেসে ফেললাম, বললাম, ধুর! প্রিয়াংকা ভাবল আমি বিনয় করছি, কিন্তু আমি যে দুই একদিনের মাঝে বাসা থেকে সারা জীবনের মতো পালিয়ে যাব কেউ আর আমার খোঁজ পাবে না সেটা আর বললাম না। বড় জোর একটা বেদে হয়ে পথেঘাটে সাপের খেলা দেখাব। আমার জীবনে এর থেকে বেশি আর কী হতে পারে? আমি জানি আমার কপালে এটা সিল মেরে লিখে দেওয়া আছে। ০৬ পলাতক বাসা থেকে পালিয়ে যাবার জন্যে অনেক কষ্টে একটু একটু করে টাকাগুলো জমিয়েছিলাম, আমার তোষকের তলায় সেগুলো পেয়ে আম্মু নিয়ে গেছেন। আম্মু ধরে নিয়েছেন সেগুলো আমি চুরি করে এনেছি আর সেদিন রাত্রে ভাইয়ার রুমেও গিয়েছিলাম চুরি করতে। আম্মুর সন্দেহ পুরোপুরি মিথ্যা না আর সেটা চিন্তা করে আমি নিজের ভিতরে নিজে কেমন যেন ছোট হয়ে গেছি। আমার মনটা আসলে ভেঙ্গে গেছে, সত্যি সত্যি আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে। আমি আসলে খারাপ ছেলে, আমি চোর। শুধু যে নিজেকে চোর মনে হয় তা না আমি কেমন যেন ভীতু হয়ে গেছি। আম্মুর হাতে সেদিন ওরকম মার খেয়ে আমার ভিতরে
false
shordindu
দরজা একটু ফাঁক করে দেখলুম—দাদা নিঃশব্দে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। চাঁদের আলো বারান্দায় পড়েছিল, দাদাকে স্পষ্ট দেখতে পেলুম।’ ব্যোমকেশ বলিল, ‘একটা কথা; আপনার দাদার পায়ে জুতা ছিল?’ ‘হ্যাঁ।’ ‘তাঁর হাতে কিছু ছিল?’ ‘না।’ ‘কিছু না? একটা কাগজ কিম্বা শিশি?’ ‘কিছু না।’ ‘তখন ক’টা বেজেছিল; দেখেছিলেন কি?’ সত্যবতী বলিল, ‘দেখবার দরকার হয়নি, তখন শহরের সব ঘড়িতেই বারোটা বাজছিল।’ ব্যোমকেশের দৃষ্টি চাপা উত্তেজনায় প্রখর হইয়া উঠিল। সে বলিল, ‘তারপর বলে যান।’ সত্যবতী বলিল, ‘দেখার দরকার হয়নি, তখন শহরের সব ঘড়িতেই বারোটা বাজছিল।’ ব্যোমকেশের দৃষ্টি চাপা উত্তেজনায় প্রখর হইয়া উঠিল। সে বলিল, ‘তারপর বলে যান।’ সত্যবতী বলিতে লাগিল,‘প্রথমটা আমি ‍কিছু বুঝতে পারলুম না। দাদা পনের মিনিট আগে ফিরে এসেছেন—তাঁর ঘরে আওয়াজ শুনে জানতে পেরেছি—তবে আবার তিনি কোথায় গিয়েছিলেন? হঠ্যাৎ মনে হলো হয়তো মেসোমশায়ের শরীর খারাপ হয়েছে, তাঁর ঘরেই গিয়েছিলেন। মেসোমশাই কখনও কখনও রাত্রিবেলা বাতের বেদনায় কষ্ট পেতেন—ঘুম হত না। তখন তাঁকে ওষুঝ খাইয়ে ঘুম পাড়াতে হত। আমি চুপি চুপি ঘর থেকে বেরিয়ে মেসোমশাইয়ের ঘরের দিকে গেলুম। ‘তাঁর ঘরের দোর রাত্রে বরাবরই খোলা থাকে—আমি ঘরে ঢুকলুম। ঘর অন্ধকার—কিন্তু সেই অন্ধকারের মধ্যেও কি রকম একটা গন্ধ নাকে এল। গন্ধটা যে ঠিক কি রকম তা আমি আপনাকে বোঝাতে পারব না—তীব্র নয়, অথচ—’ ‘মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ?’ ‘হ্যাঁ—ঠিক বলেছেন, মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ।’ ‘হুঁ—ক্লোরোফর্ম। তারপর!’ ‘দোরের পাশেই সুইচ। আলো জ্বেলে দেখলুম, মেসোমশাই খাটে শুয়ে আছেন—ঠিক যেন ঘুমাচ্ছেন। তাঁর শোবার ভঙ্গী দেখে একবারও মনে হয় না যে তিনি—, কিন্তু তবু কি জানি কেন আমার বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করতে লাগল। সেই গন্ধটা যেন একটা ভিজে ন্যাকড়ার মতন আমার নিঃশ্বাস বন্ধ করবার উপক্রম করলে। ‘কিছুক্ষণ আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইলুম। মনকে বোঝাবার চেষ্টা করলুম যে, ওটা ওষুধের গন্ধ, মেসোমশাই ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। ‘পা কাঁপছিল, তবু সন্তর্পণে তাঁর খাটের পাশে দাঁড়ালুম। ঝুঁকে দেখলুম—তাঁর নিশ্বাস পড়ছে না। তখন আমার বুকের মধ্যে যে কি হচ্ছে, তা আমি বোঝাতে পারব না—মনে হচ্ছে এইবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব। বোধহয় মাথাটা ঘুরেও উঠেছিল; নিজেকে সামলাবার জন্যে আমি মেসোমশায়ের বালিশের ওপর হাত রাখলুম। হাতটা ঠিক তাঁর ঘাড়ের পাশেই পড়েছিল—একটা কাটার মত কি জিনিস হাতে ফুটল। দেখলুম,একটা ছুঁচ তাঁর ঘাড়ে আমূল বেঁধানো—ছুঁচে তখনও সুতো পরানো রয়েছে। ‘আমি আর সেখানে থাকতে পারলুম না। কিন্তু কি করে যে আলো নিবিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলুম, তাও জানি না। যখন ভাল করে চেতনা ফিরে এল, তখন নিজের বিছানায় বসে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছি আর কাঁদছি। ‘তারপর তো সবই আপনি জানেন। দাদাকে আমি সন্দেহ করিনি, আমি জানি, দাদা এ কাজ করতে পারেন না, তবু একথা যে কাউকে বলা চলবে না, তাও বুঝতে দেরি হল না। পরদিন সকালবেলা কোনোরকমে চা তৈরি করে নিয়ে মেসোমশায়ের ঘরে গেলুম—’ সত্যবতীর স্বর ক্ষীণ হইয়া মিলাইয়া গেল। তাহার মুখের অস্বাভাবিক পাণ্ডুরতা, চোখের আতঙ্কিত দৃষ্টি হইতে বুঝিতে পারিলাম, কি অসীম সংশয় ও যন্ত্রণার ভিতর দিয়া সেই ভয়ঙ্কর রাত্রিটা তাহার কাটিয়াছিল। ব্যোমকেশের মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলাম, তাহার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করিয়া জ্বলিতেছে। সে হঠাৎ বলিয়া উঠিল, ‘আপনার মত অসাধারণ মেয়ে আমি দেখিনি। অন্য কেউ হলে চেঁচামেচি করে মূর্ছা—হিস্টিরিয়ার ঠেলায় বাড়ি মাথায় করত—আপনি—’ সত্যবতী ভাঙ্গা গলায় বলিল,‘শুধু দাদার জন্যে—’ ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘আপনি এখন তাহলে বাড়ি ফিরে যান। কাল সকালে আমি আপনাদের ওখানে যাব।’ সত্যবতীও উঠিয়া দাঁড়াইল, শঙ্কিত কণ্ঠে বলিল, ‘কিন্তু আপনি তো কিছু বললেন না?’ ব্যোমকেশ কহিল, ‘বলবার কিছু নেই। আপনাকে আশা দিয়ে শেষে যদি কিছু না করতে পারি? এর মধ্যে বিধুবাবু নামক একটি আস্ত—ইয়ে আছেন কিনা, তাই একটু ভয়। যা হোক, এইটুকু বলতে পারি যে, আপনি যে সব কথা বললেন, তা যদি প্রথমেই বলতেন, তাহলে হয়তো কোনও গোলমাল হত না।’ অশ্রুপূর্ণ চোখে সত্যবতী বলিল, ‘আমি যা বললুম তাতে দাদার কোনও অনিষ্ট হবে না? সত্যি বলছেন? ব্যোমকেশবাবু, আমার আর কেউ নেই—’ তাহার স্বর কান্নায় বুজিয়া গেল। ব্যোমকেশ তাড়াতাড়ি গিয়া সদর দরজাটা খুলিয়া দাঁড়াইল, একটু হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, ‘আপনি আর দেরি করবেন না—রাত হয়ে গেছে। আমাদের এটা ব্যাচেলর এস্টাব্ বলিশমেন্ট—বুঝলেন না—’ সত্যবতী একটু ব্যস্তভাবে বাহির হইয়া যাইবার উপক্রম করিল। সে চৌকাঠ পার হইয়াছে, এমন সময় ব্যোমকেশ মৃদুস্বরে তাহাকে কি বলিল শুনিতে পাইলাম না। সত্যবতী চমকিয়া ফিরিয়া চাহিল। ক্ষণকালের জন্যে তাহার কৃতজ্ঞতা-নিষিক্ত মিনতিপূর্ণ চোখ দুটি আমি দেখিতে পাইলাম—তারপর সে নিঃশব্দে ছোট্ট একটি নমস্কার করিয়া দ্রুতপদে সিঁড়ি দিয়া নামিয়া গেল। দরজা ভেজাইয়া দিয়া ব্যোমকেশ ফিরিয়া আসিয়া বসিল, ঘড়ি দেখিয়া বলিল,‘সাতটা বেজে গেছে।’ তারপর মনে মনে কি হিসাব করিয়া চেয়ারে হেলান দিয়া বলিল, ‘এখনও ঢের সময় আছে।’ আমি সাগ্রহে তাহাকে চাপিয়া ধরিলাম, ‘ব্যোমকেশ, কি বুঝলে? আমি তো এমন কিছু—কিন্তু তোমার ভাব দেখে বোধ হয়, যেন তুমি ভেতরের কথা বুঝতে পেরেছ।’ ব্যোমকেশ মাথা নাড়িল—‘এখনও সব বুঝিনি।’ আমি বলিলাম, ‘যাই বল, সুকুমারের বিরুদ্ধে প্রমাণ যতই গুরুতর হোক, আমার দৃঢ় বিশ্বাস সে খুন করেনি।’ ব্যোমকেশ হাসিল—‘তবে কে করেছে?’ ‘তা জানি না—কিন্তু সুকুমার নয়।’ ব্যোমকেশ আর কিছু বলিল না, সিগারেট ধরাইয়া নীরবে টানিতে লাগিল। বুঝিলাম, এখন কিছু বলিবে না। আমিও বসিয়া এই ব্যাপারে অদ্ভুত জটিলতার কথা ভাবিতে লাগিলাম। অনেক্ষণ পরে ব্যোমকেশ একটা প্রশ্ন করিল, ‘সত্যবতীকে
false
manik_bandhopaddhay
চালায়, বড়লোক, মাঝারি লোক সবাইকে খুশি রাখে এবং যার কাছে যত বেশি সম্ভব খসিয়ে নেয়। হিসাব রাখে, অন্য চাকরদের হুকুম দেয়, সম্ভ্ৰান্ত ঘরের যে মেয়েরা শিকার খুঁজতে আসে, তাদের প্রয়োজন মতো সবিনয়ে ও সসম্মানে অলঙনীয় নির্দেশ দেয়, আবার দরকার হলে প্যাট্রনের সোডার বোতল নিজ হাতে খুলে দেওয়া থেকে পা-ও চাটে। দাশগুপ্ত কিছু বলার আগেই সে শুরু করে নিরুত্তেজ কণ্ঠে, গণেশ ফেরে নি বাবু? ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না! মাল শুধু পৌঁছে দেবে, ওর হাতে টাকা দেবার তো কথা নয়। টাকা হাতে পেয়ে লোভের বশে পালাত সে বরং সম্ভব ছিল, মাল নিয়ে পালাবার ছোকরা তো ও নয়! চন্দ্রের সঙ্গে পরামর্শ করবে? মনে মনে কথাটা নাড়াচাড়া করে দাশগুপ্ত। চন্দ্র তার মস্ত সহায়, মানুষ চিনতে ও ওস্তাদ, এমন কি গণেশের মতো তুচ্ছ লোককে যে শুধু একতলায় দোকানের কাজে রাখতে হবে, তেতলার ব্যাপার টের পেতে দেওয়া চলবে না, এ পরামর্শও সে-ই দিয়েছিল। সে নিজে অতটা গ্রাহ্য করে নি, বরং ভেবেছিল এ ধরনের গেঁয়ো বোকা ছোকরাকেই তেতলার কাজে লাগানো নিরাপদ। দরকারের সময় তেতলার খুঁটিনাটি কাজ সে গণেশকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছে কয়েকবার। ম্যাকারন টেলিফোনে যা বলেছে তাতে বোঝা যায় মরবার আগে গণেশ কিছু বলে যেতে পারে নি, তা হলে তার নাম-ঠিকানা-পরিচয় জানবার জন্য ম্যাকারনের কাছে খোঁজ নেওয়া হত না। কিন্তু গুলি লেগে যদি এভাবে মরে না যেত গণেশ, সজ্ঞানে যদি কথা বলে যেতে পারত, হয়তো তেতলার ব্যাপারও তা হলে ফঁস করে দিয়ে যেত। ভাবলেও শিউরে ওঠে দাশগুপ্ত। গণেশের খবর পেয়েছি চন্দর। একটা মুশকিল হয়েছে। কে কে এসেছে আজ? অনেকে আসে নি। হাঙ্গামাটা হল। দত্ত সায়েব, বিনয় বাবু, পিটার সায়েব, রায় বাবু, ঘোষ সায়েব– ঘোষ সায়েব এসেছেন? হ্যাঁ। একটা ছোট মেয়েকে এনেছেন, পনের হবে কিনা। এক চুমুক খেয়ে বমি করে দিল। চন্দ্রর মুখে অদ্ভুত একপেশে হাসি ফোটে, গণেশের ব্যাপারটা কি বাবু? বোকা পাঁঠা তো, হাঙ্গামার মধ্যে গিয়েছিল। গুলি খেয়ে মরেছে। এখন মালটাসুদ্ধ হাসপাতালে আছে। নাম-ঠিকানা খুঁজছে, ম্যাকারনকে ফোন করেছিল। গণেশ দুবার গেছে ম্যাকারনের বাড়ি, স্লিপে ঠিকানা লিখে দেবার কি দরকার ছিল? সুধীর একটা গাধা। চন্দ্র প্রায় নির্বিকারভাবেই সব জেনে নেয় এবং মেনে নেয়। কি করবেন ঠিক করলেন বাবু? ঘোষকে বলব ভাবছি। ঘোষ চেষ্টা করলে মালটা সরিয়ে ফেলে সামলে নিতে পারবে। চন্দ্রকে চিন্তিত দেখায়। তা নয় পারবেন, আজো কিন্তু উনি সেবারেরটা ভাঙিয়ে চালাচ্ছেন! এমন তুঘোড় লোক আর দেখি নি। সামান্য ব্যাপার, কি আর করতে হয়েছিল ওনার! তাই টানছেন আজ পর্যন্ত। মদের দামটা পর্যন্ত আদায় করা যায় না। ফের ওঁকে কিছু করতে বললে পেয়ে বসবেন একেবারে। মাথা ঝুঁকিয়ে ঝুঁকিয়ে সায় দেয় দাশগুপ্ত, জ্বালার সঙ্গে বলে, কি করা যায় বল, এ সব লোকের কত ক্ষমতা, এদের হাতে না রাখলে কি ব্যবসা চলে! ঘোষের মতো বেহায়া আর কেউ নেই। আর সকলে কাজ করে দেয় সে জন্য টাকা নেয়, কিন্তু এখানে যা খরচা করে তা দেয়। ঘোষের সেটুকু চামড়াও নেই চোখে। ব্যাটা পেয়ে বসবে, কিন্তু বুঝতে পারছ তো, ওরা খোলবার আগে মালটা সরিয়ে আনা চাই। এমনি কোনো ভাবনা ছিল না। ছোঁড়া গুলি খেয়ে মরল কিনা, মুশকিল সেখানে। চন্দ্রর মনটা তবু খুঁতখুঁত করে। ঘোষ সায়েব যে শুধু তেতলার ভোগ সুখ আরাম বিরামের জন্য খরচা পর্যন্ত দেয় না, তা নয়, চন্দ্রর ব্যক্তিগত পাওনাও তার কাছ থেকে জোটে যৎসামান্য, একটা সাধারণ বয়-এর বকশিশের মতো। এটা যেন তারই বাড়ি, সবাই তার মাইনে করা চাকর, এমনি ব্যবহার করে ঘোষ সায়েব। এক কাজ করলে হয় না? বল কি করব! দাশগুপ্ত খুশি হয়, দেখি আমাদের চন্দরের বুদ্ধির দৌড়। আপনি নিজে গিয়ে যদি গণশাকে চিনে দেন আর মালটা দাবি করে নিয়ে আসেন? মালটা সরিয়ে আনার পর ওতে কি ছিল কে জানবে, আপনি যা বলবেন তাই। দাশগুপ্ত সত্যই আশ্চর্য হয়ে যায়, মনে মনে তারিফ করে চন্দ্রের বুদ্ধির। নিজেকে কূটবুদ্ধি খাটাতে হয় দিবারাত্রি, জীবনে একমাত্র অবলম্বন এই বুদ্ধি খাঁটিয়ে সাফল্য লাভের মাদক গর্ব, অন্যের কাছে সামান্য একটু ধূর্ততার পরিচয় পেলেই তাই আশ্চর্য মনে হয় দাশগুপ্তের। আমিও তা ভেবেছি চন্দর। ওই যে বললাম, খুনের ব্যাপার, মালের গায়ে কোনো ছাপ নেই। দাবি করলেই কি ছাড়বে? চেনা অফিসার কেউ থাকলে বরং– পিটার সায়েবের একখানা চিঠি নিয়ে যান না? ওকে জানাতে চাই না। হাজার টাকা চেয়ে বসবে। জানাবেন কেন। মাল আপনাকে দিয়ে দেবার জন্য চিঠি তো চাইবেন না। কি দরকার? শুধু আপনি অমুক লোক, আপনাকে ও চেনে এই বলে একটা চিঠি দেবে। ব্যস্। বলবেন, যদি দরকার। লাগে তাই দুলাইন সার্টিফিকেটটা রাখছেন। এক বোতল স্কচ দিলেই খুশি হয়ে লিখে দেবে। চন্দ্রের বুদ্ধিতে এবার এত বেশি আশ্চর্য হয়ে যায় দাশগুপ্ত যে, ঈর্ষায় জ্বলে যায় তার বুকটা। সত্যই যায়। চন্দ্ৰ তার চাকর, সে তাকে বাবু বলে, তবু। কয়েক মুহূর্তের জন্য তার মনে হয়, আসলে চন্দ্রই চালাচ্ছে তার সমস্ত কারবার নিজে আড়ালে থেকে তাকে সামনে খাড়া করে রেখে, চন্দ্ৰ তার চেয়ে ঢের বেশি বুদ্ধিমান। আয়ের মোটা ভাগটাই তার বটে, কিন্তু সেটাও এক হিসাবে চন্দ্রের বুদ্ধিরই পরিচয়। তার যেমন আয় বেশি তেমনি সমস্ত দায়িত্ব তার ঘাড়ে, সমস্ত বিপদ তার, নিজেকে সবদিক দিয়ে বাঁচিয়ে রেখে চন্দ্ৰ তো কম রোজগার করছে না। যুদ্ধের আগে
false
MZI
মাঝে একটা গাম্ভীর্য ধরে রেখে সে দরজার বেলে চাপ দিল। যে মানুষটি দরজা খুলে দিল। ছোটাচ্চু অনুমান করল সে নিশ্চয়ই আকবর হোসেন। চল্লিশ পয়তাল্লিশ বছর বয়স চেহারার মাঝে একটা সরকারি অফিসারের মতো ভাব। মানুষটা জিজ্ঞেস করল, শাহরিয়ার সাহেব? ছোটাচ্চু তার চশমাটা ঠিক করে বলল, জি। আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি থেকে এসেছি। আমাকে একটা এসাইনমেন্টের জন্যে পাঠানো হয়েছে। আমি আকবর হোসেন, আপনার জন্যে অপেক্ষা করছি। আসেন। ভিতরে আসনে। ছোটাচ্চু ভিতরে ঢুকল। ভিতরে একটা সোফা, সেই সোফায় একজন মহিলা বসে আছে। ছোটাচ্চুর ঘরে ঢোকার পর মহিলা ঘুরে তাকাল এবং তাকে দেখে ছোটাচ্চুর রক্ত হিম হয়ে গেল। মহিলাটি ডলি খালা—সেই ফর্সা নাদুস নুদুস চেহারা, সেই সিল্কের শাড়ি, সেই লিপস্টিক। চেহারাটা শুধু অন্যরকম, এখন একটা হিংস্র বাঘিনীর মতো। ছোটাচ্চুকে দেখেই ফেঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, দুলাভাই! আমি যেটা সন্দেহ করেছিলাম তাই। এই সেই ছেলে। এর থেকে সাবধান। ছোটাচ্চু কী করবে বুঝতে পারল না, একবার মনে হল একটা দৌড় দেয়, কিন্তু তার জন্যে দেরি হয়ে গেছে। ডলি খালা বলল, আমাদের জোবেদাবুর ছেলে। জোবেদাবু হচ্ছে ফিরেশতার মতো মানুষ। তার সব ছেলে মেয়ে মানুষ হয়েছে, এইটা ছাড়া (ডলি খালা এই সময় আঙুল দিয়ে ছোটাচ্চুকে দেখাল)। সব ছেলে মেয়ে বড় বড় চাকরি বাকরি করে আর ছোট ছেলের যা হয় তাই হয়েছে। টেনে টুনে পরীক্ষায় কোনোমতে পাস করেছে, কোনো চাকরি বাকরি পায় না তখন এই ডিটেকটিভগিরি শুরু করেছে। আমি যখন প্রথম শুনেছি তখন ভাবলাম ভালোই তো, সব দেশে থাকে আমাদের দেশে থাকবে না কেন? ও মা, খোঁজ নিয়ে আমার মাথা ঘুরে গেছে। বুঝলে দুলাভাই (ডলি খালা এই সময়ে আকবর হোসেনের দিকে তাকাল) এর ডিটেকটিভ এজেসি কী জান? এই ছেলে পকেটে একটা মোবাইল ফোন আর কয়েকটা বেআইনি সিম নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর কিছু নাই, কয়টা মেয়ে বন্ধু আছে তাদের দিয়ে মাঝে মধ্যে ফোন করায়। আমি সোজা সরল মানুষ (ডলি খালা এই সময় নিজের দিকে আঙুল দিয়ে দেখাল। আমার মেয়ের জন্যে জামাই খুঁজছি, এই ছেলেকে বিশ্বাস করে একটু খোঁজ খবর নিতে দিয়েছি। তখন তো বুঝি নাই তার কিছু নাই, ভেবেছিলাম আসলেই বুঝি অফিস আছে, লোকজন আছে, সরকারের পারমিশন আছে। সে আমার সর্বনাশ করে ছেড়ে দিয়েছে। সোনার টুকরা একটা ছেলে, আমেরিকা থেকে দেশে বিয়ে করতে এসেছে, তাকে এমন ভয় দেখালো। সেই ছেলে—(এই সময় ডলি খালার গলা ধরে এলো, ডলি খালা হেঁচকি তোলার মতো একটা শব্দ করল তারপর তার হতে পারতো জামাইয়ের সব ঘটনা স্মরণ করে কেমন যেন শিউরে উঠল।) ছোটাচ্চু পুরোপুরি ভ্যাবাচেকা খেয়ে ডলি খালার দিকে তাকিয়ে রইল। এখানে যে ডলি খালা থাকবে আর তার এতো বড় সর্বনাশ করবে সেটা ছোটাচ্চু একবারও ভাবেনি। একজন মানুষ যে টানা এতোক্ষণ একভাবে কারো বিরুদ্ধে এতো খারাপ খারাপ কথা বলতে পারে, ছোটা নিজের চোখে না দেখলে সেটা বিশ্বাস করতো না। ছোটাচ্চু একবার ভাবল প্রতিবাদ করে কিছু একটা বলে, কিন্তু সে বুঝতে পারল বলে কোনো লাভ নেই, সে কখনোই এরকম তীব্র ভাষার বক্তব্যের ধারে কাছে যেতে পারবে না। দেখে কোটি কোটি মানুষ—তাদের ভিতরে একজন তাকে একটা কেস দিতে চাইছে কী কপাল, সেই মানুষটা কি না ডলি খালার পরিচিত। এর থেকে বড় ট্র্যাজেডি আর কী হতে পারে! ডলি খালার আক্রমণকে ঠেকানোর কোনো উপায় নেই। ছোটাচ্চু হাল ছেড়ে দিয়ে ডলি খালার দিকে তাকিয়ে, পরের আক্রমণের জন্যে অপেক্ষা করে রইল। ডলি খালা ফোঁস ফোঁস করে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিল, তারপর কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, বুঝলে দুলাভাই, যখন খবর পেয়েছি সুম হারিয়ে গেছে তখন আমার বুকটা ভেঙে গেছে। ছোটাচ্চু বুঝতে পারা সুমন নিশ্চয়ই আকবর হোসেনের পালিয়ে যাওয়া ছেলের নাম। আমরা সব জায়গায় সুমকে খুঁজে বেড়াচ্ছি তখন খবর পেলাম তুমি নাকি ইন্টারনেট থেকে ডিটেকটিভ এজেন্সি বের করে তাদেরকে লাগাচ্ছ, তখন আমি পাগলের মতো ছুটে এসেছি তোমাকে সাবধান করার জন্যে। এই ছেলে আমার সর্বনাশ করেছে তোমার যেন সর্বনাশ করতে না পারে। (এই সময় ডলি খালার গলা আবার ধরে এল, চোখ থেকে মনে হল দুই ফোঁটা পানিও বের হল।) ডলি খালা তখন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি গেলাম দুলাভাই, তুমি পরে আমাকে বলে না যে আমি তোমাকে সাবধান করি নাই। এই ছেলে আজকে গলায় টাই আর চোখে চশমা লাগিয়ে এসেছে, আসলে ভুসভুসে ময়লা টি শার্ট পরে ঘুরে বেড়ায়, চোখে নিশ্চয়ই জিরো পাওয়ারের চশমা। যে গাড়ি তাকে নামিয়ে দিয়েছে খোঁজ নিয়ে দেখো নিশ্চয়ই ভাড়া গাড়ি, না হলে কারো কাছ থেকে ম্যানেজ করেছে। ছোটাচ্চু এখন এক ধরনের যুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে ডলি খালার দিকে তাকিয়ে রইল। যখন বুঝে গেছে এখানে তার সর্বনাশ যা হবার তা হয়ে গেছে তখন এই পুরো ব্যাপারটাকে একটা নাটক হিসেবে দেখে উপভোগ করা যেতেই পারে। ডলি খালা ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ছোটাচ্চু লক্ষ করল চোখ মুছল খুব কায়দা করে যেন চোখের রং ল্যাপ্টে না যায়। একটু পরেই গাড়ির শব্দ শোনা গেল, বোঝা গেল ডলি খালা চলে গেছে। আকবর হোসেন চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে রইলেন, তারপর এক পায়ের উপর আরেক পা তুলে বসলেন। ছোটাচ্চুও তাই করল, তখন হঠাৎ মনে হল গলায় টাইটা ফাঁসের মতো আটকে আছে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট
false
robindronath
কাটিয়া যাইবে তাহা কিছুই বলা যায় না। গোরা তো উঠিতে চায় না, ও দিকে রমাপতির প্রাণ বাহির হইতেছে। সে নাপিতের মুখের ইতিবৃত্ত শেষ না হইতেই জিজ্ঞাসা করিল, “হিন্দুর পাড়া কত দূরে আছে?” নাপিত কহিল, “ক্রোশ দেড়েক দূরে যে নীলকুঠির কাছারি, তার তহসিলদার ব্রাহ্মণ, নাম মাধব চাটুজ্জে।” গোরা জিজ্ঞাসা করিল, “স্বভাবটা?” নাপিত কহিল, “যমদূত বললেই হয়। এত বড়ো নির্দয় অথচ কৌশলী লোক আর দেখা যায় না। এই যে কদিন দারোগাকে ঘরে পুষছে তার সমস্ত খরচা আমাদেরই কাছ থেকে আদায় করবে– তাতে কিছু মুনফাও থাকবে।” রমাপতি কহিল, “গৌরবাবু, চলুন আর তো পারা যায় না।” বিশেষত নাপিত-বউ যখন মুসলমান ছেলেটিকে তাহাদের প্রাঙ্গণের কুয়াটার কাছে দাঁড় করাইয়া ঘটিতে করিয়া জল তুলিয়া স্নান করাইয়া দিতে লাগিল তখন তাহার মনে অত্যন্ত রাগ হইতে লাগিল এবং এ বাড়িতে বসিয়া থাকিতে তাহার প্রবৃত্তিই হইল না। গোরা যাইবার সময় নাপিতকে জিজ্ঞাসা করিল, “এই উৎপাতের মধ্যে তুমি যে এ পাড়ায় এখনো টিঁকে আছে? আর কোথাও তোমার আত্মীয় কেউ নেই?” নাপিত কহিল, “অনেক দিন আছি, এদের উপর আমার মায়া পড়ে গেছে। আমি হিন্দু নাপিত, আমার জোতজমা বিশেষ কিছু নেই বলে কুঠির লোক আমার গায়ে হাত দেয় না। আজ এ পাড়ার পুরুষ বলতে আর বড়ো কেউ নেই, আমি যদি যাই তা হলে মেয়েগুলো ভয়েই মারা যাবে।” গোরা কহিল, “আচ্ছা, খাওয়াদাওয়া করে আবার আমি আসব।” দারুণ ক্ষুধাতৃষ্ণার সময় এই নীলকুঠির উৎপাতের সুদীর্ঘ বিবরণে রমাপতি গ্রামের লোকের উপরেই চটিয়া গেল। বেটারা প্রবলের বিরুদ্ধে মাথা তুলিতে চায় ইহা গোঁয়ার মুসলমানের স্পর্ধা ও নির্বুদ্ধিতার চরম বলিয়া তাহার কাছে মনে হইল। যথোচিত শাসনের দ্বারা ইহাদের এই ঔদ্ধত্য চূর্ণ হইলেই যে ভালো হয় ইহাতে তাহার সন্দেহ ছিল না। এই প্রকারের লক্ষ্ণীছাড়া বেটাদের প্রতি পুলিসের উৎপাত ঘটিয়াই থাকে এবং ঘটিতেই বাধ্য এবং ইহারাই সেজন্য প্রধানত দায়ী এইরূপ তাহার ধারণা। মনিবের সঙ্গে মিটমাট করিয়া লইলেই তো হয়, ফেসাদ বাধাইতে যায় কেন, তেজ এখন রহিল কোথায়? বস্তুত রমাপতির অন্তরের সহানুভূতি নীলকুঠির সাহেবের প্রতিই ছিল। মধ্যাহ্নরৌদ্রে উত্তপ্ত বালুর উপর দিয়া চলিতে চলিতে গোরা সমস্ত পথ একটি কথাও বলিল না। অবশেষে গাছপালার ভিতর হইতে কাছারিবাড়ির চালা যখন কিছুদূর হইতে দেখা গেল তখন হঠাৎ গোরা আসিয়া কহিল, “রমাপতি, তুমি খেতে যাও, আমি সেই নাপিতের বাড়ি চললুম।” রমাপতি কহিল, “সে কী কথা! আপনি খাবেন না? চাটুজ্জের ওখানে খাওয়া-দাওয়া করে তার পরে যাবেন।” গোরা কহিল, “আমার কর্তব্য আমি করব, এখন তুমি খাওয়া-দাওয়া সেরে কলকাতায় চলে যেয়ো– ঐ ঘোষপুর-চরে আমাকে বোধ হয় কিছুদিন থেকে যেতে হবে– তুমি সে পারবে না।” রমাপতির শরীর কণ্টকিত হইয়া উঠিল। গোরার মতো ধর্মপ্রাণ হিন্দু ঐ ম্লেচ্ছের ঘরে বাস করিবার কথা কোন্‌ মুখে উচ্চারণ করিল তাই সে ভাবিয়া পাইল না। গোরা কি পানভোজন পরিত্যাগ করিয়া প্রায়োপবেশনের সংকল্প করিয়াছে তাই সে ভাবিতে লাগিল। কিন্তু তখন ভাবিবার সময় নহে, এক-এক মুহূর্ত তাহার কাছে এক-এক যুগ বলিয়া বোধ হইতেছে; গোরার সঙ্গ ত্যাগ করিয়া কলিকাতায় পলায়নের জন্য তাহাকে অধিক অনুরোধ করিতে হইল না। ক্ষণকালের জন্য রমাপতি চাহিয়া দেখিল, গোরার সুদীর্ঘ দেহ একটি খর্ব ছায়া ফেলিয়া মধ্যাহ্নের খররৌদ্রে জনশূন্য তপ্ত বালুকার মধ্য দিয়া একাকী ফিরিয়া চলিয়াছে। ক্ষুধায় তৃষ্ণায় গোরাকে অভিভূত করিয়াছিল, কিন্তু দুর্‌বৃত্ত অন্যায়কারী মাধব চাটুজ্জের অন্ন খাইয়া তবে জাত বাঁচাইতে হইবে, এ কথা যতই চিন্তা করিতে লাগিল ততই তাহার অসহ্য বোধ হইল। তাহার মুখ-চোখ লাল ও মাথা গরম হইয়া মনের মধ্যে বিষম একটা বিদ্রোহ উপস্থিত হইল। সে ভাবিল, “পবিত্রতাকে বাহিরের জিনিস করিয়া তুলিয়া ভারতবর্ষে আমরা এ কী ভয়ংকর অধর্ম করিতেছি। উৎপাত ডাকিয়া আনিয়া মুসলমানকে যে লোক পীড়ন করিতেছে তাহারই ঘরে আমার জাত থাকিবে আর উৎপাত স্বীকার করিয়া মুসলমানের ছেলেকে যে রক্ষা করিতেছে এবং সমাজের নিন্দাও বহন করিতে প্রস্তুত হইয়াছে তাহারই ঘরে আমার জাত নষ্ট হইবে! যাই হোক, এই আচারবিচারের ভালোমন্দের কথা পরে ভাবিব, কিন্তু এখন তো পারিলাম না।’ নাপিত গোরাকে একলা ফিরিতে দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া গেল। গোরা প্রথমে আসিয়া নাপিতের ঘটি নিজের হাতে ভালো করিয়া মাজিয়া কূপ হইতে জল তুলিয়া খাইল এবং কহিল– ঘরে যদি কিছু চাল ডাল থাকে তো দাও আমি রাঁধিয়া খাইব। নাপিত ব্যস্ত হইয়া রাঁধিবার জোগাড় করিয়া দিল। গোরা আহার সারিয়া কহিল, “আমি তোমার এখানে দু-চার দিন থাকব।” নাপিত ভয় পাইয়া হাত জোড় করিয়া কহিল, “আপনি এই অধমের এখানে থাকবেন তার চেয়ে সৌভাগ্য আমার আর কিছুই নেই। কিন্তু দেখুন, আমাদের উপরে পুলিসের দৃষ্টি পড়েছে, আপনি থাকলে কী ফেসাদ ঘটবে তা বলা যায় না।” গোরা কহিল, “আমি এখানে উপস্থিত থাকলে পুলিস কোনো উৎপাত করতে সাহস করবে না। যদি করে, আমি তোমাদের রক্ষা করব।” নাপিত কহিল, “দোহাই আপনার, রক্ষা করবার যদি চেষ্টা করেন তা হলে আমাদের আর রক্ষা থাকবে না। ও বেটারা ভাববে আমিই চক্রান্ত করে আপনাকে ডেকে এনে ওদের বিরুদ্ধে সাক্ষী জোগাড় করে দিয়েছি। এতদিন কোনোপ্রকারে টিঁকে ছিলুম, আর টিঁকতে পারব না। আমাকে সুদ্ধ যদি এখান থেকে উঠতে হয় তা হলে গ্রাম পয়মাল হয়ে যাবে।” গোরা চিরদিন শহরে থাকিয়াই মানুষ হইয়াছে, নাপিত কেন যে এত ভয় পাইতেছে তাহা তাহার পক্ষে বুঝিতে পারাই শক্ত। সে জানিত ন্যায়ের পক্ষে জোর করিয়া দাঁড়াইলেই অন্যায়ের প্রতিকার হয়। বিপন্ন গ্রামকে
false
robindronath
পরখ করিয়া দেখার কথাও ভূপতির মনে স্থান পায় নাই। ভূপতি সন্ধ্যার সময় বর্ধমান হইতে বাড়ি ফিরিয়া আসিল। তাড়াতাড়ি মুখহাত ধুইয়া সকাল সকাল খাইল। অমলের বিবাহ ও বিলাতযাত্রার আদ্যোপান্ত বিবরণ শুনিবার জন্য স্বভাবতই চারু একান্ত উৎসুক হইয়া আছে স্থির করিয়া ভূপতি আজ কিছুমাত্র বিলম্ব করিল না। ভূপতি শোবার ঘরে বিছানায় গিয়া শুইয়া গুড়গুড়ির সুদীর্ঘ নল টানিতে লাগিল। চারু এখনো অনুপস্থিত, বোধ করি গৃহকার্য করিতেছে। তামাক পুড়িয়া শ্রান্ত ভূপতির ঘুম আসিতে লাগিল। ক্ষণে ক্ষণে ঘুমের ঘোর ভাঙিয়া চমকিয়া জাগিয়া উঠিয়া সে ভাবিতে লাগিল, এখনো চারু আসিতেছে না কেন। অবশেষে ভূপতি থাকিতে না পারিয়া চারুকে ডাকিয়া পাঠাইল। ভূপতি জিজ্ঞাসা করিল, “চারু, আজ যে এত দেরি করলে? ” চারু তাহার জবাবদিহি না করিয়া কহিল, “হাঁ, আজ দেরি হইয়া গেল।” চারুর আগ্রহপূর্ণ প্রশ্নের জন্য ভূপতি অপেক্ষা করিয়া রহিল; চারু কোনো প্রশ্ন করিল না। ইহাতে ভূপতি কিছু ক্ষুণ্ন হইল। তবে কি চারু অমলকে ভালোবাসে না। অমল যতদিন উপস্থিত ছিল ততদিন চারু তাহাকে লইয়া আমোদ-আহ্লাদ করিল, আর যেই চলিয়া গেল অমনি তাহার সম্বন্ধে উদাসীন! এইরূপ বিসদৃশ ব্যবহারে ভূপতির মনে খটকা লাগিল, সে ভাবিতে লাগিল–– তবে কি চারুর হৃদয়ের গভীরতা নাই। কেবল সে আমোদ করিতেই জানে, ভালোবাসিতে পারে না? মেয়েমানুষের পক্ষে এরূপ নিরাসক্ত ভাব তো ভালো নয়। চারু ও অমলের সখিত্বে ভূপতি আনন্দ বোধ করিত। এই দুইজনের ছেলেমানুষি আড়ি ও ভাব, খেলা ও মন্ত্রণা তাহার কাছে সুমিষ্ট কৌতুকাবহ ছিল; অমলকে চারু সর্বদা যে যত্ন আদর করিত তাহাতে চারুর সুকোমল হৃদয়ালুতার পরিচয় পাইয়া ভূপতি মনে মনে খুশি হইত। আজ আশ্চর্য হইয়া ভাবিতে লাগিল, সে সমস্তই কি ভাসা-ভাসা, হৃদয়ের মধ্যে তাহার কোনো ভিত্তি ছিল না? ভূপতি ভাবিল, চারুর হৃদয় যদি না থাকে তবে কোথায় ভূপতি আশ্রয় পাইবে। অল্পে অল্পে পরীক্ষা করিবার জন্য ভূপতি কথা পাড়িল, “চারু, তুমি ভালো ছিলে তো? তোমার শরীর খারাপ নেই? ” চারু সংক্ষেপে উত্তর করিল, “ভালোই আছি।” ভূপতি। অমলের তো বিয়ে চুকে গেল। এই বলিয়া ভূপতি চুপ করিল; চারু তৎকালোচিত একটা কোনো সংগত কথা বলিতে চেষ্টা করিল, কোনো কথাই বাহির হইল না; সে আড়ষ্ট হইয়া রহিল। ভূপতি স্বভাবতই কখনো কিছু লক্ষ্য করিয়া দেখে না–– কিন্তু অমলের বিদায়শোক তাহার নিজের মনে লাগিয়া আছে বলিয়াই চারুর ঔদাসীন্য তাহাকে আঘাত করিল। তাহার ইচ্ছা ছিল, সমবেদনায় ব্যথিত চারুর সঙ্গে অমলের কথা আলোচনা করিয়া সে হৃদয়ভার লাঘব করিবে। ভূপতি। মেয়েটিকে দেখতে বেশ।–– চারু, ঘুমোচ্ছ? চারু কহিল, “না।” ভূপতি। বেচারা অমল একলা চলে গেল। যখন তাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিলুম, সে ছেলেমানুষের মতো কাঁদতে লাগল–– দেখে এই বুড়োবয়সে আমি আর চোখের জল রাখতে পারলুম না। গাড়িতে দুজন সাহেব ছিল, পুরুষমানুষের কান্না দেখে তাদের ভারি আমোদ বোধ হল। নির্বাণদীপ শয়নঘরে বিছানার অন্ধকারের মধ্যে চারু প্রথমে পাশ ফিরিয়া শুইল,তাহার পর হঠাৎ তাড়াতাড়ি বিছানা ছাড়িয়া চলিয়া গেল। ভূপতি চকিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “চারু, অসুখ করেছে?” কোনো উত্তর না পাইয়া সেও উঠিল। পাশে বারান্দা হইতে চাপা কান্নার শব্দ শুনিতে পাইয়া ত্রস্তপদে গিয়া দেখিল, চারু মাটিতে পড়িয়া উপুড় হইয়া কান্না রোধ করিবার চেষ্টা করিতেছে। এরূপ দুরন্ত শোকোচ্ছ্বাস দেখিয়া ভূপতি আশ্চর্য হইয়া গেল। ভাবিল, চারুকে কী ভুল বুঝিয়াছিলাম। চারুর স্বভাব এতই চাপা যে, আমার কাছেও হৃদয়ের কোনো বেদনা প্রকাশ করিতে চাহে না। যাহাদের প্রকৃতি এইরূপ তাহাদের ভালোবাসা সুগভীর এবং তাহাদের বেদনাও অত্যন্ত বেশি। চারুর প্রেম সাধারণ স্ত্রীলোকদের ন্যায় বাহির হইতে তেমন পরিদৃশ্যমান নহে, ভূপতি তাহা মনে মনে ঠাহর করিয়া দেখিল। ভূপতি চারুর ভালোবাসার উচ্ছ্বাস কখনো দেখে নাই; আজ বিশেষ করিয়া বুঝিল, তাহার কারণ অন্তরের দিকেই চারুর ভালোবাসার গোপন প্রসার। ভূপতি নিজেও বাহিরে প্রকাশ করতে অপটু; চারুর প্রকৃতিতেও হৃদয়াবেগের সুগভীর অন্তঃশীলতার পরিচয় পাইয়া সে একটা তৃপ্তি অনুভব করিল। ভূপতি তখন চারুর পাশে বসিয়া কোনো কথা না বলিয়া ধীরে ধীরে তাহার গায়ে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল। কী করিয়া সান্ত্বনা করিতে হয় ভূপতির তাহা জানা ছিল না–– ইহা সে বুঝিল না, শোককে যখন কেহ অন্ধকারে কণ্ঠ চাপিয়া হত্যা করিতে চাহে তখন সাক্ষী বসিয়া থাকিলে ভালো লাগে না। চতুর্দশ পরিচ্ছেদ ভূপতি যখন তাহার খবরের কাগজ হইতে অবসর লইল তখন নিজের ভবিষ্যতের একটা ছবি নিজের মনের মধ্যে আঁকিয়া লইয়াছিল। প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল, কোনো প্রকার দুরাশা-দুশ্চেষ্টায় যাইবে না, চারুকে লইয়া পড়াশুনা ভালোবাসা এবং প্রতিদিনের ছোটোখাটো গার্হস্থ্য কর্তব্য পালন করিয়া চলিবে। মনে করিয়াছিল, যে-সকল ঘোরো সুখ সব চেয়ে সুলভ অথচ সুন্দর, সর্বদাই নাড়াচাড়ার যোগ্য অথচ পবিত্র নির্মল, সেই সহজলভ্য সুখগুলির দ্বারা তাহার জীবনের গৃহকোণটিতে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালাইয়া নিভৃত শান্তির অবতারণা করিবে। হাসি গল্প পরিহাস, পরস্পরের মনোরঞ্জনের জন্য প্রত্যহ ছোটোখাটো আয়োজন, ইহাতে অধিক চেষ্টা আবশ্যক হয় না অথচ সুখ অপর্যাপ্ত হইয়া উঠে। কার্যকালে দেখিল, সহজ সুখ সহজ নহে। যাহা মূল্য দিয়া কিনিতে হয় না তাহা যদি আপনি হাতের কাছে না পাওয়া যায় তবে আর কোনোমতেই কোথাও খুঁজিয়া পাইবার উপায় থাকে না। ভূপতি কোনোমতেই চারুর সঙ্গে বেশ করিয়া জমাইয়া লইতে পারিল না। ইহাতে সে নিজেকেই দোষ দিল। ভাবিল, ‘বারো বৎসর কেবল খবরের কাগজ লিখিয়া, স্ত্রীর সঙ্গে কী করিয়া গল্প করিতে হয় সে বিদ্যা একেবারে খোয়াইয়াছি।’ সন্ধ্যাদীপ জ্বালিতেই ভূপতি আগ্রহের সহিত ঘরে যায়–– সে দুই-একটা কথা বলে, চারু দুই-একটা কথা বলে,
false
humayun_ahmed
সব বন্ধ। প্রতিটি বন্ধ জানালায় ভারী পর্দা ঝুলছে। দিনের আলোতেও ঘর অন্ধকার। সামান্য যে আলো আসছে সে আলোও আলাউদ্দিন সহ্য করতে পারছেন না। আলো পড়লেই চোখ জ্বলে যাচ্ছে এ রকম হয়। একটা ভেজা তোয়ালে সারাক্ষণ তাকে চোখের উপর দিয়ে রাখতে হয়। বাথটাব ভর্তি পানির ভেতর সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে আলাউদ্দিন শুয়ে আছেন। অনেকদিন ধরেই এই অবস্থায় আছেন। তাঁর সমস্ত শরীর ফোসকায় ভরে গেছে। কিছু ফোসকা ফেটে ভেতরের পোকা বের হয়ে বাথটাবের পানিতে কিলবিল। করছে। তীব্র যন্ত্রণায় আলাউদ্দিনের সমস্ত চেতনা আচ্ছান্ন। তিনি সারাক্ষণই চাপা আওয়াজ করেন। দূর থেকে সেই আওয়াজকে কুকুরের ঘড়ঘড় শব্দের মতো শোনায়। তার ক্ষুধা তৃষ্ণার সমস্ত বোধ লোপ পেয়েছে। তার কাছে এখন মনে হয় তিনি খুব ধীরে ধীরে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছেন। যাত্রা শুরু হয়েছে অতল কোনো গম্বরের দিকে। সেই অতল গহ্বরে কিছু একটা অপেক্ষা করছে তার জন্যে। সেই কিছুটা কী? বাথরুমের দরজা ধরে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। আলাউদ্দিনের চোখ বন্ধ। বন্ধ চোখের উপর ভেজা তোয়ালে। তারপরেও তিনি টের পেলেন কেউ একজন এসেছে। আলাউদ্দিন ভাঙা গলায় বললেন, কে? জবাব দিল কুটু। নিচু গলায় বলল, স্যার আমি। আলাউদ্দিন বললেন, কী চাও কুটু? কুটু শান্ত গলায় বলল, চইলা যাইতেছি স্যার। আপনার কাছ থেইকা বিদায়। নিতে আসছি। আলাউদ্দিন বললেন, আচ্ছা। বেতনের টাকাটা শুধু নিছি। বাকি টাকা সুটকেসে আছে। আচ্ছা। স্যার তাইলে যাই? যাও। তোমার রান্নায় তোমার সেবায় আমি সন্তুষ্ট। যদি ক্ষমতা থাকতো পাইলট সাহেবের মতো তোমাকে একটু সার্টিফিকেট দিতাম। আমার ক্ষমতা নাই।… কুটু! জ্বি স্যার। যাবার আগে একটা ছোট্ট কাজ করে দিয়ে যাও। খুব ভারী একটা তালা বাড়ির দরজায় লাগিয়ে দিয়ে যাও। যেন কেউ ঢুকতে না পারে। আমি চাই না আমাকে এই অবস্থায় কেউ দেখুক। জ্বি আচ্ছা স্যার। আলাউদ্দিনের চোখ বন্ধ। চোখ খোলা থাকলে তিনি দেখতে পেতেন কুটু বড় একটা তালা হাতে নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ঘরে তালা দিয়ে বলা হবে এটা যেন সে জানত। কুটুর মুখ বিষণ্ণ। বেদনায় কাতর। ভূমিকা ট্রেন দেখলেই আমার ট্রেনে চড়তে ইচ্ছা করে। ঢাকা শহরে অনেকগুলি রেল ক্রসিং। গাড়ি নিয়ে প্রায়ই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। চোখের সামনে দিয়ে ট্রেন যায় আর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ভাবি ট্রেনের যাত্রীরা কি সুখেই না আছে। আমার এই উপন্যাসটা ট্রেনের কামরায় শুরু, সেখানেই শেষ। কাহিনী শেষ হয়ে গেছে-ট্রেন চলছেই। মনে হচ্ছে এই ট্রেনের শেষ গন্তব্য অপূর্ব লীলাময় অলৌকিক কোনো ভুবন। উপন্যাসের নাম কিছুক্ষণ ধার করা নাম। ধার করেছি আমার প্রিয় একজন লেখক বনফুলের (বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায়) কাছ থেকে। হুমায়ূন আহমেদ ——— ০১. ট্রেন কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাড়বে। চিত্রাকে সিদ্ধান্ত যা নেবার এখনই নিতে হবে। সে ট্রেনে থাকবে, না-কি স্যুটকেস নিয়ে নেমে যাবে? বিশাল এই স্যুটকেস হাতে নিয়ে নামা তার পক্ষে সম্ভব না। নেমে যাবার সিদ্ধান্ত নিলে তাকে কুলি ডাকতে হবে। দেরি করা যাবে না। এক্ষুণি ডাকতে হবে। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। ছটায় ছাড়ার কথা। এখন বাজছে পাঁচটা পঞ্চাশ। দুঃখে চিত্রার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। চিত্রার হাতে প্রথম শ্রেণীর স্লিপিং বার্থের টিকেট। হাত পা ছড়িয়ে যাবে। ট্রেনে তার একফোঁটা ঘুম হয় না। তাতে অসুবিধা নেই গল্পের বই পড়তে পড়তে যাবে। হাত ব্যাগে দুটো গল্পের বই আছে। দুটাই ভূতের গল্প। স্টিফেন কিং। চলন্ত ট্রেনে ভূতের গল্প পড়তে ভাল লাগে। স্টেশনের বুক স্টল থেকে এক কপি রিডার্স ডাইজেস্ট কিনেছে। ট্রেনে বাসে ডাইজেস্ট জাতীয় পত্রিকা পড়তে আরাম। মন দিয়ে পড়তে হয় না। চোখ বুলালেই চলে। ট্রেন এখনো দাঁড়িয়ে। আজ কি ট্রেন লেট হবে? চিত্রা জানালা দিয়ে মুখ বের করল। একজন কুলিকে জানালার পাশেই দেখা যাচ্ছে। সে কি ডাকবে তাকে? বলবে স্যুটকেস নামিয়ে দিতে? সে ঠিক করল নেমেই যাবে আর তখনই বিশাল বড় বড় দুটা কালো ট্রাঙ্ক দরজায় নামল। ট্রাঙ্কের সঙ্গে বেডিং, বেতের ঝুড়ি। এইসবের মালিক এক মাওলানা। সুফি সুফি চেহারা যার গা থেকে আতরের গন্ধ আসছে। মাওলানার স্ত্রী গর্ভবতী। বোরকায় তাঁর অস্বাভাবিক বিশাল পেট ঢেকে রাখা যাচ্ছে না। ভদ্রমহিলা দৌড়ে ট্রেনে উঠার পরিশ্রমে ক্লান্ত। তিনি ট্রাঙ্কের উপর বসে পড়েছেন। বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। বিশাল এই ঝামেলা ডিঙিয়ে চিত্রার পক্ষে নামা অসম্ভব। বোরকাপরা মহিলা স্বামীকে বললেন, পানি খাব। পানি। আর ঠিক তখনই ট্রেন দুলে উঠল। চিত্রার প্রধান সমস্যা দুজনের যে কামরায় তার সিট সেখানে বুড়ো এক ভদ্রলোক আধশোয়া হয়ে আছেন। ভদ্রলোকের মাথা অস্বাভাবিক ছোট। তিনি তাঁর ছোটমাথা হলুদ রঙের মাফলার দিয়ে পেঁচিয়ে বলের মতো বানিয়েছেন। গায়ে প্রায় মেরুন রঙের কোট। কোন রুচিবান মানুষ এই রঙের কোট পরে বলে চিত্রার জানা নেই। তাঁর হাতে সিগারেট। সিগারেটে একেকটা টান দিচ্ছেন আর বিকট শব্দে কাশছেন। ঘর ভর্তি সিগারেটের ধূয়া। ভদ্রলোকের পরণে লুঙ্গি। এক শ্রেণীর মানুষ আছে যারা ট্রেনে বা লঞ্চে উঠেই কাপড় বদলে লুঙ্গি পরে ফেলে। উনি মনে হয় সেই জাতের। প্লেনে উঠেও কি এরা এই কাণ্ড করে? হয়ত করে। লাঞ্চ টাইমে গামছা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে যায় গোসলের জন্যে। বিমানবালার কাছে গায়ে মাখার জন্যে তেল চায়। অসহ্য! ভদ্রলোকের লুঙ্গি হাঁটু পর্যন্ত উঠে এসেছে। কাঠির মতো দুটো পা বের হয়ে আছে। পা ভর্তি পাকা লোম। ভদ্রলোক আবার কিছুক্ষণ পর পর এক পা দিয়ে আরেক পা ঘসছেন। পায়ের বেহালা বাজাচ্ছেন। কি কুৎসিত! কি
false
bongkim
চলিল। চিকিৎসক বলিলেন, “তুমি ইহাকে লইয়া গিয়া, রক্তসকল ধুইয়া দাও। আমি ঔষধ লইয়া যাইতেছি |” শান্তি জীবানন্দকে পুষ্করিণীতীরে লইয়া গিয়া রক্ত ধৌত করিল। তখনই চিকিৎসক বন্য লতা – পাতার প্রলেপ লইয়া আসিয়া সকল ক্ষতমুখে দিলেন, তার পর, বারংবার জীবানন্দের সর্বাঙ্গে হাত বুলাইলেন। তখন জীবানন্দ এক দীর্ঘনি:শ্বাস ছাড়িয়া উঠিয়া বসিল। শান্তির মুখপানে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “যুদ্ধে কার জয় হইল?” শান্তি বলিল, “তোমারই জয়। এই মহাত্মাকে প্রণাম কর |” তখন উভয়ে দেখিল, কেহ কোথাও নাই! কাহাকে প্রণাম করিবে? নিকটে বিজয়ী সন্তানসেনার বিষম কোলাহল শুনা যাইতেছিল, কিন্তু শান্তি বা জীবানন্দ কেহই উঠিল না – সেই পূর্ণচন্দ্রের কিরণে সমুজ্জ্বল পুষ্করিণীর সোপানে বসিয়া রহিল। জীবানন্দের শরীর ঔষধের গুণে, অতি অল্প সময়েই সুস্থ হইয়া আসিল। তিনি বলিলেন, “শান্তি! সেই চিকিৎসকের ঔষধের আশ্চর্য গুণ! আমার শরীরে আর কোন বেদনা বা গ্লানি নাই – এখন কোথায় যাইবে চল। ঐ সন্তানসেনার জয়ের উৎসবের গোল শুনা যাইতেছে |” শান্তি বলিল, “আর ওখানে না। মার কার্যোদ্ধার হইয়াছে – এ দেশ সন্তানের হইয়াছে। আমরা রাজ্যের ভাগ চাহি না – এখন আর কি করিতে যাইব?” জী। যা কাড়িয়া লইয়াছি, তা বাহুবলে রাখিতে হইবে। শা। রাখিবার জন্য মহেন্দ্র আছেন, সত্যানন্দ স্বয়ং আছেন। তুমি প্রায়শ্চিত্ত করিয়া সন্তানধর্মের জন্য দেহত্যাগ করিয়াছিলে ; এ পুন:প্রাপ্ত দেহে সন্তানের আর কোন অধিকার নাই। আমরা সন্তানের পক্ষে মরিয়াছি। এখন আমাদের দেখিলে সন্তানেরা বলিবে, “জীবানন্দ যুদ্ধের সময়ে প্রায়শ্চিত্তভয়ে লুকাইয়াছিল, জয় হইয়াছে দেখিয়া রাজ্যের ভাগ লইতে আসিয়াছে |” জী। সে কি শান্তি? লোকের অপবাদভয়ে আপনার কাজ ছাড়িব? আমার কাজ মাতৃসেবা, যে যা বলুক না কেন, আমি মাতৃসেবাই করিব। শা। তাহাতে তোমার আর অধিকার নাই – কেন না, তোমার দেহ মাতৃসেবার জন্য পরিত্যাগ করিয়াছ। যদি আবার মার সেবা করিতে পাইলে, তবে তোমার প্রায়শ্চিত্ত কি হইল? মাতৃসেবায় বঞ্চিত হওয়াই এ প্রায়শ্চিত্তের প্রধান অংশ। নহিলে শুধু তুচ্ছ প্রাণ পরিত্যাগ কি বড় একটা ভারি কাজ? জী। শান্তি! তুমিই সার বুঝিতে পার। আমি এ প্রায়শ্চিত্ত অসম্পূর্ণ রাখিব না। আমার সুখ সন্তানধর্মে – সে সুখে আমাকে বঞ্চিত করিব। কিন্তু যাইব কোথায়? মাতৃসেবা ত্যাগ করিয়া, গৃহে গিয়া ত সুখভোগ করা হইবে না। শা। তা কি আমি বলিতেছি? ছি! আমরা আর গৃহী নহি ; এমনই দুই জনে সন্ন্যাসীই থাকিব – চিরব্রহ্মচর্য পালন করিব। চল, এখন গিয়া দেশে তীর্থদর্শন করিয়া বেড়াই। জী। তার পর? শা। তার পর – হিমালয়ের উপর কুটীর প্রস্তুত করিয়া, দুই জনে দেবতার আরাধনা করিব – যাতে মার মঙ্গল হয়, সেই বর মাগিব। তখন দুই জনে উঠিয়া, হাত ধরাধরি করিয়া জ্যোৎস্নাময় নিশীথে অনন্তে অন্তর্হিত হইল। হায়! আবার আসিবে কি মা! জীবানন্দের ন্যায় পুত্র, শান্তির ন্যায় কন্যা, আবার গর্ভে ধরিবে কি? অষ্টম পরিচ্ছেদ সত্যানন্দ ঠাকুর রণক্ষেত্র হইতে কাহাকে কিছু না বলিয়া আনন্দমঠে চলিয়া আসিলেন। সেখানে গভীর রাত্রে, বিষ্ণুমণ্ডপে বসিয়া ধ্যানে প্রবৃত্ত। এমত সময়ে সেই চিকিৎসক সেখানে আসিয়া দেখা দিলেন। দেখিয়া সত্যানন্দ উঠিয়া প্রণাম করিলেন। চিকিৎসক বলিলেন, “সত্যানন্দ, আজ মাঘী পূর্ণিমা |” স। চলুন – আমি প্রস্তুত। কিন্তু হে মহাত্মন্! – আমার এক সন্দেহ ভঞ্জন করুন। আমি যে মুহূর্তে যুদ্ধজয় করিয়া সনাতনধর্ম নিষ্কণ্টক করিলাম – সেই সময়েই আমার প্রতি এ প্রত্যাখ্যানের আদেশ কেন হইল? যিনি আসিয়াছিলেন, তিনি বলিলেন, “তোমার কার্য সিদ্ধ হইয়াছে, মুসলমানরাজ্য ধ্বংস হইয়াছে। আর তোমার এখন কোন কার্য নাই। অনর্থক প্রাণিহত্যার প্রয়োজন নাই।” স। মুসলমানরাজ্য ধ্বংস হইয়াছে, কিন্তু হিন্দুরাজ্য স্থাপিত হয় নাই – এখনও কলিকাতায় ইংরেজ প্রবল। তিনি। হিন্দুরাজ্য এখন স্থাপিত হইবে না – তুমি থাকিলে এখন অনর্থক নরহত্যা হইবে। অতএব চল। শুনিয়া সত্যানন্দ তীব্র মর্মপীড়ায় কাতর হইলেন। বলিলেন, “হে প্রভু! যদি হিন্দুরাজ্য স্থাপিত হইবে না, তবে কে রাজা হইবে? আবার কি মুসলমান রাজা হইবে?” তিনি বলিলেন, “না, এখন ইংরেজ রাজা হইবে |” সত্যানন্দের দুই চক্ষে জলধারা বহিতে লাগিল। তিনি উপরিস্থিতা, মাতৃরূপা জন্মভূমি প্রতিমার দিকে ফিরিয়া জোড়হাতে বাষ্পনিরুদ্ধস্বরে বলিতে লাগিলেন, “হায় মা! তোমার উদ্ধার করিতে পারিলাম না – আবার তুমি ম্লেচ্ছের হাতে পড়িবে। সন্তানের অপরাধ লইও না। হায় মা! কেন আজ রণক্ষেত্রে আমার মৃত্যু হইল না।” চিকিৎসক বলিলেন, “সত্যানন্দ, কাতর হইও না। তুমি বুদ্ধির ভ্রমক্রমে দস্যুবৃত্তির দ্বারা ধন সংগ্রহ করিয়া রণজয় করিয়াছ। পাপের কখন পবিত্র ফল হয় না। অতএব তোমরা দেশের উদ্ধার করিতে পারিবে না। আর যাহা হইবে, তাহা ভালই হইবে। ইংরেজ রাজা না হইলে সনাতনধর্মের পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা নাই। মহাপুরুষেরা যেরূপ বুঝিয়াছেন, এ কথা আমি তোমাকে সেইরূপ বুঝাই। মনোযোগ দিয়া শুন। তেত্রিশ কোটি দেবতার পূজা সনাতনধর্ম নহে, সে একটা লৌকিক অপকৃষ্ট ধর্ম; তাহার প্রভাবে প্রকৃত সনাতনধর্ম – ম্লেচ্ছেরা যাহাকে হিন্দুধর্ম বলে – তাহা লোপ পাইয়াছে। প্রকৃত হিন্দুধর্ম জ্ঞানাত্মক, কর্মাত্মক নহে। সেই জ্ঞান দুই প্রকার বহির্বিষয়ক ও অন্তর্বিষয়ক। অন্তর্বিষয়ক যে জ্ঞান, সে-ই সনাতনধর্মের প্রধান ভাগ। কিন্তু বহির্বিষয়ক জ্ঞান আগে না জন্মিলে অন্তর্বিষয়ক জ্ঞান জন্মিবার সম্ভাবনা নাই। স্থূল কি, তাহা না জানিলে, সূক্ষ্ম কি, তাহা জানা যায় না। এখন এ দেশে অনেকদিন হইতে বহির্বিষয়ক জ্ঞান বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে – কাজেই প্রকৃত সনাতনধর্মও লোপ পাইয়াছে। সনাতনধর্মের পুনরুদ্ধার করিতে গেলে, আগে বহির্বিষয়ক জ্ঞানের প্রচার করা আবশ্যক। এখন এদেশে বহির্বিষয়ক জ্ঞান নাই – শিখায় এমন লোক নাই; আমরা লোকশিক্ষায় পটু নহি। অতএব ভিন্ন
false
shunil_gongopaddhay
জোজো বলল, তা হতে পারে। কিন্তু ও লোকটা কাকাবাবুর কাছে ক্ষমা চায়নি। ইন্দ্রজিৎ অবাক হয়ে বললেন, তার মানে? ক্ষমা চাইবার মতো কী কাজ করেছে সেলিম? কাকাবাবু বললেন, সে কিছু না। অতি সামান্য ব্যাপার। জোজো, আমরা বলেছি না, ওটা আমরা ভুলে যাব? ইন্দ্রজিৎ বললেন, ও কাকাবাবু, আপনি তো এখানে এসেই একটা দারুণ কাজ করে ফেলেছেন। এবার কাকাবাবুর অবাক হওয়ার পালা। তিনি বললেন, আমি আবার কী দারুণ কাজ করলাম? ইন্দ্রজিৎ বললেন, আপনি পুলিশকে খুব সাহায্য করেছেন। কাকাবাবু আবার বললেন, পুলিশকে সাহায্য করেছি? কই, কিছু তো করিনি! ইন্দ্রজিৎ বললেন, জাভেদ নামে একজন ইনস্পেক্টর এসেছিল, আপনি তাকে একটা টিপস দিয়েছেন, তাতেই তো মহম্মদি বেগের ছুরিটা উদ্ধার করা গেল। কাকাবাবু বললেন, তাই নাকি? ইন্দ্রজিৎ বললেন, ওটা চুরি যাওয়ার ঠিক আগে হাজারদুয়ারির সামনে একটা যাত্রাপার্টি এসে নানারকম বাজনা বাজিয়ে লড়াই-লড়াই খেলা দেখাচ্ছিল। আপনি সেই যাত্রাপার্টির খোঁজ নিতে বলেছিলেন। তাদের খোঁজ পেতেই সব ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে গেল। সেই যাত্রাপার্টির লোকরা স্বীকার করেছে যে, কোনও একজন লোক তাদের বলেছিল, ঠিক ওই সময় ওই জায়গায় গিয়ে খেলাটা দেখাতে। ওই খেলা দেখার জন্য সকলে ভিড় করেছিল, হাজারদুয়ারির গার্ডরাও উঁকিঝুকি মারছিল, সেই সুযোগে চোর ওই ছুরিটা সরিয়ে ফেলে। সেই সূত্র ধরে কে টাকা দিয়েছিল, তাও জানা গেল। সেই লোকটা বলল, তাকে টাকা দিয়েছে অন্য একজন। কাকাবাবু বললেন, চোর ধরা পড়েছে শেষ পর্যন্ত? ইন্দ্রজিৎ বললেন, পুলিশ খুব ভাল কাজ করেছে, তবু একটু দেরি করে ফেলেছে। মূল টাকাটা যে দিয়েছিল, পুলিশ তার বাড়িতেও পৌঁছে গেল। সে বাড়িতে শুধু একজন কাজের লোক ছিল। সে বলল, পুলিশ আসার কিছুক্ষণ আগেই তিনজন লোক তার মালিকের কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে ধরে নিয়ে গেছে। সে বাড়ি সার্চ করে অবশ্য ছুরিটা পাওয়া গিয়েছে। কাকাবাবু বললেন, সামান্য একটা ছুরির জন্য এত কাণ্ড! কেন? ইন্দ্রজিৎ বললেন, সেটা নিশ্চয়ই জানা যাবে। কারা ওকে ধরে নিয়ে গেল, সেটাও দেখতে হবে। কাকাবাবু বললেন, সেই লোকটি কে? ইন্দ্রজিৎ বললেন, তার নাম ফিরোজ শাহ। হিন্দু না মুসলমান তা বোঝা যাচ্ছে না। এই ফিরোজ বেশির ভাগ সময় থাকে লন্ডনে। ওখানে ব্যাবসা করে। ও নাকি এখানকারই কোনও মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। তাই আসে মাঝে মাঝে। ওর এক আত্মীয়ের একটা বাড়ি আছে এখানে। সেই আত্মীয়ও এখন বেঁচে নেই। একজন কাজের লোক নিয়ে একা থাকে। সন্তু জিজ্ঞেস করল, ছুরিটা চুরি করতে গেল কেন? ইন্দ্রজিৎ বললেন, সে তো ওকে জেরা না করলে জানা যাবে না। তবে অন্য লোকটি বলেছে, ওর নাকি নানা দেশের ছুরি জমানোর শখ। যারা ওকে ধরে নিয়ে গিয়েছে, তারা কিন্তু ছুরিটা নেয়নি, কিছুই নেয়নি। বোধহয় ওরা অপহরণ করেছে টাকার জন্য। এরকম তো প্রায়ই ব্যবসায়ীদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। জোজো বলল, অ্যাবডাকশন! এরপর টাকা চাইবে। কিন্তু চাইবে কার কাছে? ওর তো বাড়িতে একজন কাজের লোক ছাড়া আর কেউ নেই বললেন? ইন্দ্রজিৎ বললেন, সেটাও ঠিক। দেখা যাক। পুলিশ এর মধ্যে তল্লাশি শুরু করেছে। কাকাবাবু বললেন, ছুরিটা এখন কোথায়? থানায়? খুব সাবধানে রাখতে বলো। হয়তো এর মধ্যে অন্য কোনও ব্যাপার আছে! কিছুক্ষণ পর খাবারের ডাক পড়ল। আজ শুধু দুরকমের মাছ আর মিষ্টি দই। এ হোটেলের রান্না বেশ ভাল। এখন হোটেলে বেশি লোক নেই, দোতলাটা প্রায় ফাঁকা। কাকাবাবুরা দুটো ঘর নিয়েছেন। সন্তুদের পাশের দুটো ঘর তালাবন্ধ। খাওয়ার পর সন্তু আর জোজো বলল, ওরা একটু ঘুরে আসবে। রাত্তিরবেলা। হাজারদুয়ারি কেমন দেখায়, ওরা দেখতে চায়। কাকাবাবু আপত্তি করলেন না। শুধু বললেন, একটু সাবধানে, চোখকান খোলা রাখিস। তোদের যদি কেউ অপহরণ করে, তা হলে টাকা চাইলে আমি তো দিতে পারব না। অত টাকা পাব কোথায়? জোজো বলল, আমাদের যদি কেউ অপহরণ করে, তবে তার কপালে দুঃখ আছে। কাকাবাবু হাসলেন, এটা জোজো ঠিকই বলেছে। ওরা চলে যাওয়ার পর কাকাবাবু একা বসে রইলেন বারান্দায়। একটু পরেই তিনি ঘোড়ার খুরের শব্দ পেলেন। সেলিম আজও ঘোড়া ছোটাচ্ছে? আর তো কাউকে ঘোড়া চালাতে দেখা যায়নি এখানে। ঘোড়াটা অবশ্য থামল না। কাকাবাবুর মাথায় ঘুরছে সেলিমের কথা। অত বড় লোকের ছেলে, সকলে তাকে ভদ্র, ভাল ছেলে বলে জানে। অথচ সে একটা মানুষ খুন করতে চাইছে। কেন? সেটা কিছুতেই বোঝা যাচ্ছে না। ইন্দ্রজিৎকে এই কথা জানিয়ে কোনও লাভ হত না। একটা খুন হলে তারপর পুলিশ তৎপর হয়ে ওঠে। কিন্তু খুন হওয়ার আগে তা নিয়ে পুলিশ মাথা ঘামাবে কেন? কত লোকই তো বলতে পারে, আমি অমুককে খুন করব। কিন্তু সত্যি সত্যি কজন খুন করে? সেলিমকে সবাই পছন্দ করে, শুধু শুধু পুলিশ তার উপরে নজরও রাখবে না। সন্তুরা ফিরে এল ঘণ্টাখানেক পরে। দুজনেই ফুর্তিতে আছে বেশ। আর-একটু গল্প করার পর কাকাবাবু বললেন, এবার তোরা শুয়ে পড়। কাল সকালে বেরিয়ে বাকি জায়গাগুলো দেখে নিতে হবে। কাকাবাবু নিজের ঘরে এসে দরজা লক করে দিলেন। দরজাটা বেশ মজবুত, বাইরে থেকে খোলা যাবে না। এ ঘরের তিনটে জানলা। তিনি সব জানলা বন্ধ করে ঘুমোতে পারেন না। প্রত্যেকটা জানলার কাছে দাঁড়িয়ে দেখলেন, একটা জানলার কাছে একটা গাছ আছে। অন্য দুটো জানলার কাছাকাছি কিছু নেই, একেবারে ফাঁকা। তিনি শুধু গাছের কাছের জানলাটা বন্ধ রাখলেন। রিভলভারটা রাখলেন বালিশের নীচে। একটু পরেই তার ঘুম এসে গেল। কাকাবাবুর ঘুম খুব পাতলা। সামান্য শব্দেই ঘুম ভেঙে যায়।
false
shorotchandra
অপূর্ব উঠিয়া বসিল। চোখ রগড়াইয়া হাই তুলিয়া কহিল, উঃ—এই রাত্রে আবার ফিরে আসতে হলো! ভারতী টানাটানি করিয়া একটা জানালা রুদ্ধ করিতেছিল, বলিল, যাবার সময় এ কথা বলে গেলেন না কেন? সরকার-মশায়কে দিয়ে আপনার খাবারটা একেবারে আনিয়ে রেখে দিতাম! কথা শুনিয়া অপূর্বর ঘুম-ভাঙ্গা গলার শব্দ একেবারে তীক্ষ্ণ হইয়া উঠিল, কহিল, তার মানে? ফিরে আসবার কথা আমি জানতাম নাকি? ভারতী লোহার ছিটকিনিটা চাপিয়া বন্ধ করিয়া দিয়া সহজকণ্ঠে জবাব দিল, আমারই ভুল হয়েছে। খাবার কথাটা তখনি তাঁকে বলে পাঠানো উচিত ছিল। এত রাত্তিরে আর হাঙ্গামা পোয়াতে হতো না। এতক্ষণ কোথায় দুজনে বসে কাটালেন? অপূর্ব কহিল, তাঁকেই জিজ্ঞেসা করবেন। ক্রোশ-তিনেক পথ হাঁটার নাম বসে কাটানো কি না, আমি ঠিক জানিনে। ভারতীর জানালা বন্ধ করার কাজ তখনও সম্পূর্ণ হয় নাই, ছিটের পর্দাটা টানিয়া দিতেছিল, সেই কাজেই নিযুক্ত থাকিয়া বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিল, ইস্‌, গোলকধাঁধার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন বলুন! হাঁটাই সার হল । এই বলিয়া সে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া একটু হাসিয়া কহিল, সন্ধ্যা-আহ্নিক করার বালাই এখনো আছে, না গেছে? থাকে ত কাপড় দিচ্চি ওগুলো সব ছেড়ে ফেলুন। এই বলিয়া সে অঞ্চলসুদ্ধ চাবির গোছা হাতে লইয়া একটা আলমারি খুলিতে খুলিতে কহিল, তেওয়ারী বেচারা ভেবে সারা হয়ে যাবে। আজ ত দেখচি আফিস থেকে একবার বাসায় যাবারও সময় পাননি। অপূর্ব রাগ চাপিয়া বলিল, অবশ্য আপনি এমন অনেক জিনিস দেখতে পান যা আমি পাইনে তা স্বীকার করচি, কিন্তু কাপড় বার করবার দরকার নেই। সন্ধ্যা-আহ্নিকের বালাই আমার যায়নি, এ জন্মে যাবেও তা মনে হয় না, কিন্তু আপনার দেওয়া কাপড়েও তার সুবিধে হবে না। থাক, কষ্ট করবেন না। ভারতী কহিল, দেখুন আগে কি দিই— অপূর্ব বলিল, আমি জানি তসর কিংবা গরদ। কিন্তু আমার প্রয়োজন নেই,—আপনি বার করবেন না। সন্ধ্যা করবেন না? না। শোবেন কি পরে? আফিসের ওই কোট-পেন্টুলানসুদ্ধ নাকি? হাঁ। খাবেন না? না। সত্যি? অপূর্বর কণ্ঠস্বরে বহুক্ষণ হইতেই তাহার সহজ সুর ছিল না, এবার সে স্পষ্টই রাগ করিয়া কহিল, আপনি কি তামাশা করচেন নাকি? ভারতী মুখ তুলিয়া তাহার মুখের দিকে চাহিল, বলিল, তামাশা ত আপনিই করচেন। আপনার সাধ্য আছে না খেয়ে উপোস করে থাকেন? এই বলিয়া সে আলমারির মধ্য হইতে একখানি সুন্দর গরদের শাড়ী বাহির করিয়া কহিল, একেবারে নিভাঁজ পবিত্র। আমিও কোন দিন পরিনি। ওই ছোট ঘরটায় গিয়ে কাপড় ছেড়ে আসুন, নীচে কল আছে, আমি আলো দেখাচ্চি, হাত-মুখ ধুয়ে ওইখানেই মনে মনে সন্ধ্যা-আহ্নিক সেরে নিন। নিরুপায়ে এ ব্যবস্থা শাস্ত্রে আছে,—ভয়ঙ্কর অপরাধ কিছু হবে না। হঠাৎ তাহার গলার শব্দ ও কথা বলার ভঙ্গী এমন বদলাইয়া গেল যে অপূর্ব থতমত খাইয়া গেল। তাহার দপ করিয়া মনে পড়িল সেদিন ভোরবেলাতেও ঠিক যেন এমনি করিয়াই কথা কহিয়া সে ঘর হইতে বাহির হইয়া গিয়াছিল। অপূর্ব হাত বাড়াইয়া আস্তে আস্তে বলিল, দিন না কাপড়,—আমি নিজেই আলো নিয়ে নীচে যাচ্চি। আমি কিন্তু যার-তার হাতে ভাত খেতে পারব না তা বলে দিচ্চি। ভারতী নরম হইয়া কহিল, সরকারমশায় যে ভাল বামুন। গরীব লোক, হোটেল করেছেন, কিন্তু অনাচারী নন। নিজে রাঁধেন, সবাই তাঁর হাতে খায়,—কেউ আপত্তি করে না—আমাদের ডাক্তারবাবুর খাবার পর্যন্ত তাঁর কাছ থেকেই আসে। তথাপি অপূর্বর কুণ্ঠা ঘুচিল না, বিরসমুখে কহিল, যা-তা খেতে আমার বড় ঘৃণা বোধ হয়। ভারতী হাসিল, কহিল, যা-তা খেতে কি আমিই আপনাকে দিতে পারি? আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁকে দিয়ে সমস্ত গুছিয়ে আনবো,—তাহলে ত আর আপত্তি হবে না?—এই বলিয়া সে আবার একটু হাসিল। অপূর্ব আর প্রতিবাদ করিল না, আলো এবং কাপড় লইয়া নীচে চলিয়া গেল, কিন্তু তাহার মুখ দেখিয়া ভারতীর বুঝিতে বাকী রহিল না যে সে হোটেলের অন্ন আহার করিতে অত্যন্ত সঙ্কোচ ও বিঘ্ন অনুভব করিতেছে। কিছুক্ষণ পরে অপূর্ব যখন গরদের শাড়ী পরিয়া নীচের একটা কাঠের বেঞ্চে বসিয়া আহ্নিকে নিযুক্ত, ভারতী দ্বার খুলিয়া একাকী অন্ধকারে বাহির হইয়া গেল, বলিয়া গেল, সরকারমশায়কে লইয়া ফিরিয়া আসিতে তাহার বিলম্ব হইবে না, ততক্ষণ সে যেন নীচেই থাকে। বস্তুতঃ ফিরিতে তাহার দেরি হইল না। সেই মাত্র অপূর্বর আহ্নিক শেষ হইয়াছে, ভারতী আলো হাতে করিয়া অত্যন্ত সন্তর্পণে প্রবেশ করিল, সঙ্গে তাহার সরকারমশায়, হাতে তাঁহার খাবারের থালা একটা বড় পিতলের গামলা দিয়া ঢাকা, তাঁহার পিছনে আর একজন লোক জলের গ্লাস এবং আসন আনিয়াছে, সে ঘরের একটা কোণ ভারতীর নির্দেশমত জল ছিটাইয়া মুছিয়া লইয়া ঠাঁই করিয়া দিলে ব্রাহ্মণ অন্নপাত্র রক্ষা করিলেন। সকলে প্রস্থান করিলে ভারতী কবাট বন্ধ করিয়া দিয়া গলায় অঞ্চল দিয়া যুক্তকরে সবিনয়ে নিবেদন করিল, এ ম্লেচ্ছের অন্ন নয়, সমস্ত খরচ ডাক্তারবাবুর। আপনি অসঙ্কোচে আতিথ্য স্বীকার করুন। কিন্তু তাহার এই সকৌতুক পরিহাসটুকু অপূর্ব প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করিতে পারিল না। সে জাতি মানে, যে-সে লোকের ছোঁয়া খায় না, হোটেলে প্রস্তুত অন্ন ভক্ষণে কিছুতেই তাহার রুচি হয় না, কিন্তু তাই বলিয়া দামের পয়সাটা আজ ম্লেচ্ছ দিল কি অধ্যাপক ব্রাহ্মণ দিলেন এত গোঁড়ামিও তাহার ছিল না। বড়ভাইয়েরা তাহার শুদ্ধাচারিণী মাতাকে অনেক দুঃখ দিয়াছে, ভাল হউক মন্দ হউক সেই মায়ের আদেশ ও অন্তরের ইচ্ছাকে তাহার লঙ্ঘন করিতে অত্যন্ত ক্লেশ বোধ হয়। এ কথা ভারতী যে একেবারে জানে না তাহাও নয়, অথচ, যখন-তখন তাহার এই আচার-নিষ্ঠাকেই লক্ষ্য করিয়া ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ সৃষ্টি করার চেষ্টায় মন তাহার উত্যক্ত হইয়া উঠিল। কিন্তু কোন জবাব না
false
MZI
পেছন ফিরে গলা উঁচিয়ে স্লোগান ধরছে, অন্যেরা তার উত্তর দিচ্ছে। দূর থেকে সব স্লোগান শোনা যাচ্ছে না, অ্যাকশান অ্যাকশান, ডাইরেক্ট অ্যাকশান এবং প্রশাসনের গদিতে, আগুন জ্বালো একসাথে এই দুটি স্লোগান সে বুঝতে পারল। মিছিলটা খুব বড় নয়। মুক্তিযুদ্ধ চত্বরের আশপাশে ঘুরপাক খেতে থাকে, কখনোই সাদা পাজেরো থেকে বেশি দূরে সরে যাচ্ছে না। রাফি দূর থেকে লক্ষ করে, হঠাৎ মিছিলটি মুক্তিযুদ্ধ চত্বর থেকে বের হয়ে রাস্তায় উঠে আসে, কারণটাও সে সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারে। রাস্তা ধরে সাফারি কোট পরা দুজন মানুষ হেঁটে আসছে; একজন শারমিনের হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে, শারমিনের চোখে-মুখে এক ধরনের অসহায় আতঙ্ক। মানুষ দুজন শারমিনকে নিয়ে রাস্তার একপাশে সরে দাঁড়িয়ে মিছিলটিকে চলে যাওয়ার জন্য জায়গা দিল। মিছিলটি কিন্তু চলে না গিয়ে একেবারে হুঁড়মুড় করে মানুষ দুজনের ওপর গিয়ে পড়ল। একটা জটলা, জটলার মাঝে হুঁটোপুটি হচ্ছে, চিৎকার-হইচই-চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। রাফির মনে হলো, ভেতরে মারপিট শুরু হয়েছে। সে একটু এগিয়ে যাবে কি না ভাবছিল, ঠিক তখন দেখল ভিড়ের মাঝখান থেকে ভোটকা হান্নান শারমিনের হাত ধরে বের হয়ে তাকে নিয়ে ছুটছে। যেভাবে মারামারি শুরু হয়েছিল, ঠিক সেভাবেই সেটা শেষ হয়ে গেল। ছাত্রদের দলটি হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর রাফি মানুষ দুটিকে দেখতে পায়, শার্টের বোতাম ছেড়া, বিধ্বস্ত চেহারা। একজন মানুষ অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে বারবার তার বগলে, পেটের কাছে হাত দিয়ে কিছু একটা খুঁজছে। তার কিছু একটা হারিয়ে গেছে। রাফি অফিসে এসে দেখল, ভোটকা হান্নান একটা চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছে। কাছাকাছি আরেকটা চেয়ারে শারমিন মুখ কালো করে বসে আছে। রাফিকে দেখে হান্নান উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিল, তার মুখে এগাল-ওগাল জোড়া হাসি। হাসিকে আরও বিস্তৃত হতে দিয়ে বলল, স্যার, আপনার শারমিনকে নিয়ে এসেছি। হ্যাঁ, দেখেছি। থ্যাংকু। যখন যেটা দরকার হয়, বলবেন স্যার। হ্যাঁ, বলব। আপনি তাহলে শারমিনকে দেখবেন, স্যার। হ্যাঁ, দেখব। আমি তাহলে যাই? আমাকে আরেকটু সাহায্য করতে পারবে? কী সাহায্য, স্যার? দশ-বারো বছরের ছেলের জন্য একটা প্যান্ট আর শার্ট কিনে দিতে পারবে? হান্নান বলল, ঠিক আছে, স্যার কম হান্নান যখন চলে যাচ্ছিল, তখন রাফি তাকে ডাকল। বলল, হান্নান, আরও একটা জিনিস। কী জিনিস? ওই লোকগুলোকে দেখে মনে হলো, তাদের কিছু একটা হারিয়ে গেছে। হান্নানের মুখে আবার হাসি ফুটে উঠল। বলল, আপনাদের ওই সব বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। এগুলো আমাদের ব্যাপার। তোমাদের ব্যাপার? জি, স্যার। আজকে বিশাল বিজনেস হলো। থ্যাংকু স্যার। রাফি কী বলবে বুঝতে না পেরে বলল, ইউ আর ওয়েলকাম। কথাটি বলে তার নিজেকে কেমন জানি বোকা বোকা মনে হতে থাকে। হান্নান চলে যাওয়ার পর শারমিন রাফির কাছে এসে বলল, স্যার, আমার খুব ভয় করছে। রাফি বলল, তোমার ভয় পাওয়া খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এখন আর ভয় নেই। কেন ভয় নেই, স্যার? ওরা যদি আবার আসে? আসলে আসবে। আমি আছি না? স্যার। বলো, শারমিন। ওই লোক দুটি খুব খারাপ। তুমি কেমন করে জানো? আমাকে বলেছে, আমাকে নাকি কেটে আমার ব্রেন নিয়ে যাবে। রাফি কিছু বলল না। শারমিন বলল, কেন আমার ব্রেন নিয়ে যেতে চায়? কারা আমার ব্রেন নিয়ে যেতে চায়? আমি জানি না, শারমিন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শারমিন নিচু গলায় বলল, স্যার। বলো। আমার খুব ভয় করছে, স্যার। রাফির শারমিনের জন্য খুব মায়া হলো। সে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, শোনো, শারমিন। আমি তোমার কাছে আছি। কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। সত্যি, স্যার? হ্যাঁ, সত্যি। এই প্রথমবার শারমিনের মুখে একটু হাসি ফুটে উঠল। মেয়েটি রাফির কথা বিশ্বাস করেছে। ইউনিভার্সিটির গেটে সাদা পাজেরোটি নিয়ে মানুষ দুটি অপেক্ষা করছিল। রাফি তাদের সামনে দিয়েই শারমিনকে নিয়ে বের হয়ে এল, মানুষ দুটি টেরও পেল না। টের পাওয়ার কথাও না। কারণ রাফি শারমিনের চুল ছোট করে ছেলেদের মতো করে কাটিয়েছে। একটা হাফপ্যান্ট আর শার্ট পরিয়েছে, পায়ে সাদা টেনিস শু—তাকে দেখাচ্ছে ঠিক একজন বাচ্চা ছেলের মতো। রাফি সরাসরি রেলস্টেশনে চলে এসে ট্রেনের টিকিট কিনে ট্রেনে উঠেছে। আজ রাতেই সে ঢাকা পৌঁছাতে চায়। ঈশিতার ফোন পায়নি সত্যি, কিন্তু মাজু বাঙালি নামের একজন মানুষ তাকে ফোন করে বলেছে, সে তার সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলতে চায়। রাফি তাই ঢাকা রওনা দিয়েছে। শারমিনকে রেখে যেতে সাহস পায়নি—তার বাবাও খুব ভয় পেয়েছে। নিজের কাছে রাখার চেয়ে শারমিনকে রাফির কাছে রাখাই তার বেশি নিরাপদ মনে হয়েছে। শারমিন তাই রাফির সঙ্গে ঢাকা যাচ্ছে—তার নাম অবশ্যি এখন শারমিন নয়, আপাতত তাকে শামীম বলে ডাকা হচ্ছে। গভীর রাতে শারমিন যখন রাফির ঘাড়ে মাথা রেখে ট্রেনের দুলুনিতে ঘুমিয়ে পড়েছে, ঠিক তখন এনডেভারের ভেতর বব লাস্কি সাফারি কোট পরা মানুষ দুজনের সঙ্গে কথা বলছে। মানুষ দুজন হেলিকপ্টারে করে রাতের মধ্যেই ফিরে এসেছে। বব লাস্কি তাদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, কী বললে? মেয়েটাকে তোমাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিল? মধ্য বয়স্ক মানুষটি মাথা নাড়ে। হ্যাঁ, শুধু মেয়েটাকে না, আমার রিভলবারটাও। তোমার রিভলবারটাও? হ্যাঁ। ছাত্রগুলো ভয়ংকর বদ। কীভাবে খবর পেল, বুঝতে পারলাম। বব লাস্কি হুঙ্কার দিয়ে বলল, কিন্তু তোমরা মেয়েটাকে না নিয়ে ফিরে এসেছে কেন? মেয়েটা এখন সেখানে নেই। তাহলে এখন কোথায়? আমরা খোঁজ নিচ্ছি, পেয়ে যাব। কেমন করে পাবে? রাফি নামের ছেলেটাও নাই।
false
shomresh
হয়ে যেতে বাধ্য। মায়া আর করুণা কি এক? সুদীপ জানে না। কিন্তু মায়ের জন্যে তার কষ্ট হত। অবনী তালুকদারের বিশাল ব্যক্তিত্বের কাছে মা কেন এমন কুঁকড়ে থাকবেন? কিন্তু এ তো গেল ভেতরের ব্যাপার। মায়ের শরীর নিয়ে প্রাথমিক দুশ্চিন্তা এবং কষ্টের সময়টুকু পার হয়ে গেলে সে যখন জেনেছিল আর কখনও সুস্থ হবার সম্ভাবনা নেই তখন থেকেই নিজের অজান্তে মনের রাশ ঢিলে হতে শুরু করেছিল। ঠিকঠাক চিকিৎসার নামে তদারকি চলছে, নার্স আছে, ব্যাস! মায়ের যন্ত্রণাগুলো, শরীরের বিভিন্ন উপসর্গগুলো বারংবার একই চেহারা নিয়ে আসছে ফিরে যাচ্ছে। এ থেকে যখন আর কোন পরিত্রাণের আশা নেই তখন অনুভূতির চামড়া একটু একটু করে মোটা হয়ে গেল। একমাত্র মৃত্যু-সংবাদ ছাড়া মা আর কোন আলোড়ন তুলতে পারবেন না এবং সেটাও একটা মুক্তির নিঃশ্বাস ছাড়ার মত। সত্যি বড় কষ্ট পাচ্ছিল। এভাবে বেঁচে মরে থাকার চাইতে অনেক আগেই চলে গেলে ঢের বেশি বেঁচে যেত। অতএব, ব্যাপারটা এমনভাবে ভেবেছে সুদীপ। প্রিয়জন সে যতই প্রিয় হোক না কেন, অসুস্থ হয়ে পড়লে এবং সে অসুখে জীবনহানির সম্ভাবনা থাকলে তো বটেই, মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতিকারের জন্যে। হয়তো শেষ সম্বল ব্যয় করতেও কার্পণ্য করে না। কিন্তু যদি সেই অসুস্থতা দীর্ঘকালীন হয়, যদি কোনদিন সুস্থ হবার সম্ভাবনা না থাকে তখন একসময় দায় বলে মনে হতে বাধ্য। কেউ মুখে বলেন, কেউ ব্যবহারে প্রকাশ করে ফেলেন, কেউ বলেন না বোঝেন না কিন্তু মনে মনে জানেন মুক্তি পেলে ভাল হত। সুদীপ খাটের এ-পাশে চলে এল। যত দিন যাচ্ছে তত মায়ের শরীর ছোট হয়ে আসছে। মুখ বসে গিয়েছে, চোখ কোটরে। কিন্তু চুলগুলো প্রায় একইরকম আছে। হয়তো নিয়মিত স্নান হয় না বা তেল মাখানো সম্ভব হয়নি বলে ফুলে-ফেঁপে একাকার। একটা মানুষের চেহারা পালটাতে পালটাতেও তো কিছুটা থেকে যায়। সেই থেকে যাওয়া শরীর নিয়ে মা এখন শুয়ে আছেন। চোখ বন্ধ। মাঝে মাঝে শরীরটা কাঁপছে। বসুন। সুদীপ চমকে ফিরে তাকাল। মহিলার মুখে একটু বিব্রত হাসি, হাত বাড়িয়ে ডেক-চেয়ার দেখিয়ে দিলেন তিনি। সুদীপ মাথা নাড়ল, কেমন আছেন এখন? আছেন এই পর্যন্ত। সমস্ত শরীরে বেডসোর হয়ে গেছে। আমি পাউডার দিচ্ছি কিন্তু আসলে উনি যদি বসতেও পারতেন তাহলে। বেডসোর! সে তো সেরে গিয়েছিল। প্রথমবার হয়ে সেরে যায়। কিন্তু আবার হলে সামলানো মুশকিল। সেইটেই হয়েছে। দেখবেন? সুদীপ কিছু বলার আগেই মহিলা এগিয়ে গিয়ে মায়ের শরীর থেকে চাদর সরিয়ে নিল খানিকটা। আর চমকে উঠল সুদীপ। হাঁটুর ওপর থেকে কোমর পর্যন্ত চাপ চাপ শাল ঘা বীভৎস হয়ে আছে। মহিলা চাদর নামিয়ে দিলেন। এ-পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে রেখেছি কারণ ওদিকটায় সামান্য কম। কিন্তু বেশিক্ষণ এভাবে রাখাও যাবে না। ওঁর যে কি যন্ত্রণা হচ্ছে কি বলব। ডাক্তারবাবুকে বলেছেন? আমি আসার পর একবারই ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। দিনে যিনি থাকেন তিনি বললেন, ডাক্তারবাবু বলেছেন ওষুধ দিতে। বিশেষ কিছু করার নেই। আপনি বসুন না। এবার মহিলা আর একটা চেয়ার এনে কাছে রাখলেন। সুদীপ বসল। নার্স মহিলা বোধহয় অনেকক্ষণ কথা না বলে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন এবং কথা বেশি বলাই বোধহয় স্বভাব, খুব যন্ত্রণা পাচ্ছেন। এরকম কেস তো আমি আগে দেখেছি। কেউ কেউ বছরের পর বছর কষ্ট পেয়ে পেয়ে তবে যেতে পারেন। উনি আপনার সঙ্গে কথা বলেছেন? হ্যাঁ। তবে স্পষ্ট বলতে পারেন না তো। খনখনে হয়ে গেছে গলার স্বর। আর কথা বলতেও কষ্ট হয়। তবে এর মধ্যে মজার কথাও বলেছেন। কিরকম? সুদীপ অবাক হল। এই তো আজ বিকেলে এলে বললেন, তুমি এলে ভাল লাগে। বেশ দেখতে ভাল তুমি। আমি মনে মনে হেসে বাঁচি না। আমাকেও নাকি ভাল দেখতে। সুদীপ ভদ্রমহিলার দিকে তাকাল। একটু লাজুক অভিব্যক্তি, চোখে চোখ পড়তে মুখ নামালেন। মধ্যতিরিশে শরীর যথেষ্ট যৌবনবতী। সে বলল, মাকে কি ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে? হ্যাঁ। না হলে যে ঘুমুতেই পারেন না। এত যন্ত্রণা নিয়ে বিনা ওষুধে কি ঘুমানো যায়? ও! সুদীপ বুঝল এখন এই ঘরে বসে কোনও লাভ নেই। নিশ্চয়ই ঘুমের ওষুধের পরিমাণটা বেশি না হলে অমন নিঃসাড়ে পড়ে থাকতে পারে না কেউ। মানুষের জীবনীশক্তি কখনও কখনও বিস্ময় ছাড়িয়ে যায়। তিনবার সিরিয়াস অ্যাটাক হয়ে গেছে। একসময় ব্রেন কাজ করছিল না, সমস্ত শরীর অসাড় হয়ে গিয়েছিল, ম্যাসেজ করে চিকিৎসায় থেকে থেকে শরীরে সামান্য সাড় এল, মুখে আবার কথা ফুটল। কিন্তু প্রেসার নিয়ত এমন কম বেশি হতে লাগল যে চতুর্থ অ্যাটাকের জন্যে তৈরি ছিল ওরা। এবং সেটাই শেষবার একথা সবাই জানত। তার বদলে ব্লাড ইউরিয়া বাড়ল। যাবতীয় রোগ একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এখন সব ছেড়ে শুধু বেডসোর নিয়ে দুশ্চিন্তা করা ছাড়া কোনও উপায় নেই। এক একটা রাত আগে এমন কেটেছে যে ভোর হবার আগেই মা চলে যাবেন বলে মনে হত। অথচ এইভাবে বেঁচে মরে থাকতে হচ্ছে। সুদীপ উঠল, আপনি খাওয়া-দাওয়া করেছেন? হ্যাঁ। ফ্ল্যাক্সে চা রেখেছি, খাবেন? না। আপনি আর বসে থেকে কি করবেন! উনি যখন উঠবেন না তখন শুয়ে পড়ুন। আমাদের কি শুলে চলে। পেসেন্ট ঘুমের ঘোরে পেচ্ছাপ পায়খানা করে ফেলতে পারে। জেগে থাকা ছাড়া কোন উপায় নেই। মহিলা হাসলেন। সুদীপ মনে মনে বলল, সে তো দেখতেই পেয়েছি ঘরে ঢোকার সময়। সে যাওয়ার সময় বলল, ঠিক আছে। কাল সকালে এসে মায়ের সঙ্গে কথা বলব। মহিলা বললেন, যদি কোনও কারণে রাত্রে ঘুম ভাঙে
false
humayun_ahmed
কালাপাহাড়! হ্যাঁ। আমি যেখানে যাই সে আমার পেছনে পেছনে যায়। কী আশ্চর্য! শফিক বলল, আশ্চর্য কেন? অবন্তি বলল, এ রকম একটা ভয়ংকর কুকুর আপনার সঙ্গী, এইজন্যেই বললাম, কী আশ্চর্য। অবন্তি অনেক রানাবানা করেছিল। সে তার দাদাজানের জন্যে সত্যি সত্যি হোটেল থেকেও খাবার আনিয়েছিল—ডাল গোশত। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো তার পার্টিতে কেউ এল না। খালেদ মোশাররফ এলেন না। তিনি কেন আসছেন না, তা জানালেনও না। এই ধরনের কাজ তিনি আগে কখনো করেন নি। শামীম শিকদার দেশে নেই। সে নাকি কোন আর্মি অফিসারকে বিয়ে করে দেশ ছেড়ে চলে গেছে। শফিককে সন্ধ্যাবেলা পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেছে। রাধানাথ বাবুকে কে বা কারা ধারালো ছুরি দিয়ে গলা কেটে হত্যা করেছে। তার আদর্শলিপি প্রেসের অনেক কর্মচারীর মতো শফিকও একজন সাসপেক্ট। রমনা থানার ওসির সঙ্গে শফিকের প্রাথমিক কথোপকথন— আপনার সঙ্গে আবার দেখা হলো। জি স্যার। রাধানাথ বাবু খুন হয়েছেন, এটা জানেন তো? কিছুক্ষণ আগে জেনেছি। এখন বলুন, রাধানাথ বাবুর গলায় ছুরিটা কি আপনি বসিয়েছেন, নাকি আপনার কোনো সঙ্গী? জবেহ করে কাউকে হত্যা একা করা যায় না। কয়েকজন লাগে। একজন ছুরি চালায়, বাকিরা ধরে থাকে। বুঝেছেন? জি স্যার। ভেরি গুড। এখন মুখ খুলুন। শফিক মুখ খুলতে পারল না। অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। দুঃস্বপ্ন দেখে প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদের ঘুম ভাঙল। ভয়ে এবং উত্তেজনায় তার হাঁপানির মতো হয়ে গেল। অনেকক্ষণ ধরে বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্ত করার চেষ্টা করলেন। নিজেকে সামলানো যাচ্ছে না। তার হাত পারকিনসন্স রোগীর মতো কাঁপছে। পিপাসায় বুক শুকিয়ে কাঠ। তাঁর স্বপ্ন খুব ভয়ংকর কিন্তু ছিল না। স্বপ্নটা বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক। আতংকে অস্থির হওয়ার মতো কিছু না। তিনি দেখেছেন তাঁর আগামসি লেনের বাড়ির ছাদে তিনি বসে আছেন। তাঁর সামনে একগাদা কবুতর। তিনি কবুতরকে চাল খাওয়াচ্ছেন। হঠাৎ চিলেকোঠার দরজায় প্রচণ্ড শব্দ হতে লাগল। শব্দে সব কবুতর উড়ে গেল। তিনি তাকিয়ে দেখেন ছাদের দরজা এবং দেয়াল ভেঙে প্রকাণ্ড এক ট্যাংক ঢুকেছে। স্বপ্নে ছাদে ট্যাংক আসা খুবই স্বাভাবিক মনে হলো। ট্যাংকের ভেতর কর্নেল ফারুক বসে আছেন। ফারুকের চোখে কালো চশমা, গায়ে কিছু নেই, খালি গা। স্বপ্নে এই বিষয়টাও মোটেই অস্বাভাবিক মনে হলো না। কর্নেল ফারুক বললেন, কবুতরগুলি খুবই যন্ত্রণা করছে। দিন-রাত বাকবাকুম ডাক। আমি কবুতর মারতে এসেছি। মোশতাক বললেন, উত্তম কাজ করেছেন। সব কবুতর মেরে ফেলা উচিত। কাকগুলি থাকুক। এরা ময়লা খেয়ে আবর্জনা পরিষ্কার করে। কবুতর কোনো কাজের পাখি না। ছাদে আবারও ঘড়ঘড় শব্দ। আরেকটা ট্যাংক ঢুকছে। তার পেছনে আরেকটা, তার পেছনে আরেকটা। ট্যাংকগুলি নির্বিচারে কামান দাগতে শুরু করেছে। খন্দকার মোশতাক যখন ট্যাংকের স্বপ্ন দেখছেন তখন কাকতালীয়ভাবে মেজর ফারুক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে আটটা ট্যাংক এনে বঙ্গভবনের চারদিকে বসাচ্ছিলেন। বঙ্গভবনে আগেই আটটা ট্যাংক ছিল, এখন হলো যোলটা। বঙ্গভবন পুরোপুরি সুরক্ষিত। ষোলটা ট্যাংক ডিঙিয়ে কেউ এখানে ঢুকবে না। সে যত বড় বীরপুরুষই হোক। ফারুক আতংকে অস্থির হয়ে ছিলেন, কারণ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মমাশাররফের ভাবভঙ্গি মোটেই তার ভালো মনে হচ্ছিল না। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন কর্নেল শাফাত জামিল। বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট থেকেও ট্রপস মুভমেন্ট শুরু হয়েছে। খালেদ মোশাররফের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কর্নেল হুদাও যুক্ত হয়েছেন। কর্নেল হুদার ভাবভঙ্গিও ভালো না। রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ১০ এবং ১৫ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট আসছে। এরা মুক্তিযুদ্ধের সময় খালেদ মোশাররফের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। কোনো কারণে যদি খালেদ মোশাররফ বঙ্গভবন আক্রমণ করেন তাহলে ভরসা ট্যাংকবহর। ফারুকের আতংকগ্রস্ত হওয়ার আরেকটি কারণ আন্ধা হাফেজ। আন্ধা হাফেজ খবর পাঠিয়েছেন—ফারুকের বাহিনী পনেরই আগস্টে বাড়াবাড়ি করেছে, তার ফল অশুভ হয়েছে। ফারুকের উচিত জীবন বাঁচানোর জন্যে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া এবং কোনোদিন দেশে ফিরে না আসা। নভেম্বরের দুই তারিখ ভোরে ফারুক ব্যাকুল হয়ে টেলিফোন করলেন কর্নেল ওসমানীকে। তিনি যেন খালেদ মোশাররফের সঙ্গে কথা বলে একটা সমঝোতায় আসেন। এখন মোটামুটি পরিষ্কার, খালেদ মোশাররফ কিছু ঘটাতে যাচ্ছেন। সেনাকর্মকর্তারা সবাই কোনো-না-কোনো সময়ে বঙ্গভবনে এসেছেন। চা-পানি খেয়েছেন। মেজর ফারুক, মেজর রশীদ ও মেজর ডালিমের সঙ্গে গল্পগুজব করেছেন। একমাত্র ব্যতিক্রম খালেদ মোশাররফ। তিনি কখনো আসেন নি। কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে খালেদ মোশাররফের সংক্ষিপ্ত টেলিফোন কথোপকথন— ওসমানী : খালেদ, এইসব কী হচ্ছে! খালেদ : কিছুই হচ্ছে না স্যার। আপনি ট্যাংকগুলিকে ঘরে যাওয়ার নির্দেশ দিন। ওসমানী : আমি বঙ্গভবনে যাচ্ছি, তুমিও আসো। আমরা কথা বলি। মেজর রশীদ তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছে। খালেদ মোশাররফ : আমার সঙ্গে কী কথা? খুনি মেজররা যারা দেশ শাসন করছে তাদের সঙ্গে আমার কোনো কথা নেই। ওসমানী : বঙ্গভবনে জোর গুজব, জিয়াকে হত্যা করা হয়েছে। তুমি কি জিয়াকে হত্যা করেছ? খালেদ মোশাররফ : আমি রক্তপাতে বিশ্বাস করি না। জিয়াকে আটক করা হয়েছে, হত্যা করা হয় নি। তবে বঙ্গভবনে ঢুকে একজনকে আমার হত্যা করার ইচ্ছা আছে। আপনি কি তার নাম শুনতে চান? তিনি প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক। শ্বেত সর্প। ওসমানী : কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে যাবে না। [এই পর্যায়ে টেলিফোনের লাইন কেটে গেল।] বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট সাহেব জোহরের নামাজ শেষ করে, চোখ বন্ধ করে জায়নামাজে বসে আছেন। তিনি দরুদে তুনাজ্জিনা পাঠ করছেন। মানবজীবনের যাবতীয় বিপদ-আপদ থেকে মুক্তিলাভের জন্যে এই দোয়ার শক্তি সর্বজনস্বীকৃত। মোশতাক সাহেবের একাগ্র মনোেযোগ ব্যাহত হলো। মেজর রশীদের গলা— আপনি দেখি বঙ্গভবনকে মসজিদ বানিয়ে ফেলেছেন! সারাক্ষণ নামাজ কালাম পড়লে রাষ্ট্রকার্য পরিচালনা
false
bongkim
চাহিয়া রহিলেন–মুখে মনুষ্যের সাধ্যাতীত রোগের ছায়া। মাধবীনাথ তাঁহার সঙ্গে কথা কহিলেন না–মাধবীনাথ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন যে, ইহজন্মে আর গোবিন্দলালের সঙ্গে কথা কহিবেন না। বিনাবাক্যে মাধবীনাথ চলিয়া গেলেন। গোবিন্দলাল গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া ভ্রমরের শয্যাগৃহতলস্থ সেই পুষ্পোদ্যানে গেলেন। যামিনী যথার্থই বলিয়াছেন, সেখানে আর পুষ্পোদ্যান নাই। সকলই ঘাস খড় ও জঙ্গলে পুরিয়া গিয়াছে–দুই একটি অমর পুষ্পবৃক্ষ সেই জঙ্গলের মধ্যে অর্ধমৃতবৎ আছে–কিন্তু তাহাতে আর ফুল ফুটে না। গোবিন্দলাল অনেক্ষণ সেই খড়বনের মধ্যে বেড়াইলেন। অনেক বেলা হইল–রৌদ্রের অত্যন্ত তেজ: হইল–গোবিন্দলাল বেড়াইয়া বেড়াইয়া শ্রান্ত হইয়া শেষে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। তথা হইতে গোবিন্দলাল কাহারও সঙ্গে বাক্যালাপ না করিয়া, কাহারও মুখপানে না চাহিয়া বারুণী-পুষ্করিণী-তটে গেলেন। বেলা দেড় প্রহর হইয়াছে। তীব্র রৌদ্রের তেজে বারুণীর গভীর কৃষ্ণজ্জ্বল বারিরাশি জ্বলিতেছিল–স্ত্রী পুরুষ বহুসংখ্যক লোক ঘাটে স্নান করিতেছিল–ছেলেরা কালো জলে স্ফাটিক চূর্ণ করিতে করিতে সাঁতার দিতেছিল। গোবিন্দলালের তত লোকসমাগম ভাল লাগিল না। ঘাট হইতে যেখানে বারুণীতীরে, তাঁহার সেই নানাপুষ্পরঞ্জিত নন্দনতুল্য পুষ্পোদ্যান ছিল, গোবিন্দলাল সেই দিকে গেলেন। প্রথমেই দেখিলেন, রেলিং ভাঙ্গিয়া গিয়াছে –সেই লৌহনির্মিত বিচিত্র দ্বারের পরিবর্তে কঞ্চির বেড়া। ভ্রমর গোবিন্দলালের জন্য সকল সম্পত্তি যত্নে রক্ষা করিয়াছিলেন, কিন্তু এ উদ্যানের প্রতি কিছুমাত্র যত্ন করেন নাই। একদিন যামিনী সে বাগানের কথা বলিয়াছিলেন–ভ্রমর বলিয়াছিল, “আমি যমের বাড়ী চলিলাম–আমার সে নন্দনকাননও ধ্বংস হউক। দিদি, পৃথিবীতে যা আমার স্বর্গ ছিল–তা আর কাহাকে দিয়া যাইব?” গোবিন্দলাল দেখিলেন ফটক নাই–রেলিং পড়িয়া আছে। প্রবেশ করিয়া দেখিলেন–ফুলগাছ নাই–কেবল উলুবন, আর কচুগাছ, ঘেঁটু ফুলের গাছ, কালকাসন্দা গাছে বাগান পরিপূর্ন। লতামন্ডপসকল ভাঙ্গিয়া পড়িয়া গিয়াছে—প্রস্তরমূর্তি সকল দুই তিন খন্ডে বিভক্ত হইয়া ভূমে গড়াগড়ি যাইতেছে–তাহার উপর লতা সকল ব্যাপিয়াছে, কোনটা বা ভগ্নাবস্থায় দণ্ডায়মান আছে। প্রমোদভবনের ছাদ ভাঙ্গিয়া গিয়াছে; ঝিলমিল শার্সি কে ভাঙ্গিয়া লইয়া গিয়াছে–মর্মরপ্রস্তর সকল কে হর্ম্যতল হইতে খুলিয়া তুলিয়া লইয়া গিয়াছে–সে বাগানে আর ফুল ফুটে না–ফল ফলে না–বুঝি সুবাতাসও আর বয় না। একটা ভগ্ন প্রস্তরমূতির পদতলে গোবিন্দলাল বসিলেন। ক্রমে মধ্যাহ্নকাল উপস্থিত হইল, গোবিন্দলাল সেইখানে বসিয়া রহিলেন। প্রচণ্ড সূর্যতেজে তাঁহার মস্তক উত্তপ্ত হইয়া উঠিল। কিন্তু গোবিন্দলাল কিছুই অনুভব করিলেন না। তাঁহার প্রাণ যায়। রাত্রি অবধি কেবল ভ্রমর ও রোহিণী ভাবিতেছিলেন। একবার ভ্রমর, তার পর রোহিণী, আবার ভ্রমর, আবার রোহিণী। ভাবিতে ভাবিতে চক্ষে ভ্রমরকে দেখিতে লাগিলেন, সম্মুখে রোহিণীকে দেখিতে লাগিলেন। জগৎ ভ্রমর-রোহিণীময় হইয়া উঠিল। সেই উদ্যানে বসিয়া প্রত্যেক বৃক্ষকে ভ্রমর বলিয়া ভ্রম হইতে লাগিল–প্রত্যেক বৃক্ষছায়ায় রোহিণী বসিয়া আছে দেখিতে লাগিলেন। এই ভ্রমর দাঁড়াইয়াছিল–আর নাই–এই রোহিণী আসিল, আবার কোথায় গেল? প্রতি শব্দে ভ্রমর বা রোহিণীর কণ্ঠ শুনিতে লাগিলেন। ঘাটে স্নানকারীরা কথা কহিতেছে, তাহাতে কখনও বোধ হইল ভ্রমর কথা কহিতেছে–কখনও বোধ হইতে লাগিল রোহিণী কথা কহিতেছে–কখনও বোধ হইল তাহারা দুই জনে কথোপকথন করিতেছে। শুষ্ক পত্র নড়িতেছে–বোধ হইল ভ্রমর আসিতেছে–বনমধ্যে বন কীটপতঙ্গ নড়িতেছে–বোধ হইল রোহিণী পলাইতেছে। বাতাসে শাখা দুলিতেছে–বোধ হইল ভ্রমর নিশ্বাস ত্যাগ করিতেছে–দয়েল ডাকিলে বোধ হইল রোহিণী গান করিতেছে। জগৎ ভ্রমর-রোহিণীময় হইল। বেলা দুই প্রহর–আড়াই প্রহর হইল–গোবিন্দলাল সেইখানে–সেই ভগ্নপুত্তলপদতলে–সেই ভ্রমর-রোহিণীময় জগতে। বেলা তিন প্রহর, সার্ধ তিন প্রহর হইল–অস্নাত অনাহারী গোবিন্দলাল সেইখানে, সেই ভ্রমর-রোহিণীময় অনলকুণ্ডে। সন্ধ্যা হইল, তথাপি গোবিন্দলালের উত্থান নাই–চৈতন্য নাই। তাঁহার পৌরজনে তাঁহাকে সমস্ত দিন না দেখিয়া মনে করিয়াছিল, তিনি কলিকাতায় চলিয়া গিয়াছেন, সুতরাং তাঁহার অধিক সন্ধান করা নাই। সেইখানে সন্ধ্যা হইল। কাননে অন্ধকার হইল। আকাশে নক্ষত্র ফুটিল। পৃথিবী নীরব হইল। গোবিন্দলাল সেইখানে। অকস্মাৎ সেই অন্ধকার, স্তব্ধ বিজন মধ্যে গোবিন্দলালের উন্মাদগ্রস্ত চিত্ত বিষম বিকার প্রাপ্ত হইল। তিনি স্পষ্টাক্ষরে কণ্ঠস্বর শুনিলেন। রোহিণী উচ্চৈঃস্বরে যেন বলিতেছে, “এইখানে!” গোবিন্দলালের তখন আর স্মরণ ছিল না যে, রোহিণী মরিয়াছে। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “এইখানে–কি?” যেন শুনিলেন, রোহিণী বলিতেছে– “এমনি সময়ে!” গোবিন্দলাল কলে বলিলেন, “এইখানে, এমনি সময়ে, কি রোহিণী?” মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত গোবিন্দলাল শুনিলেন, আবার রোহিণী উত্তর করিল, “এইখানে, এমনি সময়ে ঐ জলে, “আমি ডুবিয়াছিলাম!” গোবিন্দলাল আপন মানসোদ্ভূত এই বাণী শুনিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমি ডুবিব?” আবার ব্যাধিজনিত উত্তর শুনিলেন, “হাঁ, আইস। ভ্রমর স্বর্গে বসিয়া বলিয়া পাঠাইতেছে, তাহার পুণ্যবলে আমাদিগকে উদ্ধার করিবে। প্রায়শ্চিত্ত কর। মর |” গোবিন্দলাল চক্ষু বুজিলেন। তাঁহার শরীর অবসন্ন, বেপমান হইল। তিনি মূর্ছিত হইয়া সোপানশিলার উপরে পতিত হইলেন। মুগ্ধাবস্থায়, মানস চক্ষে দেখিলেন, সহসা রোহিণীমূর্তি অন্ধকারে মিলাইয়া গেল। তখন দিগন্ত ক্রমশ: প্রভাসিত করিয়া জ্যোতির্ময়ী ভ্রমরমূর্তি সম্মুখে উদিত হইল। ভ্রমরমূর্তি বলিল, “মরিবে কেন? মরিও না। আমাকে হারাইয়াছ, তাই মরিবে? আমার অপেক্ষাও প্রিয় কেহ আছেন। বাঁচিলে তাঁহাকে পাইবে |” গোবিন্দলাল সে রাত্রে মূর্ছিত অবস্থায় সেখানে পড়িয়া রহিলেন। প্রভাতে সন্ধান পাইয়া তাঁহার লোকজন তাঁহাকে তুলিয়া গৃহে লইয়া গেল। তাঁহার দূরবস্থা দেখিয়া মাধবীনাথেরও দয়া হইল। সকলে মিলিয়া তাঁহার চিকিৎসা করাইলেন। দুই তিন মাসে গোবিন্দলাল প্রকৃতিস্থ হইলেন। সকলেই প্রত্যাশা করিতে লাগিলেন যে, তিনি এক্ষণে গৃহে বাস করিবেন। কিন্তু গোবিন্দলাল তাহা করিলেন না। এক রাত্রি তিনি কাহাকে কিছু না বলিয়া কোথায় চলিয়া গেলেন। কেহ আর তাঁহার কোন সংবাদ পাইল না। সাত বৎসরের পর, তাঁহার শ্রাদ্ধ হইল। পরিশিষ্ট গোবিন্দলালের সম্পত্তি তাঁহার ভাগিনেয় শচীকান্ত প্রাপ্ত হইল। শচীকান্ত বয়ঃপ্রাপ্ত। শচীকান্ত প্রত্যহ সেই ভ্রষ্টশোভ কাননে–যেখানে আগে গোবিন্দলালের প্রমোদোদ্যান ছিল–এখন নিবিড় জঙ্গল–সেইখানে বেড়াইতে আসিত। শচীকান্ত সেই দুঃখময়ী কাহিনী সবিস্তারে শুনিয়াছিল। প্রত্যহ সেইখানে বেড়াইতে আসিত, এবং সেইখানে বসিয়া সেই কথা ভাবিত। ভাবিয়া ভাবিয়া আবার সেইখানে সে উদ্যান প্রস্তুত করিতে আরম্ভ করিল। আবার বিচিত্র রেলিং প্রস্তুত করিল–পুষ্করিণীতে
false
shomresh
দিদিমণি। দারোয়ান বলল, কৌনসা দিদিমণি? নাম ক্যা? অনি বলল, তপুদিদিমণি! স্বৰ্গছেঁড়া থেকে এসেছে। কা বোলতা? পুরা নাম কহ। দারোয়ান খিঁচিয়ে উঠল। পুরো নাম জানি না। অনি বলল। তব ভাগো। দো মিনিট নেহি থা আর ফটসে ঘুস গিয়া। যা ভাগ। লিডিস স্কুলমে ঘুঁসনেমে বহুত মজা-হাঁ? লোকটা অনির হাত ধরে টানতে টানতে গেটের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। অনি বলল, আমাকে ছেড়ে দাও, আমি চলে যাচ্ছি। ওর খুব লজ্জা করছিল। মাঠের অন্য মেয়েরা ওর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ একটি মেয়ে দৌড়ে ওদের দিকে দারোয়ানকে ডাকতে ডাকতে এল। ডাক শুনে দারোয়ান ওকে ধরে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। ওর শক্ত লোহার মতো আঙুলের চাপে অনির হাত ভেঙে যাবার উপক্রম। হলি। মেয়েটি হপতে হাঁপাতে কাছে এসে বলল, দারোয়ান, দিদি ওকে ছেড়ে দিতে বলল। কোন দিদি? দারোয়ান বোধহয় এটা আশা করেনি। ডেপুটি দিদি। মেয়েটি কথাটা বলতেই দারোয়ান ওর হাত ছেড়ে দিল। অনির মনে হল, ওর হাতটা নিজের কবজির কাছে ভেঙে গেছে। একটুও সাড়া পাচ্ছে না। অন্য হাতটা দিয়ে ও অবশ্য জায়গাটায় মালিশ করতে গিয়ে নল মেয়েটি তাকে বলছে, তোমাকে দিদিমণি ডাকছেন। খুব অবাক হয়ে অনি ওর মুখের দিকে তাকাল। ফ্রক-পরা এই মেয়েটি মাথায় তারই মতো লম্বা, দৌড়ে এসেছে বলে মুখটা একটু লালচে। ও বলল, আমাকে মেয়েটি ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল। কে? অনি টিক বুঝতে পারছিল না। ডেপুটি দিদি। আমি তো–! অনি ভয় পেল, হয়তো তার এই প্রবেশের জন্য স্কুলের কর্তৃপক্ষ ওকে শাস্তি দেবেন, শুধু দারোয়ানের আঙুলের চাপই যথেষ্ট নয় অনি ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, এখানে তপু দিদিমণি কোথায় আছে, স্বৰ্গছেঁড়ায় থাকতেন? মেয়েটিকে তুমি বলতে কেমন বাধল অনির। উনিই তো আমাদের ডেপুটি। উনিই তোমাকে ডাকছেন। অনির বোকামি দেখে মেয়েটি ঠোঁট টিপে হাসল। তুপুপিসি কী ধরনের কাজ করে যাতে তাকে ডেপুটি বলা যায় তার কোনো ধারণা ছিল না অনির। ও মেয়েটির পেছনে পেছনে অনেকটা পথ হেঁটে এল। এর আগে কোনো গার্লস স্কুলের ভেতর ও ঢোকেনি, এখন এতগুলো মেয়ের মধ্যে প্রশ্ন দৃষ্টির সামনে হাঁটতে গিয়ে অনির খুব অস্বস্তি হতে লাগল। অদ্ভুত এক আড়ষ্টতা এবং পুরুষালি সপ্রতিততা একসঙ্গে ওকে পেয়ে বসল। মাঠের শেষে চেয়ারে গা এলিয়ে তপূপিসি বসেছিল। অনিদের আসতে দেখে উঠে দাঁড়াল। অনি খানিকটা দূর থেকে তপুপিসিকে দেখে খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল। ভীষণ রোগা হয়ে গেছে তপূপিসি। মুখচোখ যেন কেমন-কেমন, রাগী-রাগী মনে হয়। মেয়েটি বলল, দিদি, ওকে এনেছি। কথাটা শেষ হতেই তপপিসি ওকে হাত ধরে কাছে টেনে নেন, ওমা আমাদের অনি, তুই কত বড় হয়ে গেছিস! দূর তেকে দেখে আমি একদম অবাক। একবার ভাবি অনি কি না, তারপর হাঁটা দেখে বুঝলাম এ নির্ঘাত তুই। খুব লম্বা হয়েছিল যাহোক, সোজা হয়ে দাঁড়া দেখি, ওমা, আমি কোথায় যাব-তুই যে একদম আমার মাথায়-মাথায় হয়ে গেছিস! গালে হাত দিতেই তপূপিসির মুখের গাভীর্য কোথায় পালিয়ে গেল। এই ধরনের কথা শুনে অনির খুব ভালো লাগছিল। এইভাবে নিজের লোকের মতো কথা কেউ বলে না আজকাল। ও দেখল মেয়েটি বিস্ময়ে হাঁ হয়ে তপুপিসিকে দেখছে। বোধহয় ওদের কাছে, তপুপিসির এই চেহারাটা অজানা। তপুপিসি বলল, এই ছোঁড়া, সেই যে এলি, তারপর আর তপুপিসির স্বৰ্গছেঁড়ায় গেলি না? খুব নিষ্ঠুর তুই। তার পরেই ঘটনাটা মনে পড়ে যাওয়ায় গলাটা অদ্ভুত নরম হয়ে গেল তার, মায়ের জন্য খুব কষ্ট হয়, না রে? তপুপিসির হাতটা ওর কাধের ওপর ছিল। অনি মাথা নিচু করল! ও আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করেছে, ইদানীং মায়ের কথাবার্তা কেউ বললেও বেশ সহ্য করতে পারে, আগেকার মতো দমবন্ধ হয়ে কান্না পায় না। তোর নতুন মা কিন্তু খুব ভালো মেয়ে। আচ্ছা, তুই কার কাছে এসেছিস এখানে? কী পরিচিতি আছে এখানে? তপুপিসি যেন হঠাৎই বাস্তবে ফিরে এলে। হাসল অনি, তোমার কাছে এসেছিলাম। আমার কাছে সত্যি? তা হলে ফিরে যাচ্ছিলি কেন? দারোয়ান তাড়িয়ে দিচ্ছিল। তোমার পুরো নাম বলতে পারিনি। কথাটা শুনে হাঁ হয়ে গেল তপুপিসি, সে কী! তুই আমার নাম জানিস না? নিজেকে সামলাতে সামলাতে অনি বলল, কী করে জানব, তুমি ডেপুটি-ফেপুটি হয়েছ। ওমা, আরে আমি তো এই হোস্টেলে থাকি আর মেয়েদের খুব শাসন করি, তাই ওরা ডেপুটি সুপারিন্টেভেট করে দিয়েছে। তপুপিসি বোঝালেন। তা হারে, কার কাছে শুনলি আমি এখানে আছি? অনি বলল, শুনলাম পিসিমা বলছিল। তপুপিসি বলল, বড়দি, মোসোমশাই ভালো আছেন। অনি ঘাড় নাড়ল। কেউ তোকে পাঠিয়েছে আমার কাছে তপুপিসি চোখ বড় বড় করল! ঘাড় নাড়ল অনির, না। এই প্রথম অনির মনে হল, ও যে-জন্য তপুপিসির কাছে এসেছে সেটা বলতে ওর কেমন সঙ্কোচ হচ্ছে। ছোটকাকুর কোনো খবর পুপিসির কাছে পেতে হলে যে-সম্পর্কটা থাকা দরকার সেটা আছে কি? অনির মনে পড়ল সেই চিঠিটার কথা, যার অথ তখন সে বুঝতে পারেনি কিন্তু তপুপিসির জন্য কষ্ট হয়েছিল। এই তো তপুপিসি বাড়িঘর ছেড়ে একা একা এখানে আছেন, কেন, কী জন্যে? তপুপিসি জিজ্ঞাসা করল, কেন এসেছিল বলনা রে! এবার অনি ঠিক করল, ও বলেই ফেলবে। মাথা নিচু করে ও বলল, আমি একটা কথার মানে বুঝতে পারি না। ছোটকাকু থাকলে আমি জিজ্ঞাসা করতাম। তুমি জান কোথায় ছোটকাকু আছে? আমি জানব এই ধারণা তোর কী করে হল? যেন একটা গভীর কুয়োর ভেতর থেকে কথা বলছে তপুপিসি। অনি সত্যি কথা বলে
false
shirshendu
ফেললাম আমরা! মিস্টার বোস ভাবছেন। একটু ভাবুক না! রোজ তো ভাবে না, আজ ভাবুক। আপনার যা মানায়, আমাকে তো তা মানায় না। দোষটা বোধহয় আমার ঘাড়ে এসে পড়বে। কেন? আপনার দোষ কিসের? আমিই তো আসতে চেয়েছিলাম। দীপনাথ একটু শ্বাস ফেলল। সব কথা মণিদীপা বুঝবে না। বোঝানো যাবেও না। মণিদীপা আবার তার স্বভাবসিদ্ধ শ্লেষের হাসি হেসে বলে, ইউ আর এ স্লেভ। বন্ডেড লেবারার। বোসের মতো একজন কাকতাড়ুয়াকেও ভয় পান। আমিই যে সেই কাক। মণিদীপা সামান্য ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে, কথাটা মিথ্যে নয়। একটা কথা মনে রাখবেন, দীপনাথবাবু, আমি সম্পূর্ণ স্বাধীন। কারও কাছে দাসখত লিখে দিইনি, দেবও না। আমি কোথায় যাব না যাব সেটা আমিই ঠিক করতে ভালবাসি এবং তার জন্য কোনও জবাবদিহি করতে ভালবাসি না। মণিদীপা যে মোটেই তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েনি সেটা হঠাৎ চোখের দৃষ্টির খর বিদ্যুৎ এবং স্বরের কঠিন শীতলতায় হাড়ে হাড়ে টের পেল দীপনাথ। তার ভিতরে যে প্রত্যাশা, লোভ ও তরল এক রকমের আবেগ তৈরি হয়েছিল তা চোখের পলকে কেটে গেল। সে সচেতন হয়ে নড়েচড়ে বসল। তার পাশে যে মেয়েটা বসে আছে সে মোটেই মেয়েছেলে নয়। একজন দৃপ্ত কমরেড, একজন নির্বিকার বিপ্লবী। যদি কারও প্রেমে কখনও পড়ে থাকে মণিদীপা তবে সে দীপনাথ •ায়। সেই ভাগ্যবান বা দুর্ভাগা একজন স্কুলমাস্টার, স্নিগ্ধদেব। দীপনাথ কথার তোড়ে একটু কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিল। কী বলবে ভেবে না পেয়ে বেশ কিছুক্ষণ বাদে বলতে পারল, আমার দাদা-বউদি একটু সেকেলে। আপনার বোধহয়– মণিদীপা কথাটার জবাব দিল না। বাইরের দিকে চেয়ে শিথিল শরীরে বসে ছিল। মুখ গম্ভীর। দীপনাথ আর কিছু বলার সাহস পেল না। বাগানবাড়িতে তাদের অনুপ্রবেশ বিন্দুমাত্র আলোড়ন তুলল না। কেউ জিজ্ঞেস করল না কিছু। শিকারের পার্টি এখনও ফিরে আসেনি। দীপনাথ এতক্ষণ মনে মনে এই এক ভয়ই পাচ্ছিল। বোস সাহেব ফিরে এসে যদি শোনে— দীপনাথ নিশ্চিন্ত হল। মণিদীপা গাড়ি থেকে নেমে তাকে কোনও কথা না বলে সেই যে গটগট করে হেঁটে কোথায় চলে গেল তাকে আর দেখতে পেল না সে। খুঁজতেও সাহস হল না। মুহুর্মুহু মেয়েটার মেজাজ পালটে যায়। দীপনাথ চারদিকে চেয়ে দেখল, দুপুরের রোদে উঁচু সমাজের গৃহিণীরা গাছতলার টেবিলচেয়ারে থ ভঙ্গিতে বসে আছে। দুটো তাসের আড্ডা বসেছে। কয়েকজন পুরু আনাড়ির মতো ক্রিকেট খেলার চেষ্টা করছেন। বেয়ারারা বিয়ারের ট্রে নিয়ে ঘুরছে। দীপনাথ একটা নিরিবিলি গাছতলা বেছে নিয়ে মাথার ওপর হাত রেখে শুয়ে পড়ল। বউদি অঢেল খাইয়েছে। লাঞ্চে সে আজ অব কিছু খাবে না। আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ছিল সে। স্বপ্নের মধ্যে মণিদীপা এসে সামনে দাঁড়াল। পিছনে চাবুক হাতে বোস সাহেব। বোস সাহেবের ব্যাকগ্রাউন্ডে মণিদীপাকে আরও কঠিন ও সাংঘাতিক দেখাচ্ছে। মণিদীপ বলল, দীপনাথবাবু। দীপনাথ সঙ্গে সঙ্গে বলল, জানি। কী জানেন? আপনি আমাকে অপমান করবেন এইবার। অপমানটা আমি সবার আগে টের পাই। কী করে বুঝলেন? কারণ আমি সবসময়েই অপমানই প্রত্যাশা করি বলে। জীবনে আমি এতবার এত মানুষের অপমান সহ্য করেছি যে, আমাকে আর অপমান করার দরকারই নেই কারও। প্লিজ, আপনিও করবেন না। যারা কাপুরুষ তারাই অপমানিত হয়। কই, করুক তো স্কুলমাস্টার স্নিগ্ধদেবকে কেউ অপমান! এমন রুখে উঠবে যে যত বড় লোকই হোক না কেন, ওর চোখের সামনে দাঁড়াতেই পারবে না। জানি। স্নিগ্ধর আপনি কতটুকু জানেন? স্নিগ্ধদেবকে জানি না। কিন্তু চরিত্রবান মানুষদের জানি। তাদের কেউ অপমান করতে সাহস পায়। ব্যক্তিত্বওলা লোকদের চেনা শক্ত নয়। আপনার চোখের দৃষ্টি দেখেই আমি স্নিগ্ধদেবকে অনুমান করতে পারি। আমি তার চেয়ে বোধহয় অনেক বেশি স্বাস্থ্যবান, কিন্তু তার জোর অন্য জায়গায়। আমি জানি। মণিদীপা হাসল না। গম্ভীর মুখে বলল, স্নিগ্ধদেবের জোরটা কোথায় জানেন? না, বলুন শুনি? স্নিগ্ধদেব কখনও আমাকে কামনা করেনি। আর করেনি বলেই সে আমাকে কিনে রেখেছে। আর আপনি? আমি করেছি।–চোখ নামিয়ে দীপ বলল। আর কী জানেন? কী? স্নিগ্ধদেব কখনও তার বসকে খুশি করে জীবনে উন্নতি করতে চায়নি। স্নিগ্ধদেব কখনও টাকা-পয়সায় বড়লোক হতে চায় না। স্নিগ্ধদেব একা বড় হতে চায় না। তাই স্নিগ্ধ অত বড়। মানছি। আমি বড় নই। কেন বড় নন? সারা জীবন আমার কেটেছে বড় ভয়ে-ভয়ে। আতঙ্কে। নৈরাশ্যে। অনিশ্চয়তায়। স্নিগ্ধরও কি তার চেয়ে বেশি ভয়, আতঙ্ক, নৈরাশ্য বা অনিশ্চয়তার কারণ নেই? আছে। মানুষ যত বড় হয় তার সমস্যার বহরও তত বাড়ে। তা হলে? স্নিগ্ধদেব পারলে আপনি পারবেন না কেন? আমি যে বড় নই। ওটাও কাপুরুষের মতো কথা। আমার যে স্নিগ্ধদেবের ট্রেনিংটা নেই। আমার জীবনের তেমন কোনও লক্ষ্যও নেই। হতাশ হয়ে মণিদীপা বলে, কোনও লক্ষ্যই নেই? দীপ একটু ভেবে বলে, একটা লক্ষ্য আছে হয়তো। কিন্তু বললে আপনি হাসবেন। আমার জীবনের একটাই লক্ষ্য। একদিন স্বর্গের সমান উঁচু মহান এক পাহাড়ে উঠব। উঠব, কিন্তু চুড়ায় পৌছোব না কোনওদিন। পাহাড়ের ওপর উঠলে তাকে ছোট করে দেওয়া হয়। আমি পাহাড়ের চেয়ে উঁচু নই। আমি চাই উঠতে উঠতে একদিন সেই পাহাড়ের কোলেই ঢলে পড়ব। রোমান্টিক ইডিয়ট। সেন্টিমেন্টাল ফুল। শুনুন মিসেস বোস, আমার কথাটা একটু শুনুন। যখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি তখন একটা হারমাদ ছেলের সঙ্গে আমার লড়াই বাধে। খুবই সাংঘাতিক ছেলে। তার নাম ছিল সুকু। সে অসম্ভব ভাল সাইকেল চালাত, ছিল খুবই ভাল স্পোর্টসম্যান। তার গায়ে ছিল আমার দ্বিগুণ জোর। কী নিয়ে তার সঙ্গে আমার প্রথম লেগেছিল মনে নেই। বোধহয়
false
bongkim
থাকে, এজন্য দুইটা সর্পের দ্বারা হন্য ব্যক্তিকে দংশন করান রীতি ছিল। মবারক তাহা জানিতেন। তিনি দ্বিতীয় পিঞ্জরের উপর পা রাখিলেন, দ্বিতীয় মহাসর্পও তাঁহাকে দংশন করিয়া তীক্ষ্ণ বিষ ঢালিয়া দিল। মবারক তখন বিষের জ্বালায় জর্জ্জরীভূত ও নীলকান্তি হইয়া, ভূমে জানু পাতিয়া বসিয়া যুক্তকরে ডাকিতে লাগিল, “আল্লা আক‍‍বর! যদি কখনও তোমার দয়া পাইবার যোগ্য কার্‍য করিয়া থাকি, তবে এই সময়ে দয়া কর |” এইরূপে জগদীশ্বরের ধ্যান করিতে করিতে, তীব্র সর্পবিষে জর্‍জরীভূত হইয়া, মোগলবীর মবারক আলি প্রাণত্যাগ করিল। অষ্টম পরিচ্ছেদ : সব সমান রঙ‍মহালের সকল সংবাদই আসে–সকল সংবাদই জেব-উন্নিসা নিয়া থাকেন–তিনি নায়েবে বাদশাহ। মবারকের বধসংবাদও আসিয়া পৌঁছিল। জেব-উন্নিসা প্রত্যাশা করিয়াছিলেন যে, তিনি এই সংবাদে অত্যন্ত সুখী হইবেন। সহসা দেখিলেন যে, ঠিক বিপরীত ঘটিল। সংবাদ আসিবামাত্র সহসা তাঁহার চক্ষু জলে ভরিয়া বাহিয়া ধারায় ধারায় সে জল গড়াইতে লাগিল। শেষ দেখিলেন, চীৎকার করিয়া কাঁদিতে ইচ্ছা করিতেছে। জেব-উন্নিসা দ্বার রুদ্ধ করিয়া হস্তিদন্তনির্‍মিত রত্নখচিত পালঙ্কে শয়ন করিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। কৈ শাহজাদী? হস্তিদন্তনির্‍মিত রত্নদণ্ডভূষিত পালঙ্কে শুইলেও ত চক্ষুর জল থামে না! তুমি যদি বাহিরে গিয়া দিল্লীর সহরতলীর ভগ্ন কুটীরমধ্যে প্রবেশ করিতে, তাহা হইলে দেখিতে পাইতে, কত লোক ছেঁড়া কাঁথায় শুইয়া কত হাসিতেছে। তোমার মত কান্না কেহই কাঁদিতেছে না। জেব-উন্নিসার প্রথমে কিছু বোধ হইল যে, তাঁহার আপনার সুখের হানি তিনি আপনিই করিয়াছেন। ক্রমশ: বোধ হইল যে, সব সমান নহে–বাদশাহজাদীরাও ভালবাসে; জানিয়া হউক, না জানিয়া হউক, নারীদেহ ধারণ করিলেই ঐ পাপকে হৃদয়ে আশ্রয় দিতে হয়। জেব-উন্নিসা আপনা আপনি জিজ্ঞাসা করিল, “আমি তাকে এত ভালবাসিতাম, সে কথা এত দিন জানিতে পার নাই কেন?” কেহ তাহাকে বলিয়া দিল না যে, ঐশ্বর্‍যমদে তুমি অন্ধ হইয়াছিলে, রূপের গর্‍বে তুমি অন্ধ হইয়াছিলে, ইন্দ্রিয়ের দাসী হইয়া তুমি ভালবাসাকে চিনিতে পার নাই। তোমার উপযুক্ত দণ্ড হইয়াছে–কেহ যেন তোমাকে দয়া না করে। কেহ বলিয়া বলিয়া না দিক –তার নিজের মনে এ সকল কথা কিছু কিছু আপনা আপনি উদয় হইতে লাগিল। সঙ্গে সঙ্গে এমনও মনে হইল, ধর্‍মাধর্‍ম বুঝি আছে। যদি থাকে, তবে বড় অধর্‍মের কাজ হইয়াছে। শেষ ভয় হইল, ধর্‍মাধর্‍মের পুরস্কার দণ্ড যদি থাকে? তাহার পাপের যদি দণ্ডদাতা কেউ থাকেন? তিনি বাদশাহজাদী বলিয়া জেব-উন্নিসাকে মার্‍জনা করিবেন কি? সম্ভব নয়। জেব-উন্নিসার মনে ভয়ও হইল। দু:খে, শোকে, ভয়ে জেব-উন্নিসা দ্বার খুলিয়া তাহার বিশ্বাসী খোজা আসিরদ্দীনকে ডাকাইল। সে আসিলে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “সাপের বিষে মানুষ মরিলে তার কি চিকিৎসা আছে?” আসিরদ্দীন বলিল, “মরিলে আবার চিকিৎসা কি?” জেব। কখনও শুন নাই? আসি। হাতেম মাল এমনই একটা চিকিৎসা করিয়াছিল, কাণে শুনিয়াচি চক্ষে দেখি নাই। জেব-উন্নিসা একটু হাঁপ ছাড়িল। বলিল, “হাতেম মালকে চেন?” আ। চিনি। জে। সে কোথায় থাকে? আ। দিল্লীতে থাকে। জে। বাড়ী চেন? আ। চিনি। জে। এখন সেখানে যাইতে পারিবে? আ। হুকুম দিলেই যাইতে পারি। জে। আজ মবারক আলি (একটু গলা কাঁপিল) সর্পাঘাতে মরিয়াছে জান? আ। জানি। জে। কোথায় তাহাকে গোর দিয়াছে, জান? আ। দেখি নাই, কিন্তু যে গোরস্থানে গোর দিবে, তাহা আমি জানি। নূতন গোর, ঠিকানা করিয়া লইতে পারিব। জে। আমি তোমাকে দুই শত আশরফি দিতেছি। একশ হাতেম মালকে দিবে, একশ আপনি লইবে। মবারক আলির গোর খুঁড়িয়া মোরদা বাহির করিয়া, চিকিৎসা করিয়া তাহাকে বাঁচাইবে। যদি বাঁচে, তাহাকে আমার কাছে লইয়া আসিবে। এখনই যাও। আশরফি লইয়া খোজা আসিরদ্দীন তখনই বিদায় লইল। নবম পরিচ্ছেদ : সমিধ-সংগ্রহ–দরিয়া আর একবার রঙ‍মহালে পাথরের দ্রব্য বেচিয়া, মাণিকলাল নির্‍মলকুমারীর খবর লইল। এবারও সেই পাথরের কৌটা চাবি-বন্ধ হইয়া আসিয়াছিল। চাবি খুলিয়া, নির্‍মল পাইল–সেই দৌত্য পারাবত। নির্‍মল সেটিকে রাখিল। পত্রের দ্বারা, পূর্‍বমত সংবাদ পাঠাইল। লিখিল “সব মঙ্গল । তুমি এখন যাও আমি পূর্‍বেই বলিয়াছি, আমি বাদশাহয়ের সঙ্গে যাইব ।” মাণিকলাল তখন দোকান-পাট উঠাইয়া উদয়পুর যাত্রা করিল। রাত্রি প্রভাত হইবার তখন অল্প বিলম্ব আছে। দিল্লীর অনেক “দর‍ওয়াজা |” পাছে কেহ কিছু সন্দেহ করে, এজন্য মাণিকলাল আজমীর দর‍ওয়াজায় না গিয়া, অন্য দর্‍ওয়াজায় চলিল। পথিপার্শ্বে একটা সামান্য গোরস্থান আছে। একটা গোরের নিকট দুইটা লোক দাঁড়াইয়া আছে। মাণিকলালকে এবং তাহার সমভিব্যাহারীদিগকে দেখিয়া, সেই দুইটা মানুষ দৌড়াইয়া পলাইল। মাণিকলাল তখন ঘোড়া হইতে নামিয়া নিকটে গিয়া দেখিল। দেখিল যে, গোরের মাটি উঠাইয়া, উহারা মৃতদেহ বাহির করিয়াছে। মাণিলকলাল, সেই মৃতদেহ খুব যত্নের সহিত, উদয়োন্মুখ ঊষার আলোকে পর্‍যবেক্ষণ করিল। তার পর কি বুঝিয়া ঐ দেহ আপনার অশ্বের উপর তুলিয়া বাঁধিয়া কাপড় ঢাকা দিয়া আপনি পদব্রজে চলিল। মাণিকলাল দিল্লীর দর্‍ওয়াজার বাহিরে গেল। কিছু পরে সূর্‍যোদয় হইল, তখন মাণিকলাল ঐ মৃতদেহ ঘোড়া হইতে নামাইয়া, জঙ্গলের ছায়ায় লইয়া গিয়া রাখিল। এবং আপনার পেঁটরা হইতে একটি ঔষধের বড়ি বাহির করিয়া, তাহা কোন অনুপান দিয়া মাড়িল। তার পর ছুরি দিয়া মৃতদেহ স্থানে স্থানে একটু একটু চিরিয়া, ছিদ্রমধ্যে সেই ঔষধ প্রবেশ করাইয়া দিল। এবং জিবে ও চক্ষুতে কিছু কিছু মাখাইয়া দিল। দুই দণ্ড পরে আবার ঐরূপ করিল। এইরূপ তিন বার ঔষধ প্রয়োগ করিলে মৃত ব্যক্তি নি:শ্বাস ফেলিল। চারি বারে সে চক্ষু চাহিল ও তাহার চৈতন্য হইল। পাঁচ বারে সে উঠিয়া বসিয়া কথা কহিল। মাণিকলাল একটু দুগ্ধ সংগ্রহ করিয়াছিল। তাহা মবারককে পান করাইল। মবারক ক্রমশ: দুগ্ধ পান করিয়া সবল হইলে, সকল কথা তাঁহার স্মরণ হইল। তিনি মাণিকলালকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে আমাকে বাঁচাইল? আপনি?” মাণিকলাল বলিল, “হাঁ
false
MZI
হ্যাঁ। ঈশ্বরের কসম খেয়ে বলছি– বেশ। রিদি অস্ত্রটা তার গলায় স্পর্শ করে বলল, এই মুহূর্তে আমাদের হওনকে এখান থেকে বের হয়ে একটা বুলেটপ্রুফ গাড়িতে করে নিয়ে যাও। নিয়ে যাব। অবশ্যই নিয়ে যাব। একশবার নিয়ে যাব। কোথায় নিয়ে যাবে? ক্রিভন ভাঙ্গা গলায় বলল, তোমরা যেখানে বলবে। তোমরা যেখানে যেতে চাও– যাবার কোনো জায়গা আছে নাকি আবার। পুরো দুনিয়াটাই তো তোমরা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে রেখেছ! জঙ্গলে? মাথা খারাপ, জঙ্গলে গিয়ে আমি শেয়াল কুকুরের মতো লুকিয়ে থাকব? তাহলে কোথায় যাবে? লাল পাহাড়ে গেলে কেমন হয়? লাল পাহাড়ে? ক্ৰিভনের মুখটা বিবর্ণ হয়ে যায়। লা-লাল পাহাড়ে? হ্যাঁ। রিদি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা দিয়ে গলায় খোঁচা দিয়ে বলল, কোনো সমস্যা আছে? না, নেই। চমৎকার! রিদি ক্ৰিভনকে ধাক্কা দিয়ে বলল, চল যাই। ক্রিভন অনিশ্চিত ভঙ্গিতে দুই পা হেঁটে সামনে যায়। রিদি পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে একবার দর্শকদের মুখের দিকে তাকাল। তারপর রুহানের দিকে চোখ মটকে বলল, দর্শকদের আরেকটু আনন্দ দেয়া যাক কী বলো? রুহান মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে। সেও তার অস্ত্রটা বের করে নেয়। তারপর কেউ কিছু বোঝার আগে দর্শকের মাথার উপর দিয়ে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে। ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে সবাই মাথা নিচু করে যে যেখানে আছে শুয়ে পড়ার চেষ্টা করে, হুঁটোপুটি করে ছুটে পালাতে শুরু করে। রিদি হা হা করে হেসে বলল, হায়রে আমাদের মুরগি ছানার দল! ইউনিট খরচ করে মানুষ মারা দেখতে এসেছে অথচ সাহসের নমুনা দেখ! রুহান বলল, অনেক হয়েছে, এখন চল। রিদি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, দেখা যাক আসলেই আমরা পালাতে পারি কি না! ক্রিনের পোশাকের পিছনে ধরে তারা তাকে ঠেলে নিয়ে যেতে থাকে। সমস্ত এলাকাটা তখন মানুষের হৈ চৈ চিৎকারে একটা নারকীয় পরিবেশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে কোনো জায়গা থেকে কেউ গুলি করে তাদের শেষ করে দিতে পারে কিন্তু সেটা নিয়ে এখন চিন্তা করার সময় নেই। রুহান আর রিদি পাশাপাশি ছুটতে থাকে। কিছুক্ষণ আগেও তাদে একজনের আরেকজনকে হত্যা করার কথা ছিল। পাহাড়ের উপর থেকে নিচের উপত্যকাটির দিকে তাকিয়ে রিদি বলল, এই হচ্ছে সেই লাল পাহাড়। রুহান বলল, এটা লালও না পাহাড়ও না তাহলে এর নাম লাল পাহাড় কেন? রিদি হেসে বলল, আমাকে জিজ্ঞেস করো না। আমি এর নাম দিই নি। তুমি এখানে আসতে চেয়েছ–এটা সম্পর্কে নিশ্চয়ই তুমি জান। এমন কিছু জানি না, শুধু শুনেছি এই লাল পাহাড়টা কারো এলাকা না। সবার ভেতরে একটা অলিখিত নিয়ম হয়ে গেছে যে এটা কেউ দখল করে নেবে না। কেন? রিদি ঘাড় বাঁকিয়ে বলল, সবারই ব্যাবসাপাতি করতে হয়। অস্ত্র কিনতে হয়। সৈনিক বিক্রি করতে হয়। যন্ত্রপাতি ঠিক করতে হয়। তাই লাল পাহাড়টা এই সব করার জন্যে রেখে দিয়েছে। রুহান আঁকাবাঁকা রাস্তাটির দিকে তাকিয়ে রইল, সেটা পাহাড় ঘিরে নিচে উপত্যকায় নেমে গেছে। তাদেরকে এই পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে নেমে যেতে হবে। এরকম বেশ কয়েকটি রাস্তা চারদিক থেকে এসেছে। ওরা ইচ্ছে করলে ক্ৰিভনকে নিয়ে একেবারে উপত্যকায় নেমে যেতে পারত কিন্তু তা না করে এখানে নেমে পড়েছে। ক্রিভনের গলায় একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র চেপে ধরে রেখে বিশাল একটা বুলেটপ্রুফ গাড়ি করে শহরের ভেতর ঢুকলে শহরের সব মানুষ নিশ্চয়ই বিস্ফারিত চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে। তারা কারো চোখে আলাদা করে পড়তে চায় না, যে ঘটনা ঘটিয়ে এসেছে সেটা নিশ্চয়ই কয়েকদিনে জানা-জানি হয়ে যাবে কিন্তু তারাই যে সেই ঘটনার নায়ক সেটা তারা কাউকে জানতে দিতে চায় না। তাই দুজনে মাঝপথে নেমে গেছে, বাকীটা হেঁটে যাবে। রিদি বলল, এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে চল হাঁটি। পাহাড় ঘিরে পথটা গেছে, অনেকদূর হেঁটে যেতে হবে। উঁহু। রুহান মাথা নেড়ে বলল, আমাদের এখন রওনা দেয়া ঠিক হবে না। কেন? অনেকটা পথ। কমপক্ষে তিন চার ঘণ্টা তো লাগবেই। এখন এই রাস্তা আমাদের এতক্ষণ থাকা ঠিক না। কেন? রাস্তায় থাকলে কী হবে? ক্ৰিভনকে আমরা যেভাবে ধরে এনেছি সেটা একটা যুদ্ধবাজ নেতার জন্যে খুব বড় অপমান। বিশেষ করে এত হাজার হাজার মানুষের সামনে- হ্যাঁ। সেটা ভুল বল নি। রুহান বলল, সেই অপমান থেকে রক্ষা পাবার তার এখন একটাই পথ। রিদি মাথা নেড়ে বলল, আমাদের ধরে নিয়ে দশ হাজার মানুষের সামনে একটা ভয়ঙ্কর শাস্তি দেয়া? হ্যাঁ। আমরা ক্ৰিভনকে এখানে ছেড়ে দিয়েছি। ক্ৰিভন জানে আমরা এখন এই পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে যাব। ঘণ্টা তিনেক লাগবে পৌঁছাতে। সে নিশ্চয়ই এই সময়ে তার দলবল নিয়ে আমাদের ধরতে ফিরে আসবে। কাজেই আমাদের এখন এই রাস্তায় থাকা ঠিক হবে না। রিদি কিছুক্ষণ রুহানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ঠিকই বলেছ। রুহান বলল, রাস্তা দিয়ে না হেঁটে আমরা এই পাহাড়ের ঢালু দিয়ে হেঁটে যাই। আমার মনে হয় আমরা তাহলে অনেক তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাব। রিদি আবার মাথা নেড়ে বলল, চমৎকার বুদ্ধি। যদি দরকার হয় আমরা তাহলে ভালো একটা জায়গায় অপেক্ষা করতে পারি। যদি ক্ৰিভনের দলের সাথে যুদ্ধ করতেই হয় আমরা সেটা করব একটা সুবিধাজনক জায়গা থেকে। রিদি বলল, রুহান, তোমার মাথা খুব পরিষ্কার। তোমার মাথায় ইলেকট্রড বসিয়ে যে সক্রেটিস বানায় নি সেটাই আশ্চর্য। চেষ্টা করেছিল। রুহান বলল, আমি ধোকা দিয়ে বের হয়ে এসেছি। রিদি চোখ বড় বড় করে বলল, আশ্চর্য! আশ্চর্যের কিছু নেই। এখন চল ঢালু বেয়ে
false
humayun_ahmed
বলল, তাহলে সন্ধ্যার পরই গায়ে-হলুদ হবে। সন্ধ্যার পর করলে কেউ কিছু দেখবেও না। ভাইয়াকে বাদ দিয়ে কি আর গায়েহলুদ হবে? মা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আচ্ছা আচ্ছা। কেন জানি মা ইরাকে খুব ভয় পান। গোসল করে আপা হলুদ শাড়ি পরবে না? শাড়ি তো নেই। তুমি টাকা দাও, আমি হলুদ শাড়ি কিনে আনিব। তুই কিনে আনবি, কেউ যদি কিছু জিজ্ঞেস করে? জিজ্ঞেস করলে বলব, আমার বড় আপার বিয়ে। আমি এমন ফকিরের মত আপার বিয়ে হতে দেব না। আচ্ছা আচ্ছা, যা, চিৎকার করিস না। অন্তু আসুক, ওকে নিয়ে দোকানে যাবি। তুই একটু রান্নাঘরে আসবি? আমাকে সাহায্য করবি? না, আমি অন্য কাজ করছি। মা আবার রান্নাঘরে চলে গেলেন। ভাজা ঘিয়ের গন্ধ আসছে। কি কি রান্না হচ্ছে একবার গিয়ে দেখলে হত। এত কিছু রান্না সব মার একা করতে হচ্ছে। আমাদের কাজের মেয়ে দু দিনের ছুটি নিয়ে দেশে গেছে, এখনো আসছে না। আসবে বলে মনে হয় না। এক দোকানদারের সঙ্গে খুব খাতির ছিল। সেখান থেকে কোন সমস্যা বাঁধিয়েছে কি-না কে জানে। ইরার ধারণা ঘোরতর সমস্যা। তাকে না-কি গোপনে বলছে। আমি বারান্দায় খানিকক্ষণ এক-একা দাঁড়িয়ে রইলাম। বাবাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি ইজিচেয়ারে ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাঁর কোলের উপর রাখা খবরের কাগজ ফর ফর করে বাতাসে উড়ছে। তিনি দুপুরে অনেকক্ষণ ঘুমান। আজ সে সুযোগ হয় নি। রান্নাঘর থেকে হাঁড়িকুড়ি নাড়ার শব্দ আসছে। আমি রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছি। আমাদের এ বাড়িটা হিন্দুবাড়ি। আমার দাদা এই বাড়ি জলের দামে এক হিন্দু ব্ৰাহ্মণের কাছ থেকে কিনেছিলেন। বেচারা এত সস্তায় একটিমাত্র কারণেই বাড়ি বিক্রি করে— দাদাজান যেন তার ঠাকুরঘরটা যে রকম আছে সে রকম রেখে দেন। সেই ঠাকুরঘরটাই আমাদের এখনকার রান্নাঘর। মা আমাকে দেখেই বলল, তুই এখানে কেন? যা তো। যা। আমি বললাম, এক-একা কি করছ? আমি তোমাকে সাহায্য করি। কোন সাহায্য লাগবে না। তুই দরজা বন্ধ ঘরে চুপচাপ খানিকক্ষণ শুয়ে থাক। রান্না-বান্না কদুর করেছ? দুটা তরকারি নেমেছে। চেখে দেখবি? না। আমি নরম গলায় বললাম, মা, আমি বসি তোমার পাশে? ধোঁয়ার মধ্যে বসতে হবে না। তুই যা। আমি বুঝতে পারছি মার প্রচণ্ড পরিশ্রম হচ্ছে। কিন্তু তার চোখে-মুখে পরিশ্রমের ক্লান্তি নেই। মনে হচ্ছে তিনি খুব আনন্দে আছেন। প্রয়োজন হলে আজ সারারাত তিনি রান্না করতে পারবেন। নবনী! জ্বি মা। বৃষ্টি হবে না-কি রে মা? বুঝতে পারছি না। হবে মনে হয়। আকাশে মেঘা জমছে। অবশ্যই বৃষ্টি হবে। শুভদিনে বৃষ্টি হওয়া খুব সুলক্ষণ। তোর বাবা কি করছে? ঘুমুচ্ছে। তুইও শুয়ে ঘুমিয়ে পড়। যা এখন। চা খাবি? বানিয়ে দেখ এক কাপ? পানি গরম আছে। দাও, বানিয়ে দাও। দুকাপ বানাও মা। তুমি নিজেও খাও। মা কেতলিতে চা-পাতা ছেড়ে দিলেন। মার রান্না-বান্না দেখার মত ব্যাপার। অসম্ভব রকম গোছানো ব্যবস্থা। আমি এখন পর্যন্ত কোন মহিলাকে এত দ্রুত এত কাজ করতে দেখি নি। মশলা কি তুমিই বাটছ? গুড়া মশলা আছে, কিছু নিজে বাটলাম। অস্তুকে বললাম, একটা ঠিকা লোক আনতে। কোথায় যে উধাও হয়েছে! কাজের বাড়ি, একজন পুরুষ মানুষ থাকলে কত সুবিধা। কিছু লাগবে? জিরা কম পড়েছে। আমি এনে দেই মা। রাস্তার ওপাশেই তো দোকান। হয়েছে, তোর গিয়ে জিরা আনতে হবে না। চা নিয়ে চুপচাপ বসে খা। তোমার পাশে বসে খাই মা? আমার পাশে বসে খেতে হবে না। ধোয়ার মধ্যে বসে চা খাবি কি? তোমার পাশে বসেই খাব। মা বললেন, আয় আয়, বোস। আমি মার পাশে বসলাম। তিনি এক হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। হাসি-খুশি মা হঠাৎ বদলে গেলেন। তিনি শিশুদের মত শব্দ করে কাঁদতে লাগলেন। এই কান্না কোন আনন্দের কান্না না গভীর দুঃখের কান্না। আমাকে নিয়ে মার অনেক দুঃখ। আমি বললাম, মা কান্না থামাও তো। মা কাঁদতে কাঁদতেই উঠে গেলেন। আমি মার পেছনে পেছনে যাচ্ছি। মা গিয়ে দাঁড়ালেন বাবার সামনে। বাবা জেগে উঠে অবাক হয়ে তাকাচ্ছেন। ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারছেন। না। ইরাও এসেছে বারান্দায়। মা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, এরকম ফকিরের মত চুপি চুপি আমি আমার মেয়ের বিয়ে দেব না। বাবা হতভম্ব গলায় বললেন, কি বলছি তুমি! মা ধরা গলায় বললেন, অতুকে বল সে যেন ডেকোরেটরকে দিয়ে গেট বানায়। আলোকসজ্জা যেন হয়। পাগল হয়ে গেলে না-কি? হ্যাঁ, আমি পাগল হয়ে গেছি। আমি এই ভাবে মেয়ে বিয়ে দেব না। ইরা, তুই যা, সবাইকে খবর দে। বাবা পুরোপুরি হকচকিয়ে গেছেন। এমনভাবে তাকাচ্ছেন যে, দেখে মায়া লাগছে। তিনি নির্জীব গলায় বললেন, চুলার গরমে থেকে থেকে তোর মার ব্রেইন সর্ট সার্কিট হয়ে গেছে। নিগেটিভ পজিটিভ এক হয়ে গেছে। মা তীব্র গলায় বললেন, আমার মেয়ে কোন পাপ করে নাই। কেন তাকে আমি চোরের মত বিয়ে দেব? বাবা ইরার দিকে তাকিয়ে প্রচণ্ড ধমক দিলেন, হা করে দেখছিস কি? তোর মার শরীর কাঁপছে দেখছিস না? তাকে ধর। মাথায় পানি ঢাল। বিছানায় শুইয়ে দে। আমরা দুজনেই মাকে ধরে ফেললাম। বাবা হতাশ গলায় বললেন, আচ্ছা যাও, হবে। সবই হবে। অন্তু আসুক। গাধাটা গেল কোথায়! বাড়ির চেহারা পাল্টে গেছে। গিজগিজ করছে মানুষ। আমাদের যেখানে যত আত্মীয় ছিলেন সবাই চলে এসেছেন। শুনছি। অতিথিপুরে ছোট খালাকেও খবর দেয়া হয়েছে। তিনিও না-কি আসছেন। বাড়ির সামনে শুধু যে গোট বসেছে তাই না। আলোকসজ্জা হচ্ছে। কাঁঠাল গাছে লাল, নীল, সবুজ
false
MZI
সদস্য ছিল। মনে আছে, একজন দাবি করেছিল সে নাকি যীশুখ্রিস্ট। হাঃ হাঃ হাঃ। রিকি লোকটার কথা বুঝতে পারে না, কিন্তু ভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে তাকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করছে। রিকি বুঝতে পারে, প্রচণ্ড ক্রোধের সাথে সাথে আরো একটা অনুভূতি তার ভিতরে ছড়িয়ে পড়ছে, যেটার সাথে তার ভালো পরিচয় নেই–অনুভূতিটি ভয়ের। দ্বিতীয় লোকটি তার পকেট থেকে চৌকোণা একটা যন্ত্র বের করে ফর্মটি দেখে দেখে রিকির নামটি লিখতে থাকে। রিকি কৌতূহলী হয়ে তাকাল, সম্ভবত একটি কম্পিউটার, কোনো কেন্দ্রীয় ডাটা বেসের সাথে যুক্ত। তার সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছে। লোকটি নিস্পৃহ দৃষ্টিতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছিল, হঠাৎ কিছু-একটা দেখে চমকে উঠল, চোখ বড় বড় করে তাকাল একবার রিকির দিকে। তারপর আবার তাকাল স্ক্রিনের দিকে। তোমার নামে আমাদের একটা ফাইল আছে। আমার নামে? হ্যাঁ। ফাইলে একটা খবরের কাগজের কাটিংও আছে। সেখানে তোমার সম্পর্কে বড় খবর। কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি নষ্ট করে পালিয়ে গিয়েছিলে, শীকে খুন করেছিলে নিজের হাতে লেখা আছে, তুমি অনেক বড় ক্রিমিনাল! লোক দুটির গায়ে প্রচণ্ড জোর, খুব সহজে রিকির হাত দুটি পিছনে টেনে হাতকড়া লাগিয়ে দিল। সামনে যাবার ইঙ্গিত করে একজন মাথা নেড়ে বলল, আমি জীবনে অনেক আহাম্মক দেখেছি, কিন্তু প্রেসির মতো আহাম্মক আর দেখি নি। রিকি মাথা নিচু করে এগিয়ে যায়। সময়ের অপবলয় অভ্যাসমতো দরজায় তালা লাগানোর পর হঠাৎ করে রিগার মনে পড়ল আজ আর ঘরে তালা লাগানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না। সে যেখানে যাচ্ছে, সেখান থেকে সে সম্ভবত আর কোনো দিন ফিরে আসবে না। ব্যাপারটি চিন্তা করে একটু আবেগে আপত হয়ে যাওয়া বিচিত্র নয়, কিন্তু রিগার সেই সময়টাও নেই। এখন রাত তিনটা বেজে তেতাল্লিশ মিনিট, আর ঘণ্টা দুয়েকের মাঝেই ভোরের আলো ফুটে উঠবে। সে যেটা কতে যাচ্ছে, তার প্রথম অংশটা ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই শেষ করতে হবে। ছোট ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে রিগা নিচে নেমে এল। বাকি জিনিসগুলো আগেই বড় ভানটিতে তুলে নেয়া হয়েছে। সে গত পাঁচ বছর থেকে এই দিনটির জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে, খুঁটিনাটি সবকিছু অসংখ্যবার যাচাই করে দেখা হয়ে গেছে, কোথাও কোনো ভুল হবার অবকাশ নেই, তবে ভাগ্য বলে যদি সত্যি কিছু থাকে এবং সে ভাগ্য যদি বেঁকে বসে, তাহলে সেটা ভিন্ন কথা। ছোট ব্যাগটা পাশে রেখে রিগা তার ভ্যানটির সুইচ স্পর্শ করামাত্র সেটি একটি ছোট ঝাঁকুনি দিয়ে চলতে শুরু করে। কোন পথে কোথায় যেতে হবে বহুকাল আগে প্রোগ্রাম করে রেখেছে। ভ্যানটি নিঃশব্দে সেদিকে যাত্রা শুরু করে দেয়। নিরীহদর্শন এই ভ্যানটি দেখে বোঝার উপায় নেই, কিন্তু এটি অসাধ্য সাধন করার ক্ষমতা রাখে। আবাসিক এলাকার ছোট রাস্তা ধরে খানিকটা এগিয়ে ভ্যানটি হ্রদের তীরের বড় রাস্তায় উঠে পড়ল। রাস্তাটি এরকম সময় নির্জন থাকে। একেবারে মাটি ছুঁয়ে যাওয়া যায়। এ এলাকায় শীতকালে হাড়-কাঁপানো কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস হু-হু করে বইতে থাকে, বসন্তের শুরুতে এতটা খারাপ হবার কথা নয়। রিগা জানালাটা একটু নামিয়ে দেখল, হ্রদের ঠাণ্ডা ভিজে বাতাসের সাথে সাথে সারা শরীর শিউরে ওঠে। রিগা দ্রুত আবার জানালাটা তুলে দেয়। দুহাত একসাথে ঘষে শরীরটা একটু গরম করে সে আকাশের দিকে তাকাল। শুক্লপক্ষের রাত, আকাশে ভাঙা একটা চাঁদ উঠেছে, সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রিগার মনটা হঠাৎ একটু বিষণ্ণ হয়ে যায়। পরিচিত এই পৃথিবীটার জন্যে—যেটা কখনো ভালো করে তাকিয়ে দেখে নি, তার বুকটা হঠাৎ টনটন করতে থাকে। রিগা জোর করে নিজেকে মাটির পৃথিবীতে নামিয়ে আনে। একটু পরেই সে যে জিনিসটি করতে শুরু করবে তার খুঁটিনাটি মনে মনে আরো একবার যাচাই করে দেখা দরকার। ব্যাপারটি শুরু হয়েছিল এভাবে। সংবিধানে দুশ বছর আগে একটা সংশোধনী যোগ করা হয়েছিল। সংশোধনীটা এরকম : ১৯শে এপ্রিলের বিপর্যয়সংক্রান্ত তথ্যাবলী পৃথিবীর স্বার্থের পরিপন্থী। সংশোধনীটি বিচিত্র, কিন্তু এই সংশোধনীটির জন্যে যেটা ঘটল, সেটি আরো বিচিত্র। পৃথিবীর তথ্য নিয়ন্ত্রণকারী যাবতীয় কম্পিউটার পৃথিবী থেকে ১৯শে এপ্রিলের বিপর্যয়সংক্রান্ত সকল তথ্য সরিয়ে নিতে শুরু করল। এক শ বছর পর পৃথিবীর ইতিহাসে এই বিপর্যয়ের উপর আর কোনো তথ্য থাকল না। এক শ বছর আগে কোনো-এক এপ্রিল মাসের উনিশ তারিখে পৃথিবীতে কোনো-এক ধরনের বিপর্যয় ঘটেছিল। যেহেতু এ সংক্রান্ত যে-কোনো তথ্য পৃথিবীর স্বার্থের পরিপন্থী, কাজেই সংবিধানের এই সংশোধনীটিও হঠাৎ একদিন সরিয়ে নেয়া হল। ব্যাপারটি ঘটেছিল প্রায় পনের বছর আগে, তখন রিগার বয়স তিরিশ। হঠাৎ করে সংশোধনীটি সরিয়ে নেবার পর ব্যাপারটি নিয়ে অনেকেরই কৌতূহল হয়েছিল। সান্ধ্য খবরের বিশেষ ক্লেম কার্ড বের হল, সেটা নিয়ে সবাই হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে জল্পনা-কল্পনা করতে থাকে। তরুণ অনুসন্ধানীরা কম্পিউটার ঘাঁটাঘাঁটি করে নানারকম তন্তু দিতে শুরু করে। কেউ বলল, জিনেটিক পরিবর্তন করে একধরনের অতিমানব তৈরি করা হয়েছিল, যারা পৃথিবী ধ্বংস করতে চাইছিল। কেউ বলল, গ্রহান্তরের আগন্তুক পৃথিবীতে হানা দিয়ে তার নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছিল। আবার কেউ বলল, বায়োকেমেস্ট্রির এক ল্যাবরেটরি থেকে ভয়ংকর এক ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর জীবজগৎকে ধ্বংস করে দিতে উদ্যত হয়েছিল। সবই অবশ্যি উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা, কারণ এইসব তত্ত্বকে সত্যি বা মিথ্যা কোনোটাই প্রমাণ করার মতো কোনো তথ্য পৃথিবীর ডাটা বেসে নেই, সব একেবারে ঝেড়েপুছে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বছরখানেক পর সবার কৌতূহল থিতিয়ে এল। শুধুমাত্র জল্পনা-কল্পনা করে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া ১৯শে এপ্রিলের বিপর্যয়সংক্রান্ত তথ্য পৃথিবীর স্বার্থের পরিপন্থী বলে সেটা নিয়ে প্রকাশ্যে গবেষণা করাও সম্ভব
false
shordindu
সীমন্তিনীকে ফেরত দিলেন এবং রাজপুরী তল্লাস করিয়া রাজকন্যাকে ধরিয়া লইয়া গেলেন। রাজকন্যার নাম ছিল শিলাবতী। অতঃপর যবন সৈন্য বিশ্রাম শেষ করিয়া দক্ষিণ দিকে চলিয়া গেল। শিলাবতীকে আলাউদ্দিন সঙ্গে লইয়া গেলেন। তিনি আর এ পথে আসেন নাই, অন্য পথে প্রত্যাবর্তন করিয়াছিলেন; পিতৃব্যকে হত্যা করিয়া সুলতান হইয়াছিলেন। শিলাবতীর কি হইল কেহ জানে না। হয়তো তিনি বিষপান করিয়াছিলেন, হয়তো বা দিল্লীর হারেমে আলাউদ্দিনের অসংখ্য উপপত্নীর অন্তর্ভুক্ত হইয়া এখনও বাঁচিয়া আছেন। সে-সময় ভূপ সিংহের পরিবারে ছিলেন তাঁহার রানী ঊষাবতী, যোড়শী কন্যা শিলাবতী, দ্বাদশ বর্ষীয় বালকপুত্র রামরুদ্র এবং সদ্যোজাত কন্যা সোমশুক্লা। আলাউদ্দিন যখন শিলাবতীকে হরণ করিয়া লইয়া যান তখন রানী ঊষাবতী সূতিকাগৃহে ছিলেন। তিনি এই দারুণ আঘাত সহ্য করিতে পারিলেন না, প্রসূতিগৃহেই তাঁহার মৃত্যু হইল। দাসী সীমন্তিনী শিশু সোমশুক্লাকে নিজের বুকে তুলিয়া লইল। সীমন্তিনীর গর্ভাধান হইয়াছিল; যথাকালে সে একটি কন্যা প্রসব করিল। সে নুন খাওয়াইয়া কন্যাকে মারিতে উদ্যত হইয়াছিল, কিন্তু ভূপ সিংহ নিষেধ করিলেন—না, আলাউদ্দিনের কন্যাকে বাঁচিয়ে রাখো, হয়তো পরে প্রয়োজন হবে। আলাউদ্দিনের কন্যা বাঁচিয়া রহিল, মাতার বিষদৃষ্টির সম্মুখে বাড়িয়া উঠিতে লাগিল। তার নাম হইল—চঞ্চরী। ভূপ সিংহের বুকে যে শেল বিধিয়াছিল তাহা বিঁধিয়া রহিল। তিনি উদার ও মহৎ চরিত্রের পুরুষ ছিলেন, এখন তাঁহার চরিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত মূর্তি ধারণ করিল। অপমান ও লাঞ্ছনায় জর্জরিত হৃদয়ে তিনি কেবল প্রতিহিংসা সাধনের জন্য জীবিত রহিলেন। কিন্তু দিল্লীর সুলতানের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা সাধন সামান্য ভূস্বামীর পক্ষে সহজ নয়। দিন কাটিতে লাগিল। আট বৎসর পরে ভূপ সিংহ পুত্রকে ডাকিয়া বলিলেন—রামরুদ্র, তোমার বয়স বিশ বৎসর পূর্ণ হয়েছে। কলঙ্কমোচনের সময় উপস্থিত। রামরুদ্র বলিলেন—আমি প্রস্তুত আছি। ভূপ সিংহ পুত্রের হস্তে ছুরিকা দিয়া বলিলেন—দিল্লী যাও, এই ছুরি দিয়ে নর-পিশাচকে গুপ্তহত্যা কর। পরদিন রামরুদ্র পাঁচজন সঙ্গী লইয়া দিল্লী যাত্রা করিলেন। দীর্ঘ পথ; ভূপ সিংহের দীর্ঘ প্রতীক্ষ্ণ আরম্ভ হইল। এক বৎসর পরে দুইজন সঙ্গী ফিরিয়া আসিল। জল্লাদের হাতে রামরুদ্রের মৃত্যু হইয়াছে। একদিন আলাউদ্দিন রক্ষীপরিবৃত হইয়া অশ্বারোহণে দিল্লীর রাজপথ দিয়া যাইতেছিলেন, রামরুদ্র ছুরিকা-হস্তে তাঁহার দিকে ধাবিত হন; কিন্তু আলাউদ্দিনের কাছে পৌঁছিবার পূর্বেই ধরা পড়েন। তাঁহার আক্রমণ ব্যর্থ হয়।– এইবার ভূপ সিংহের চরিত্রে এক বিচিত্র পরিবর্তন দেখা দিল। পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সে একমাত্র পুত্রকে হারাইয়া তিনি শোক করিলেন না। তাঁহার প্রকৃতি যেন দ্বিধাভিন্ন হইয়া গেল; একদিকে শুষ্ক কঠিন কুটিলতা, অন্য দিকে নির্বিকার ঔদাসীন্য। রানী ঊষাবতীর মৃত্যুর পর তিনি দারান্তর গ্রহণ করেন নাই, এখনও করিলেন না; কিন্তু কন্যা সোমশুক্লাকে তিনি জন্মাবধি অবহেলা করিয়াছিলেন, এখন তাহার প্রতি নির্লিপ্তভাবে ঈষৎ স্নেহশীল হইলেন। সপ্তপুরীর বাকি ছয়জন রাজার সহিত তাঁহার সম্পর্ক প্রায় ছিন্ন হইয়াছিল, এখন তিনি দূত পাঠাইয়া পূর্বর্তন প্রীতির সম্বন্ধ পুনঃস্থাপন করিলেন। মন্ত্রীর সহিত বসিয়া কখনও মন্ত্রণা করেন, কখনও বা বয়স্যদের সঙ্গে চতুরঙ্গ খেলেন। সপ্তমপুরের অধিপতি সূর্যবমা ভূপ সিংহের সমবয়স্ক মিত্র, তাঁহার সহিত দূর হইতে চতুরঙ্গের চাল চালেন। কখনও তিনি গম্ভীর কুটিল সন্দিগ্ধ, কখনও দায়িত্বহীন ক্রীড়াচটুল প্রগভ। সকলে তাঁহার কাছে সশঙ্ক হইয়া থাকে, কখন তাঁহার কোন্ রূপ প্রকাশ পাইবে কেহই বলিতে পারে না। এইভাবে আরও নয় বৎসর কাটিয়াছে। কুমারী সোমশুক্লা এখন সপ্তদশী যুবতী। প্রথমপুরের যুবরাজ হিরণ্যবর্মার সঙ্গে তাঁহার বিবাহের একটা প্রসঙ্গ উঠিয়াছে; কিন্তু কোনও পক্ষেই ত্বরা নাই। হিরণ্যবর্মার দুইটি পত্নী বর্তমান, তাঁহারা পুরাতন না হওয়া পর্যন্ত যুবরাজ নূতন বিবাহ সম্বন্ধে নিরুৎসুক। সীমন্তিনীর কন্যা চঞ্চরী এখন ষোড়শী। তাহার বুদ্ধি বেশি নাই, কিন্তু রূপের ছটায় চোখে ধাঁধা লাগে। সে রাজপুরীতে কুমারী সোমশুক্লার কিঙ্করীর কাজ করে। তাহার মা তাহার পানে মুখ ফিরাইয়া চাহে না, কিন্তু ভূপ সিংহ আলাউদ্দিনের কন্যার প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন নয়। কেবল, কদাচিৎ যখন চঞ্চরীর উপর রাজার দৃষ্টি পড়ে তখন তাঁহার চোখে একটা ক্রুর অভিসন্ধি খেলা করিয়া যায়। তিনি যেন প্রতীক্ষ্ণ করিয়া আছেন; কিন্তু কিসের প্রতীক্ষ্ণ তাহা কেহ জানে না।– ভট্ট নাগেশ্বরের মুখে রাজকাহিনী শুনিতে শুনিতে ময়ূর যেন আচ্ছন্নের মতো হইয়া পড়িয়াছিল, মনে হইয়াছিল সেও এই কাহিনীর সহিত নিবিড়ভাবে জড়িত। সুলতান আলাউদ্দিনের নামটাই সে জানিত, এখন একটা বিকৃত মনুষ্যমূর্তি চোখের সামনে দেখিতে পাইল। রাজা ভূপ সিংহের নিদারুণ ভাগ্যবিপর্যয় তাহার অন্তরে অঙ্গারের মতো জ্বলিতে লাগিল। কিন্তু তাহার প্রকৃতি স্বভাবতই অন্তর্মুখী, বাহিরে তাহার মনের উষ্ম প্রকাশ পাইল না। কাহিনী শেষ করিয়া ভট্ট নাগেশ্বরও নীরবে চলিলেন। আর কোনও কথা হইল না। সূর্যাস্তের সময় তাঁহারা রাজধানীতে উপনীত হইলেন। নাগেশ্বর বলিলেন—আজ আর রাজার। সঙ্গে দেখা হবে না। তুমি চল, রাত্রে আমার গৃহে থাকবে। কাল প্রাতঃকালে তোমাকে রাজার কাছে নিয়ে যাব। ভট্ট নাগেশ্বরের গৃহ ক্ষুদ্র কিন্তু পাষাণনির্মিত। মাত্র দুইটি ঘর, তৈজসপত্র বেশি নাই। ব্রাহ্মণ অকৃতদার, গৃহ গৃহিণীহীন; নিজেই গৃহকর্ম করেন, নিজেই রন্ধন করেন। তাঁহার গৃহদ্বার সর্বদাই খোলা থাকে; দেশে চোর বেশি নাই, যাহারা আছে তাহারা নাগেশ্বরের শূন্য গৃহে চুরি করিতে আসে না। হস্তমুখ প্রক্ষালনের পর নাগেশ্বর রন্ধনকার্যে লাগিয়া গেলেন; সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার বাক্যস্রোত আবার প্রবাহিত হইল। তিনি রাজ্য ও রাজপুরীর বহু কৌতুককর ঘটনা বিবৃত করিলেন। ময়ূর তাঁহার বিবৃতি হইতে অনেক কথা জানিতে পারিল। নৈশাহার সমাধা হইলে নাগেশ্বর ঘরের কোণ হইতে গোল করা শয্যা আনিয়া দুই ভাগ করিয়া মাটিতে পাতিলেন; তারপর প্রদীপ নিভাইয়া শয়ন করিলেন। উভয়েই ক্লান্ত ছিলেন, অবিলম্বে ঘুমাইয়া পড়িলেন। পরদিন প্রভাতে নাগেশ্বর ময়ূরকে লইয়া রাজভবনে উপনীত হইলেন। প্রতীহার ময়ূরের হাতে ধনুর্বাণ দেখিয়া ভ্রূ তুলিল, কিন্তু রাজবয়স্যের সঙ্গীকে বাধা দিল না, হাস্যমুখে পথ ছাড়িয়া
false
shunil_gongopaddhay
চেয়ে বেশী কানে শুনতে পাবেন–তোমার কতগুলোন আমি বরং ওঁর কানে কানে বলে দিচ্চি! হাত ধরে ধরে সে কুসুমকুমারীকে নিয়ে এলো পালঙ্কের কাছে। নবীনকুমার ধীর স্বরে বললো, এ মেয়েটি কে, চিনতে পারলুম না তো! সরোজিনী বললো, আহা-হা, মস্করা হচ্চে, কুসোমাদিদিকে চিনতে পারচেন না? সেই যে, আপনাদের থ্যাটারের আগের দিন এয়েছেল। আপনি ওর কাচ ঠেঙে শাড়ী পরে হাঁটার ধরন শিকতে চাইলেন… নবীনকুমার কুসুমকুমারীর নীল চক্ষু দুটি দেখতে লাগলো। তারপর আপনমনেই বললো, কই, এ মুখ আগে দেকেচি বলে মনে তো পড়ে না। কুসুমকুমারীও নবীনকুমারকে দেখছে একদৃষ্টে। নবীনকুমারকে চিনতে তারও যেন কষ্ট হচ্ছে খুব। তার সখী কৃষ্ণভামিনীর স্বামী নবীনকুমারকে সে প্রায় দেখেছিল অতিশয় প্রাণবন্ত, অতিশয় চঞ্চল এক কিশোর, চক্ষু দুটি অত্যুজ্জ্বল। পরে সরোজিনীর স্বামী হিসেবেও তাকে প্রায় একই রকম দেখেছিল। কিন্তু এ কোন নবীনকুমারকে এখন দেখছে সে! শরীরই শুধু কৃশ নয়, চক্ষু দুটি নিষ্প্রভ। মুখে পাণ্ডুর ছায়া, কণ্ঠস্বর নিষ্প্রাণ। কুসুমকুমারী বললো, আমার নাম বনজ্যোৎসা, মনে পড়ে না? সরোজিনী স্বামীর কানে সেই বার্তা প্রেরণ করবার জন্য ঘনিষ্ঠ হয়ে এসে বললো, কুসোমদিদি বলচে, ওর আর একটা নাম বনজোছছনা! এবার চিনতে পেরেচেন? নবীনকুমার দুদিকে মস্তক আন্দোলিত করলো। জলে ভরে গেল কুসুমকুমারীর চক্ষু, নীল মণিদুটি আর দেখা গেল না। একবার বুঝি তার ওষ্ঠাধর সামান্য একটু কাঁপলো, তারপরই সে পিছন ফিরে দৌড় লাগালো, মাটিতে লুটিয়ে পড়লো তার শাড়ীর আঁচল। সরোজিনীও চলে গেল কুসুমকুমারীর পিছু পিছু। নবীনকুমার আবার পুস্তক পাঠে মনোনিবেশ করলো। সরোজিনী ফিরে এলো বেশ খানিকক্ষণ পর। আফসোসের সুরে বললো, এহ, ছি, ছি, আপনি এমনধারা ব্যাভার করলেন কুসোমদিদির সঙ্গে? কত কাঁদলো! নিজে থেকে এয়েছেল আপনাকে দেকতে। নবীনকুমার কথাগুলি ভালো শুনতেও পেল না, ভ্রূক্ষেপও করলো না। সরোজিনী স্বামীর কণ্ঠ জড়িয়ে ধরে কর্ণকুহরে বললো, আপনি সত্যি করে বলুন তো, কুসোমদিদিকে সত্যি চিনতে পারেননি? নবীনকুমার বললো, না। মেয়েটি কে? কাদের বাড়ির যেন বউ মনে হলো। মেয়েটি একলা এয়েচে? ওর স্বামী আসেনি? —ওর স্বামী যে ঘোর পাগল! আপনি একবার গেসলেন ওদের বাড়িতে। —আমি গোসলাম কবে? —আপনার সত্যি মনে নেই! নবীনকুমারের মুখমণ্ডলে এবার একটু ব্যথার ছাপ পড়লো। সে অস্থিরভাবে বললো, আমার মনে পড়াচে না তো আমি কী করবো বলতে পারো? আমি কী মিচে কতা বলচি? সরোজিনী ভয় পেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল হঠাৎ। আরও কয়েকটি ঘটনার পর সকলেই বুঝতে পারলো যে এই কঠিন ব্যাধিতে নবীনকুমারের শ্রবণশক্তিই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, তার স্মৃতিশক্তিও অত্যন্ত দুর্বল হয়ে গেছে। অনেক কিছুই তার মনে পড়ে না, অনেক মানুষকেই সে আর চিনতে পারে না। বিদ্যোৎসাহিনী সভার কথা তার মনে নেই। যে বিধবা বিবাহের ব্যাপার নিয়ে সে এত মত্ত হয়েছিল, এখন সে ঐ প্রসঙ্গ একবারও উচ্চারণ করে না। ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগরের নামও বোধহয় তার স্মরণে নেই। আবার অনেক চিকিৎসক বদ্যি ডেকে আনা হলো। যথারীতি, সকলেরই ভিন্নমত। তবে, সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য এবং নির্ভরযোগ্য মতামত মনে হলো এই যে, কোনো ঔষধ প্রয়োগে স্মৃতিশক্তি বা শ্রবণশক্তি ফিরিয়ে আনা যাবে না। কিছু সময় দিলে স্বাভাবিকভাবেই ওগুলি আবার ফিরে আসতে পারে। নবীনকুমারের বয়েস কম, তার জীবনীশক্তিতেই সে পুনরায় পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠবে। এখন সবাগ্রে প্রয়োজন স্বাস্থ্যোদ্ধার। এবং স্বাস্থ্যোদ্ধারের শ্রেষ্ঠ উপায় বায়ু পরিবর্তন। বিম্ববতী তাঁর পুত্রকে কিছুতেই চোখের আড়াল করতে চান না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিধুশেখরও উপদেশ দিলেন, কিছুদিনের জন্য নবীনকুমারকে বাইরে কোথাও পাঠিয়ে দেওয়া হোক। কোথায় পাঠানো হবে, তা নিয়ে জল্পনা কল্পনা করা হলো কয়েকদিন। কেউ বললো, বর্ধমান, ওদিককার জল হাওয়া ভালো, ওদিকে সচরাচর ওলাওঠা হয় না। কেউ বললো, কৃষ্ণনগর, অনেকেই সেখানে স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য যায়। বারানসীর নামও উঠলো। মহাদেবের ত্রিশূলাগ্রে অবস্থিত ঐ বারানসী ধাম, সেখানকার তো তুলনাই হয় না। কিন্তু বারানসী বড় দূরের পথ, অতখানি ঝুঁকি নেওয়া যায় না। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো, কোনো বিশেষ স্থলে নয়, নবীনকুমারকে ভ্ৰমণ করানো হবে নদীপথে। শীতকাল সমাসন্ন, এসময় নদীর বাতাস অতিশয় তেজ-বর্ধক। নদীর সজীব মৎস্য আর দু তীরের গ্রামাঞ্চলের টাট্‌কা তরিতরকারি পরিপাকের পক্ষে অতি উত্তম। এলাহী বন্দোবস্ত হলো নবীনকুমারের নদী ভ্ৰমণের। তিনখানি বজরা ও চারখানি পানসী নিয়ে একটি বহর। দাস-দাসী-পাঁচক লাঠিয়াল এবং বন্দুকধারী সেপাই-এর দলবল ছাড়াও সঙ্গে নেওয়া হলো একজন কবিরাজ ও একজন অ্যালোপাথ। দিবাকর দুলালচন্দ্রের মতন বিশ্বস্ত কর্মচারীরাও রইলো। আর নেওয়া হলো সরোজিনীকে। এখন সরোজিনী শুধু নবীনকুমারের স্ত্রী এবং সঙ্গিনীই নয়, বার্তাবাহকও বটে। নদীপথে পথেই পরিভ্রমণ করা হবে, তবে যদি কখনো জলযাত্রায় ক্লান্তি বোধ হয় তাহলে একটি বিশ্রামের স্থলও নির্দিষ্ট রইলো। কুষ্টিয়ার দিকে সিংহ পরিবারের একটি জমিদারি আছে, সেখানে আছে একটি অতি মনোহর কুঠিবাড়ি। আগে থেকেই স্থলপথে লোক পাঠিয়ে দেওয়া হলো সেখানে, কুঠিবাড়িটি সাজিয়ে গুছিয়ে প্রস্তুত করে রাখবে। শুভদিন দেখে শান্তি স্বস্ত্যয়ন করে নিমতলার ঘাট থেকে গঙ্গাবক্ষে শুরু হলো যাত্রা। তখন কেল্লা থেকে মধ্যাহ্নের তোপ দাগ হচ্ছে। যেন নবীনকুমারের সম্মানেই শোনানো হলো সেই তোপধ্বনি। দু-তিনদিন নবীনকুমার বেশ উৎফুল্ল হয়ে রইলো। শহর ছেড়ে এই প্রথম তার অন্য কোথাও যাত্ৰা। কাব্য-সাহিত্যের মধ্য থেকে সে বহু স্থানের বর্ণনা পাঠ করেছে। তার দেখতে ইচ্ছে করে সেই সব দেশ। সে সমুদ্র দর্শন করেনি, পাহাড় দেখেনি, অথচ মনশ্চক্ষে সে সমুদ্র ও পাহাড় দেখতে পায়। এবার সে স্বচক্ষে সব দেখবে। কিন্তু দু-তিনদিন পরই আবার তার সব উৎসাহ চলে গেল। সে মলিন, বিষণ্ণ মুখে বোটের জানলা দিয়ে নদীর সৈকতের
false
manik_bandhopaddhay
মহেশ চৌধুরীর মনে হইতে লাগিল, অনেক দিন পরে বাড়ি ফিরিয়া সে শুধু বাপের সঙ্গে কথা কাটাকাটি এড়াইয়া চলিয়াছিল, কথাগুলি তার মাথায় ঢোকে। নাই। একবার টোক গিলিয়া মহেশ চৌধুরী এক চুমুকে জলের গ্লাসটা প্রায় অর্ধেক খালি করিয়া ফেলিল। ছেলেও যদি তার সহজ সরল কথা না বুঝিয়া থাকে– অথবা এ সব কথা বুঝিবার নয়? মানুষ যা করিতে চায় তাই করে? অল্প দূরে মহেশের পোমানা বিড়ালটি ঘাপটি মারিয়া বসিয়া ছিল। মাছের ঝোল পরিবেশন করিতে আসিবার সময় বেচারির লেজে কি করিয়া মাধবীলতার পা পড়িয়া গেল কে জানে, চমক দেওয়া আওয়াজের সঙ্গে লাফাইয়া উঠিয়া মাধবীলতার নতুন শাড়িখানা আঁচড়াইয়া চিড়িয়া দিল। মাছের ঝোলের থালাটি মাটিতে পড়িয়া গেল, বিড়ালটির মতোই বিদ্যুৎগতিতে লাফ দিয়া পিছু হটিতে গিয়া মাধবীলতা ধপাস করিয়া মেঝেতে পড়িয়া গেল পা ছড়াইয়া বসিবার ভঙ্গিতে। গায়ে তার আঁচড় লাগে নাই, পড়িয়া গিয়াও বিশেষ ব্যথা লাগে নাই, কিন্তু চিৎকার শুনিয়া মনে হইল তাকে বুঝি বাঘে ধরিয়াছে। কাঠের মোটা একটা পিঁড়ি কাছেই পড়িয়া ছিল, দুহাতে পিঁড়িটা তুলিয়া নিয়া এমন জোরেই। বিভূতি বিড়ালটিকে মারিয়া বসিল যে, মরিবার আগে একটা আওয়াজ করার সময়ও বেচারির জুটিল না। সকলের আগে মহেশ চৌধুরীর মনে হইল তার পোমানা জীবটি আর কোনোদিন লেজ উঁচু করিয়া তার পায়ে গা ঘষিতে ঘষিতে ঘড় ঘড়, আওয়াজ করিবে না। তারপর অনেক কথাই তার মনে হইতে লাগিল। জটিল, খাপছাড়া, সব রাশি রাশি কথা চিন্তাগুলি যেন হেঁড়া কাগজের মতো মনের ঘরে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল, হঠাৎ দমকা হাওয়ায় এলোমেলো উড়িতে আরম্ভ করিয়া দিয়াছে। এ রকম অবস্থায় মহেশ চৌধুরী কথা বলে না। তাছাড়া আর উপায় কি আছে? এমন অভ্যাস জন্মিয়া গিয়াছে। যে, বিচার-বিবেচনার পর একটা কিছু সিদ্ধান্ত দিয়া না বুঝিলে মনের ভাব আর প্রকাশ করা যায় না। আত্মা-বিরোধী মত যদি কিছু প্রকাশ করিয়া বসে? সেটা প্রায় সর্বনাশের শামিল। কেন সর্বনাশের শামিল, তা অবশ্য মহেশ চৌধুরী কখনো ভাবিয়া দেখে নাই, তবে ক্ষতির সম্ভাবনাকে আত্মরক্ষী জীবমাত্রেই ভয় করে। নিজের সুখ-দুঃখের মুখাপেক্ষী করার নীতি যাকে মানিয়া নিতে হয়, অস্বাভাবিক সংযম তার একমাত্র বর্ম। রাগে, দুঃখে, অভিমানে বিচলিত হওয়া মহেশ চৌধুরীর পক্ষে সম্ভব, কিন্তু উচিত কি অনুচিত না জানিয়া পোষা বিড়ালকে মারার জন্য বিভূতিকে চড়চাপড়টা মারিয়া বসাও সম্ভব নয়, গালাগালি দেওয়াও সম্ভব নয়। কয়েকবার ঢোঁক গিলিয়া মহেশ চৌধুরী একেবারে চুপ করিয়া যায়। অন্য বিষয়েও একটি শব্দ আর তার মুখ দিয়া বাহির হয় না। খাওয়াও তখনকার মতো শেষ হয় সেইখানে। বিস্ফারিত চোখে খানিকক্ষণ মরা বিড়ালটার দিকে চাহিয়া থাকিয়া মাধবীলতা প্রথম ভয়ে ভয়ে। কথা বলে, কেন মিরলে? কি নিষ্ঠুর তুমি! যেখানে যেখানে আঁচড় দিয়েছে, আইডিন লাগিয়ে দাও গিয়ে। আঁচড় লাগে নি। কথাটা বিভূতি সহজে বিশ্বাস করিতে চায় না। একটুও আঁচড় দেয় নাই? একেবারে না? কি আশ্চর্য ব্যাপার! তবে তো বিড়ালটাকে না মারিলেও চলিত। বোকার মতো একটু হাসে বিভূতি, মরা বিড়ালটার দিকে চাহিয়াই মুখ ফিরাইয়া নেয়। বেশ বুঝিতে পারা যায় সে যেন একটু স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছে বিস্ময়ে নয়, ব্যথা লাগে না এমন কোনো আকস্মিক ও প্রচণ্ড আঘাতে। মহেশ চৌধুরীর নির্বাক থাকার চেয়ে বড় সংযম যেন বিভূতির দরকার হইতেছে শুধু সহজ নির্বিকার ভাবটা বজায় রাখতে। বিচলিত হওয়ার উপায় তো বেচারির নাই। মনের কোমল দুর্বলতা যদি প্রকাশ পাইয়া যায়? সেটা প্রায় সর্বনাশের শামিল। কেন সর্বনাশের শামিল, তা অবশ্য বিভূতি কখনো ভাবিয়া দ্যাখে নাই, তবে অন্যায়-বিরোধী মানুষমাত্রেই নিজের দুর্বলতাকে চাপা দিতে চায়। পরের দুঃখ কমানোর জন্য নিজের দুঃখকে তুচ্ছ করার নীতি যাকে মানিয়া নিতে হয়, অস্বাভাবিক সংযম তারও বৰ্ম। অনুতাপে থতমত খাইয়া যাওয়া বিভূতির পক্ষে সম্ভব, কিন্তু স্ত্রীকে আক্রমণ করার জন্য তুচ্ছ একটা বিড়ালকে শাস্তি দিয়া ব্যাকুলতা প্রকাশ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। চাকর বিড়ালের দেহটা তুলিয়া নিয়া যায়। বিভূতি আবার খাইতে আরম্ভ করে। খাইতে খাইতে ধীরে ধীরে সে আত্মসংবরণ করিতে থাকে। আত্মসংবরণ করিতে সময় তার বেশিক্ষণ লাগে। না, খাওয়াদাওয়ার পর মাধবীলতা যখন আজ শশধরের বৌয়ের সঙ্গে গল্প করার বদলে পান হাতে স্বামীর ঘরে ঢুকিয়া ভিতর হইতে দরজাটা বন্ধ করিয়া দেয়, বিভূতির মন তখন কঠিন কর্তব্য সম্পন্ন করার গাঢ় আর আঠার মতো চটচটে তৃপ্তিতে ভরিয়া গিয়াছে। দুপুরটা সেদিন দুজনের গভীর আনন্দে কাটিয়া গেল। পুরুষ আর নারীর প্রথম যৌবনের সব দুপুর ও রকম আনন্দে কাটে না। বিভূতির মা ঘরে যায় দুধের বাটি হাতে। মহেশ একরকম কিছুই খায় নাই। খাও? মহেশ কথা বলে না, শুধু মাথা নাড়ে। কিন্তু শুধু মাথা নাড়িয়া পতিব্ৰতা স্ত্রীকে কে কবে ঠেকাইতে পারিয়াছে? শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হইয়া বলিতে হয়, কেন জ্বালাতন করছ? এখন কিছু খাব না। কেন খাবে না? বিভূতির মার নিজেরও খাওয়া হয় নাই, ক্ৰমে ক্ৰমে মেজাজ চড়িতেছিল, আবার খানিকক্ষণ নীরব থাকিয়া মহেশ যখন সংক্ষেপে কৈফিয়ত দেয় যে, মনের উত্তেজনার সময় খাইলে শরীর খারাপ হয়–বিভূতির মার মেজাজ রীতিমতো গরম হইয়া ওঠে। কচি খোকার মতো কি যে কর তুমি! ভালো করিয়া কথা বলিলে, এমন কি রীতিমতো ঝগড়া করিলেও, হয়তো বিভূতির মা তখনকার মতো শুধু রাগে গগর করিতে করিতে চলিয়া যাইত, এক ঘণ্টা পরে আবার ফিরিয়া আসিত দুধের বাটি হাতে। কিন্তু এভাবে কথা পর্যন্ত বলিতে না চাহিলে কি মানুষের সহ্য হয়? বিভূতির মা তো আর জানি না, নিজের মনের সঙ্গে মহেশ বোঝাপড়া করিতেছে,
false
humayun_ahmed
সঙ্গে। এই যে ভাই সাহেব, আমার এই মেয়েটা… শুনেছি, বাবাকে বলছিলেন। আমি বারান্দায় ছিলাম। খুব ভালো খবর! নীলু, কদমবুসি কর, টগর সাহেবকে। আমি আঁৎকে উঠলাম, আরে না-না। না-না কি? মুরুব্বির দোয়া ছাড়া কিছু হয় নাকি? এ্যাঁ? রামিজ সাহেব ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলেন। আজ আর তিনি দীন ভাড়াটে নন। আজ এক জন অহংকারী বাবা। আমি বললাম, তোমার নাম কী? নীলু। রামিজ সাহেব গর্জে উঠলেন, ভালো নাম বল। নীলাঞ্জনা। রামিজ সাহেব হৃষ্টচিত্তে বললেন, ওর মা-র রাখা নাম। আমি নাম দিয়েছিলাম জোবেদা খানম। সেটা তার মায়ের পছন্দ হল না। নামটা নাকি পুরানা। আরে ভাই আমি নিজেও তো পুরানা। হা-হা-হা। বাবা মেয়েটির জন্য একটা পার্কার কলম কিনে পাঠিয়ে দিলেন। সেই কলমের প্রসঙ্গ রামিজ সাহেব সময়ে–অসময়ে কত বার যে তোলেন তার ঠিক নেই। যেমন দিন সাতেক পর রিমিজি সাহেবের সঙ্গে নিউমার্কেটে দেখা হল। তিনি এক%াল হেসে বললেন, কাণ্ড শুনেছেন নাকি ভাই? কী কাণ্ড? পার্কার কলমটা যে দিয়েছেন আপনারা-নিলু স্কুলে নিয়ে গিয়েছিল। ক্লাস ছুটি হওয়ার পর আর পায় না। মেয়ে তো কাঁদতে কাঁদতে বাসায় আসছে। আমি দিলাম এক চড়। মেজাজ কি ঠিক থাকে, বলেন আপনি? শেষে তার ব্যাগের মধ্যে পাওয়া গেল। দেখেন অবস্থা। হা-হা-হা। নীলুর সঙ্গে আমার খানিকটা খাতিরও হল অন্য একটি কারণে। এক দিন দেখলাম দুপুরের কড়া রোদে সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। এক নয়, সঙ্গে আরো কয়েকটি মেয়ে। স্কুল-ড্রেস পরা থাকলে যা হয়–সব কটাকে অবিকল এক রকম লাগে। তবুও এর মধ্যে নীলুকে চিনতে পারলাম, এ্যাই নীলু। নীলু হকচকিয়ে এগিয়ে এল। যাচ্ছ কোথায়? এ লাইনে তো মিরপুরের বাস যায়। কল্যাণপুর যাচ্ছি। আমাদের এক বন্ধুর আজ গায়ে হলুদ, আমাদের যেতে বলেছে। ঐ ওরাও যাচ্ছে তোমার সাথে? জ্বি। উঠে পড় গাড়িতে। পৌঁছে দিই। যে ভিড়, এখন আর বাসে উঠতে পারবে না। নীলু ইতস্তত করতে লাগল। যেন আমার সঙ্গে হঠাৎ দেখা হওয়ায় মস্ত অপরাধ হয়েছে। অন্য মেয়েগুলি অবশ্যি খুব হৈ-চৈ করে গাড়িতে উঠে পড়ল। তারা খুব খুশি। সারা দিন থাকবে তোমরা? নীলু জবাব দিল না। কালোমতো একটি মেয়ে হাসিমুখে বলল, আমরা সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকব। সবাই বাসায় বলে এসেছি। শুধু নীলু বলে আসে নি। কেন, নীলু বলে আস নি কেন? নীলু তারও জবাব দিল না। মাথা নিচু করে বসে রইল। কালো মেয়েটা বললো, নীলু। তার মার সঙ্গে ঝগড়া করেছে। দু দিন ধরে ওদের মধ্যে কথা বন্ধ। তাই বুঝি? জ্বি, ও যখন আজ সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরবে, তখন মজাটা টের পাবে। সব কটি মেয়ে খিলখিল করে হেসে ফেলল। ব্যাক ভিউ মিররে দেখলাম নীলুর চোখে জল এসে যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর নীলুদের বাসায় সত্যি সত্যি দারুণ অবস্থা। রমিজ সাহেব কাঁদো। কাঁদো হয়ে বাবুভাইকে গিয়ে বললেন, ভাইসোব শুনেছেন, আমার মেয়েটা কিডন্যাপ হয়েছে। কী বলছেন এইসব? জ্বি ভাইসব, সত্যি কথাই বলছি। রমিজ সাহেব ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেললেন। আমি বললাম, এসে পড়বে, হয়তো বন্ধুর বাড়িটাড়ি গিয়েছে। আমার মেয়ে না বলে কোথাও যাবে না। টগর সাহেব। নীলু সে রাতে বাড়ি এসে পৌঁছে রাত পৌণে আটটায়। ওর বন্ধুর বাড়ি থেকে মুরুরি কিসিমের এক ভদ্রলোক এসে পৌঁছে দিয়ে গেলেন। কিন্তু ইতোমধ্যে আমাদের নিচতলায় প্রলয়ের মতো হয়ে গেল। রামিজ সাহেব কেঁদে গিয়ে পড়লেন। আমার বড়োেচাচার কাছে। বড়োচাচা একটা কাজ পেয়ে লাফ-ঝাঁপ দিতে শুরু করলেন–এই থানায় টেলিফোন করছেন, ঐ করছেন হাসপাতালে, এক বার শুনলাম অত্যন্ত গভীর ভঙ্গিতে কাকে যেন বলছেন, আরে ভাই, বলতে গেলে বাসার সামনে থেকে মেয়েটাকে ধরে নিয়ে গেছে। এই দেশে বাস করা অসম্ভব। আমি সিঁড়ির কাছাকাছি আসতেই দেখলাম গাড়ি এসে ঢুকেছে। ডাক্তার চলে এসেছে। কোন জন এসেছে কে জানে? বড়ো রাস্তার মোড়ে এক জন ডাক্তার থাকেন, যাকে দেখেই যক্ষ্মারোগী বলে ভ্রম হয়। দাদার জন্যে তিনি হচ্ছেন ফুলটাইম ডাক্তার। তাঁর নাম প্রদ্যোত বাবু বা এই ধরনের কিছু। এর বিশেষত্ব হচ্ছে, তিনি এ্যালোপ্যাথির পাশাপাশি টোটকা অষুধ দেন। বাবুভাইয়ের এক বার টনসিল ফুলে বিশ্ৰী অবস্থা হল। কিছুই গিলতে পারেন না। এক শ দুই জ্বর গায়ে। প্রদ্যোত বাবু এসেই গম্ভীর মুখে বললেন বানরলাঠি গাছের ফল পিষে গলায় প্রলেপ দিতে। এটাই নাকি মহৌষধ। বাবুভাই দারুণ রেগে গেল। চিঁ চিঁ করে বলল, শালা মালাউন কবিরাজী শুরু করেছে। প্রদ্যোত বাবু (কিংবা পীযূষ বাবু), কিন্তু সত্যি সত্যি বানরলাঠি গাছের ফল যোগাড় করে পুলটিশ লাগিয়ে ছাড়লেন। অসুখ আরাম হল। যদিও বাবুভাইয়ের ধারণা, এম্নিতেই সারিত। শরীরের নিজস্ব রোগপ্রতিরোধের মেকানিজমেই সেরেছে। যাই হোক, প্রদ্যোত বাবুর আমাদের বাড়িতে মোটামুটি একটা সম্মানের আসন আছে। তিনি বাড়ি এলেই তাঁর জন্য দুধ-ছাড়া চা হয়, সন্দেশ আনান হয় এবং বাবা নিজে নেমে এসে কথাবার্তা। বলেন। এই যে ডাক্তার, যাওয়ার আগে আমার প্ৰেশারটা দেখে যাবে। বিনা কী-তে প্ৰেশার দেখা ছেড়ে দিয়েছি রহমান সাহেব। মেডিকেল এথিক্সের ব্যাপার আছে–হা-হা-হা। আজ দেখলাম আমাদের প্রদ্যোত বাবু ছাড়াও অন্য এক জন ডাক্তার নামলেন। সেই ভদ্রলোকের চোখেমুখে সীমাহীন বিরক্তি, যার মানে তিনি এক জন বড়ো ডাক্তার। পিজির কিংবা মেডিক্যালের প্রফেসর বা এসোসিয়েট প্রফেসর। ভদ্রলোকের বিরক্তি দেখি ক্রমেই বাড়ছে। গাড়ি থেকে নেমেই হাতঘড়ি দেখলেন। আমার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল দেখি ভদ্রলোক যে কতক্ষণ থাকেন তার মাঝে মোট কবার হাতঘড়ি দেখেন। কিন্তু এখন এসব এক্সপেরিমেন্টের ভালো সময় নয়। গাড়ি নিয়ে কিছুক্ষণের
false
nazrul
মাতা বলিলেন, ‘তুই এখন শো দেখি। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সব কথা বলি। জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘আর সব কথা বলতে হবে না তোমার। আমি সব জানি। এরই মধ্যে হাজিবুড়ি হতে যাচ্ছ, এই তো!’ মাতা হাসিয়া বলিলেন, ‘তা বুড়ো তো হয়েছি বাবা। এইবার তোর জিনিস তুই নে। আমি আর যখের ধন আগলাতে পারিনে।’ জাহাঙ্গীরও তরল হাসি হাসিয়া বলিল, ‘অর্থাৎ যক্ষ ভূত হয়ে আমিই এ টাকাকড়ি নিয়ে পাহারা দিই! তা মা, জ্যান্ত ছেলেকেও যখ দেওয়া যায় না!’ মা ছেলের মুখ চাপিয়া বলিলেন, ‘তুই থাম খোকা। ষাট! বালাই! নিতে হবে না তোকে কিছু। দেওয়ান সাহেবই সব দেখবেন। তুই ঘরেরও হবিনে। অথচ আমায়ও মুক্তি দিবিনে। আমি কতদিন আর এ শাস্তি বইব, বল তো?’ জাহাঙ্গীর দুষ্টুমির হাসি হাসিয়া বলিল, ‘আচ্ছা মা, আমি যদি তোমার বউমা এনে দিই, তা হলে হজ করতে যেতে পারবে?’ মা যেন হাতে স্বর্গ পাইয়া বলিলেন, ‘তোর মুখে ফুলচন্দন পড়ুক খোকা! ও অদৃষ্ট নিয়ে আমি আসিনি। বাড়িতে যদি আমার বউমা আসে, তুই ফিরে আসিস, তা হলে কাজ কী আমার মক্কার হজে! ওই হবে আমার মক্কা-কাবা সব!’ জাহাঙ্গীর হো হো করিয়া মায়ের মুখের কথা কাড়িয়া লইয়া বলিল, ‘বলো কী মা, তোমার বউমাই হবে সব! কাবার চেয়েও বড়ো!’ – বলিয়াই কৃত্রিম দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘থাক, আমিই বানে ভেসে এসেছিলুম!’ মা এইবার রাগিয়া উঠিয়া বলিলেন, ‘চুপ কর হতভাগা ছেলে! যা নয় তাই বলা হচ্ছে!’ – বলিয়াই স্নেহ বিগলিত স্বরে বলিলেন, ‘সত্যি খোকা বল, তুই আমার ঘরে বউ এনে দিবি? আর ভূতের মতো একলা বাড়ি আগলাতে পারিনে! কেমন? তা হলে জিনিসপত্র খুলতে বলি?’ – বলিয়া হাঁক-ডাক দিতে আরম্ভ করিলেন, ‘ওরে মোতিয়া, দেওয়ানজিকে একবার খবর দে তো !’ মোতিয়া বাড়িরই পুরাতন ঝি। সে এতক্ষণ সব শুনিতেছিল আড়ালে থাকিয়া। এই খোশখবরে সে আর থাকিতে না পারিয়া বলিয়া উঠিল, ‘বেগম আম্মা, আপনি দেইহ্যা বুঝবার পারছেন না, ভাইজানের মুখ ক্যামন শুরুষকু অইয়্যা গিয়াছে! জোয়ান পোলার শাদি না দিলে সে তাই ব্যাওরা অইয়্যা যাইব না?’ জাহাঙ্গীর হো হো শব্দে হাসিয়া উঠিল। মা-ও হাসিয়া ফেলিয়া বলিলেন, ‘তুই যা দেখি, আগে দেওয়ান সাহেবকে ডেকে আন, তার পর তোর ভাইজানের শাদির কথা হবে।’ জাহাঙ্গীর বলিয়া উঠিল, ‘তার আগে মা তোমার সব কথা ভালো করে শোনা দরকার!’ মোতিয়া তাহার কাজলায়িত চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া জাহাঙ্গীরের দিকে তাকাইয়া চলিয়া গেল। মাতা পুত্রের রুক্ষ চুলের মধ্যে অঙ্গুলি চালনা করিতে করিতে বলিলেন, ‘কতদিন তেল মাখিসনে খোকা, বল তো! তুই কি সন্ন্যাসী হয়ে যাবি নাকি শেষে?’ জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘কিন্তু তুমি তো সন্ন্যাসী হতে দেবে না। সে যাক, তুমি যে আসল কথাটাই শুনতে চাচ্ছ না!’ মা হাসিয়া বলিলেন, ‘সে কথা না শুনেই আমি বুঝেছি। সে মেয়েটি কোথায় থাকে বল, তার পর আমার যা করবার আমি করব!’ জাহাঙ্গীর লজ্জিত হইয়া বলিল, ‘তুমি যা মনে করছ মা তা নয়। আমি তোমার কাছে কিছু লুকোব না। সব শুনে তুমি যা করতে বলবে তাই করা যাবে।’ জাহাঙ্গীর হারুণদের বাড়ি যাওয়া হইতে আরম্ভ করিয়া তাহার উন্মাদিনী মাতার কীর্তি পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা বলিয়া গেল। বলিল না শুধু তাহার বিপ্লবীদলের সহিত সংশ্লিষ্ট থাকার কথা। মাতা বিস্ময়াভিভূত হইয়া অনেকক্ষণ বসিয়া রহিলেন, তাঁহার মুখ দিয়া কোনো কথা উচ্চারিত হইল না। ক্ষণে ক্ষণে তাঁহার মুখে আনন্দ ও শঙ্কার আলোছায়া খেলিয়া যাইতে লাগিল। হঠাৎ জাহাঙ্গীর বলিয়া উঠিল, ‘কিন্তু মা তাকে কিছুতেই এ বাড়িতে আনা যেতে পারে না। তোমাকে বলতে ভুলে গেছি – সে অতিমাত্রায় অহংকারী মেয়ে। আমার মা গিয়ে তাকে অভ্যর্থনা করে আনলে তবে নাকি তিনি আমাদের ঘরে শুভ পদার্পণ করলেও করতে পারেন। বিষ নেই মা, কিন্তু ফণা-আস্ফালন আছে!’ মা হাসিয়া ফেলিয়া বলিলেন, ‘সে ঠিকই বলেছে খোকা। তা যদি সে না বলত, আমি তাকে আনবার কথা ভাবতে পারতুম না। যে সাপ ফণা ধরে – তার বিষও থাকে, সে জাতসাপ।’ জাহাঙ্গীর ভয় পাইয়া বলিয়া উঠিল, ‘তুমি কি তাকে এ বাড়িতে আনবে মা?’ মা হাসিয়া বলিলেন, ‘তা আনতে হবে বইকী! খোদা নিজে হাতে যে সওগাত পাঠিয়েছেন তাকে মাথায় তুলে নিতে হবে।’ জাহাঙ্গীর ক্লান্ত কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, ‘কিন্তু মা আমি তো তাকে বিয়ে করতে পারি না। তাকে কেন, কাউকেই বিয়ে করবার অধিকার আমার নেই!’ মা চমকিয়া উঠিয়া কী ভাবিলেন। তাহার পর আদেশের স্বরে বলিলেন, ‘তোর তো বিয়ে হয়ে গেছে খোকা। তুই তাকে অস্বীকার করতে পারিস, কিন্তু সে মেয়েকে না দেখলেও তোর কাছে তার সম্বন্ধে যা শুনেছি – তাতে মনে হচ্ছে – সে তোকে অস্বীকার করতে পারবে না। তুই যদি তাকে না নিস, সে তার নিয়তিকে মেনে নিয়ে চিরকাল দুঃখ ভোগ করবে। জানি না, তার অদৃষ্টে কী আছে, কিন্তু আমার ছেলে যদি তার কাছে চির-অপরাধীই থেকে যায় আমাকে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে!’ জাহাঙ্গীর শূন্যদৃষ্টিতে একবার তাহার মাতার পানে চাহিয়া অসহায়ভাবে শুইয়া পড়িল। মা ম্লান হাসি হাসিয়া বলিলেন, ‘কিন্তু তোর এত ভয় কেন খোকা? সে কি সুন্দরী নয়? না অন্য কারণে তোর মনে ধরেনি?’ জাহাঙ্গীর রুগ্‌ণ-কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, ‘না মা, তা নয়। তার মতো সুন্দরী মেয়ে খুব কমই চোখে পড়ে। তুমি তো হারুণকে দেখেছ। তার চেয়েও সে সুন্দর। আর, মনে ধরার কথাই উঠতে পারে
false
shorotchandra
নিরানন্দও ত অদৃষ্টে লেখা থাকতে পারে। কমল কহিল, এই অন্ধকার নির্জন পথে একলা আপনার পাশে বসে ঊর্ধ্বশ্বাসে কত দূরেই না বেড়িয়ে এলাম। আজ আমার কি ভালই যে লেগেছে তা আর বলতে পারিনে। অজিত বুঝিল কমল তাহার কথায় কান দেয় নাই,—সে যেন নিজের কথা নিজেকেই বলিয়া চলিতেছে। শুনিয়া লজ্জা পাইবার মত হয়ত সত্যই ইহাতে কিছুই নাই, তবুও প্রথমটা সে যেন সঙ্কুচিত হইয়া উঠিল। ওই মেয়েটির সম্বন্ধে বিরুদ্ধ কল্পনা ও অশুভ জনশ্রুতির অতিরিক্ত বোধ হয় কেহই কিছু জানে না,—যাহা জানে তাহারও হয়ত অনেকখানি মিথ্যা,—এবং সত্য যাহা আছে তাহাতেও হয়ত অসত্যের ছায়া এমনি ঘোরালো হইয়া পড়িয়াছে যে চিনিয়া লইবার পথ নাই। ইচ্ছা করিলে যাচাই করিয়া যাহারা দিতে পারে তাহারা দেয় না, যেন সমস্তটাই তাহাদের কাছে একেবারে নিছক পরিহাস। অজিত চুপ করিয়া আছে, ইহাতেই কমলের যেন চেতনা হইল। কহিল, ভাল কথা, কি বলছিলেন, ফিরে গিয়ে আনন্দের বদলে নিরানন্দ অদৃষ্টে লেখা থাকতে পারে? পারে বৈ কি! অজিত কহিল, তা হলে? কমল বলিল, তা হলেও এ প্রমাণ হয় না, যে আনন্দ আজ পেলাম তা পাইনি! এবার অজিত হাসিল। বলিল, সে প্রমাণ হয় না, কিন্তু এ প্রমাণ হয় যে আপনি তার্কিক কম নয়। আপনার সঙ্গে কথায় পেরে ওঠা ভার। অর্থাৎ যাকে বলে কূট-তার্কিক, তাই আমি? অজিত কহিল, না, তা নয়, কিন্তু শেষ ফল যার দুঃখেই শেষ হয় তার গোড়ার দিকে যত আনন্দই থাক, তাকে সত্যকার আনন্দভোগ বলা চলে না। এ ত আপনি নিশ্চয়ই মানেন? কমল বলিল, না, আমি মানিনে। আমি মানি, যখন যেটুকু পাই তাকেই যেন সত্যি বলে মেনে নিতে পারি। দুঃখের দাহ যেন আমার বিগত-সুখের শিশিরবিন্দুগুলিকে শুষে ফেলতে না পারে। সে যত অল্পই হোক, পরিমাণ তার যত তুচ্ছই সংসারে গণ্য হোক, তবুও যেন না তাকে অস্বীকার করি। একদিনের আনন্দ যেন না আর একদিনের নিরানন্দের কাছে লজ্জাবোধ করে। এই বলিয়া সে ক্ষণকাল স্তব্ধ থাকিয়া কহিল, এ জীবনে সুখ-দুঃখের কোনটাই সত্যি নয় অজিতবাবু, সত্যি শুধু তার চঞ্চল মুহূর্তগুলি, সত্যি শুধু তার চলে যাওয়ার ছন্দটুকু। বুদ্ধি এবং হৃদয় দিয়ে একে পাওয়াই ত সত্যিকার পাওয়া। এই কি ঠিক নয়? এ প্রশ্নের উত্তর অজিত দিতে পারিল না, কিন্তু তাহার মনে হইল অন্ধকারেও অপরের দুই চক্ষু একান্ত আগ্রহে তাহার প্রতি চাহিয়া আছে। সে যেন নিশ্চিত কিছু একটা শুনিতে চায়। কৈ জবাব দিলেন না? আপনার কথাগুলো বেশ স্পষ্ট বুঝতে পারলাম না। পারলেন না? না। একটা চাপা নিশ্বাস পড়িল। তাহার পরে কমল ধীরে ধীরে বলিল, তার মানে স্পষ্ট বোঝবার এখনো আপনার সময় আসেনি। যদি কখনো আসে আমাকে কিন্তু মনে করবেন। করবেন ত? অজিত কহিল, করব। গাড়ি আসিয়া সেই ভাঙ্গা ফুলবাগানের সম্মুখে থামিল। অজিত দ্বার খুলিয়া নিজে রাস্তায় আসিয়া দাঁড়াইল, বাটীর দিকে চাহিয়া কহিল, কোথাও এতটুকু আলো নেই, সবাই বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েচে। কমল নামিতে নামিতে কহিল, বোধ হয়। অজিত কহিল, দেখুন ত আপনার অন্যায়। কাউকে জানিয়ে গেলেন না, শিবনাথবাবু না জানি কত দুর্ভাবনাই ভোগ করেছেন। কমল কহিল, হাঁ। দুর্ভাবনার ভারে ঘুমিয়ে পড়েছেন। অজিত জিজ্ঞাসা করিল, এই অন্ধকারে যাবেন কি করে? গাড়িতে একটা হাতলণ্ঠন আছে, সেটা জ্বেলে নিয়ে সঙ্গে যাবো? কমল অত্যন্ত খুশী হইয়া কহিল, তা হলে ত বাঁচি অজিতবাবু। আসুন, আসুন, আপনাকে একটুখানি চা খাইয়ে দিই। অজিত অনুনয়ের কণ্ঠে কহিল, আর যা হুকুম করুন পালন করব, কিন্তু এত রাত্রে চা খাবার আদেশ করবেন না। চলুন, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসচি। সদর দরজায় হাত দিতেই খুলিয়া গেল। ভিতরের বারান্দায় একজন হিন্দুস্থানী দাসী ঘুমাইতেছিল, মানুষের সাড়া পাইয়া উঠিয়া বসিল। বাড়িটি দ্বিতল। উপরে ছোট ছোট গুটি-দুই ঘর। অতিশয় সঙ্কীর্ণ সিঁড়ির নীচে মিটমিট করিয়া একটি হারিকেন লণ্ঠন জ্বলিতেছে, সেইটি হাতে করিয়া কমল তাহাকে উপরে আহ্বান করিতে অজিত সঙ্কোচে ব্যাকুল হইয়া বলিল, না, এখন যাই। রাত অনেক হলো। কমল জিদ করিয়া কহিল, সে হবে না, আসুন। অজিত তথাপি দ্বিধা করিতেছে দেখিয়া সে বলিল, আপনি ভাবচেন এলে শিবনাথবাবুর কাছে ভারী লজ্জার কথা। কিন্তু না এলে যে আমার লজ্জা আরও ঢের বেশী এ ভাবচেন না কেন? আসুন। নীচে থেকে এমন অনাদরে আপনাকে যেতে দিলে রাত্রে আমি ঘুমোতে পারবো না। অজিত উঠিয়া আসিয়া দেখিল ঘরে আসবাব নাই বলিলেই হয়। একখানি অল্প মূল্যের আরাম-কেদারা, একটি ছোট টেবিল, একটি টুল, গোটা-তিনেক তোরঙ্গ, একধারে একখানি পুরানো লোহার খাটের উপর বিছানা-বালিশ গাদা করিয়া রাখা,—যেন, সাধারণতঃ তাহাদের প্রয়োজন নাই এমনি একটা লক্ষ্মীছাড়া ভাব। ঘর শূন্য,—শিবনাথবাবু নাই। অজিত বিস্মিত হইল, কিন্তু মনে মনে ভারী একটা স্বস্তি বোধ করিয়া কহিল, কৈ তিনি ত এখনো আসেন নি? কমল কহিল, না। অজিত বলিল, আজ বোধ হয় আমাদের ওখানে তাঁর গান-বাজনা খুব জোরেই চলচে। কি করে জানলেন? কাল-পরশু দু’দিন যাননি। আজ হাতে পেয়ে আশুবাবু হয়ত সমস্ত ক্ষতিপূরণ করে নিচ্চেন। কমল প্রশ্ন করিল, রোজ যান, এ দু’দিন যাননি কেন? অজিত কহিল, সে খবর আমাদের চেয়ে আপনি বেশী জানেন। সম্ভবতঃ, আপনি ছেড়ে দেননি বলেই তিনি যেতে পারেন নি। নইলে স্বেচ্ছায় গরহাজির হয়েছেন এ ত তাঁকে দেখে কিছুতেই মনে হয় না। কমল কয়েক মুহূর্ত তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া থাকিয়া অকস্মাৎ হাসিয়া উঠিল। কহিল, কে জানে তিনি ওখানে যান গান-বাজনা করতে! বাস্তবিক, মানুষকে জবরদস্তি ধরে রাখা বড়
false
humayun_ahmed
তখন তার চোখের দিকেই প্রথম তাকাই। তারপর তার মুখ দেখি, মাথার চুল দেখি। এক ফাঁকে সে কী কাপড় পরে এসেছে তা দেখি। যদি আমরা তার চোখ থেকেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নেই তা হলে চোখ ছাড়া লোকটির আর কিছুই দেখা হয় না। চোখ থেকেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবার ব্যাপার কখন ঘটবে? তখনই ঘটবে যখন লোকটির চোখের তীব্র বিকর্ষণী ক্ষমতা থাকবে। চোখ কখন বিকর্ষণ করে? যখন চোখে কোনো সূক্ষ্ম অস্বাভাবিকতা থাকে। মিসির আলি মনে মনে বললেন, মুশফেকুর রহমান নামের লোকটির চোখের অস্বাভাবিক বিকর্ষণী ক্ষমতার জন্যেই তাকে কখনো ভালোভাবে লক্ষ করা হয় নি। তাকে ভালোভাবে দেখার আগেই আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়েছি। আমি তার কুৎসিত কালো জিব দেখেছিল—কারণ সে আমাকে ইচ্ছে করে তা দেখিয়েছে। মিসির আলি নিশ্চিন্ত বোধ করলেন। সম্ভবত এখন তাঁর ঘুম আসবে। হাই উঠছে। তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। রাতে তার সুনিদ্ৰা হল। শেষরাতের দিকে পাখি নিয়ে কিছু ছাড়া ছাড়া স্বপ্ন দেখলেন। একটি স্বপ্নে চড়ুই পাখি দুটি তাঁর সঙ্গে কথা বলল। মিষ্টি রিনারিনে গলায় বলল, মিসির আলি সাহেব, শরীরের হাল অবস্থা ভালো? তিনি বললেন, জি-না, ভালো না। রোজ খানিকটা পাইজিং চাল খাবেন! চা চামচে এক চামচ, খালি পেটে। জি আচ্ছা, খাব। স্বপ্নের মধ্যেই মিসির আলি নিজেকে বোঝালেন—এ জাতীয় স্বপ্ন দেখার পেছনে যুক্তি আছে। তিনি ক্রমাগত পাখি নিয়ে ভাবছেন বলেই এরকম দেখছেন। এ জগতে যুক্তিহীন কিছু ঘটে না। অযুক্তি হল অবিদ্যা। এ পৃথিবীতে অবিদ্যার স্থান নেই। তাঁর পাখিবিষয়ক গবেষণা বেশিদূর এগুচ্ছে না। চড়ুই পাখি দুটি খাঁচায় ঢুকছে না। মিসির আলি খাঁচাটা জানালার পাশে রেখেছেন। খাঁচার ভেতরে পিরিচ ভর্তি চাল। পাখি দুটি মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চাল দেখছে। তবে সাহস করে এগুচ্ছে না। তাদের ষষ্ঠ ইন্দ্ৰিয় তাদের সাবধান করে দিচ্ছে। বলে দিচ্ছে এই খাঁচার ভেতর না ঢুকতে। একটি চড়ুই পাখির মস্তিষ্কের পরিমাণ কত? খুব বেশি হলে পঞ্চাশ মিলিগ্রাম। মাত্র পঞ্চাশ মিলিগ্রাম মস্তিষ্ক নিয়েও সে বিপদ আঁচ করতে পারে। মানুষ কিন্তু পারে না। সিক্সথ সেন্স মানুষের ক্ষেত্রে তেমন প্রবল নয়। সারাটা দিন মিসির আলি পাখির পেছনেই কাটালেন। পাখি দুটির আজ হয়তো কোনো কাজকর্ম নেই। এরা খাঁচার আশপাশেই রইল, অন্যদিনের মতো চলে গেল না। মিসির আলিও সময় কাটাতে লাগলেন বিছানায় আধশোয়া হয়ে! তিনি এমনভাবে শুয়েছেন যেন প্রয়োজনে চট করে উঠে খাঁচার দরজা বন্ধ করতে পারেন। মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ার ভানও করলেন। পাখি দুটি তাতে প্রতারিত হল না। সন্ধ্যাকেলা তিনি গেলেন পার্কে। শীতের সময় সন্ধ্যাবেল পার্কে লোকজন হাওয়া খেতে যায় না। পার্ক থাকে খালি। এই সময় হঁটিতে ভালো লাগে। সন্দেহজনক কিছু লোকজনকে অবিশ্যি দেখা যায়। তারা কুটিল চোখে বারবার তাকায়। একবার চাদর গায়ে একজন মধ্যবয়স্ক লোক তার খুব কাছাকাছি এসে গম্ভীর গলায় বলেছিল–সব খবর ভালো? তিনি তৎক্ষণাৎ বলেছেন, জি ভালো। লোকটি এক দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে গিয়েছিল। মিসির আলি পার্কে সেজেগুঁজে থাকা কিছু মেয়েকেও দেখেন। সাজ খুবই সামান্য-কড়া লিপস্টিক, গালে পাউডার এবং রোজ, চোখে কাজল। তারা ঘোরাফেরা করে অন্ধকারে। অন্ধকারে তাদের সাজসজ্জা কারোর চোখে পড়ার কথা না। এরা কখনো মিসির আলির কাছে আসে না। তবে তিনি এদের সঙ্গে কথা বলার জন্যে এক ধরনের আগ্রহ অনুভব করেন। তিনি ঠিক করে রেখেছেন এদের কেউ যদি কখনো তার কাছে আসে তিনি তাকে নিয়ে পার্কের বেঞ্চিতে বসবেন, তার তীব্র দুঃখ ও বেদনার কথা মন দিয়ে শুনবেন। তাঁর খুব জানতে ইচ্ছা করে—এই মেয়েগুলো জীবনের চরমতম গ্লানির মুহুর্তগুলো কীভাবে গ্ৰহণ করেছে? এ সুযোগ এখনো তাঁর হয় নি। পার্কে তিনি ঘণ্টাখানেক হাঁটলেন। কুড়ি মিনিটের মতো তাঁর পরিচিত প্রিয় জায়গায় পা তুলে বসে রইলেন। পার্কটার একটা বড় সমস্যা হল-গাছগাছালি খুব বেশি, আকাশ দেখা যায় না। তাঁরা আজকাল খুব ঘন ঘন আকাশ দেখতে ইচ্ছা করে। একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর সবারই বোধহয় এরকম হয়—বারবার আকাশের দিকে দৃষ্টি যায়। প্রকৃতি মানুষের জিনে অনেক তথ্য ঢুকিয়ে দিয়েছে। প্রকৃতি মানুষের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারে না, কিংবা চায় না। তার যা বলার তা সে বলে দিয়েছে, লিখিতভাবেই বলেছে। সেই লেখা আছে জিনে-ডিএনএ এবং আরএনএ অণুতে। মানুষ সেই লেখার রহস্যময়তা জানে কিন্তু লেখাটা পড়তে পারছে না। একদিন অবশ্যই পারবে। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। মিসির আলির উঠতে ইচ্ছা করছে না। তিনি অপেক্ষা করছেন। মুশফেকুর রহমান নামের লোকটির জন্যে। যদিও তিনি জানেন সে আজ আসবে না। কারণ মুশফেকুর রহমান জানে, মিসির আলি গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। রহস্যপ্রিয় মানুষ, নিজের রহস্য কখনো ভাঙবে না। আরো রহস্য তৈরি করবে। এই লোকটি তখনই তার কাছে আসবে–যখন মিসির আলি তার জন্যে অপেক্ষা করা বন্ধ করে দেবেন। লোকটিকে খুঁজে বের করা কি কঠিন? মিসির আলির কাছে এই মুহুর্তে কাজটা কঠিন বলে মনে হচ্ছে না। বিত্তবান লোক হলে তার একটা টেলিফোন থাকার কথা। গাড়ি থাকার কথা। গাড়ি রেজিস্ট্রেশন কী নামে হয়েছে তা বের করা কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার। গাড়ি না থাকলেও তার টিভি কিংবা রেডিও আছে। এদের জন্যেও লাইসেন্স করতে হয়। ঠিকানা আছে এমন মানুষকে খুঁজে পাওয়া কোনো সমস্যাই নয়। বের করা যায় না। শুধু ঠিকানাহীন মানুষদের। স্নামালিকুম স্যার। ওয়ালাইকুম সালাম। স্যার, আমি মুশফেকুর রহমান। আপনি আজ পার্কে আসবেন ভাবি নি। আমি ভেবেছিলাম আজ আপনি পাখিদের নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন। মিসির আলি স্বাভাবিক
false
shottojit_roy
হয়। তা হলে আপনাকে বলে দিই–আপনি এই ম্যাক্সওয়েল ছাকরাটির উপর একটু দৃষ্টি রাখবেন। ওর ব্যবহার আমার মাথায় দুশ্চিন্তা ঢুকিয়ে দিয়েছে। নিশ্চয়ই রাখব। লজে ফিরে এসে আরও দুজনের সঙ্গে আলাপ হল—তাদের কথা এই বেলা লিখে রাখি। এক–মিস্টার নস্কর। ইনি কলকাতার একজন নাম-করা ধনী ব্যবসায়ী। ইনি আগেই দুটোর সময় নিজের গাড়িতে এসে পৌঁছেছেন। দুই–জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়। ইনি বালপুরেই থাকেন। স্টেটসম্যানে পিটারের লেখাটা পড়ে সোজা আমাদের সঙ্গে এসে দেখা করে বললেন উনি বীরভূম সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ। এখানকার প্রত্যেকটি টেরা কোটা মন্দির ওঁর দেখা এবং সে ব্যাপারে উনি সাহেবদের খুব সাহায্য করতে পারেন। পিটার তাঁকে বলে দিল ওর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে। মিঃ নস্কর-পরে জেনেছিলাম পুরো নাম অর্ধেন্দু নস্কর-স্টুরিস্ট লজে এসে লাউঞ্জে আমাদের দেখা পেলেন। আমরা সবাই তখন লাঞ্চের ডাক কখন পড়বে তার অপেক্ষায় বসে আছি। ভদ্রলোক এসে ঢুকতে আমাদের সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন, কারণ চেহারাটা বেশ চোখে পড়ার মতো! টকটকে গায়ের রং, ফ্রেঞ্চ কাট কালো দাড়ি, চোখে রিমালেস চশমা, পরনে গাঢ় নীল সুটের সঙ্গে জামার উপর কালো নকশা করা স্কার্ফ। ভদ্রলোক দুজন সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে মিঃ রবার্টসন? বলতেই পিটার উঠে দাঁড়িয়ে তার হাতটা বাড়িয়ে দিল। ভদ্রলোক করমর্দন করে বললেন, মই নেম ইজ ন্যাস্কার। আমি স্টেটসম্যানে তোমার লেখাটা পড়ে খোঁজখবর করে তোমার সঙ্গে দেখা করব বলে সোজা এখানে চলে আসছি আমার গাড়িতে। হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ? নস্কর একটা চেয়ার টেনে নিয়ে পিটারের মুখোমুখি বসে বলল, আগে তোমার মুখ থেকে আমি একটা কথা শুনতে চাই… কী? দেড়শো বছর আগে তোমার পূর্বপুরুষ তাঁর ডায়রিতে যে বাসনার কথা লিখেছেন, তুমি কি সত্যিই সেটা পূরণ করতে এদেশে এসেছ? অ্যাবসোলিউটলি, বলল। পিটার। তুমি কি অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস করা? তোমার কি সত্যিই ধারণা যে রুবিটা ভারতবর্ষে ফেরত দিলে তোমার পূর্বপুরুষের আত্মা শাস্তি পাবে? পিটার শুকনো গলায় উত্তরটা দিল। আমি কী বিশ্বাস করি বা না করি সেটা জানার কী দরকার? যতদূর বুঝছি আপনি রুবিটা কেনার প্রস্তাব করছেন। আমার উত্তর হল আমি ওটা বেচব না। তুমি তোমার দেশের জহুরিকে এটা দেখিয়েছ? দেখিয়েছি। রুবির দাম তার মতে কত হতে পারে? টেগয়েন্টি থাউজ্যান্ড পাউন্ডস। পাথরটা কি হাতের কাছে আছে? সেটা একবার দেখতে পারি কি? পাথরটা টমের কাছেই ছিল; সে ব্যাগ থেকে কৌটোটা বার করে নস্করকে দিল। মিঃ নস্কর কৌটোটা খুলে পাথরটা বার করে বেশ কিছুক্ষণ ধরে সেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে তারপর পিটারের দিকে ফিরে বলল, তোমাদের দুজনের কাউকেই তো তেমন ধনী বলে মনে হচ্ছে না। তার কারণ, বলল। পিটার, আমরা ধনী নই। কিন্তু এও বলতে পারি যে আমরা লোভীও নাই। আমরা দুজনে কিন্তু এক ছাঁচে ঢালা নাই, টম ম্যাক্সওয়েল হঠাৎ বলে উঠল। তার মানে? নস্কর শুধোলেন। পিটার বলল, আমার বন্ধু বলতে চাইছে যে এ ব্যাপারে আমাদের দুজনের মধ্যে মতের সম্পূর্ণ মিল নেই। অর্থাৎ, রুবিটা বিক্রি করে দু পয়সা রোজগারের ব্যাপারে তার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু রুবিটা তো ওর প্রপার্টি নয়, আমার প্রপাটি; কাজেই ওর কথায় তেমন আমল না দিলেও চলবে। টম দেখি। গম্ভীর হয়ে গেছে, তার কপালে গভীর খাঁজ। এনিওয়ে, বললেন নস্কর, আমি এখানে আরও তিনদিন আছি। শান্তিনিকেতনে আমার বাড়ি রয়েছে। আমি আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখৰ্ব্ব। অত সহজে আমাকে ঝেড়ে ফেলতে পারবেন না মিস্টার রবার্টসন। আমি আপনাকে বারো লাখ টাকা দিতে রাজি আছি। আমার মূল্যবান পাথরের সংগ্ৰহ সারা ভারতবর্ষে পরিচিত। এত বড় একটা রোজগারের সুযোগকে আপনারা কেন হেলাফেলা করছেন জানি না। আশা করি ক্রমে আপনাদের মত পরিবর্তন হবে। পিটার বলল, এখানে একটা কথা কিন্তু বলা দরকার। আপনার আগে আরেকজন আমাদের অফার দিয়েছেন। কে? দুবরাজপুরের একজন ব্যবসায়ী। ঢানঢানিয়া? হ্যাঁ। ও কত দেবে বলেছে? দশ লাখ। সেটা আরও বাড়বে না। এমন কোনও কথা নেই। ঠিক আছে। ঢানঢানিয়াকে আমি খুব চিনি; ওকে আমি ম্যানেজ করে নেব। মিঃ নস্কর আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন, আর ওদিকে ডাইনিং রুম থেকে খবর এল যে পাত পড়েছে। বোলপুর থেকে ২৫ মাইল দূরে আড়াইশো বছর আগে বর্ধমানের এক মহারানির তৈরি রাধাবিনোদের টেরা কোটা মন্দির ঘিরে চলেছে কেন্দুলির বিরাট মেলা। মেলা বলতে যা বোঝায়। তার সবই এখানে আছে। দক্ষিণ দিয়ে বয়ে চলেছে অজয় নদী। আমরা আমাদের গাড়িতেই এসেছি। সকলে; সেটা সম্ভব হয়েছে ফেলুদা গাড়ি চালানোর ফলে। আমরা তিনজন সামনে আর পিছনে পিটার, টম ও জগন্নাথ চাটুজ্যে।। মেলার এক পাশে একটা বিরাট বটগাছের তলায় বাউলরা জমায়েত হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন আবার একতারা আর ডুগডুগি নিয়ে নেচে নেচে গান গাইছে– আমি অচল পয়সা হলাম রে ভবের বাজারে তাই ঘৃণা করে ছোঁয় না আমায় রসিক দোকানদারে… জগন্নাথবাবু এদিকে পিটারকে মন্দিরের গায়ের কারুকার্য বোঝাচ্ছে। আমিও কাছে গিয়ে অবাক হয়ে দেখলাম যে রামায়ণ-মহাভারতের অনেক দৃশ্য মন্দিরের গায়ে খোদাই করা রয়েছে। টম একটু আগেও আমাদের পাশেই ছিল, এখন জানি না কোথায় চলে গেছে। একটা সুযোগ পেয়ে ফেলুদা পিটারকে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে একটা প্রশ্ন করল, যেটা আমার মাথায়ও ঘুরছিল। তোমাদের দুজনের বন্ধুত্বে কি একটু চিড় ধরেছে? টমের কথাবার্তা হাবভাবী কাল থেকেই আমার ভাল লাগছে না। তুমি ওর উপর কতখানি বিশ্বাস রাখ? পিটার বলল, আমরা একই স্কুলে একই কলেজে পড়েছি। ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব বাইশ বছরের। কিন্তু ভারতবর্ষে আসার পর
false
shunil_gongopaddhay
জানি! আমার তো কিছুই মনে পড়ছে না! কাকাবাবু আবার চুপ করে আকাশের দিকে চেয়ে রইলেন। সন্তু আর কফি খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করতে সাহস পেল না। প্যান্ট-শার্ট ছেড়ে সন্তু একটা পাজামা আর পাঞ্জাবি পরে নিল। তারপর ঘুরে দেখতে গেল সারা বাড়িটা। অন্য দু খানা ঘরের মধ্যে একটা ঘরে তালা বন্ধ, অন্য ঘরটি খোলা। সেটার দরজা ঠেলে সন্তু দেখল, ঘরটি বেশ বড়, এক পাশে একটা খাওয়ার টেবিল আর অন্য পাশে কয়েকটা সোফা-কৌচ সাজানো। একটা বেশ বড় রেডিও রয়েছে সেখানে। সে-ঘরের দু দিকের দেওয়ালে দুটো ছবি। একটা ত্রিপুরার আগেকার কোনও মহারাজার, আর একটা রবীন্দ্রনাথের। তিনতলার একটা সিঁড়ি উঠে গেছে ওপর দিকে। সেই সিঁড়ি দিয়ে উঠে সন্তু দেখল ছাদের দরজা তালাবন্ধ। সন্তু একটু নিরাশ হয়েই নেমে এল। যে-কোনও নতুন বাড়িতে গেলেই তার ছাদটা দেখতে ইচ্ছে করে। সন্তু নেমে গেল একতলায়।। সিঁড়ির পাশের ঘরটার সামনেই টুল পেতে দুজন সাদা-পোশাকের ষণ্ডামাকা পুলিশ বসে আছে। সন্তুকে দেখেই একজন জিজ্ঞেস করল, কী, কিছু লাগবে? সন্তু বলল, না, বাগানটা একটু দেখতে এসেছি। বাগানটি বেশ যত্ন করে সাজানো। নিশ্চয়ই মালি আছে। গোলাপ আর জুই ফুলই বেশি। সন্তু কক্ষনো ফুল ছেড়ে না, ফুল গাছে থাকলেই তার দেখতে ভাল লাগে। সে মুখ নিচু করে এক-একটা ফুলের গন্ধ নিতে লাগল। বাগানের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে সন্তু অনেক কথা চিন্তা করতে লাগল। সকাল থেকে কত ঘটনাই না ঘটে গেল! একটা ব্যাপার সন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছে না। প্রথমে তাদের থাকবার কথা ছিল পুরী। তারপর হঠাৎ সেই প্ল্যান বদল করে তাকে আর কাকাবাবুকে নিয়ে যাওয়া হল গৌহাটিতে। সেখান থেকে আবার তাদের আনা হল এই আগরতলায়। এক রাত্তিরের মধ্যে এসব ঘটেছে। তবু আগরতলায় এত লোক তাদের কথা জানল কী করে? আর এখানে তাদের এত শত্রুই বা হল কেন? সন্তু এই সব ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্কভাবে হাঁটছিল, হঠাৎ একটা বিশ্রী শব্দ শুনে সে চমকে উঠল। কী রকম যেন স্প্রে করার মতন ফিস ফিল্স শব্দ।। সন্তু সামনে তাকিয়ে দেখল একটা সাপ ফণা তুলে আছে তার দিকে। সন্তু তো আর সাধারণ শহরের ছেলেদের মতন নয় যে, সাপ দেখেই ভয়ে আঁতকে উঠবে! সে কত দুর্গম পাহাড় আর কত গভীর জঙ্গলে গেছে, সাপ-টাপ দেখার অভিজ্ঞতা তার অনেক আছে। সাপটার চোখের দিকে তাকিয়ে সন্তু একেবারে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ফুল দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক হয়ে আর একটু হলেই সে সাপটাকে মাড়িয়ে দিত। তা হলেই হয়েছিল আর কী! সেবার আন্দামানে যাবার পথে কাকাবাবু সন্তুকে সাপ সম্পর্কে অনেক কিছু জানিয়ে দিয়েছিলেন। তাই সন্তু জানে, যে সাপ ফণা তুলতে পারে, সে সাপের বিষ থাকে। তা হলেও বিষাক্ত সাপ চট করে মানুষকে কামড়ায় না। মানুষ তো আর সাপের খাদ্য নয়। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে সাপ নিজে থেকেই চলে যায়। কিন্তু এই সাপটা তো যাচ্ছে না। সন্তুর দিকেই ফণাটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একটু একটু দুলছে। চিড়িক চিড়িক করে বেরিয়ে আসছে তার লম্বা জিভটা। এবার সন্তুর গায়ে ঘাম দেখা গেল। সাপটার দিকে চোখ রেখে সন্তু খুব সাবধানে আস্তে আস্তে তার পাঞ্জাবির বোতামগুলো খুলতে লাগল। তারপর বিদ্যুৎগতিতে পাঞ্জাবিটা খুলে ফেলেই ছুঁড়ে মারল সাপটার গায়ে। সাপটা অমনি পাঞ্জাবিটার মধ্যে পাক খেতে-খেতে ছোবল মারতে লাগল বারবার। সন্তু এই সুযোগে সরে গেল অনেকটা দূরে। এই কায়দাটাও কাকাবাবুর কাছ থেকে শেখা। ছোটখাটো লাঠি কিংবা পাথর ছুঁড়ে সাপ মারার চেষ্টা না করে গায়ের জামা ছুঁড়ে মারলে অনেক বেশি কাজ হয়। সাপটার যত রাগ পড়েছে ওই পাঞ্জাবিটার ওপরে, ওটার মধ্যে কুণ্ডলি পাকিয়ে ছোবল মেরে যাচ্ছে। বারবার। সন্তুর ভাবভঙ্গি দেখে বারান্দায় বসে-থাকা পুলিশ দুজনের কী যেন সন্দেহ। হল। একজন উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে, খোকাবাবু? এই খোকাবাবু ডাকটা শুনলে সন্তুর গা জ্বলে যায়। আর কদিন বাদে সে কলেজে পড়তে যাবে! এখনও সে খোকাবাবু! যেন কিছুই না, একটা আরোলা বা গুবরে পোকা, এইরকম তাচ্ছিল্য দেখিয়ে সন্তু বলল, কুছ নেহি, একঠো সাপ হায়! ত্রিপুরায় সবাই বাংলায় কথা বলে, তবু সন্তু হিন্দিতে কেন জবাব দিল কে জানে! বোধহয় পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে গেলে আপনিই হিন্দি এসে যায়! সাপ! একজন পুলিশ খানিকটা অবিশ্বাসের সঙ্গে বাগানের মধ্যে নেমে এসে বলল, কোথায়? সন্তু আঙুল দিয়ে পাঞ্জাবিটা দেখিয়ে দিয়ে বলল, ওই যে! এবারে পুলিশটি চমকে উঠে বলল, বাপ রে! সত্যিই তো সাপ! লাঠি, লাঠি কোথায়। এই শিবু, লাঠি আনো! তখন অনেকে দৌড়ে এল। সাপেরা এমনিতে কানে কিছুই শুনতে পায় না। কিন্তু লোকজন চলার সময় মাটিতে আর হাওয়ায় যে তরঙ্গ হয়, সেটা ঠিক শরীর দিয়ে টের পায়। এক সঙ্গে অনেক লোকের পায়ের ধুপধাপে সাপটা বুঝে গেল যে বিপদ আসছে। এবারে সে পাঞ্জাবিটা ছেড়ে সরসর করে ঢুকে পড়ল পাশের একটা ঝোপে। পুলিশ দুজন আর রান্নার লোকটি সেই ঝোপটায় লাঠিপেটা করতে লাগল। সেই লাঠির চোটে আহত হল কয়েকটা ফুলগাছ, সাপের গায়ে লাগল না। সন্তু দেখতে পেয়েছে সাপটা একটা গর্তে ঢুকে পড়েছে। সাপেরা কিন্তু বেশ বোকা হয়। গর্তের মধ্যে প্রথমে ঢুকিয়ে দেয় মুখটা, লেজের দিকটা অনেকক্ষণ বাইরে থাকে। যে-কেউ তো লেজটা ধরে টেনে তুলতে পারে। পুলিশরা ফুলের ঝোপে তখনও লাঠি পিটিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় হৈ-হৈ। করে ছুটে এল বাগানের মালি। সাপের ব্যাপারটায় সে কোনও গুরুত্বই দিল না, ফুলগাছ নষ্ট হচ্ছে বলে সে
false
shottojit_roy
যাওয়া রেসের বই।–চল, দারোয়নের সঙ্গে একবার কথা বলে বেরিয়ে পড়ি। আবার মেঘ করল! ব্যাগটা কি ফেরত দেবেন? জিজ্ঞেস করলেন লালমোহনবাবু। অবিশ্যি। কোন হাসপাতালে আছে খোঁজ করে কাল একবার যাব। আর সে-লোক যদি মরে গিয়ে থাকে? সেই অনুমান করে তো আর তার প্রপার্টি আত্মসাৎ করা যায় না। সেটা নীতিবিরুদ্ধ। —আর সাঁইত্রিশ টাকায় ব্লু-ফক্সে তিনজনের চা-স্যান্ডউইচের বেশি কিছু হবে না, সুতরাং আপনি ডিনারের আশা ত্যাগ করতে পারেন। আমরা আবার উলটা মুখে ঘুরে কবরের সারির মাঝখানের পথ দিয়ে গেটের দিকে এগোতে লাগলাম। ফেলুদা গভীর। এরই ফাঁকে একটা চারমিনার ধরিয়ে নিয়েছে। এমনিতে ও সিগারেট অনেক কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু রহস্যের গন্ধ পেলে নিজের অজান্তেই মাঝে সাঝে সাদা কাঠি মুখে চলে যায়। অর্ধেক পথ যাবার পর সে হঠাৎ থামল কেন সেটা তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারিনি। তারপর তার চাহনি অনুসরণ করে একটা জিনিস দেখে আমার হাঁটার হার্টবিটটাও সঙ্গে সঙ্গে এক পলকের জন্য থেমে গোল। একটা গম্বুজওয়ালা সমাধি—যার ফলকে মৃতব্যক্তির নাম রয়েছে মিস মারগারেট টেম্পলটন-তার ঠিক সামনে ঘাসে পড়ে থাকা একটা পুরনো ইটের উপর একটা সিকিখাওয়া জ্বলন্ত সিগারেট থেকে সরু ফিতের মতো ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উপরে উঠছে। বৃষ্টি হবে বলেই বোধহয় বাতাসটা বন্ধ হয়েছে, না হলে ধোঁয়া দেখা যেত না। ফেলুদা এগিয়ে গিয়ে দুইঞ্চি লম্বা সিগারেটটা তুলে নিয়ে মন্তব্য করল, গোল্ড ফ্লোক। জটায়ু বলল, বাড়ি চলুন। আমি বললাম, একবার খুঁজে দেখব লোকটা এখনও আছে কি না? সে যদি থাকত, বলল ফেলুদা, তা হলে সিগারেট হাতে নিয়েই থাকত; কিংবা হাত থেকে ফেলে পা দিয়ে মাড়িয়ে নিবিয়ে দিত। আধখাওয়া অবস্থায় এভাবে ফেলে যেত না। সে লোক পালিয়েছে, এবং বেশ ব্যস্তভাবেই পালিয়েছে। দারোয়ান ঘরে ছিল না। মিনিট তিনেক অপেক্ষা করার পর সে পশ্চিম দিকের একটা ঝোপের পিছন থেকে বেরিয়ে হেলতে দুলতে এগিয়ে এসে বলল, আভি এক চুহাকো খতম। করা দিয়া। বুঝলাম, ওই ঝোপের পিছনে চুহার সৎকার সেরে তিনি ফিরছেন, ফেলুদা কাজের কথায় চলে গেল। যার উপর গাছ পড়েছিল তাকে জখম অবস্থায় প্রথম দেখল কে? দারোয়ান বলল যে সেই দেখেছিল। গাছ পড়ার সময়টা সে গোরস্থানে ছিল না, তার নিজের একটা শার্ট উড়ে গিয়েছিল পার্ক স্ট্রিটে, সেটা উদ্ধার করতে গিয়েছিল। ফিরে এসে ব্যাপারটা দেখে। দারোয়ান ভদ্রলোকের মুখ চিনত, কারণ উনি নাকি সম্প্রতি আরও কয়েকবার এসেছেন। গোরস্থানে। আর কেউ এসেছিল কালকে? মালুম নেহি বাবু। হাম যাব দৌড়কে গিয়া, উস টাইমামে তো আউর কোই নেহি থা। এইসব সমাধির পিছনে লুকিয়ে থাকতে পারে তো? এটা দারোয়ান অস্বীকার করল না। আমারও মনে হচ্ছিল যে এই গোরস্থানের চেয়ে ভাল লুকোচুরির জায়গা বোধহয় সারা কলকাতায় আর একটিও নেই। নরেন বিশ্বাসের অবস্থা দেখে দারোয়ান রাস্তায় বেরিয়ে এসে এক পথচারী সাহেবকে খবরটা দেয়। বর্ণনা থেকে মনে হল সেন্ট জেভিয়ার্সের ফাদার-ট্রাদার হতে পারে। তিনিই নাকি ট্যাক্সি ডাকিয়ে নরেন বিশ্বাসকে হাসপাতালে পাঠানোর বন্দোবস্ত করেন। আজ একটু আগে কাউকে আসতে দেখেছিলে? আভি? হ্যাঁ? না, দারোয়ান কাউকে আসতে দেখেনি। সে গেটের কাছে ছিল না। সে গিয়েছিল চুহার লাশ নিয়ে ওই ঝোপড়াটার পিছনে। ওটা ফেলে দিয়েই ওর কাজ শেষ হয়নি, কারণ একটু পিপাসার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। রাত্রে তুমি এখানে থাক? হাঁ বাবু। লেকিন রাতকো তো পাহারেক কেই জরুরৎ নেহি হাতা। ডর কে মারে কোই আতাহি নেহি। পহলে লোয়ার সারকুলার রোড সাইডমে দিওয়ার টুটা থা, লেকিন আজকাল স্নাতকো কোই নেহি আতা সমনিটরিমে। তোমার নাম কী? বিরামদেও! এই নাও। সালাম বাবু। দারোয়নের হাতে দুটাকার নোটটা গুঁজে দেবার ফল অবিশ্যি আমরা পরে পেয়েছিলাম। গডউইন…? টমাস গডউইন…? সিধুজ্যাঠার কপালে ছটা খাঁজ পড়ে গেল। সিধুজ্যাঠাকে আমি বলি বিশ্বকোষ, ফেলুদা বলে শ্রুতিধর। দুটোই ঠিক। একবার যা পড়েন, একবার যা শোনেন-মনে ধরলে ভোলেন না। ফেলুদাকে মাঝে মাঝে ওঁর কাছে আসতেই হয়। যেমন আজকে। ভোরে উঠে হাঁটতে বেরোন সিধুজ্যাঠা লেকের ধারে। মাইল দু-এক হেঁটে বাড়ি ফিরে আসেন সাড়ে ছাঁটার মধ্যে। বৃষ্টি হলেও বাদ নেই, ছাতা নিয়ে বেরোবেন। বাড়ি ফিরে সেই যে তক্তপোষের উপর বসেন, এক স্নান-খাওয়া ছাড়া ওঠা নেই। সামনে একটা ডেস্ক, তার উপর বই, ম্যাগাজিন, খবরের কাগজ। লেখেন না। চিঠিও না, ধোপার হিসেবও না, কিছু না। খালি পড়েন। টেলিফোন নেই। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার দরকার হলে চাকর জনাৰ্দনকে দিয়ে বলে পাঠান; দশ মিনিটে সে খবর পৌঁছে যায়। বিয়ে করেননি; বউ-এর বদলে বই নিয়ে ঘর করেন। বলেন, আমার সংসার, আমার স্ত্রী-পুত্র-পরিবার। আমার ডাক্তার মাস্টার সিস্টার মাদার ফাদার, সবই আমার বই। পুরনো কলকাতা সম্বন্ধে ফেলুদার উৎসাহের জন্য সিধু জ্যাঠাই কতকটা দায়ী। তবে সিধুজ্যাঠা শুধু কলকাতা না। সারা বিশ্বের ইতিহাস জানেন। দুধ-ছাড়া চায়ে পর পর দুটো চুমুক দিয়ে সিধু জ্যাঠা গডউইন কথাটা আরও দুবার আওড়ালেন। তারপর বললেন, গডউইন নামটা ফস করে বললে প্রথমটা শেলির শ্বশুরের কথাই মনে হয়, কিন্তু ভারতবর্ষে এসেছে এমন একটা গডউইনও ছিল বটে; কোন বছরে মারা গেছে বললে? আঠারো শো আটান্ন। আমার জন্ম? সতেরো শো আটাশি। হু, তা হলে এই গডউইন হতে পারে বটে। আটচল্লিশেই বোধ হয়, কিংবা উনপঞ্চাশে, ক্যালকাটা রিভিউতে একটা লেখা বেরিয়েছিল। টমাসের মেয়ে। নাম শার্লি। না না-শার্লট । শার্লট গডউইন। তার বাপ সম্বন্ধে লিখেছিল। হুঁ, মনে পড়েছে।… ওরেব্বাস! সে তো এক তাজ্জব কাহিনী হে ফেলু!—অবিশ্যি শেষ জীবনের কথা লেখেনি শার্লট। আর
false
shordindu
করিয়া বলিল—এইখানে অঙ্গার চুল্লী রচনা কর। জম্বুকের আদেশে ভৃত্য আসিয়া অঙ্গার চুল্লী রচনায় প্রবৃত্ত হইল। এই অবকাশে ইতস্তত পদচারণা করিতে করিতে চিত্ৰক লক্ষ্য করিল, কক্ষশ্রেণী যেখানে শেষ হইয়াছে সেখানে একটি বংশনির্মিত নিঃশ্রেণি বক্রভাবে ছাদসংলগ্ন হইয়া রহিয়াছে। তাহার মন আবার সন্দিগ্ধ হইয়া উঠিল। ছাদে উঠিবার সিঁড়ি কেন? উপরে যদি কেহ লুকাইয়া থাকে? চিত্ৰক জম্বুককে সিঁড়ি দেখাইয়া বলিল—ছাদে কী আছে? জম্বুক বলিল—শুষ্ক জ্বালানি কাষ্ঠ আছে। আর কিছু নাই। চিত্রকের সন্দেহ ঘুচিল না; সে স্বচক্ষে দেখিবার জন্য নিঃশ্রেণি বাহিয়া ছাদে উঠিয়া গেল। জম্বুককে বলিল—তুমিও এস। ছাদের উপর সত্যই জ্বালানি কাষ্ঠ ভিন্ন আর কিছু নাই। চিত্রক নক্ষত্রালোকে ত্রিভুজ ছাদের সর্বত্র পরিভ্রমণ করিয়া নিশ্চিন্ত হইল। ছাদের উপর মন্দ মন্দ শীতল বায়ু বহিতে আরম্ভ করিয়াছিল; চারিদিক শব্দহীন, অন্ধকার; কেবল গিরিনদীর বুকে নক্ষত্র খচিত আকাশের প্রতিবিম্ব পড়িয়াছে। চিত্ৰক নামিবার উপক্রম করিতেছে এমন সময় বাহিরের অন্ধকার হইতে এক উৎকট অট্ট-কোলাহল উত্থিত হইয়া চিত্রককে চমকিত করিয়া দিল। একদল শৃগাল নিকটেই কোথাও বসিয়া যাম ঘোষণা করিতেছে। তাহাদের সম্মিলিত ক্রোশন ক্রমে শান্ত হইলে চিত্ৰক হাসিয়া উঠিল, বলিল—এখানে জম্বুকের অভাব নাই দেখিতেছি। জম্বুক হাসিল, বলিল—পৃথিবীতে জম্বুকের অভাব কোথায়? তবে জয়কন্তু বড় অধিক নাই মহাশয়। চিত্ৰক বলিল—সেকথা সত্য। তুমি উত্তম পান্থপাল। এই সময় পশ্চিম দিগন্তের পানে দৃষ্টি পড়িতে চিত্ৰক দেখিল, বহুদূরে চক্রবালরেখার নিকট যেন পাহাড়ে আগুন লাগিয়াছে; আগুন দেখা যাইতেছে না, কেবল তাহার উৎসারিত প্রভা দিগন্তকে রঞ্জিত করিয়াছে। অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া চিত্ৰক জিজ্ঞাসা করিল—উহা কি? পাহাড়ের জঙ্গলে কি আগুন লাগিয়াছে? জম্বুক বলিল—বোধহয় না। কয়েকদিন ধরিয়া দেখিতেছি, একই স্থানে আছে। পাহাড়ের আগুন হইলে দক্ষিণে বামে ব্যাপ্ত হইত। তবে কী? ওদিকে কি কোনও নগর আছে? কিন্তু নগর থাকিলেও রাত্রে এত আলো জ্বলিবে কেন? ইহা তো দীপোৎসবের সময় নয়! ওদিকে নগর নাই। তবে– তবে? জম্বুক বলিল—পান্থশালায় অনেক লোক আসে যায়, অনেক কথা শুনিতে পাই। শুনিয়াছি, হূণ আবার আসিতেছে। যদি কথা সত্য হয়, আবার দেশ লণ্ডভণ্ড হইবে। বলিয়া জম্বুক নিশ্বাস ফেলিল। চিত্ৰক বলিল—তোমার কি মনে হয় হুণেরা ঐখানে ছত্রাবাস ফেলিয়াছে? জম্বুক বলিল—না, তাহা মনে হয় না। হুণেরা এত কাছে আসিলে লুটপাট করিত, অত্যাচার করিত। কিন্তু এদিকে হূণ দেখি নাই। তবে কী হইতে পারে? জনশ্রুতি শুনিয়াছি, সম্রাট স্কন্দগুপ্ত সসৈন্যে হূণের গতিরোধ করিতে আসিয়াছেন। চিত্ৰক বিস্মিত হইয়া বলিল—স্কন্দগুপ্ত স্বয়ং! জম্বুক বলিল—এইরূপ শুনিয়াছি। সত্য মিথ্যা বলিতে পারি না। কেন, আপনি কিছু জানেন না? চিত্রক চকিতে আত্মসংবরণ করিয়া বলিল—না, আমি কিছু জানি না। যুদ্ধ সম্ভাবনার পূর্বেই আমি পাটলিপুত্র ছাড়িয়াছি। চিত্রক ও জম্বুক নীচে নামিয়া আসিল। ভৃত্য ইতিমধ্যে অঙ্গার প্রস্তুত করিয়া শূল্য মাংসের উপকরণাদি আনিয়া রাখিয়াছে। চিত্রক তাহা দেখিয়া প্রথমে গিয়া রট্টার রুদ্ধ দ্বারের সম্মুখে দাঁড়াইল। কান পাতিয়া শুনিল, কিন্তু কিছু শুনিতে পাইল না। তখন সে দ্বার ঈষৎ ঠেলিয়া ভিতরে দৃষ্টিপাত করিল। দীপের স্নিগ্ধ আলোকে রট্টা শয্যায় শুইয়া আছেন, একটি বাহু চক্ষের উপর ন্যস্ত। বোধহয় নিদ্রাবেশ হইয়াছে। এই নিভৃত দৃশ্য দেখিয়া চিত্রকের মন এক অপূর্ব সম্মোহে পূর্ণ হইয়া উঠিল; মৃগমদ-সৌরভের ন্যায় মাদক-মধুর রসোচ্ছ্বাসে হৃৎকুম্ভ কণ্ঠ পর্যন্ত ভরিয়া উঠিল। সে ধীরে ধীরে। দ্বার বন্ধ করিয়া দিল। মনে মনে বলিল—ঘুমাও, রাজকুমারী, ঘুমাও। চাঁদ উঠিয়াছে। কৃষ্ণা চতুর্থীর চন্দ্র পূর্বাচলের মাথায় উঠিয়া ক্লান্ত হাসি হাসিতেছে। পান্থশালার অঙ্গন শূন্য, পারসিকেরা নিজ প্রকোষ্ঠে দ্বার বন্ধ করিয়াছে। অঙ্গন স্তিমিত জ্যোৎস্নায় পাণ্ডুর। চিত্ৰক রট্টার দ্বারে করাঘাত করিয়া ডাকিল—দেবি, উঠুন উঠুন, আহার প্রস্তুত। দ্বার খুলিয়া রট্টা হাসিমুখে সম্মুখে দাঁড়াইলেন, ঈষৎ জড়িত কণ্ঠে বলিলেন—ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম। সম্মুখেই অলিন্দে আহারের আসন হইয়াছিল, দুইটি আসন মুখোমুখি; মধ্যে বহু কটোর এবং স্থালীতে খাদ্য সম্ভার। পাশে দুইটি দীপ জ্বলিতেছে। উভয়ে আহারে বসিলেন; জম্বুক দাঁড়াইয়া তত্ত্বাবধান করিতে লাগিল। আহারের সঙ্গে সঙ্গে দুই চারিটি কথা হইতেছে। জম্বুক মাঝে মাঝে চিত্তবিনোদনের জন্য কৌতুকজনক উপাখ্যান বলিতেছে। রাজকন্যা হাসিতেছেন; তাঁহার মুখে তৃপ্তি, চোখে নিরুদ্বেগ প্রশান্তি। চিত্ৰক নিজ হৃদয়-মধ্যে একটি আন্দোলন অনুভব করিতেছে, যেন সাগরতরঙ্গে তাহার হৃদয় দুলিতেছে ফুলিতেছে, উঠিতেছে নামিতেছে— রট্টা বলিলেন—কাল পিতার দর্শন পাইব ভাবিয়া বড় আনন্দ হইতেছে। চিত্রকের মনের উপর ছায়া পড়িল। রট্টার পিতা…তাহার সহিত চিত্রকের একটা বোঝাপড়া আছে…কিন্তু সে চিন্তা এখন নয়… চিত্ৰক বলিল—একটা জনরব শুনিলাম। —পরমভট্টারক স্কন্দগুপ্ত নাকি চতুরঙ্গ সেনা লইয়া এদেশে আসিয়াছেন। রট্টা চকিত চক্ষু তুলিলেন—স্কন্দগুপ্ত! চিত্ৰক নির্লিপ্তস্বরে বলিল—হাঁ। হূণ আবার আসিতেছে, তাই মহারাজ তাহাদের গতিরোধ করিবার জন্য স্বয়ং আসিয়াছেন। রট্টা কিয়ৎকাল নতমুখে রহিলেন, তারপর মুখ তুলিয়া বলিলেন—আপনি সম্ভবত প্রভুর সহিত মিলিত হইতে চাহেন? চিত্ৰক বলিল—সে পরের কথা। আগে আপনাকে চষ্টন দুর্গে পৌঁছাইয়া দিয়া তবে অন্য কাজ। রট্টা তাহার মুখের উপর ছায়া-নিবিড় চক্ষু দুটি স্থাপন করিয়া স্নিগ্ধ হাসিলেন। আহার সমাপ্ত হইলে রট্টা জম্বুককে বলিলেন-তোমার সেবায় আমরা তৃপ্ত হইয়াছি। অন্ন ব্যঞ্জন অতি মুখরোচক হইয়াছে। দেখ, আর্য চিত্ৰক কিছুই ফেলিয়া রাখেন নাই। জম্বুক করতল যুক্ত করিয়া সবিনয়ে হাস্য করিল। চিত্ৰক মৃদু হাসিয়া রট্টাকে জিজ্ঞাসা করিল—কোন্ ব্যঞ্জন সর্বাপেক্ষা মুখরোচক লাগিল? রট্টা বলিলেন—শূল্য মাংস। এরূপ সুস্বাদু রন্ধন রাজ-পাচকও পারে না। চিত্ৰক মিটিমিটি হাসিতে লাগিল; রট্টা তাহা দেখিয়া সন্দিগ্ধ হইলেন, বলিলেন—শূল্য মাংস কে রাঁধিয়াছে? জম্বুক তর্জনী দেখাইয়া বলিল—ইনি! অবাক হইয়া কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া রট্টা হাসিয়া উঠিলেন—আপনার তো অনেক বিদ্যা! এ বিদ্যা কোথায় শিখিলেন? চিত্ৰক বলিল—আমার সকল বিদ্যা যেখানে শিখিয়াছি সেইখানে। সে কোথায়? যুদ্ধক্ষেত্রে। চিত্রকের মন কল্পনায় স্কন্দগুপ্তের স্কন্ধাবারের দিকে উড়িয়া গেল। ঐ
false
toslima_nasrin
ইসলাম ও রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা প্রতিরোধ মোর্চার মিছিল। ঈমান বাঁচাও দেশ বাঁচাও আন্দোলনের মিছিলের ব্যানারে লেখা তসলিমা নাসরিন সহ সকল ধর্মদ্রোহী ও নাস্তিক মুরতাদের ফাঁসি ও বিদেশি মদদপুষ্ট ইসলাম বিরোধী এনজিওদের অপতৎপরতা বন্ধের দাবি। জামাতে ইসলামির মিছিলের ব্যানারে লেখা, আল্লাহ, রাসুলুল(সাঃ) ও ইসলাম অবমাননাকারী ধর্মদ্রোহীদের শাস্তি চাই, সংসদে ধর্মদ্রোহীদের শাস্তিমূললক আইন পাশ কর। এনজিওদের অপতৎপরতা ও নাস্তিক মুরতাদ প্রতিরোধ আন্দোলনের মিছিলের ব্যানারে লেখা, তসলিমা নাসরিন সহ সকল নাস্তিক মুরুরতাদদের ফাঁসি চাই। ধর্মদ্রোহীতা বিরোধী আইন প্রণয়ন কর। এনজিওদের অপতৎপরতা বন্ধ কর। ঢাকার রাজপথ কেবল টুপিতে সাদা হয়নি, ঢাকায় যা ঘটছে, ঢাকার বাইরেও তা ঘটছে, টুপিতে সাদা। রাস্তায় যানবাহন চলছে না, মিছিল চলছে। আমার জীবদ্দশায় আমি মৌলবাদীদের এত বড় আন্দোলন দেখিনি। আমার জীবদ্দশায় মৌলবাদীদের এত সংগঠিত আর শক্তিশালী হতে দেখিনি। তসলিমা ও মুরতাদ নাস্তিকদের শাস্তি দাবি অব্যাহত। এখনও আমাকে সরকার গ্রেফতার করতে পারেনি বলে সরকারের নিন্দা করছে বিভিন্ন গোষ্ঠী। চট্টগ্রামের জনসভায় বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মোহাম্মদ জাফরুল্লাহ খান বলেছেন, কুলাঙ্গার তসলিমা কিতাবুল্লাহর সংশোধনী দাবির ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। অতএব ঈমান নিয়ে বাঁচতে হলে এদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও তার আনুগত্য কোরানের প্রতি নেই, বাংলাদেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও তার আনুগত্য এ দেশের প্রতি নেই। আছে ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতের প্রতি। সুতরাং ধর্মদ্রোহীতার পাশাপাশি রাষ্ট্রদ্রোহীতার অপরাধে তাকে অবশ্যই ফাঁসি দিতে হবে। তসলিমাকে নিয়ে সরকার ভানুমতির খেল শুরু করেছে। এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে, এখনও পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি। অথচ দেশের ভেতরে থেকেই সে স্পীকারের কাছে চিঠি লিখে যাচ্ছে। নতুন নতুন সংগঠন যোগ দিচ্ছে আমার ফাঁসির দাবিতে। নারী অধিকার আন্দোলনের সভানেষনী অধ্যাপিকা চেমন আরা ও সেক্রেটরি হাবিবা চৌধুরী বিবৃতি দিয়েছেন, তসলিমা নাসরিন একজন নারী হয়েও নারী সমাজের অমর্যাদা করে চলেছেন, সুতরাং তাঁকে গ্রেফতার করা হোক, তাকে ফাঁসি দেওয়া হোক। সাংস্কৃতিক চেতনা বিকাশ কেন্দ্রও আমার গ্রেফতার এবং বিচার দাবি করেছে। আরেকটি সংগঠন গড়ে উঠেছে, নাম ইয়ং হিন্দু সোসাইটি। এরাও আমার শাস্তি দাবি করেছে। ইয়ং হিন্দু সোসাইটির নেতা স্বপন কুমার বিশ্বাস, শ্রী কৃষ্ণ চন্দ্র দে, সুভাষ চন্দ্র দে ধর্মীয় উত্তেজেনা সৃষ্টির চেষ্টায় নিয়োজিত তসলিমা নাসরিন গংদের শাস্তির এবং ব্লাসফেমি আইনের আওতায় হিন্দু ধর্মকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান। আজ সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের একটি বিবৃতিও ছাপা হয়েছে। মৌলবাদীরা সামাজিক সংহতি এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ নষ্টে পাঁয়তারায় লিপ্ত। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের পক্ষ থেকে জোটের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রামেন্দু মজুমদার এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম কুদ্দুস গতকাল এক বিবৃতিতে বলেছেন, আমরা অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ করছি যে দেশে উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী চক্রান্তমূলকভাবে সামাজিক সংহতি ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিনষ্ট করার কাজে লিপ্ত হয়েছে এবং ধর্মানুভূতির অপব্যবহার করে এই ষড়যন্ত্র জোরদার করে চলেছে। তাদের এইসব অপতৎপরতা বন্ধের ব্যবস্থা না করে অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে সরকার বরং মৌলবাদী গোষ্ঠীর ক্রীড়নক হয়ে উঠছে। উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় নারীদের বর্ধমান অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অপব্যাখ্যাকারীদের ফতোয়া, জাতীয়ভাবে সম্মানিত প্রতিষ্ঠিত লেখক বুদ্ধিজীবীদের মুরতাদ আখ্যাদান ও উস্কানিমূলক বক্তব্য, জাতীয় সংসদে স্বাধীনতার অবমাননাকর পাল্টা পতাকা উত্তোলন, সরকারি পত্রিকার স্থলে অশালীন অননুমোদিত পত্রিকা বিতরণ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র শিবিরের নতুন করে সশস্ত্র হামলা ইত্যাদির ১৩৯ বিরুদ্ধে সরকার নিষিক্রয় ভূমিকা পালন করে চলছে। পক্ষান্তরে কথিত অভিযোগের ভিত্তিতে জাতীয় দৈনিক জনকণ্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক শ্রদ্ধাভাজন প্রবীণ সাংবাদিক তোয়াব খান ও নির্বাহী সম্পাদক বোরহান আহমেদকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেষেন আনীত অভিযোগের সুরাহার জন্য প্রেস কাউন্সিলের শরাণাপন্ন না হয়ে সরকার যেভাবে পুলিশি ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন তা গণতান্ত্রিক সমাজের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন করেছে। আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং অবিলম্বে সাংবাদিকদের মুক্তি দাবি করছি। সেই সঙ্গে লেখিকা তসলিমা নাসরিন কর্তৃক প্রদত্ত অস্বীকৃতির পরও তার সাক্ষাৎকারের বিকৃত ভাষ্য নিয়ে ফায়দা হাসিলের খেলা বন্ধ এবং লেখিকার সুস্পষ্ট বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে আনীত মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি। আমার প্রসঙ্গ লেজের দিকে বলা হলেও বলা হয়েছে। কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ হই। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট বড় ব্যাপার। ছোট দল তসলিমা পক্ষ একটি পোস্টার ছেপে ঢাকা শহরের বিভিন্ন দেয়ালে সেঁটেছে। আমি পবিত্রত্রত্রত্র কোরান সংশোধনের কথা কখনও কোথাও বলিনি –তসলিমা নাসরিন ০ তসলিমা নাসরিনএর উপর দায়েরকৃত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার কর ০ স্বাধীন সংবাদপত্র এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা চাই ০ ফতোয়াবাজদের রুখে দাঁড়াও একটি লিফলেটও বের করেছে মুক্তবুদ্ধি চর্চা কেন্দ্র থেকে। জানি না এই কেন্দ্রটিতে সাজু জাহেদাদের দল আছে কি না। আমার নামটি উচ্চারণ করতে ওদের কোনও আড়ষ্টতা নেই। তসলিমা নাসরিনের হুলিয়া প্রত্রত্যাহার কর ফতোয়াবাজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও প্রিয় দেশবাসী, তসলিমা নাসরিনের কথিত কোরান সম্পর্কে উক্তির কারণে তার উপর সরকার মামলা দায়ের ও হুলিয়া জারি করেছেন। যে কথিত উক্তির জন্য তার বিরুদ্ধে মামলা, সে উক্তি সম্পর্কে তসলিমা নাসরিন নিজেই বলেছেন, তিনি তা বলেননি। কলকাতার স্টেটসম্যান পত্রিকা ভুল ছেপেছে। স্টেটসম্যান পত্রিকায় পাঠানো প্রতিবাদ লিপিতে তসলিমা নাসরিন বলেছেন, কোরান পরিবর্তনের কথা তিনি বলেননি। তিনি বলেছেন শরিয়া আইন পরিবর্তনের কথা। স্টেটসম্যান পত্রিকায় প্রকাশিত তসলিমা নাসরিনের কথিত এই উক্তি সম্পর্কে প্রথমে খবরটি প্রকাশিত হয় দৈনিক বাংলাবাজারে। তারপর খবরটি লুফে নেয় দৈনিক ইনকিলাব। এরপর প্রায় প্রতিদিনই ইনকিলাব পত্রিকায় তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে খবর ছাপা হচ্ছে। এই গ্রুপের সাপ্তাহিক পূর্ণিমা গত দুবছর ধরে তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে একের পর এক করেছে কভার স্টোরি। অর্ধেক পৃষ্ঠার লেখায়
false
humayun_ahmed
তোমার চাচার বাড়ি থেকে কাউকে স্থায়ীভাবে এনে তোমাদের ফ্ল্যাটে রাখতে পার কি-না দেখ। তুমি কলেজে চলে যাবে, কাজের মেয়েদের হাতে এত ছোট বাচ্চা রেখে যাওয়া ঠিক না। আমি বললাম, সেই ব্যবস্থা করব। মহা আনন্দে আমি গোছগাছ শুরু করলাম। নতুন সংসার শুরু করতে যাচ্ছি সেই আনন্দেও আমি আত্মহারা। মা’র কঠিন বলয় থেকে হারুনের মুক্তিও অনেক বড় ব্যাপার। এপ্রিল মাসের দু’তারিখ বাড়ি ছাড়ব, এক তারিখে দুর্ঘটনা ঘটল। আমার বাবু মারা গেল। আমি তখন কলেজে। প্রাকটিক্যাল ক্লাস নিচ্ছি। কলেজের প্রিন্সিপাল হঠাৎ ক্লাসে ঢুকে বললেন, শায়লা আপনি এক্ষুনি বাড়ি যান। আপনার বাচ্চা অসুস্থ। আমার গাড়ি আছে, গাড়ি নিয়ে যান। বাড়িতে পৌঁছে দেখি আমার শাশুড়ি মৃত বাচ্চা কোলে নিয়ে পাথরের মূর্তির মতো বসে আছেন। তিনি ক্ষীণগলায় বললেন, বৌমা সব শেষ। আমার বাচ্চাটি কীভাবে মারা গেল, তার কী হয়েছিল, আমি কিছুই জানতে পারি নি। আমার শাশুড়ি আমাকে বলেন নি। যে কাজের মেয়েটি বাচ্চার। দেখাশোনা করত তাকেও পাওয়া যায় নি। দুর্ঘটনার দিন কাচের জগ ভাঙার মতো অতি গুরুতর অপরাধে (?) তার চাকরি চলে যায়। আমার শাশুড়ি তাকে বেতন দিয়ে বিদায় করে দেন। বাসায় একজন কেয়ারটেকার থাকত, সবুর মিয়া। সবুর মিয়াও ঘটনার সময় বাসায় ছিল না। শাশুড়ি তাকে কী এক কাজে নারায়ণগঞ্জ পাঠিয়েছিলেন। আমি শাশুড়ির কাছ থেকে ঘটনা জানতে চেয়েছি, তিনি কিছুই বলেন নি। শুধু বলেছেন, আমি কিছু বলব না, তোমরা ফ্ল্যাট বাড়িতে চলে যাও। আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবে না। আমি বাচ্চাটার সুরতহাল করাতে পারতাম, তার জন্যে পুলিশ কেইস করতে হতো। সেটা করা সম্ভব ছিল না। আমার নিজের মাথাও তখন পুরোপুরি খারাপ হয়ে গিয়েছিল। চোখ বন্ধ করলেই দেখতাম আমার ছোট্ট বাবু হামাগুড়ি দিয়ে আমার দিকে আসছে। তার সব ঠিক আছে হাসি হাসি মুখ, বড় বড় মায়াভর্তি চোখ; শুধু মুখ দিয়ে টপটপ করে। রক্তের ফোঁটা পড়ছে। দীর্ঘদিন গুলশানের এক মনোরোগ ক্লিনিকে আমাকে কাটাতে হয়েছে। সেখানেই আমি একবার ঘুমের ওষুধ খেয়ে সুইসাইডের চেষ্টা করি। তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। আমার শাশুড়ি মারা গেছেন। স্বাভাবিক মৃত্যু। ডায়রিয়া হয়ে মহাখালী কলেরা হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছেন। কিন্তু মৃত্যুর পরও তিনি আমার স্বামীকে ছাড়েন নি। এখনো হারুনের ঘাড়ে ভর করে আছেন। তিনি হারুনকে কন্ট্রোল করে যাচ্ছেন। হারুন তার জীবিত মায়ের দ্বারা যেভাবে চালিত হতো, মৃত মাও তাকে সেভাবেই চালিত করছে। আমাদের আর কোনো ছেলেমেয়ে হয় নি। কারণ আমার শাশুড়ি তাঁর অতি আদরের ছেলেকে বলেছেন যেন আমার সঙ্গে কোনো শারীরিক সম্পর্ক না হয়। আমি আপনাকে লেখা। আমার এই দীর্ঘ চিঠি এখানে শেষ করছি। আপনাকে ‘বাবা’ সম্বোধন করেছি যেন আপনি চিঠির এক কন্যার প্রতি দয়া করেন এবং চিঠি-কন্যার পুত্রের মৃত্যুরহস্য বের করেন। আমার ধারণা এই রহস্য ভেদ হওয়া মাত্র হারুনের মোহমুক্তি ঘটবে। সে তার মৃত মা’কে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলবে। আমি হারুনকে নিয়ে। সত্যিকার সংসার শুরু করতে পারব। বিনীতা চিঠিকন্যা শায়লা (লেখকের কথা) একেকজন মানুষের গল্প বলার একেক রকম। অতি সাধারণ কথা মিসির আলি যখন বলেন তখন মনে হয় দারুণ রহস্যময় কোনোকিছুর বর্ণনা দিচ্ছেন। উদাহরণ দেই— একদিন তাঁর বাসায় গেছি। তিনি জানালার পাশে বসে গল্প করছেন। গল্পের এক পর্যায়ে বললেন ‘বুঝলেন ভাই! তখন জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি এত্ত বড় একটা চাঁদ। শুনে আমার গা ছমছম করে উঠল। আমি চমকে মিসির আলির জানালা দিয়ে তাকলাম। অথচ চমকাবার কিছু নেই। পূর্ণিমার রাতে জানালা দিয়ে এত্ত বড় চাঁদ দেখা যেতেই পারে। এই তিনিই আবার অতি ভয়ঙ্কর ব্যাপার এমন সাদামাটাভাবে বলেন যেন এটা কিছুই না। এরকম রোজই ঘটছে। এক সিরিয়েল কিলার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে হাই তুলতে তুলতে বললেন ‘লোকটার অভ্যাস ছিল খেজুরের কাঁটা দিয়ে ভিকটিমের চোখ গেলে দেয়া। তাঁর বলার ভঙ্গি, বলতে বলতে হাই তোলা থেকে শ্রোতাদের ধারণা হবে খেজুরের কাঁটা দিয়ে চোখ তোলা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। এমন কিছু না। আমি অনেকদিন থেকেই মিসির আলিকে বলছিলাম, তাঁর রহস্য সমাধানের প্রক্রিয়ায় খুব কাছ থেকে আমি যুক্ত হতে চাই। আমি দেখতে চাই তিনি কাজটা কীভাবে করেন। লজিকের সিঁড়ি কীভাবে পাতেন। রহস্যের প্রতি আমার আগ্রহ না। আমার আগ্রহ রহস্যভেদ প্রক্রিয়ার প্রতি। সুযোগ সে অর্থে আসে নি। আমি নিজে অত্যন্ত ব্যস্ত থাকি, মিসির আলি ঘরকুনো মানুষ। তিনি নিজেও তাঁর মানসিক জগৎ নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের দু’জনের দেখা হয় না বললেই হয়। এই সময় আমি আমার পারিবারিক ট্র্যাজেডির নায়ক হয়ে বসলাম। সমাজের একজন দুষ্ট মানুষ হিসেবে আমার পরিচয় ঘটল এবং মিটিং করে নিজের বাড়ি থেকে বের করে। দেয়া হলো। পত্র-পত্রিকাগুলিতে ছাপার মতো খবর অনেক দিন ছিল না। তারা মনের আনন্দে আমাকে নিয়ে নানান গল্প ফাঁদতে লাগল। মিসির আলি সাহেবের যে গল্পটি এখানে লিখছি, সেখানে আমার ব্যক্তিগত গল্পের স্থান নেই বলেই নিজের গল্প বাদ থাকল। অন্য কোনোদিন সেই গল্প বলা হবে। যাই হোক, আমি বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে কিছুদিন বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করলাম। বন্ধু-বান্ধবরা তেমন আগ্রহ দেখাল না। ‘মহাবিপদ’ কে সেধে পুষতে চায়? বাধ্য হয়ে উত্তরায় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করলাম। তিনতলায় একা থাকি। দিনেরবেলা অফিসের একজন পিয়ন থাকে। হোটেল থেকে খাবার এনে দিয়ে সন্ধ্যায় নিজের বাসায় চলে যায়। আমি তাকে চক্ষুলজ্জায় বলতে পারি না যে তুমি। থাকো। এত বড় ফ্ল্যাটে একা থাকতে ভয় পাই। ভয় পাওয়ার কারণ
false
humayun_ahmed
হাঁটে। ব্যাপারটা কী? কে ওখানে, কে? যে অনুসরণ করছিল সে থেমে গেল। ফয়জুর রহমান সাহেব পুলিশি গলায় ডাকলেন, কাছে আসো। ভীত পায়ে মাথা নিচু করে কেউ একজন আসছে; কাছাকাছি এসে দাড়াবার পর তাকে চেনা গেল। পাংখাপুলার রশিদ। ফয়জুর রহমান সাহেব হাঁটতে শুরু করলেন। রশিদ পেছনে পেছনে মাথা নিচু করে আসছে। রশিদের এই এক অভ্যাস–তিনি যেখানে যান রশিদ তাকে অনুসরণ করে, যত রােতই হোক। এর কোনো ব্যতিক্রম হয় না। অদ্ভুত স্বপ্নটার কথা ফয়জুর রহমান সাহেবের হঠাৎ মনে পড়ল। স্বপ্নে তিনি বরযাত্রী যাচ্ছিলেন। সেখানেও তাঁর পেছনে ছিল রশিদ। বাস্তবের অনুসরণকাবী স্বপ্নেও ছিল। রশিদ! জি স্যার। বিয়ে করেছ? জি-না স্যার। পরিপূর্ণ জোছনায় দুজন হাঁটছে। ফয়জুর রহমান সাহেবের হঠাৎ মনে হলো— স্বপ্নদৃশ্যেও আকাশে জোছনা ছিল; বরযাত্রী চাঁদের আলো গায়ে মাখতে মাখতে এগুচ্ছিল। জেনারেল টিক্কা খান আজ চোস্ত পায়জামার সঙ্গে মিলিয়ে হালকা ঘি কালারের পাঞ্জাবি পরেছেন। পায়ে পরেছেন কাবুলি চপ্পল। পাঞ্জাবির উপর নকশাদার কাশ্মিরী কটি পরেছিলেন। কাটির লাল, হলুদ এবং কড়া সবুজ রঙ বেশি কটকট করছিল বলে কটি খুলে ফেলেছেন। কানের লতিতে সামান্য আতর দিয়েছেন। আতরের নাম মেশক-এ আম্বর। তাঁর ফুপাতো ভাই এই আন্তর সৌদি-আরব থেকে পাঠান। আতরের কড়া গন্ধ তাঁর ভালো লাগে না। তবে আজ খারাপ গছে না। মেজাজে সামান্য ফুরফুরে ভাব চলে এসেছে। আগামী দুঘণ্টা তাকে এই ফুরফুরে ভাব ধরে রাখতে হবে। আজ তার জন্মদিন। জনদিন উপলক্ষে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে দুটি কেক আনা হয়েছে। দুটি কেকের উপর উর্দুতে লেখা জিন্দা পাকিস্তান। অর্ডার দিয়ে বানানো এই দুটা কেক আজ রাতে দুই দফায় কাটা হবে। প্রথম দফায় কাটবেন ঢাকা শহরের কিছু বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে। এদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আছেন, কবি-সাহিত্যিক আছেন, শিল্পী আছেন, ফিল্ম লাইনের কিছু লোকজন আছেন। তাদের সময় দেয়া হয়েছে সন্ধ্যা সাতটা। গাড়ি যাবে, তাদের নিয়ে আসবে। অনুষ্ঠান শেষে গাড়ি তাদের পৌঁছে দেবে। অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা যখন করা হয়, তখন তার এডিসি ইসমত খান বলেছিল, কেউ আসবে না। টিক্কা খান বলেছেন, যাদের দাওয়াত করা হবে, তারা সবাই আসবে। কেউ বাদ যাবে না। ইসমত খান তারপরেও বলল, স্যার, মনে হয় না কেউ আসবে। টিক্কা খান বললেন, বাজি ধরতে চাও? এসে তোমার সঙ্গে ছোট একটা বাজি হয়ে যাক। এডিসি বলল, বাজি রাখলে আপনি হেরে যাবেন। কারণ আমার বাজির ভাগ্য খুব ভালো। আমি সবসময় বাজিতে জিতি। চলো দেখা যাক। . কেন তুমি উইন করবে না শুনতে চাও? . ইন্টেলেকচুয়ালস আর কাউয়ার্ডস। শেকসপিয়ার বলে গিয়েছেন, . 53 Ř মৃত। মৃতদের ইচ্ছাঅনিচ্ছা বলে কিছু নেই। বুঝেছ? চেষ্টা করছি। জীবন বঁচিয়ে রাখার জন্যে তারা মাটি চাটবে। দুএকটা ব্যতিক্রম থাকতে পারে। যে-কোনো নিয়মেই কিছু ব্যতিক্রম থাকে। ভালো কথা, আমি গায়ে যে আতর দিয়েছি, তার গন্ধ তোমার কাছে কেমন লাগছে? কড়া। ওয়াটার কালারের মতো হালকা টান না। তেলরঙের কঠিন ব্ৰাসের টান। ঠিক বলেছি? ইয়েস স্যার। যুদ্ধাবস্থায় ওয়াটার কালার থাকে না। তখন সবই তেলরঙ। সেই অর্থে আন্তরটা মানিয়ে যাচ্ছে। ইয়েস স্যার। অতিথিরা সময়মতো এসে পড়লেন। তারা ভীত। তাদের দাড়াবার ভঙ্গি, বসার ভঙ্গি–সব কিছুর মধ্যেই জবুথবু ভাব। তাদের নিঃশ্বাস ফেলার ভঙ্গিও বলে দিচ্ছে তারা ঠিকমতো নিঃশ্বাস ফেলতে ভয় পাচ্ছেন। সবাই মেরুদণ্ড সোজা করে বসেছেন। ভীত মানুষ মেরুদণ্ড সোজা করে বসে। তখন তাদের স্নায়ু টানটান হয়ে থাকে। জেনারেল টিক্কা বললেন, আপনারা আমার নিমন্ত্রণ রক্ষা করার জন্যে কষ্ট করে এসেছেন, এতে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। আপনাদের কাউকে কাউকে আমি চিনি, সবাইকে চিনি না। আপনারা যদি নিজের পরিচয় দেন, তাহলে আমি অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করব। না না, উঠে দাঁড়াতে হবে না। বসে বসে বলুন। . আমি ডঃ …। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক। , . আমি ডঃ …। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। , . আমি …। আমি একজন কবি। . পরিচয়পর্ব শেষ হতে সময় লাগল, কারণ জেনারেল টিক্কা সবার সামনেই কিছুক্ষণ দাঁড়াচ্ছেন। ভদ্রতার হাসি হাসছেন। কারো কারো সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন। একজনের সঙ্গে কোলাকুলিও করলেন। পরিচয়পর্ব শেষ হবার পর জেনারেল সুন্দর একটা ভাষণ দিলেন। ভাষণটা পুরোপুরি ইংরেজিতে দেয়া হলো। আমার মতো সামান্য একজন সৈনিকের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে আপনাদের মতো গুণী-জ্ঞানীরা যে এসেছেন তাতে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। আমার জন্যে আজকের দিনটি একটি বিশেষ দিন। এই দিনে পাঞ্জাবের এক অখ্যাত দুৰ্গম গ্রামে আমার জন্ম হয়। জন্মদিন পালন করার মতো হাস্যকর ছেলেমানুষি করা কোনো সৈনিকের শোভা পায় না। আমি এই ছেলেমানুষিটা করছি মূলত আপনাদের কাছে পাওয়ার একটি অজুহাত হিসেবে। আপনারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, দুষ্কৃতকারীদের সব চক্রান্ত আমরা গুড়িয়ে দিয়েছি। দুষ্কৃতকারীদের পেছনে আছে বেঈমান আওয়ামী লীগ। এক বেঈমানকে সাহায্য করবে: অন্য বেঈমান। আওয়ামী লীগকে সাহায্য করছে বেঈমান হিন্দুস্তান। আমরা এখন প্ৰস্তুত হচ্ছি বেঈমান হিন্দুস্তানকে শায়েস্তা করার জন্যে। আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যেই শায়েস্তা হয়েছে। বড় শয়তান খাঁচায় ঢুকে গেছে। আমরা আমাদের সুবিধামতো সময়ে বড় শয়তানটাকে খাঁচা থেকে বের করব। তাকে নিয়ে আমাদের ইন্টারেস্টিং পরিকল্পনা আছে। স্বাধীন বাংলা বেতার নামে হিন্দুস্তানের আকাশবাণীর একটি শাখা এতদিন প্রচার করছিল–শেখ মুজিব বিদ্রোহীদের সঙ্গে থেকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। আশা করি, আমার ভাষণের পর এই বিষয়ে আপনাদের মনে আর কোনো প্রশ্ন থাকবে না। আগামীকালের সংবাদপত্রে করাচি এয়ারপোর্টে বসে থাকা শেখ মুজিবের একটি ছবি
false
shirshendu
আপাতত ঢাকার পথে। সেখানে সে আত্মসমর্পণ করিবার পর কী হইবে তাহা ঠাকুর জানেন। ফাঁসি যদি নাও হয় যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর কি ঠেকানো যাইবে? লক্ষণ দেখিয়া বুঝিতেছি, তাহাকে বেশ কিছুদিন হাজতবাস করিতে হইবে। সে গেল এক কথা। তাহার উপর পুত্রের মতিগতি দেখিয়া বুঝিতেছি, সংসারধর্ম পালন করিবার বিন্দুমাত্র আগ্রহ তাহার নাই এবং অদূর ভবিষ্যতে হইবেও না। আমার আয়ুর বেষ্টনী দিয়া আমি আর তাহার জন্য বিশেষ কিছু করিতে পারিব বলিয়া মনে হয় না। তাই ধরিয়া লইয়াছি, বিশাখার বিবাহই আমার জীবনের শেষ শুভ কাজ। কাজটি নির্বিঘ্নে সমাধা হয়, ইহাই আমার ইচ্ছা। “এই কাজে বাধা পড়িলে মর্মপীড়ার কারণ হইতেই পারে। আমার প্রতি পুত্র, কন্যা ও পুত্রবধূদের বিরাগের ভাবটি তাহারা গোপন রাখে নাই, স্পষ্টভাবেই প্রকাশ করিয়াছে। মনুর প্রতি আমার গোচরে ও অগোচরে আরও কত লাঞ্ছনা বর্ষিত হইতেছে তাহা জানি না। মনুও আমাকে। খুলিয়া বলিবে না। কিন্তু সংসারের বদ্ধ জলাশয়ে সফরীর ন্যায় ক্ষণ ও ক্ষুদ্রজীবী এইসব আত্মীয়েরা যে আমার সত্তা, আমারই শোণিত ধারণ করিয়া আছে তাহা ভাবিলে নিজের প্রতিই ধিক্কার দিতে ইচ্ছা করে। আমি অপরাধ যদি-বা করিয়া থাকি তাহার দণ্ড বিশাখাকে পাইতে হইবে কেন? “অপটু শরীর লইয়াই উঠিলাম। ঘুরিয়া ঘুরিয়া বিবাহের আয়োজন দেখিতে লাগিলাম। পুবের চওড়া বারান্দায় কনককান্তি পুরোহিতের সামনে বসিয়া বৃদ্ধিশ্রাদ্ধ করিতেছে। নীচের উঠানে জেলেরা মস্ত মস্ত মাছ আনিয়া ধড়াস ধড়াস করিয়া ফেলিতেছে। বিশাল আকৃতির ঝকঝকে বঁটিতে তাহা চোখের পলকে খণ্ড বিখণ্ড হইয়া ঝুড়িতে তূপাকৃতি হইতেছে। উঠানে, বাহিরের মাঠে শামিয়ানা টাঙানোর শেষ পর্ব চলিতেছে। ফটকের উপর নহবৎখানায় সানাই বাজিয়া চলিয়াছে। বাহির হইতে দেখিলে কোনও গণ্ডগোল নাই, সবই সুশৃঙ্খলভাবে চলিতেছে। এস্টেটের পুরাতন ও বিশ্বস্ত কর্মচারীরা বুক দিয়া খাটিতেছে এবং তত্ত্বাবধান করিতেছে। গোরুর গাড়ি করিয়া কত যে জিনিস আসিতেছে তাহা হিসাব করিতে পারি না। তবু এইসব আয়োজনের আড়ালে একটা উলটা ধারাস্রোতও বহিতেছে। স্ত্রী-আচার হইতেছে না, বা প্রতিবেশিনী কতিপয় স্ত্রীলোকের উদ্যোগে ক্ষীণভাবে হইতেছে। উলুধ্বনি শোনা যায় না। গাত্র-হরিদ্রার উদ্যোগ নাই। বিশাখা সম্ভবত একা ঘরে বসিয়া অশ্রুবিসর্জন করিতেছে। মনুর মাকে ছোটাছুটি করিতে দেখিলাম, কিন্তু সে মনুর মা বলিয়াই মহা অপরাধী। তাহাকে কে আমল দিবে? “জীমূত কোথায় গিয়াছে জানি না। হয় কাজেই কোথাও গিয়াছে বা কাজের নাম করিয়া গা-ঢাকা দিয়াছে। জামাই বাবাজীবনদেরও পাত্তা নাই। “হতাশভাবে কাছারির বারান্দায় দুর্বল শরীরে বসিয়া পড়িলাম। একজন বৃদ্ধ কর্মচারী শশব্যন্তে আগাইয়া আসিয়া কহিল, কর্তাবাবু, একখানা চেয়ার বের করে দিই? “মাথা নাড়িয়া কহিলাম, চেয়ারের দরকার নাই। শোন, আমার বাড়িতে এয়োর কাজ করার লোক নেই। আমি চাই, এস্টেটের কর্মচারীরা প্রত্যেকেই নিজের স্ত্রী, মা এবং বয়স্কা আত্মীয়াদের এখনই নিয়ে আসুক। এটা আমার দায় বলে জেনো। এ দায় উদ্ধার করতেই হবে। “সে ব্যস্ত হইয়া উঠিল। কহিল, যে আজ্ঞে। “আমি আবার কহিলাম, বেশি দেরি যেন না হয়। “সে অনুগতের মতো মাথা নাড়িয়া কহিল, যে আজ্ঞে। “সে চলিয়া গেল। আমি ক্লান্তভাবে বসিয়া রইলাম। এয়োর অভাব হইবে না, কিন্তু তবু মন শান্ত হইতেছে না। পাড়া-প্রতিবেশী দিয়া কি সব কাজ হয়? “ক্লান্তির ভার লইয়াই উঠিলাম। অন্দরমহলে এক দাসীকে দিয়া আমার জ্যেষ্ঠা কন্যা সবিতার কাছে এত্তেলা পাঠাইয়া নিজের ঘরে বসিয়া অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। “থমথমে মুখ লইয়া সবিতা আসিল। চক্ষু নত রাখিয়া বলিল, ডেকেছেন? “হ্যাঁ। তোমরা সব কী করছ? এত বড় আয়োজন, একটু দেখাশোনা করার লোক নেই! আমরা তো দেখাশোনা করতেই চাই। কিন্তু মানমর্যাদা বলেও তো একটা কথা আছে। তার অর্থ কী? তোমাদের মানমর্যাদার হানি হল কীসে? আপনি অসুস্থ ছিলেন, তাই জানেন না। আমরা এসে অবধি দেখছি এ বাড়িতে একজনেরই আধিপত্য। আমরা যেন কেউ কিছুই নই। সেই একজন কি মনু? পুরুতের মেয়েকে আস্কারা দিয়ে আপনি মাথায় তুলেছেন। চিরকাল আমাদের এঁটোপাত কুড়িয়ে ওদের সংসার চলেছে। কাঙালকে শাকের খেত দেখালে যা হয়। সে কি তোমাদের কোনও অমর্যাদা করেছে? অনবরতই করছে। আপনি তাকে ঘরে স্থান দিয়েছেন শুনেছি, কিন্তু সে কোন অধিকারে ঘরে ঢোকে তা আমাদের জানা নেই। অধিকার তার একটু আছে। আমরা তা কী করে জানব? আপনি তাকে বিয়ে করেছেন বলে সে শতমুখ করে লোকের কাছে বলে বেড়াচ্ছে। কিন্তু বিয়ের কোনও সাক্ষী নেই, নিমন্ত্রণপত্র নেই, শহরের লোকেও বিয়ের খবর কেউ রাখে না। সুতরাং লোকে যা খুশি তা বলে বেড়াচ্ছে। পাঁচজনের কাছে আমরা মুখ দেখাতে পারছি না। তোমরা কি এখানে আসবার আগে খবর পাওনি? আপনি কি আমাদের জানিয়েছেন? জানাইনি ঠিকই, তবে– আপনি একজন নষ্টচরিত্রের মেয়েমানুষকে ঘরে ঠাঁই দেবেন জানলে আমরা বিশাখার বিয়েতে আসতাম না। আপনার জামাইরাও অত্যন্ত লজ্জায় পড়েছেন। “নিজেকেই কহিলাম, ধীরে রজনী ধীরে। উত্তেজিত হইয়া লাভ নাই, ক্রুদ্ধ হইলে ব্যাপার আরও বহুদুরে গড়াইবে। কিন্তু বাহিরে ক্রোধ বা উত্তেজনা প্রকাশ পাইতে না দিলেও আমার ভিতরে ঝড় বহিতেছিল। বুকে আবার চাপ ও মৃদু বেদনা অনুভব করিতেছি। সম্মুখে দাঁড়াইয়া আমারই তো কন্যা, ইহার শিরায় আমারই রক্ত প্রবহমান। এত কঠিন কথা ইহার মুখ হইতে বাহির হইল কীরূপে? “মৃদুস্বরে কহিলাম, তোমার কথার জবাব দেওয়ার সাধ্য আমার নেই। তবে মনুকে নিয়ে তোমরা আন্দোলন কোরো না। তাকে আমি অগ্নি ও শালগ্রাম সাক্ষী রেখেই বিয়ে করেছি। কিন্তু তার বিচার পরে হতে পারবে। বিশাখার বিয়ে তো আর ফিরে আসবে না। আমাদের আপনি কী করতে বলেন? ব্যাপার বাড়িতে কত কাজ! বললাম তো, কাজ করতে আমাদের কেউ ডাকেনি। আপনার মনুই যখন
false
humayun_ahmed
চোখ বড় বড় করে বললেন, এই ফাজিল মেয়েটা কে? নীলু হাসিমুখে বলল, ফাজিল বলছেন কেন? খুব হাসোহাসি শুরু হয়ে গেল চারদিকে। রুবিনার খালা রেগেমেগে অস্থির। কয়েকবার বললেন, আজিকালিকার মেয়েগুলি এমন কেন? অনেকদিন পর রুবিনার গায়ে হলুদ উপলক্ষে আমরা খুব হৈচৈ করলাম। বিয়েটিয়ে এই জাতীয় অনুষ্ঠান আমার ভাল লাগে না। গাদাগাদি ভিড়। মেয়েদের লোক দেখান আহাদীপনা। খাবার টেবিলে তাড়াহুড়ো করে বসতে গিয়ে শাড়িতে রেজালার ঝোল ফেলে দেয়া। অসহ্য! কিন্তু রুবিনার গায়ে হলুদ আমার কেন যে এত ভাল লাগল। বরের বাড়ি থেকে এলা নামের একটি মেয়ে এসেছিল, সে ঢাকায় ও লেভেলে পড়ে। ওর সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল। জন্মের বন্ধুত্ব। এর আগে আর কোনো মেয়ের সঙ্গে এত বন্ধুত্ব হয়নি। আমরা দু’জন এক ফাঁকে ছাদে চলে গেলাম। মেয়েটি নানান কথা বলতে লাগল। একটি ছেলের সঙ্গে তার ভাব হয়েছে। ছেলেটি মেডিক্যালে পড়ে। এক বিয়ে বাড়িতে আলাপ হয়েছিল। খুব নাকি লাজুক ছেলে। আর দারুণ ভদ্র। এলা নিচু স্বরে বলল, জানো ভাই, ও একবার যা অসভ্য কথা লিখেছিল আমাকে। আমি খুব রাগ করলাম। ওর সঙ্গে দেখা করাই বন্ধ করে দিলাম। টেলিফোন করলে টেলিফোন নামিয়ে রাখতাম। শেষে কি করল সে জান? কি করল? বলল সে বিষ খাবে। আমি তো জানি তাকে। খাবে বলেছে। যখন তখন খাবেই। ছেলেরা দারুণ সেন্টিমেন্টাল হয় ভাই। তখন তুমি কি করলে? কি আর করব, দেখা করলাম। আমি ইতস্তত করে বললাম, অসভ্য কথাটা কি লিখেছিল? এলা তরল গলায় হেসে উঠল, দূর তা বলা যায় নাকি? বিয়ের দিন তুমি আসবে তো? ঐ দিন তোমাকে ওর ঐ চিঠিটাই পড়াব। দেখবে ছেলেরা কি রকম অসভ্য হয়। রুবিনার বিয়ের দিন আমরা কেউ ও-বাড়িতে গেলাম না। নীলুর জন্যেই যাওয়া হল না। সে কিছুতেই যাবে না এবং আমাকেও যেতে দেবে না। তুই না গেলে না যাবি। আমি যাই। না বললাম তো যেতে পারবি না। কেন অসুবিধেটা কি? ওরা আজেবাজে কথা বলছিল, তোকে বলতে চাই না। বলতে চাস না কেন? কারণ শুনলে তোর খারাপ লাগবে। লাগুক খারাপ নীলু মৃদু স্বরে বলল, ওরা বলছিল সেতারার চেহারার সঙ্গে নাকি ঐ লোকটির খুব মিল। আর সেতারা গান-বাজনাও ঐ লোকটির মত জানে। কখন বলছিল? রুবিনার খালা বলছিল, আমি পাশের ঘরে ছিলাম। আমি চুপ করে রইলাম। নীলু বলল, তোর মন খারাপ লাগবে বলেছিলাম না। তবুও তো শোনা চাই। আমি সে রাতে ঘুমোতে পারলাম না। বাবা ফিরলেন অনেক রাতে। সিঁড়িতে ধুপধ্যাপ শব্দ হতে লাগল। রমজান ভাইয়ের গলা শোনা গেল, ছিঃ, আপনের শরম করে না? চুপ থাক। আপনে চুপ থাকেন। ধুপ করে একটা শব্দ হল। বাবার গলা। ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দেব। শুয়োরের বাচ্চা। বেশি সাহস হয়েছে। মেয়েরা বড় হইছে না? হায়া-শরাম নাই? চুপ থাক। আপনে চুপ থাকেন। পানি ঢালার শব্দ। আকবরের মা উঠে গেল। নবান করে কি যেন পড়ল। আবার পানি ঢালা হচ্ছে। কি হচ্ছে এসব? বাবা আজকাল বড্ড ঝামেলা করছেন। আবার একটা বিয়ে করলে তার জন্যে ভালই হত। নজমুল চাচা যাকে বাসায় নিয়ে এসেছিলেন সেই মহিলাটিকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছিল। ছোটখাটো মানুষ, লম্বা চুল। কথা বলেন টেনে টেনে। আমাদের সঙ্গে বেশ আগ্রহ করে কথা বললেন। নীলু যখন বলল, আচ্ছ। আপনি কি আমাদের দু’জনকে আলাদা করতে পারবেন? আমার নাম নীলু ওর নাম বিলু। কিছুক্ষণ পর যদি আমরা দু’জন এক রকম কাপড় পরে আসি তাহলে কি বলতে পারবেন। কে বিলু কে নীলু? তিনি হাসিমুখে বললেন, আরে এ মেয়ে তো দেখি খুব পাগলী! আমাদের দু’জনারই ভদ্রমহিলাকে খুব পছন্দ হল। শুধু সেতারা মুখ গোজ করে দূরে দাঁড়িয়ে রইল। তিনি ডাকলেন, এই কি যেন নাম তোমার? সে উঠে চলে গেল। আমরা তাকে বাগান দেখাবার জন্যে নিয়ে গেলাম। সেতারা কিছুতেই যাবে না। আমরা সেতারাকে ছাড়াই বাগানে বেড়াতে গেলাম। বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া তেঁতুল গাছ দুটি দেখে তিনি খুব অবাক হলেন। আশ্চর্য হয়ে বললেন, বসতবাড়ির কাছে কেউ তেঁতুল গাছ লাগায় নাকি? নীলু বলল, লাগালে কি হয়? বুদ্ধি কমে যায়। তেঁতুল খেলেও বুদ্ধি কমে। এটা কিন্তু ঠিক না। রকিব ভাই খুব তেঁতুল খান। কিন্তু তার খুব বুদ্ধি। রকিব ভাই কে? নীলু চুপ করে গেল। তিনিও আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। একবার শুধু বললেন, এত বড় বাড়িতে থাক, ভয় লাগে না? আমরা কিছু বললাম না। ভদ্রমহিলা যাবার আগে নীলুকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন এবং অত্যন্ত মৃদুস্বরে বললেন, তোমাদের মোর সঙ্গে কি তোমাদের যোগাযোগ আছে? নীলু বলল, না নেই। তোমরা চিঠি লিখেলেই পার। তোমরা কেন লিখবে না? তোমরা লিখবে। আমাদের খুব আশা ছিল ভদ্রমহিলার সঙ্গে বাবার বিয়ে হবে কিন্তু বিয়ে হয়নি। বাবা কিছুতেই রাজি হলেন না। নজমুল চাচার ওপর রেগে গিয়ে আজেবাজে কথা বলতে লাগলেন, তোমরা পেয়েছিটা কি? আমাকে না বলে এই সব কি শুরু করেছ? নজমুল চাচাও কি সব যেন বললেন। তুমুল ঝগড়া বেঁধে গেল। এক পর্যায়ে বাবা বললেন, যাও তুমি আমার বাড়ি থেকে এক্ষুণি বিদেয় হও। নজমুল চাচাও চোঁচাতে লাগলেন, আমি তোমার দয়ার ওপর আছি নাকি? নগদ ভাড়া দিয়ে থাকি। সে এক বিশ্ৰী অবস্থা। নজমুল চাচা সেই রাতেই ঠেলা গাড়ি নিয়ে এলেন। মালপত্র পাঠানো হতে লাগল। আমরা বসে বসে দেখলাম। ঠেলা গাড়ি
false
shomresh
ওরা কী উদ্দেশ্যে আসা-যাওয়া করছে। জানতেন না? ডাক্তার বললেন, দেখুন মশাই, আমি চাইব পেশেন্টের প্রাণ বাঁচুক। ওরা হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইল, তখন দ্বিতীয় কোনও উপায় নেই এই গ্রাম থেকে বৃদ্ধ মানুষটাকে নিয়ে যাওয়ার, মনে হয়েছিল ভগবানই ওদের পাঠিয়েছেন। তা ছাড়া আমি তারিণীবাবুর গার্জেন নই যে, ঠিক করব কার সঙ্গে যাবে বা না যাবে। মৃত্যুপথযাত্রীর কোনও পছন্দ থাকে না। ওঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়নি। সে কী! অন্তত ময়নাগুড়ি বা জলপাইগুড়ির হাসপাতালে ওরা যায়নি। দ্রুত চিকিৎসার জন্যে এ-দুটো জায়গায় নিয়ে যাওয়া স্বাভাবিক ছিল। সঙ্গে কে গেছেন? ওঁর দ্বিতীয় স্ত্রী। প্রথমজন কোথায়? বোধ হয় বাড়িতেই আছেন। অর্জুন ওঁদের নিয়ে মন্দিরের সামনে এসে চারপাশে তাকাল। তারপর অবনীবাবুকে বলল, আপনি জিপটাকে এমনভাবে সরিয়ে রাখুন যাতে এখানে এসে কেউ দেখতে না পায়। কেন? যারা তারিণী সেনকে নিয়ে গেছে তাদের মনে হচ্ছে, আজই আবার এখানে আসতে হবে। অবনীবাবু যখন জিপটাকে আড়ালে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন অর্জুন ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, ওরা কেন ফিরে এসেছিল সে ব্যাপারে কিছু বলেছে? হ্যাঁ। শিলিগুড়িতে ফিরে যাওয়ার আগে ওরা দেখে নিতে চায় উনি কেমন আছেন? আমরা তখন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। এখন… আচ্ছা, শিলিগুড়িতে নিয়ে যায়নি তো? জানি না। ওরা তাই বলেছে? না। শুধু জিজ্ঞেস করেছিল যে দোমহনিতে যাওয়ার কোনও শর্টকাট রাস্তা আছে কি না। অর্জুন অবাক হল, দোমহনি? হ্যাঁ। তা হলে কি ভূল হল! রিচার্ড ম্যাকডোনাল্ড প্রায়ই তিস্তা পেরিয়ে দোমহনিতে আসতেন। কমলাকান্ত রায়কে ওখানেই অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছিল। ওখান থেকেই তারিণী সেন তাঁকে বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন বার্নিশে। তারিণী সেনের হাতকাটা হয়েছিল দোমহনির লালকুঠিতে। সেখানকার খোঁজ নিয়েছে যখন, তখন…। অর্জুন বুঝতে পারছিল না। লালকুঠির রং নিশ্চয়ই লাল। ওই হেঁয়ালির ছড়া কি সেই লালকুঠিকে কেন্দ্র করে? ওখানেই কি মূর্তিটা রাখা আছে? এ কি সম্ভব হবে। তারিণী সেনের মতো মানুষ, যিনি ভাল করে হাঁটতে পারেন না, তিনি কাছাকাছি না রেখে অত দূরে লুকিয়ে রাখবেন? সে ধীরে-ধীরে লাল মন্দিরটার দিকে এগিয়ে যেতে অবনীবাবু তার সঙ্গ নিলেন। এখন আকাশে হাজার তারার ফিকে আলো। পৃথিবীতে অন্ধকার থাকলেও সেই আলোয় খানিকটা দৃষ্টি যায়। ছোট মন্দিরটাকে ঘুরে দেখল অর্জুন। কালোর মধ্যে লাল আর লালের মধ্যে কালো/ ভক্তিভরে তারে নমো করাই ভালো। লালের মধ্যে কালো দেখা যাচ্ছে, লাল মন্দিরের ভেতরে কালো শিবলিঙ্গ। কিন্তু কালোর মধ্যে লাল কোথায়? অবনীবাবু টর্চ জ্বেলে চারপাশে দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী খুঁজছেন? ছড়াটা মনে আছে? কালোর মন, লাল…? হ্যাঁ। কিন্তু এখানে কালো কোথায়? কিন্তু লালের মধ্যে কালো আছে। ওই শিবলিঙ্গ। টর্চটা দিন তো। সে জুতো খুলে মন্দিরে ঢুকল। দেওয়ালে আলো ফেলতেই দেখতে পেল ঠিক মাঝখান বরাবর একটা মোটা কালো দাগ চারপাশে আঁকা রয়েছে। এরকম দৃশ্য অভিনব। ভেতরে একমাত্র শিবলিঙ্গ ছাড়া আর কিছু নেই। সে লিঙ্গের সামনে হাঁটু মুড়ে বসল। কিছু শুকনো ফুলপাতা ছড়ানো রয়েছে। সেগুলোকে সরিয়ে মূর্তির পূর্ণ অবয়ব দেখল। মন্দিরের মেঝে ভেদ করে যেন উঠে এসেছে। অন্তত দশ ইঞ্চি মোটা। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আলো ফেলতে হঠাৎ স্থির হয়ে গেল অর্জুন। কালো শিবলিঙ্গের ঠিক নীচের দিকটায় যেন জোড়ের দাগ। জায়গাটায় রঙ করে দেওয়া হয়েছিল কি। সে একটা শক্ত কাঠি তুলে ঘষতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে সেখানে জোড়ের দাগ স্পষ্ট হল। এই ব্যাপারটা হয়তো অধার্মিক হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাবা বিশ্বনাথ নিশ্চয়ই ক্ষমা করবেন। এই সময় ডাক্তারবাবুর গলা কানে এল, এটা আপনি কী করছেন? অর্জুন উঠে দাঁড়াল। দেবমূর্তিকে নষ্ট করার কোনও বাসনা তার নেই। তবু…। সে জিজ্ঞেস করল, এই শিবলিঙ্গ কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল?। আমার জন্মের আগে। অর্জুন ধীরে-ধীরে বেরিয়ে এল বাইরে, গ্রামের মানুষ মন্দিরটাকে গুরুত্ব দেয়? শিবরাত্রির দিন অবশ্যই দেয়। শিবরাত্রির দিন বটগাছের তলায় পড়ে-থাকা পাথরও তো গুরুত্ব পায়। আপনি কী বলতে চাইছেন? শিবলিঙ্গের নিচের দিকে একটা জোড় দেখতে পেলাম। তার মানে ওখানে কোনও মেরামতি হয়েছে। মন্দিরের বাইরের রঙ লাল, ভেতরে কালো দাগ, কালো দাগের মধ্যে আবার কালো শিবলিঙ্গ, এমন তো হতে পারে তারিণী সেন ছড়া মেলাতে ইচ্ছে করে শব্দ দুটো উলটে দিয়েছেন। লালের মধ্যে কালো না বলে কালোর মধ্যে লাল বলেছেন। শিবলিঙ্গের যেখানটা মেরামতি হয়েছে। সেখানে অল্প লাল রং মাখানো আছে। তা হলে অবশ্য কালোর মধ্যে লাল বলতে আপত্তি নেই। অর্জুন জোরে-জোরেই কথাগুলো উচ্চারণ করছিল। তারপর সে অবনীবাবুকে বলল, এই মন্দিরটাকে পাহারার ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা পুরাতত্ত্ব বিভাগকে জানাব। যা ব্যবস্থা করার, তারাই করবে। অবনীবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কি সন্দেহ হচ্ছে মূর্তিটা ওখানেই লুকোন আছে? আমি যদি নিঃসন্দেহ হতাম, তা হলে তো এখনই খুঁড়ে ফেলতাম। আপনি এক কাজ করুন। জিপ নিয়ে ময়নাগুড়ি চলে যান। ওখানে ফোর্স পাবেন। আজই দোমহনির লালকুঠিতে তল্লাশি চালান। মনে হয়, তারিণী সেনকে ওখানে পেয়ে যাবেন। আপনি যাবেন না? আমি এখানে পাহারায় থাকতে চাই, যতক্ষণ না সকাল হয়। ডাক্তারবাবু বললেন, আপনি আমার ওপর ভরসা করতে পারেন। এটা আমার গ্রামের মন্দির। আমি এখনই লোকজনকে ডাকছি…। না। লোকজন ডাকলে চলবে না। আমার সন্দেহ যদি সত্যি হয়, তা হলে ওরা এখানে আসবে। লোকজন দেখলে ওরা ধরা দেবে না। অবনীবাবু চলে গেলেন। ওঁর জিপের আলো অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। ডাক্তারবাবু উসখুস করছিলেন। মন্দিরের চাতালে অর্জুন বসেছিল তাঁর পাশে। চারপাশ নিঃশব্দ, পাতলা অন্ধকারে মাখামাখি। ডাক্তারবাবু হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা অৰ্জুনবাবু, এসব করে
false
zahir_rayhan
স্বপ্ন এঁকেছে মনে মনে। দুদিনের পরিচয়ে যাকে পেলে, তাকেই ভালবেসে ফেললে তুমি? ভালো বলেই ওকে আমি ভালবেসেছি। জাহানারার গলার স্বর তীব্র এবং তীক্ষ্ণ শোনালো কানে। কিন্তু ও যে ভালো এ কথা কেমন করে বুঝলে? ক’দিন ওর সঙ্গে মিশেছো তুমি? ওর কতটুকু তুমি জানো? ও একটা ঠগ হতে পারে, জোচ্চোর হতে পারে। তোমার ফুলের মতো পবিত্র জীবন নিয়ে হয়তো ছিনিমিনি খেলতে পারে সে। যদি খেলেই তাতে আপনার কিবা এলো গেলো। হয়তো কিছুই এসে যাবে না। কিন্তু জাহানারা, তুমি বাচ্চা খুকী নও, বোঝার মত বয়স হয়েছে তোমার। যে চরম সিদ্ধান্ত তুমি নিতে চলেছে, তার আগে কি একটুও ভাববে না, চিন্তা করবে না? চিন্তা আমি করিনি সেকথা কেমন করে বুঝলেন? জাহানারা হাসলো। হাসলে ওকে আরো সুন্দর দেখায়। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আর কোন কথা বলতে পারলো না কাসেদ। হঠাৎ সুর কেটে গেলো। জাহানারা বললো, একি, সাধনা না হয় আমরা করছি। কিন্তু আপনি তন্ময় হয়ে আছেন কেন? কাসেদ ইতস্তত করে বললো, একটা কবিতার বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম। ও, তাহলে আপনি কবিতার ভাবে মগ্ন ছিলেন। আমি ভাবছিলাম বুঝি সেতারের সুর শুনে। মাস্টার সবিনয়ে উঠে দাঁড়ালেন। আমি তাহলে এখন চলি? জাহানারা ঘাড় দুলিয়ে বললো, কাল আসছেন তো? হ্যাঁ, আসবো। দেখবেন, আবার ভুলে যাবেন না যেন। না, ভুলবো না। আপনি সব ভুলে যান কিনা, তাই বললাম। মাস্টারকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেলো জাহানারা। ও ফিরে এলে কাসেদ বললো, আমি চলি। যাবার জন্যে অমন উতলা হয়ে গেলেন কেন? আপনি এসেছেন বলেই তো মাস্টারকে তাড়াতাড়ি বিদায় দিলাম। জাহানারা মৃদু গলায় বললো, এখানে চুপটি করে বসুন। আমি দু’কাপ চা করে নিয়ে আসি। আমি না। আসা পর্যন্ত যাবেন না যেন। শাসনের ভঙ্গিতে ওর দিকে এক পলক তাকিয়ে ভেতরে চলে গেল জাহানারা। ওর শেষ কথাগুলো মুহুর্তে শান্ত করে দিয়ে গেলো তাকে। তাহলে এতক্ষণ যা নিয়ে এত চিন্তা করছিলো সে, তার কোনটাই সত্য নয়। কাসেদের সঙ্গে কথা বলবে বলে মাস্টারকে তাড়াতাড়ি বিদায় করে দিয়েছে জাহানারা। জাহানারা তুমি বড় ভালো মেয়ে। বড় লক্ষ্মী মেয়ে তুমি। তাইতো তোমাকে এত ভাল লাগে। ভালবাসি। দু’কাপ চা হাতে ওর সামনে এসে বসলো জাহানারা। চা আনতে গিয়ে মুখহাত ধুয়ে এসেছে সে। শাড়িটা পালটেছে। চুলে চিরুনি বুলিয়েছে কয়েক পোঁচ। কাসেদ বললো, তাহলে সেতারের মাস্টার ঠিক করেই ফেললেন আপনি? আপনার অপেক্ষায় আর কতকাল বসে থাকবো। চায়ের কাপটা টেনে নিতে গিয়ে হাত কেঁপে উঠলো। কাসেদের। বাইরে রাত। ভেতরে দু’জন নীরবে বসে। আশেপাশে কারো কোন সাড়া শব্দ নেই। সমস্ত পৃথিবী যেন চুপ করে আড়ি পেতে আছে ওরা কি বলে শুনবার জন্য। কাসেদ বললো, আপনার আঙ্গুলে একটা কালো দাগ পড়ে গেছে। জাহানারা বললো, সেতার শিখতে গেলে প্ৰথম প্রথম অমন হয় শুনেছি। কাসেদ বললো, হুঁ। আবার দু’জনে চুপ করে গেলো ওরা। বাইরে তারা জ্বলছে, ভেতরে বাতি। কাসেদ ভাবলো, জাহানারাকে মন খুলে আজ। সব কিছু বললে কেমন হয়। এখানে কেউ নেই। এইতো সময়। কাপটা মুখের কাছে এনে নামিয়ে রাখলো কাসেদ। জাহানারা নীরবে তাকিয়ে রয়েছে। ওর দিকে। সেও কিছু বলতে চায় ওকে। সে বলুক। প্রথম সেই বলুক। কাসেদ নড়েচড়ে বসলো। জাহানারা বললো, আপনি যেন আগের চেয়েও শুকিয়ে গেছেন। কাসেদ বললো, মা-ও তাই বলেন। হ্যাঁ, মা কেমন আছেন? ভালো। নাহার? সেও ভালো। আপনার শরীর কেমন? মোটামুটি যাচ্ছে। আবার নীরবতা। শূন্য চায়ের কাপ দুটাে সামনে নামিয়ে রেখেছে ওরা। ওরা এখন মুখোমুখি বসে। জাহানারা জানালার দিকে তাকিয়ে। হয়তো আকাশ দেখছে কিম্বা আঁধারের আলো। কাসেদ দেখছে জাহানারাকে। ওর চোখ, ওর মুখ, ওর চিবুক। কি সুন্দর। আমাকে কিছু বললেন, জানালা থেকে চোখ সরিয়ে এনে ওর দিকে তাকালো জাহানারা। কাসেদ অপ্ৰস্তৃত গলায় বললো কইনা নাতো। জাহানারা মৃদু হাসলো। কিছু বললো না। জাহানারা। আস্তে করে ওকে ডাকলো কাসেদ। বলুন। চাপা স্বরে জবাব দিলো জাহানারা। আমি এখন চলি। সেকি, এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন? অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালো জাহানারা। যেন এমন কিছু একটু আগেও সে ভাবতে পারে নি। যেন এ সময় চলে যাওয়াটা কোনমতে বিশ্বাস করতে পারছে না। সে। কাসেদ বললো, অনেকক্ষণ বসা হলো। আর কত? জাহানারা আরো কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর অস্পষ্ট গলায় বললো, আচ্ছা। বলতে বলতে উঠে দাড়ালো সে। এ মুহুর্তে ওকে বড় দুর্বল দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে শরীরটা যেন ক্লান্তির ভারে ভেঙ্গে পড়তে চাইছে। বাইরে বারান্দা পর্যন্ত ওকে এগিয়ে দিলো জাহানারা। আবার আসছেন তো? আসবো। বাইরে মুক্ত বাতাসে বেরিয়ে একটা জোর শ্বাস নিলো কাসেদ। দিন কয়েক পরে নিউ মার্কেটের মোড়ে শিউলির সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলো। ওর। শিউলির পরনে বাদামী রঙের একখানা শাড়ি। চুলগুলো খোঁপায় বাঁধা। হাতে একটা কাপড়ের থলে। আপনি বেশ মানুষ তো, অনুযোগ ভরা কণ্ঠে শিউলি বললো, এত করে বললাম। শুক্রবার দিন গেটের সামনে আমার জন্যে অপেক্ষা করবেন, কই আপনি এলেন না তো? সারাটা বিকেল শুধু ঘর-বার করেছি। শিশুসুলভ হাসিতে সারা মুখ ভরে এলো তার। কাসেদ আস্তে করে বললো, ভুলে গিয়েছিলাম। ভুলে তো যাবেনই। আমি আপনার কে যে আমার সঙ্গে দেখা করার কথা আপনার মনে থাকবে। গলাটা যেন ঈষৎ কেঁপে উঠল তার। শিউলির সঙ্গে পরিচয়ের পর এই প্রথম চমকে উঠলো কাসেদ। ওর চোখের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকালো সে। কি বলতে চায় শিউলি।
false
shomresh
জায়গায় লাঠির ডগলায় কাকাতাড় য়ারা ছেঁড়া জামা পরে হাওয়ায় দুলছে। তেমনি একজন শুধু মাথায়, চোখমুখ আঁকা কালো হড়িটাই যা নেই, বালির ওপর উবু হয়ে বসে এক হাতের আড়ালে চোখের রোদ্দুরে ঢেকে ওদের দেখছে। মণ্টুর কথা শুনে একগাল হাসল বুড়ো, অ খোকাবাবু, তা-ই কও! এত চোরের আওন-যাওন বাড়ছে আজকাল যে চিনতে পারি না। কালকের ফলটা মিষ্টি ছিল? হ্যাঁ, খুব মিষ্টি ছিল। মণ্টু বলল। যাও কই? এক আনি পয়সা আছে, একটা তরমুজ দেবে। বুড়ো হাসল, বোঝলাম। তা হলে যাওয়ার সময় নিয়ে যাব, কেমন কথাটা বলে ও চাপা গলায় অনিদের বুঝিয়ে দিল, যাওয়ার সময় প্রত্যেক একটা করে নিয়ে যাব, বুঝলি! তপন বলল, পয়সা? মণ্টু খিঁচিয়ে উঠল, আমাকে পয়সা দেখাচ্ছিস? আমি তোমাদের মতো বাচ্চা নাকি? জঙ্গলের ভিতর ঢুকে পড়লে আর হাকিমপড়া দেখা যায় না। শুধু দূরে জেলা স্কুলের মতো লাল ছাদটা চোখে পড়ে। জঙ্গল সরিয়ে সামান্য এগিয়ে একগ খোলা জায়গায় এসে দাঁড়াল ওরা। চারধারে জঙ্গল, মাঝখানে টাকের মতো পরিস্কার বালি। হঠাৎ মণ্টু বলল, এই অনি, আজকে আমাকে কেমন দেখাচ্ছে বল তো! অনি মণ্টুকে ভালো করে দেখল। ওর মাথার চুল বেশ কোকড়া, গায়ের রঙ খুব ফরসা। কিন্তু ওকে তো অন্যরকম কিছু দেখাচ্ছে না। রোজকার মতো ইউনিফর্ম পরাই আছে। ওর মুখ দেখে মণ্টু সেই বিজ্ঞের হাসিটা হাসল। এই হাসিটা দেখলে অনির নিজেকে খুব ছোট বলে মনে হয়। মণ্টু ওদের বন্ধু, এক ক্লাসে পড়ে, কিন্তু ও অনির চেয়ে অনেক বেশিকিছু জানে। মণ্টু হাসিটা শেষ করে জিজ্ঞাসা করল, আজকে আসবার সময় কর-বাড়ির দিকে তাকাসনি অনি ঘাড় নেড়ে না বলল। তপন বলল, মুভিং ক্যাসেল পায়চারি করছিল বারান্দায়। মণ্টু বলল, জানলার ফাঁক দিয়ে রম্ভার চোখ দুটো তো দেখিসনি তোরা, আহা। তখনই বুঝতে পেরেছিলাম আমাকে আজ অন্যরকম দেখাচ্ছে। ওদের স্কুলের উলটোদিকে যে বিরাট বাড়িটা অনেকখানি গান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেটা এখানকার মিউনিসিপ্যালিটি অন্যতম কর্তা শ্রীবিরাম কর মহাশয়ের। মণ্টু একদিন ওকে দেখিয়েছিল বাড়ির গেটের গায়ে ওঁর নামের আগে কে যেন অ অক্ষরটা লিখে গেছে। মানেটা ঠাওর করতে পারেনি প্রথমটায়। মণ্টু বলেছিল, তুই একটা গাড়ল। নতুন স্যারের চ্যালা হয়ে বন্ধু রয়ে গেলি। তারপর মুখ-খারাপ করে কথাটার মানে বুঝিয়ে দিয়েছিল। কানটান লাল হয়ে গিয়েছিল অনিমেষের। অথচ মণ খারাপ ছেলে ভাবতে পারে না। ক্লাসে যে-কোনো প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক দেয়। অ্যানুয়েল পরীক্ষার সময় ইচ্ছে করে দুটো উত্তর না-লিখে ছেড়ে দেয় যাতে ফার্স্ট না হতে পারে। নতুন স্যার কারণটা জিজ্ঞেস করাতে ও বলেছিল, ফার্স্ট হলে ঝামেলা। ক্লাসের ক্যাপ্টেন হতে হয়, সবাই গুড বয় ভাবে। সবই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল। নতুন স্যারও। মণ্টু যেসব খারাপ কথা জানে, অনিমেষ তা জানে না। সেইজন্যে মণ্টু ওর চেয়ে যেন এক হাত এগিয়ে আছে। তপনটা মুখে কিছু বলে না। কিন্তু মণ্টুর সব ইঙ্গিত ও চটপট বুঝতে পারে। আলাউদ্দিন খিলজির চিতোর আক্রমণটা ক্লাসে পড়ানো হয়ে গেলে তপন আর মণ্টু দুজনে মিলে দেবলাদেবীর নাচ ওদের দেখাল। নাচটা দেখতে খুব বিশ্রী, তপন মেয়েদের, ঢং করে দেবলাদেবী। সাজছিল আর মণ্টু আলাউদ্দিন খিলজি। নাচ শেষ হলে মণ্টু বিজ্ঞের মতো জিজ্ঞাসা করেছিল, পৃথিবীতে সবচেয়ে আরাম কিসে পাওয়া যায়? কে যেন বলেছিল, ঘুমুতে সবচেয়ে আরাম। পেটুক অজিত বলেছিল, খুব পেটভরে রসগোল্লা খেতে দারুণ আরাম। তপনের মাথা নেড়ে বলেছিল, ধুস! একবার খেলার মাঠে আমার পেট কামড়েছিল। উঃ, কী যন্ত্রণা! দৌড়ে বাড়ি ফিরছি, কপালে ঘাম জমে যাচ্ছে। তারপর একসময় আর পা যেন চলতে চায় না। যখন ল্যাটিন থেকে বেরিয়ে এলাম, ওঃ, তখন এত আরাম এত হারকা লাগল-এরকম আরাম হয় না। তপনের বলার ভঙ্গিতে ব্যাপারটা এত জীবন্ত ছিল সবাই যেন বুঝতে পেরে একমত হয়ে গেল। কিন্তু মণ্টু বলল, তপন অনেকটা ঠিক কথা বলেছিস কিন্তু পুরো নয়। আচ্ছা অনিমেষ, ট্রয়ের যুদ্ধটা কার জন্য হয়েছিল? হেলেনের জন্য। তপর উত্তরটা দিয়ে দিল। লঙ্কাকাণ্ড? সীতার জন্য। উত্তরটা অনেকগুলো মুখ থেকে বুলেটের মতো ছুটে এল। আলাউদ্দিন খিলজি কেন চিতোর আক্রমণ করেছিল? পদ্মনীর জন্য। সবাই হেসে উঠতেই মণ্টু সেই বিজ্ঞের হাসিটা হেসে হাত তুলে ওদের থামাল, আমরা কেন মুভিং ক্যাসেলকে মাসিমা বলে ডাকি, এবার কিন্তু কোনো শব্দ হল না, চট করে উত্তরটা খুঁজে না পেয়ে এ ওর মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। শুধু তপন খিকখিক করে হেসে উঠল। অনি বুঝতে পারছিল না এর সঙ্গে আরামের কী সম্পর্ক। মুভিং ক্যাসেল হল বিরাম কর মশাই-এর স্ত্র। গোলগাল লম্বা এবং প্রচণ্ড ফরসা মহিলা। বাংলায় বলা হয় চলন্ত দুর্গ, পেছন থেকে দেখলে মনে হয় ওঁর শরীরের মধ্যে অনেকে লুকিয়ে থাকতে পারে। দারুণ সাজেন মহিলা, ওর মেয়েরাও টিক পাত্তা পায় না। জলপাইগুড়ি শহরের মেয়েরা। খুব একটা উগ্র নয়, বরং স্কুলগুলোর সুবাদে একটা গোড়া রক্ষণশীল ভাব বজায় আছে। অবশ্য ইদানীং বাইরের কিছু মেয়ে আসার পর হাওয়া বদলাতে শুরু করলেও দেখলেই বোঝায় যায় কে বাইরের! সেক্ষেত্রে মিসেস বিরাম কর যাকে সবাই মুভিং ক্যাসেল বলে সত্যিই ব্যতিক্রম। গায়ের রঙ ফরসা বলেই হাতকাটা লাল সরু রাউজ: যে ওকে মানাবে একথা ওঁর চেয়ে বেশি কেউ জানে না। অনি পেছনথেকে ওঁর রিকশায় চলে-যাওয়া শরীর দেখে একদিন ভেবেছিল বোধহয় চাপ-চাপ মাখন দিয়ে ওঁকে তৈরি করা হয়েছে। বিরাম কর মহাশয়ের নাম ছেলেরা রেখেছে ফড়িংদা। মণ্টু বলে ওর দাদা। নাকি
false
shottojit_roy
মধ্যে আছে। সাবাটিনি ধরা গলায় বলল, সোনা তৈরির ফরমুলা আছে তোমাদের কাছে? নিশ্চয়ই। না হলে তৈরি হয় কী করে? ক্রোল বলল, আমাদের তো একদিন না একদিন দেশে ফিরে যেতে হবে; তখন তো আমাদের এই অভিজ্ঞতার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। তোমাদের অন্তত একজন প্ৰাণীকে কি আমরা সঙ্গে নিয়ে যেতে পারব না? অল্প কয়েক দিনের জন্য? তারপর আবার তাকে ফেরত দিয়ে যাব। এবারে একটা হাসির শব্দ পাওয়া গেল। তারপর কথা এল— সে যদি তোমাদের সঙ্গে যায়, তা হলে ফেরার কোনও সমস্যা নেই। যানবাহন ছাড়া চলাফেরা করার উপায় আমরা প্রথম থেকেই জানি। তা হলে তোমাদের একজনকে দেবে আমাদের সঙ্গে? বললাম তো—তার আকৃতি তোমরা সহ্য করতে পারবে না। সে আকৃতি তোমরা বদলাতে পারবে না? এত কিছু পার, এটা পারবে না? কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা। তারপর কথা এল— আমাদের দুদিন সময় দাও। আজ বিদায়। যেভাবে এসেছি তোমরা সেভাবেই ফিরে যেতে পারবে। ক্রোল বলল, কিন্তু একটা কথা তো জানা হয়নি। কী? আমরা যেমন মানুষ, তেমনি তোমাদের নাম কী? সে নাম তোমাদের জিভে উচ্চারণ হবে না। তা হলে ফিরে গিয়ে তোমাদের কী নামে উল্লেখ করব? দু সেকেন্ড পরে উত্তর এল: অটোপ্লাজম। আর এই শহরের নাম? নোভোপলিস বলতে পার। এবারে আমার একটা বলার ছিল, সেটা বলে নিলাম। প্রথমে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের এখানে ব্যারাম নেই? না। তার মানে কোনও ওষুধও নেই? না। কিন্তু ব্যারামের সম্ভাবনা নেই সেটা কী করে বলছ? এর পরে যখন আসব। তখন আমার তৈরি ওষুধ মিরাকিউরলের বেশ কিছু বড়ি সঙ্গে করে এনে এই টেবিলের উপর রেখে দেব। যদি ব্যারাম হয়, তা হলে সেটা খেলে সেরে যেতে বাধ্য। আমি অবশ্য ক্রিস্টোবাল্ডির ভবিষ্যদ্বাণীর কথাটা ভেবেই এটা বললাম। এরপরে আমরা গোলাঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। এরা এয়ারকন্ডিশনিংটা ভালই রপ্ত করেছে, কারণ মাটির নীচে হলেও আমরা অতি আরামদায়ক ঠাণ্ডা উপভোগ করেছি। সিঁড়ির কাছে এসে দেখি, সেটা এখন নীচ থেকে উপর দিকে যাচ্ছে। বিচিত্ৰ মনোভাব নিয়ে আমরা ক্যাম্পে ফিরলাম। সাবাটিনি বলল, এখনও কিন্তু প্ৰমাণ পাওয়া যায়নি যে, এরা মানুষ নয়। সেটা অবশ্য ঠিক, বলল ক্রোল। এরা সবটাই মিথ্যে বলে থাকতে পারে। খাদ্যের সমস্যা এরা কীভাবে সমাধান করেছে। সেটা অবিশ্যি বোঝা গেল না। কিন্তু কৃত্রিম উপায়ে মাটির নীচে গাছপালা ফুল ফল সবই গজানো যায়। আর সোনার ব্যাপারটা? সুমা জিজ্ঞেস করল। সাবাটিনি একটা বিদ্যুপের হাসি হেসে উঠল। তুমি কি বিশ্বাস করলে ওই চেয়ার টেবিল সোনার তৈরি? গোল্ড হ্যাজ এ স্পেশাল কাইন্ড অব ম্মেল, বলল সুমা। আমি চেয়ার টেবিল থেকে সে গন্ধ পেয়েছি। হোয়াট! সোনার গন্ধ! আমি এমন কথা কস্মিনকালেও শুনিনি। আমি জানি। আমি জেনেশুনেই বলছি, ঈষৎ রাগতভাবে বলল সুমা। আমি দুজনকে ঠাণ্ডা করলাম। তারপর বললাম, এরা মানুষই হোক আর নতুন প্রাণীই হোক, এরা যখন একশো বছর আগে লেসার রশ্মি আবিষ্কার করেছে, তখন এদের বিজ্ঞান যে অন্য মানুষের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর সেটা স্বীকার করতেই হবে। অক্টোবর ৬ আজ আমাদের অটোপ্লাজমদের ব্যাপারে কিছু করার নেই। আগামীকাল ওরা কী স্থির করল সেটা জানতে পারব। আমরা পাঁচজনে লোগোস খেলে আর সমুদ্রে স্নান করে সময় কাটালাম। আমার মন কিন্তু বলছে এরা মানুষ নয়, এবং এরা যা বলছে তা সবই সত্যি। সন্ধ্যায় যথারীতি লেসারস্তম্ভ জ্বলে উঠল। আমরা এদের কাছ থেকে কোনওরকম খবর বা বিবৃতি আশা করছিলাম না, কিন্তু আলোকস্তম্ভ জ্বলার একটু পরেই পরিচিত কণ্ঠে ঘোষণা শুনলাম। কাল আলো জ্বলার আধঘণ্টার মধ্যে তোমরা চলে এসো। যেমনভাবে এসেছিলে তেমনভাবেই আসবে, যে ঘরে বসেছিলে সে ঘরেই বসবে। কী সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটা তখনই বলব। ঘোষণা বন্ধ হবার পর ক্রোল বলল, এমনও তো হতে পারে যে আমাদের দেশের কিছু বিজ্ঞানী দেশে আমল না পেয়ে জেদের বশে এখানে এসে ডেরা বেঁধেছে? কিন্তু দেখলে তো এসক্যালেটর? বলল সন্ডার্স। এইসব জিনিস তৈরি করার জন্য তো নানারকম ধাতু, লোকজন, যন্ত্রপাতি ইত্যাদির প্রয়োজন। এসব এরা পেল কী করে? ইচ্ছাশক্তির কথাটা ভুলো না সন্ডার্স? আমি মনে করিয়ে দিলাম। সত্যিই যদি এদের তেমন উইলপাওয়ার থাকে, তা হলে তার জোরে অনেক কিছুই সম্ভব। দেখা যাক এরা কাল কী বলে, বলল সুমা। অক্টোবর ৭ সন্ধ্যাবেলা লেসার রশ্মিটা কখন জ্বলে তার একটা আন্দাজ হয়ে গিয়েছিল আমাদের। আজ তাঁর আধঘণ্টা আগে রওনা হয়ে পৌঁছোবার ঠিক আগেই আলোকস্তম্ভটা জ্বলে উঠল। তারপর কণ্ঠস্বর শোনা গেল : তোমরা চলে এসো। আমরা চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে নেমে আবার সেই গোলাঘরে গিয়ে হাজির হলাম। কী স্থির করলে? প্রশ্ন করল ক্রোল। আমাদের একজন লোক তোমাদের সঙ্গে দেব। তার আকৃতি হবে মানুষের মতো। পোশাকেও তোমাদের সঙ্গে কোনও তফাত করা যাবে না। কেবল বুদ্ধি হবে ওর আটোপ্লাজমের মতো। ও কি ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করতে পারবে? না; কারণ একজনের ইচ্ছাশক্তিতে কোনও ফল হয় না। তোমাদের জন্য চলন্ত সিঁড়িটা তৈরি করতে আমাদের পঞ্চাশজনের উইলপাওয়ার দরকার হয়েছিল। তা হলে তো আর বেশিদিন এখানে থেকে লাভ নেই বলল সন্ডার্স। আমরা পরশুই সকালে বেরিয়ে পড়তে পারি। কাল তোমরা তা হলে এই সময়েই এসো। ঠিক আছে। অক্টোবর ৯ আমরা আজ সকাল সাড়ে আটটায় রওনা হচ্ছি। চটপট কালকের ঘটনাটা বলে নিই। কাল সন্ধ্যায় আবার সেই গোলাঘরে গিয়ে পৌঁছোতে কথা শোনা গেল। তোমরা যেই পথ দিয়ে এলে, সেই পথ দিয়েই আমাদের প্রতিভূ। তোমাদের কাছে
false
shordindu
হইতে স্ত্রী-প্রহরীর এলাকা আরম্ভ হইয়াছে। প্রহরিণীদ্বয় অর্জুনবর্মাকে উত্তমরূপে নিরীক্ষণ করিল, রক্ষীকে প্রশ্ন করিল, তারপর পথ ছাড়িয়া দিল। রক্ষী নীচেই রহিল, অর্জুনবর্মা সঙ্কীর্ণ সোপান দিয়া উপরে উঠিতে লাগিল। সোপান মধ্যপথে মোড় ঘুরিয়া গিয়াছে, মোড়ের কোণে অন্য একজন প্রহরিণী দাঁড়াইয়া আছে। তাহাকে অতিক্রম করিয়া অর্জুনবর্মা দ্বিতলে উঠিল। এখানে আরো দুইজন প্রহরিণী। তাহারা জানিত, অর্জুনবর্মা নামক এক ব্যক্তিকে রাজা আহ্বান করিয়াছেন; তাহাদের মধ্যে একজন অর্জুনকে রাজ-সমীপে উপনীত করিল। রাজকক্ষটি আকারে যেমন বৃহৎ, উচ্চ দিকে তেমনি গোলাকৃতি ছাদযুক্ত; মুসলমান স্থাপত্যের প্রভাবে ভবনশীর্ষে গম্বুজ রচনার রীতি প্রচলিত হইয়াছিল। দেয়ালগুলি পুরু রেশমের কানাৎ দিয়া আবৃত; তাহার ফলে কক্ষটি দ্বিপ্রহরেও ঈষৎ ছায়াচ্ছন্ন ও নিরুত্তাপ হইয়া আছে। কক্ষের মধ্যস্থলে মণিমুক্তাজড়িত মর্মর-পালঙ্কে মহারাজ দেবরায় অর্ধশয়ান রহিয়াছেন। তাঁহার মাথার দিকে মসৃণ শিলাকুট্টিমের উপর বসিয়া মন্ত্রী লক্ষ্মণ মল্লপ কোনো দুরূহ চিন্তায় মগ্ন আছেন। পায়ের কাছে মেঝেয় বসিয়া পিঙ্গলা পান সাজিতেছে এবং মৃদুকণ্ঠে রাজাকে নবাগতা কলিঙ্গ কুমারীদের কথা শুনাইতেছে।…রাজকুমারীরা স্নানাহার সম্পন্ন করিয়া বিশ্রাম। করিতেছেন…কন্যা দুটি যেমন সুন্দরী তেমনি শীলবতী…প্রথমটি একটু গম্ভীর প্রকৃতির, দ্বিতীয়টি সরলা হাস্যময়ী… পিঙ্গলা সোনার তাম্বুলকরঙ্ক দুই হাতে রাজার সম্মুখে ধরিল। রাজা একটি পান তুলিয়া মুখে দিলেন, বলিলেন—তুমি পান নাও, আর্য লক্ষ্মণকেও দাও। রাজার সম্মুখে তাম্বুল চর্বণ পুরুষের পক্ষে নিষিদ্ধ ছিল, তবে অনুমতি দিলে খাওয়া চলিত। স্ত্রীলোকের পক্ষে কোনো নিষেধ ছিল না, এমন কি নর্তকীরাও রাজার সম্মুখে পান খাইত। লক্ষ্মণ মল্লপ পানের বাটা লইয়া নিজের সম্মুখে রাখিলেন, তারপর শঙ্কুলা লইয়া নিপুণ হস্তে সুপারি কাটিতে লাগিলেন। পিঙ্গলা বাটা হইতে একটি পান লইয়া মুখে পুরিল। এই সময় অর্জুনবর্মা দ্বারের নিকট আসিয়া দাঁড়াইল এবং শিক্ষানুযায়ী যুগ্মবাহু তুলিয়া রাজাকে বন্দনা করিল। রাজা তাহাকে কক্ষের মধ্যে আহ্বান করিলেন, সে আসিয়া পালঙ্কের সমীপে ভূমির উপর পা মুড়িয়া বসিল। তাহার মেরুদণ্ড ঋজু হইয়া রহিল, দেহভঙ্গিতে দীনতা নাই, আবার ঔদ্ধত্যও নাই। রাজা পিঙ্গলাকে ইঙ্গিত করিলেন, সে পাশের একটি কানাৎ-ঢাকা দ্বার দিয়া বাহিরে চলিয়া গেল। কক্ষে রহিলেন রাজা, লক্ষ্মণ মল্লপ এবং অর্জুনবর্মা। লক্ষ্মণ মল্লপ শঙ্কুলায় কুচকুচ শব্দ করিয়া সুপারি কাটিতেছেন, যেন অন্য কিছুতেই তাঁহার মন নাই। রাজা নিবিষ্ট চক্ষে অর্জুনকে দেখিলেন, তারপর শান্ত কণ্ঠে বলিলেন—তোমার নাম অর্জুনবর্মা? অর্জুন ইতিপূর্বে দূর হইতে মহারাজ দেবরায়কে একবার দেখিয়াছিল, এখন মুখোমুখি বসিয়া সে তাঁহার পরিপূর্ণ অনুভাব উপলব্ধি করিল। রাজা দেখিতে শান্তশিষ্ট, কিন্তু তাঁহার একটি বজ্রকঠিন ব্যক্তিত্ব আছে যাহার সম্মুখীন হইলে অভিভূত হইতে হয়। অর্জুন যুক্তকরে বলিল—আজ্ঞা, মহারাজ। রাজা বলিলেন—তুমি ক্ষত্রিয়। রাজকন্যাদের নৌকায় যোদ্ধা রূপে এসেছ? অর্জুন বলিল—আমি রাজকন্যাদের সঙ্গে কলিঙ্গ থেকে আসিনি মহারাজ। রাজা ঈষৎ বিস্ময়ে বলিলেন—সে কি রকম? অর্জুন তখন গুলবগা ত্যাগের বিবরণ বলিল। রাজা শুনিলেন; লক্ষ্মণ মল্লপ শঙ্কুলা থামাইয়া অর্জুনের মুখের উপর সন্ধানী চক্ষু স্থাপন করিলেন। বিবৃতি শেষ হইলে রাজা বলিলেন—চমকপ্রদ কাহিনী! তোমার পিতার নাম কি? অর্জুনবর্মা বলিল—আমার পিতার নাম রামবর্মা। রাজা একবার মন্ত্রীর দিকে অলসভাবে চক্ষু ফিরাইলেন, লক্ষ্মণ মল্লপের শঙ্কুলা আবার সচল হইল। রাজা বলিলেন—ভাল। সংবাদ পেয়েছি কাল ঝড়ের সময় তুমি রাজকন্যাকে নদী থেকে উদ্ধার করেছিলে। তুমি উত্তম সন্তরক, কিভাবে রাজকুমারীকে উদ্ধার করলে আমাকে শোনাও। রাজার এই জিজ্ঞাসার মধ্যে অর্জুন কোনো কূট উদ্দেশ্য দেখিতে পাইল না, সে সরলভাবে রাজকন্যা উদ্ধারের বৃত্তান্ত বলিল। তাহার মনে পাপ ছিল না, তাই কোনো কথা গোপন করিল না; নিজের কৃতিত্ব যথাসম্ভব লঘু করিয়া বলিল। রাজা ও মন্ত্রী তাহার মুখের উপর নিশ্চল চক্ষু স্থাপন করিয়া শুনিলেন। বৃত্তান্ত শেষ হইলে রাজা কিছুক্ষণ প্রীতমুখে নিজ কর্ণের মণিকুণ্ডল লইয়া নাড়াচাড়া করিলেন, তারপর বলিলেন—তোমার কাহিনী শুনে পরিতুষ্ট হয়েছি। তোমার সৎসাহস আছে, বিপদের সম্মুখীন হয়ে তোমার বুদ্ধি বিক্ষিপ্ত হয় না। তুমি বিজয়নগরে বাস করতে চাও, ভাল কথা। কোন্ কাজ করতে চাও? অর্জুন জোড়হস্তে বলিল—মহারাজ, আমি ক্ষত্রিয়, আমাকে আপনার বিপুল বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করে নিন। রাজা বলিলেন—সৈন্যদলে যোগ দিতে চাও? ভাল ভাল। কিন্তু বর্তমানে তুমি কলিঙ্গ-সমাগত অতিথিদের অন্যতম। আপাতত বিজয়নগরের রাজ-আতিথ্যে থেকে আহার-বিহার কর। তারপর তোমার ব্যবস্থা হবে। এই স্বর্ণমুদ্রা নাও। তুমি রাজকুমারীর প্রাণরক্ষা করেছ, তোমার প্রতি আমি প্রসন্ন হয়েছি। রাজার পালঙ্কের উপর উপাধানের পাশে এক মুষ্টি স্বর্ণমুদ্রা রাখা ছিল; ছোট বড় অনেকগুলি স্বর্ণমুদ্রা। রাজা একটি বড় মুদ্রা লইয়া অর্জুনকে দিলেন, অর্জুন কপোতহস্তে গ্রহণ করিল। রাজা বলিলেন—আর্য লক্ষ্মণ, অর্জুনবর্মাকে পান দিন। লক্ষ্মণ মল্লপ বাটা হইতে অর্জুনকে পান দিলেন। অর্জুন জানে না যে পান দেওয়ার অর্থ বিদায় দেওয়া, সে পান মুখে দিয়া ইতস্তত করিতে লাগিল; স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া রাজসকাশ হইতে চলিয়া যাওয়া উচিত হইবে কিনা ভাবিতে লাগিল। লক্ষ্মণ মল্লপ তাহা বুঝিয়া হাতে তালি বাজাইলেন। প্রহরিণী দ্বারের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। মন্ত্রী বলিলেন—অর্জুনবর্মাকে পথ দেখাও। অর্জুন তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইল, পূর্বের ন্যায় উদ্বাহু প্রণাম করিয়া প্রহরিণীর সঙ্গে বাহিরে। চলিয়া গেল। রাজা ও মন্ত্রী কিছুক্ষণ আত্মস্থ হইয়া বসিয়া রহিলেন; কেবল মন্ত্রীর হাতের যন্ত্রিক কুচকুচ শব্দ করিয়া চলিল। অবশেষে রাজা লক্ষ্মণ মল্লপের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিপাত করিলেন। লক্ষ্মণ মল্লপ মাথা নাড়িয়া বলিলেন—কুমার কম্পন তিলকে তাল করেছেন। অর্জুনবর্মার মন নিষ্পাপ, সুতরাং রাজকন্যাও নিষ্পাপ। রাজা কহিলেন—আপনি যথার্থ বলেছেন, আমারও তাই মনে হয়। কম্পন ছেলেমানুষ, রজ্জুতে সর্পভ্রম করেছে। কিন্তু তবু বিবাহোম্মুখী কন্যাকে পরপুরুষ স্পর্শ করেছে, এ বিষয়ে শাস্ত্রের বিধান যদি কিছু থাকে– মন্ত্রী বলিলেন—উত্তম কথা। গুরুদেবের উপদেশ নেওয়া যাক। অতএব রাজগুরু আর্য কূর্মদেবকে রাজার প্রণাম পাঠানো হইল। কূর্মদেব একটি তৃণাসন হস্তে উপস্থিত হইলেন। শীর্ণকায়
false
tarashonkor
হল। জীউটা বেরিয়ে গেলে খালাস পায়। তা কি সে সহজে যায়? অ্যানেক এতে আঁধারের মধ্যে কখন যে জীউটা বেরিয়ে গেল, তা বুঝতে পারলাম। —আটপৌরেদের একজন মরেছে—এই যে গো—বেশ নামটি। কিন্তু কিছুতেই মনে থাকে না। পাগল বললে–বিশ্বামিত্ত। –হ্যাঁ, হ্যাঁ। বিশ্বামিত্ত। ‘বিশ্বামিত্ৰ’ নামটি নসুর মনে থাকে না। বিশ্বামিত্রের বাবা যাত্রায় পালাগান দেখে ওই নাম রেখেছিল ছেলের। বিশ্বামিত্ৰ মরেছে জ্বরে। তারপর এর ওর ছেলে মরেছে, কচিকাঁচা মরেছে—সে ধর্তব্যের মধ্যে নয়। নসু বললে— পায়ের হাতের আঙুলে গোনা যায় না ব্যানোকাকা, হিসেব দোব কি? একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ বলে উঠল—আর তোমার নিমতেলে পানার হয়েছে জেল। আহা! পানকেষ্ট কদমতলায় বিহার করতে যেয়ে গেল জেলখানাতে। —জেল? –হ্যাঁ, জেল। নসু খুব রঙ দিয়েই বললে–যেমন জেলাপির পাক বুদ্ধি, তেমনি ফল। মনিবের সঙ্গে হিসেব নিয়ে ঝগড়া হল। পানু আমার পানকেষ্ট; মনিবের শোধ নিতে–মনিবের উপো-বাঁধানো হুঁকো চুরি করেছিল। পানার মনিবকে তো জান! পেকো মোড়ল নাম! কাজেও পেকো মোড়ল! পাগল বললে–ধরা পড়ত না ছোঁড়া। ধরা পড়ল পরিবারের টানে। ধরিয়ে দিলে করালী। পুলিশে খবর দিয়েছিল পেকো মণ্ডল। পানু তখন লুকিয়ে পড়েছে। কোথা যে লুকিয়ে থাকত কেউ জানত না। রাত্তে এসে ঘরে চারটি করে খেয়ে যেত। তুমি তখন শয্যাশায়ী অজ্ঞান, করালী বুক ফুলিয়ে আসে যায়; ছোঁড়া এখন পানার পরিবারকে নানা রকম লোভ দেখাতে লাগল। বলে— চন্ননপুরে চল, খাটবি খাবি। ভাল কাজ করে দেব আমি। সেই লোভে মেয়েটা স্বীকার করলে রাত্রে পানা এসে খেয়ে যায় বাড়িতে। করালী শুনে রাত্রে তত্ত্বে তত্ত্বে ছিল—ধরলে একদিন চেপে। দিয়ে দিলে পুলিশে। পানা বলে গেল কি জান? বললে—যাক, কিছুদিন এখন নিশ্চিন্দি। নসু বললেপানার বউ এখন চন্ননপুরে আঙামুখো সাহেবের উড়োজাহাজের আস্তানায় খাটে। খাটুনি না মাথা! ওজকার খুব; ফেশান কি? বনওয়ারী উদাস হয়ে চেয়ে রইল। চোখ গিয়ে পড়ল তার চন্ননপুরের রাঙা পাকা পথের উপর। রাস্তাটা ঝকঝাক তকতক করছে। ওই পথে সব ছুটে যায় চন্ননপুরে খাটুনি খাটতে। পাঁচ সিকে দেড় টাকা মজুরি। যারা আবার রেলের তেরপল-ঢাকা-মালগাড়িতে লাইনের কাজে সেইখানেই দিনরাত্রি থাকে, তারা পায় বেশি। কয়লা পায়, রেলের লোকেরা কম দামে চালডাল দেয়। হঠাৎ বনওয়ারী পাগলের মুখের দিকে চেয়ে বললে—পাগল, কুলকম সবাই ছাড়লে? অতন, গুপী, পেল্লাদ–সবাই? কথার উপরেই কথা দিয়ে জবাব দিলে নসুবালা—সবাই সবাই সবাই। কেউ বাকি। নাই। মেয়ে-পুরুষ সব চন্ননপুরে ছুটছে ভোর না হতে। সময় নাই। রবকাশ নাই। কি করবে বল? পেটের দায়। পাগল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেওদর, পেট-বনওয়ারী, উনিই সব। নসুবালা বললে—মরে যাই। শুধু ওদর? লোভ পাপ, বুয়েচ ব্যানোকাকা, পাপ! পিথিমীতে পাপের ভারা ভরতে আর বাকি নাই। একটি নোক দেখলাম না যে ধম্মের মুখ তাকায়। ঘোষেরা–তোমার এতকালের মনিব, ভাগের জমি ছাড়িয়ে নিলে। সায়েবডাঙায় জমি, তুমি উইকে এক পিঠ উঁইকে এক পিঠ দিয়ে ভাঙলে। চন্ননপুরের বাবু তা সব কেড়ে নিলে। পাগলমামা যেয়েছিল একবার বাবুদের ঠেনে, তা— বনওয়ারী পাগলের মুখের দিকে চেয়ে বললে—পাগল! পাগল মাটি খুঁটতে খুঁটতে বললে—“যেয়েছে, সেসব যেয়েছে, ভাই। বাবুরা এক ছটাক ভাগ। দিলে না। বনওয়ারীর কাছে পিতিপুরুষের আমল থেকে যে জমি ভাগ দিয়েছিল, ঘোষেরাও তা ছাড়িয়ে নিয়েছে। বনওয়ারী হাসলে। যাক, সর্বস্বান্ত হয়েছে তা হলে। নিশ্চিন্ত। অনেকক্ষণ পর বনওয়ারী বললে, নিজের কথা বাদ দিয়ে কাহারদের কথাই বললে—তা লোকে কারখানায় গিয়ে ভালই করেছে। দোষ দেবার কিছু নাই। নসুবালা বলে গেল-দুর্দশার দিনে করালী ওদের ডাকলে। নিয়ে গেল চন্ননপুরের রেলের কারবারে কারখানায়। কাজ দিলে। সব সুড়সুড় করে চলে গেল। তোমার এত বড় ব্যামো গেল, কেউ খোজও করলে না। বনওয়ারী হাসলে–তা না করুক। নসু বললে না এলে দুঃখ হয় বৈকি! দুঃখ হয় না? পাগল হেসে বললে দুঃখ করেই-বা কি করবে বুন? বনওয়ারীর হাত-পায়ের ডগাগুলি ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। নসু বললে আমি শুধু যাই নাই। ব্যানোকাকা, ওই মুখপোড়া করালীর উপর ঘেন্নায় লজ্জায় যাই নাই। যত ভালবাসতাম তাকে, তত বিষ হয়েছে তার উপর। ছিছিছি! লজ্জায় মরে যাই! সে আবার সেপাইদের মতন পোশাক পরে আজকাল বলে—মেলেটারি! জুতো পরে, টুপি মাথায় দেয়। নসুবালা বলে যায় করালীর লজ্জাকর ঘৃণাৰ্হ কীর্তিকলাপের কথা। বনওয়ার কয়েকদিন তখন শয্যাশায়ী, এখন-তখন অবস্থা, সেই সময় একদিন সকালে দেখা গেল, সুবাসী নাই। সুবাসী তার আগের দিন বনওয়ারীর চিকিৎসার খরচের অজুহাতে গরু-বাছুরগুলি বিক্রি করেছিল। সেও টাকাকড়ি সব নিয়ে বনওয়ারীকে ফেলে গভীর রাত্রে অদৃশ্য হল। দুপুর নাগাদ খবর এল, সুবাসী চন্ননপুরে করালীর বাসায়। বনওয়ারীকে ‘মামা’ বলত করালী। সম্পর্ক। বাছলে নাছি-ছিছি! রোগা মানুষ বনওয়ারী, মেয়েটা চলে গেলে তার কি হবে, সে কথাও একবার ভাবলে না। নিষ্ঠুর হৃদয়হীন ঘৃণাৰ্হ করালী। শুধু গায়ের জোরে, রক্তের তেজে, আর রোজগারের গরমে ধর্মকে পায়ে মাড়িয়ে গেল, রীতি-ব্যবহারকে ফু দিয়ে উড়িয়ে দিলে। থুতু দিলে, ছি! ছি! বনওয়ারী মাটির দিকে চেয়ে রইল স্থির দৃষ্টিতে। না বললেও সে এ কথা মনে মনে বুঝেছিল। তার অন্তর বলে দিয়েছিল—সুবাসী যখন পাশে নাই, ঘরে নাই, তখন করালী তাকে নিয়ে গিয়েছে। হাসতে হাসতে কালোবউয়ের মত রঙ্গ করে করালীর সঙ্গে গিয়েছে, সে তা জানে। যাবেই—এই নিয়ম। হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় এই কথাটি পুরনো কথা। পাগল হাসলে, ঘাড় নাড়লে, সেও জানে হাঁসুলী বাঁকে এই নিয়ম। ন চোখ মুছছিল, চোখ মুছে সে আবার বললে—বলব কি ব্যানোকাকা, পাখীর মত মেয়ে, তার মুখের দিকেও চাইলে না সে। পাখী আঃ কি বলব ব্যানোকাকা—‘চোখ গেল পাখি যেমন ‘চোখ গেল’ বলে ডেকে সারা
false